You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.07.12 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | প্রশাসনিক রদবদল | একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১২ই জুলাই, শুক্রবার, ২৭শে আষাঢ়, ১৩৮১

প্রশাসনিক রদবদল

সরকারের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু রদবদলের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। গতকাল সংবাদ বেরিয়েছে কয়েকজন কর্মকর্তার অপসারণের। সেকারণে কিছু রদবদলও করা হয়েছে। প্রশাসনিক রদবদলের ব্যাপারটা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেননা এ দাবিটা বহু পুরনো এবং জনসমর্থিত। দেশের সাধারণ মানুষেরও ধারণা–সরকারের সদিচ্ছা যথার্থ অর্থে প্রশাসনযন্ত্রই বাস্তবায়িত হতে দিচ্ছে না। এতদিন ধরে যে সকল অনাচার অবিচার ও দুর্নীতি হয়েছে তার এক বিরাট অংশ প্রশাসনযন্ত্রের দ্বারা সৃষ্ট। প্রশাসনযন্ত্রের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ অযোগ্য আমলারাই এসবের মূলে রয়েছে। সর্বোপরি আমাদের দেশে বর্তমান যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা রয়েছে তা পুরনো নিয়ম-কানুনের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। নতুন চিন্তা ভাবনার সঙ্গে তার বৈপরীত্য এত বেশি যে কোনো ক্রমেই প্রশাসন ব্যবস্থার দ্বারা নতুন কোনো সদিচ্ছা বাস্তবায়িত করা সম্ভব নয়। নীতিগত কারণেই এ ব্যবস্থার রদবদল দেশের প্রগতিশীল জনগণ কামনা করে আসছিল। কিন্তু আজও তা কতৃপক্ষ করেননি। মাঝে মাঝে দুই-একজন দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিকে অপসারণ করলেই প্রশাসন কলুষমুক্ত হবে এমন ভাবা যায় না। তবু এমন অপসারণ এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না। প্রশাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে নীতিগত কারণে। সিস্টেম পরিবর্তন করে নতুন ইচ্ছার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে প্রশাসনকে। নইলে ইচ্ছার সঙ্গে অবস্থার কন্ট্রাডিকশন অনিবার্য হয়ে পড়বে। গতকালের সংবাদপত্রগুলোতে কয়েকজন বড় কর্মকর্তার অপসারণ এর যে সংবাদ প্রকাশ পেয়েছে তা নিঃসন্দেহে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকবে। কারণ একটি গ্রামের মানুষও তার নিকটস্থ সার্কেল অফিসার বা দারোগা সাহেবের প্রশাসন ব্যবস্থার নমুনা প্রতিনিয়ত মর্মে মর্মে উপলব্ধি করে থাকে। বড় বড় কর্মকর্তাদের কথা তারা অনুমানেই বুঝতে পারে।
বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু বড় পরিবর্তন সাধন করতে চলেছেন বলে দেশে আজ যে কথা প্রচলিত হয়েছে তার প্রতিক্রিয়ায়ই এ ধরনের কিছু পরিবর্তন হতে চলেছে বলে অনেকের ধারণা। মন্ত্রিপরিষদের কয়েকজন সদস্যের পদত্যাগ, বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা, সীমান্তে সৈন্য প্রেরন, কালো টাকার পাহাড় সৃষ্টিকারী কয়েকজন ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার ও কয়েকজন বড় ধরনের আমলাকে বরখাস্ত ইত্যাদি ঘটনাগুলোকে আশ্রয় করে জনগণ বঙ্গবন্ধুর পরিবর্তন মুখি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা ভাবছে। যদি সত্যিই কোন আদর্শগত পরিবর্তনের জন্য সরকার এ ধরনের প্রাথমিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তার শুভ ফলশ্রুতি সমাজ জীবনে প্রতিবিম্বিত হবে। কিন্তু যদি সাময়িক কারণে এই ধরনের পদক্ষেপ গৃহীত হয়ে থাকে তাহলে তার ফলশ্রুতি সমাজ জীবনে সুদূর কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে সকল দুর্নীতি আজ চরম আকার ধারণ করেছে তার মূলোৎপাটন না হওয়া পর্যন্ত সমাজের কোন মৌলিক শুভ সম্ভাবনা আশা করা বৃথা। কতৃপক্ষ একটি মহৎ পরিকল্পনা নিয়ে সকল কর্মসূচি প্রণয়ন করবেন বলে আমরা বিশ্বাস করি এবং অনতিবিলম্বে সে শুভ চিন্তার বাস্তবায়ন কামনা করি।

একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি

বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন সরদার গত ৯ জুলাই রাতের বেলায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, রাত আটটার দিকে জনাব জালাল উদ্দিন তার বগুড়া রোডস্থ চেম্বারে কয়েকজন মক্কেলের সঙ্গে আলাপ করছিলেন। এমন সময় একজন ষ্টেনগানধারী ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে জনাব জালাল উদ্দিনকে আত্মসমর্পণ করতে বলে। তিনি দাড়ানো মাত্র ষ্টেনগানধারী তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এ সময় বাইরে অপেক্ষমান তিন-চারজন ঘরের দরজায় হাতবোমা ছুড়ে আততায়ী সহ পলায়ন করে। ঘটনার পর শহরে কার্ফু জারি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি।
দ্বিতীয় বার বরিশালে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো। প্রথম ঘটনাটি ঘটেছিল গত ২৪শে মে। শহরের সদর রাস্তায় অবস্থিত শাপলা ষ্টুডিওতে রাত নটার সময় দু’জন যুবলীগ কর্মী ও একজন বিমানবাহিনীর পদস্থ অফিসার যখন আলাপ করছিলেন তখন একজন সশস্ত্র ব্যক্তি এলএমজি নিয়ে তাদের উপর প্রকাশ্য হামলা চালায়। এ ঘটনায় ১ জন প্রাণ হারায় এবং অপর দু’জন হাসপাতালে। পরবর্তী পর্যায়ে শহরে কার্ফু জারি করা হয়। ৬৭ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কার্ফু চলাকালীন প্রত্যেক বাড়িতে তল্লাশি চালানো হয়। তল্লাশি অভিযানে একটি বেয়োনেট, একটি স্টেনগান, একটি গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়।
মে মাসে বরিশালের নিশংস হত্যাকাণ্ড ঘটনা ছিল না। একটি মাসে অনেকগুলো হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৫ মে সাতক্ষীরার একটি বিল থেকে গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তেশরা মে দুর্বৃত্তদের গুলিতে ফরিদগঞ্জ থানার একজন পুলিশ নিহত হয়েছেন। ৬ হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানা আওয়ামী লীগের একজন বিশিষ্ট কর্মী আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। শ্রীপুরের মৌচাক ইউনিয়নের দু’ব্যক্তির লাশ হাত-পা বাঁধা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। ৮ মে মঠবাড়িয়া থানার পালনারা ইউনিয়ন এর নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান ও তার ভাইকে আততায়ীরা গুলি করে হত্যা করে। ৯ই মে বাগেরহাটের ফকিরহাট থানার একটি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানকেও একই অবস্থায় হত্যা করা হয়েছে। একই সময় পীরগঞ্জে ও শেরপুরে একটি করে গলাকাটা লাশের সন্ধান পাওয়া গেছে। দশ মে কলাবাগানের নিকটে দুর্বৃত্তের গুলিতে জনৈক পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর নিহত হয়েছেন। ১৪ই মে মতলব থানার তিন জন ছাত্রীকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। ২০শে মে মাদারীপুরের গোসাইরহাট থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি তার কর্মীদের সঙ্গে আলাপরত অবস্থায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। এক কথায় বলতে গেলে গোটা মে মাসেই দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছিল। মে মাসের পর একটি মাস অতিবাহিত হতে না হতেই আবার একই ঘটনা ঘটে চলেছে। বরিশালের এ মর্মান্তিক ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে দেশের অন্যান্য স্থানে ও সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা গুপ্তহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। বরিশালে হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হওয়ার একই দিনে অর্থাৎ ৯ই জুলাই সিদ্ধিরগঞ্জ থানার নিকটস্থ গোদনাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জনাব কফিলউদ্দিন মিয়াকে কতিপয় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারী তার বাড়িতে গুলি করে হত্যা করেছে (ইন্নালিল্লাহি… রাজিউন)। কুষ্টিয়া আলমডাঙ্গা থানাধীন খাশকারা গ্রামের ডাক্তার বিনয় কৃষ্ণ নামে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে একই তারিখে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী হত্যা করেছে। খবরে প্রকাশ, গভীর রাতে একদল সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী উক্ত বাড়িতে হানা দেয় এবং ডাক্তার বিনয় কৃষ্ণকে ডেকে নিয়ে হত্যা করে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, সরকারী প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য ও সহযোগিতা করার জন্য গত ২৫ এপ্রিল দেশের সর্বত্র সেনাবাহিনীর ছড়িয়ে পড়ে। সেনাবাহিনী দেশের অন্তপ্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়ার প্রধান ও প্রথম উদ্দেশ্য ছিল বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি বিধান। সেনাবাহিনীর এ পর্যন্ত প্রশংসনীয় কাজ করেছেন। উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেআইনি অস্ত্র শস্ত্র তারা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছেন। শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনী তৎপর হওয়াতে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বরিশাল ও অন্যান্য স্থানের গুপ্তহত্যার ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি আবার ঘটলো। জনসাধারণের মনে যেটুকু স্বস্তি ফিরে এসেছিল তা উবে যাবে আলোচনার ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে। বরিশালের ব্যাপারে তো এ কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য। মাত্র এক মাসেরও বেশি সময় এর মধ্যে পরপর দুটি হত্যাকাণ্ড যদি একই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় তাহলে ভাববার কথা বৈকি!
স্পষ্টতঃই বোঝা যাচ্ছে যে, দুর্বৃত্তরা আবার তৎপর হয়ে উঠেছে এ অসাধু তৎপরতাকে যেকোনোভাবেই হোক না কেন বন্ধ করতে হবে। কেননা গত পরশু বরিশাল শহরে যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে তা বর্তমানে কর্তৃপক্ষের নেওয়া কঠোর পদক্ষেপের প্রতি চ্যালেঞ্জস্বরূপ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন