You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১১ই জুলাই, বৃহস্পতিবার, ২৬শে আষাঢ়, ১৩৮১

রাজধানীর যানবাহন নিয়ন্ত্রণ

একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায় রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে সর্বদা ট্রাফিক জ্যাম হয়ে থাকে। পত্রিকান্তরের মাধ্যমে ট্রাফিক জ্যাম সংক্রান্ত প্রতিবেদন ও প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে ট্রাফিক জ্যামের কারণস্বরূপ বলা হয়েছে-ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ পুলিশের সংখ্যা খুব কম। এবং পত্রিকান্তরের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রাজধানীতে যেখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য পনেরশো পুলিশ দরকার, সেখানে কাজ করছেন মাত্র ২৯০ জন। রাজধানীতে ট্রাফিক সার্জেন্টের প্রয়োজন ৫০ জন, সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র ১৭ জন। ফলে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভব হয়না এবং ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে।
প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়েছে, স্বাধীনতার পর রাজধানীতে ১০০ জন পুলিশ বাড়ানো হয়েছে এবং ৪৪৫ জন যানবাহন নিয়ন্ত্রণকারি পুলিশ নিয়োগের মঞ্জুরি রয়েছে। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে–রাজধানী ঢাকায় নিঃসন্দেহে যানবাহনের চাপ এখন অত্যধিক। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এখানে বহু বিদেশী সংস্থাসহ গুরুত্বপূর্ণ দপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে বাস ও গাড়ি সহ বিভিন্ন প্রকার যানবাহনের সংখ্যা স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের তুলনায় অনেক গুণ বেড়েছে। অথচ তার তুলনায় যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়নি।
অনাদিকে ট্রাফিক পুলিশদের কাজের তদারকি রাখার জন্য সার্জেন্টরা গাড়ি বা মোটরসাইকেল করে আকস্মিক টহল দিতেন। এদের জন্য প্রয়োজনীয় পেট্রোল বরাদ্দ ছিল। আর যাদের নিজেদের গাড়ি ছিল তাদের জন্য পেট্রোল ভাতার বরাদ্দ ছিল ৪৫ টাকা। এখন নাকি সে সব সুবিধা ও বন্দোবস্ত নেই। ফলে ট্রাফিক পুলিশদের কাজের গাফিলতি বা অনিয়মের প্রেক্ষিতে আকস্মিক তদারকি ও অনেকাংশে শিথিল করতে হয়েছে। অথচ যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য এই আকস্মিক তদারকি খুবই প্রয়োজন।
তার উপরেও সমস্যা আছে। এখানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা খুবই নগণ্য। বর্তমানে শহরে একটি মাত্র ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুল আছে। কিন্তু প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির অভাবে সেখানে উন্নত মানের ট্রাফিক ট্রেনিং দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে মাত্র দু’জন ট্রাফিক অফিসার বিদেশি ট্রেনিংপ্রাপ্ত। এই সংখ্যা বাড়ানো উচিত। কারণ সড়কের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ এর জন্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত ও অধিক সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ প্রয়োজন।
ট্রাফিক জাম এর অন্যতম কারণ গুলির মধ্যে প্রথম হল–একই রাস্তায় বিচিত্র গতির যানবাহন চলাচল করা। দ্বিতীয় হল–অন্যায় ভাবে রাজপথ আগলে গাড়ি পার্ক করে রাখা। তৃতীয়ত–ভঙ্গুর সড়ক। এবড়ো-থেবড়ো রাস্তার যত্রতত্র ভাঙ্গা ও গর্ত থাকায় সর্বপ্রকার যানবাহন রাস্তায় সেই অংশ এড়িয়ে যেতে চায়। ফলে রাস্তা জ্যাম হয়ে যায়।
প্রধান সড়কগুলো যেখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি অজস্র যানবাহনের চলাচল সেখানে আশ্চর্যরকম কম হারে নিয়ন্ত্রক পুলিশ কাজ করছে বলে প্রতিবেদনে এ তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা আমাদের দৃষ্টিতে অন্যায্য নয়। অন্য সব কথা বাদ দিলেও নিউ মার্কেটের সামনের সড়কের কথা কারোর অজানা থাকতে পারেনা। সব রকম যানবাহন ও মানুষ যেন রাস্তার উপর হুমরি খেয়ে পরে থাকে রিক্সা-গাড়িতে ঠোকাঠুকি, বাসে- ট্যাক্সিতে ঘষাঘষি, মানুষের গরুতে ধাক্কাধাক্কি ছাড়া সেখানে অন্য কোন দৃশ্য নেই। আর তারই মাঝে অসহায়ের মতো গুটিকয় পুলিশ হাত-পা নেড়ে বিভ্রান্তমূলক আচরণ করে চলে। ফলে নিউমার্কেটের সমঝোতা স্মারকে সর্বদায় ট্রাফিক জ্যাম লেগে থাকে। অফিস স্কুলের সময়কার অবস্থা হয় আরো ভয়াবহ। একথা অনস্বীকার্য যে, নাগরিক জীবন যানবাহনের যন্ত্রণা ও দুর্ঘটনার উদ্বেগ আজ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। কর্মব্যস্ত জীবনে ট্রাফিক জ্যাম ও তাই একই অস্থিরতা ডেকে আনে। এরই প্রেক্ষিতে আমরা নিয়ন্ত্রক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানোর তাগিদ দিচ্ছি। ট্রেনিং প্রাপ্ত পুলিশের সংখ্যা ও সার্জেন্টের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সার্জনদের ভাতা বা পেট্রোল বা প্রয়োজনীয় গাড়ি ও সরবরাহ করতে হবে। একমাত্র ট্রাফিক ট্রেনিং স্কুলের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ করে প্রতিষ্ঠান চালু রাখার দিকেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আর এ এমন একটা ছোট সমস্যা যাকে জিইয়ে রেখে নাগরিক জীবনের উদ্বেগ কে বাড়িয়ে তোলা মোটেই সমীচীন নয়।

বেলুচিস্তানের ঘটনাবলী

পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেতা খান আব্দুল ওয়ালী খান গত ৮ই জুলাই ঘোষণা করেছেন যে, তিনি রেডক্রস ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলির কাছে বেলুচিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরবেন। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান সাংবাদিকদের জানান, কোয়েটায় তার দলের দু’দিনব্যাপী কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। জনাব আলী খান বলেন, গণহত্যার প্রকৃত তথ্য জনসমক্ষে তুলে ধরার সকল পথ রুদ্ধ করায় তার দল সর্বশেষ অবলম্বন হিসেবে এ উদ্যোগ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
সম্প্রতি পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে বিরোধী দলগুলি এই মর্মে মুলতবি প্রস্তাব উত্থাপন করেন যে, পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশের অংশবিশেষে সরকারি বাহিনী বোমা বর্ষণ করেছে। তারা অভিযোগ করেন যে, ওই বোমা বর্ষণের ফলে প্রায় ৫০ জন লোক নিহত হয়। কিন্তু সরকার ওই সংবাদের সত্যতা অস্বীকার করেন। ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির সাথে আলোচনার প্রস্তাব এর ব্যাপারে ন্যাপ নেতা বলেন রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে তিনি আলোচনা করতে প্রস্তুত আছেন। তবে এ ধরনের আলোচনার জন্য সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে কতগুলি নিয়মনীতিকে পূর্ব শর্ত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। জনাব ওআলী খান আলোচনার ব্যাপারে নিম্নোক্ত পূর্ব শর্ত আরোপ করেন।
(ক) প্রাদেশিক পরিষদের সংখ্যা গরিষ্ঠ সদস্যদের প্রদেশের শাসনক্ষমতা নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
(খ) সকল রাজবন্দির মুক্তি ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে।
(গ) সংবাদপত্রের সকল বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে হবে। বিশেষতঃ কতকগুলি সংবাদপত্রে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে হবে এবং বেতার ও টেলিভিশনে সকল দলের মতামতকে স্থান দিতে হবে।
পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ যে ঘটনা ঘটেছে গত দেড় বছরের মধ্যে তা কারও অজানা নয়। সেখানে ন্যাপ ও অন্যান্য দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও সরকার গঠনে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, ’৭৩ সালে বেলুচিস্তান উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে সৈন্যবাহিনী পাঠানো হয়েছিল। এবং ভুট্টা সরকারের সেনাবাহিনী সেখানে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তা আজ আর কারো অবিদিত নয়। ন্যাপের একজন বিশিষ্ট নেতা আবদুস সামাদ আচকজাই আততায়ীর হাতে নিহত হবার পর আজও পর্যন্ত সে রহস্যের কুলকিনারা হয়নি। ভুট্টো সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
বেলুচিস্তান উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনসাধারণের দাবি-দাওয়া এমন কিছু নয়। তারা আত্মসম্মান বজায় রেখে খেয়ে পরে বাঁচতে চায়। সেখানকার জনসাধারণ তথা বিরোধী দলীয় নেতৃবৃন্দ কোনদিন বলেননি যে, তারা পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চান। তারা শুধু চেয়েছেন আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার। অথচ ফুটো সরকার সেখানকার জনসাধারণের প্রাণের দাবীকে পদদলিত করেছেন বারংবার। শুধু তাই নয়, বিদেশী রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে সেখানকার জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে দাবিয়ে রাখবেন বলে বহুবার ঘোষণা করেছেন। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ’৭৩ সালে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ বিসুভিয়াসের রূপ নেয়। যেকোনো মুহূর্তে জলন্ত অগ্নি লাভা ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন অবস্থারও সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। অথচ ভুট্টো সরকার সেখানকার বাস্তব অবস্থাকে উপলব্ধি করা ও দূরে থাকুক নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছেন। তারই ফলশ্রুতি হলো বেলুচিস্তানে সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণ।
অথচ এটা আজ ঐতিহাসিক সত্য যে, বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কোনো কিছুর সমাধান হয় না। যেমনটি হয়নি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। ’৭১ সালের নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ও তৎকালীন ইয়াহিয়া সরকার তা স্বীকার করতে চাননি। বিশ্ববাসীকে ধোকা দিতে চেয়েছে বারংবার।
সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বলবো যে, আগুনকে ছাইচাপা না দিয়ে আগুনের গোড়াতেই পানি ঢালা উচিত অর্থাৎ বাস্তব সমস্যাবলীর সমাধান করা উচিত। ন্যাপ নেতা ওয়ালী খান আলোচনার পূর্বশর্ত হিসেবে উল্লেখ করেছেন সেসব দাবি-দাওয়া অনায়াসেই মেনে নেয়া যায়। এটা নির্ভর করে স্বদিচ্ছা ও আন্তরিকতার উপর। আমরা আশা করি পাকিস্তানের শান্তিকামী জনসাধারণের স্বার্থের দিকে তাকিয়ে ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টি আলোচনায় বসবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!