You dont have javascript enabled! Please enable it! সিলেট অঞ্চলে অভিযান এবং চূড়ান্ত বিজয় - সংগ্রামের নোটবুক
সিলেট অঞ্চলে অভিযান এবং চূড়ান্ত বিজয়
বাঁশতলার পথে
তুরা পাহাড়ের তেলঢালা ক্যাম্প থেকে ১০ অক্টোবর আমরা রওনা হলাম। আমাদের বহরে প্রায় একশাে গাড়ি। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ৫৯টা সিভিল ট্রাক দিয়েছিল, বাকিগুলাে আমার ব্যাটালিয়নের জিপ, ডজ, থ্রি টন এই সব। টানা দু’দিন দু’রাত চলার পর গৌহাটিতে পৌছুলাম। গৌহাটি থেকে শিলং। শিলং থেকে দীর্ঘ পাহাড়ি ও বিপদসঙ্কুল রাস্তা পাড়ি দিয়ে বৃষ্টিবহুল চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম আমরা। মেঘের দেশ চেরাপুঞ্জি। চারদিকে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে নানা আকারের পাখর। চোখে পড়লাে অনেক পাহাড়ি ঝরনা। আর বহু উচুতে বলে হাত বাড়ালেই যেন মেঘের নাগাল! আকাশের গা-ছোঁয়া পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলেছি, হঠাৎ করেই দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেলাে। গাড়ির সামনে পথের ওপর ভেসে এসেছে এক টুকরাে মেঘ! তাই এ বিপত্তি। ভাসমান মেঘটা সরে যেতেই আবার যাত্রা। ৫ হাজার ফুট নিচে দিগন্ত বিস্তৃত সমতলভূমি, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। অদ্ভুত এক ধরনের অনুভূতি হচ্ছিল। চেরাপুঞ্জির বৃষ্টির কথা এতােদিন কানে শুনেছি, এবার চোখে দেখা হলাে। এই অক্টোবর মাসেও ক’দিনের যাত্রায় চেরাপুঞ্জির বৃষ্টিতে ভেজার অভিজ্ঞতা হলাে। চেরাপুঞ্জি হয়ে আমরা এলাম শেলা বিওপিতে। শেলা বিওপির অবস্থান সিলেটের ছাতক শহর থেকে বারাে মাইল উত্তরে, ভারতে। শেলা বিওপির পাশেই বাশতলা নামে একটা জায়গা গােটা জায়গা জুড়ে শুধু ছােট ছােট পাহাড় আর ঘন জঙ্গল। আপাতত জঙ্গল পরিষ্কার করে অনেকগুলাে তবু পেতে বঁশতলায় ক্যাম্প করলাম আমরা এই ক্যাম্পেই ক্যাপ্টেন আকবর, আশরাফ আর আমার পরিবারের থাকার ব্যবস্থা হলাে। আমাদের পরিবার এর আগে ছিল তুরার উপকণ্ঠে একটা ভাড়া বাড়িতে। বাঁশতলা আসার সময় আকবর গিয়ে ওদের সঙ্গে করে নিয়ে আসে।
এজন্য সে আমাদের একদিন পর রওনা হয়। বাঁশতলায় আমাদের গুছিয়ে উঠতে উঠতে বেলা গড়িয়ে গেলাে। সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত ও ভারতীয় জেনারেল গিল সন্ধ্যায় ভারতীয় ১০১ কমুনিকেশন জোনের জিওসি মেজর জেনারেল শুরক্স সিং গিল এবং ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলী (পরে লে. জেনারেল অব.) আমাদেরকে স্বাগত জানাতে এলেন। কথাবার্তার এক পর্যায়ে জে, গিল এবং মেজর শওকত জানালেন, সেদিন ভাের রাতেই আমাদেরকে অপারেশনে যেতে হবে। তারা বললেন, পুরাে ব্যাটালিয়ন এই অপারেশনে যাবে, সঙ্গে দেয়া হবে আরাে তিনটি এফএফ (ফ্রিডম ফাইটার) কোম্পানি। এফএফ কোম্পানিগুলাে ছিল সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে। ৫ নম্বর সেক্টরে এসময় কোনাে নিয়মিত সেনাদল ছিল না। এই সেক্টরে অপারেশন চালাতে মেজর শওকতকে সাহায্য করার জন্য জেড ফোর্স থেকে সাময়িকভাবে আমাদেরকে পাঠানাে হয়। এদিকে জেড ফোর্স। কমান্ডার মেজর জিয়া তুরা থেকে সিলেটের পুবদিকে মুভ করলেন। তার সঙ্গে প্রথম ও অষ্টম বেঙ্গল। তৃতীয় বেঙ্গলকে নিয়ে আমি এলাম সিলেটের উত্তরাঞ্চলে। যাই হােক, সেক্টর কমান্ডার মেজর শওকত এবং ভারতীয় জেনারেল গিল বললেন, আমাদেরকে (তৃতীয় বেঙ্গলকে) প্রথমে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে অবস্থিত পাকসেনাদের অবস্থান দখল করতে হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে দখল করতে হবে ছাতক শহর। পৌছানাে মাত্রই অপারেশনের অর্ডার শুনে আমরা কিছুটা অবাক হলাম। এই অঞ্চলে আমরা কেউ আগে আসি নি। এলাকাটা সম্পর্কে আমাদের কারােরই কোনাে ধারণা নেই। যে অবস্থানটা দখল করতে বলা হলাে, সেটা। বাঁশতলা থেকে দশ-বারাে মাইল দূরে। চারদিকে শুধু বিল আর হাওর। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আর শহরের মাঝখানেও বিরাট সুরমা নদী। এক কথায় খুবই দুর্গম এলাকা। তার ওপর আমাদের কাছে ম্যাপ, কম্পাস বা যােগাযােগের সরঞ্জাম (Signal sets) বলতে কিছুই দেয়া হয় নি।
অবাস্তব এক অভিযানের পরিকল্পনা
প্রায় ৪শ’ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে সবাই খুব ক্লান্ত। আর এ অবস্থাতে সেদিন ভাের রাতেই অভিযানে যেতে হবে। একেবারে অবাস্তব পরিকল্পনা। সাধারণ বাস্তববুদ্ধি-বিবর্জিত উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা। যাই হােক, অপারেশনের নির্দেশনা দেয়া হলাে এরকমের ক্যাপ্টেন মােহসীন তার চার্লি কোম্পানি নিয়ে ছাতকের উত্তর-পশ্চিমে দোয়ারা বাজারের নিকটবর্তী টেংরাটিলা দখল করবে, যাতে করে পাকসেনারা তাদের অবস্থানের সাহায্যার্থ ছাতকের দিকে অগ্রসর হতে না পারে। দোয়ারাবাজারে পাকিস্তানিদের ফ্রন্টিয়ার কনস্ট্যালারির একটি দল প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল। ছাতক ও ভােলাগঞ্জের মধ্যে ছিল একটা রােপওয়ে। সেই রােপওয়ে দিয়ে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির জন্য ভােলাগঞ্জ থেকে চুনাপাথর আনা হতাে। রােপওয়েটির প্রায় নিচ দিয়েই ভােলাগঞ্জ থেকে ছাতক পর্যন্ত একটা হাঁটাপথও আছে। পথটা গিয়ে পৌছেছে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি পর্যন্ত। সিমেন্ট ফ্যাক্টরির মাইল দেড়েক উত্তরে আরেকটি পায়ে-চলা-পথ দোয়ারাবাজারের দিক থেকে এসে এই রােপওয়ের নিচের রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। ঐ রাস্তা ধরে পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে আমাদের মূল বাহিনীর পেছনে এসে আক্রমণ করতে না পারে, সে জন্যই দোয়ারাবাজার দখল করতে হবে। ইকো কোম্পানি থাকবে এই হাঁটাপথ দুটোর সংযােগস্থলের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে, যাতে শত্রুপক্ষ দোয়ারাবাজার থেকে আমাদের পেছনে কোনাে সৈন্য সমাবেশ করতে না পারে। ছাতক শহর ও সিলেটের মধ্যে গােবিন্দগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে। গােবিন্দগঞ্জে সিলেট-ছাতক এবং সিলেট-সুনামগঞ্জ রাস্তা এসে মিলেছে। সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের দিকে মাইল বিশেক ভেতরে এর অবস্থান। ছাতক শহর থেকে দূরত্ব ১০ মাইল। লে. নূরন্নবীকে তার ডেলটা কোম্পানি নিয়ে এই গােবিন্দগঞ্জের রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করার দায়িত্ব দেয়া হলাে। সিলেট থেকে ছাতকে পাকিস্তানি রিইনফোর্সমেন্ট আসা ঠেকাতে হবে তাকে সেই সঙ্গে ছাতক থেকে যেন পাকসেনারা সিলেটে পশ্চাদপসরণ করতে না পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। ছাতক অবরােধ এবং দখলের জন্য মূল ফোর্স হিসেবে রইলাে আলফা ও ব্রাভাে কোম্পানি, ছাত্রদের নিয়ে গঠিত ইকো কোম্পানি এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকতের দেয়া তিনটি এফএফ কোম্পানি। এ ছয়টি কোম্পানি প্রথমে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি আক্রমণ করে দখল করবে। এরপর নদী পার হয়ে ছাতক শহরে অভিযান চালাবে। ভারতীয়রা জানালাে, তারা এসময় আর্টিলারি সাপাের্ট দেবে।
শুরু হলাে অপারেশন
অপারেশন শুরু হওয়ার কথা পরদিন অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর ভাের পাঁচটায়। রাতে রওনা হলাম আমরা। মেজর শওকত এ সময় আমার সঙ্গে ছিলেন। পরিকল্পনা মতাে আলফা ও ব্রাভাে কোম্পানি বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকে ক্যাপ্টেন আনােয়ার ও আকবরের নেতৃত্বে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে তীব্র আক্রমণ শুরু করলাে। তাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় টিকতে না পেরে সেখানে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা এক পর্যায়ে ফ্যাক্টরির অবস্থান ছেড়ে দিয়ে সুরমা নদীর ওপারে ছাতক শহরে পিছিয়ে গেলাে। ৩০ এফএফ এবং টোচি স্কাউটস-এর সৈন্যরা সেখানে অবস্থান করছিল। আনােয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দখল করে সেখানে অবস্থান নেয়। আকবর ঠিক তার পেছনেই, মাঝখানে একটা বিল। এদিকে দোয়ারাবাজারে একটা বিপর্যয় ঘটে গেলাে। দোয়ারাবাজার ঘাটে আগে থেকেই পাকিস্তানিরা তৈরি হয়ে ছিল। পাকসেনা, রাজাকার বাহিনী এবং পাকিস্তান থেকে আসা ফ্রন্টিয়ার কনস্ট্যাবুলারি তখন ঘাট এলাকায় প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল। হাওর-বিল পার হয়ে মােহসীন ও তার চার্লি কোম্পানি দোয়ারাবাজার ঘাটে নামার আগেই তারা গুলি চালাতে শুরু করে। খুব সম্ভবত রাজাকারদের কাছ থেকে তারা আমাদের আগমনের খবর পেয়ে যায়। খবর পাওয়ার কথাই। প্রায় শ খানেক গাড়ির বহর আমাদের। হেড লাইট জ্বালিয়ে এতােগুলো গাড়ি আসছে, সেটা চোখে পড়া খুবই স্বাভাবিক। আর উচু পাহাড়ি রাস্তা বলে অনেক দূর থেকেই দেখতে পাওয়ার কথা। পাকসেনারা বুঝে গিয়েছিল, এ এলাকায় আমাদের সৈন্য সমাবেশ হচ্ছে। সে জন্য তারা পুরােপুরি সতর্ক ছিল। মােহসীনের কোম্পানিটা নৌকায় থাকা অবস্থাতেই পাকিস্তানিরা গুলি চালাতে শুরু করলে বেশ কয়েকটি নৌকা পানিতে ডুবে যায়। এবং অতর্কিত আক্রমণে পুরাে কোম্পানিই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই যুদ্ধের দিন তিনেক পরও আমি মােহসীনের কোম্পানির জনা ত্রিশেক সহযােন্ধার কোনাে খবর পাই নি। এরা শহীদ, আহত, না বন্দি কিছুই বােঝা যাচ্ছিল না। দেড়শাে যােদ্ধার প্রায় ষাট শতাংশ অস্ত্রই পানিতে পড়ে যায়।
প্রাণ রক্ষার্থ আমাদের সৈন্যরা হাওরের গভীর পানিতে অস্ত্রশস্ত্র ফেলে দিতে বাধ্য হয়। কাজেই কোম্পানি তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন, অর্থাৎ দোয়ারাবাজার দখল এবং প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে ব্যর্থ হলাে। ওদিকে নৌকা যােগাড় করতে দেরি হওয়ায় গােবিন্দগঞ্জে পৌছুতে নবীর কিছুটা বিলম্বই হয়ে যায়। সেই সুযােগে পাকিস্তানিরা ছাতকে তাদের ট্রপস্ রিইনফোর্সমেন্ট পাঠিয়ে দেয়। তারা ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরির আশপাশে আমাদের অবস্থানে প্রচণ্ড শেলিং শুরু করলাে। ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দখল করার জন্য আমরা সেখানে কিছু শেলিং করেছিলাম। ফ্যাক্টরি দখল হয়ে গেলে ছাতক শহরের ওপর কিছু গােলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু বেসামরিক লােকদের হতাহত হওয়ার আশঙ্কায় কিছুক্ষণ পরই শহরে গােলাবর্ষণ বন্ধ করা হলাে। এদিকে নবীর গােবিন্দগঞ্জে পৌছুতে দেরি হওয়ার সুযােগে সিলেট থেকে পাকবাহিনীর নতুন সৈন্য এসে যায়। ৩০ এফএফ রেজিমেন্টের দু’কোম্পানি এবং ৩১ পাঞ্জাবের এক কোম্পানি সৈন্য ছাতক শহরে পৌছে যায়। নৰী গােবিন্দগঞ্জে পৌছানাের পরদিন পাকসেনাদের ঐ কোম্পানিগুলোর একটি অংশ তার ওপর আক্রমণ চালায়। নবী সেখানে প্রতিরােধ যুদ্ধ করে। পাকসেনাদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি ঘটিয়ে এক পর্যায়ে সে পিছিয়ে আসে। লে, নবীর গােবিন্দগঞ্জ পৌছুতে দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ, আমাদের কাছে ওখানকার কোনাে ম্যাপ ছিল না। প্রায় ৪শ’ মাইল রাস্তা পাড়ি দিয়ে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে আমরা ঐ এলাকায় পৌছুই। আমাদের কাছে এলাকাটি ছিল এক বিশাল প্রশ্নবােধকের মতাে। আমাদের অনেকেই এর আগে কখনাে হাওর দেখে নি। তার ওপর আমাদের কোনো Signal Sets দেয়া হয় নি।
পুরাে যুদ্ধের সময়টাই আমাদের (ব্যাটালিয়ন থেকে কোম্পানি এবং কোম্পানি থেকে প্লাটুন) যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম ছিল রানার এবং তার মাধ্যমে আদান-প্রদান করা চিঠিপত্র। এরকম বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আমাদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হয়। | প্রথাগত (Conventional) যুদ্ধ, যেমন Attack এবং Defenceদুটোতেই বহুবার অংশ নিয়েছি আমরা কোনাে Signal communication ছাড়াই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করেছি। যেমন বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ, রৌমারীর প্রতিরক্ষা এবং ছােটখেল আক্রমণ ও দখল। আবার ছাতক ও গােয়াইনঘাট অভিযানের মতাে ব্যর্থতাও ছিল।
নবীর সঙ্গে যাওয়া স্থানীয় গাইডরা অন্ধকার রাতে হাওরে চলতে গিয়ে দিক হারিয়ে ফেলেছিল। অবশ্য এর চাইতেও বড়াে কারণ ছিল। তা হচেছ, নবীর অধীনস্থ দু’জন প্লাটুন কমান্ডারের সঙ্গে তার অহেতুক ভুল বােঝাবুঝি। নবী EME Corps-এর একজন ইঞ্জিনিয়ার অফিসার। পদাতিক ব্যাটালিয়নের বর্ষীয়ান এবং অনেকদিনের চাকরির অভিজ্ঞতালব্ধ দু’জন পাটুন কমান্ডার (জেসিও) এই বিপদসঙ্কুল অভিযানের যৌক্তিকতা নিয়ে যাত্রাপথে সন্দেহ ও উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা একজন অ-পদাতিক (Non Infantry) বাহিনীর অফিসারের অধীনে বাংলাদেশের প্রায় ২৫ মাইল অভ্যন্তরে অবস্থান গ্রহণ করে পাকবাহিনীর মােকাবেলা করতে খুব একটা স্বস্তিবােধ করছিল না। এই অভিযানের আদেশ পেয়ে জেসিও দু’জন একরকম আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। যাত্রাপথেই এরকম অপ্রত্যাশিত নৈরাশ্য! কোনােমতে তাদেরকে মানিয়ে নিয়ে নবী কয়েক ঘণ্টা পরে নির্ধারিত স্থানে পৌছায়। এরি মধ্যে পাকিস্তানিদের ৩০ এফএফ রেজিমেন্টের রিইনফোর্সমেন্ট এবং কয়েকটা আর্টিলারি গান ছাতকে পৌছে যায়। এদেরই একটা অংশ পরদিন নবীর গােবিন্দগঞ্জ অবস্থানে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর নবী পশ্চাদপসরণ করে ভােলাগঞ্জে অবস্থান নেয়। সেখান থেকেই সে যাত্রা শুরু করেছিল। গােবিন্দগঞ্জের যুদ্ধে পাকবাহিনীর একজন অফিসারসহ অনেক সৈন্য হতাহত হয়।  আমরাও এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন যােদ্ধাকে হারাই। ছাতক যুদ্ধ শেষে পুরাে ঘটনা জানতে পেরে আমি ঐ দু’জন জেসিও-কে Close করে বাঁশতলায় পাঠিয়ে দিই। বাশতলায় তখন আমার ব্যাটালিয়নের এলওবি। যুদ্ধ শেষে তাদেরকে অন্য একটি ব্যাটালিয়নে বদলি করা হয়।
আনােয়ার ও আকবরের পশ্চাদপসরণ
এদিকে ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দখল করে আনােয়ার ও আকবর দু’দিন ধরে সেখানে অবস্থান নিয়ে আছে। এই দু’দিনের মধ্যে পাকিস্তানিরা ছাতকে যে রিইনফোর্সমেন্ট নিয়ে এলাে, সেটা দোয়ারাবাজারে এসে আমাদের পেছনে সমবেত হতে লাগলাে। আমাদের অগ্রবর্তী সৈন্যরা তখন সুরমা নদীর সামনে পৌছে গেছে। ক্যাপ্টেন আনােয়ার তাদের সঙ্গে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানিরা দোয়ারাবাজার দিয়ে আমাদেরকে পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে। আমাদের পেছনে আবার ছিল ইকো কোম্পানি অর্থাৎ ছাত্র মুক্তিযােদ্ধারা। পাকসেনাদের সঙ্গে তাদেরও প্রচণ্ড যুদ্ধ হলাে। ইকো কোম্পানির ছেলেরা এ সময় দুর্দান্ত লড়াই করে। এ যুদ্ধে তাদের বেশ কয়েকজন যােদ্ধা নিজেদের অবস্থানে থেকে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শহীদ হয়। ইকো কোম্পানির বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধের ফলে পাকিস্তানিদের অগ্রাভিযান কিছুটা হলেও ব্যাহত হয়। এক পর্যায়ে ইকো কোম্পানির অবস্থান পাকবাহিনীর হস্তগত হলে তারা আমাদের পেছনে এসে পড়ে। এ কারণে আমরা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই।  ক্যাপ্টেন আনােয়ারের আলফা কোম্পানি তখন দখলিকৃত সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে অবস্থান করছে। তার পেছনেই একটি ছােট বিলের পাড়ে উচু টিলার মতাে জায়গায় ক্যাপ্টেন আকবরের ব্রাভাে কোম্পানি। এদিকে পাকবাহিনীর রিইনফোর্সমেন্ট (৩০ এফএফ ও ৩১ পাঞ্জাব) দোয়ারাবাজার হয়ে ইকো কোম্পানির অবস্থান পর্যদস্ত করে আমাদের অবস্থানের প্রায় পেছন এসে পড়েছে।
আনােয়ার এবং আকবরের অবস্থানের ওপর পেছনে দিক থেকে একটা আক্রমণ অত্যাসন্ন। আমি তখন ক্যাপ্টেন মোহসানের চালি কোম্পানির উদ্ধারপ্রাপ্ত সেনাদের সঙ্গে ইকো কোম্পানির অবস্থান পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছি। যুদ্ধে একটা বিশৃঙ্খল অবস্থা। আমাদের কারাে সঙ্গে কারাে যােগাযােগ নেই। পাকিস্তানিরা অনবরত শেলিং করে যাচ্ছে। সবগুলােই Air burst অর্থাৎ আকাশেই ফেটে গিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে নিচে আঘাত হানছে। আনােয়ার ও আকবরের অবস্থানগুলােতে পেছন দিক থেকে রাইফেল আর এলএমজির গুলিও গিয়ে পড়ছিল। চারদিকে একটা সংশয় আর অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে অবস্থানের পেছনদিককার গােলাগুলি খুবই বিপজ্জনক। আমাদের বেসামাল অবস্থা। আক্রমণ করতে এসে এখন নিজেরাই আক্রান্ত হয়ে পড়েছি। এই পরিস্থিতিতে সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকত আক্রমণের দ্বিতীয় পর্যায় স্থগিত রেখে আকবরকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। আকবরের অবস্থানের ঠিক পেছনে অবস্থান করছিলেন তিনি। আনােয়ারকে ফিরে আসার নির্দেশ পৌছে দেয়ার দায়িত্ব আকবরকেই দেয়া। হলাে। আগেই বলেছি, আমাদের মধ্যে কোনাে রকম Signal communication ছিল না। আকবর তার কোম্পানিকে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে নিজেই কয়েকজন সৈন্য নিয়ে সেই গভীর রাতে গলা সমান পানি ভেঙে বিল অতিক্রম করে আনােয়ারের অবস্থানে এসে পৌছায়। তখন প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ চলছিল। সেই সঙ্গে হালকা অস্ত্রের অবিরাম গােলাগুলি। তাের
হওয়ার আগেই আনােয়ারের অবস্থান আক্রান্ত হওয়ার সমূহ শঙ্কা।
ফিরে যাওয়ার নির্দেশ সময়মতাে না পেলে আনােয়ার এবং তার কোম্পানি বিচ্ছিন্ন হয়ে আক্রমণকারীদের যেরাওয়ের মধ্যে পড়ে যেতে পারতাে। আনােয়ার ও আলফা কোম্পানির সঙ্কটময় অবস্থার কথা ভেবে আকবর তাদের পশ্চাপদসরণ নিশ্চিত করার জন্য কোনাে রানার না পাঠিয়ে নিজেই এই দায়িত্বটি পালন করে। আলফা কোম্পানি একটি নিশ্চিত বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পায়। | ছাতক এলাকায় ১৪ থেকে ১৮ অক্টোবর— এই পাঁচদিন যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে দু’পক্ষেরই বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। বলতে গেলে আমার তৃতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও এ যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা ব্যাপক আন্তর্জাতিক প্রচার পাই। তাছাড়া সেবারই প্রথম একটি বড়াে ফোর্স নিয়ে অপারেশন করি আমরা, যার ফলে আমাদের যােদ্ধাদের মনােবল অনেকটাই বেড়ে যায়। পাক বাহিনীও বুঝতে পারে, মুক্তিবাহিনী এখন অনেক সংগঠিত। তারা এখন আগের চেয়ে অধিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে এবং পাকবাহিনীকে মােকাবেলা করার শক্তি অর্জন করেছে। এই যুদ্ধের পর আমরা ৫/৬ মাইল পিছিয়ে এসে বাঁশতলা সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের ভেতরেই বাংলাবাজারে প্রতিরক্ষাগত অবস্থান গ্রহণ করি।
সিদ্দিক সালিকের ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কোনাে অভিযানকেই ভারতীয় অথবা পাকিস্তানিরা  কখনাে সম্মানজনকভাবে চিত্রিত করে নি। তাদের কোনাে গ্রন্থ বা রচনায় বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে কৃতিত্বের কথাই স্বীকৃত হয় নি। পাকিস্তানিদের লেখা পড়লে মনে হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের কৃতিত্ব সবই ভারতীয় সেনাবাহিনীর। কিন্তু সিদ্দিক সালিক নামে পাকিস্তান আর্মির একজন ব্রিগেডিয়ার (তিনি কয়েক বছর আগে পাক প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হকের সঙ্গে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন) ‘Witness to Surrender’ নামে একটা বই লিখেছেন, যেখানে ছাতক যুদ্ধের কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সিদ্দিক সালিক ঢাকাস্থ আইএসপিআর-এ কর্মরত ছিলেন বলে যুদ্ধের খবরাখবর সম্পর্কে ভালােই অবগত ছিলেন। পাকিস্তানি এই লেখকের গােটা বইয়ে মুক্তিবাহিনীর মাত্র দুটো অভিযানের কথা স্থান পেয়েছে। তার একটি হলাে ছাতক অভিযান, অন্যটি প্রথম বেঙ্গলের কামালপুর আক্রমণ । লেখক তার বইতে লিখেছেন, আক্রমণকারীরা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দখল করতে পারলেও ছাতক শহর তাদের পাকিস্তানিদের হাতেই রয়ে গিয়েছিল। ছাতকের যুদ্ধ যে পাকিস্তানি হেড কোয়ার্টারে বড়াে ধরনের ধাক্কা দিয়েছিল, সিদ্দিক সালিকের বইয়ে তার প্রমাণ রয়েছে। তাঁর বক্তব্য, ভারতীয় বাহিনী ছাতক শহর ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে আক্রমণ চালিয়েছিল। প্রচণ্ড হামলার পর তৃতীয় বেঙ্গলের সহায়তায় তারা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি দখল করে নেয়। সিদ্দিক আরাে লিখেছেন, এ আক্রমণ এতাে প্রচণ্ড ছিল যে আমরা সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছেড়ে দিয়ে ছাতক শহরে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হই। পরে আমরা ৩১ পাঞ্জাব এবং ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের একটা রেজিমেন্ট নিয়ে কাউন্টার-অ্যাটাক করি।
তিনদিন যুদ্ধের পর অবস্থানটি আবার আমাদের অধিকারে আসে। লেখক তাঁর বইতে সম্পূর্ণ সত্য তথ্য দিয়েছেন, শুধু ভুল করেছেন আক্রমণকারীদের চিহ্নিত করতে। তিনি লিখেছেন, ৮৫ বিএসএফ এই আক্রমণ পরিচালনা করে এবং এতে তৃতীয় বেঙ্গল তাদের সাহায্য করেছিল মাত্র। প্রকৃত তথ্য এই যে, ভারতীয় সেনাসদস্যদের একজনও এই আক্রমণাভিযানের সঙ্গে জড়িত ছিল না। এটি পুরােপুরিভাবেই তৃতীয় বেঙ্গল এবং ৫ নম্বর সেক্টরের তিনটি এফএফ কোম্পানির নিজস্ব অভিযান ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে কেবল আমরা ভারতীয়দের কিছু গােলাবর্ষণের সাহায্য নিয়েছিলাম।
ওসমানী ও জিয়া এলেন বাঁশতলায়
ছাতক অভিযানের ব্যর্থতার দায়িত্ব নির্ধারণ করতে ২০ অক্টোবর ওসমানী সাহেব বাঁশতলায় আসেন। তিনি ঢালাওভাবে আমার এবং অধীনস্থ অফিসারদের ওপর ব্যর্থতার দায়িত্ব চাপিয়ে দিলেন। আমি প্রতিবাদ করে বললাম, কোলকাতা এবং শিলংয়ের পাহাড়-চূড়ায় বসে যারা এরকম একটি অবাস্তব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন এবং আমরা এ অঞ্চলে পৌছানাে মাত্র কোনাে রকম প্রস্তুতি ছাড়াই অভিযানে যেতে বাধ্য করেছেন, ব্যর্থতার দায়িত্বভার তাদের ওপরে চাপানােই যুক্তিযুক্ত হবে। ওসমানী তখনকার মতাে আর কিছু না বললেও পরবর্তীকালে অর্থাৎ ১৯৭২ সালে তৃতীয় বেঙ্গলের ওপর তার ঝাল ঝেড়েছেন বীরত্বসূচক পদক দেয়ার সময়। পদক বিতরণকালে তৃতীয় বেঙ্গলের অনেক যােগ্য সদস্যের প্রতি অন্যায়ভাবে বিমাতাসুলভ আচরণ প্রদর্শন করা হয়। একটি রাজনৈতিক যুদ্ধ, যা নাকি জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, সেখানে কেবল কিছুসংখ্যক যােদ্ধাকে খেতাব দেয়া কতােটুকু যুক্তিযুক্ত হয়েছে সেটা পর্যালােচনা এবং সেই সঙ্গে পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এর মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা বিভাজিত হয়েছিল। অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ ঘটনা অনুঘটিত ও অবহেলিত রয়ে যায়। সেই সব ঘটনার নায়কদের সম্বন্ধে কীর্তিপত্র বা citations লেখার কেউ তাে তখন ধারেকাছেও ছিলেন না! সেক্টর কমান্ডারদের হেড কোয়ার্টারগুলাে সীমান্ত পাড়ের বড়াে শহরের চৌহদ্দিতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সমগ্র বাংলাদেশের বিস্তৃত রণক্ষেত্রে কোথায় কী ঘটছে, তার কতােটুকু সংবাদ তাদের কাছে পৌছুতাে? 
পদক বিতরণের নামে এই প্রহসনে তৎকালীন সরকারের আস্থা ও বিশ্বাসের অমর্যাদা করে তৃতীয় বেঙ্গলের সদস্যদের আত্মত্যাগ, রক্তদান এবং সার্বিক অবদানকে ওসমানী বিদ্বেষমূলকভাবে অবমূল্যায়ন করেন। এই প্রহসনের ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান না করেও কেবল ওসমানী ও তার নিয়ােজিত নির্বাচকদের সঙ্গে সুসম্পর্ক এবং ব্যক্তিগত পছন্দের কারণে বহুসংখ্যক অফিসার খয়রাতি বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত হন। যুদ্ধের ময়দানে পালিত ভূমিকা বিবেচনা সেখানে অনুপস্থিত ও গৌণ, মুখ্য উপাদান ছিল গােষ্ঠী রাজনীতি ও তদবির।  ছাতকের বিপর্যয়ের সংবাদ পেয়ে আমাদের উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত করার জন্য জেড ফোর্স কমান্ডার জিয়া বাঁশতলায় আসেন। জিয়াকে ওসমানীর সঙ্গে আমার বাদানুবাদের কথা খুলে বলাতে তিনি বললেন, ‘You have done the right thing, I shall vindicate you and your battalion at an appropriate moment. মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ৯ মার্চ এক ব্যক্তিগত চিঠিতে তিনি আমাকে 1629, ‘Do convey my eternal gratitude and congratulation to your men for the fine performance at a very high cost during our War of Independence. You all must understand that “truths’ and ‘facts’ emerge after struggle for sometime, but they do come out definitely. I can assure you that I shall play my part for your battalion at the right moment and well.’ কিন্তু কিছুই হলাে না। জিয়াও তাঁর কথা রাখেন নি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তৃতীয় বেঙ্গলের সার্বিক অবদান অবহেলিত এবং অবমূল্যায়িতই রয়ে গেলাে।
নবীর কোম্পানির পুনর্গঠন ছাতক যুদ্ধের পর নবী তার অবস্থান থেকে সরে এসে শেলার মাইল পাঁচেক পূৰে ভােলাগঞ্জ কোলিয়ারির পাশে অবস্থান নিয়েছিল। অক্টোবরের ১৯ তারিখের দিকে আমি নবীর নেতৃত্বাধীন ডেল্টা কোম্পানির অবস্থানে যাই। উদ্দেশ্য নবীর কোম্পানির অভ্যন্তরীণ রদবদল ও পুনর্গঠন। দু’জন প্লাটুন কমান্ডারকে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে বাঁশতলায় (Rear HQ) close করে রাখার ফলে সৃষ্ট শূন্যতা মােকাবিলায় এই রদবদল খুবই জরুরি হয়ে পড়েছিল। ব্যাটালিয়নের অভ্যন্তরীণ রদবদল এবং যুদ্ধাবস্থায় সেনাদের পদোন্নতি জাতীয় কাজ সিও-কেই করতে হয়। সারাদিন ভােলাগঞ্জ থেকে কোম্পানিটির পুনর্গঠন কাজ তদারকি করলাম। জেনারেল গিলের কনফারেন্স সন্ধ্যায় দু’জন রানার বাশতলা থেকে অ্যাডজুট্যান্ট আশরাফের বার্তা নিয়ে এলাে। পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় আমাকে শিলংয়ের ১০১ কমুনিকেশন জোনের জিওসির অফিসে অনুষ্ঠেয় conference-এ যােগ দিতে হবে। আমার নির্দেশমতাে আশরাফ শেলা বিওপি-তে রাত তিনটা নাগাদ একটি জিপ এবং প্রােটেকশন পাটি তৈরি করে রাখলাে। রাত দুটো নাগাদ ভােলাগঞ্জ থেকে রওনা হলাম। পায়ে হাটা পাহাড়ি রাস্তা। গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় পাঁচ মাইল। নিচ্ছিদ্র অন্ধকার। জনমানবহীন এলাকা। চলার সময় পাহাড়ি বুনাে লতাপাতা ও গাছের ছােট ছােট ডাল শরীরে এবং অনাবৃত মুখে আছড়ে পড়ছিল। যাই হােক, খুব দ্রুত হেঁটে আমি ও আমার সহযােদ্ধারা রাত চারটার কিছু আগে শেলা বিওপি-তে পৌছে যাই। সেখানে পৌছেই নতুন প্রােটেকশন পার্টি নিয়ে শিলংয়ের পথে যাত্রা শুরু করি। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শিলংয়ের অবস্থান ৬ হাজার ফুট উচুতে। তাই শিলংয়ের যতােই কাছে যাচ্ছি, ততােই ঠাণ্ডা লাগতে শুরু করলাে।
এক সময় মনে হলাে শীতে জমে যাবাে। আমরা আসছি সমতল ভূমি থেকে, কাজেই গায়ে সুতির একটা শার্ট মাত্র। শিলংয়ে কাছাকাছি পৌছে গেছি এমন সময় মনে হলাে, টুপ টুপ করে আমার মাথা ও ঘাড়ের কাছ থেকে কি যেন গাড়ির ভেতরে পড়লাে। গাড়ি থামিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম কতোগুলাে বড়াে কুল বরইয়ের মতাে কি যেন পড়ে রয়েছে গাড়ির ভেতরে। ভালাে করে পরীক্ষা করে দেখা গেলাে, ওগুলাে সব গেছে জোঁক। রক্ত খেয়ে ফুলে বরইয়ের মতাে গােল হয়ে গেছে। শীতের তীব্রতায় ওরাও আমার শরীর ছেড়ে দিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছে। একটা জোক তখনাে চোখের একটু ওপরে লেগেছিল। আমার মুখ ও ঘাড় তখন সত্যিকার অর্থেই রক্তাক্ত। পাঁচটি জোঁক বেশ কয়েক ঘণ্টা ধরে পরম নিশ্চিন্তে আমার রক্ত চুষছিল। কিন্তু একটুও টের পাই নি। হয়তাে যুদ্ধের চিন্তায় আচ্ছন্ন ছিলাম বলে।
গােয়াইনঘাট অভিযানের আদেশ
যাই হােক, সময়মতাে জেনারেল গিলের সামনে হাজির হলাম। তিনি বললেন, তােমার ব্যাটালিয়ন এখন দু’ভাগ করতে হবে। একভাগ অর্থাৎ দুই কোম্পানি থাকবে ছাতক-বাশতলা এলাকায়। বাকি দুই কোম্পানি নিয়ে তুমি যাবে ডাউকি সাব-সেক্টরে। তার আগে তােমাকে একটা কাজ করতে হবে। গােয়াইনঘাটে পাকসেনাদের অবস্থান আক্রমণ করবে তুমি। গােয়াইনঘাটে অবস্থান সিলেটের ডাউকি সীমান্ত থেকে মাইল দশেক দক্ষিণে, অর্থাৎ বাংলাদেশের অনেকটাই ভেতরে। গােয়াইনঘাটের উত্তরে আবার রাধানগর প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্স, সেটা পাকিস্তানিদের খুবই শক্তিশালী একটা ঘাঁটি। গােয়াইনঘাটেও পাকিস্তানিদের বেশ শক্তিশালী অবস্থান ছিল।  গােয়াইনঘাটে পিয়াইন নদীকে সামনে রেখে পাশে ডাউকি-রাধানগরগােয়াইনঘাট সড়ক কভার করে পাক-ডিফেন্স। গােয়াইনঘাট হয়ে নদীর পাড় ধরে সােজা গেলে শালুটিকর এয়ারপাের্ট। এটাই সীমান্ত থেকে সিলেটে যাওয়ার সংক্ষিপ্ততম রাস্তা। রাস্তাটা তখন পায়েহাটা পথ হলেও স্ট্র্যাটেজিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গিলের নির্দেশমতাে ১৮ অক্টোবর দুটো কোম্পানি ক্যাপ্টেন মােহসীনের অধীনে রেখে গেলাম। মােহসীন তখন আমার টুআইসি। আলফা কোম্পানির কমান্ডার আনােয়ারকে চিকিৎসার জন্য শিলং পাঠানাের ব্যবস্থা করলাম। মার্চে সৈয়দপুর এলাকার পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে আহত হয়েছিল আনােয়ার। এতােদিন সুচিকিৎসা হয় নি বলে কষ্ট পাচ্ছিল সে। ওর জায়গায় কমান্ডার হলাে সে, লে, মঞ্জুর। প্রসঙ্গত, ছাতক অপারেশন শেষে বাঁশতলায় ফিরে আসার পর আরাে দু’জন সেনা অফিসার আমাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এরা ছিল ‘ফাস্ট মূর্তি ব্যাচ’ অর্থাৎ যুদ্ধকালীন সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ সমাপনকারী অফিসার সে, লে, মজুর এবং সে, লে, হােসেন (মঞ্জুর পরে মেজর অব., হােসেন পরে লে. কর্নেল, ১৯৮১-তে ফাঁসিতে নিহত)। এ দু’জনকে যথাক্রমে আলফা ও ব্রাভাে কোম্পানিতে নিযুক্ত করা হয়। মূর্তি নামক স্থানে এদের প্রশিক্ষণ হয়েছিল বলে এর নাম হয়ে দাঁড়ায় মূর্তি  কমিশন। এদের গ্রুপটাই বাংলাদেশের সর্বপ্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার।
অভিযানের প্রস্তুতি
মঞ্জুরের আলফা কোম্পানি আর ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার নিয়ে প্রথমে গেলাম ভােলা। সেখান থেকে ডেল্টা কোম্পানিসহ কোনাকুনিভাবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড দিয়ে মাইল পনেরো দূরবতী হাদারপাড়ায় গেলাম। সেখানে আমরা একটা কনসেনট্রেশন এরিয়ার মতাে করলাম, অনেকটা হাইডআউট ধরনের। এখানে আমাদের দুটো কোম্পানি আর ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারের মােট প্রায় পাঁচশ সৈন্য। হাদারপাড়ায় আরাে দুটো এফএফ কোম্পানি যােগ দিলাে আমাদের সঙ্গে। মােট প্রায় সাতশ’ লােক নিয়ে একদিন একরাত সেখানে থাকলাম। এর মধ্যে গােয়াইনঘাটের পরিস্থিতি, রাস্তাঘাট সম্পর্কে খোঁজখবর নিলাম। গােয়াইনঘাট তখনাে বারাে মাইল দূরে। সারা রাত হেঁটে খুব ভােরে পিয়াইন নদীর পারে পৌছুলাম আমরা। পৌছে দেখি, যাদের ওপর নৌকা যােগাড় করার দায়িত্ব ছিল, তারা নৌকা যােগাড় করতে পারে নি। অথচ এখবরটাও তারা আমাদের দেয় নি। পাহাড়ি নদী বলে অবশ্য পিয়াইন বেশি চওড়া নয়, বড়ােজোর শ’ দেড়েক ফুট ছিল এর প্রশস্ততা। নদীর তীর বরাবরই পাকিস্তানিদের অবস্থান। ওপারের একটা স্কুলে তাদের হেড কোয়ার্টার। স্কুলটার ছাদে মেশিনগান বসানাে। কথা ছিল। গােয়াইনঘাটকে মাইল দেড়েক উত্তরে রেখে নৌকায় নদী পার হবাে। জায়গামতাে গিয়ে নৌকা না পেয়ে তাই বিপদেই পড়ে গেলাম। এর মধ্যে সকাল হয়ে গেলাে। সকাল হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তানিরা আমাদের দেখে ফেলে। ফলে যা হওয়ার তাই হলাে। দু’পক্ষের মধ্যে সমানে গােলাগুলি শুরু হয়ে গেলাে। আমরা পজিশনেই যেতে পারলাম না। নদী পার হয়ে তবে তাে অ্যাটাক করতে হবে! অথচ ওপারে গিয়ে পজিশন নেয়ার আগেই শুরু হয়ে গেলাে ফায়ারিং।
গােয়াইনঘাটের বিপর্যয়
সে, লে, মজুরের আলফা কোম্পানি ছিল সবার আগে। পাক আক্রমণের প্রথম ধাক্কাতেই ওদের সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাে আমাদের। নবীর ডেটা কোম্পানিরও বেশির ভাগ লােক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। রাত তিনটার দিকে আমরা যখন গােয়াইনঘাট এলাকায় গিয়ে পৌছই, তখন হঠাৎ করেই বাড়ি থেকে আজানের ধ্বনি উঠতে থাকে। অসময়ে আজান শুনে আমরা অবাক হয়ে যাই। এক বাড়ির আজান শুনে কিছুদূর পরপর বিভিন্ন বাড়ি থেকে আজান দেয়া হচ্ছিল। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, এভাবে আমাদের আপমনবার্তা পৌছে দেয়া হচ্ছিল পাকসেনাদের কাছে। আর আজান দেয়া হচিছল রাজাকারদের বাড়ি থেকে। কাজেই আচমকা আক্রমণ করে পাকিস্তানিদের হতভম্ব করতে পারি নি আমরা, বরং আগে থেকেই সতর্ক থাকায় ওরাই আমাদেরকে ভ্যাবাচ্যাকা খাইয়ে দেয়। যাই হােক, কিছুক্ষণের মধ্যে আলফা আর ডেল্টা দুটো কোম্পানিই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলাে। ওই অবস্থাতেই পাকসেনাদের সঙ্গে আমাদের দিন গােলাগুলি চললাে। আশপাশে ৫০/৬০ জন্য সৈন্য ছাড়া আর কাউকে পেলাম না। যােগাযােগ যে করবাে তারও উপায় নেই। যে-কোনাে কারণেই হােক, ভারতীয়রা আমাদের সিগন্যাল সেট, ম্যাপ, কম্পাস, বাইনােকুলার এসব প্রয়ােজনীয় রসদ সরঞ্জাম দেয় নি। পাকঅবস্থানের ওপর মেশিনগান আর তিন ইঞ্চি মর্টার চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। সেদিন আমাদের কাছে বেশকিছু মর্টারের পােলা ছিল। প্রায় পাঁচশ’ সৈন্যের প্রতিটি হাত একটা করে গােলা বহন করছিল।
কিন্তু বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াতেই সমস্যা দেখা দিলাে। মর্টারের গােলা দূরে থাক, সৈন্যদেরই পাত্তা নেই। এক সময় দক্ষিণ দিক থেকে কিছু সৈন্যকে বিলের ভেতর দিয়ে পানি ভেঙে এগিয়ে আসতে দেখলাম। কাছাকাছি এলে বােঝা গেলাে তারা আলফা কোম্পানির সৈন্য। ফায়ার কাভার দিয়ে নিয়ে এলাম তাদেরকে। সারাদিনসারারাত যুদ্ধ করে এভাবে পাকসেনাদের সামনে থেকে বাকি লােকদের উদ্ধার করতে হয়। দুপুরের দিকে মাথার ওপর দুটো ফিক্সড উইং প্লেন (ছােট প্রশিক্ষণ বিমান) এসে আমাদের ওপর মেশিনগানের গুলি চালাতে লাগলাে। কিন্তু প্লেন দুটো এতাে উঁচুতে ছিল যে তেমন একটা সুবিধা করতে পারে নি। তবে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে তা সাময়িকভাবে কিছুটা ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। আমরা নদীর এপারে বাঁধমতাে একটা উঁচু জায়গার আড়ালে ছিলাম বলে রক্ষা! কেবল স্কুলের ছাদে বসানাে পাকসেনাদের মেশিনগানটাই সমস্যা করছিল। এর মধ্যে সবাইকে পিছিয়ে এসে পশ্চাত্ত্বর্তী একটি গ্রামে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলাম। আমাদের কোম্পানিগুলাের অবস্থা তখন শােচনীয়। ডেলটার নবী ও গুটিকয় সৈন্য ছাড়া আশপাশে কেউ নেই। এফএফ কোম্পানিগুলােও উধাও। আমার নিজের হেড কোয়ার্টারের শ’খানেক সৈন্যের বেশির ভাগেরই খবর নেই। কয়েকজন জেসিও এবং এনসিওকে নিয়ে শত্রুর একেবারে সামনে থেকে বেশ ঝুঁকি নিয়ে কতক সৈন্যকে উদ্ধার করলাম। এরপর ধীরে ধীরে সবাই পেছনের একটা গ্রামে জড়াে হলাম। গ্রামটার নাম লুনি। এ যুদ্ধে আমাদের এমনই দুর্দশা হয় যে, জনা পনেরাে সৈন্যকে শেষ পর্যন্ত পেলামই না। সব মিলিয়ে গােয়াইনঘাট অপারেশন আমাদের জন্য একটা বিপর্যয়ই ছিল বলতে হবে। এখানকার পাকঅবস্থানটি ছিল খুবই সুরক্ষিত। মিত্র বাহিনীর কমান্ডাররা দূর থেকে পাহাড়ের চূড়ায় বসে চোখে বাইনােকুলার লাগিয়ে আর স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে পাওয়া ভাসা ভাসা তথ্যের ওপর নির্ভর করেই আমাদের বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করার নির্দেশ দিতাে। ফলে যেখানে বলা হতাে পাকবাহিনীর একটা সেকশন আছে, সেখানে গিয়ে দেখা যেতাে একটা প্লাটুন বসে আছে, আর প্লাটুন বললে হয়তাে দেখা যেতাে পুরােদস্তুর একটা কোম্পানি সেখানে উপস্থিত। গােয়াইনঘাটের বিপর্যয়ের কারণও তাই। আমরা পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না।
মিত্র বাহিনীর সঙ্গে মতবিরােধ
মিত্র বাহিনীর সেনানায়কের সঙ্গে ছাতক যুদ্ধের সময় থেকেই মতবিরােধ দেখা দেয় আমার। আমি বলেছিলাম, কনভেনশনাল অ্যাটাকে যাওয়া আমাদের ঠিক হবে না। অন্তত বর্তমান পর্যায়ে আমাদের সেই দক্ষতা অর্জিত হয় নি। প্রয়ােজনীয় যুদ্ধোপকরণও নেই বললেই চলে। আর প্রথাগত আক্রমণ করতে গেলে প্রতিপক্ষের চেয়ে তিনগুণ বেশি সৈন্য যেমন থাকতে হবে, তেমনি শত্রুর চেয়ে তিনগুণ বেশি ক্যাজুয়ালটি স্বীকার করার প্রস্তুতি থাকতে হবে। কিন্তু এতাে বেশি ক্যাজুয়ালটি মেনে নেয়ার অবস্থায় আমরা নেই। কারণ রিইনফোর্সমেন্টের ব্যবস্থা বলতে গেলে কিছুই নেই। নিয়মিত বাহিনী হিসেবে পাকবাহিনীর সেটা ভালাে মতােই আছে। এসব ব্যাপারে আমাদের সেক্টর কমান্ডারদের প্রায় সবাই ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিরােধ এড়িয়ে গেছেন। আর না এড়িয়েই-বা কি করবেন? আমাদের সেক্টরগুলাের বিপরীতে ভারতীয় যে সেক্টরগুলাে গঠিত হয়েছিল, তার কমান্ডারদের একজন ছাড়া সবাই ছিল কর্মরত ব্রিগেডিয়ার, অবশিষ্ট জনের ব্যাঙ্কও ছিল মেজর জেনারেল।
আর আমাদের সেক্টর কমান্ডাররা একেকজন মেজর, ক্যাপ্টেন আর এয়ারফোর্সের উইং কমান্ডার। পৃথিবীর কোনাে আমিই পারতপক্ষে ছাতক অভিযানের মতাে আহম্মকি অপারেশন করবে না। প্রায় চারশাে মাইল পথ অতিক্রম করে একটা সম্পূর্ণ অপরিচিত জায়গায় পৌছানাে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অ্যাটাক করার পরিকল্পনা কেউই সমর্থন করবে না। যাই হােক, আমরা পিছিয়ে লুনি থামে প্রতিরক্ষাগত অবস্থান নিলাম। আস্তে আস্তে সবাই সেখানে জড়াে হলো। লুনির অবস্থান রাধানগর আর গােয়াইনঘাটের মধ্যে, একটু পশ্চিমে। ঐ অবস্থানে থেকে কয়েকদিন প্রতিরােধ যুদ্ধ করলাম আমরা। পাকসেনারা মাঝেমধ্যে ফাইটিং প্যাট্রল পাঠিয়ে ছােটোখাটো হামলা চালায়, আমরা ওদের প্রতিহত করি। এমনি ধরনের সংঘর্ষ চলে কোনাে বড়ােসড়াে লড়াই হয় নি। রাধানগর এলাকায় তৃতীয় বেঙ্গলের অবস্থান গ্রহণ। গােয়াইনঘাট আক্রমণে (২৪/২৫ অক্টোবর) তৃতীয় বেঙ্গলের বিপর্যয়ের পর জেনারেল গিল আমাকে রাধানগরের পাকিস্তানি সেনাদলের শক্তিশালী প্রতিরক্ষার বিপরীতে অবস্থানরত এফএফ কোম্পানিগুলাের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে আলফা ও ডেল্টা কোম্পানিকে প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করার পরামর্শ দিলেন। মুক্তিবাহিনীর তিনটি এফএফ কোম্পানি রাধানগর পাক ডিফেন্সের মুখােমুখি বাঙ্কারে প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত ছিল। জুলাই-আগস্ট মাস থেকেই এফএফ কোম্পানিগুলাে মােটামুটি অর্ধচন্দ্রাকারে পাক অবস্থানটিকে ঘিরে রেখেছিল। ভারতীয় সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রাজ সিং জেনারেল গিলের সার্বিক তত্ত্বাবধানে এই অঞ্চলের অঘােষিত কমান্ডার হিসেবে মুক্তিবাহিনীর কোম্পানিগুলাে পরিচালনা করছিলেন। এখানে প্রায় প্রতিদিনই ছােটোখাটো আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণের ঘটনা ঘটছিল। সেই সঙ্গে বেড়ে চলছিল দু’পক্ষের হতাহতের সংখ্যাও। ছােটখেল গ্রাম ছিল রাধানগর প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্সের হেড কোয়ার্টার।
গােয়াইনঘাটের অবস্থান এর প্রায় পাঁচ মাইল দক্ষিণে। ২৭ অক্টোবর আলফা কোম্পানিকে কাউরা এবং ডেলটা কোম্পানিকে লুনি গ্রামে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলাম। কাফাউরা গ্রামটি রাধানগরগােয়াইনঘাট রাস্তার উত্তর-পূর্ব এবং লুনি গ্রামটি একই রাস্তার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এফএফ কোম্পানিগুলােকে সাহায্য করতে আমার কোম্পানি দুটো অবস্থান নেয়াতে রাধানগরে অবস্থিত পাক সেনাদল তিনদিক থেকে প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থায় পড়ে যায়। একমাত্র দক্ষিণ দিকটাই ভােলা ছিল। সেদিক দিয়ে গােয়াইনঘাট যাওয়ার রাস্তা। কয়েকদিনের মধ্যেই আমি নবীর ডেল্টা কোম্পানির অবস্থান লুনি গ্রামের প্রতিরক্ষা আরো জোরদার করার জন্য ইকো এবং ব্রাভাে কোম্পানির দুটো প্লাটুন বাংলাবাজার (শেলা-ছাতকের রাস্তার ওপর) থেকে আনিয়ে নবীর কমাডে ম্যও করেছিলাম। এর ফলে রাধানগর
পুরােপুরিভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লাে। এই অবরােধ ভাঙার কাজ করার জন্য পাকসেনারা ২৮ অক্টোবর থেকে প্রায় প্রতিদিন লুনি এবং কাফাউরা গ্রামে হামলা চালাতে থাকে। সেই সঙ্গে আর্টিলারির গােলাবর্ষণও অব্যাহত রাখে। রাধানগরে এক কোম্পানি টোচি স্কাউটস এবং ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্য অবস্থান করছিল। আগেই বলেছি পাকসেনাদের হেড কোয়ার্টার ছিল রাধানগরের আধ মাইল দক্ষিণে ছােটখেল গ্রামে। গােয়াইনঘাট যাওয়ার রাস্তাটি ছােটখেলের প্রায় লাগােয়া। নভেম্বরের মাঝামাঝি ডেটা কোম্পানি রাধানগরের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত নিকটবর্তী দুয়ারিখেল ও গােরা নামের দুটি গ্রাম দখল করে নেয়। ফলে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে প্রায় প্রতিদিন তেলটা কোম্পানির অবস্থানগুলোতে হামলা চালাতে থাকে। এতে দু’পক্ষের শুকুর হতাহত হলেও পাকসেনারা ডেটা কোম্পানিকে হটাতে পারে নি। কর্নেল রাজ সিংয়ের অযাচিত হুকুমদারি। ২১ নভেম্বর মুক্তিবাহিনীকে মিত্রবাহিনীর অধীনস্থ করা হয়। তারপরেই শুরু হলাে কর্নেল রাজ সিংয়ের অযাচিত হুকুমদারি। তিনি আমার অধীনস্থ কোম্পানি কমান্ডারদের সরাসরি নির্দেশ দিতে শুরু করলেন। এক সময় তারা আমার কাছে এ ব্যাপারে অভিযােগ করে। রাজ সিংকে একদিন ডাউকিতে বিএসএফ-এর বিওপি সংলগ্ন এলাকায় পেয়ে ধরলাম। তাকে সরাসরি 7, “You will not communicate to any one directly under my command without my permission. You must remember that I have taken up arms to liberate my country from an occupation army by revolting from a disciplined army leading from the front. In the process, I had to arrest my own commanding officer. Please do not try to encroach on my command in future. রাজ সিংকে আরাে বললাম, আগামীতে আবার এরকম করলে সৈন্যদেরকে নিয়ে বাংলাদেশের অনেক ভেতরে অবস্থান নেবাে আমি। তারপর সে তার অনধিকার চর্চাৱ ফল বুঝবে!
কারণ আমাদেরকে খেপিয়ে দেয়ার জন্য উধ্বতন ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তাকে নিশ্চিতভাবেই ধরে বসবে। কর্নেল রাজ সিং এরকম কথা শােনায় অভ্যস্ত ছিলেন না। আমার কথায় মনে হলাে খানিকটা ভড়কে গেলেন তিনি। এতে করে কাজ হলাে। মনে মনে আমার ওপর খেপে থাকলেও তার দৌরাত্ম্য কিছুটা কমলাে। রাধানগর-ছােটখেল আক্রমণ: প্রথম পর্যায় ২৬ নভেম্বর জেনারেল গিল অপারেশনাল ব্রিফিংয়ের জন্য ডাউকি বিএসএফ হেড কোয়ার্টারে যাওয়ার আমন্ত্রণ পাঠালেন আমাকে। সেদিনই সন্ধ্যায় ডাউকিতে গেলাম। জেনারেল গিল আমাকে জানালেন, ভোর রাতে ৫/৫ গুৰ্থা। রেজিমেন্টের দু’টি কোম্পানি রাধানগর এবং একটি কোম্পানি একই সময়। ছােটখেল আক্রমণ করবে। আক্রমণের আগে একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট শত্রুর অবস্থান দুটোর ওপর গােলাবর্ষণ করবে। গিল বললেন, তােমার থার্ড বেঙ্গলের দুই কোম্পানি যার যার অবস্থানে থেকে Assault করার পাঁচ মিনিট আগ পর্যন্ত ফায়ার সাপাের্ট দেবে। এছাড়া গুদের FUP-র (Forming Up । Place, যেখান থেকে সরাসরি হামলা শুরু করা হয়) নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে তােমার সৈন্যরা। FUP সাধারণত শত্রু অবস্থান থেকে ৬শ’শ গজ দূরে রাখা হয়। আমার মনে হলাে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর উদ্যোগে সম্পূর্ণ একটি প্রথাগত (conventional) আক্রমণ পরিচালিত হতে চলেছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে কোনাে ভারতীয় পদাতিক ব্যাটালিয়নের অংশগ্রহণ এটিই প্রথম।
বীরের জাতি গুৰ্থা। পাঠকের অবগতির জন্য গুর্খা রেজিমেন্ট সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়ােজন। গুৰ্বারা হিমালয়ের এক পাহাড়ি উপজাতি। হাজার বছরের যুদ্ধের ইতিহাস এদের। আনুগত্য ও সাহসিকতা গুর্খাদের চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য। লড়াকু জাতি। হিসেবে এদের পরিচিতি পৃথিবীর সর্বত্র। গুর্খারা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল ও বিনয়ী। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পৃথিবীর বিভিন্ন রণাঙ্গনে তারা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। অসংখ্য vC (Victoria Cross) এদের বীরদের গলার মালা হয়েছে। এখনাে কয়েকটি দেশে গুখারা Mercenary হিসেবে কাজ করে যাচেছ। যেমন ভারতীয়, বৃটিশ ও ব্রুনাই সেনাবাহিনী। মাতৃভূমি নেপালের সেনাবাহিনীতে তাে রয়েছেই। আশির দশকে দক্ষিণ আমেরিকার ফকল্যান্ডযুদ্ধে বৃটিশ সেনাবাহিনী একটি গুর্খা রেজিমেন্টকে তাদের আক্রমণের বর্শাফলক হিসেবে ব্যবহার করায় তা নেপালের সঙ্গে আর্জেন্টিনার একটি কূটনৈতিক যুদ্ধের সূচনা করে। ফকল্যান্ডেও গুর্খারা তাদের ঐতিহ্যের প্রতি নিষ্ঠাবান থেকে প্রতিপক্ষকে পর্যুদস্ত করে ছাড়ে। বৃটিশরা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে ঐ যুদ্ধে জিতে যায় । এহেন গুর্খাদের ৫/৫ রেজিমেন্ট আমাদের সাহায্য করার জন্য রাধানগর ও ছােটখেল আক্রমণে যাচ্ছে। সবারই মনােবল তখন তুঙ্গে। মনে হলাে চূড়ান্ত বিজয়ের আর বেশি দেরি নেই। যুদ্ধ হলাে শুরু ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের সিও লে. কর্নেল রাওয়ের সঙ্গে শেষ রাতে তাদের। আক্রমণের FUP পর্যন্ত গেলাম। নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগ থেকেই। রাধানগর ও ছােটখেলে পাকবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থানগুলাের ওপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু হলাে।
সেই সঙ্গে গর্জে উঠলাে আমার আলফা ও ডেটা কোম্পানির মেশিনগানগুলাে। মাঝে মাঝে আমাদের ট্যাঙ্ক-বিধ্বংসী কামানগুলাে থেকেও গােলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকলাে। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রচণ্ড সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলাে। ভারতীয় কামান এবং আমার দুই কোম্পানির মেশিনগানগুলাে পরিকল্পনা মতাে এই পর্যায়ে তাদের ফায়ার কভার বন্ধ করে দিলাে। এবার পাকবাহিনীর গােলাবর্ষণের পালা। তারা Assault line বানিয়ে বেয়নেট উচিয়ে ফায়ার করতে করতে পাকসেনাদলের অবস্থানগুলাের দিকে এগুচ্ছিল। তাদের কণ্ঠে রণধ্বনি ‘আয়াে-গুর্থালি’, যার অর্থ গুর্খারা এসে গেছে! কিছুক্ষণের মধ্যেই গুর্খাদের হামলার ফলাফল আসতে শুরু করলাে। অনেক আহত গুৰ্থ সেনাকে সরিয়ে আনতে দেখলাম। যে কোম্পানিগুলাে রাধানগর আক্রমণে গিয়েছিল হতাহতের সংখ্যা তাদেরই বেশি। গুর্খাদের একটি কোম্পানি ওখানকার একটা মেশিনগানের Line of Fire-এ পড়ে গিয়েছিল। যার ফলে তারা আর এগুতেই পারে নি। এই কোম্পানিটি প্রায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অন্য কোম্পানির অবস্থাও তথৈবচ। তারাও আর এগুতে না পেরে রণে ভঙ্গ দিয়ে পেছনে ফিরে এলাে। ছোটখেল দখল এবং আবার হাতছাড়া ওদিকে ছােটমেলের পাক অৱস্থানটি খারা দখল করে ফেললাে। সেখানে অবস্থানরত পাকসেনারা পালিয়ে গিয়ে দূরের কাশবনে আত্মরক্ষামূলক অবস্থান নিলো। মাত্র আধ ঘণ্টার ব্যবধানে এই দুই জায়গায় প্রচণ্ড আক্রমণে গুর্খাদের ৪ জন অফিসার ও ৬৭ জন বিভিন্ন ব্যাঙ্কের সদস্য হতাহত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য ভারতীয় সেনাবাহিনী তথা গুর্খাদের এই চরম আত্মত্যাগ আমরা কোনােদিন ভুলতে পারবাে না। আমরা তাদের কাছে চিরঋণী হয়ে রইলাম। ছােটখেল গুদের হাতে এলেও রাধানগর সম্পূর্ণভাবে পাকবাহিনীর দখলেই রয়ে গেলাে। পাকসেনাদেরকে একচুল পরিমাণও টলানাে গেলাে না এই আক্রমণাভিযানে। গুৰ্ধাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতা কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়লে পাকসেনারা ডেল্টা কোম্পানির অবস্থানগুলােতে প্রবল গােলাবর্ষণ শুরু করে দেয়। এতে আমাদেরও কয়েকজন সৈন্য হতাহত হলো।
ছােটখেলের অবস্থান ছিল রাধানগরের পেছনে এবং এটিই ছিল পাকসেনাদের মূল প্রতিরক্ষা কেন্দ্র। ছােটখেল হাতছাড়া হওয়াতে পাকবাহিনী বিচলিত হয়ে পড়লাে। কারণ, গােয়াইনঘাট যাওয়ার তাদের একমাত্র রাস্তাটি এখন বন্ধ। এজন্য প্রায় মরিয়া হয়েই ঘণ্টাতিনেক পর পাকবাহিনী অতিরিক্ত সৈন্য সমাবেশ করে আরাে সংগঠিত হয়ে আর্টিলারির গােলাবর্ষণের সহায়তায় গুর্খাদের ছােটখেল অবস্থানে প্রতি-আক্রমণ করলাে। প্রায় কুড়ি মিনিটের এই প্রচণ্ড আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়ে গুর্খারা ছােটখেলের অবস্থান ছেড়ে দিয়ে লুনিতেঅবস্থানরত আমার ডেল্টা কোম্পানির সঙ্গে আশ্রয় নিলাে। পাকবাহিনী ছােটখেল ঘামে তাদের অবস্থান পুনর্ধতিষ্ঠা করে ফেললাে। এই পাল্টা হামলাতেও দু’পক্ষের প্রচুর হতাহত হলাে। হতাশার কালাে ছায়া। আমরা সবাই খুব মুষড়ে পড়লাম ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের এই বিপর্যয়ে। চারদিকে হতাশাব্যঞ্জক একটা অবস্থা। মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর মনােবল একেবারে বিপর্যস্ত। এদিকে পাকসেনারা তাদের প্রাথমিক সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে নতুন উদ্যমে ডেল্টা কোম্পানির দুয়ারিখেল ও গােরা গ্রামের অবস্থানগুলােতে তীব্র আক্রমণ শুরু করলো। কামানের গােলার ছত্রছায়ায় তারা এই দুই অবস্থানে হামলা চালালাে। বিকেলের দিকে দুয়ারিখেলে অবস্থিত ডেটা কোম্পানির প্লাটুনটি লুনি গ্রামে পশ্চাদপসরণ করে সেখানকার অবস্থানটির শক্তি বৃদ্ধি করলাে। এর মধ্যে খবর এলাে রাত আটটায় ডাউকি বিএসএফ হেড কোয়ার্টারে জেনারেল গিলের অপারেশনাল ব্রিফিং হবে। আমাকে যেতে হবে। রাধানগর-ছােটখেল আক্রমণ : দ্বিতীয় পর্যায়। যথাসময়ে ডাউকি বিএসএফ হেড কোয়াটারে পৌছুলাম। মিত্রবাহিনীর অন্যান্য অফিসারও যথারীতি উপস্থিত।
সবাই বিমর্ষ পরিস্থিতি থমথমে। জেনারেল গিল ৫/৫ গুর্খা রেজিমেন্টের বিপর্যয়ের জন্য কাউকেই দোষারােপ করলেন না। তিনি শুধু বললেন, ছােটখেল অবস্থানটি ধরে রাখতে না পারার কোনাে যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না। এই অবস্থানটি দখল করতে গিয়ে গুর্খাদের প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। জেনারেল গিল গুর্খা রেজিমেন্টের সিও কর্নেল রাওকে এজন্য সহানুভূতি জানালেন। তারপর সেদিনই (২৮ নভেম্বর) ভােররাত সাড়ে চারটায় দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আবারাে রাধানগর আক্রমণ করার নির্দেশ দিলেন তাকে। তাদের আক্রমণে সাহায্যকারী হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট গােলাবর্ষণ করবে। এছাড়া মুক্তিবাহিনীর তিনটি এফএফ কোম্পানি এবং তৃতীয় বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি নিজ নিজ প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে গুৰ্খাদের ফায়ার সাপাের্ট দেবে। এরপর তিনি আমাকে লুনি, দুয়ারিখেল ও গােরা গ্রামে অবস্থানরত তৃতীয় বেঙ্গলের সকল সেনাসদস্যকে সংগঠিত করে একযােগে ছােটখেল আক্রমণ করে সেটা দখল করার নির্দেশ দিলেন। তবে আমাদের কোনাে আর্টিলারি সাপাের্ট দেয়া হবে না বলে গিল জানালেন। অর্থাৎ কোনাে ফায়ার সাপাের্ট ছাড়াই আমাদের একটি প্রথাগত আক্রমণ পরিচালনা করতে হবে, যাকে Silent attack বা নীরব আক্রমণ বলা চলে।
ঐ গ্রাম তিনটিতে তৃতীয় বেঙ্গলের ডেলটা কোম্পানি এবং আরাে দুটো পাটুন অবস্থান করছিল। অপারেশনের অর্ডার নিয়ে রাত প্রায় একটার দিকে আমি নবীর অবস্থানে পৌছুলাম। গােরা গ্রামে তখনাে থেমে থেমে দু’পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি চলছিল। দুয়ারিখেল যে এরি মধ্যে পাকসেনাদের দখলে চলে গেছে সে কথা আগেই উল্লেখ করেছি সন্ধ্যার আগে সেখানে অবস্থানরত প্লাটুনটি পশ্চাদপসরণ করে লুনি গ্রামে অবস্থানরত ডেলটা কোম্পানির সঙ্গে নবীর বাঙ্কারে বসেই সব প্লাটুন কমান্ডারকে খবর পাঠালাম। তারা এলে গিলের নির্দেশের কথা জানালাম প্রায় সবাই একবাক্যে এই আক্রমণ কয়েকদিনের জন্য স্থগিত রাখার কথা বললাে। তাদের যুক্তি, গত প্রায় দেড় মাস ধরে অনবরত পাল্টাপাল্টি যুদ্ধ করে আমাদের সেনা-সদস্যরা খুবই পরিশ্রান্ত অনেকেই আহত অথবা নিখোঁজ সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়াও ঠিকমতাে সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে অনেক সময় অভুক্ত থেকেই তাদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। কয়েকদিনের বিশ্রামের পরই এরকম একটা আক্রমণে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে বলে প্লাটুন কমান্ডাররা অভিমত ব্যক্ত করলো। তাদের বক্তব্য যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ছিল। তবুও আমাদের এই আক্রমণে যেতেই হবে। আমাদের মাতৃভূমির মুক্তির জন্য বিদেশী খাবা আবারাে রাধানগর আক্রমণে যাচ্ছে আর আমরা আক্রমণ স্থগিত রাখার জন্য যুক্তির অবতারণা করছি! অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সবাইকে উৎসাহিত করার জন্য বললাম, কোম্পানি কমান্ডার লে. নবীর সঙ্গে আমিও এই আক্রমণে অংশ নেবাে। রাত চারটার মধ্যে সবাইকে নবীর বাঙ্কারের কাছে নিচু জমিটায় সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলাম।
তৃতীয় বেঙ্গলের ছােটখেল দখল নবীর অবস্থানে ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেয়ার পর বের হয়ে দেখলাম, ডেল্টা কোম্পানির সদস্যরা আক্রমণে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে রয়েছে। এখন নির্দেশের পালা। FUP-র উদ্দেশে রওনা হলাম। এক সারিতে প্রায় একশাে পঞ্চাশজন যােদ্ধা সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থান করতেই রাধানগরের ওপর মিত্রবাহিনীর কামানের প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ শুরু হয়ে গেলাে। কয়েক মিনিট পর আমরা Extended line-এ ছােটখেলের শক্ত অবস্থানগুলাের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। লাইনের একেবারে বায়ে ছিলাম আমি। মাঝখানে কোম্পানি কমান্ডার লে. নবী। শত্রুর অবস্থান আর মাত্র তিনশাে গজ দূরে! ‘জয় বাংলা, “ইয়া হায়দার’, ‘আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে চারদিকে কাপিয়ে তৃতীয় বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি বেয়নেট উচিয়ে ফায়ার করতে করতে শত্রু অবস্থানের ওপর ঝাপিয়ে পড়লাে কয়েকটি বাঙ্কারে রীতিমতাে হাতাহাতি যুদ্ধ হলাে ডেটা কোম্পানির সৈন্যরা তখন এক অজেয়, অপ্রতিরােধ্য শক্তি কোনাে বাধাই তাদেরকে আটকে রাখতে পারছে না। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে ছােটখেলের। শত্রু অবস্থানগুলাের পতন হলাে গুর্খারা যেই অবস্থান দখলের লড়াইয়ে মাত্র একদিন আগে পরাজিত হয়েছিল, আজ সেটা আমাদের হাতের মুঠোয়। তৃতীয় বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানি প্রমাণ করলাে বেঙ্গল রেজিমেন্টের যােদ্ধারা বিশ্বের অন্য যে-কোনাে রেজিমেন্টের তুলনায় কোনাে অংশে কম নয়। অতুলনীয় তাদের সাহস, নিষ্ঠা আর দেশপ্রেম পাকসেনারা পশ্চাদপসরণ করে দূরের কাশবনের আড়ালে পালিয়ে গেলাে। তাদের বেশ কয়েকজন আমাদের হাতে ধরা পড়ে।
প্রামের সর্বত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল। ছােটখেল দখলের পর পাকসেনাদের প্রচুর অস্ত্র, গােলাবারুদ আর খাদ্যসামগ্রী ডেল্টা কোম্পানির হাতে আসে, যা দিয়ে অন্তত কয়েক মাস যুদ্ধ করা সম্ভব। পাকসেনাদের পরিত্যক্ত বাজারগুলােতে চারজন ধর্ষিত মহিলার লাশ পাওয়া গেলাে অমানুষিক নির্যাতন চালানাের পর বর্বর পাকসেনারা পালানাের সময় তাদেরকে হত্যা করে যায়। আমি আহত হলাম বিজয় আনন্দের আতিশয্যে কয়েকজন সৈন্য কয়েকটা খড়ের গাদায় আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তখন ভােরের আলাে ফুটতে শুরু করেছে। জ্বলন্ত খড়ের পাদার আগুনে এলাকাটা আরাে আলােকিত হয়ে উঠলাে। আমি পাকসেনাদের একটি বাঙ্কারের সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরটা দেখছি বালির বস্তা, বাঁশ, ভারি কাঠ দিয়ে তৈরি বাঙ্কারগুলাে। মর্টারের শেলও ওগুলাের কোনাে ক্ষতি করতে পারবে না বলে মনে হলাে। চারদিকে তখনাে বিক্ষিপ্ত গােলাগুলি চলছে। আগুনের আলাে লক্ষ্য করে পাকসেনারা দূর থেকে গুলি ছুঁড়ছিল। হঠাৎ করেই উনি কোমরে প্রচণ্ড এক আঘাত পেয়ে কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়ে গেলাম আমি। উঠতে চেষ্টা করেও পারলাম না। বুঝতে পারলাম গুলিবিদ্ধ হয়েছি। শুয়ে থেকেই নড়াচড়া করে বুঝলাম হাড় ভাঙে নি। বুলেটটা ভেতরেই রয়ে গিয়েছিল। প্রবল যন্ত্রণা হচ্ছিল এ সময়  আমার ব্যাটালিয়নের ডাক্তার ওয়াহিদ তখন লুনিতে। কয়েকজন সহযােদ্ধা আমাকে ধরাধরি করে তার কাছে নিয়ে গেলাে আমার আগে আরাে চারজন আহত সৈন্যকে সেখানে আনা হয়েছে। ওয়াহিদ সবাইকে ফার্স্ট এইড দিলাে। তীব্র যন্ত্রণা কমানাের জন্য আমাকে পেথেড্রিন ইঞ্জেকশন দেয়া হলাে। সেই অবস্থায় একটা চিঠিতে নবীকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিলাম।
পাল্টা আক্রমণ ঠেকানাের জন্য প্রস্তুত থাকতে লিখলাম ওকে এই অসাধারণ বিজয়গৌরব যে-কোনাে কিছুর বিনিময়ে হলেও ধরে রাখার নির্দেশ দিলাম । আরাে বললাম, আমার আহত হওয়ার কথা যেন সৈন্যরা জানতে না পারে কারণ, তাহলে তাদের মনােবল ক্ষুন্ন হতে পারে। আহত অবস্থায় চিঠিটা লিখি বলে হস্তাক্ষর খুব খারাপ হয়েছিল। ইংরেজিও হয়তাে দু’একটা ভুল হয়ে থাকতে পারে। চিঠিটা খুব সম্ভব নবীর কাছে এখনাে আছে। ঐ সময় আমার স্ত্রীকেও একটা চিঠি লিখি। সে তখন ব্যাটালিয়নের LOB-র সঙ্গে বাঁশতলার জঙ্গলে অবস্থান করছিলাে। তারা যাতে কোনাে দুশ্চিন্তা না করে সে জন্যই চিঠিটা লেখা।
শিলং মিলিটারি হাসপাতালে বেলা দশটার দিকে কয়েকজন সহযােদ্ধা স্ট্রেচারে করে আমাকে ডাউকি সীমান্তে নিয়ে গেলাে। সঙ্গে আহত অপর চারজন সৈন্য। সীমান্তের কাছে পৌছে দেখলাম, খােলা একটা জায়গায় কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে জেনারেল গিল দাঁড়িয়ে আছেন। একটু দূরে তার হেলিকপ্টার যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে এসেছেন তিনি তাকে ছােটখেল যুদ্ধে আমাদের সাফল্যের সংবাদ দিলাম। ছােটখেল দখলের বিবরণ শুনে গিল উল্লসিত হয়ে অভিনন্দন জানালেন তার কাছেই শুনলাম, গুর্খারা রাধানগরে দ্বিতীয়বারের মতাে পর্যন্ত হয়েছে। এবারও প্রচুর হতাহত হয়েছে তাদের পক্ষে  গিল তাঁর হেলিকপ্টারে করে আমাদের হাসপাতালে পাঠানাের ব্যবস্থা করলেন। গিলের হেলিকপ্টার চালক অন্য আহত সহযােদ্ধাসহ আমাকে তুলে নিয়ে শিলং মিলিটারি হাসপাতালে নামিয়ে দেয়। হাসপাতালে পৌছুই বেলা বারােটার দিকে। সেখানে গুর্খা রেজিমেন্টের একজন জেসিওর সঙ্গে দেখা হলাে। রাধানগর অপারেশনে তার একটা হাত উড়ে গিয়েছিল। সে আমাকে দেখে অবাক হয়ে বললাে, ‘স্যার, আপ ভি ইধার আ গিয়া। দুপুরের দিকে হাসপাতালে পৌছুলেও প্রায় কুড়ি ঘণ্টা পর অপারেশন টেবিলে ভােলা হয় আমাকে ২৬ নভেম্বরের যুদ্ধে আহত গুর্খাদের disposal করতেই এতাে সময় লেগে যায়। ২৯ নভেম্বর দুপুর নাগাদ জ্ঞান ফিরলে জানতে পারলাম, আমার শরীর থেকে বুলেটটা বের করা হয়েছে এবং শিগগিরই সেরে উঠবাে আমি। হাসপাতালে ফুলের তােড়া নিয়ে জেনারেল গিল আমাকে দুইদিন দেখতে এসেছিলেন পয়লা ডিসেম্বরের পর থেকে তাকে আর দেখছিলাম না। খোঁজখবর করলাম কিন্তু কেউ কিছু বলছিল না। বােধহয় নিজেদের গােপনীয়তা ভাঙতে চায় না আর কি! কয়েকদিন পর জানতে পারলাম, ময়মনসিংহের কামালপুর সাব-সেক্টরে একটি অপারেশন পরিচালনা করতে গিয়ে মাইন বিস্ফোরণে জেনারেল গিলের পা উড়ে গেছে। প্রবীণ, সাহসী এই জেনারেলের দুর্ঘটনার কথা শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলাে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ছাতক যুদ্ধের পর থেকে (১৮ অক্টোবর) তখন পর্যন্ত ৫ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মীর শওকতের সঙ্গে আমার আর দেখা বা যােগাযােগ হয় নি। ১৪/১৫ ডিসেম্বর সিলেটের লামাকাজি ঘাটে তার সঙ্গে দেখা হয় আমার যদিও কমান্ডার শওকতের হেড কোয়ার্টার শিলংয়েই অবস্থিত ছিল।
যুদ্ধের ভেতর পলিটিক্স শিলং সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার সময় উল্লেখ করার মতাে একটি ঘটনা ঘটে। ১১ ডিসেম্বর এক বাংলাদেশি ভদ্রলােক আমাকে দেখতে এলেন। তিনি তার পরিচয় দিলেন ব্যারিস্টার আবদুল হক বলে। সিলেট জেলার একজন নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি তিনি। আবদুল হক আরাে জানালেন, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার প্রধান রাজনৈতিক সমন্বয়কারীর দায়িত্বও পালন করছেন তিনি। আবদুল হক নামের এই ভদ্রলােককে আমি আগে কখনাে দেখি নি। আর দেখার সুযােগই-বা কোথায়! ১০ অক্টোবরই তাে রংপুরের রেীমারী এলাকা থেকে দীর্থ ভারতীয় ভূখণ্ড পাড়ি দিয়ে সােজাসুজি ছাতকের উত্তপ্ত রণাঙ্গনে প্রবেশ করেছি। তারপর থেকে তাে একের পর এক যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে আহত হয়ে আবার ২৮ নভেম্বর থেকে হাসপাতালে।  নিজের পরিচয় দেয়ার পর আবদুল হক আমার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে বললেন, আমি আপনার অজান্তে আপনার একটা বিরাট ক্ষতি করে ফেলেছি। আমি তাে হতভম্ব। বলে কি লােকটা! তার সঙ্গে তাে কস্মিনকালেও আমার দেখাসাক্ষাৎ কিছু হয় নি। অত্যন্ত বিনয় ও অনুশোচনার সঙ্গে আবদুল হক তারপর এক হীন চক্রান্তের কথা শোনালেন। তিনি বললেন, ছাতক যুদ্ধে বিপর্যয়ের পর অক্টোবরের শেষদিকে বাংলাদেশের একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার প্ররােচনা ও পিড়াপিড়িতে তিনি বাংলাদেশ ফোর্সের হেড কোয়ার্টারে লেখা এক চিঠিতে অবিলম্বে আমাকে তৃতীয় বেঙ্গল থেকে প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছিলেন। 
ব্যারিস্টার আবদুল হকের কথা শুনতে শুনতে হঠাৎ করেই আমার মনে পড়ে গেলাে, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই এমনি এক চক্রান্তের মাধ্যমে নিতান্ত জুনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত করে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম নায়ক মেজর জিয়াকে কিছুদিনের জন্যে হলেও গারাে পাহাড়ের তেলঢালায় নির্বাসিত করা হয়। এখানেও আবার সেই এই নােংরা সামরিক রাজনীতির খেলা। আমার কাছে ব্যাপারটা তেমন অপ্রত্যাশিত ছিলাে না বলে মর্মাহত হলাম না। ব্যারিস্টার হক জানালেন, তিনি তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। একতরফা কথা শুনে এরকম একটা কাজ করা তার ঠিক হয় নি ইত্যাদি ইত্যাদি বলে চললেন। বুঝতে পারছিলাম, তীব্র অনুশােচনায় ভুগছেন তিনি। আবদুল হক আরাে বললেন, ৫ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান করে সত্যিকারের যুদ্ধ কারা করছেন তার কাছে সেটা এখন দিবালােকের মতোই স্পষ্ট । আর কানাই-বা শিলংয়ের মতাে নিরাপদ জায়গায়
বসে যুদ্ধের কাগুজে বিবরণ বিডিএফ হেড কোয়ার্টারে পাঠিয়ে কৃতিত্ব জাহির করছেন সেটাও তিনি বুঝতে পেরেছেন। আবদুল হক চলে যাওয়ার আগে জানালেন, শিগ্‌গিরই তার এই ভুলের সংশােধন করবেন তিনি।
এ ঘটনার কদিন পরই বাংলাদেশ স্বাধীন হলাে। মুক্তির বাঁধভাঙা আনন্দে উদ্বেল ব্যারিস্টার হক ১৬ ডিসেম্বর একটি প্রাইভেট কারে ছাতক থেকে সিলেট যাচ্ছিলেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাঁর গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার পাশে একটি বড়াে গাছে প্রচণ্ড আঘাত হানে। ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন আবদুল হক বিজয়ের আনন্দমুখর মুহূর্তে এই আকস্মিক বিয়ােগাত্ম ঘটনায় আমরা সবাই বিমূঢ়। স্বাধীনতার আস্বাদ দীর্ঘস্থায়ী হলাে না। ব্যারিস্টার হকের জন্য। আমাকে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতিও পূরণ করতে পারলেন না তিনি। তবে আমি তৃতীয় বেঙ্গলেই রয়ে গেলাম। পাকিস্তানিদের পাল্টা হামলা ও পশ্চাদপসরণ পাল্টা আক্রমণের জন্য আমি নবীকে প্রস্তুত থাকতে বলেছিলাম। পরে জেনেছি, আমরা ছােটখেল দখল করার ঠিক এক ঘণ্টার মাথায় পাকিস্তানিরা হামলা চালায়। সারাদিন তারা কয়েকবার কাউন্টার অ্যাটাক করে। সেই সঙ্গে চলেছে আর্টিলারি ফায়ার পাকসেনারা ছােটখেল থেকে পিছিয়ে গিয়ে রক্ষণাত্মক অবস্থান নিয়েছিল। এরি মধ্যে তাদের নতুন সৈন্য আনা হয়; কিন্তু নবীকে তারা পজিশন থেকে সরাতে পারে নি। ২৮ নভেম্বর সারাদিন নবীকে পাকিস্তানি কাউন্টার অ্যাটাক সামলাতে হয়। ২৯ নভেম্বর ভারতীয় সাব-সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রাজ সিং তাকে বলে, তুমি যেমন করে হােক ছােটখেল ধরে রাখে। আমরা কাল সকালে আবার রাধানগর আক্রমণ করবাে। তবে ৩০ তারিখ সারাদিন কেউ কাউকে আক্রমণ করে নি। এদিকে নবীর পজিশন আর ধরে রাখা যায় না এমন একটা অবস্থা। শেষমেষ নবী সিদ্ধান্ত নিলাে, সে নিজেই রাধানগর আক্রমণ করবে। আহত হওয়ার পর আমি নবীকে যে চিঠিটা লিখি তাতে বলেছিলাম, এখন থেকে ডাউকি সাব-সেক্টরে তৃতীয় বেঙ্গলের যতাে সৈন্য রয়েছে সে তার কমান্ডার হবে এবং সেই অনুযায়ী নবী সিদ্ধান্ত নেয়, ভারতীয়দের আশায় বসে থাকলে আর চলবে না, যা করার নিজেদেরই করতে হবে।
সে সিদ্ধান্ত নেয় তিন কোম্পানি এফএফ এবং আলফা ও ডেল্টা কোম্পানি নিয়ে সম্মিলিতভাবে রাধানগর অ্যাটাক করবে। এফএফ কোম্পানিগুলাে নয় মাস ধরেই ঐ এলাকায় যুদ্ধ করছিল, একই অবস্থানে থেকে। আক্রমণের সময় নির্ধারিত হলাে ৩০ নভেম্বর শেষ রাত। এফএফ আর আলফা কোম্পানি রাধানগর আক্রমণ করবে। ছােটখেল থেকে নবী তার ডেলটা কোম্পানির ট্রপস্ নিয়ে ফায়ার সাপাের্ট দেবে। কিন্তু অ্যাটাকের আগেই শেষ রাতে বােঝা গেলাে, রাধানগর প্রতিরক্ষা কমপ্লেক্স ফাকা। পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনাে সাড়াশব্দ নেই সেখানে। পরে জানা যায়, নবীর অ্যাটাকের আগেই তারা পজিশন গুটিয়ে নিয়ে গােয়াইনঘাটে পিছিয়ে যায়। সারাদিন চেষ্টা করেও নবীকে সরাতে না পেরে ওরা ধরে নেয়, ছােটখেল তাে উদ্ধার করা গেলােই না, রাধানগরেও শেষ পর্যন্ত থাকা যাবে না। কারণ রাধানগরে সৈন্য, রসদ এসব কিছু পাঠাতে হলে নবীর ছােটখেলের পজিশনের সামনে দিয়েই যেতে হবে। এজন্য আহতদেরকেও সরাতে পারছিল না পাকসেনারা। সর্বোপরি হেড কোয়ার্টারের সংযােগ সূত্র থেকে গােয়াইনঘাট ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল তারা।
নবীর অগ্রাভিযান
বিনা যুদ্ধে রাধানগরের দখল পেয়েও থামলাে না নবী। সে তখন গােয়াইনঘাটের দিকে মুভ করলাে। গােয়াইনঘাট গিয়ে নবী দেখে সেখান থেকেও ভেগে গেছে পাকবাহিনী। এরি মধ্যে ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় মিত্রবাহিনী পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় বিভিন্ন দিক দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ শুরু করে। ট্রুপস্ নিয়ে আরাে অগ্রসর হয়ে নবী শালুটিকর এয়ারপাের্টের বিপরীতে কোম্পানিগঞ্জ গিয়ে পৌঁছয়। নদীর এপারে কোম্পানিগঞ্জ, ওপারে শালুটিকর। নবীৱ টুপস্ অবস্থান নেয় এপারে। এখানে নবীর ওপর বেশ কয়েকবার অ্যাটাক হয়। কিন্তু ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পরও তার বাহিনীকে পিছু হটাতে পারে নি পাকবাহিনী। এরই মধ্যে নবীর সঙ্গে আসাম রেজিমেন্ট, বিএসএফ এবং গুর্খা রেজিমেন্টের একটি করে কোম্পানি যােগ দিয়েছিল। নবী এদেরকে নিয়ে গােয়াইনঘাট থেকে সামনে অগ্রসর হয়। তার নিজের টুপস্ তাে আছেই, তৃতীয় বেঙ্গলের দুই কোম্পানি, এফএফ তিন কোম্পানি, সেই সঙ্গে ভারতীয় তিন তিনটি কোম্পানি। নবীরা এপারে থাকলে পাকিস্তানিদের সমূহ অসুবিধা। তাই তারা নবীকে হটাতে কয়েকবার আক্রমণ চালালাে; কিন্তু এখান থেকেও নবীর টুপকে এক চুল নড়াতে পারলাে না পাকিস্তানিরা।
রাজ সিংয়ের মতলববাজি
এমনি সময় কর্নেল রাজ সিং আবার কর্তৃত্ব ফলাতে এলাে নবীর ওপর। ২১ নভেম্বরের পর মুক্তিবাহিনী অফিসিয়ালি মিত্রবাহিনীর অধীনস্থ হয় বলে পিলের অনুপস্থিতিতে সে-ই তখন কমান্ডার। রাজ সিং নবীকে বললো, তােমার ওপর অর্ডার আছে, তুমি এখন ছাতক যাবে। সেখানে গিয়ে তৃতীয় বেঙ্গলের যে বাকি ট্রপস্ আছে, তাদের সঙ্গে মিলিত হবে। নবীকে ছাতক পাঠিয়ে দেয়া হলাে। বিশেষ উদ্দেশ্যে এটা করা হলাে। ভারতীয়রা চায় নি আমাদের সৈন্যরা আগে সিলেট প্রবেশ করুক। যদিও নবী ডিসেম্বরের ৪/৫ তারিখেই তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদলসহ কোম্পানিগঞ্জ অর্থাৎ সিলেটের উপকণ্ঠে পৌছে গিয়েছিল। রাজ সিংয়ের কথামতাে নৰী তার টুপ নিয়ে ছাতক চলে যাওয়ার পর কোম্পানিগঞ্জে রইলাে আলফা কোম্পানি। ইতিমধ্যে সৈয়দপুর এলাকার যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন আনােয়ার, চিকিৎসার জন্য যাকে শিলং পাঠানো হয়েছিলাে, ছাতকের যুদ্ধের পরপরই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে এসে কোম্পানিগঞ্জে আলফা কোম্পানিতে জয়েন করলাে। ইতিমধ্যে ছাতক দখল হয়ে গেছে। ঐ এলাকায় তৃতীয় বেঙ্গলের সেনাদলের কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মােহসীন। নবী ছাতকে পৌছে তাদের সঙ্গে যােগ দেয়।
এরপর মােহসীনের নেতৃত্বে সম্মিলিত তৃতীয় বেঈল (আলফা কোম্পানি বাদে) সিলেটের পথে অগ্রসর হয়। তৃতীয় বেঙ্গল ছাতক-গােবিন্দগঞ্জ হয়ে ১৪ ডিসেম্বর সিলেটের কাছে সুরমা নদীর লামাকাজি ঘাটে অবস্থান করতে থাকে। দেশে ফেরা ইতিমধ্যে আমি ১৩ ডিসেম্বর হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হয়ে জিপ নিয়ে প্রথমে এলাম রাধানগর। সেখানে কাউকে পেলাম না। আগ বেড়ে পৌছুলাম গােয়াইনঘাট। সেখানেও হতাশ হতে হলাে। জানা গেলাে, আমাদের ট্রপস্ সেখানে ছিলো, তবে তারা আরাে সামনে এগিয়ে গেছে। গােয়াইনঘাটে একটা সমস্যা দেখা দিলাে। সেখানে গাড়ি পার করার কোনাে উপায় নেই। সে জন্য জিপ ঘুরিয়ে নিয়ে পিছিয়ে শিলংয়ের কাছে একটা রােড জংশনে পৌছুলাম। সেখান থেকে চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি পার হয়ে আমাদের প্রথম ক্যাম্প বঁশতলায় যাই। বাঁশতলা গিয়ে নদী পার হলাম। অর্থাৎ প্রায় একশাে কুড়ি মাইল ঘুরে গিয়ে নদী পার হতে হলো আমাকে। এভাবে পৌছুলাম ছাতকে, সেখানে গিয়ে আবার ফেরিতে করে নদী পার হতে হলাে। আমার সঙ্গে তিনচারজন সশস্ত্র দেহরক্ষী। ছাতকেও কাউকে পাওয়া গেলাে না। অর্থাৎ আমাদের সৈন্যরা এগিয়েই চলেছে। গােবিন্দগঞ্জ পৌছে শুনলাম তৃতীয় বেঙ্গল আরাে সামনে চলে গেছে। শেষটায় লামাকাজি ঘাটে তাদেরকে পাওয়া গেলাে। টুআইসি (2nd in Command) ক্যাপ্টেন মােহসীন, নবী, আকবরসহ অন্যরা আমাকে দেখে ভয়ানক খুশি। আমিও এতােদিন পর ওদের দেখে আনন্দিত। দিনটি ছিল একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর।
১৬ ডিসেম্বর সকালে সুরমা নদীর লামাকাজি ঘাটে একটা ঘটনা ঘটলাে। এই রণাঙ্গনে আগের দিন থেকে যুদ্ধবিরতি চলছে। নদীর ওপারে অবস্থানরত পাকসেনা ও তাদের সহযােগীরা হঠাৎ যাবতীয় অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্য সরঞ্জামাদি নদীতে ফেলে দিতে শুরু করে । কাঠের তৈরি কয়েকটা ফেরি বােটও ডুবিয়ে দিলাে তারা। অবশিষ্ট ছিল একটা মাত্র ফেরি। পাকসেনারা সেটাও বিনষ্ট করার প্রস্তুতি নেয়ায় নদীর এপার থেকে তাদেরকে এ কাজ না করার অনুরােধ জানালাম। পাকিস্তানিরা আমাদের কথায় কান দিলাে না। উপায়ান্তর না দেখে কয়েক রাউন্ড ফায়ার করার নির্দেশ দিলাম। মুহূর্তের মধ্যেই দু’পক্ষ আবার যুদ্ধাবস্থায় ফিরে গেলাে । নদীর এপারে তৃতীয় বেঙ্গল এবং তার সঙ্গে ৫ নম্বর সেক্টরের কয়েক কোম্পানি এফএফ যােদ্ধা। ওপারে পাকসেনা দল, তাদের সঙ্গে সীমান্তরক্ষী ফ্রন্টিয়ার কনস্ট্যাবুলারি এবং এদেশী সহযােগী রাজাকারদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা বিরাট একটা বাহিনী। দু’পক্ষের মাঝখানে ব্যবধান বড়ােজোর ১৫০ গজ। পাকসেনারা আমাদের গুলির পাল্টা জবাব দিলাে না। তবে তারা সবাই যার যার পজিশনে চলে গেলাে। টান টান উত্তেজনা ও উদ্বেগের মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলাে। বেলা তিনটার দিকে সিলেট শহর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা শিখ রেজিমেন্টের কয়েকজন অফিসার ও সেনাসদস্য কয়েকটা গাড়ির একটা কনভয় নিয়ে শাদা পতাকা উড়িয়ে ঘাটে এলাে। সিলেটে অবস্থানরত পাকবাহিনীর কমান্ডারের অনুরােধে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার জন্য মিত্রবাহিনীর কমান্ডার এই শিখ সেনাদলকে পাঠিয়েছেন। উল্লেখ্য, শিখ রেজিমেন্টটি সিলেটের দক্ষিণ-দিক থেকে এসে ১৫ ডিসেম্বর রাতে অন্যান্য ভারতীয় সেনা ইউনিটের সঙ্গে শহর এলাকায় ঢােকে। নদীর এপারে এসে শিখ সেনাদলের কমান্ডার মিত্রবাহিনীর এই রণাঙ্গনের সেনা-অধিনায়কের পক্ষ থেকে যুদ্ধবিরতির কঠোর নির্দেশ জানিয়ে দিলো আমাকে। আমিও দাবি করলাম, পাকসেনারা যাতে আর কোনাে অস্ত্র ও গােলাবারুদ পানিতে না ফেলে সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ফেরি বােটটিরও কোনাে ক্ষতি যেন তারা না করে। এক পর্যায়ে দু’পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হলো। মধ্যস্থতাকারী শিখ সেনাদল ফিরে গেলাে। পুরােপুরি যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠিত হলাে এবার।
বিজয় যাত্রা
দ্রুত নদী পার হয়ে সিলেটের দিকে যাত্রা করলাম আমরা। আত্মসমর্পণের উদ্দেশ্যে একই রাস্তার একপাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছে পরাজিত পাকসেনারা। অন্য পাশে দৃপ্তপদভারে চলেছে বিজয় গর্বে উল্লসিত মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা। দু’দলের মধ্যে কোনাে কথাবার্তা হচ্ছে না। কেউ কারাে প্রতি বিদ্রুপ, তাচ্ছিল্য বা ক্রোধও প্রকাশ করছিল না। সে এক বিচিত্র সহাবস্থান। মােহসীন ও নবীকে সঙ্গে নিয়ে আমি জিপে করে সন্ধ্যার আগেই সাকিট হাউসে পৌছে গেলাম। সার্কিট হাউসের লনে জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়াকে দাঁড়ানাে দেখলাম। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সিলেটের ডিসি সৈয়দ আহমদ এবং এডিসি শওকত আলী। দু’জনই এখন সচিব হিসেবে কর্মরত।
সিলেট যাওয়ার পথে আমরা কয়েকজন মাঝারি র্যাঙ্কের পাকিস্তানি অফিসারকে আহ্বান জানিয়েছিলাম আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। জবাবে তারা জানায়, ইচ্ছে থাকলেও তারা সেটা করতে পারবে না। পাকিস্তানি হাইকমান্ডের নির্দেশ আছে তারা যেন সিলেটে এসে সবাই এক সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে শুধু ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছেই আত্মসমর্পণ করে, মুক্তিবাহিনীর কাছে নয়। পাকিস্তানিদের আত্মমর্যাদা বােধের এই পরিচয় পেয়ে আমরা চমৎকৃত হলাম। যে বাঙালিদের নির্মূল করার জন্য তারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছিল, মুক্তিবাহিনীর কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করতে তাদের সম্মানে বাধছে।
ফেরিঘাটে পানিতে ফেলে দেয়া অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধারের জন্য আমি ডেটা কোম্পানির সিনিয়র জেসিও সুবেদার আলী নওয়াজকে নির্দেশ দিলাম। অস্ত্র উদ্ধার শেষ না হওয়া পর্যন্ত একটা প্লাটুন নিয়ে ঘাটে অবস্থান করতে বললাম তাকে। প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে আলী নওয়াজ কয়েক হাজার অস্ত্র ও প্রচুর গােলাবারুদ উদ্ধার করে। পরে কয়েকটি রেল ওয়াগনে করে ঐ অস্ত্রসম্ভার ঢাকায় পাঠানাে হয়। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা সার্কিট হাউসে পৌছানাের পর বিপুলসংখ্যক মানুষ সেখানে জড়াে হয়েছিল। একসময় উত্তেজিত জনতা কয়েকজন রাজাকারকে মারধর শুরু করলাে। মেজর জিয়া এতে একটু বিচলিত হয়ে ডিসি-কে শহরের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলানাের পরামর্শ দিলেন। তিনি বলেন, ‘Anyonc must not be punished without proper trial. There must be no retribution and no reprisals’.
পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ পরদিন, ১৭ ডিসেম্বর সিলেটে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, মিত্রবাহিনী এই অনুষ্ঠানে আমাদের কাউকে আমন্ত্রণ করে নি। অথচ জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়া ও তার অধীনস্থ প্রথম, তৃতীয় এবং অষ্টম বেঙ্গলের অধিনায়ক আমরা সবাই সেদিন সিলেটে ছিলাম। তবে আমার কয়েকজন অফিসার কৌতূহলী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে তা উপভােগ করে। উল্লেখ্য, ১৬ ডিসেম্বর বিকেলেই আনােয়ারের আলফা কোম্পানি, ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টার ও ইকো কোম্পানি সেনাদল শালুটিকর বিমানবন্দরের বিপরীতে অবস্থিত পিয়াইন নদীর অবস্থান থেকে নদী পার হয়ে শহরে ঢুকে পড়ে। প্রায় দু’মাস পর তৃতীয় বেঙ্গলের সবগুলাে কোম্পানি একত্র হয়। আমরা সাময়িকভাবে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থান নিয়েছিলাম।
আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যােগাযােগ। ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে লে, নবীকে নিয়ে স্থানীয় টি অ্যান্ড টি এক্সচেঞ্জে গেলাম। উদ্দেশ্য বাবা-মা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়ের খোঁজখবর নেয়া। ঢাকায় কথা বললাম। আমার এবং রাশিদার পরিবারের কারাে কোনাে ক্ষতি হয় নি জেনে আশ্বস্ত হলাম। নবীও তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিন্ত হলাে। সিলেটের শেষ দিনগুলাে কয়েকদিন পর মেজর জিয়া তাঁর হেড কোয়ার্টার নিয়ে শ্রীমঙ্গল চলে গেলেন। প্রথম ও অষ্টম বেঙ্গল যথাক্রমে শায়েস্তাগঞ্জ ও মৌলভীবাজার এলাকায় অবস্থান নিলাে। তৃতীয় বেঙ্গল নিয়ে আমি সিলেট শহরেই রয়ে গেলাম। সিলেট মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে কোম্পানিগুলাে অবস্থান নিয়েছিল। ওয়াপদা রেস্ট হাউস হলাে তৃতীয় বেঙ্গলের অফিসার্স মেস।  ডিসেম্বরের শেষ দিকে জিয়া একদিন ফোনে আমাকে বললেন, পাকবাহিনীর বন্দিদশা থেকে তাঁর সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত সহধর্মিণী সিলেটে মাজার। জিয়ারত করতে চেয়েছেন। আমাকে এজন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বেগম জিয়া তাঁর দুই ছেলেসহ বেশ কয়েক মাস পাকবাহিনীর হাতে অন্তরীণ থাকার পর ১৬ ডিসেম্বর অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে মুক্তি পান। আমি ও আমার স্ত্রী রাশিদা বেগম জিয়াকে হযরত শাহজালালের মাজারে নিয়ে গেলাম। সেখান থেকে তিনি মাইল পনেরাে দূরে রানীপিঙ নামে একটা গ্রামে। যেতে চাইলেন। চট্টগ্রামে পাকসেনাদের হাতে বন্দি অবস্থায় নিহত শহীদ লে, ক. এম. আর. চৌধুরীর স্ত্রী তখন রানীপিঙে ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে কাটাবার পর বেগম জিয়া সেদিনই শ্রীমঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান।
কয়েকদিনের মধ্যেই সিলেট শহরে ৪ ও ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর হেড কোয়ার্টার অবস্থান নিলাে। তাদের অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধারা দলে দলে শহরে সমবেত হতে থাকলো। সিলেট শহরে তখন হাজার দশেক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা, তৃতীয় বেঙ্গল, ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সদ্য আত্মসমর্পণকারী প্রায় এক ডিভিশন পাকসেনার মহাসমাবেশ। ভারি সামরিক যান চলাচলের শব্দে চারদিক গমগম করতে লাগলাে। মনে হচ্ছিল, শহরে সাধারণ মানুষের চেয়ে অস্ত্রধারীদের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু ঐ পরিস্থিতিতেও কোথাও কোনাে রকম আইন-শৃঙ্খলা-বিরােধী ঘটনা ঘটে নি।  কয়েকদিন মেডিকেল কলেজে থাকার পর আমরা সাবেক ইপিআর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এলাকায় অবস্থান নিলাম। জায়গাটার নাম মনে নেই। এখানে অবস্থানকালেই প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী তৃতীয় বেঙ্গল পরিদর্শনে এলেন। কয়েকদিন পর আবার স্থান পরিবর্তন করলাম আমরা। এবার এলাম খাদিমনগরে। এখানে পাকবাহিনীর একটা মিনি ক্যান্টনমেন্ট ছিল। বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা নাজিম কোয়ায়েস চৌধুরীর সৌজন্যে আমাদের পরিবারের থাকার জন্য স্থানীয় চা বাগানে একটা বাংলাে পাওয়া গেলাে। ১৯৭২ সালের মে মাস পর্যন্ত তৃতীয় বেঙ্গল খাদিমনগরেই ছিল। এরপর আমরা কক্সবাজার যাই।
অনেকদিন পর ঢাকায়
খাদিমনগরে থাকার সময়ই জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকা যাওয়ার সুযােগ পেলাম। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এটাই প্রথম ঢাকা সফর। পথে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হয়ে এলাম। অফিসার্স কোয়ার্টারে আমার নিজের বাসা দেখতে গেলাম। জিনিসপত্র কিছুই নেই বাসায়। একটা আলপিনও না। কোয়ার্টারে কয়েকজন যুদ্ধবন্দি ছিল। তারা জানালাে, তারা আসার সময়ও বাসায় কিছুই ছিল না। আমার ধারণা হলাে, স্থানীয় সেনা কর্তৃপক্ষ এপ্রিল মাসেই আমাদের সংসারের যাবতীয় জিনিসপত্র মাল-এ-গনিমত হিসেবে লুট করিয়েছিল। যাই হােক, মুক্তিযুদ্ধে এদিক থেকে আমি একেবারেই সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম । আক্ষরিক অর্থেই তখন আমি সর্বহারায় পরিণত হয়েছিলাম।
রাজাকার শিরােমণির কথা
ঢাকায় অবস্থানকালে একদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর হেড কোয়ার্টারে যাই। সেখানে পাকিস্তানিদের সঙ্গে আত্মসমর্পণকারী বাঙালি অফিসার লে. কর্নেল ফিরােজ সালাহউদ্দিনকে দেখলাম। তিনি আবার কর্নেল ওসমানীর খুবই প্রিয়পাত্র। শােনা যায়, এই লে. কর্নেল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকবাহিনীর প্রধান রাজাকার রিক্রুটিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হেড কোয়ার্টারে তাকে দেখে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তীব্র ঘৃণা হলাে আমার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পা-চাটা এই লে. কর্নেলের দিকে তাকাতেও ইচ্ছে হলাে না। কয়েকদিন পর সিলেট ফিরে এসে ওসমানীর টেলিফোন পেলাম। আমি কেন ঐ অফিসারটিকে স্যালুট করি নি, তার ব্যাখ্যা চাইলেন ওসমানী। তিনি আমাকে এই ‘অপরাধের জন্য কোট মার্শাল করার হুমকি দিলেন। আমি অনমনীয়ভাবে বললাম, ঠিক আছে তাই হােক।’ যে-কোনাে কারণেই হােক ওসমানী তাঁর হুমকি কাজে পরিণত করতে পারেন নি।
তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি তৃতীয় বেঙ্গলে একটা ভাঙনের সুর বেজে ওঠে। ১৭ তারিখেই জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়া আমার কাছ থেকে লে. নবীকে তাঁর হেড কোয়ার্টারে নিতে চাইলেন। EME Corps-এর অফিসার নবী সেদিনই তাঁর হেড কোয়ার্টারে চলে গেলো। এর কয়েকদিন পর আকবরকেও ছেড়ে দিতে হলাে DGFI-এ জয়েন করার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের আগে আকবর সামরিক গােয়েন্দা বিভাগে চাকরিরত ছিলো বলে ঐ সংস্থাটির পুনর্গঠনকালে তার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রয়ােজন ছিল। তৃতীয় বেঙ্গলে রয়ে গেলাম আমি, মােহসীন, আনােয়ার, মনজুর ও হােসেন। ইতিমধ্যে ফ্লাইট লে, আশরাফকেও বিদায় দিতে হলাে বিমান বাহিনীতে যােগ দেয়ার জন্য। ব্যাটালিয়নের ডাক্তার ওয়াহিদও ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে তার কোর্স শেষ করার জন্য চলে গেলাে। 
মেডিকেল ছাত্র ওয়াহিদ নিজের জীবন বিপন্ন করে আমাদের চিকিৎসা সহায়তা দিয়েছিল, যা অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। দ্বিতীয়বারের মতাে তৃতীয় বেঙ্গলের পুনর্গঠনে মনােনিবেশ করতে হলাে আমাকে। ইকো কোম্পানি ভেঙে দিলাম। সাবেক ইপিআর ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরাও নিজস্ব বাহিনীতে ফিরে যেতে চাইছিলাে। তাদের সবাইকে ছেড়ে দিলাম। ব্যাটালিয়নের অন্যান্য ছাত্র ও গ্রামের যুবকদের মধ্যে যাদের উপযুক্ত মনে হলাে, তাদের সবাইকে নিয়মিত সৈনিক হিসেবে রেখে দিলাম। পুনর্গঠনের কারণে তৃতীয় বেঙ্গলের সেনা-সদস্য সংখ্যা মাত্র ক’দিনের ব্যবধানে ১৩শ’ থেকে ৭শ’-তে গিয়ে ঠেকে। এদিকে খাদিমনগরে অবস্থানকালে দ্বিতীয় স্মৃতি কোর্স-এর ছ’জন অফিসার ক্যাডেট তৃতীয় বেঙ্গলে যােগ দেয়। দু’জন বাদে এদের সবাই পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পায়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির খবর। জানুয়ারির ৮/৯ তারিখে সিলেটে একটা মজার ঘটনা ঘটলাে। রাতে রেডিওর খবরে ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি পাওয়ার খবর শুনে উল্লসিত মুক্তিযােদ্ধারা হাজার হাজার রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছুঁড়তে থাকে। গুলির আওয়াজ শুনে শহরবাসী প্রথমটায় ভড়কে যায়। পরে আসল ব্যাপার জানতে পেরে তারাও রাস্তায় নেমে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে আনন্দ-উল্লাসে যােগ দেয়।সব সম্ভবের দেশে। বাংলাদেশ সব সম্ভবের দেশ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেখা গেলাে, রাজাকার রিক্রুটিং অফিসার সেই লে. কর্নেল সাহেব সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের পদে নিযুক্তি পেলেন। কী বিচিত্র এই বঙ্গদেশ! এরপর থেকে সেই লে. কর্নেল ভদ্রলােকের উত্তরােত্তর উন্নতি হতে থাকে। একসময় তিনি ব্রিগেডিয়ার হলেন। আশির দশকের শেষে হলেন রাষ্ট্রদূতও। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ক্রমেই কেমন যেন ফ্যাকাশে হতে লাগলাে। যে চেতনাকে ধারণ করে একদিন সবকিছু তুচ্ছ করে একটি পদাতিক ব্যাটালিয়নের বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম, সেই চেতনা ক্রমশই ম্লান হতে লাগলাে একের পর এক স্বাধীনতা-বিরােধী কর্মকাণ্ডে। যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে এক নিভৃত পল্লির মাটিতে রক্ত বিসর্জন দিয়েছি, রক্ত ঢেলে দিয়েছে স্বাধীনতাকামী লক্ষ মানুষ, সেই চেতনার ছবিটা ধূসর থেকে ধূসরতর হতে লাগলাে স্বাধীনতা-বিরােধী পরাজিত ঘাতকদের আস্ফালনে। এসব দেখে ক্রমে প্রচণ্ড হতাশ হয়ে পড়লাম।
জ্বলে একাত্তরের শিখা
একাত্তর থেকে সাতানব্বই। কেটে গেছে ছাব্বিশটি বছর। এরই মধ্যে আমরা পেয়েছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, পেয়েছি প্রিয় জাতীয় সঙ্গীত আর পতাকা। আবার এরই মধ্যে বিপন্ন হয়েছে স্বাধীনতার মূল্যবােধ। অন্ধকার গুহায় সাময়িক নিদ্রা কাটিয়ে গুটিগুটি করে বেরিয়ে এসেছে পলাতক সরীসৃপ। ভূলুণ্ঠিত হয়েছে অগণিত শহীদের আত্মত্যাগের মহিমা। বিস্মৃতিপ্রবণ বাঙালির আত্মঘাতী চরিত্র দেশকে ঠেলে নিয়ে গেছে সেই পথে। আবার একাত্তরই আমাদের দিয়েছে একটি প্রজন্ম। স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত মাটিতে হামাগুড়ি দিতে শিখেছে যে শিশু, সে আজ টগবগে যুবক। এই যুবককেই দেখি স্বাধীনতা-বিরােধীদের বিচার দাবি করে মিছিলে বহুমুষ্টি তুলতে। তাই দেখে ভরসা পাই। গর্বে ভরে ওঠে বুক। একের পর এক প্রজন্মের প্রাণে এভাবেই ছড়িয়ে যায় একাত্তরের শিখা। সে শিখা নিভবে না কোনাে দিন।
সর্বনাশের বার্তা
আমি এমনিতে সকাল ছ’টার দিকেই ঘুম থেকে উঠি। সেদিনও আমার ঘুম ভাঙলাে ঠিক একই সময়ে। অবশ্য স্বাভাবিকভাবে নয়, ঘুম ভাঙলাে দরােজার ওপর অসহিষ্ণু করাঘাতের শব্দে। এভাবেই শুরু হলো পঁচাত্তরের পনেরােই আগস্টের ভাের। এরপর থেকে একের পর এক ঘটতে থাকলাে অন্যরকম, ভয়ঙ্কর সব ঘটনা। সে রাতে যখন আমি ঘুমােতে যাই, তখন প্রায় তিনটা বেজে গিয়েছিল। এর আগে এক বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরে এগারােটার দিকে যখন শুতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন হঠাৎ শুনতে পেলাম বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালের বাইরে থেকে প্রতিবেশী ব্রিগেডিয়ার সি,আর, দত্ত (পরে মেজর জেনারেল অব.) ডাকছেন আমাকে। দেয়ালের ওপাশে দাড়িয়ে তিনি। কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেলাম। সি.আর, দত্ত ওপাশ থেকেই বললেন, ‘শাফাত, নােয়াখালির কাছে একটা ইভিয়ান হেলিকপ্টার ক্র্যাশ করেছে। ক্রুদের সবাই মারা গেছে ঐ দুর্ঘটনায়। লাশগুলাে সিএমএইচ-এ আছে। আমি যাচ্ছি ডিসপােজালের ব্যবস্থা করতে। তুমিও চলো।
প্রসঙ্গত, তখন পার্বত্য চট্টগ্রামে উপজাতীয় সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ওখানকার অসন্তোষ মােকাবিলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ভারত হেলিকপ্টার দিয়ে সাহায্য করছিল। তারই একটি হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে সেদিন। ঘুমুতে যাওয়া হলাে না আর। তড়িঘড়ি কাপড়চোপড় বদলে উভয়ে দ্রুত ছুটলাম হাসপাতালের দিকে। সেখানে এক বীভৎস দৃশ্য! দুর্ঘটনায় নিহত ক্রুদের দেহ মানুষের বলে চেনা প্রায় অসম্ভব। মাংস, হাড়গােড় একাকার হয়ে বিকৃত পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। আর তার থেকে বেরুচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ । দুজনেরই গা গুলিয়ে উঠলাে ঐ দৃশ্য দেখে। যাহােক, দ্রুত দেহাবশেষগুলাে হস্তান্তরের প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা করে বাসায় ফিরে আসি আমি আর ব্রিগেডিয়ার সি,আর, দত্ত। রাত তখন প্রায় দুটো। বাসায় ফিরে আবার বিছানায় যেতে অল্পক্ষণেই ক্লান্ত শরীরমন জুড়ে নেমে এলাে ঘুম।
আমার বাইরের ঘরের দরােজায় ধাক্কাধাক্কিতে ঘুম ভাঙতেই আমি ভাবলাম, কি হচ্ছে? এতাে সকালে দরােজার ওপর এরকম ধাক্কাধাক্কি! দ্রুত পায়ে হেঁটে গিয়ে দরােজা খুলে দিই। দিতেই যা দেখলাম তার জন্য তৈরি ছিল না সদ্য ঘুমভাঙা চোখ। আমার একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেজর রশিদ (পরে লে.ক, অব.)। সশস্ত্র। তার পাশে আরাে দু’জন অফিসার। প্রথমজন মেজর হাফিজ (আমার ব্রিগেড মেজর) অন্যজন লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরী (আর্মি হেড কোয়ার্টারে কর্মরত)। তাদের কাছে কোনাে অস্ত্র নেই। মনে হলাে এ দুজনকে জবরদস্তি করে ধরে আনা হয়েছে। আমার চমক ভাঙার আগেই রশিদ উচ্চারণ করলাে ভয়ঙ্কর একটি বাক্য, উই হ্যাভ কিডু শেখ মুজিব’। অস্বাভাবিক একটা কিছু যে ঘটেছে সেটা আগন্তুকদের দেখেই বুঝেছিলাম। তাই বলে এ কী শুনছি! আমাকে আরাে হতভম্ব করে দিয়ে রশিদ বলে যেতে লাগলাে, “উই হ্যাভ টেকেন ওভার দ্য কনট্রোল অফ দ্য গভর্নমেন্ট আন্ডার দ্য লিডারশিপ অফ খন্দকার মােশতাক।… আপনি এই মুহূর্তে আমাদের বিরুদ্ধে কোনাে অ্যাকশনে যাবেন না। কোনাে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া মানেই গৃহযুদ্ধের উস্কানি দেয়া।” রশিদের শেষ দিকের কথাগুলােতে হুঁশিয়ারির সুর ছিল।
মেজর রশিদ ছিল আমার অধীনস্থ আর্টিলারি রেজিমেন্টটির অধিনায়ক। মাসখানেক আগে সে ভারত থেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশে ফেরে। তার পােস্টিং হয় যশােরে। কয়েকদিন পরেই সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লাহ মেজর রশিদের পােস্টিং পাল্টে তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসেন। উল্লেখ্য, এ ধরনের পােস্টিং সেনাপ্রধানের একান্তই নিজস্ব দায়িত্ব। কী সর্বনাশ ঘটে গেছে একথা ভেবে স্তম্ভিত আমি! এরি মধ্যে চোখে পড়লাে একটু দূরে রাস্তায় দাড়ানাে একটা ট্রাক আর একটা জিপ। গাড়ি দুটো বােঝাই সশস্ত্র সৈন্যে। রশিদের কথা শেষ হতে-না-হতেই পেছনে বেজে উঠলাে টেলিফোন। দরােজা থেকে সরে গিয়ে রিসিভার তুললাম। ভেসে এলাে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর কণ্ঠ, “শাফায়াত, তুমি কি জানাে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে কারা ফায়ার করেছে?… উনিতাে আমাকে বিশ্বাস করলেন না।” বিড়বিড় করে একই কথার পুনরাবৃত্তি করতে লাগলেন সেনাপ্রধান। তাঁর কণ্ঠ বিপর্যস্ত। টেলিফোনে তাকে একজন বিধ্বস্ত মানুষ মনে হচ্ছিল। আমি বললাম, “আমি এব্যাপারে কিছু জানি না, তবে এইমাত্র মেজর রশিদ এসে আমাকে জানালাে, তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। তারা সরকারের নিয়ন্ত্রণভারও গ্রহণ করেছে।” রশিদ যে আমাকে কোনাে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার বিরুদ্ধে হুমকিও দিয়েছে, সেনাপ্রধানকে তাও জানালাম। সেনাপ্রধান তখন বললেন, বঙ্গবন্ধু তাকে টেলিফোনে জানিয়েছেন যে শেখ কামালকে আক্রমণকারীরা সম্ভবত মেরে ফেলেছে। তবে সেনাপ্রধানের সঙ্গে কথা শেষে তার অবস্থান কি সে সম্পর্কে কিছুই বুঝতে পারলাম না। প্রতিরােধ-উদ্যোগ নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ বা নির্দেশ কিছুই পেলাম না।
আমার মাথায় তখন হাজার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। দ্রুত আমার ব্রিগেডের তিনজন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারকে ফোন করে তাদেরকে স্ট্যান্ড টু (অপারেশনের জন্য প্রস্তুত) হতে বললাম। বিদ্রোহীদের মােকাবিলা করার উদ্দেশ্যে আমার অধীনস্থ প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিলাম। ব্যারাকে শান্তিকালীন অবস্থায় কোনাে ইউনিটকে অভিযানের জন্য তৈরি করতে কমপক্ষে দু’ঘণ্টা সময়ের প্রয়ােজন। তার আগে কিছুই করা সম্ভব নয়। | ফোন রেখে ড্রইং রুমে এসে দেখি, মেজর হাফিজ (আমার ব্রিগেড মেজর) একা। রশিদ আর তার সঙ্গে আরেকজন অফিসার এরি মধ্যে চলে গেছে। রাস্তায় দাঁড়ানাে গাড়ি দুটোও উধাও। আমার পরনে তখন স্রেফ লুঙ্গি-গেঞ্জি। মানসিক পরিস্থিতি এমন যে ঐ অবস্থাতেই বেরুনাের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। হাফিজ আমাকে থামালাে, ‘স্যার, আপনি ইউনিফরুম্ পরে নিন।’ ওর কথায় যেন সংবিৎ ফিরলাে আমার। ঝটপট ইউনিফ পরে তৈরি হয়ে নিলাম।
হাফিজকে সঙ্গে করে বাসা থেকে বেরিয়ে এলাম। সেদিন আমার বাড়ির গার্ড ছিল মেজর রশিদের ইউনিটের কয়েকজন সদস্য। কে জানে এটা নিছকই কাকতালীয় ছিল কি না! গার্ডদের পেরিয়ে রাস্তায় পা রাখলাম। গাড়িটাড়ি কিছু নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে যাবাে। বাসা থেকে হেড কোয়ার্টার বেশি দূরে নয়। হাঁটতে হাঁটতেই সিন্ধান্ত বদলে ফেললাম। ঠিক করলাম, আগে বাবা ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসায়। ডেপুটির কাছ থেকে কোনাে নির্দেশ বা উপদেশ পাওয়া যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে ছিলাম। একসঙ্গে অনেক সময় কাটিয়েছি। তার ওপর আমার একটা আস্থা ও বিশ্বাস ছিল। ডেপুটি চিফ জিয়ার বাসভবন আমার বাসা ও ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের মাঝামাঝি। জিয়ার বাসার দিকেই পা চালালাম দ্রুত। কিছুক্ষণ ধাক্কাধাক্কি করার পর দরােজা খুললেন ডেপুটি চিফ স্বয়ং। অল্প আগে ঘুম থেকে ওঠা চেহারা। স্লিপিং ড্রেসের পাজামা আর স্যান্ডাে গেঞ্জি গায়ে। একদিকের গালে শেভিং ক্রিম লাগানাে, আরেক দিক পরিষ্কার। এতাে সকালে আমাকে দেখে বিস্ময় আর প্রশ্ন মেশানাে দৃষ্টি তার চোখে। খবরটা দিলাম তাকে। রশিদের আগমন আর চিফের সঙ্গে আমার কথােপকথনের কথাও জানালাম। মনে হলাে জিয়া একটু হতচকিত হয়ে গেলেন। তবে বিচলিত হলেন না তিনি। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “So what, President is dead? Vice-president is there. Get your troops ready. Uphold the Constitution.” মুহূর্তে যেন সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার দৃঢ় প্রত্যয় ধ্বনিত হলাে তার কণ্ঠে। ডেপুটি চিফের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমাদের এখন একটা গাড়ি দরকার।
তিন প্রধান রওনা হলেন রেডিও স্টেশনের দিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসার গেট থেকে বেরিয়েই দেখি আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে ডেপুটি চিফের জন্য জিপ আসছে। জিপটাকে থামিয়ে কমান্ডিয়ার (অধিগ্রহণ) করলাম। তারপর রওনা হলাম ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দিকে। ওদিক থেকে একটানা কিছু গুলির আওয়াজ শুনলাম। একটু সামনে যেতেই দেখলাম একটা ট্যাঙ্ক দাঁড়িয়ে আছে ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের সামনের মােড়টায়। ট্যাঙ্কটার ওপর মেশিনগান নিয়ে বেশ একটা বীরের ভাব করে বসে আছে মেজর ফারুক (পরে লে. কর্নেল অব.)। একটু দূরে এমটি পার্কে আমার ব্রিগেডের এসএ্যান্ডটির (সাপ্লাই এ্যান্ড ট্রান্সপাের্ট) কয়েকটি সারিবদ্ধ যান। অবস্থাদৃষ্টে নিরস্ত্র অবস্থায় অরক্ষিত হেড কোয়ার্টারে যাওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না বুঝতে পারলাম। সেজন্য পদাতিক ব্যাটালিয়ন দুটোর (প্রথম ও চতুর্থ বেঙ্গল) প্রস্তুতি ত্বরান্বিত করার জন্য ইউনিট লাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। এই দু’টি ব্যাটালিয়ন আমার হেড কোয়ার্টার সংলগ্ন ছিল।
ইউনিট লাইনে গিয়ে শুনি, ফারুক কিছুক্ষণ আগে ট্যাঙ্কের মেশিনগান থেকে গাড়িগুলাের ওপর ফায়ার করেছে। ঐ ফায়ারিংয়ে এসএ্যান্ডটির কয়েকজন সেনাসদস্য আহত হয়। কয়েকটি গাড়িও ক্ষতি হয়। একটা সরু রাস্তার দু’পাশে প্রথম ও চতুর্থ বেঙ্গলের অবস্থান। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, ব্যাটালিয়ন দুটোর মাঝখানে তিনটি ট্যাঙ্ক অবস্থান নিয়ে আছে। ব্রিগেড সদর দপ্তরের সামনেও ফারুকের ট্যাঙ্কসহ দুটো ট্যাঙ্ক দেখেছিলাম। আমার মনে হলাে, ব্যাটালিয়ন দুটোকে ঘিরে রাখা হয়েছে। জানতে পারলাম, প্রয়ােজনে আমার ব্রিগেড এলাকায় গােলা নিক্ষেপের জন্য মিরপুরে ফিল্ড রেজিমেন্টের আর্টিলারি গানগুলােও তৈরি রয়েছে। ট্যাঙ্কগুলােতে যে কামানের গােলা ছিল না, আমরা তখন জানতাম না । জানতে পারি আরাে পরে, দুপুরে।
ফোনে যে নির্দেশ দিয়েছিলাম, সে অনুযায়ী প্রথম ও চতুর্থ বেঙ্গলের সদস্যরা অপারেশনের জন্য তৈরি হচ্ছিল। প্রথম বেঙ্গলের অফিসে গেলাম ; কিন্তু সেখানে যা দেখলাম, তার জন্য আমি মােটেই প্রস্তুত ছিলাম না। আশপাশের জোয়ানদের অনেককেই দেখলাম রীতিমতাে উল্লাস করছে। তারা সবাই লাগোয়া টু ফিল্ড রেজিমেন্টের সৈনিক যারা ছিল মেজর রশিদের অধীনে। তবে এই রেজিমেন্টের কর্মরত প্রায় ১৩শ’ সৈনিকের মধ্যে মাত্র শ’খানেক সৈন্যকে মিথ্যা কথা বলে ভাঁওতা দিয়ে ফারুক-রশিদরা ১৫ আগস্টের এ অপকর্মটি সঘটিত করে। ঐ রেজিমেন্টেরই কয়েকজন অফিসার দেয়াল থেকে বঙ্গবন্ধুর বাঁধানাে ছবি নামিয়ে ভাঙচুর করছিল। এসব দেখে মনে পড়লাে একটি প্রবাদ—Victory has many fathers, defeat is an orphan. সবকিছু দেখে খুবই মর্মাহত হলাম। আমার অধীনস্থ একজন সিওকেই (কমান্ডিং অফিসার) কেবল বিমর্ষ মনে হলাে।  এরি মধ্যে জোয়ানরা আমার নির্দেশ মতাে তৈরি হচ্ছিল। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে সিজিএস (চিফ অফ জেনারেল স্টাফ) ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ইউনিট লাইনে এসে উপস্থিত হলেন। তিনি প্রথম বেঙ্গলের অফিসে এসে আমাকে বললেন, সেনাপ্রধান তাকে পাঠিয়েছেন সমস্ত অপারেশন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দিয়ে। এখন থেকে ৪৬ ব্রিগেডের সব কর্মকাণ্ড সেনাপ্রধানের পক্ষে তার (সিজিএস-এর) নিয়ন্ত্রণেই পরিচালিত হবে। সেনাপ্রধানের নির্দেশে সিজিএস এভাবে আমার কমান্ড অধিগ্রহণ করলেন । আমার আর নিজের থেকে কিছুই করার রইলাে না। এভাবে আমার কমান্ড অধিগ্রহণ করার কারণ একটাই হতে পারে, সেনাপ্রধান আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন নি। তিনি হয়তাে এমন মনে করেছিলেন যে, আমি অভুথানের সঙ্গে জড়িত। এসব কারণেই হয়তাে বিদ্রোহ শুরু হওয়ার খবর রাত সাড়ে চারটায় জেনেও সবার সঙ্গে যােগাযােগের পর সকাল ছয়টায় আমাকে ফোন করেন তিনি। ততােক্ষণে সব শেষ। উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট সারাদিনে টেলিফোনে সেনাপ্রধানের সঙ্গে আমার ঐ একবারই মাত্র কথা হয়।
আমার কাছে এটা খুবই দুঃখওনক মনে হয়েছে যে, সেনাপ্রধান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারে অনেক আগে অভ্যুত্থানকারীদের অভিযান শুরু হওয়ার খবর পেলেও তার কাছ থেকে না শুনে বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের খবর আমাকে শুনতে হলাে অত্যুত্থানকারীদের অন্যতম নেতা মেজর রশিদের কাছ থেকে। এটা আজো আমার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার সময় প্রথম বেঙ্গলের অফিসের সামনে  এসে দাঁড়ালাে একটা বিরাট কনভয় । গাড়ি থেকে নেমে এলেন সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, উপপ্রধান জিয়া, মেজর ডালিম ও তার অনুগামী কয়েকজন সৈনিক। ডালিম ও এই সৈনিকদের সবাই ছিল সশস্ত্র। তাদের পেছনে পেছনে নিরস্ত্র কয়েকজন জুনিয়র অফিসারও আসেন। একটু পর এয়ার চিফ এ.কে খন্দকার এবং নেভাল চিফ এম.এইচ. খানও এসে পৌছলেন। এরি মধ্যে বিদ্রোহ দমনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করে ফেলেছি আমরা। আমি আশা করছিলাম, বিমানবাহিনীর সহায়তায় সেনা সদরের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনে একটি সমন্বিত আন্তঃবাহিনী অভিযান পরিচালনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। কারণ ট্যাঙ্ক বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক সেনাদল এককভাবে কখনােই আক্রমণযুদ্ধ পরিচালনা করে না। সেক্ষেত্রে পদাতিক সেনাদলের সহায়ক শক্তি হিসেবে বিমান অথবা ট্যাঙ্ক বাহিনীর সহায়তা প্রয়ােজন।
অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, সেনাপ্রধানের তত্ত্বাবধানে বিদ্রোহ দমনের কোনাে যৌথ পরিকল্পনা করা হলাে না, যদিও তিন বাহিনীর প্রধানই একসঙ্গে ছিলেন। মিনিট দশেক পর সেনাপ্রধান সবাইকে নিয়ে রেডিও স্টেশনের উদ্দেশে চলে গেলেন। সেনাপ্রধান এবং তার সঙ্গীরা প্রথম বেঙ্গলে মাত্র মিনিট দশেক ছিলেন। এরি মধ্যে আমি সেনাপ্রধানের সঙ্গে পরামর্শ ও তার অনুমতিক্রমে জয়দেবপুরে অবস্থানরত একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে লে. কর্নেল আমিন আহমেদ চৌধুরীর পােস্টিংয়ের ব্যবস্থা করলাম। অফিসারটি ঐ ব্যাটালিয়নের সাবেক অফিসার ছিলেন। সেই সঙ্কটময় মুহূর্তে ব্যাটালিয়নটিতে কোনাে সিনিয়র অফিসার না থাকায় আমি এ ব্যবস্থা নিই। কথাটা এজন্য বলছি যে, সেনাপ্রধান তার কয়েকটি সাক্ষাৎকার ও রচনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি আমাকে সেদিন প্রথম বেঙ্গলের ইউনিট লাইন বা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে দেখেন নি বা আমি তার কাছ থেকে দূরত্ব রেখে চলছিলাম।
ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে ফিরলেন ঘণ্টাখানেক পর। তিনি আমার অফিসে বসে সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে লাগলেন। ইতিমধ্যেই সারা জাতিকে স্তম্ভিত করে দিয়ে সেনাপ্রধান অন্যদের নিয়ে একটি অবৈধ ও খুনি সরকারের প্রতি বেতারে তার সমর্থন ও আনুগত্য ঘােষণা করে বসেন। তার এই ভূমিকার ফলে আমাদের বিদ্রোহ দমনের সকল প্রস্তুতি অকার্যকর ও অচল হয়ে পড়লাে। কার্যত আমাদের আর কিছুই করার থাকলাে না এবং অ্যুথানকে তখনকার মতাে মেনে নিতে বাধ্য হলাম । রেডিওতে সেনাপ্রধানের আনুগত্যের ঘােষণা শুনে সেনানিবাসের প্রায় সমস্ত অফিসার আমার ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারে এসে ভিড় করলাে। তারা সবাই এ অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়েছিল যে সমগ্ন সেনাবাহিনীই এ নৃশংস ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত। একজন সিনিয়র অফিসার তাে তার অধীনস্থ এক নিতান্ত জুনিয়র অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির মূল্যবান সামগ্রী লুটপাটে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। কয়েকদিন পর অন্যান্য জুনিয়র অফিসারের মুখে এই লুটপাটের ঘটনা শুনি।
এরপর বঙ্গভবন থেকে আদিষ্ট হয়ে খালেদ মােশাররফ দিনভর বিভিন্ন সামরিক-বেসামরিক সংস্থা, ইউনিট ও সাব-ইউনিটের প্রতি একের পর এক নির্দেশ জারি করছিলেন। তখনকার মতাে সব কিছুরই লক্ষ্য ছিল বিদ্রোহের সাফল্যকে সংহত ও অবৈধ মােশতাক সরকারের অবস্থানকে নিরঙ্কুশ করা। অভ্যুথানকারীদের পক্ষে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজগুলাে সম্পাদন করা হয়েছিল সেদিন। ১৫ আগস্টের অ্যুথান-পরবর্তী সময়ে সেনাসদরের কোনাে ভূমিকা ছিল না বলাটাই সঙ্গত হবে। প্রকৃতপক্ষে সেনাসদরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ অফিসার আমার হেড কোয়ার্টারে অবস্থান করে সিজিএস-কে সাহায্য-সহযােগিতা করছিলেন।
সামরিক শৃঙ্খলা বিপর্যস্ত ১৫ আগস্ট খালেদ মােশাররফ সেনাপ্রধানের নির্দেশে বঙ্গভবন, রেডিও স্টেশন, টিভিকেন্দ্র, বিমানবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, তিতাস গ্যাসের ট্রান্সমিশন সেন্টার ইত্যাদি নাজুক এলাকাগুলােতে আমার অধীনস্থ ৪৬ ব্রিগেড থেকে সৈন্য মােতায়েন করেন। দুপুর বারােটার দিকে বঙ্গভবন থেকে সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ ফোন করলেন সিজিএস খালেদ মােশাররফকে। সেনাপ্রধান বললেন, অভ্যুত্থানকারীদের ট্যাঙ্কগুলােতে গান অ্যামুনিশন নেই। তিনি অ্যামুনিশন ইস্যুর ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিলেন সিজিএস-কে। খালেদ মােশাররফ তাঁর নির্দেশমতাে রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপােকে অ্যামুনিশন ইস্যুর অর্ডার দিলেন। অভ্যুত্থানকারীদের ট্যাঙ্কগুলােতে যে গান অ্যামুনিশন ছিল না, এই প্রথম সেটা জানতে পারলাম আমরা।
ক্যান্টনমেন্টে তখন বিশৃঙ্খল পরিবেশ। দুটি রেজিমেন্ট চেইন অফ কমান্ডের সম্পূর্ণ বাইরে। রশিদ-ফারুকের সঙ্গে হাত মেলানাের যেন একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। ক্যান্টনমেন্টে সে সময় ৪৬ ব্রিগেড ছাড়াও ছিল লগ এরিয়া, আর্টিলারি, ইঞ্জিনিয়ারিং ও সিগন্যাল কমান্ডের বিভিন্ন ইউনিট ও সাবইউনিট। আমি এদের সিও এবং ওসিদের ডেকে বললাম, “সামরিক আইনমাফিক আপনারা অবশ্যই চেইন অফ কমান্ডের অধীনে থাকবেন। এর বাইরের কোনাে নির্দেশ আপনারা মানবেন না।” তারা সবাই আমার উপদেশের প্রতি সম্মতি জানালেন। এভাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের কমান্ড ও শৃঙ্খলা ধরে রাখার চেষ্টা করি আমি। তা না হলে এদের অনেকেই হয়তাে বিদ্রোহীদের প্রতি প্রকাশ্য আনুগত্য স্বীকার করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতেন।
দুপুরে খবর পেলাম, কুমিল্লা থেকে অনেক সৈন্য কোনাে নির্দেশ ছাড়াই সিভিল বাস ও ট্রাকে করে অভুথানকারীদের সঙ্গে যােগ দিতে ঢাকায় আসছে। কুমিল্লার ব্রিগেড কমান্ডার তখন কর্নেল আমজাদ আহমেদ চৌধুরী (পরে মেজর জেনারেল অব.)। তিনি ব্যাঙ্কের দিক থেকে আমার সমকক্ষ, কিন্তু বয়স ও চাকরিতে অনেক সিনিয়র। তাকে আমি অনুরােধ করলাম সৈন্যদের ঢাকায় অসিতে না দিতে। আরাে বললাম, আর্মি হেড কোয়ার্টার ছাড়া কারাে নির্দেশ না মানতে। যে করে হােক চেইন অফ কমান্ড রক্ষা করার অনুরােধ জানালাম তাকে। কর্নেল আমজাদ আমার সঙ্গে একমত হয়ে সে মতাে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানালেন। অনেক সৈন্য অবশ্য ততােক্ষণে ঢাকায় পৌঁছে গিয়েছিল। অনেকে ছিল পথে।
দুপুরের খাবার খেতে বিকেল চারটায় বাসায় ফিরলাম। মিনিট পনেরাে বাসায় ছিলাম এসময় । এরি মধ্যে আকস্মিকভাবে হাজির হলেন ঢাকা সেনানিবাসে অবস্থানরত আরেকটি হেড কোয়ার্টারের কমান্ডার। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর দেখাচ্ছিল। তিনি বারবার বলছিলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে আওয়ামী লীগ নেতাদের যে অংশটি ক্ষমতা দখল করেছে তাদের প্রতি আনুগত্য স্থাপন করা অত্যন্ত পীড়াদায়ক। তিনি বললেন, এই বেঈমানগুলােকে যতাে শিগগির উৎখাত করা যাবে জাতির ততােই মঙ্গল। সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ে হত্যাকারী ও তাদের মদদদাতা রাজনীতিকদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তাদের বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশ পরিচালনার পরিবেশ সৃষ্টি করা এখন আশু কর্তব্য। খালেদ মােশাররফ আরাে বললেন, পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ ঘােলাটে। পক্ষ-বিপক্ষ বােঝা দুরূহ হয়ে পড়েছে। এর জন্য সময়ের প্রয়ােজন। এই মুহূর্তে কোনাে ভুল পদক্ষেপ নেয়া আত্মঘাতী পদক্ষেপের শামিল হবে বলে মত দিলেন তিনি। তাঁর কথায় যুক্তি ছিল বলে আমিও একমত হলাম। পরদিন অর্থাৎ ১৬ আগস্ট সকালে সিজিএস সেনাসদরে চলে গেলেন। তিনি তার নিজস্ব দায়িত্ব পালন শুরু করলেন। ব্রিগেড হেড কোয়ার্টারের দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই আবার আমার কাছে ফিরে এলাে।
 

সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ  রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮