You dont have javascript enabled! Please enable it!
অবৈধ খুনি সরকারের প্রতি চ্যালেঞ্জ
১৬ আগস্ট বিকেলের দিকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তােফায়েল আহমেদের ধানমন্ডির বাসায় গেলাম। তাকে আমি একজন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা বলে জানতাম। মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবঙ্গীকালে তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেশার সুযােগ হয়েছিল। তাে, ভাবলাম তার কাছে যাই। গিয়ে বলি, আওয়ামী লীগের নেতারা এটা কি করলেন! তােফায়েল আমাকে দেখে অবাক হলেন খুবই। অবাক হওয়ারই কথা। কথাবার্তায় বুঝতে পারলাম প্রচণ্ড  নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন তিনি আমাকেও যেন একটু অবিশ্বাস করছেন মনে হলাে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম, তিনি ইচ্ছে করলে আমার বাসায় এসে থাকতে পারেন। তােফায়েল সবিনয়ে বললেন, তেমন প্রয়ােজন মনে করলে আমার বাসায় যাবেন তিনি, তবে এখন নয়! ঘণ্টাখানেক তার বাসায় ছিলাম। পরে শুনেছি, আমি যে তােফায়েল আহমেদের বাসায় গিয়েছি একথা প্রকাশ পাওয়ায় রাতে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। মেজর ডালিম, নূর, শাহরিয়ার, লেফটেন্যান্ট মাজেদসহ অন্যরা তােফায়েল আহমেদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে জানতে চায় আমার সঙ্গে তার কি কথা হয়েছে। সেরকম কোনাে কথা হয় নি একথা বারবার বলার পরও ডালিম এবং তার সহযােগীরা তার ওপর অব্যাহত নির্যাতন চালায়। তােফায়েল আহমেদের ওপর অত্যাচারের এই খবর পেলাম রাতে। খুব অনুতাপ হচ্ছিল। আমি তার বাসায় না গেলে হয়তাে এই নির্যাতনের শিকার হতে হতাে না তাকে। মােশতাকের সহযােগী হত্যাকারীরা তােফায়েল আহমেদের আনুগত্য ও সমর্থন আদায়ের জন্য তার ওপর প্রবল মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। তারা তােফায়েল আহমেদের এপিএস শফিকুল আলম মিন্টুকেও ধরে নিয়ে গিয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালায় তার ওপর। এক পর্যায়ে ঐ কর্তব্যপরায়ণ তরুণ অফিসারটিকে ঠাণ্ডা মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। শােনা যায়, অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মাজেদ এই নির্মম কাজটি করে। হত্যাকারী ঐ অফিসারটি এখনাে সরকারি চাকরিতে (বেসামরিক পদে) বহাল রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সরকারি কর্মচারীদের অসংখ্য সংগঠন থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে এই অফিসারটির বিচারের ব্যাপারে কেউই সােচ্চার হন নি। 
অভ্যুত্থান-পরবর্তী কয়েকদিনে বিদ্রোহীরা ঢাকার কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বেতার কেন্দ্রে স্থাপিত নিজেদের ক্যাম্পগুলােতে ধরে নিয়ে গিয়ে নিগৃহীত করে। বিদ্রোহীদের মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের আনুগত্য ও সমর্থন আদায় করা। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার প্রচেষ্টাও ছিল। লাঞ্ছিত ও শারীরিকভাবে নিগৃহীত হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা ও আইনজ্ঞ আমিনুল হক। পরবর্তীকালে তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন। আমিনুল হক পাক যুদ্ধবন্দি ও তাদের এদেশীয় সহযােগীদের যুদ্ধাপরাধ তদন্ত কমিশনের একজন বিশিষ্ট সদস্য ছিলেন। নিষ্ঠার সঙ্গে তদন্তের দায়িত্ব পালনকালে তিনি অভ্যুত্থানকারীদের দেশি-বিদেশি প্রভুদের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। এরই পরিণতিতে বিদ্রোহীদের হাতে তাকে নিগৃহীত হতে হয়। ডালিম, নূর, শাহরিয়ার ও মাজেদ—এরা তার ওপর বর্বর নির্যাতন চালায়।
১৬ ও ১৭ আগস্ট ক্যান্টনমেন্টের পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক ছিল। সবাই যার যার অফিসিয়াল কাজকর্ম করেছি। অভ্যুথানকারীদের বিরুদ্ধে কোনাে তৎপরতা দেখা গেলাে না কোথাও। বেতারে মােশতাক সরকারের প্রতি সেনাপ্রধান ও অন্যান্য বাহিনীপ্রধানের আনুগত্য ঘােষণার পর এই দুটো দিন মূলত সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি সংহত করার কাজেই ব্যাপৃত ছিলাম আমরা। চেইন অফ কমান্ড মানার স্বার্থেই এটা করতে হয়েছে আমাদের তবে অনেককেই অতি উৎসাহে অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করতে দেখা গেছে। ১৮ আগস্ট সেনাসদরে অনুষ্ঠিত এক মিটিংয়ে ডিজিএফআই-এর দায়িত্বপালনরত ব্রিগেডিয়ার রউফ তােফায়েল আহমেদের বাসায় আমার যাওয়ার কথা সবাইকে অবহিত করেন। তিনি উল্লেখ করেন, তােফায়েল সাহেবের বাসার সামনে আমার গাড়ি দেখা গেছে। এ কথা শুনে সেনাপ্রধান ও উপপ্রধান উভয়েই আমাকে তিরস্কার করলেন। আমি যেন ভবিষ্যতে কোনাে রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আর সম্পর্ক না রাখি, সে জন্য তাঁরা সাবধান করে দিলেন আমাকে। এই মিটিংয়ে চেইন অফ কমান্ড এবং পরবর্তী আর কোনাে রক্তপাত ও সঘাত এড়ানাের বিষয় আলােচিত হয়।
১৯ আগস্ট সেনাসদরে আরেকটি মিটিং হয়। বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে মিটিংয়ে সেনাপ্রধান সভায় ঢাকাস্থ সকল সিনিয়র অফিসারকে তলব করেন। তিনি মেজর রশিদ ও ফারুককে সঙ্গে করে কনফারেন্স রুমে এলেন। বললেন, প্রেসিডেন্ট মােশতাকের নির্দেশে রশিদ ও ফারুক সিনিয়র অফিসারদের কাছে অভ্যুত্থানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করবে। রশিদ তার বক্তব্য শুরু করলো। সে বললাে, সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র অফিসার এই অভ্যুত্থানের কথা আগে থেকেই জানতেন এমন কি ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারও (অর্থাৎ আমি) এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। রশিদ আরাে দাবি করলাে, প্রত্যেকের সঙ্গে আগেই তাদের আলাদাভাবে সমঝােতা হয়েছে। উপস্থিত অফিসারদের কেউই এই সর্বৈব মিথ্যার কোনাে প্রতিবাদ করলেন না। একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেউ। কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। নীরব থাকা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ফারুক-রশিদের মিথ্যে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে আমি সেদিন বলেছিলাম, “You are all liars, mutineers and deserters. You are all murderers. Tell your Mustaque that he is an usurper and conspirator. He is not my President. In my first opportunity shall dislodge him and you all will be tried for your crimes.” আমার কথা শুনে তারা বাক্যহীন হয়ে পড়ে এবং বিষন্ন মুখে বসে থাকে।
পরবর্তী সময়ে জীবন বাজি রেখে সে কথা রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমি। যাই হােক, আমার তীব্র প্রতিবাদের মুখে মিটিং শুরু হতে-না-হতেই ভেঙে গেলাে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ উঠে গিয়ে তার কক্ষে ঢুকলেন। উপপ্রধান জিয়া অনুসরণ করলেন তাকে। আমি তখন স্বভাবতই বেশ উত্তেজিত। তাদের দুজনের প্রায় পেছনে পেছনেই গেলাম আমি। সেনাপ্রধানের কক্ষে ঢুকতেই জিয়া আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “শাফায়াত, একেবারে ঠিক আচরণ করেছে ওদের সঙ্গে। একদম সঠিক কাজটা করেছে। কিপ ইট আপ। ওয়েল ডান!” উৎসাহিত হয়ে আমি তাদের দু’জনকে উদ্দেশ করে বললাম, “”Sir, the way I treated the murderers you must talk to Mustaque in the same language and get the conspirator out of Bangabhaban.” দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেনাপ্রধান বা উপপ্রধান কেউই অবৈধ খুনি সরকারের স্বঘােষিত প্রেসিডেন্টকে সরানাের মতাে সৎ সাহস অর্জন করতে পারেন নি। এই বিশাল ব্যর্থতা তাদের উভয়ের ওপরই বর্তায়। প্রসঙ্গত একটা কথা বলতে হয়, ১৫ আগস্ট থেকে মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ যতােদিন সেনাপ্রধান ছিলেন (অর্থাৎ ২৪ আগস্ট পর্যন্ত) তাকে এবং মেজর জেনারেল জিয়াকে প্রায় সর্বক্ষণ একসঙ্গে দেখা গেছে। একজন যেন আরেকজনের সঙ্গে ছায়ার মতাে লেগে ছিলেন।
১৫ আগস্টের অ্যুত্থান কেন হয়েছিল?
আজো একটি প্রশ্ন বহু লােকের মনকে আলােড়িত করে, অনেকে আমাকেও জিগ্যেস করেন, ১৫ আগস্ট সামরিক অভ্যুথান কেন হয়েছিল? তৎকালীন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক একাধিক কারণের উল্লেখ করবাে না আমি। সে দায়িত্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইতিহাসবিদদের। নিজের যে পরিমণ্ডলে আমার অবস্থান ছিলাে, তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবাে আমার বক্তব্য।  আমি পেছন ফিরে দেখি, সেনাবাহিনীতে মুক্তিযােদ্ধা ও অমুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের মধ্যে একটা রেষারেষি ছিল। কিছুসংখ্যক অমুক্তিযােদ্ধা অফিসার, যারা মূলত যুদ্ধ শেষে পাকিস্তান প্রত্যাগত, তারা মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের সহ্যই করতে পারতেন না। কয়েকজন সিনিয়র অমুক্তিযােদ্ধা অফিসার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে শুরু করেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি, বঙ্গবন্ধুর মহানুভবতায় তারা রাষ্ট্রীয় ও সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন। তাদের ষড়যন্ত্রের প্রধান লক্ষ্যই ছিল চরিত্র হননের মাধ্যমে সিনিয়র মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের স্বপদ থেকে সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলাে দখল এবং পরবর্তকিালে রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতা করায়ত্ত করা। আমার মতাে একজন মাঝারি ব্ল্যাঙ্কের অফিসারও তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পায় নি। চক্রান্তকারীরা সুকৌশলে রাষ্ট্রপ্রধানকে পর্যন্ত জড়িত করতে দ্বিধা বােধ করে নি। এরকম দু’একটি ঘটনার উল্লেখ করলে পাঠকবৃন্দ বুঝতে পারবেন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র কোন্ পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছিল। প্রথমবার আমাকে চিহ্নিত করা হয় গােপন সশস্ত্র সর্বহারা পার্টির সমর্থক হিসেবে এবং দ্বিতীয়বারে সুতা চোরাচালানির পৃষ্ঠপােষকরূপে কিন্তু কোনাে অভিযােগেই আমাকে তারা ফাসাতে পারে নি।
পঁচাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাস। আমি ব্রিগেড নিয়ে সাভার এলাকায় ট্রেনিংয়ে ব্যস্ত। আকস্মিকভাবে একদিন বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে পাঠালেন তার বাসভবনে। ৩২ নম্বরের তিন তলায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হতে কোনাে ভূমিকা ছাড়াই তিনি বললেন, “তােমার বিরুদ্ধে একটা গুরুতর অভিযােগ আছে আমি নিজেই ইনভেস্টিগেট করবাে বলে তােমার চিফ বা ডেপুটি চিফ কাউকেই বিষয়টা জানাই নি। তার প্রয়ােজনও নেই। তােমার ওপর আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে বলেই আমি নিজে এর ভার নিয়েছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাকে মিথ্যা রিপাের্ট দেওয়া হয়েছে। হতবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, “স্যার, অভিযােগটা কি?” জবাবে বঙ্গবন্ধু জানালেন, একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তাকে বলেছেন, সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর মাত্র এক সপ্তাহ আগে নাকি তার সঙ্গে আমার গােপন বৈঠক হয়েছে। অভিযােগটি একেবারেই ভিত্তিহীন ছিল।
বলে আমি জোর গলায় কিন্তু বিনয়ের সঙ্গে তা অস্বীকার করি। বলতে দ্বিধা নেই, সিরাজ সিকদারের সঙ্গে আমার কখনাে পরিচয় বা দেখাও হয় নি। শুধু নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন আমার কাছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে অত্যন্ত স্নেহ ও বিশ্বাস করতেন। আমার স্পষ্ট জবাব শােনার পর তিনি বললেন, ‘Go back to your duties, you need not talk about this episode to anyone. The chapter is closed and sealed’. এবার আমার পালা। আমার বারবার অনুরােধের পর বঙ্গবন্ধু সাবেক প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকীর নাম বললেন, যিনি এই মিথ্যে তথ্য তাকে দিয়েছিলেন। আমার জানা ছিল, সেই বিচারপতি সাহেবের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় তখন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে (এসবি) কর্মরত ছিলেন, খুব সম্ভব ঐ সংস্থাটির প্রধান হিসেবে বুঝতে অসুবিধা হলাে না যে, এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ও ডিজিএফআই (ডাইরেক্টরেট জেনারেল ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্স) উভয়ে মিলেই এটা করেছে। হিসেবও খুব সহজেই মিলে গেলাে। ডিজিএফআই প্রধান ছিলেন ব্রিগেডিয়ার রউফ। তারই পৌরােহিত্যে ঐ সংস্থাটির অমুক্তিযােদ্ধা অফিসাররা এসবি প্রধানের সর্বাত্মক সহযােগিতায় এরকম একটা নির্জলা মিথ্যে রিপাের্ট তৈরি করেন। বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জনের জন্য তারা একজন সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রাক্তন প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে এ রিপাের্ট বঙ্গবন্ধুর গােচরে আনেন কী ঘৃণ্য হিংসাত্মক মানসিকতা। ব্রিগেডিয়ার রউফ ও তার সহযােগীরা ঐ কাল্পনিক অভিযােগের জাল ফাঁদতে শুরু করেন সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পরদিন থেকেই। সেদিন খুব ভােরে ডিজিএফআই-এর দু’জন অমুক্তিযোেদ্ধা অফিসার মেজর (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.) দৌলা ও আমার সতীর্থ মেজর (পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) মাহমুদ-উল হাসান আকস্মিকভাবে আমার সঙ্গে দেখা করতে অফিসে আসেন। আলাপচারিতায় তারা মূলত সিরাজ সিকদারের মৃত্যুতে আমার ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া জানতে চান। 
এ প্রসঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের জন্য এখানে একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই আমি। বিষয়টি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই এবং তার সহযােগী অন্যান্য গােয়েন্দা সংস্থায় চাকরি করেছেন এমন বাঙালি অফিসারদের স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে, বিশেষ করে গােয়েন্দা বিভাগে নিয়ােগ সংক্রান্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কেবল সেই ধরনের বাঙালি অফিসারদের গােয়েন্দা বিভাগে কাজ করার সুযােগ দেয়া হতাে, যারা কি না নিষ্ঠার সঙ্গে স্বজাতি (অর্থাৎ বাঙালি) সেনা কর্মকর্তা ও রাজনীতিকদের সম্পর্কে সত্য-মিথ্যা নানা ধরনের রিপাের্ট দিতে উৎসাহ বােধ করবে তাই বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে মনেপ্রাণে ভিন্নমত পােষণকারী অফিসাররাই বিভিন্ন গােয়েন্দা পদে নিযুক্তি লাভ করতেন।
পাকিস্তানি প্রভুদের তুষ্ট করতে তারা অনেক নিচে নামতেও দ্বিধাবােধ করতেন। এর থেকে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে পাক গােয়েন্দা বিভাগের অফিসারদের আত্তীকরণ, বিশেষত গােয়েন্দা সংস্থায় তাদের নিয়ােগদান কতােটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছিল? ঐসব গােয়েন্দা কর্মকর্তা কতােটুকু আনুগত্য সহকারে নতুন নিয়ােগদাতা বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে কাজ করেছিলেন, সেটা ছিলাে প্রশ্নসাপেক্ষ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ। গােলটেবিল বৈঠক করে তাে আর বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নি!  দ্বিতীয় ঘটনাটি পঁচাত্তর সালেরই মে মাসের । তারিখটা মনে নেই। রাত তখন এগারােটা। ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়া ফোন করে আমাকে তার বাসায় যেতে বললেন। আমাকে দেখা মাত্রই জিয়া বললেন, গােয়েন্দা সূত্রের খবর অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু তাকে জানিয়েছেন যে আমার অধীনস্থ একটি ইউনিটের স্টোর রুমে চোরাই সুতা পাচারের জন্য মজুদ রাখা হয়েছে। আর সেই সুতা ভর্তি স্টোর রুম থেকে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন পর্যন্ত পুরাে রাস্তা ঐ ইউনিটের সৈনিকেরা পাহারা দিচ্ছে বঙ্গবন্ধু ডেপুটি চিফকে অনুসন্ধান সাপেক্ষে এ ব্যাপারে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। এটা একটা অতি গুরুতর অভিযােগ আর চুপ করে বসে থাকা যায় না। আমি ব্রিগেডিয়ার রউফের সঙ্গে Confrontation-এর সিদ্ধান্ত নিলাম।
অনেক বাকবিতণ্ডার পর ঠিক হলাে, আমার দুজন কমান্ডিং অফিসার আর ব্রিগেডিয়ার রউফের পক্ষে তার অধীনস্থ মেজর মাহমুদ-উল হাসান (এখন মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) একসঙ্গে স্টোর রুমটি পরিদর্শনে যাবে। পরিদর্শন শেষে আমার দুই অফিসার লে. কর্নেল (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.) আমিনুল হক ও লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূত) হারুন আহমেদ চৌধুৰী ডেপুটি চিফের বাড়িতে এসে রিপাের্ট করলেন, কথিত সেই স্টোর রুমে একগাছি সুতাও পাওয়া যায় নি। স্টোর রুমটি শুধু Firing Target-এ ঠাসা। আর রাস্তার প্রহরা সম্পর্কে তারা জানালেন, কোম্পানিগুলাে Night Training-এ ব্যস্ত, তারা রাস্তা জুড়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। সঙ্গত কারণেই মেজর মাহমুদ-উল হাসান আর ডেপুটি চিফের বাসায় ফিরে আসেন নি। আর ব্রিগেডিয়ার রউফ তাে অনেক আগেই ব্যস্ততা দেখিয়ে সরে পড়েছেন। ব্রিগেডিয়ার রউফ ও তার সহযােগীদের মিথ্যাচারের কোনাে সীমাপরিসীমা ছিল না। “To make mountain out of a mole hill” প্রবাদটিকেও হার মানিয়েছিল তারা। মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি তাদের অনেকেরই ছিল প্রবল বৈরী মনােভাব। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি বহুদিনের লালিত হিংসা-বিদ্বেষ আর ঘৃণার চরম প্রকাশ তারা ঘটিয়েছিলেন পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে প্রেসিডেন্ট জিয়ার হত্যাকাণ্ডের পর।
মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি অন্ধ বিদ্বেষের কারণে জিয়া হত্যাকাণ্ডকে উপলক্ষ করে কতিপয় অমুক্তিযােদ্ধা সিনিয়র অফিসার এরশাদের নেতৃত্বে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের ফাসি, জেল ও চাকরিচ্যুত করেই এরশাদ ও তার পােষ্য ঐ অমুক্তিযােদ্ধা সিনিয়র অফিসাররা সন্তুষ্ট হতে পারে নি। প্রেসিডেন্ট থাকাকালে এরশাদ এক অলিখিত নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সন্তান ও নিকট আত্মীয়দের সেনাবাহিনীর অফিসার কোরে যােগদান নিষিদ্ধ করেছিলেন। অনেক মুক্তিযােদ্ধার মতাে কর্নেল (অব.) শওকত আলী এমপির এবং আমার ছেলেও সামরিক বাহিনীতে যােগদান করা থেকে বঞ্চিত হয়। পক্ষান্তরে একাত্তরে পরাজিত পাকবাহিনীর দোসরদের সন্তানদের জন্য সেনাবাহিনীর দুয়ার অবারিত করা হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, এরশাদ বাংলাদেশে আগমনের পর আর্মি হেড কোয়ার্টার-এর প্রথম কনফারেন্সে মুক্তিযােদ্ধাদের দুই বছরের সিনিয়রিটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন।
সিনিয়র অমুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্র আমাকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে। এই অস্বস্তিকর পরিবেশে ক্রমশ সামরিক বাহিনীর চাকরিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠতে থাকি আমি। এমনি পরিস্থিতিতে পঁচাত্তরের জুলাই মাসের কোনাে একদিন সেনাপ্রধান টেলিফোনে আমাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে বললেন। তিনি জানালেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে তাঁর এমএসপি করতে চান। সেনাপ্রধান আমাকে বঙ্গবন্ধুর কথায় রাজি হয়ে যেতে বলেন। সে রাতেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করলাম। বঙ্গবন্ধু আমাকে এম,এস,পি-র দায়িত্ব নিতে হবে বলে আশ্বাস দিলেন, অনতিবিলম্বে তিনি আমাকে মেজর জেনারেল র্যাঙ্কে পদোন্নতি দেবেন। বঙ্গবন্ধু আরাে জানালেন, এমএসপি-র র্যাঙ্ককে ইতিমধ্যেই উন্নীত করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু বােধহয় আবেগের বশেই ঐ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমাকে। কারণ কর্নেল র্যাঙ্কের একজন অফিসারকে রাতারাতি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি দেয়াটা বিধিবহির্ভূত। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধু হয়তাে সামরিক নিয়মকানুন সম্পর্কে ততােটা ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আমাকে ঘিরে অমুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের অব্যাহত চক্রান্তের কথা স্মরণ করে আমি এই স্পর্শকাতর পদে যােগদান করতে অত্যন্ত বিনীতভাবে অপারগতা প্রকাশ করি। মনে হলাে বঙ্গবন্ধু এতে করে একটু মনােক্ষুন্ন হলেন। তােফায়েল আহমেদ তখন রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক সচিব। তিনিও আমাকে ঐ পদে যােগদানের অনুরােধ করেন। কিন্তু আমি সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমার সিদ্ধান্তেই অটল থাকলাম। এছাড়া আমার আর কিছুই করার ছিল না।
তিরস্কারের বদলে পুরস্কারের পরিণতি
অমুক্তিযােদ্ধা সিনিয়র কিছু অফিসার সরকার ও সেনাবাহিনী দু’জায়গাতেই একটা পরিবর্তন চাচ্ছিলেন। বিভিন্ন সময় তাদের বিভিন্ন উস্কানিমূলক কথাবার্তা ও কর্মকাণ্ড অসন্তুষ্ট ও বিভ্রান্ত জুনিয়র মুক্তিযােদ্ধা অফিসারদের প্ররােচিত করতাে। সরকারের বিভিন্ন ব্যর্থতা আর দুর্নীতির অভিযােগে সাধারণ মানুষের মতাে সেনাবাহিনীতেও কিছুটা ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনীর নিয়ম-শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে জঘন্য একটি হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের জন্য এগুলাে কোনাে অজুহাত হতে পারে না। সেনাসদস্যদের মধ্যে এরকম একটি প্ররােচনার ঘটনা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। ‘৭৪ সালের শেষ দিকের কথা। মেজর ডালিমের সঙ্গে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গােলাম মােস্তফার একটি পারিবারিক দ্বন্দ্বের সুযােগ নিয়ে ঘটনার পরদিন তদানীন্তন কর্নেল এরশাদ ঘােলা পানিতে মাছ শিকারের মতলব আঁটেন। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি একদল তরুণ অফিসারকে নেতৃত্ব দিয়ে তৎকালীন সেনা উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়ার অফিসে যান এবং ঐ ঘটনায় সেনাবাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের দাবি করেন। অথচ কর্নেল এরশাদ তখন এজি (অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল), অর্থাৎ সেনাবাহিনীর সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত। আমি এ ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী। সেনা উপপ্রধান তাৎক্ষণিকভাবে কর্নেল এরশাদের ঐ অযৌক্তিক দাবি প্রত্যাখ্যান করে তার দায়িত্ববােধ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।
বিদ্রোহতুল্য এই আচরণের জন্য ভিন্ন কর্নেল এরশাদকে তীব্র ভাষায় তিরস্কার করে বলেন, তার এই অপরাধ কোর্ট মার্শাল হওয়ার যােগ্য। এ ঘটনার জন্য ঐদিনই বিকেলে বঙ্গবন্ধু তার অফিসে সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, কর্নেল এরশাদ এবং আমাকে তলব করেন। এরশাদের আচরণের জন্য উপস্থিত সবাইকে কঠোর ভাষায় ভৎসনা করেন তিনি। এরপরও সাবেক সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কর্নেল এরশাদের বিরুদ্ধে কোনাে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ তাে করলেনই না, বরং তাঁর প্রিয়ভাজন এই কর্নেলকে কয়েকদিন পরই দিল্লিতে পাঠিয়ে দিলেন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য। অল্প কয়েকদিন পরই নিয়ম-বহির্ভূতভাবে Supernumerary Establishment-এ থাকা অবস্থায় তার পদোন্নতিরও ব্যবস্থা করেন। কর্নেল থেকে ব্রিগেডিয়ার হয়ে গেলেন এরশাদ। আমার ধারণা, এরশাদ ছিলেন পাকিস্তানের প্রধান গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) আশীর্বাদপুষ্টদের অন্যতম প্রধান। ১৯৭২ ও ১৯৭৩ সালে তিনি অন্তত চারবার বিমানযােগে বিভিন্ন মূল্যবান সামগ্রী (?) পাকিস্তান থেকে রংপুরে তার বাড়িতে পাঠান। আটকেপড়া বাঙালি সামরিক অফিসাররা তখন তাে বিভিন্ন বন্দিশিবিরে নানারম দুর্ভোগের মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। তখন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে কোনাে নিয়মিত বিমান চলাচলও ছিল না।
অনিয়মিতভাবে চলাচলকারী আইসিআরসি (আন্তর্জাতিক রেডক্রস)-এর ভাড়া করা প্লেনে এরশাদ সাহেবের সেসব জিনিসপত্র পাচার করার অপারেশন চালানাে হয়। পাক বন্দিশিবিরের তথাকথিত বন্দি এরশাদের পক্ষে ISI-এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও সার্বিক সহযােগিতা ছাড়া এধরনের কাজ করা কোনােক্রমেই সম্ভব ছিল না। আমার জানা মতে, আটকে-পড়া প্রায় বারোশ’ অফিসারের আর কারােরই তার মতাে সুযােগ পাওয়ার সৌভাগ্য হয় নি। এরশাদের ওইসৰ অপারেশনে তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাই পুরাে সহযােগিতা করেছেন। শফিউল্লাহ সাহেব তার এডিসির মাধ্যমে হেলিকপ্টারে করে সেই সব মালামাল রংপুর পাঠাতেন এবং আমাকে সেগুলাে বাড়িতে পৌছে দেয়ার জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করতে হতাে। আমি তখন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার। এরশাদ সম্পর্কে বলার আরাে রয়েছে। অভিযােগ শােনা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে আসেন এবং যুদ্ধে যােগ দেয়ার সুযােগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে যান। এ কারণে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সরকার পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের সেনাবাহিনীতে আত্তীকরণের জন্য যে নীতিমালা প্রণয়ন করেন, সে অনুযায়ী তার চাকুরিচ্যুতি হওয়ার কথা। একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যারা বাংলাদেশে এসে যুদ্ধে যােগদানের সুযােগ থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানে ফিরে গেছেন, তাদেরকে এই নীতিমালা অনুযায়ী চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। জনা পঞ্চাশেক অফিসারকে এ কারণে চাকুরি হারাতে হয়।
কিন্তু একই অপরাধে অভিযুক্ত হওয়ার পরও এরশাদ চাকুরিচ্যুত তাে হনই নি, বরং প্রমােশনসহ এজি (অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল) পদে অধিষ্ঠিত হন। এর পেছনে তকালীন সেনাপ্রধান ও আওয়ামী যুবৰ্পীগের একজন প্রভাবশালী নেতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। একই বিষয়ে এ দুইমুখাে নীতিতে সেনাবাহিনীর অফিসাররা খুবই বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তখন অমুক্তিযােদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের অনেকেই নিরন্তর চক্রান্ত ও মিথ্যাচারে লিপ্ত ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধা সিনিয়র অফিসাররাও তাদের দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। তারা তাদের স্বগােত্রীয় (অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধা) জুনিয়র অফিসারদের কৃত অনেক বিশৃঙ্খলার ঘটনা অনেক সময়ই আড়াল করে রেখেছেন, যার ফলে উচ্ছলতা উৎসাহিত হয়েছে। এরকমই একটি ঘটনার কথা এখানে বলছি। চুয়াত্তর সালের মধ্য এপ্রিলে ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পদে নিয়ােগপ্রাপ্ত হই আমি। তার আগে আমি রংপুর ব্রিগেডের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ঢাকায় আসার কিছুদিন পরই অন্য অফিসারদের মুখে শুনি, মেজর ফারুক এর আগে অর্থাৎ ১৯৭৩ সালের শেষদিকে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার সমর্থনে কুমিল্লা থেকে সৈন্য দল ঢাকায় আসার কথা ছিল। কিন্তু সেই সেনাদল শেষ পর্যন্ত ঢাকায় না আসায় ফারুকের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায়। উল্লেখ্য, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ট্যাঙ্ক ছিল মাত্র তিনটি। সেই তিনটি ট্যাঙ্কই কজা করে অত্যুত্থানের ফন্দি এঁটেছিল ফারুক। তার এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার পর সেনাবাহিনীতে তা ফাঁস হয়ে যায়।
উর্ধ্বতন অফিসারদের সূৰাই ফারুকের অভুথান সংগঠনের ফন্দির কথা জানতেন। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, এজন্য তার বিরুদ্ধে কোনাে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় নি। আরাে আশ্চর্যের ব্যাপার, ১৯৭৪ সালে মিসরের কাছ থেকে শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে ৩২টি ট্যাঙ্ক পাওয়ার পর গঠিত ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টটি সেই ফারুকের দায়িত্বেই ঢাকায় মােতায়েন করা হয়। ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টটির মােতায়েন সেনাপ্রধানো ভুল সিদ্ধান্তেরই পরিচায়ক। উল্লেখ্য, ঢাকা ও তার পাশ্ববর্তী এলাকা ট্যাঙ্ক যুদ্ধের জন্য মােটেই উপযােগী নয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও সে কথাই বলে। মুক্তিযুদ্ধে উল্লেখযোপ্য ট্যাঙ্ক যুদ্ধগুলাে হয়েছে যশাের, হিলি, কুমিল্লা এসব এলাকায়। সেনাপ্রধানের এই ভুল সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতালি যড়যন্ত্রকারী অফিসাররা পরবর্তীকালে বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়। এভাবে বিভিন্ন সময়ে সামরিক বাহিনীতে সংঘটিত শৃঙ্খলার গুরুতর পরিপন্থী কাজের জন্য তিরস্কারের বদলে পরােক্ষভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। এসব বিশৃঙ্খলার ধারাবাহিকতাই পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তিত। রচনা করেছে।
এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরোধ করা কি সম্ভব ছিল?
অনেকেই প্রশ্ন করেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল কি না। আমি মনে করি, এ হত্যাকাণ্ড প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল। সেনাপ্রধান এজন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিলেন। ডিএমআই (পরিচালক, সামরিক গােয়েন্দা পরিদফতর) লে. কর্নেল (অব.) সালাহউদ্দিনের ভাষ্যানুযায়ী সেনাপ্রধান এই বিদ্রোহের কথা তার কাছ থেকে অবহিত হন রাত প্রায় সাড়ে চারটায়। ডিএমআই-এ তথ্য দিয়েছিলেন ১৯৭৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার বিরুদ্ধে এ কোর্ট অফ এনকোয়ারির সময়। কাজেই এটিকে প্রামাণ্য বলে ধরা যায়। সেনাপ্রধান আমাকে ফোন করেন সকাল প্রায় ছ’টায়। ততােক্ষণে সব শেষ। ডিএমআই বলেছেন, সেনাপ্রধান তার উপস্থিতিতে একের পর এক ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত প্রায় সব ইউনিট কমাভারদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন (এদের মধ্যে আমার অধীনস্থ ইউনিট কমান্ডাররাও ছিলেন)। তিনি সর্বশেষ কথা বলেন আমার সঙ্গে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এভাবে প্রায় দেড় ঘণ্টা মহামূল্যবান সময়ের অপচয় হয়। সেনাপ্রধান আমাকে সতর্ক করতে অহেতুক দীর্ঘ বিলম্ব করেন। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য সময়মতাে ফোর্স পাঠানাের কোনাে সুযােগই তাই আমার ছিল না। দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের নিরাপত্তায় নিয়ােজিত সেনাদলের সঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে যােগাযোগ করে তাদেরকে অগ্রসরমান হত্যাকারীদের। প্রতিরােধ করার নির্দেশ দেয়া যেতাে।
কুমিল্লা ব্রিগেড থেকে আসা ১২০ জন সেনাসদস্যের একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল। বিধি অনুযায়ী সেনাদলটির প্রশাসনিক দায়িত্ব থাকার কথা ঢাকার স্টেশন কমান্ডার লে. কর্নেল (অব.) হামিদের ওপর। সার্বিক দায়িত্ব ছিল লগ এরিয়া কমান্ডার এবং সেনাপ্রধানের। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন আক্রান্ত হওয়ার সময় এই সেনাদলটিকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু নিহত হন আনুমানিক ভাের পৌনে ছ’টার দিকে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ রাত সাড়ে চারটায় খবর পাওয়ার পরপরই রক্ষীদের মাভাৱৰে ফোনে সতর্ক করে দিলে অভুখানকারীরা তাদের একথা বােঝাতে পারতাে না যে, এটা একটা সামরিক অভ্যুত্থান। বিদ্রোহী অফিসাররা গাওঁদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে পুরাে সামরিক বাহিনীই এই অভুথানের পেছনে রয়েছে। এটা মেনে নিয়ে গার্ডরা তাই আর তাদের বাধা দেয় নি। এখানে একটা বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত বা তাঁর বাসভবনের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব ৪৬তম ব্রিগেডের বা এর অধিনায়ক হিসেবে আমার ওপর ছিল না। সে দায়িত্ব ছিল সেনাসদরের। আর সেনাসদর ঐ দায়িত্ব ন্যস্ত করেছিল কুমিল্লা ব্রিগেডের সেনাদের ওপর অতীতে, ১৫ আগস্টের বিদ্রোহ যে একদিনের ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল না, সেটা এখন দিবালােকের মতাে স্পষ্ট। কিন্তু ডিডিএফআই ও ডিএমআইসহ দেশের অন্যান্য সামরিক ও বেসামরিক গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে এ বড়যন্ত্রের কোনাে পূর্বাভাস বঙ্গবন্ধু বা সরকারকে দিতে পারে নি। এটা এতাে বড়াে ব্যর্থতা যে, কোনোমতেই তা মেনে নেয়া যায় না। বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার খবর পাওয়ার দেড় ঘণ্টা পর সেনাপ্রধান আমাকে তা জানান। পরিস্থিতি দৃষ্টে তাই মনে হয়, সর্বস্তরে ষড়যন্ত্রটিকে আড়াল করার একটি প্রচ্ছন্ন চেষ্টা ছিল।
বিশেষত আমার সম্পর্কে সুতা চোরাচালানি ও নিষিদ্ধ সর্বহারা পাটির সঙ্গে যোপসাজশের ভুয়া গােয়েন্দা তথ্য অতি উৎসাহের সঙ্গে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করা হলেও বিদ্রোহ সংগঠন ও সরকার উৎখাতের মতো একটি বিশাল ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতার কোনাে আভাস গােয়েন্দা সংস্থাগুলাে পায় নি, এটা বিশ্বাসযােগ্য নয়। উরেখ্য, ১৫ আগস্টের আগে বিভিন্ন সময়ে সেনাসদরে অনুষ্ঠিত যেসব বৈঠকে আমি উপস্থিত ছিলাম তার কোনােটিতেই এ ধরনের কোনাে ঘটনা ঘটতে পারে, সে সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করা, কিংবা সতর্ক থাকার কোনাে আভাস দেয়া হয় নি। প্রসঙ্গত একটি বিষয়ের উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মাস দুয়েক আগে আমার ব্রিগেডের একমাত্র গােয়েন্দা ইউনিটটিকে অজ্ঞাত কারণে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। গােয়েন্দা ইউনিটটির কমান্ডার ছিলেন মেজর শামসুজ্জামান (পরে কর্নেল অব.)। সেনাপ্রধান ঐ ইউনিটটিকে তার অধীনে ন্যস্ত করেন। উল্লেখ্য, অন্যান্য ব্রিগেড কমান্ডারের অধীনস্থ গােয়েন্দা ইউনিটগুলাে যথাস্থানেই বহাল ছিল। এর ফলে আমার ব্রিগেডের কোনাে গােপনীয় তথ্য পাওয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত হই আমি।
সেনাবাহিনীর শীর্ষপদে রদবদল
২৪ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে সে উপপ্রধান জিয়া অরফ তাঁর অফিসে ডেকে পাঠালেন। আমাকে কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখলেন তিনি। তাঁর টেবিলে একটা রেডিও দেখলাম। একটু পর জিয়া সেটটি অন করলেন। তখন, খবর হচ্ছিল। খবরে জানানাে হলাে, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহকে প্রেষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। সেনাপ্রধান করা হয়েছে উপপ্রধান জিয়াকে। তার স্থলে উপপ্রধান হয়েছেন তখন দিল্লিতে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ঐদিনই রাতারাতি মেজর জেনারেল পদে উন্নী করা হয় তাকে। নিতান্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের বাইরে অবস্থানরত এরশাদের এই দু’দুটো বিধিবহির্ভূত পদোন্নতি এবং উপপ্রধানের পদ লাভের সঙ্গে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের কোনাে যােগসূত্র আছে কি না, সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। স্মর্তব্য, মেজর ডালিম ও গাজী গােলাম মােস্তফার বিরােধে এরশাল, ডালিমের পক্ষে শৃঙ্খলাবিরােধী জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। এছাড়া মেজর রশিদ ও ব্রিগেডিয়ার এরশাদ উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রায় একই সময় দিতিতে অবস্থান করছিলেন। এসবের মধ্যে কোনাে যােগসূত্র থাকাটা তাই অসম্ভব কিছু নয়। পনেরাে আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি, খুব সম্ভবত, মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পন্নবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তার উল্টোদিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ।
এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা। তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রূঢ়ভাবে জিগ্যেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাৰে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতাে সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতাে কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তার ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোনাে সুযােগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। পরদিন ভােরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থল দিল্লিতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকায় এসেছিলেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি আরো পরের । জিয়ার শাসনামলের শেষদিকের কথা। ঐ সময় বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের বিন্নি দূতাবাসে কর্মরত ১৫ আগস্টের অত্যুথানকারী অফিসাররা গােপনে মিলিত হয়ে জিয়া সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে। এক পর্যায়ে ওই ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে তাদের সবাইকে ঢাকায় তলব করা হয়। সম্ভাব্য বিপদ আঁচ করতে পেরে চক্রান্তকারী অফিসাররা যার যার দূতাবাস ত্যাগ করে লন্ডনসহ বিভিন্ন জায়গায় রাজনৈতিক আশ্রয় নেয়। এদিকে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীতে কর্মরত কয়েকজন সদস্য একই অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে বিচারের সম্মুখীন হন।
আরাে অনেকের সঙ্গে লে. কর্নেল দীদারের দশ বছর এবং লে. কর্নেল নূরন্নবী খানের এক বছর মেয়াদের কারাদণ্ড হয়। প্রধান আসামিক্স বাংলাদেশের সরকার ও আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে বিদেশে নিরাপদেই অবস্থান করছিল। ঐ বিচার তাই একরকম প্রহসনেই পরিণত হয়। ১ পরবর্তীকালে, জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসার পর অ্যুথানকারীদের মধ্যে যারা চাকরি করতে চেয়েছিলেন, এরশাদ তাদেরকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। দ্বিতীয়বারের মতাে পুনর্বাসিত হলাে ১৫ আগস্টের অভূত্থানকারীরা। পােস্টিং নিয়ে তাদের অনেকে বিভিন্ন দূতাবাসে যােগ দেয়।  শুধু পুনর্বাসনই নয়। এরশাদ আগস্ট অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত উল্লিখিত অফিসারদের কর্মস্থলে বিনানুমতিতে অনুপস্থিতকালের প্রায় তিন বছরের পুরাে বেতন ও ভাতার ব্যবস্থাও করে দেন। প্রায় একই সময়ে বিচারের হাত থেকে পালিয়ে থাকা ফেরারী প্রধান আসামিরা বিদেশী দূতাবাসে সম্মানজনক চাকরিতে নিযুক্ত হলেও একই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত তাদের সহযােগীরা। বাংলাদেশে কারাবন্দি থাকে। কী অভিনব ও পক্ষপাতমূলক বিচার! প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, অত্যুত্থানকারীদের প্রতি কি দায়বদ্ধতা ছিল প্রেসিডেন্ট এরশাদের যে, কর্মস্থল ছেড়ে তিন বছর আইনের হাত থেকে পালিয়ে থাকার পরও ১৫ আগস্টের অ্যুথানকারীদের বিচার অনুষ্ঠান এড়িয়ে গিয়ে তাদেরকে আবার চাকরিতে পুনর্বহাল করলেন তিনি? ১৫ আগস্টের অ্যুথানের মাধ্যমে প্রত্যক্ষভাবে উপকৃত হওয়াতেই অভ্যুত্থানকারীদের ঋণ শােধ করতে এরশাদ এ কাজ করেছিলেন কি না, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। ঘটনাপ্রবাহ থেকে একথা মনে করা মােটেই অযৌক্তিক নয় যে, ১৫ আগস্টের অ্যুত্থান ও হত্যাকাণ্ডের পেছনে এরশাদের একটি পরােক্ষ কিন্তু জোরালাে ভূমিকা ছিল। অবাক করার মতাে ঘটনা যে এরশাদের উত্তরসূরি জিয়ার সহধর্মিণীর শাসনামলে ঐসব ফেরারী আসামিরা তাদের চাকরিস্থলে শুধু বহালই থাকেন নি, পদোন্নতিও পেয়েছিলেন।
২৪ আগস্টের ঘটনায় ফিরে আসি। আমি যখন সদ্য সেনাপ্রধান হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া জেনারেল জিয়ার অফিসে বসে আছি, চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) তখন পাঠানাে হয় আমার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে। তিনি সেখানে গিয়ে ব্রিগেড মেজর হাফিজকে সঙ্গ দেন। এর উদ্দেশ্য একটাই হতে পারে। তা হলাে, আমাদের দু’জনকে সতর্ক পাহারার মধ্যে রাখা। জিয়া আমাকে তার অফিসে বসিয়ে রেডিওর খবর শুনিয়ে দিলেন হয়তাে এজন্যই, যাতে কিছু আর বলতে হয়। কিছুক্ষণ পর নতুন সেনাপ্রধান জিয়ার অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলাম। একটু পরেই ফোন বেজে উঠলাে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কণ্ঠস্বর : রেডিওর খবর শুনেছো, শাফায়াত? – হ্যা স্যার, শুনলাম। স্যার, আপনি এই অবৈধ সরকারের অবৈধ আদেশ মানতে বাধ্য নন। আপনি এটা মানবেন না। – তা কি হয়? আমার কথা কি কেউ শুনবে? সেনাপ্রধান কি অবৈধ মােশতাক সরকারের বদলির নির্দেশ প্রত্যাখ্যান করতে পারতেন না? খুনিদের সঙ্গ ত্যাগ করাই তাে উচিত ছিল তার। সেনাপ্রধান সেদিন যদি এটা করতেন তাহলে হয়তাে পরবর্তী ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতাে। সাংবিধানিক বৈধতার প্রশ্ন তুলেই তিনি মােশতাককে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য করতে পারতেন। একটি নিরপেক্ষ নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারতেন তিনি। এবং ঐ মুহুর্তে জাতি সেরকম একটা কিছুই আশা করছিল। সেটা করা হলে দেশ ও জাতির ওপর দীর্ঘ অবৈধ সামরিক শাসনের জোয়াল চেপে বসতাে না।

সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!