বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩১শে জুলাই, বুধবার, ১৪ই শ্রাবণ, ১৩৮১
ভাড়া বাড়লেও দুর্ভোগ কমেনি
এখন রেল পরিবহনের মাধ্যমে যাত্রীসাধারণ রীতিমতো উৎকণ্ঠিত। কারণ একটি দুটি নয় বহু। মারাত্মক কারণটি হলো নিরাপত্তার অভাব। শুধু ট্রেন দুর্ঘটনাই নয় ভয়াবহ ট্রেন ডাকাতি হচ্ছে গড়ে প্রতি মাসে প্রায় ৩টি। পত্রিকান্তরের বিশেষ প্রতিবেদনে এই পরিসংখ্যান পরিবেশিত হয়েছে। এবং চলতি মাসেই পাঁচটি ট্রেন ডাকাতি হয়েছে শুধু ঢাকাসহ দেশের পূর্বাঞ্চলে। এসব ডাকাতিতে ১ জন নিহত এবং মহিলাসহ ৭ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।
ট্রেন ডাকাতের ব্যাপারে রেলপুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা রেল কর্তৃপক্ষের সহযোগিতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে। তাদের অভিযোগ হলো স্বাধীনতার পর থেকে রেল কর্তৃপক্ষ রেলবগীগুলিতে বাতি সরবরাহ করতে পারেননি। ফলে দুস্কৃতিকারীরা অবাধে অন্ধকারের রাজ্যে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যেতে পারছে। রেল কর্তৃপক্ষ আবার পাল্টা অভিযোগ করে বলেন যে, প্রতিটি গাড়িতে সশস্ত্র রক্ষী মোতায়েন থাকা সত্ত্বেও ট্রেন ডাকাতি বেড়ে যাচ্ছে। স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে, পারস্পরিক অভিযোগ বিনিময় করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছেন। এতে যাত্রীসাধারণের কোনো লাভ লোকসান নেই। রেলের বগি গুলোতে বাতি নেই একথাও যেমন সত্য রেলে ভয়াবহ এবং মর্মান্তিক ডাকাতি হচ্ছে, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে এবং যাত্রীসাধারণ আতঙ্কিত হচ্ছে -একথাও তেমনি সত্য। দোষ যে কোন কর্তৃপক্ষের এই থাকনা কেন ভোগান্তিতে সাধারণ যাত্রীদের। সেইটে অতীব দুঃখজনক।
যাত্রীদের তরফ থেকেও কিছু অভিযোগ আছে। তাদের বক্তব্যের সূত্র দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রেলে বন্দুকধারী পুলিশ থাকে ঠিকই তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের হাতে কোনো টর্চলাইট থাকে না। তাছাড়া চলন্ত ট্রেন নাকি যেখানে সেখানে হঠাৎ থেমে পড়ে। এবং এর কারণ বয়স্ক ইঞ্জিনের যান্ত্রিক ব্যাধি। হয়তো সঙ্ঘবদ্ধ দুষ্কৃতিকারীদের তরফ থেকে চেন টানার জন্য কখনো কখনো ট্রেন থেমে যায় বলে ভুক্তভোগী রেলযাত্রীদের অনুমান।
এছাড়াও রেলযাত্রীদের অভিযোগে জানা যায় যে, রেলে পানি থাকেনা প্রায়শঃই। দূরপাল্লার যাত্রী হলে সে যে কত বড় ভোগান্তি তা বলাই বাহুল্য। বসার বন্দোবস্তও তথৈবচ। বগীর সংখ্যা কম, আসনগুলো নোংরা, আসন নির্ধারণ করে রাখার বা রিজার্ভ করে রাখার যো নেই। গায়ের জোরে সবাই যেখানে সেখানে বসে যায় অথচ টিকিটধারী ব্যক্তি বসার জায়গা পায়না। রেলের ছাদে হতভাগা যাত্রীদের ভিড় তো আমরা নিত্য নিয়ত চোখে দেখছি। অন্ততঃ একথা সত্যি যে, বসার জায়গা পেলে কেউ ছাদে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসতো না!
রেলের সময় বলতে কোন ব্যাপার আর আছে বলে শোনা যায় না। প্রয়োজনমতো চেন টেনে নেমে যাওয়ার দৃষ্টান্তও প্রচুর। তারপর লাইন পরিষ্কার সিগন্যাল সময়মতো না পাওয়ার জন্য রেল চলাচলে বিলম্ব ঘটে। তার উপর প্রতিটি স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা বড়ই দুর্বল। ফলে মাঝপথে ট্রেন থেমে থাকলে বা দুর্ঘটনায় পড়লে অথবা ডাকাতের কবলে পড়লেও স্টেশন থেকে তড়িৎ সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায়ই থাকেই না।
এরই প্রেক্ষিতে ট্রেন ভাড়া আরেক দফা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে–ভোগান্তি কমলো কই? আমাদের কাছে ট্রেন ভাড়া বাড়ানোর অর্থ হ’ল যাত্রীসাধারণের সুযোগ সুবিধাও বাড়বে। কিন্তু সে প্রয়াসের কোন নমুনা এখনো দেখা যাচ্ছে না কিন্তু যাত্রী সাধারণ সে কথা শুনবে কেন? তাদের দাবি তারা নিরাপদে এবং আরামে রেলে ভ্রমণ করতে চায়। প্রয়োজনবোধে রেলপুলিশ বাড়ানো বা বাতি ও পানির বন্দোবস্ত যাদের করবার তারা অবশ্যই করবেন। যাত্রী সাধারণের সুযোগ-সুবিধা দেখা, তাদের আরাম-আয়েশের প্রতি লক্ষ্য রাখা, নিরাপত্তা বিধানের নিশ্চয়তা দেয়া এবং সময়মতো যাত্রীদেরকে যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব যাদের উপরে আছে তাদের প্রতি আমাদের আবেদন-পারস্পরিক দোষারোপের কোন্দলে না নেমে স্ব-স্ব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে যান। এতেই কিছু কাজ হতে পারে। শুধু ভাড়া বাড়িয়ে এদের পরিবহনের আভিজাত্য আনা যায় না।
বন্যার প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পর–
এমন বন্যা দু’দশকে অথবা দুই শতকে হয়েছে কিনা সে বিতর্কে না গিয়েও বলা চলে বাংলাদেশের বন্যা যে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ভয়াবহতা নিয়ে এসেছে তেমনটি আর আসেনি। প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর কোন বন্যার সময় আমার প্রকট ছিলনা। ছিল না সকল ক্ষেত্রে এমন ‘নাই নাই’ অবস্থা। বন্যা হবে প্রায় প্রতিবছরই-এটা অবধারিত বলে ধরে নিয়েছে এ দেশের লোক। বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা? তাতেও আস্থা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না তাদের মধ্যে। ওটা ভবিষ্যতের ব্যাপার, অনাদিকাল পর্যন্ত ওটা ভবিষ্যতের গর্ভেই নিবদ্ধ থাকবে–এমন একটা ধারণা প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে নেতা-মন্ত্রী-বিশেষজ্ঞদের আশ্বাস থেকে জনসাধারণের মনে গড়ে উঠেছে।
আমাদের বক্তব্য বন্যা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে অথবা এবারের বন্যার ভয়াবহতা নিয়ে নয়। যেটা বন্যা নিয়ন্ত্রণের আশ্বাসের মতোই প্রতি বন্যাকালে জনগণের দুর্ভোগকে শতগুণ বৃদ্ধি করার জন্য জনসাধারণকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে সেই পাশব শক্তিগুলোর সম্বন্ধে। বন্যা দেশের জনগোষ্ঠীর এক ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অভিশাপ আর দুর্ভোগের কারণ হলেও এক শ্রেণীর মানুষ রয়েছে যারা একে আশীর্বাদ আর সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবেই ব্যবহার করে। বন্যার্তদের জন্য সাহায্যের-সামগ্রী, ঔষধ-খাবার থেকে শুরু করে সবকিছু থেকেই তারা নিজেদের একটা হিস্যা বের করে আনে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার ফলে অর্থগুরু ব্যবসায়ীরা মওজুত মালের দাম প্রতি মুহূর্তে বাড়িয়ে চলে, যাদের উপর সাহায্য সামগ্রিক বন্টন অথবা ঔষধপত্র সরবরাহের দায়িত্ব অর্পিত হয় তারা বন্যার্তদের দুর্গতি লাঘবের চাইতে নিজেদের ফায়দা লুটতেই অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ওষুধের অভাবে রোগ প্রতিরোধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকায় গোটা বন্যাক্রান্ত এলাকায় মহামারী আকারে বিস্তার লাভ করে ব্যাধি। মজুদদারদের কারসাজিতে খাবার থেকে শুরু করে প্রতিটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়তে থাকে।
এখনো বন্যার পানি বাড়ছে। বহু স্থানে নদীর পানি বিপদসীমার উপরে। শস্যাদি এবং গবাদিপশুর যে কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে সে সম্বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও আগামী দিনগুলোতে যে তা মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে তা অবধারিত। এমতাবস্থায় জনসাধারণের দুর্ভোগ লাঘবে প্রয়োজনীয় সকল প্রস্তুতি গ্রহণ অত্যাবশ্যক বলে আমরা মনে করি। বন্যার ফলে প্রাথমিকভাবে যে ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা নিয়ে হাহুতাশ করে কোন লাভ নেই। বরং সে ক্ষয়ক্ষতি যাতে আরও মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ না করে সেদিকে সবার নজর দিতে হবে। ইতিমধ্যে কোন কোন স্থানে রোগ ছড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে। মতলববাজ ব্যবসায়ীরা বন্যা দুর্গত এলাকায় সক্রিয় হয়ে উঠেছে। চাল, ডালের দাম অসম্ভব হারে বাড়ছে। ঔষধ মিলছে না অনেক জায়গায়ই। শুধু প্রশাসনিক ব্যবস্থা এসব কিছু মোকাবিলা করতে পারবেনা। জনসাধারণের সচেতন অংশকে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করতে হবে। রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংস্থা-সমিতি দুর্গতদের দুর্ভোগ লাঘবে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক