You dont have javascript enabled! Please enable it! 1975.08.15 | অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট : খুনিদের হাতে জাতি জিম্মি - সংগ্রামের নোটবুক
অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট : খুনিদের হাতে জাতি জিম্মি
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট কাপুরুষােচিত ও বর্বরতম এক হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হয় বাংলাদেশে। রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে তাঁর পরিবারের সদস্যদের হত্যা করে দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের সহায়তায় ক্ষমতা দখল করে আওয়ামী লীগের একটি অংশ। এই বর্বর গােষ্ঠীকে বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে আমরা উৎখাত করি একই বছরের ৩ নভেম্বর। বিগত একুশ বছর যাবৎ ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের ওপর অনেক কালিমা লেপন করা হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে “রুশ-ভারতের চরদের অভ্যুত্থান হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টা করেছেন। ১৯৭১ সালে আমরা অনেকেই জীবনবাজি রেখে অসম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছিলাম। সম্মুখসমরে গুরুতরভাবে আহত হয়েছি কেউ কেউ, আমরা এসবই করেছিলাম ফাসির রশি গলায় পড়বার ঝুঁকি নিয়ে। সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অংশগ্রহণ শুরু হয় প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘােষণার দ্বারা, চুপিসারে পক্ষত্যাগের মাধ্যমে নয়। তাই আমাদেরকে অন্য কোনাে দেশের দালাল বা চর আখ্যায়িত করলে স্বাভাবিকভাবে তীব্র বেদনা অনুভব করি। আমাদের দেশপ্রেম সম্পর্কে প্রশ্ন তােলার যােগ্যতা আর কারাে আছে কি এই বাংলাদেশে? 
বৈরী পরিবেশে, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগের অনুপস্থিতিতে আগে কখনাে কিছু বলি নি। এখন সুযােগ এসেছে জাতির কাছে, বিবেকবান মানুষের কাছে ৩ নভেম্বর অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার। সেই অভুথানে জড়িত, নিহত ও চাকরিচ্যুত সাহসী অফিসারদের আত্মত্যাগের প্রতি আমার দায়বদ্ধতা থেকে উৎসারিত বর্তমান প্রয়াস। মুক্তিযুদ্ধের কিংবদন্তির সেনানায়ক খালেদ মােশাররফ এবং বীর সেনানি কর্নেল হুদা চক্রান্তের শিকার হয়ে ৭ নভেম্বর নির্মমভাবে নিহত হন। অথচ এঁদের আত্ত্যাগেই জাতি একদল খুনির হাতে জিম্মি হয়ে থাকা অবস্থা থেকে মুক্তি পায়। এদিকে বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা লে. কর্নেল হায়দার ও আরাে ১০ থেকে ১২ জন অফিসার (একজন মহিলা ডাক্তারসহ) এবং একজন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধার স্ত্রী নিহত হন ৭ নভেম্বর এবং তার পরবর্তী কয়েকদিনে। এদের কেউই ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনােভাবেই জড়িত ছিলেন না। তাঁরা সবাই। নিহত হন জাসদ-এর সেই তথাকথিত “ৰিপুৰী সৈনিক সংস্থা উদ্ভাবিত আত্মঘাতী এক শ্লোগানে প্রভাবিত এক শ্রেণীর উখল সেনাসদস্যদের। হাতে। পরবর্তীকালে জিয়ার শাসনামলে এদের অনেকেই বিচারের সম্মুখীন। হয়। কঠোর হাতে তাদের দমন করা হয়। দুর্বলের অত্যাচার যে কতাে ভয়ঙ্কর’—এ সত্যটি জাতি হাড়ে হাড়ে টের পেতাে ওদের দমন করা না গেলে।
শুরুতেই বলে নিই ৩ নভেম্বরের অভুত্থানের মূল লক্ষ্যগুলাে কি ছিল : ক. সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমাণ্ড পুনঐতিষ্ঠা করা ;  খ, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ এবং হত্যাকান্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের ব্যবস্থা। গ, সংবিধান-বহির্ভূত অবৈধ সরকারের অপসারণ, এবং ঘ, একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির অধীনে গঠিত একটি অন্তর্বর্তীকালীন। সরকারের মাধ্যমে ৬ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের নির্বাচিত সরকারের কাছে হস্তান্তর করা। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে বিদেশি শক্তির মদদ ছিল সে কথা আর। বলার অপেক্ষা রাখে না। আশ্চর্যের বিষয়, দেশের সামরিক-বেসামরিক গােয়েন্দা। দপ্তর বা বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলাের স্থানীয় মিশনগুলাে এই ষড়যন্ত্রের কোনাে আগাম আভাস দিতে ব্যর্থ হয়। এর থেকে ধারণা করা যায়, এই চক্রান্তটি বিভিন্ন গােয়েন্দা দপ্তর ও বিদেশি মিশনগুলাে সযত্নে আড়াল করে রাখে। ১৫ আগস্ট ভােরে অভুথান-প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর তকালীন। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ সেটা জানতে পারেন। তারও অনেক। পরে ঢাকাস্থ ৪৬ ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে আমি বিষয়টি অবগত হই। যদিও প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব আমার ছিল না, তবু যখন বিষয়টি আমার গােচরে আসে ততােক্ষণে সবই শেষ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ও তাঁর। পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল ততােক্ষণে সম্পন্ন। অভ্যুত্থান-প্রক্রিয়া চলাকালে এই খবর জানতে পারলেও কোনাে কিছু করার। ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। সময় ও অবস্থানের বিচারে সেনাপ্রধান ও আমি। অ্যুত্থানকারীদের থেকে অন্তত দুই ঘণ্টা পেছনে ছিলাম। 
যে-কোনাে অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতে হলে Pre-emptive strike করতে হয়। এর জন্য প্রয়ােজন আগাম গােয়েন্দা খবরাখবর । আমার অধীনে। কোনাে গােয়েন্দা ইউনিট ছিল না। ঢাকায় নিযুক্ত সবকটি ইউনিট ছিল সেনা হেড কোয়ার্টারের অধীন। এ জাতীয় ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে যেহেতু কোনাে । আগাম পূর্বাভাস কোনাে দিন দেয়া হয় নি, সেহেতু ধারণা করি যে, বাংলাদেশের সব গােয়েন্দা সংস্থা ১৫ আগস্টের অভুথান সম্পর্কে হয়। একেবারেই বেখবর ছিলেন অথবা সবাই অতি যত্নে সাফল্যের সঙ্গে এটিকে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। অভূত্থান একবার শুরু হয়ে গেলে করার আর বিশেষ কিছুই থাকে না। কারণ অনুগত ইউনিটগুলাে বিদ্রোহীদের চাইতে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা পেছনে থাকে সময় ও অবস্থান এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণের বিচারে। ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর সকাল ন’টার মধ্যেই তিন বাহিনী প্রধান অবৈধ খুনি সরকারের প্রধান খন্দকার মােশতাকের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরপর থেকে সেনাবাহিনীর সকল কর্মকর্তা ও সদস্য শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা তথা সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ এড়ানাের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ থাকেন।
অভূখনকারীদের ক্ষমতা দখলের দুই দিনের মধ্যে দিল্লিতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত কর্নেল মঞ্জুর (পরে মেজর জেনারেল ও নিহত) অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। এর কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দ্বারা নিয়ােগকৃত ও সে সময়ে সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ মেজর জেনারেল এরশাদও অযাচিতভাবে বিনা ছুটিতে দেশে এসে উপস্থিত হন। জেনারেল এরশাদ তখন দিল্লিতে একটি সামরিক কোর্সে অংশ নিচ্ছিলেন। জিয়া তখন এরশাদকে অনাবশ্যক ও অনাহূতভাবে দেশে আসার জন্য তিরস্কার এবং বঙ্গভবনে যেতে নিষেধ করেছিলেন। সেখানে মোশতাকাই অত্যুখানকারী বিদ্রোহী মেজৱৱা অবস্থান করছিলেন। কিন্তু এরশাদ বারণ সত্ত্বেও বঙ্গভবনে যান এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে সলাপরামর্শে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড ও অ্যুথানের অন্যতম হােতা রশিদও ১৫ আগস্টের মাস দুয়েক পূর্বে দিল্লিতে অবস্থান করছিলেন। একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, বিধি লঙ্ঘন করে এরশাদকে কোর্সে অংশগ্রহণরত অবস্থায় প্রমােশন সহকারে পদোন্নতি দেয়া হয়। শুধু তাই নয়, তার চেয়েও সিনিয়র তিনজন অফিসারকে ডিঙিয়ে (ব্রিগেডিয়ার মাশহুরুল হক, ব্রিগেডিয়ার সি. আর. দত্ত এবং ব্রিগেডিয়ার কিউ, জি, দস্তগীর) খুনিরা এরশাদকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অফ স্টাফ পদে নিযুক্তি দেয়। | ২৪ আগস্ট জেনারেল জিয়া চিফ অফ স্টাফের ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। চিফ অফ স্টাফ হলেও দৃশ্যত তার হাতে বিশেষ ক্ষমতা ছিল না। তার ওপরে বসানাে হলাে চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ ও প্রেসিডেন্টের ডিফেন্স এডভাইজারকে। এ দুটো পদে ছিলেন যথাক্রমে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান ও জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী ।
সর্বোপরি ছিলেন প্রেসিডেন্ট। আগে চিফ অফ স্টাফের ওপরে থাকতেন দুজন। এখন হলেন চারজন। তদুপরি ছিল অভুথানকারী মেজর সাহেবরা। তারা প্রত্যেকেই ছিল চিফ অফ স্টাফেরও বস! তারা ইচ্ছেমতাে পােস্টিং দিচ্ছে, উপস্ মুভমেন্ট করাচ্ছে, ছােটোখাটো সেনা অপারেশন করাচ্ছে। রাষ্ট্র ও সেনাবাহিনী তাদের হাতে প্রকৃত অর্থেই জিম্মি ছিল। আসলে সে ছিল এক অসহনীয় পরিবেশ! | ইতিমধ্যে অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়মিত হিসেবে আত্তীকরণ করা হয়েছিল। তাদেরকে বিভিন্ন ইউনিটে পােস্টিংও দেয়া হলাে, যদিও কেউ তাতে যােগ দিল না। তাদের সকলেই ছিল যেন যাবতীয় সেনা আইনের উর্ধ্বে। সেপ্টেম্বরের প্রথমার্ধে জার্মানি থেকে নিয়ে আসা হয় ব্যবসায়ী গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম.জি, তাওয়াবকে। তাওয়াব এর আগে পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করে জার্মানিতে বসবাস করছিলেন। সেও প্রায় বছর চারেক। বিমান বাহিনীর সকল নিয়মনীতি ও বিধি লঙ্ঘন করে নজিরবিহীনভাবে তাওয়াবকে বিমান বাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হলাে এক সঙ্গে দুটো প্রমোশন দিয়ে। একলাফে তাওয়ৰ অবসরপ্রাপ্ত গ্রুপ ক্যাপ্টেন থেকে সক্রিয় এয়ার ভাইস মার্শাল হয়ে গেলেন। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সৃষ্টির ব্যাপারে তাওয়ারের কোনাে ভূমিকাই ছিলাে না। একেই বলে ভাগ্য। উল্লেখ্য, উগ্র ডানপন্থী তাওয়াকে আনতে রশিদ জার্মানি পর্যন্ত গিয়েছিল। পরবর্তীকালে তিনি একাধিকবার লিবিয়া ও পাকিস্তানে গিয়ে আঁতাতের চেষ্টা করেন। সেনাবাহিনীর মধ্যে সমান্তরাল আরেকটা আর্মির মতাে বহাল থাকতে লাগলাে অত্থানের সঙ্গে জড়িতরা। কারক-রশিল অবস্থান করতাে মােশতাকের সঙ্গে বঙ্গভবনে। বঙ্গভবনের ভেতরে ছিল ১২ থেকে ১৪টি ট্যাঙ্ক। বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে মােতায়েন করা হয়েছিলাে ১২টি এবং ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আরাে ৮ থেকে ১০টি ট্যাঙ্ক। ট্যাঙ্ক ও গােলন্দাজ বাহিনী রয়ে গিয়েছিল সেনাবাহিনীর চেইন অফ কমান্ডের বাইরে। জেনারেল জিয়া, খলিল বা ওসমানী– এই তিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার কারােরই নিয়ন্ত্রণ ছিল না তাদের ওপর। তারা শুধু মােশতাক, ফারুক ও রশিদের নির্দেশ শুনতাে এবং সে অনুযায়ী কাজ করতাে।
অন্যদিকে ডালিম, নূর, শাহরিয়ার ও অন্যরা অবস্থান করতে বাংলাদেশ বেতার ভবনের অভ্যন্তরে। তারা ইঞ্জিনিয়ার্সের কিছু সৈন্য নিয়ে মুভমেন্ট করতাে। লেফটেন্যান্ট মাজেদ নামে একজন অফিসারও তাদের সঙ্গে যােগ দেয়। তারা এ সময় ঢাকা ও তার আশপাশের বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে ধরে এনে জোর করে টাকা-পয়সা আদায় করতাে। অনেকেই তাদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন বলে অভিযােগ রয়েছে। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, নির্যাতিতদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সাংবাদিক আবিদুর রহমান এবং বিশিষ্ট রাজনীতিক তােফায়েল আহমদ। তােফায়েল আহমদের এপিএস-কে তাে তারা মেরেই ফেলে।
এ সময় সেনাপ্রধান জিয়ার কমান্ড কতাে নাজুক ছিল তার একটা উদাহরণ দেয়া যায়। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সেনাসদর থেকে এক নির্দেশে বঙ্গভবনে তিনটি ট্যাঙ্ক রেখে বাকি সব ট্যাঙ্ক অবিলম্বে ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে আনতে বলা হলাে। ৭ দিনের মধ্যেও বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐ নির্দেশ পালন করার কোনাে লক্ষণ দেখা গেলাে না। তখন মুখরক্ষার জন্য বাতিল করা হলাে আদেশটি। রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে মােশতাক সরকারের বেশ মাখামাখি দেখা যাচ্ছিল। একজন চিহ্নিত স্বাধীনতা-বিরােধী পীর মােহসেন উদ্দিন দুদু মিয়াকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যোগাযােগের জন্য দূত হিসেবে সে দেশে পাঠানাে হলাে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনে নিয়ােগপ্রাপ্ত বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধাকে চাকরি থেকে সরানাের পাঁয়তারা চলতে লাগলাে। সবকিছু মিলিয়ে মনে হচিছল পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন গঠনের দিকেই যেন এগিয়ে যাচ্ছে মােশতাক সরকার। এর আগে, ১৯৭১ সালে খন্দকার মােশতাক এবং মাহবুব আলম চাষীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম। ষড়যন্ত্রকারীরা তখন একটি বৃহৎ শক্তির ছত্রছায়ায় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের পরিকল্পনা করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়। সৌভাগ্য আমাদের, মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেই চক্রান্ত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মােকাবেলা করে অঙ্কুরেই তা ধ্বংস করে দেন। আমার ধারণা, সেই বৃহৎ শক্তির বিরাগভাজন হওয়ার কারণেই পরবর্তীকালে জেলে অত্যন্ত নির্মমভাবে নিহত হন জাতীয় চার নেতা। বৃহৎ শক্তিটির দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত চর মােশতাকের নির্দেশে যে হত্যাকাণ্ডটি সঘটিত হয়েছিল, এখন আর সেটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না।
প্রসঙ্গত, সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে জারি করা একটি ফরমানের উল্লেখ করা যায়। নজিরবিহীন এ ফরমানের ভাষ্যে বলা হয়েছিলাে, কোনাে ব্যক্তি যদি দুর্নীতি করে, এমন কি তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগও ওঠে (reputed to be corrupt), তাহলে তাকে বিচারপূর্বক মৃত্যুদণ্ড দেয়া হবে। আমার ধারণা, অভুথানকারীরা মােশতাকের প্রতিদ্বন্দ্বী সকল যােগ্য নেতাকে এই আইনের বলেই ফাসিতে ঝােলাতাে। নিঃসন্দেহে এটা ছিল একটা জংলি আইন। ৭ নভেম্বরের পর আমি যখন তিন মাস জেলে ছিলাম, তখন শুনেছি জাতীয় নেতা শ্রদ্ধেয় তাজউদ্দিন আহমেদ পত্রিকায় ফরমান জারির খবর দেখে সহবন্দিদের বলেছিলেন, আমাদের আর বাঁচিয়ে রাখা হবে না। এ আইন তারই আলামত।  অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িতদের বিশৃঙ্খল ও উদ্ধত কার্যকলাপে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছিল। আমার অধীনস্থ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যরাও ছিল অসন্তুষ্ট ও হতাশ। অক্টোবরের মাঝামাঝি একদিন আমি বাংলাদেশ বেতারে অবস্থান নেয়া বিদ্রোহী আর্টিলারি সেনাদল পরিদর্শনে গেলাম। সেখানে অবস্থানরত কতিপয় অফিসার সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে যে-কোনাে পদক্ষেপ নেয়া হলে আমাকে সমর্থন ও সহযােগিতা করবে বলে অঙ্গীকার করেন। বঙ্গভবনের মেইন গেটেও আমার অধীনস্থ প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি নিয়ােজিত ছিল। ৪৬ ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে তাদের পরিদর্শনে গেলাম আমি একদিন। সেদিন বিকেলে জেনারেল জিয়া খবরটা শুনে খুবই খুশি হন। তিনিও ট্রপস্ পরিদর্শনে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। জিয়া সম্ভবত তার কমান্ড সম্পর্কে তখনাে সন্দিহান ছিলেন। পরদিন চিফ অফ স্টাফ জিয়াকে নিয়ে আবার ট্রপস্ পরিদর্শনে গেলাম। বেতার ভবনে মােতায়েন আর্টিলারি এবং বঙ্গভবনের সামনে প্রথম বেঙ্গলের ট্রপস ও পাশেই অবস্থানরত ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের অফিসার এবং জওয়ানদের সঙ্গে কথাবার্তা বললেন জিয়া। বিভিন্ন অভাব-অভিযােগ শুনলেন। এ সময় তাকে বেশ তৃপ্ত ও সন্তুষ্ট দেখাচ্ছিল।
প্রতিরােধের প্রস্তুতি : খালেদ মােশাররফ বললেন, ‘ডু সামথিং’
১৫ আগস্টের পর থেকেই অভূত্থানকারী খুনিদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ার একটা চিন্তা কাজ করছিল আমার মধ্যে। সমমনা কিছু অফিসারের মৌন সমর্থনও আমার পেছনে ছিল জানতাম। ১৯ আগস্ট সেনাসদরে অনুষ্ঠিত কনফারেন্সে ফারুক ও রশিদের উপস্থিতিতে আমি এই বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করি যে, দেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার হবে। অবৈধ খুনি প্রেসিডেন্ট মােশতাককে আমি মানি না এবং প্রথম সুযােগেই আমি তাকে পদচ্যুত করবাে। অফিসারদের অনেকেই বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কিছু একটা করার তাগিদ ও নৈতিক সমর্থন দিচ্ছিলেন আমাকে। সেনা আইনে এগুলাে গর্হিত অপরাধ। কিন্তু ১৫ আগস্টের অপরাধের যখন কোনাে প্রতিকার হয় নি, তখন দেশের রাষ্ট্রপতির হত্যাকারীদের বিরুদ্ধাচরণ করায় কি দোষ থাকতে পারে?
অক্টোবর নাগাদ চিফ অফ স্টাফ জিয়া অভ্যুত্থানকারী সেনা অফিসারদের বিশৃঙ্খল কার্যকলাপের গুরুতর অনুযোগ করলেন আমার কাছে। আমি তাকে বললাম, ‘স্যার আপনি চিফ, আপনি অর্ডার করলে আমি জোর করে এদের চেইন অফ কমান্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু জিয়া ভুগছিলেন দোটানায়। ১৫ আগস্টের ভয়াবহ ঘটনাবলি তাকে কিছুটা বিমূঢ় করে। দিয়েছিল। তখন তিনি একপা এগােন তাে দু-পা পিছিয়ে যান। মনে হলাে, চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছেন না জিয়া। যা করার নিজেদেরকেই করতে হবে।
কিছু একটা করতে চাইছিলাম। কিন্তু তখন পক্ষ-বিপক্ষ চেনা ছিল খুবই দুরূহ। তবে বুঝতে পারছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ও অন্যান্য শৃঙ্খলাপরায়ণ ও নীতিবান কিছু অফিসারের সমর্থন আমি পাবাে। অক্টোবরের মাঝামাঝি কোনাে একদিন সেনাসদরে একজন পিএসও-র অফিসে রক্ষীবাহিনীর দুই প্রভাবশালী কর্মকর্তা আনােয়ারুল আলম শহীদ ও সারােয়ারের সঙ্গে অবৈধ সরকারকে প্রতিরােধ করার ব্যাপার নিয়ে আলাপ করি। তারা আমার সঙ্গে একমত হলেন। আমি একথা বলার সময় পিএসও অফিস কক্ষের বাইরে ছিলেন। তিনি অফিসে ফিরতে ফিরতে আমার কথা খানিকটা শুনে ফেলেছিলেন। রুমে ঢুকে পিএসও বললেন, ‘স্যার, আপনি যদি এসব ষড়যন্ত্র করেন আমি রিপাের্ট করবাে। এই ছিল তখন সরকারের বিভিন্ন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তার মানসিক অবস্থা। ভীত সন্ত্রস্ত সবাই। উল্লেখ্য, সামরিক বাহিনীতে রক্ষীবাহিনীর ইউনিটগুলাের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া চলছিল সে সময়। অক্টোবরের মাঝামাঝি রাষ্ট্রপতির প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা ওসমানী বঙ্গভবনে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের একটা কনফারেন্স ডাকেন। বঙ্গভবনের ভেতরে সেটাই আমার প্রথম প্রবেশ-ঘটনা। কনফারেন্সে ওসমানী সবাইকে রাষ্ট্রপতি মােশতাক ও তার সরকারের প্রতি অনুগত থাকার নির্দেশ দেন। যে-কোনাে রকম অবাধ্যতা সমূলে উৎখাত করা হবে বলে জানালেন তিনি। ওসমানী এরপর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন রেজিমেন্টের সিনিয়র জেসিও-দের কাছে ডেকে নিয়ে বলতে লাগলেন, যারা সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করবে তারা ভারতীয়দের প্ররােচনাতেই তা করবে, তারা সব ভারতীয় এজেন্ট।
এসব কথা বলে, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও অভূত্থান-বিরােধীদের ‘ভারতের দালাল” লেবেল সেঁটে দেয়া হলাে। অক্টোবরের শেষ নাগাদ ৪৬ ব্রিগেডের বিকল্প গড়ে তােলার উদ্দেশ্যে কর্নেল মান্নাফের (পরে মেজর জেনারেল অব.) অধীনে সাভারে আরেকটি ব্রিগেড গঠন প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। দৃশ্যত ঢাকা ব্রিগেডের ক্ষমতা সীমিতকরণের লক্ষ্যেই সেটা করা হয়েছিল। এসব থেকে আমার ধারণা হলাে, বেশিদিন আর অপেক্ষা করা যাবে না। অক্টোবরের শেষার্ধে সেনাবাহিনীর প্রমােশন বাের্ডের সভা অনুষ্ঠিত হয়। উদ্দেশ্য মেজর র্যাঙ্কের অফিসারদের যােগ্যতার ভিত্তিতে লে. কর্নেল র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেয়া। রশিদ, ফারুক ও ডালিমের নামও এই বাের্ডে উপস্থাপিত হয় বিবেচনার জন্য। প্রমােশনের পরিবর্তে তাদের বিচারের ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করি আমি। আমাকে সমর্থন করেন তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল কিউ.জি, দস্তগীর, ব্রিগেডিয়ার সি, আর, দত্ত এবং কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল আমজাদ আহমেদ চৌধুরী। দুঃখের বিষয়, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায়ে আমাদের বিরােধিতা খড়কুটোর মতাে ভেসে যায়।
দস্তগীর সম্পর্কে আর একটি কথা বলতেই হয়। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের পর গােটা বাংলাদেশে যেখানে হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদও হয় নি, সেখানে দস্তগীর তার নিজের দায়িত্বে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের কোনাে কোনাে নেতাকে প্রতিবাদ মিছিল বের করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। পাকিস্তানপ্রত্যাগত এই অফিসারটি তখন চট্টগ্রামের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা যে-কোনাে কারণেই হােক মিছিল বের করা থেকে নিবৃত্ত  অক্টোবরের ২৮/২৯ তারিখ হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ আমাকে বললেন, কিছু কী ভাবছাে? এরকমভাবে দেশ ও আর্মি চলতে পারে না। জিয়া এগিয়ে আসবে না। ডু সামথিং।’ ব্রিগেডিয়ার খালেদের সঙ্গে রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানের আলাপ হয়েছিল এ ব্যাপারে। খালেদ আমার মত চাইলেন। আমি বললাম, ‘আপনি দিন-তারিখ বলেন। আমি প্রস্তুত।’  ২৯ অক্টোবর রাত ১১টায় জিয়া আমাকে তার অফিসে ডাকলেন। ডেকে আমাকে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে মেজর শাহরিয়ার অশালীন ব্যবহার করেছে। জিয়া বললেন, ‘এরা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছে। ট্যাঙ্কগুলাে থাকাতেই ওদের এতাে ঔদ্ধত্য। তুমি একটা এক্সারসাইজের আয়ােজন করে ট্যাঙ্কগুলাে সাভারের দিকে নিয়ে খাও। আমি উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলাম, কবে নাগাদ এটা করবাে। জবাবে জিয়া বললেন, ‘জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে করাে।’ আমি চুপসে গেলাম। আমরা ভাবছিলাম দু’একদিনের মধ্যেই কিছু করার কথা, অর জিয়া কি না ট্যাঙ্ক বাইরে নিতে বললেন আরাে ২/৩ মাস পর! আমার মনে হলাে, জিয়াকে নিয়ে কিছু করা যাবে না। বরং খালেদ মােশাররফের সঙ্গেই কাজ করা যাক। ১ নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান ও আমি খালেদের অফিসে বসলাম । বিস্তারিত আলােচনার পর খালেদ সিদ্ধান্ত দিলেন ২ নভেম্বর দিবাগত রাত দুটোয় বঙ্গভবনে মােতায়েন আমার দুটো কোম্পানি ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসবে, সেটাই হবে আমাদের অভ্যুত্থান সূচনার ইঙ্গিত।
অ্যুত্থান শুরু
পরিকল্পনামতাে রাত তিনটায় বঙ্গভবনে মােতায়েন প্রথম বেঙ্গলের কোম্পানি দুটো ক্যান্টনমেন্টে চলে এলাে। আমার স্টাফ অফিসারবৃন্দ- মেজর নাসির, মেজর ইকবাল, মেজর মাহমুদ এবং এম.পি. অফিসার মেজর আমিন অভ্যুত্থান শুরুর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সেনাপ্রধান জিয়াকে ১৫ আগস্টের খুনি বিদ্রোহকারীদের কবল থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্য ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহর নেতৃত্বে প্রথম বেঙ্গলের এক প্লাটুন সেনা পাঠানাে হলে তাকে নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রাখতে। মেজর নাসির ও মেজর আমিনকে পাঠালাম ট্যাঙ্ক বাহিনী হেড কোয়ার্টারে। নাসির ট্যাঙ্ক বাহিনীর অফিসার ছিল বলে সুবিধা হবে ভেবে তাকেই সেখানে পাঠাই। এর আগে আমি একদিন ট্রপস্ পরিদর্শনে গেলে রেডিওতে মােতায়েন গােলন্দাজ বাহিনীর কোনাে কোনাে অফিসার আমাকে গােপনে যে আভাস দিয়েছিল, সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি। কিন্তু ট্যাঙ্ক বাহিনীতে গিয়ে মেজর নাসির ও মেজর আমিনের অভিজ্ঞতা হলাে উল্টো। উদ্দেশ্য শুনে তাদেরকে বন্দি করে ফেলা হলাে। বঙ্গভবনে থেকে ফারুক তাদের মেরে ফেলার হুকুম জারি করলাে।
অন্যদিকে ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ জিয়ার বাসায় গিয়ে তাকে প্রােটেক্টিভ কাস্টডিতে এনে নিষ্ক্রিয় করে ফেললাে। তাঁর বাসার টেলিফোন বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হলাে। খুনি মােশতাক-রশিদ চক্রের কবল থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে রাখাই ছিল এর উদ্দেশ্য। টিভি ও রেডিওতে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারির যে অফিসাররা অবস্থান করছিল তারা আমার নির্দেশে ঠিক দুটোয় ফারুক-রশিদের আনুগত্য ত্যাগ করে রেডিও-টিভি বন্ধ করে দেয়। আমার ওসি সিগন্যাল কোম্পানির মেজর মুসা কেন্দ্রীয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। সেনাসদরের মেজর লিয়াকত (পরে লে. কর্নেল অব.) এ ব্যাপারে তাকে পুরােপুরি সহযােগিতা করে। বঙ্গভবনে মােতায়েন বিদ্রোহীপেগ্ন ট্যাঙ্ক আক্রমণের চেষ্টা করলে তা প্রতিহত করার জন্য সােনারগাঁও হােটেলের ক্রসিংয়ে পাঠানাে হলাে এক কোম্পানি সৈন্য। এক কোম্পানি পাঠানাে হলাে সায়েন্স ল্যাবরেটরি মােড়েও। এই কোম্পানি দুটো ছিল প্রথম বেঙ্গলের। ৩ নভেম্বর সকাল আটটার মধ্যে এরা অবস্থান গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। ক্যান্টনমেন্ট ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টার থেকে যাতে হামলা না আসতে পারে সেজন্য দ্বিতীয় বেঙ্গলের ২ কোম্পানি গেলাে রাস্তা বন্ধ করতে। বিমানবন্দরের রানওয়ের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত রইলাে বঙ্গভবন থেকে প্রত্যাহৃত ২টি কোম্পানি। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী একজন অফিসার হলেন রক্ষীবাহিনী থেকে সদ্য রূপান্তরিত একটি পদাতিক সেনা ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুল গাফফার হালদার। লে. কর্নেল গাফফার ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের বিদ্রোহী ট্যাঙ্কগুলাে যাতে আমাদের হেড কোয়ার্টারে হামলা চালাতে না পারে, সেজন্য ৩ নভেম্বর সকাল আটটার মধ্যেই স্টাফ রােড রেলওয়ে ক্রসিংয়ে রােডরক স্থাপন করেন। | চতুর্থ বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসারের দফতরে আমাদের থাকার কথা ছিল রাত দুটোয়।
আমি তখন থেকে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করি। কিন্তু খালেদ মােশাররফ বা নুরুজ্জামান কারােরই দেখা নেই। এতােদিন অন্য যারা প্রতিনিয়ত বলতেন একটা কিছু করার জন্য, তাদেরও দেখা নেই। রুদ্ধশ্বাস দীর্ঘ অপেক্ষার পর খালেদ মােশাররফ এলেন শেষ রাতে চারটার দিকে। ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান এসেছিলেন সকালে। ততােক্ষণে হেলিকপ্টার ও মিগ ফাইটার আকাশে। যাহােক, আমরা গুটিকয়েক লােক যখন অসীম উকণ্ঠার মধ্যে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছি, শুনতে পেলাম দ্বিতীয় বেঙ্গলের সিও লে. কর্নেল আজিজুর রহমান (বর্তমানে মে. জেনারেল) হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। অবশ্য তার বদলে তার অধীনস্থ ক্যাপ্টেন নজরল ২ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়। সিও সাহেব বােধহয় ভােরবেলা আকাশে হেলিকপ্টার আর মিগ দেখে আশ্বস্ত হন যে সাফল্য আমাদের নিশ্চিত। তিনি সকাল হয়ে যাওয়ার পর এসে হাজির হন এবং অতি উত্সাহ দেখাতে থাকেন। উল্লেখ্য, ৩ নভেম্বরের আগ পর্যন্ত এই কমান্ডিং অফিসারটি বেশ কয়েকবার আমার সঙ্গে দেখা করে বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তাগিদ দেন। তাঁর অধীনস্থ কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন নজরুলকেও একবার তিনি সঙ্গে করে আনেন। অথচ একই ব্যক্তি ৭ নভেম্বরের বিপর্যয়ের পর অবলীলায় রাজসাক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তৎকালীন সামরিক কর্তৃপক্ষ এই অফিসারটিকে দিয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়ায়। তাকে দিয়ে বলানাে হয় যে, আমাদের সঙ্গে নাকি ভারতীয়দের যােগসাজশ ছি। কী জঘন্য মিথ্যাচার! তার মিথ্যা সাক্ষ্য আমাৰ মৃত্যুদণ্ডের জন্য ছিল যথেষ্ট। বিচার তাে আর করতে পারে নি জিয়া এবং তাঁর সহযােগীরা! সে কথায় পরে আসছি। যাই হােক স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতের মাধ্যমে বিমান বাহিনীর সহায়তা নিশ্চিত করা হয়।
২ নভেম্বর মধ্যরাতে স্কোয়াড্রন লিডার ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পর্যায়ের ১০ জন অফিসার আমাদের সঙ্গে যােগ দিলেন। তখন তেজপাও এয়ারপাের্টে রাতে জঙ্গিবিমান ওড়ানাের সুবিধা ছিল না। তবে বিমান বাহিনীর অফিসাররা কথা দিলেন ফাস্ট লাইটে অর্থাৎ কাকডাকা ভােরেই তারা বিমান ওড়াবেন। তারা তাদের কথা রেখেছিলেন। ভােরে তারা একটি হেলিকপ্টার ও একটি ফাইটার যথাসময়ে আকাশে উড়িয়েছিলেন, যা দেখে বিদ্রোহীরা হতভম্ব হয়ে যায়।  বিমান বাহিনীর এই অসমসাহসী অফিসাররা মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে তাদের বিমান ও হেলিকপ্টারগুলাে শান্তিকালীন অবস্থান থেকে যুদ্ধকালীন সশস্ত্র অবস্থানে রূপান্তরিত করে কাকডাকা ভােরে ফাইটার প্লেন এবং হেলিকপ্টার উড়িয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে তাদের এই ক্ষিপ্রতায় হতভম্ব ও হতাশ হয়েই ১৫ আগস্টের খুনিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত, বদরুল আলম, জামাল এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশিদ, সালাহউদ্দিন, ওয়ালী, মিজান এবং ফ্লাইং অফিসার কাইয়ুম ও ফরিদুজ্জামান সেদিন এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ বিমানের একজন বৈমানিক ক্যাপ্টেন কামাল মাহমুদও আমাদের পক্ষে সেদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। আমি সশ্রদ্ধ চিত্তে তাদের এই অবদানের কথা স্মরণ করি।
অভ্যুত্থানের প্রথম দিন
ভাের হতে-না-হতেই চতুর্থ বেঙ্গলের অফিসে আমরা যে হেড কোয়ার্টার করেছিলাম, সেখানে অনেক অফিসার এসে সমবেত হলেন আমাদের সমর্থনে। মনে রাখা দরকার, রাত দুটোয় আমার দুইজন স্টাফ অফিসার ছাড়া কেউ ছিল না সেখানে। এখন অফিসারের ভিড়ে আমি বসার জায়গা পাই না। অসংখ্য অফিসারের মধ্যে বিমানবাহিনী এবং নৌবাহিনী প্রধানও উপস্থিত ছিলেন। বিমানবাহিনীতে আমাদের সমর্থক অফিসাররা যেসব ফাইটার ও হেলিকপ্টার আকাশে উড়িয়েছিলেন, সেগুলাে সারাদিন পর্যায়ক্রমে বঙ্গভবন আর ক্যান্টনমেন্টের উত্তরে অবস্থিত ট্যাঙ্ক বাহিনী ও সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপরে (যেখানে কিছু বিদ্রোহী সেনা ও ট্যাঙ্ক ছিল) বিমান আক্রমণের মহড়া চালায়। কোনাে ট্যাঙ্ক বিন্দুমাত্র মুভ করা মাত্রই সেগুলাের ওপর আঘাত হানার জন্য তৈরি ছিলেন বিমানবাহিনীর অকুতােভয় পাইলটরা। তারা আমার কাছে বারবার অনুরােধ করছিলেন air strick-এর অনুমতি চেয়ে। কিন্তু খালেদ মােশাররফ ও আমি এই সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম যে, ভ্রাতৃহত্যার কোনাে প্রয়ােজন নেই।
সকাল আটটা নাগাদ রংপুর ব্রিগেডের কমান্ডার কর্নেল হুদা টেলিফোনে আমাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন। কর্নেল হুদা বলেন, আমাদের প্রয়ােজনে যে-কোনাে সাহায্য করতে তিনি প্রস্তুত রয়েছেন। এরপর সারা দিনই তিনি আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেন। | নারী ও শিশুসহ নিরস্ত্র ব্যক্তিদের হত্যাকারীরা সবসময়ই কাপুরুষতার পরিচয় দিয়ে থাকে। প্রতিরােধের সাহস তাদের থাকে না। এ ক্ষেত্রে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীরা এক রকম বিনা প্রতিরােধেই আত্মসমর্পণ করে। তাদের পরাভূত করতে একটি গুলিও খরচ করতে হয় নি। টেলিফোন যুদ্ধেই পরাজয় মেনে নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে তারা।  ৩ নভেম্বর ভাের থেকে শুরু হয় ১৫ আগস্টের হত্যাকারী বিদ্রোহী অফিসার তথা ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে টেলিফোনে আমাদের বাক-যুদ্ধ। আমাদের দিকে খালেদ মােশাররফ এবং ওদিকে পর্যায়ক্রমে রশিদ, জেনারেল ওসমানী, সর্বোপরি, খন্দকার মােশতাক। দুপুরের পর আমাদের পক্ষ থেকে একটি negotiation team পাঠানাে হয় বঙ্গভবনে ৩/৪ জন অফিসারের সমন্বয়ে। খুনিরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।
তারা সংঘাতের পথ বেছে নেয়। প্রথমে তারা গরম গরম কথা বললেও সারা দিন হেলিকপ্টার ও মিগের মহড়া দেখে ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে প্রেসিডেন্ট মােশতাক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশত্যাগের জন্য সেফ প্যাসেজের অঙ্গীকার দাবি করলেন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। সে-সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে, বিদেশে চলে গেলেও প্রয়ােজনে পরে ইন্টারপােলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে। ঠিক হলো, ফারুক-রশিদ গংকে ব্যাঙ্কক পৌছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে বিমানবাহিনী প্রধান এম,জি, তাওয়াব। ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে আমাদের টেলিফোনে যখন বাকযুদ্ধ চলছিল, তখন ঘুণাক্ষরেও আমরা জানতে পারি নি জেলে চার জাতীয় নেতার হত্যাকাণ্ডের কথা। অথচ আগের রাতেই সংঘটিত হয়েছিল ঐ বর্বর হত্যাকাণ্ড। ওসমানী ও খলিলুর রহমান ঐ ঘটনার কথা তখন জানতেন বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু তারা আমাদের কিছুই জানান নি। জানালে এভাবে ১৫ আগস্টের খুনিদের নিরাপদে চলে যেতে দেয়া হতাে না। আমাদের নেগেসিয়েশন টিমকেও এ বিষয়ে কেউ কিছু আভাস দেয় নি। ইতিমধ্যে দুপুর দুটোর দিকে জিয়া তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। তিনি আমাকে একবার তার সঙ্গে দেখা করার জন্য খবর পাঠান; কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য সেটা হতাে কিছুটা ব্রিতকর । জিয়ার সঙ্গে আমার একটা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। একাত্তরে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছি আমরা। সব মিলিয়ে আমি একটা ব্রিতকর অবস্থায় ছিলাম বলে তার সঙ্গে দেখা করতে যাই নি। তবে জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার ভার আমার ওপর ছিল।
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, নিজেদের ক্ষমতা সংহত করার পর জিয়াকে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি করে পাঠিয়ে দেবাে। ৩ নভেম্বর রাত এগারােটার খুনিচক্র ব্যাঙ্কক অভিমুখে রওনা হয়। ঢাকা থেকে ওড়ার পর রিফুয়েলিংয়ের জন্য তারা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একবার নেমেছিল। এ সময়ের মধ্যে চতুর্থ বেঙ্গলের সিও লে. কর্নেল আমিনুল হককে বদলি করে তার জায়গায় বসানাে হলাে লে. কর্নেল আবদুল গাফফার হালদারকে। আমিনুল হককে খালেদ মােশাররফের পিএস করা হয়। এ ঘটনায় আমিনুল হক ক্ষুব্ধ হন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ও খালেদ আমিনুল হককে তার সেক্টর থেকে অন্যত্র বদলি করেছিলেন। আমার ধারণা, মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত কোনাে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই খালেদ মােশাররফ সম্ভবত তার ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিলেন। এই অফিসারটি পরে ৭ নভেম্বর জাসদ ও কর্নেল তাহেরকে কোণঠাসা করার ব্যাপারে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন জিয়ার পক্ষ নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী চক্রের সেনা অফিসাররা প্রায় সবাই ব্যাঙ্কক চলে যায়। তবে তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য একজন, আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনকে সম্ভবত কৌশলগত কারণে দেশে রেখে যাওয়া হয়। এ অফিসারটি ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে একটি আর্টিলারি গান দিয়ে সরাসরি ৭/৮ রাউন্ড ফায়ার করেছিল। লক্ষ্যভ্রষ্ট ঐ গােলায় মােহাম্মদপুর এলাকায় কয়েকজন বেসামরিক লােক হতাহত হয়। ৭ নভেম্বর রাতে এই মেজর মহিউদ্দিনই তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের নেতৃত্ব। | দিয়ে জিয়াকে মুক্ত করে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারিতে নিয়ে আসে।
অ্যুত্থানের দ্বিতীয় দিন : মােশতাককে গৃহবন্দি করা হলাে
৪ নভেম্বর সকাল দশটা নাগাদ স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডিআইজি ই,এ, চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে খালেদ মােশাররফ চতুর্থ বেঙ্গলের হেড কোয়ার্টারে এলেন। তাদের মুখেই প্রথম শুনলাম জেল হত্যাকাণ্ডের কথা। এ ঘটনার কথা শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে যাই। নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত কয়েক দিনের জন্য মােশতাককে স্বপদে বহাল রাখতে চেয়েছিলেন খালেদ মােশাররফ, যা আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সব দিক বিবেচনা করে মেনে নিই। চার জাতীয় নেতাকে জেলখানায় এভাবে হত্যা করার কথা শুনে আমি খালেদ মােশাররফকে বললাম, “মােশতাককে এক্ষুণি অপসারণ করুন আপনি। দুপুর এগারােটার দিকে খালেদ মােশাররফ বঙ্গভবনে গেলেন, যেখানে মােশতাক তার রাজনৈতিক সহযােগীদের নিয়ে অবস্থান করছিলেন। আমি হেড কোয়ার্টারে রইলাম সারা দিন। প্রায় সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত বসে আছি। চারদিকে নানা গুজব, নানা আশঙ্কা। অফিসারদের অনেকেই বেশ উত্তেজিত। তারা বলছেন, এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে অভ্যুত্থান কেন করলাম আমরা! ছ’টার দিকে তিনজন অফিসারকে নিয়ে বঙ্গভবনে গেলাম আমি। গিয়ে দেখি প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারির কক্ষে খালেদ মােশাররফ, তাওয়াবি এবং এম. এইচ, খান বসে আলাপ করছেন। দেখে মনে হলাে, বেশ হাল্কা মেজাজেই আছেন তারা। বঙ্গভবনে তখন কেবিনেট মিটিং চলছিল। খালেদকে আমি একটু গম্ভীরভাবেই বললাম, আপনি এগারােটার সময় এখানে এলেন আর সারা দিন কিছুই হলাে না, কিছুই জানালেন না। মােশতাক বৈঠক করছেন, ওদিকে অফিসাররা ক্ষিপ্ত। খালেদ অবস্থাটা বুঝতে পারলেন মনে হলাে। তিনিসহ আলাপরত তিনজনই উঠে বাইরে চলে গেলেন। আমি যাদের নিয়ে গিয়েছিলাম তাদের নিয়ে বসলাম। হঠাৎ উচ্চ কণ্ঠে চিঙ্কার শুনতে পেলাম।
মােশতাকের কণ্ঠ। তিনি বলছেন, ‘I have seen many Brigadiars and Generals of Pakistan Army. Don’t try to teach me!’ দরজা খুলে বেরিয়ে আমরা দেখি করিডােরে মােশতাক উত্তেজিতভাবে কথা বলছেন খালেদ মােশাররফের সঙ্গে। মােশতাকের পাশে দাড়িয়ে ওসমানী। ৪ নভেম্বর সকালে প্রথম বেঙ্গলের দুটো কোম্পানিকে বঙ্গভবনের নিরাপত্তার জন্য মােতায়েন করা হয়েছিল। একটি কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর ইকবাল (পরে অব. এবং মলী)। করিডােরে ইকবাল ও শ খানেক সৈন্যও ছিল। মেজর ইকবাল মােশতাকের কথার জবাবে ততােধিক উত্তেজিত হয়ে বললাে, ‘You have seen the Generals of Pakistan Army. Now you see the Majors of Bangladesh Army’, এর মধ্যে সৈনিকরা গুলি চালানাের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিল। ওসমানী সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে আমাকে দেখেই বলে উঠলেন, ‘Shafat save the situation. Don’t repeat Burma!” আমি গিয়ে ইকবাল ও মােশতাকের মধ্য দাঁড়ালাম। ইকবালকে বললাম, তুমি সরে যাও, আর মােশতাককে বললাম কেবিনেট কক্ষে ঢুকতে। কেবিনেট কক্ষে আমিও ঢুকলাম। দেখি এক প্রান্তে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমান বসা। তাকে দেখেই আমি তুললাম জেল হত্যাকাণ্ডের কথা। তাকে লক্ষ্য করে বললাম, ‘আপনি চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ, প্রায় ৪০ ঘণ্টা হয়ে গেছে জেলখানায় জাতীয় নেতাদের হত্যা করা হয়েছে, তারও ঘণ্টা কুড়ি পর দেশ ত্যাগ করেছে খুনিরা, আপনি এসবই জানেন কিন্তু আমাদের বলেন নি কিছুই। এই ডিসগ্রেসফুল আচরণের জন্য আমি আপনাকে অ্যারেস্ট করতে বাধ্য হচ্ছি।’ খলিল কোনাে কথা বললেন না। আমি যখন এদিকে ব্যস্ত, কেবিনেট ককে তখন খালেদ মােশাররফের এডিসি ক্যাপ্টেন হুমায়ুন কবির ও কর্নেল মালেক (পরে অব, এবং ঢাকার মেয়র) ভাষণ দিচ্ছিলেন। যাই হােক, এরপর আমি মােশতাককে ধরলাম। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার আনুষ্ঠানিক মর্যাদা রক্ষা করেই বললাম, ‘স্যার, আপনি আর এই পদে থাকতে পারবেন না। কারণ আপনি একজন খুনি।
জাতির পিতাকে হত্যা করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন। জেল হত্যাকাণ্ড আপনার নির্দেশে হয়েছে। এসব অপরাধের জন্য বাংলার জনগণ আপনার বিচার করবে। আপনি অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। আপনার পদত্যাগের পর সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রেসিডেন্ট হবেন।’ অমি একথা বলা মাত্রই মন্ত্রী ইউসুফ আলী প্রতিবাদ করে বললেন, ‘কোন্ বিধানে এটি হবে?’ তিনি আরাে বললেন, প্রেসিডেন্ট পদত্যাগ করলে ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং তার অনুপস্থিতিতে স্পিকার হবেন প্রেসিডেন্ট। আমি জবাব দিলাম, খন্দকার মােশতাক যে বিধানে আজ প্রেসিডেন্ট একই বিধানে প্রধান বিচারপতিকে প্রেসিডেন্ট করতে হবে। মােশতাককে ক্ষমতায় বসানাের জন্য যেমন সংবিধান সংশােধনের প্রয়ােজন, এক্ষেত্রেও তেমনি করতে হবে।’ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করার জন্যও তাকে আমি চাপ দিলাম। জিয়ার পদত্যাগপত্র গ্রহণ এবং খালেদকে নিযুক্তি দিতে মােশতাক প্রথমে অপারগতা প্রকাশ করে বললেন, ব্যাপারটা নিয়ে তিনি ওসমানীর সঙ্গে আলােচনায় বসতে চান। যাই হােক, আমার অনমনীয়তায় শেষ পর্যন্ত মােশতাক এটা মেনে নিতে বাধ্য হন।
আমি মিটিং কক্ষে ঢােকার আগে কেবিনেট জেল হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে লােক দেখানাে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। আমি বললাম, ঐ কমিটিতে কাজ হবে না। হাইকোর্টের বিচারকের নিম্নপদের কেউ এতে থাকতে পারবে না। এ কথা বলে আমি বেরিয়ে এলাম।  কর্নেল মালেক প্রয়ােজনীয় কাগজপত্র তৈরির দায়িত্ব নিলেন। মােশতাকের পদত্যাগপত্র, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফকে প্রমােশনসহ চিফ অফ স্টাফ করা এবং জেলহত্যা তদন্ত কমিশন গঠনসহ বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি হলাে। প্রেসিডেন্ট মােশতাক তাতে সই করলেন।  এদিকে, খালেদের পিএস লে. কর্নেল আমিনুল হক জেলহত্যার ব্যাপারে জেল কর্তৃপক্ষের ভাষ্য টেপ রেকর্ডারে রেকর্ড করলেন। ৬ নভেম্বর টেপটা আমি পাই। ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে আমার অফিসের চেস্ট অফ ড্রয়ারে সেটা রাখি। পরে আর কখনাে হেড কোয়ার্টারে যেতে পারি নি আমি। ৭ নভেম্বরের অ্যুত্থানের পর ব্রিগেড কমান্ডারের দায়িত্ব পান আমিনুল হক। তিনিই এই টেপের কথা বলতে পারবেন।  মােশতাককে গৃহবন্দি করে রাখা হলাে প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে। তার মন্ত্রীদের মধ্যে ১৫ আগস্টের ও জেল হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযােগে শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, ওবায়দুর রহমান, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ও নুরুল ইসলাম মঞ্জুরকে পাঠানাে হলো সেন্ট্রাল জেলে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের পর রাত বারােটার দিকে বঙ্গভবন থেকে বাসায় ফিরে এলাম আমি।
অ্যুত্থানের তৃতীয় দিন
: ক্ষমতা দখল করতে চান নি খালেদ মােশাররফ ৫ নভেম্বর সকালে বিডিআর-এর ডিজি মেজর জেনারেল দস্তগীর আমার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে আসেন। প্রবীণ ও আস্থাভাজন মেজর জেনারেল দস্তগীরকে আমি অচলাবস্থার কথা উল্লেখ করে জানাই, সেনা হেড কোয়ার্টার কোনাে কিছুতেই উদ্যোগ নিচ্ছে না। তড়িৎগতিতে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য খালেদ মােশাররফের ওপর প্রভাব খাটাতে আমি তাকে অনুরােধ করলাম। দু’দিন ধরে রেডিও-টিভি বন্ধ। দেশময় উকণ্ঠা, নানা আশঙ্কা। ইতিমধ্যে আমি এবং আরও অনেকে খালেদ মোশাররফকে বারবার অনুরোধ করি রেডিও-টিভিতে জাতিকে সবকিছু অবহিত করে একটা ভাষণ দেয়ার জন্য। খালেদের এক কথা, নতুন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিই কেবল ভাষণ দেবেন।
খালেদ মােশাররফ সম্পর্কে অনেক মিথ্যাচার হয়েছে এদেশে। ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তিনি দেশের ক্ষমতা দখল করতে চান নি এবং করেনও নি। বারবার অনুরােধ সত্ত্বেও তিনি দায়িত্ব নিয়ে রেডিও-টিভিতে ভাষণ দিতে চান নি। ক্ষমতা দখলের লােভ থাকলে তিনি সেটা অনায়াসেই করতে পারতেন। ক্ষমতালােভী বা উচ্চাভিলাষী কোনােটাই ছিলেন না খালেদ মােশাররফ। তিনি ছিলেন শৃঙ্খলার প্রতি নিবেদিত একজন দক্ষ সেনানায়ক। তাঁর সেনাপ্রধান নিযুক্তি অথবা প্রমােশন তিনি নিজের উদ্যোগে নেন নি। আমরা আমাদের প্রয়ােজনে তাকে সেটা করেছিলাম।  যাই হােক, ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকেই প্রেসিডেন্টের ভাষণের একটা কপি তৈরি করলাম আমরা। মেজর জেনারেল দস্তগীরকে সঙ্গে করে সেনাসদরে গেলাম। বেশ কয়েকজন (১৫/২০ জন হবে) সিনিয়র অফিসারকে নিয়ে খালেদ মােশাররফ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করার জন্য বৈঠকে বসলেন। আমাদের তৈরি ভাষণের খসড়া নিয়ে প্রায় সারাদিন আলােচনা করলেন তিনি। এ ভাষণটিই প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় ১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশে পাঠ করেন নবনিযুক্ত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েম।  রাষ্ট্রপতি সায়েমের ভাষণে আমাদের অগােচরে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সেটি হচ্ছে সংসদ ভেঙে দেয়া। পরে শুনেছি খন্দকার মােশতাকের আস্থাভাজন শফিউল আজম (যিনি বঙ্গভবনে একজন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে অবস্থান করছিলেন) অনাকাঙ্ক্ষিত এই কাজটি করেন। বিচারপতি সায়েমের ভাষণের মূল ভাষ্য ছিল ৬ মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন হবে, আইনশৃঙ্খলা পুনর্ধতিষ্ঠা করা হবে, সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরবে ইত্যাদি। সবাইকে সাৱ ৱ দায়িত্ব নির্ভয়ে পালন করতে বলা হলাে।
আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ১৫ আগস্টের অভূত্থান ও হত্যাকাণ্ড করেছে উচ্ছল কিছু সেনাসদস্য, যার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয় এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করা হবে।  ৫ নভেম্বর সন্ধ্যায়ই আমরা বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরােধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাতেই খালেদ মােশাররফ, এম. জে. তাওয়াব এবং এম, এইচ, খানসহ আমরা বিচারপতি সায়েমের বাসভবনে গেলাম। সায়েম ধৈর্য সহকারে খালেদের বক্তব্য শুনলেন। এর আগে অবশ্য তাকে একবার বঙ্গভবনে ডেকে এনে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথাটি জানানাে হয়েছিল। যাই হােক, সায়েম এখন খালেদের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাবটি পেয়ে শারীরিক অসুস্থতার কথা বলে প্রথমে অস্বীকৃতি জানালেন। আমরা কিছুটা পিড়াপিড়ি করায় বললেন, পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিচারপতি সায়েম তক্ষুণি উঠে গিয়ে ঘরের ভেতরে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেন। অতি অল্পসময়ের মধ্যেই। ফিরে এলেন তিনি। এতাে তাড়াতাড়ি যে, আমাদের মনে হলাে যেন এক দরজা দিয়ে বেরিয়ে অন্য দরজা দিয়ে ঢুকলেন তিনি। এ সময়ের মধ্যে কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন, তা তিনিই জানেন। তাে, সায়েম এসেই বললেন, আলহামদুলিল্লাহ।’
দুঃখের বিষয়, বিচারপতি সায়েমকে আমরা রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত করলাম, কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেন তিনি। আপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগ দিলেন না আমাদের ৩ নভেম্বরের অত্যুথানে অংশ নিয়ে আমরা কোনাে অপরাধ করে থাকলে বিচারপতি সায়েমের নিয়ােগও একটি অপরাধ নয় কি? আমাদের বরখাস্ত করার আগে তাঁর নিজের পদত্যাগ করা উচিত ছিল না কি? বিভিন্ন সময়ে আমাদের বিচারপতিদের মধ্যে যারা সর্বোচ্চ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন, তাদের অনেকেই যে মেরুদণ্ডহীনতার নজির স্থাপন করেছেন, বিচারপতি সায়েম তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামরিক শাসক এরশাদের নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরীর পাঠকৃত শপথবাক্যে ছিল, “সিএমএলএ (এরশাদ) কর্তৃক যা করতে বলা হবে তাই করতে বাধ্য থাকবাে’—এ ধরনের একটি বাক্য! জিয়া হত্যা মামলায় কোর্ট মার্শালের এক প্রহসনমূলক বিচারে ১৩ জন মুক্তিযােদ্ধা অফিসারের ফাঁসির আদেশ হয়। তৎকালীন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ফাঁসির আদেশ স্থগিত করার জন্য রিট আবেদনটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বিচারপতি সাত্তার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও এরশাদকে সুযােগ করে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের। এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের অনেক আগেই বিভিন্ন সাক্ষাৎকার এবং বক্তৃতার মাধ্যমে তার অভিপ্রায় সম্পর্কে জানান দিয়েছিলেন। তখন তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে পদচ্যুত এবং গ্রেফতার করা যেতাে। মেরুদণ্ডহীন বিচারপতি সাত্তার তখন প্রয়ােজনীয় আইনানুগ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হলে বাংলাদেশের সিভিল সমাজের চেহারা নিঃসন্দেহে উন্নততর হতাে বলে আমার ধারণা। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইয়িদ চৌধুরী সহজেই বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হয়েছিলেন। এর কি কোনাে প্রয়ােজন ছিল?
এদিকে ৫ নভেম্বর সেনাপ্রধান খালেদ মােশাররফ রংপুর ব্রিগেড থেকে ২ ব্যাটালিয়ন এবং কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে ১ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় পাঠানাের নির্দেশ দিয়েছিলেন। যে কারণেই হােক খালেদ মােশাররফ এ ব্যাপারে আমার পরামর্শ নেন নি বলে বিষয়টি আমি জানতাম না । ৬ নভেম্বর সকালে রংপুর ব্রিগেডের সৈন্যরা ঢাকায় উপস্থিত হলে আমি বিষয়টি জানতে পারি। রংপুর ব্রিগেডের দশম বেঙ্গল এসে অবস্থান করছিল শেরে বাংলা নগরে। অন্যটির কিছু অংশ সাভারে, বাকি অংশ নগরবাড়িঘাটে। এই ব্যাটালিয়নটির কমান্ডিং অফিসার ছিলেন লে. কর্নেল জফর ইমাম। তিনি স্বউদ্যোগে ৪ নভেম্বর রাতেই আমাদের সঙ্গে বঙ্গভবনে মিলিত হন। আমার অজ্ঞাতে অতিরিক্ত সৈন্য আনার এমন ঘটনা ঘটায় আশ্চর্য হই, খটকাও লাগে । যাই হােক, কুমিল্লা থেকে যে
ব্যাটালিয়নটিকে আসতে বলা হয়েছিল তারা আর শেষ পর্যন্ত আসে নি। অজ্ঞাত কারণে কর্নেল আমজাদ তাদের পাঠানাে থেকে বিরত থাকেন। এদিকে ৫ নভেম্বর সকাল থেকেই যশােরের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত আলী (পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে যিনি খালেদ মােশাররফের সতীর্থ এবং শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন) অনবরত ফোন করতে থাকেন ঢাকায় আসার অনুমতি দেয়ার জন্য। এমন কি মীর শওকতের স্ত্রীও খালেদ মােশাররফের স্ত্রীকে অনুরােধ করেন খালেদকে এ ব্যাপারে রাজি করানাের জন্য। এ বিষয়টি এখানে বিশেষ করে উল্লেখ করছি এজন্য যে, গত পাঁচ বছরে টেলিভিশনে ৭ নভেম্বর উপলক্ষে প্রচারিত অনুষ্ঠানে প্রতিবার মীর শওকত তার ঢাকায় আসার একটি মিথ্যা ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন, যা অনেককে বিভ্রান্ত করে থাকতে পারে। মীর শওকত বলেছেন, তাকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করা হয়। তাকে নাকি আনুগত্য প্রকাশের জন্য হুমকি দেয়া হয় এবং এর অন্যথা হলে যশাের ক্যান্টনমেন্টে বিমান হামলার ভয় দেখানাে হয়।
প্রকৃতপক্ষে একথা ডাহা মিথ্যে এবং এসবের কোনাে প্রয়ােজনই ছিল না। কেননা আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলাে মােশতাক-রশিদফারুক চক্র, মীর শওকত নয়। ঐ সময়ের বাস্তবতায় মীর শওকতের গুরুত্ব ছিল খুবই সামান্য।  খালেদ মােশাররফ মীর শওকতের উপর্যুপরি টেলিফোনে বিরক্ত হয়ে ওঠেন। অবশেষে খালেদ তাকে ঢাকায় আসার অনুমতি দেন। মীর শওকত ৬ নভেম্বর বিমানযােগে ঢাকায় আসেন। খালেদ মােশাররফের সঙ্গে তার দীর্ঘ ২/৩ ঘণ্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়। আমার ধারণা, বৈঠকে তারা বােধহয় জিয়ার ভাগ্য নিয়ে আলােচনা করে থাকবেন। আমার এটাও মনে হয়, পরবর্তীকালে খালেদের মর্মান্তিক মৃত্যুতে একটি বড়াে ভূমিকা ছিল ঐ রুদ্ধদ্বার বৈঠকের। আমার ধারণা একেবারে কল্পনাপ্রসূত নয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ৩ নভেম্বরের ঘটনায় জড়িত আটক অফিসারদের পরিদর্শনের জন্য মীর শওকত ৭ নভেম্বরের পর গণভবনে যান। ঐ অফিসারদের সেখানে বিচারের অপেক্ষায় কড়া পাহারায় রাখা হয়েছিল। অথচ অফিসারদের লক্ষ্য করে তাদের সামনেই মীর শওকত গার্ড কমান্ডারের কাছে মন্তব্য করেন, Why try them? Line them up and shoot them like dogs.’ 07764 377 wf 19 শওকতের এই চরম প্রতিহিংসামূলক মন্তব্যে হতবাক হয়ে যান।  ৬ নভেম্বর দুপুরে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি সায়েমের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হলাে। দুপুর থেকেই বঙ্গভবন, সােহরাওয়ার্দী উদ্যান ইত্যাদি জায়গা থেকে ট্যাঙ্কগুলাে ক্যান্টনমেন্টে ফেরত আনা শুরু হলাে। সন্ধ্যার মধ্যে প্রায় সব ট্যাঙ্ক তাদের ইউনিট লাইনে চলে আসে। গােলন্দাজ রেজিমেন্টের কামানগুলাে লাইনে ফেরত এসেছিল ৪ নভেম্বরেই।
অভূত্থানের চতুর্থ দিন : সিপাহি বিপ্লব ও ঠাণ্ডা মাথায় খালেদকে হত্যা। ৬ নভেম্বর বিকেলে খবর পেলাম ক্যান্টনমেন্টে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামে একটি সংগঠনের উস্কানিমূলক লিফলেট ছড়ানাে হয়েছে। এ ধরনের কোনাে সংগঠনের অস্তিত্বের কথা সেদিনই প্রথম জানি আমরা। আগে কখনাে এ সম্বন্ধে কোনাে তথ্য আমাদের সরবরাহ করা হয় নি। এটা সামরিক গােয়েন্দা বিভাগের ব্যর্থতা বা তারা সেটা গােপন রেখেছিল। যাই হােক, শুনলাম, ক্যান্টনমেন্টে সৈনিকদের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। অফিসারদের বিরুদ্ধে কথাবার্তা চলছে তাদের মধ্যে। সেনাপ্রধান খালেদ মােশাররফ সৈনিকদের উত্তেজনা প্রশমিত করতে সন্ধ্যার দিকে ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টে গেলেন। আমিও ছিলাম তার সঙ্গে। সৈনিকদেরকে তিনি ধৈর্যশীল হওয়ার পরামর্শ দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেয়া হবে না বলে অঙ্গীকার ব্যক্ত করলেন। ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট থেকে ফিরে সেনাসদরে বৈঠক করলেন খালেদ। সৈনিকদের সমস্ত অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা করার নির্দেশ দিলেন তিনি। বললেন, পরদিন থেকে সৈনিকদের স্বাভাবিক ট্রেনিং শুরু হবে। সবদিক থেকে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনার তাগিদ দিলেন তিনি। ঐ বৈঠকের পরপরই আমি সেনাপ্রধানের নির্দেশ অনুযায়ী ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে গিয়ে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিলাম। রাত দশটার দিকে খালেদ মােশাররফের ফোন পেলাম। ফোনে তিনি আমাকে বঙ্গভবনে যেতে বললেন। বঙ্গভবনে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠছি, তখন ব্রিগেড মেজর হাফিজ আমাকে বললাে, “স্যার একটা জরুরি কথা আছে।” হাফিজ জানালাে, প্রথম বেঙ্গলের একজন প্রবীণ জেসিও বলেছে, ঐদিন রাত বারােটায় সিপাইরা বিদ্রোহ করবে। জাসদ এবং সৈনিক সংস্থার আহ্বানেই তারা এটা করবে।
খালেদ ও আমাকে মেরে ফেলার নির্দেশও সৈনিকদের দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে জেসিওটি। ঐ জেসিও, যিনি একজন সুবেদার ছিলেন, বলেছেন, আমাদেরকে এ কথা জানিয়ে সতর্ক করে দিতে। এগারােটার দিকে আমি বঙ্গভবনে পৌছুলাম। দুই বাহিনী (বিমান ও নৌ) প্রধানকে সেখানে দেখলাম। খালেদ তখনাে আসেন নি। তিনি এলেন ২০/২৫ মিনিট পর। শুনলাম, একটি দৈনিকের সম্পাদক তার বাড়িতে যাওয়ায় আটকে পড়েছিলেন খালেদ। পরে জেনেছি, ৩ থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত দুজন বিশিষ্ট সম্পাদক (একসময় যাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমি গােয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযােগ ছিল) প্রায়শই খালেদ মােশাররফের বাড়িতে যেতেন এবং পরামর্শের নামে তার মূল্যবান সময় নষ্ট করতেন। ৬ নভেম্বর রাতেও আমরা যখন বঙ্গভবনে অপেক্ষা করছি, এই দুই সম্পাদকের একজন তখন তার বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। মজার ব্যাপার হলাে, ৭ নভেম্বরের পর ঐ দুই সম্পাদকের কাগজেই খালেদ ও তার সহকর্মীদের ‘রুশ ভারতের দালাল’ বলে।
চিহ্নিত করে অশালীনভাবে বিষােদগার করা হতে থাকে। যাই হােক, খালেদ আমাকে ডেকেছিলেন একটা মধ্যস্থতার জন্য। সামরিক আইন প্রশাসকদের বিন্যাস কীভাবে হবে, তা নিয়ে অন্য দুই বাহিনী প্রধানের সঙ্গে তাঁর মতভেদ দেখা দিয়েছিল। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্টের অভুথানের অব্যবহিত পরপরই মােশতাক সামরিক আইন জারি করেন এবং নিজে চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর হন। সেই সঙ্গে স্থগিত করেন সংবিধানের কার্যকারিতা। তাে, খালেদ বলছিলেন যে সিএমএলএ বা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হওয়া উচিত সেনাপ্রধানেরই। কারণ সশস্ত্র বাহিনী কিছু করলে তার দায়দায়িত্ব সেনাপ্রধানের ওপরই বর্তায়। অন্য দুই প্রধানের দাবিতে প্রেসিডেন্ট সিএমএলএ এবং তিনজন (সেনা, বিমান ও নৌ-প্রধান) ডিসিএমএলএ হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমস্যা হতে পারে। অন্য দুই প্রধান সেনাপ্রধানের অভিমতের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে সেনাপ্রধান সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রশ্নে নাজুক অবস্থায় পড়বেন, এ ভাবনাও হয়তাে খালেদের মধ্যে ছিল। কথাবার্তার এক পর্যায়ে খালেদকে আমি ক্যান্টনমেন্টের পরিস্থিতির কথা বললাম। আমাদের যে হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাও জানালাম। তিনি বিশেষ গ্রাহ্য করলেন না আমার কথা। আমাদের কথাবার্তার মাঝপথেই বারােটার দিকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফোন এলাে। ফোনে বলা হলাে, সিপাইদের বিপ্লব শুরু হয়ে গেছে। তারা এলােপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ছে। এ কথা শােনার পর খালেদ মিটিং ভেঙে দিলেন। খালেদের সঙ্গে বঙ্গভবনে এসেছিলেন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল হুদা ও চট্টগ্রামের একটি ব্যাটালিয়নের কমান্ডার লে. কর্নেল হায়দার। হায়দার খুব সম্ভবত ছুটিতে ছিলেন এবং ঘটনাচক্রেই খালেদের সঙ্গে দেখা হয়ে যায় তার। | মিটিং ভেঙে দিয়ে হুদা ও হায়দারকে নিয়ে চলে গেলেন খালেদ মােশাররফ।
অন্য দুই চিফও চলে গেলেন। তবে খালেদ আমাকে বললেন বঙ্গভবনেই থাকতে। তিনি নিজে প্রথমে যান মােহাম্মদপুরে কোনাে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখান থেকে তারা যান রংপুর ব্রিগেড থেকে আসা দশম বেঙ্গলের অবস্থানস্থল শেরেবাংলা নগরে। রাত বারােটার পর সিপাইরা ফিল্ড রেজিমেন্টের মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে জিয়াকে মুক্ত করে ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে আসে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এই মেজর মহিউদ্দিনই ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য একটি আর্টিলারি গান থেকে ৩২ নম্বরের বাড়িতে গােলা ছুড়েছিল। শেষ রাতের দিকে দশম বেঙ্গলের অবস্থানে যান খালেদ। পরদিন সকালে ঐ ব্যাটালিয়নে নাশতাও করেন তিনি। বেলা এগারােটার দিকে এলাে সেই মর্মান্তিক মুহূর্তটি। ফিল্ড রেজিমেন্টে অবস্থানরত কোনাে একজন অফিসারের নির্দেশে দশম বেঙ্গলের কয়েকজন অফিসার অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় খালেদ ও তার দুই সঙ্গীকে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয় নি আজো। সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার হলে ৬ নভেম্বর দিবাগত রাত বারােটার পর ফিল্ড রেজিমেন্টে সদ্যমুক্ত জিয়ার আশপাশে অবস্থানরত অফিসারদের অনেকেই অভিযুক্ত হবেন এ দেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম সেনানায়ক ও বীর মুক্তিযােদ্ধা খালেদ মােশাররফকে হত্যার দায়ে। তথাকথিত সিপাহি বিপ্লবের অন্যতম নায়ক কর্নেল তাহের এবং তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দও এর দায় এড়াতে পারবেন না। সাতই নভেম্বর : “অফিসারদের রক্ত চাই” আগেই বলেছি ৬ নভেম্বর রাতে খালেদ মােশাররফ চলে যাওয়ার পরও আমি বঙ্গভবনে থেকে যাই তাঁরই নির্দেশে। খালেদের সঙ্গে আর যােগাযােগ হয় নি আমার । তারপর তাে “সিপাহি বিপ্লব ঘটে গেলাে।
রাত তিনটার দিকে জিয়া ফোন করলেন আমাকে বললেন, “Forgive and forget, let’s unite the Army.” আমি ঢ়ভাবেই বলি, “আপনি সৈনিকদের দিয়ে বিদ্রোহ করিয়ে ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। আপনি বাঘের পিঠে সওয়ার হয়েছেন, আর নামতে পারবেন না। যা করার আপনি অফিসারদের নিয়ে করতে পারতেন, সৈনিকদের নিয়ে কেন?” সেনাবাহিনীর মধ্যে হিংসা ও বিভেলের রাজনীতি ঢােকানাে হয়েছে বলেও ক্ষোভ প্রকাশ করি আমি এই সময় একটা আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। জিয়ার সঙ্গে আমার কথােপকথন হচ্ছিল ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে । আমাদের সংলাপের যে অংশগুলাে বাংলা ছিল তা সঙ্গে সঙ্গে লাইনে থাকা অন্য কেউ ইংরেজিতে ভাষান্তর করে দিচ্ছিল, যেটা আমি পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম। আমার কোনাে সন্দেহ নেই, বঙ্গভবনে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে এমন কেউ অবস্থান করছিল যে আমাদের সংলাপ বিদেশি কোনাে সূত্রের কাছে ভাষান্তর করে দিচ্ছিল। আমাদের রাষ্ট্রীয় গােপনীয়তা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা যে কতাে নাজুক এর থেকেই সেটা স্পষ্ট বােঝা যায়। খােদ বঙ্গভবনের ভেতরে অবস্থান করেই কেউ সে কাজটা করছিল। রাত সাড়ে তিনটা নাগাদ বঙ্গভবনের অদূরে ‘নারায়ে তাকবির, সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান শুনলাম। সেই সঙ্গে ফাকা গুলির আওয়াজ। দ্বিতীয় বেঙ্গলের দু’টি পদাতিক কোম্পানি তখন বঙ্গভবনের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল। এছাড়া ছিল রক্ষীবাহিনী থেকে সদ্য রূপান্তরিত পদাতিক ব্যাটালিয়নটির একটি কোম্পানি। এর দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল ক্যাপ্টেন দীপক। কোম্পানি কমান্ডারদের নির্দেশ দিলাম পজিশন নিতে এবং  বিদ্রোহী সৈনিক সংস্থার সদস্যরা গুলি করলে তাদের প্রতিরােধ করতে। ১৫/২০ মিনিট পর গুলি ও স্লোগান আরাে তীব্র এবং নিকটতর হয়ে উঠলাে।
আশ্চর্য হয়ে গেলাম যাদেরকে প্রতিরােধের জন্য পাঠিয়েছি তারা পাল্টা গুলি করছে না দেখে। তখন আমার বােপধাদয় হলাে, বিদ্রোহী সিপাইদের ঐ স্লোগানে তারাও immobilized হয়ে গেছে। তারা ওদের বিরুদ্ধে কিছুই করবে । এ ঘটনা দেখার পর আমার সঙ্গে থাকা অন্য একতন কোম্পানি কমান্ডার ক্যাপ্টেন দিদার আমাকে বললাে, “স্যার, চলুন আমরা বেরিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টে ঢােকার চেষ্টা করি।” ওদিকে ফায়ারিং ও শ্লোগান তখন একেবারে সামনে এসে গেলাে। উপায়ান্তর না দেখে দিদার ও কয়েকজন সৈনিককে নিয়ে আমি বঙ্গভবনের পেছনের পাঁচিল টপকে বেরিয়ে এলাম। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ সময় আমার পা ভেঙে যায়। যাই হােক, বাইরে থাকা একটি সামরিক ডজ গাড়িতে উঠলাম সবাই। এই অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া সমীচীন মনে হলাে না। আমার | তখন জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার প্রয়ােজন ছিল। ভেবে দেখলাম কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এখনাে শান্ত। তাই সেই অভিমুখেই রওনা হলাম। সেখানে গিয়ে সিএমএইচ-এ চিকিৎসা নেয়া যাবে। মেঘনা ফেরিঘাটে পৌছে মনে হলাে কুমিল্লা যাওয়াটাও ঠিক হবে না। এতােক্ষণে সেখানকার পরিস্থিতিও হয়তাে পাল্টে গেছে। সঙ্গী সৈনিকদের ফেরত পাঠিয়ে আমি ও দিদার নৌকায় করে মুন্সিগঞ্জ অভিমুখে রওনা হলাম। উল্লেখ্য, মেঘনা ফেরিঘাটে কর্মরত বিআইডটিসির কর্মচারীদের কাছ থেকে আমরা সাধারণ শার্ট আর লুঙ্গি নিয়ে ইউনিফরম ছেড়ে সেগুলাে পরে নিই।
নৌকায় ঘণ্টা দুয়েক চলার পর দেখলাম মুন্সিগঞ্জের এসডিও একটা লঞ্চ নিয়ে নারায়ণগঞ্জে যাচ্ছেন। আমি তার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে আমার  চিকিৎসার প্রয়ােজনীয়তার কথা বললাম। ক্যাপ্টেন দিদারের পরিচয় গােপন করে তাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম আমাকে সাহায্য করা এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হিসেবে। এসডিও আমাকে সঙ্গে করে নারায়ণগঞ্জ থানায় নিয়ে গেলেন। সেখানে পুলিশি হেফাজতে রাখা হলাে আমাকে। আর দিদার জনতার সাথে | মিশে গেলাে। নারায়ণগঞ্জ থানা থেকে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে জিয়ার সঙ্গে যােগাযোগ করলাম। জিয়ার পক্ষে মীর শওকত আমাকে বললেন, “তুমি ওখানেই থাকো। আমি লে. কর্নেল আমিনুল হককে পাঠাচ্ছি। সে তােমাকে নিয়ে আসবে।” | ঘণ্টা দুয়েক পর আমিনুল হক এলাে। তার সঙ্গে ২/৩টি গাড়িতে চতুর্থ। বেঙ্গলের কিছু সৈন্য। ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। ঢাকা পৌঁছে আমাকে সিএমএইচ-এ ভর্তি করা হলাে। এখানে এসেই শুনি খালেদ, হায়দার ও হুদার নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর। পরে শুনি মুক্তি পেয়ে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টে আসার পর জিয়া নিজে বলেছিলেন, “There should be no bloodshed. No retribution. Nobody will be punished without proper trial.” অথচ জিয়ার নির্দেশ উপেক্ষা করে এবং যাবতীয় শৃখলা ভঙ্গ করে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করা হয় সেনাবাহিনী তথা মুক্তিযুদ্ধের তিন বীর সেনানিকে।
হঠকারিতার চরম মূল্য
বিদ্রোহের পরিধি ক্রমশ বিভিন্ন ইউনিট-সাব ইউনিট পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। নিরাপত্তাহীনতার কারণে বহু অফিসার ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করেন। আমাদের অভ্যুত্থানের সঙ্গে কোনাে যােগ না থাকা সত্ত্বেও একজন লেডি ডাক্তারসহ ১৩ জন অফিসারকে তথাকথিত বিপ্লবী সৈনিকেরা গুলি করে হত্যা করে। বীর মুক্তিযােদ্ধা লে. কর্নেল আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রীকেও তারা হত্যা করে। জিয়াও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। ক্রমশ তিনি ৩ নভেম্বরের অভুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে কথিত ভারতীয় জুজুর ভয় দেখিয়ে সিপাহিদের নিয়ন্ত্রণে আনলেন। উল্লেখ্য, তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নেয়া এই সব সিপাহির বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান-প্রত্যাগত। মাসখানেক হাসপাতালে থাকার পর ৭ ডিসেম্বর রিলিজ করা হলাে আমাকে। তারপর পাঠানাে হলাে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে প্রােটেক্টিভ কাস্টডিতে। জেলে থাকাকালে জিয়া ও তার সহযােগীরা আমার বিরুদ্ধে ৭টি চার্জ তৈরি করেন, যার ৪টিই ছিল মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অপরাধ। একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হলাে। তদন্ত আদালতের প্রেসিডেন্ট জেলেই আমার উপস্থিতিতে সাক্ষীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করেন। বর্তমান মন্ত্রী লে. জেনারেল (অব.) নুরুদ্দিন খানসহ অনেকেই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে আসেন। তাদের মধ্যে তৎকালীন দ্বিতীয় বেঙ্গলের সিও-কে দেখে খুবই অবাক হলাম। প্রধান আসামি হিসেবে আমার পরই তার অবস্থান হওয়া উচিত ছিল।
তিনি রাজসাক্ষীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেকে রক্ষা করেন এবং চাকরি বজায় রাখেন। মামলা অবশ্য বেশি দূর এগােয় নি। এ সময় আরাে ১২ জন সেনা অফিসার তৎকালীন গণভবনে বন্দি ছিলেন। এই মুহূর্তে যাদের নাম মনে পড়ছে তারা হলেন : কর্নেল মালেক (পরে এমপি ও মেয়র), লে. কর্নেল গাফফার (পরে এমপি ও মন্ত্রী), লে. কর্নেল জাফর ইমাম (পরে এমপি ও মন্ত্রী), মেজর আমিন, মেজর হাফিজ (পরে এমপি ও মন্ত্রী), মেজর ইকবাল (পরে এমপি ও মন্ত্রী), ক্যাপ্টেন কবির ; ক্যাপ্টেন তাজ (পরে এমপি), ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ, ক্যাপ্টেন নাসির, ক্যাপ্টেন দীপক প্রমুখ। তিনজন অফিসার দেশত্যাগ করেন। এরা হলেন ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান (পরে রাষ্ট্রদূত, প্রয়াত), ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ওসমান (পরে এমপি) ও লেফটেন্যান্ট কাদের। এছাড়া এয়ারফোর্সের ১২/১৩ জন অফিসারকে আটক রাখা হয়েছিল বিমানবাহিনী এলাকায়। তাওয়াবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে চটজলদি তাদের বিচার শেষ করা হয়। স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকতকে মৃত্যুদণ্ড এবং অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে লিয়াকতের সাজা। কমিয়ে দেয়া হয় ১৪ বছরের জেল।  এদিকে গণভবনে আটক সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে চারজন মেজর হাফিজ, মেজর ইকবাল, ক্যাপ্টেন তাজ ও ক্যাপ্টেন হাফিজউল্লাহ এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে গিয়ে তারা আশ্রয় নেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত প্রথম বেঙ্গলে, যাদের নিয়ে আমরা অভ্যুথান শুরু করেছিলাম।
প্রথম বেঙ্গলকে ৭ নভেম্বরের পর জিয়া শাস্তিস্বরূপ ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। পালিয়ে যাওয়া চারজন অফিসারকে আশ্রয়দানকারী প্রথম বেঙ্গলের বক্তব্য ছিল, ঐ অফিসাররা কোনাে অপরাধ করে নি। তাদের যদি কোনাে বিচার করতে হয় তবে ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের বিচার আগে হতে হবে। কোনাে অবস্থাতেই প্রথম বেঙ্গলকে এ অবস্থান থেকে টলানাে গেলাে না। চারজন অফিসারকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত সৈনিকদের কাছ থেকে সরিয়ে আনার জন্য পর্যায়ক্রমে হেলিকপ্টারে করে নেগােসিয়েশন টিম, সিজিএস মেজর জেনারেল মঞ্জুর, এমন কি সেনাপ্রধান জিয়া একাধিকবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া গেলেন। পালিয়ে যাওয়া চার অফিসার ও সৈনিকদের সঙ্গে আলাপ করলেন সিনিয়র অফিসাররা। কিন্তু তারা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকলাে। অপরদিকে তাদের ওপর উর্ধ্বতন সেনা কর্তৃপক্ষের চাপও অব্যাহত থাকে। ১৯৭৬ সালের মার্চের প্রথমদিকে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার সেনাদল ঢাকা অভিযানের চূড়ান্ত ঘােষণা প্রদান করে। এতে সেনাপ্রধান জিয়া ও তার সহকর্মীদের টনক নড়ে ওঠে। তারা তড়িঘড়ি এক আপস ফর্মুলা দিলেন। বলা হলাে, আটক সব সেনা অফিসারকে ছেড়ে দেয়া হবে। তবে আর্মিতে না রেখে বেশির ভাগ অফিসারকে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। কেবল দৃষ্টান্ত হিসেবে একজন অফিসার- ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডার (অর্থাৎ আমার) বিচার করা হবে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত অফিসার ও সৈনিকেরা সেটা মানতে রাজি হলাে  তারা দাবি করলাে, কোনাে অফিসারের বিচার করা যাবে না এবং তাদেরকে চাকরিতে রাখতে হবে। বিক্ষুব্ধ সৈনিকরা সত্যি সত্যিই ঢাকা আসার উদ্যোগ নিলে জিয়া আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া যান এবং আশ্বস্ত করেন, কারাে বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে না। এবার তিনি ঐ চারজন অফিসারকে নিজে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন। তবে এতাে কিছুর পর ঐ চারজন অফিসার নিজেরাই আর সেনাবাহিনীতে থাকা সমীচীন মনে করে নি। অফিসার বা তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল কেউই আর তার জন্য চাপাচাপিও করে নি। তবে জিয়া প্রতিশ্রুতি দেন তাদেরকে কূটনৈতিক নিয়ােগ দিয়ে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। এই প্রতিশ্রুতি তিনি পালন করেন নি। যদিও জিয়াই ১৫ আগস্টের হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছিলেন।
১৯৭৬ সালের ৭ মার্চ ছাড়া পেলাম আমি। তৎকালীন ডিএমই লে. কর্নেল মােহসীন (পরে ব্রিগেডিয়ার এবং ফাসিতে নিহত) আমাকে সেন্ট্রাল জেল থেকে বাসায় পৌছে দিলেন। সেই সঙ্গে আমার হাতে ধরিয়ে দেয়া হলাে বরখাস্তের আদেশ। আমার চাকরিচ্যুতির ফাইলে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম। | ৭ নভেম্বরের সিপাহি বিপ্লব সম্পর্কে কিছু বলতে হয়। আসলে এতে অংশ নেয়া সৈনিকদের বেশির ভাগই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনাে একটি ব্যাটালিয়নও এর মধ্যে ছিল না। বিদ্রোহী সৈনিকদের স্লোগানে প্রভাবিত হয়ে তারা হয়তাে আমাদের সুরক্ষা দেয় নি, কিন্তু স্বয়ং উদ্যোগী হয়ে তারা আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করেও নি। অন্যদিকে আর্মির ট্রাডিশন ও চেইন অফ কমান্ড ভেঙে ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহের যে অপরাধ করেছিলেন, তার জন্য তিনি বিচারের সম্মুখীনও হয়েছিলেন। বিভিন্ন ব্যাঙ্কের মধ্যে আনুগত্যের যে বিধি ও ঐতিহ্য ছিল, তাকে চরমভাবে লঘন করেছিলেন কর্নেল তাহের। শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য, নিয়মশৃঙ্খলা এবং আনুগত্যের ভিতে ধস নামিয়েছিলেন তাহের ও জাসদের উদ্ভাবিত হঠকারী, আত্মঘাতী বিভিন্ন স্লোগান। আসলে, তাহের এবং তৎকালীন জাসদ নেতৃবৃন্দ জিয়াকে সামনে রেখে, জিয়ার মুক্তিযুদ্ধকালীন ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে মুচতুরভাবে ক্ষমতা দখলের প্রয়াস নেন ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। কিন্তু এতাে কিছুর পরও চেইন অফ কমান্ড এবং সেনাপ্রধান পদের অন্তর্নিহিত শক্তি ও আনুগত্যের কাছে তারা পরাজিত হন। আর তাহেরকে এর জন্য চরম মূল্যও দিতে হয়। 
যেদিন রাতে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়, সেদিন সন্ধ্যায় তাহেরের প্রধান কৌঁসুলি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল প্রয়াত আমিনুল হক (যিনি আমার একজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয়) আমাকে তার চেম্বারে নিয়ে যান। সেখানে উপস্থিত তাহেরের নিকটাত্মীয়রা তাহেরের প্রাণরক্ষার চেষ্টা করার জন্য আমাকে অনুরােধ জানান। কোনােভাবে প্রভাব খাটানাের মাধ্যমে তাহেরের মৃত্যুদণ্ড রদ করার জন্য আমি অত্যন্ত প্রভাবশালী তিন-চারজন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলি। কিন্তু দুঃখজনকভাবে ব্যর্থ হই। বিপ্লব কোথায় এবং কিভাবে হলাে ৩ নভেম্বরের অভুথান ছিল প্রকৃতপক্ষে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড এবং অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে একটি সশস্ত্র প্রতিবাদ। চারটি লক্ষ্যের মধ্যে দুটিতে সফলতা অর্জনে সক্ষম হয়েছিলাম আমরা – অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী বিদ্রোহীদের বলপূর্বক অপসারণ করা হয় এবং বিদ্রোহী ইউনিটগুলােকে চেইন অফ কমান্ডে ফিরিয়ে আনা হয় আমাদের উল্লিখিত প্রয়াসের ভেতর দিয়ে। খুনিদের বিচারের ব্যবস্থা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় নি ঘটনার নিয়ন্ত্রকরূপে আমাদের ক্ষমতার ক্ষণস্থায়িত্বের কারণে। জনগণই বিচার করবেন, আমার বক্তব্যের আলােকে, ৩ নভেম্বরের অভ্যুত্থান একটি দেশপ্রেমিক পদক্ষেপ ছিল কি না? আমরা দৃশ্যপট থেকে অপসৃত হয়েছিলাম সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি গােষ্ঠীর কর্মকাণ্ডের পরিণতিতে। ৭ নভেম্বরের ঘটনাবলি কোনাে পাল্টা অভ্যুত্থান ছিল।
মােশতাক-রশিদ-ফারুক চক্র এই পাল্টা অভ্যুত্থান ঘটায় নি এবং সে জন্য তারা ক্ষমতায়ও ফিরে আসতে পারে নি। জিয়ার ভাবমূর্তি কাজে লাগিয়ে জাসদ ও কর্নেল তাহেরই ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা চালায় ৭ নভেম্বর। সেই দিনের অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টায় তাদের কোনাে বিপ্লবী রাজনীতি সম্পৃক্ত ছিল না। সৈনিক সংস্থার’ ১২ দফায় বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত করে এমন একটি দফাও স্থান পায় নি। সবগুলােই ছিল সেনাছাউনিকেন্দ্রিক। সেনাছাউনিতে শস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের লক্ষ্যে রচিত ১২-দফায় ছিল শুধু ঘৃণা, হিংসা আর বিদ্বেষ। অফিসারদের বিরুদ্ধে হিংসা ও বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে, বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য সৃষ্টি করে, অফিসার নিধনের মাধ্যমে সেনাবাহিনীকে তারা সৈনিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে এনে ক্ষমতা নিজেদের দখলে নেয়ার প্রয়াস চালিয়েছিল সেদিন। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে জিয়া এবং তার অনুগতা জাসদ ও তাহেরের ঐ অপচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। জাসদ তাদের লক্ষ্য অর্জনে শােচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। কিন্তু জাসদ এবং তাহেরের হঠকারিতায় এরই মধ্যে নিহত হন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শ্রেষ্ঠ সেনানিদের কয়েকজন।  মূলত চেইন অফ কমান্ড ও জিয়ার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি তাকে সেদিন সফল হতে সাহায্য করে। তাহের ও তাঁর রাজনৈতিক সহযােগীরা ব্যর্থ হন।
৭ নভেম্বরের ঘটনাবলিতে জাসদ যত বিপ্লবী তত্ত্বই পরে জুড়ে দিতে চেষ্টা করুক না কেন, বস্তুত এটি ছিল রাজনীতি-বর্জিত ক্ষমতা দখলের একটা নির্জলী প্রয়াসমাত্র। এর সঙ্গে সেদিন কোনাে বিপ্লবী কর্মকাণ্ড অথবা তত্ত্ব জড়িত ছিল না। তথাকথিত শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্বের আবরণে ক্ষমতা দখলের এক হীন চক্রান্ত হয়েছিল এ দিনটিতে। ৭ নভেম্বর এবং এর অব্যবহিত কয়েকদিনের মধ্যে জিয়া তার একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন। এদিকে তাহের ও তাঁর রাজনৈতিক সহযােগীরা আত্মগােপন করার মাধ্যমে আত্মরক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একপক্ষকালের মধ্যে জাসদের উল্লেখযোগ্য নেতারা অন্তরীণ হন। জিয়া ক্ষমতা নিয়ে আমাদেরই নিযুক্ত প্রেসিডেন্টকে দায়িত্বে বহাল রাখেন। বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানদ্বয়ও (যারা খালেদের সঙ্গে সামরিক আইন প্রশাসনে ক্ষমতার ভাগ-বাটোয়ারার ব্যাপারে দর কষাকষি করেছিলেন) স্বপদে বহাল রইলেন। মােশতাক অপসারিত এবং ক্ষমতাচ্যুত হলেন। তথাকথিত সূর্যসন্তানেরা দেশ থেকে বহিস্কৃত হলাে। দৃশ্যপটে একমাত্র কেবল খালেদ মােশাররফ রইলেন না। বাংলাদেশের কোনাে শহর-বন্দরে বিপ্লবের কোনাে আলামতও পরিলক্ষিত হলাে না। তাহলে ‘বিপ্লব’ কোথায় এবং কিভাবে ঘটলাে? আমার ধারণা, ৭ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ড তদন্ত ও বিচারের হাত থেকে চিরদিনের জন্য দায়মুক্ত থাকার ব্যবস্থা হিসেবে অত্যন্ত সুচতুরভাবেই এই দিনটিকে জাতীয় সংহতি ও বিপ্লব দিবস’ রূপে ঘােষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে জিয়ার একটি মানবতা-বিরােধী পদক্ষেপ। এর অবসান হওয়া প্রয়ােজন ছিল। সেই সঙ্গে সামরিক ও বেসামরিক সকল হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের বিধান করা প্রয়ােজন। যে সৎ উদ্দেশ্য ও মহৎ লক্ষ্য নিয়ে আমরা ৩ নভেম্বরের অভ্যুথানে অংশগ্রহণ করেছিলাম, বিবিধ কারণে প্রাথমিক বিজয়ের পর সে ক্ষেত্রে সাফল্য সংহত করতে পারি নি।
সেই সকল কারণ বিবৃত করে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে চাই না। কোনাে অজুহাতও দাঁড় করাবাে না। আমরা যে ব্যর্থ হয়েছি, এটাই সত্য। আর সেই ব্যর্থতার দায়ভার সম্পূর্ণ এবং এককভাবে আমারই প্রাপ্য। জীবন এবং চাকরির ঝুঁকি নিয়ে সেদিনের উদ্যোগে যারা আমার সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করে সহযােগিতার হাত বাড়িয়েছিলেন, বিশেষভাবে আমার স্টাফ অফিসারবৃন্দ এবং বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে যাওয়া সেই চারজন অফিসার, যে আনুগত্য, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম ও সাহসের সঙ্গে পরিস্থিতি মােকাবেলা করেছিলেন, তাদের অবদান আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করি। সেদিনকার ঘটনাপ্রবাহে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারসমূহের প্রতিও রইলাে আমার আন্তরিক সমবেদনা। সেই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম বেঙ্গলের সুবেদার মেজর, অনারারি লে, আবদুল মজিদের সময়ােচিত সহযােগিতার কথা স্মরণ করি শ্রদ্ধার সঙ্গে।

সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮