শুরু হলাে প্রতিরােধ যুদ্ধ
২৮ মার্চ দুপুরের দিকে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন (এখন মেজর জেনারেল) একটা মােটর সাইকেলে করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে হাজির হলো। ২৭ মার্চ রাতে কোনােভাবে আমাদের বিদ্রোহের খবর পাওয়ার পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালায় সে। তারপর আশপাশের কোথাও থেকে একটা মােটর সাইকেল যােগাড় করে সােজা আমাদের কাছে চলে আসে। মাত্র সাতদিন আপে নবম ইস্ট বেঙ্গলে পােস্টিং হয় তার বদলির সুবাদে ছুটিতে ছিল সে এ কারণেই সিও-র সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া না এলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টেই রয়ে যায় আইনউদ্দিন। সন্ধ্যায় তাকে অ্যান্ডারসন খালে পাঠানাে কোম্পানিটির দায়িত্ব দেয়া হলাে। সে বললাে, আমি এখনই আবার কুমিল্লা যেতে চাই। কুমিল্লা গিয়ে বাঙালি সৈন্য ও অফিসারদেরকে সপরিবার ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যাওয়ার কথা বলেই চলে আসবাে। আইনউদ্দিন কিছুক্ষণের মধ্যে কুমিল্লার দিকে রওনা হয়ে গেলাে। কিন্তু ক্যান্টনমেন্টের কাছাকাছি পৌছুতেই সে দেখতে পায়, বিশাল এক কনভয় এগিয়ে আসছে তখন রাত হয়ে গেছে। বেশ কটা হেডলাইট গােনার পর মােটর সাইকেল ঘুরিয়ে আইনউদ্দিন সােজা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে ছুট দেয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছানাের পর সব শুনে তাকে অ্যান্ডারসন খালে অবস্থান নিতে বলা হলাে। পরদিন দুপুরে পাক বাহিনীর কনভয়ের অগ্রবর্তী দুটো জিপ অ্যান্ডারসন খালের ব্রিজের মুখে পৌছুলে এপাশ থেকে আইনউদ্দিনের কোম্পানির অস্ত্রগুলাে তাদের ওপর গর্জে ওঠে। আচমকা আক্রমণে একটা জিপ অচল হয়ে যায়, আরেকটা কোনাে মতে পালায়। ঐ সংঘর্ষে একজন অফিসারসহ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। আইনউদ্দিনের আর ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া হলাে না। এখন শত্রু-মিত্র স্পষ্টতই চিহ্নিত হয়ে গেছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত অন্যান্য বাঙালি সেনাসদস্য ও সবার পরিবারের কথা ভেবে আমরা শঙ্কিত হয়ে পড়লাম।
ক্যান্টনমেন্টে যুদ্ধ
২৯ মার্চ বিকেলে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চতুর্থ বেঙ্গলের রিয়ার হেড কোয়ার্টারের ওপর পাক আর্মি আর্টিলারি গান ও থ্রি কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের সাহায্যে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় আমাদের যেসব জওয়ান রিয়ারের দায়িত্বে ছিল তারা সংগঠিত হয়ে প্রবল বাধা দেয়। দু’পক্ষের মধ্যে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। রাত নেমে এলে পাকিস্তানিদের আক্রমণ কিছুটা স্তিমিত হয়। তখন কয়েকজন জেসিও এবং এনসিওর নেতৃত্বে অধিকাংশ সৈন্য তাদের পরিবারসহ ক্যান্টনমেন্টের মরণফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। চতুর্থ বেঙ্গলের নায়েব সুবেদার এম,এ, সালাম এ সময় অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে যুদ্ধ করে বেরিয়ে আসা সৈনিকেরা অবশ্য তখুনি আমাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে পারে নি। মে মাসের দিকে এদেরই একটা বড়াে অংশ বিবিরবাজার এলাকায় মাহবুবের সাব-সেক্টরের সঙ্গে যােগ দেয়। জাঙ্গালিয়া গ্রিড স্টেশনে আগে থেকেই অবস্থানরত চতুর্থ বেঙ্গলের একটি প্লাটুনও তাদের সঙ্গে মিলিত হয়। প্লটুনটির কমান্ডার ছিলেন নায়ের সুবেদার এম.এ. জলিল। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল একত্র হলাে ৩০ মার্চ টেলিফোন অপারেটরদের কাছ থেকে খবর পেলাম, মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে দ্বিতীয় বেঙ্গল ২৮/২৯ তারিখে জয়দেবপুরে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহে একত্র হয়েছে। আরাে জানা গেলাে, দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল ট্রেনে করে ঢাকা অভিযানের উদ্যোগ নিয়েছে। এ খবর পাওয়া মাত্র একটা রেলওয়ে ইঞ্জিন যােগাড় করে মাহবুবকে কিশােরগঞ্জ পাঠানাে হলাে। তার সঙ্গে পাঠানাে এক জরুরি বার্তায় খালেদ মােশাররফ মেজর শফিউল্লাহকে চতুর্থ বেঙ্গলের সঙ্গে যােগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, এই মুহূর্তে ঢাকা গেলে তারা পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন।
আরাে শক্তি সঞ্চয় করে সংগঠিত হয়ে তারপর ঢাকার দিকে এগােনাের প্রস্তাব করেন তিনি ওদিকে আরেকটি ট্রেন ভৈরববাজার হয়ে নরসিংদী পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এই ট্রেনটিতে দ্বিতীয় বেঙ্গলের যেসব সৈন্য ছিল তারা নরসিংদী এবং ডেমরার কাছে পাঁচদোনার বিভিন্ন জায়গায় পাক বাহিনীর ওপর এ্যামবুশ করে তাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে দ্বিতীয় বেঙ্গলের এই যােদ্ধাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিল ইপিআর সদস্য। পাঁচদোনা এলাকায় দ্বিতীয় বেঙ্গলের যে ফোর্স গিয়েছিল তার কমান্ডার ছিল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (এখন মেজর জেনারেল)। সে তখন বালুচ রেজিমেন্টে কর্মরত ছিল। ছুটিতে থাকা অবস্থায় ২৯/৩০ মার্চ ময়মনসিংহে দ্বিতীয় বেঙ্গলের সঙ্গে যােগ দেয় সে। যা হােক, ৩১ মার্চ নাগাদ দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একত্র করা সম্ভব হয়। এই রেজিমেন্ট দুটো ছিল প্রায় অক্ষত। দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গলের একত্র হওয়ার ব্যাপারটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এরপরই মুক্তিযুদ্ধ একটি সুসংহত সামরিক শক্তি হিসেবে সফল পরিণতির দিকে অগ্রসর হয়। নয় মাসের যুদ্ধের মূল স্তম্ভ ছিল এই ব্যাটালিয়ন দুটো। দখলদার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে একটি সংগঠিত ও দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পিত যুদ্ধাভিযান পরিচালনায় দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গল অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ব্যাটালিয়ন দুটি সৈন্যদের মনােবল বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশবাসীর মনেও বিজয় সম্পর্কে আশার সঞ্চার করে।
তেলিয়াপাড়ার হেড কোয়ার্টার
দ্বিতীয় বেঙ্গল আসার পরই আমাদের বাহিনীর হেড কোয়ার্টার হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে স্থানান্তরিত করা হয়। আশুগঞ্জ ও লালপুর ফেরিঘাটে অবস্থানরত চতুর্থ বেঙ্গলের সেনাদলকে প্রত্যাহার করে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে পাঠানাে হয়। তাদের জায়গায় মােতায়েন করা হয় দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটো কোম্পানিকে শায়েস্তাগঞ্জে অবস্থানরত লে, মাহবুবের (পরবর্তীকালে লে, কর্নেল ও চট্টগ্রাম অ্যুত্থানে নিহত) কোম্পানিকেও তেলিয়াপাড়া পাঠানাে হয়। শায়েস্তাগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের দিকে পাঠানাে হয় দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানি। অর্থাৎ ১ এপ্রিলের পর আমাদের অবস্থান ছিল এরকমের : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অ্যান্ডারসন খালে আইনউদ্দিনের কোম্পানি, শাহবাজপুর ব্রিজে হারুনের কোম্পানি এবং গঙ্গাসাগরে একটা প্লাটুন। গঙ্গাসাগরে প্লাটুনটি পাঠানাের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেন লাইন ধরে আসতে গেলে তাদের প্রতিহত করা। অবশিষ্ট সমস্ত সৈন্য অর্থাৎ চতুর্থ বেঙ্গলের দু’কোম্পানির কিছু বেশি সৈন্য এবং দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটো কোম্পানি তেলিয়াপাড়াতে একত্র হলাে। এরই মধ্যে একদিন চতুর্থ বেঙ্গলের সিও খালেদ মােশাররফ বিওপিগুলােতে (Border Outpost) অভিযান চালিয়ে বাঙালি ইপিআরদের মুক্ত এবং পাঞ্জাবিদের বন্দি করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র দখলের দায়িত্ব দিলেন মাহবুবকে। মাহবুব পরবর্তী প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে কৃতিত্বের সঙ্গে বিভিন্ন বিওপি থেকে কয়েকশাে বাঙালি ইপিআরকে মুক্ত করে। এছাড়া বেশ কিছু পাঞ্জাবিকে বন্দি করে তাদের অস্ত্রগুলাে নিয়ে আসে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক
এপ্রিলের ২ তারিখে খালেদ আর আমার সঙ্গে তেলিয়াপাড়া সীমান্তের নাে ম্যান্স ল্যান্ডে’ ভারতের ত্রিপুরাস্থ বিএসএফ-এর আইজি (নাম মনে নেই) এবং আগরতলার ডিসি মি, সায়গলের মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য-সহযােগিতার বিষয়ে আলােচনা হলাে। এসময় আমরা আমাদের কাছে আটক পাকিস্তানি অফিসার তিনজনের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। আমরা বন্দি তিনজনকে তাদের নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে অনুরােধ করলাম। তারা কেন্দ্রের সঙ্গে আলােচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে জানালেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিকেলে বন্দিদের গ্রহণের ব্যাপারে সবুজ সঙ্কেত দিলেন। তবে কাগজকলমে তাদের পরিচয় যুদ্ধবন্দির বদলে লেখা হলাে অনুপ্রবেশকারী হিসেবে। যেভাবেই হােক আমরা তাদের দায়িত্ব মাথার ওপর থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছিলাম। তাই ভারত তাদের নিতে রাজি হওয়ায় হাঁফ ছেড়ে বাচলাম। উল্লেখ্য, ৩১ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিপিও আমার কাছে এসে একরকম হাতজোড় করে বলেন, “আমি আর এদের রাখতে পারছি না। লােকজন পাঞ্জাবিদের ওপর এমন ক্ষিপ্ত, যেখানেই পাঠাই কয়েক হাজার লােক জড়াে হয়ে যায় এদের ছিনিয়ে নেয়ার জন্য। আমি তিন তিনটি থানা হাজতে বদলি করেছি বন্দিদের, সবখানে একই অবস্থা। আপনি আমাকে গুলি করুন, তবুও এদের নিয়ে যান।
ওসমানী এলেন ঢাকা থেকে
২ এপ্রিলের পর কোনাে এক সময় কর্নেল (অব.) ওসমানী ঢাকা থেকে পালিয়ে কুমিল্লার মতিনগর সীমান্ত পার হন। বিএসএফ-এর ব্রিগেডিয়ার পান্ডে তাঁকে আমাদের তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে নিয়ে আসেন। কর্নেল ওসমানীকে তাে প্রথমে চেনাই যাচ্ছিল না। তার সুপরিচিত গোঁফ উধাও! প্রতিরােধ যুদ্ধ সম্পর্কে কোনাে কথাবার্তা বললেন না ওসমানী। কীভাবে পোঁফ কামিয়ে ছদ্মবেশে ঢাকা থেকে পালিয়ে এলেন, বারবার শুধু সে কথাই বলছিলেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলিতে তার পােষা কুকুর মন্টির মৃত্যুতে খুব আফসােস করছিলেন কর্নেল ওসমানী। সেদিন একটা ছােটোখাটো মিটিং হয়। এ বৈঠকে আমরা ওসমানীকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের তাগিদ দিই, যাতে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রাম একটি বৈধতা অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে সক্ষম হয়। মিটিংয়ে বিএসএফএর ব্রিগেডিয়ার পাড়ে জানালেন, চট্টগ্রামে মেজর জিয়া প্রতিরােধ যুদ্ধ শেষে রামগড়ে অবস্থান করছেন। তার সেনাদল একেবারে বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। পান্ডে বললেন, মেজর জিয়াকে আমাদের সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে হবে। মিটিংয়ে জিয়াকে সাহায্য করার সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। সে অনুযায়ী চতুর্থ ও দ্বিতীয় বেঙ্গলের দুটো শক্তিশালী কোম্পানি সে রাতেই তার সাহায্যার্থ পাঠানাে হলাে। কোম্পানি দুটো ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে রামগড় পৌছে মেজর জিয়ার অষ্টম বেঙ্গলের অবশিষ্ট সেনাদলের সঙ্গে যােগ দেয়।
পরে তারা ফেনী-চট্টগ্রাম সড়কের শুভপুর ব্রিজ এবং কুমিরা এলাকায় কয়েকটি বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে অংশ নেয়। জিয়াকে দেয়া চতুর্থ বেঙ্গলের কোম্পানিটির অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.), দ্বিতীয় বেঙ্গলের কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন এজাজ (এখন মেজর জেনারেল)। এই মিটিংয়ে ওসমানী তার এক অবাস্তব পরিকল্পনার কথা উত্থাপন করেন। তিনি দ্বিতীয় ও চতুর্থ বেঙ্গলকে দিয়ে ভারতের সােনামুড়া সংলগ্ন গােমতি নদী পার হয়ে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের প্রস্তাব দিলেন। ওসমানী বললেন, কুমিল্লার দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে গিয়ে ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ এবং দখল করতে হবে। পরিকল্পনাটা অবাস্তব ছিল এজন্যই যে, এতে আমাদের পক্ষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতাে। ঐ মুহূর্তে সদ্য একত্র হওয়া দুটো ব্যাটালিয়নই আমাদের প্রধান সম্বল। ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে গেলে ব্যাটালিয়ন দুটোর অঙ্কুরেই বিধ্বস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। সৌভাগ্যক্রমে ব্যাটালিয়ন দুটোর উর্ধ্বতন অফিসারদের প্রবল আপত্তির মুখে ওসমানীর এই অসাধ্য ও অবাস্তব প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়।
মৃত্যুর মুখােমুখি
৬ এপ্রিল প্রায় নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলাম। সেদিন সকালে জিপ চালিয়ে তেলিয়াপাড়া থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনউদ্দিনের পজিশনে যাচ্ছি। আমার সঙ্গে দ্বিতীয় বেঙ্গলের মেজর নুরুল ইসলাম, ড্রাইভার এবং আমাদের দু’জনের দুই ব্যাটম্যান। জিপের ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ডে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা। গাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের প্রধান সড়কের রেলওয়ে লেভেল ক্রসিংয়ের কাছে পৌছুতেই আকাশে জঙ্গি বিমানের শব্দ পেলাম, বাইরে মাথা বের করে তাকাতেই দেখি, দুটো এফ-৮৬ স্যার জেট ডাইভ দিয়ে নেমে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থামিয়ে যে যেখানে পারলাম আশ্রয় নিলাম। আমি আর আমার ব্যাটম্যান পার্শ্ববর্তী নিয়াজ মােহাম্মদ কলেজের একটি কক্ষে ঢুকে পড়লাম। মেজর ইসলাম ঠাই নিলাে পাশের কালভার্টের নিচে। তার ব্যাটম্যান ঢুকে গেলাে লেভেল ক্রসিংয়ের পাশের ঘণ্টি ঘরে। ড্রাইভার যে কোথায় গেলাে, বুঝলাম না। এর পরের কিছুক্ষণ মনে হলাে একটা দুঃস্বপ্ন দেখছি। টানা প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে আমাদের অবস্থানের ওপর চললাে দুটো জঙ্গি বিমানের অনবরত স্ট্রাফিং। মেশিনগানের গুলি আর রকেটের প্রবল আওয়াজে কানে তালা লেগে যাওয়ার অবস্থা তবে বেঁচে গেলাম মূলত রুমটার সামনেই একটু দুরে রেল লাইনের ওপর রেলের তিনটি মালবাহী ওয়াগনের জন্য। মেশিনগানের গুলি এবং রকেট আঘাত করে ঐ ওয়াগন তিনটিকে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যায় সেগুলােতে। ওয়াগন তিনটি সেখানে না থাকলে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনাে সম্ভাবনাই ছিল না। ওয়াগন তিনটি আমার অবস্থানকে Line of fire থেকে আড়াল করে রেখেছিল। মিনিট পাঁচেক পর বিমানের আওয়াজ মিলিয়ে যেতে ধীরে ধীরে সবাই যার যার অবস্থান থেকে বেরিয়ে এলাম। সবাইকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেল একজনকে ছাড়া। অন্যরা বেরিয়ে এলেও মেজর ইসলামের ব্যাটম্যানকে দেখছিলাম না। হঠাৎ মনে পড়লাে সে ঘণ্টি ঘরে ঢুকেছিল।
দ্রুত সবাই সেখানে গিয়ে দেখলাম, মেশিনগানের গুলিতে এফোঁড়-ওফোড় হয়ে পড়ে আছে সে। তার বুকে, পেটে এবং উরুতে মেশিনগানের ৫০ গুলির তিনটি বিরাট গর্ত। গুলি লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মারা গেছে সে। টিনের ঘণ্টি ঘরটা মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা! একজন সহযােদ্ধার মৃত্যু এবং অকস্মিক বিমান হামলায় সবাই মানসিকভাবে ভয়ানক বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। কয়েক মিনিটের বিমান আক্রমণের প্রচণ্ডতায় সবাই হতবিহবল। আসলে ঐ মুহূর্তের অনুভূতি ঠিক লিখে বােঝানাে সম্ভব নয়। ঐ শেল শক পুরােপুরি কাটিয়ে উঠতে দিন পনেরাে লেগে যায় আমার। সেদিনই বিকেলে রেডিওতে ঘােষণা করা হলাে, পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর এফ-৮৬ জঙ্গি বিমানের ইন্টারসেপশনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিদ্রোহী কমান্ডার নিহত হয়েছে। আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আছি একথা জানা থাকায় ঢাকায় আমার স্ত্রী ও পরিবারের সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। সম্ভবত জিপে লাগানাে ফ্ল্যাগ দেখে পাকিস্তানিরা ধরে নেয়, মুক্তিযােদ্ধাদের হােমরাচোমরা কেউ ঐ গাড়িতে ছিল।
ক্যাপ্টেন হায়দার এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ইমাম ও মাহবুব এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আরাে তিনজন অফিসার আমাদের সঙ্গে যােগ দেয়। এরা হলাে ক্যাপ্টেন হায়দার (পরে লে. কর্নেল এবং শহীদ) সে, লে, ইমামুজ্জামান (এখন মেজর জেনারেল) এবং লে, মাহবুব (পরে ক্যাপ্টেন এবং সিলেটের এক যুদ্ধে শহীদ)। দু’ একদিন আগে-পরে তারা তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পে আসে। তিনজনই কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিল। হায়দার ছিল থ্রি কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের অফিসার। ওই ব্যাটালিয়নে আরেকজন বাঙালি অফিসার ছিল। সামগ্রিক পরিস্থিতি আঁচ করতে পেরে ক্যাপ্টেন হায়দার পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হওয়ার আগেই ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে আসে। অন্য বাঙালি অফিসারটি পাকিস্তানিদের প্রতি আনুগত্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে ক্যান্টনমেন্টেই থেকে যায়। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতায় বেশ দক্ষতার পরিচয় দেয় ঐ অফিসারটি। পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে চট্টগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দখল করতে সহায়তা করে সে। অফিসারটি এ সময় মেজর জিয়ার সেনাদলের সঙ্গে সংঘর্ষে আহত হয়। এই ঘটনার পরপরই সে পাকিস্তানে পােস্টিং নিয়ে চলে যায়। অবাক করার মত ঘটনা, জিয়া-পত্নীর শাসনকালে ঐ অফিসারটি তার মন্ত্রীসভায় জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিল। সে. লে. ইমামুজ্জামানের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার ঘটনাটি ছিল লােমহর্ষক। সে ছিল কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের আর্টিলারি রেজিমেন্টে। রেজিমেন্টটির সিও পাঞ্জাবি লে. কর্নেল ইয়াকুব ছিলেন চরম বাঙালি-বিদ্বেষী। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের বিদ্রোহ করার খবর পেয়ে রক্তলােলুপ ঐ অফিসার তার রেজিমেন্টের বাঙালি সেনাসদস্যদের ওপর গুলি চালানাের নির্দেশ দেয়। তার নির্দেশমতো বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনাসদস্যকে একটি কক্ষে ঢুকিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালায়। সে, লে, ইমামুজ্জামানও এই বাঙালি সেনাসদস্যদের মধ্যে ছিল। গুলিবিদ্ধ হয়ে সবাই লুটিয়ে পড়ে। ইমামুজ্জামানের পায়ে গুলি লাগলেও তার মৃত্যু হয় নি।
আহত অবস্থায় অন্যদের মৃতদেহের নিচে লুকিয়ে থাকে সে পরে রাত নেমে এলে গােপনে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসে ইমামুজ্জামান। তারপর সীমান্ত পার হয়ে বিএসএফ-এর কাছে পরিচয় দিলে তারা তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। একটু সুস্থ হলে সেখান থেকে তেলিয়াপাড়া চলে আসে ইমামুজ্জামান। লে, মাহবুবের পােস্টিং ছিল ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানকালে ২৯ মার্চের পর পালিয়ে এসে তেলিয়াপাড়ায় আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় মাহবুব। পরবর্তীকালে প্রথম বেঙ্গলে পােস্টিং হয় তার। নভেম্বরের শেষদিকে সিলেটের পূর্বাঞ্চলে এক রণাঙ্গনে শহীদ হয় মাহবুব।
আপসকামী নেতৃত্ব
বিমান হামলার দুতিনদিন আগের ঘটনা। ডিফেন্স পজিশনগুলাে তদারকির রুটিন কাজে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যাওয়ার সময় সিলেট সড়কে সরাইলের কাছে হঠাৎ করে তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেলাে। রাস্তার পাশে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। ছােটোখাটো একটা জনতা তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সঙ্গে আমার ছাত্রজীবনের পরিচয়। ১৯৬১ সালে তদানীন্তন ঢাকা হল ছাত্র সংসদে ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেলে তিনি জিএস আর আমি সহ-ক্রীড়া সম্পাদক ছিলাম। সত্তরের নির্বাচনে সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তাহের ঠাকুর। যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন সেটাই তার নির্বাচনী এলাকা। স্বভাবতই আমি গাড়ি থেকে নেমে সােৎসাহে তাকে ২৭ তারিখ আমার বিদ্রোহ করার কথা জানালাম। ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের নির্দেশনা কি, জানতে চাইলাম তার কাছ থেকে। আমাকে হতবাক করে দিয়ে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর রীতিমতাে খাপ্পা হয়ে গিয়ে বললেন, “I don’t know anything. I have nothing to do with you. Who told you to revolt? We didn’t ask you to do so…you people in uniform always complicate the situation.” তাহের ঠাকুরের মনোভাব দেখে যারপরনাই বিস্মিত হলাম আমি। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে চাকরির নিশ্চয়তার প্রলােভন, নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা তুচ্ছ করে দেশের জন্য নিরস্ত্র জনগণের জীবন রক্ষায় যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লাম, আর একজন জনপ্রতিনিধি হয়ে এই লােক বলে কি না Who told you to revolt? তার সঙ্গে আর কোনাে কথা বলার প্রবৃত্তি হলাে না আমার। তক্ষুনি চলে এলাম সেখান থেকে।
স্ত্রী-পুত্রের খোঁজখবর
৩ বা ৪ এপ্রিল ঢাকা থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলেন। জাকারিয়া চৌধুরীসহ (সাবেক মন্ত্রী) কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি তার সঙ্গে ছিলেন। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন তিনি। মওদুদ জানালেন, ঢাকা থেকে অনেক তরুণ যুদ্ধে যােগ দিতে চাইছে। তিনি আবার ঢাকায় ফিরে গিয়ে বন্ধুবান্ধবসহ আগ্রহীদেরকে নিয়ে আসতে চাইলেন মওদুদ ঢাকায় যাবেন শুনে আমার স্ত্রী ও দু’ছেলে বিন্তু ও কোচন কোথায় কেমন আছে সে ব্যাপারে খোজ করতে বলায় সাগ্রহে রাজি হলেন তিনি। ঢাকা থেকে মওদুদ ফিরলেন ৮ এপ্রিল এসে জানালেন, আমার স্ত্রী রাশিদা দু ছেলেকে নিয়ে ঘোড়াশালে কোনাে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আছেন। ঘােড়াশালে আমাদের একজন নিকটাত্মীয় থাকতেন, তবে আমার ধারণা, রাশিদার সেখানে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। মওদুদ বানিয়ে বলছেন কি না সন্দেহ হলাে আমার ঢাকা শহরে চলাফেরা তখন মােটেই নিরাপদ নয়। তাই হয়তাে আমার পরিবারের খোঁজ করতে পারেন নি। এখন চক্ষুলজ্জায় না-ও করতে পারছেন না। হঠাৎ করেই মনে হলাে, নরসিংদীতে রাশিদার এক আত্মীয়ের বাড়ি আছে। ঘােড়াশাল থেকে নরসিংদী কাছেই তাহলে রাশিদা হয়তাে নরসিংদীতেই আছেন। সেদিনই নরসিংদীতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। সন্ধ্যা পেরােতে চারজন জওয়ান আর ব্যাটম্যানকে নিয়ে রওনা হলাম। অনেক ঘােরাঘুরি করে নরসিংদীর ঐ বাড়িটিতে যখন পৌছুলাম, তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ভয়ে কেউ দরজা পর্যন্ত খুলতে চায় না। শেষ পর্যন্ত জিগ্যেস করলাম, ঢাকা থেকে কেউ এসেছে কি না। বন্ধ দরজার ওপাশ থেকেই জানানাে হলাে, না কেউ আসে নি ঢাকা থেকে এতােটা পথ এসেও ওদের কোনাে খবর না পেয়ে খুব হতাশ লাগলাে। ফেরার সময় কাছেই নরসিংদী বাজারে দেখলাম আগুন জ্বলছে। প্রচুর গুলির শব্দও শােনা গেলাে। বুঝলাম পাকসেনাদের কাজ। আমরা সংখ্যায় মাত্র পাঁচজন।
তাই চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। পরদিন সকালের দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এসে পৌছুলাম। এ সময় দ্বিতীয় বেঙ্গলের একটি কোম্পানি নিয়ে আশুগঞ্জের প্রতিরক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল ক্যাপ্টেন নাসিম (পরে লে. জেনারেল ও সেনাবাহিনী প্রধান)। নরসিংদী যাওয়ার পথে আশুগঞ্জ পার হওয়ার সময় তার সঙ্গে দেখা হয় আমার। | ৪ এপ্রিল পাক বিমানবাহিনী অ্যান্ডারসন খালে আমাদের অবস্থানে হামলা চালায়। এই হামলায় চতুর্থ বেঙ্গলের একজন জওয়ান শহীদ হয়। গুরুতর আহত হয় আরেকজন। বিমান হামলার পর অ্যান্ডারসন খালের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করা হয়।
তেলিয়াপাড়ায় গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্স
এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে তেলিয়াপাড়া হেড কোয়ার্টারে একটি বড়াে ধরনের কনফারেন্স হলাে। দ্বিতীয় ও চতুর্থ ব্যাটালিয়নের সিনিয়র অফিসাররা ছাড়াও এতে কর্নেল (অব.) ওসমানী, রামগড় থেকে আসা মেজর জিয়া, ভারতীয় বিএসএফ-এর প্রধান মি. রুস্তমজি, ব্রিগেডিয়ার পাভেসহ কয়েকজন সিনিয়র অফিসার এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এসডিও কাজী রকিবউদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। কনফারেন্সে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও খাদ্যসামগ্রী দিয়ে সহায়তা করার ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় প্রতিশ্রুত সাহায্যের পরিমাণ ছিল নেহাতই অনুল্লেখ্য। এ কনফারেন্সেই আমরা সবিশেষ গুরুত্বারােপ করে বলি মুক্তিযুদ্ধকে বৈধতাদানের জন্য এখনই একটি অস্থায়ী সরকার গঠন অত্যাবশ্যক। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য এটি অপরিহার্য ছিল। এরই ফলে ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার বৈদ্যনাথ তলায় সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি করে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হলাে। এদিকে কনফারেন্স চলাকালে একটা ঘটনা ঘটলাে। সকাল সােয়া আটটা একজন সিগন্যাল জেসিও একটা মেসেজ ইন্টারসেপ্ট করে আনলাে। মেসেজটা হচেছ TOT (Time over Target) at 8.30। এর অর্থ বাংলাদেশের কোনাে একটি জায়গায় সাড়ে আটটার সময় বিমান থেকে বােমা হামলা হবে। ওসমানী সাহেব এতে খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলেন।
তিনি বারবার বলছিলেন, যে-কোনাে সময় পাকবাহিনী বিমান হামলা চালাতে পারে। চলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন তিনি অথচ তেলিয়াপাড়া একেবারে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকা, সেখানে পাকিস্তানি বিমান হামলার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ সীমান্তের অতাে কাছে জঙ্গি বিমান পাঠানাে মানে ভারতকে একরকম যুদ্ধের উস্কানি দেয়া, যেটা অন্তত ঐ মুহূর্তে পাকিস্তানিরা চাইছিল না। ওসমানীর এই ভীরুতা দেখে বিদেশী অতিথিদের সামনে অনেকটা অপ্রস্তুতই হতে হয় আমাদের। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অ্যান্ডারসন খালের ডিফেন্স পর্যবেক্ষণে যেতাম আমি। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের সঙ্গে কথাবার্তা হতাে। এরি মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটা ট্রেনিং কোম্পানি গঠন করা হয়েছিল। কোম্পানিটির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ডাক্তার লে. আখতারকে। পরে আখতারের ট্রেনিং কোম্পানিকে তেলিয়াপাড়ায় নিয়ে আসা হয়। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই ট্রেনিং কোম্পানিতে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা হাজারে উন্নীত হলাে। এই বিপুলসংখ্যক লােককে সামাল দেয়া আখতারের জন্য বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলো।
আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া পাকবাহিনীর দখলে
১৩ এপ্রিল পাকবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের অভিযান শুরু করে। এ উদ্দেশ্যে তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ আমাদের অবস্থানগুলােতে বিমান হামলা চালায়। হেলিকপ্টারে করে আশুগঞ্জে পাওয়ার স্টেশনের পেছনের মাঠে সৈন্য নামানাে হয়। এছাড়া বেশ কিছু পদাতিক সৈন্য ভৈরববাজার-আশুগঞ্জ রেলওয়ে ব্রিজের ওপর দিয়ে অগ্রসর হয়। সেই সঙ্গে মেঘনা নদী দিয়ে গানবােট এবং অ্যাসল্ট ক্র্যাফটের মাধ্যমে ও সৈন্য সমাবেশ ঘটায় পাকিস্তানিরা। মেঘনা ব্রিজ পার হয়ে তারা জঙ্গি বিমানের ছত্রচ্ছায়ায় সারাদিন ধরে গোলাবর্ষণ করতে করতে অগ্রসর হয়। পাক সৈন্যদের কাভার দেয়ার জন্য ছ’টি এফ-৮৬ জঙ্গি বিমান হামলা শুরু করে। এর মধ্যে পালা করে দুটি বিমান সারা দিনই আকাশে ছিল। জল-স্থল-আকাশপথের এই ত্রিমুখী সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে আশুগঞ্জ ও লালপুরে নিয়ােজিত দ্বিতীয় বেঙ্গলের সৈন্যরা তাদের অবস্থান ছেড়ে পিছিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসে। মেঘনা ব্রিজ ও আশুগঞ্জ সম্পূর্ণভাবে পাকসেনাদের দখলে চলে যায়। উল্লেখ্য, কয়েকদিন আগে মেঘনা ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার জন্য আমরা তাতে হাইএক্সপ্লোসিভ স্থাপন করেছিলাম। একটি মাত্র অগ্নিস্ফুলিঙ্গই নিচের দুটো স্প্যান উড়িয়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু দেশের সম্পদের এত বড়াে একটা ক্ষতি কতে আমাদের কারুরই মন চাইছিল না। আর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েও আকাশ ও নৌ-পথে তাদের অগ্রাভিযান ঠেকানাে যেতাে না। ব্রিজটা দখল করার পর পাকসেনারা এই আয়ােজন দেখে হতবাক হয়ে যায়। কেন আমরা পশ্চাদপসরণ করার সময়ও ব্রিজটি উড়িয়ে দিই নি, তা তারা ভেবে পায় নি।
১৪ থেকে ১৬ এপ্রিল— এই তিনদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আমাদের অবস্থানে বেশ কয়েকবার বিমান হামলা হলাে। পাকিস্তানিরা আশুগঞ্জে এরি মধ্যে এক ব্রিগেডের মতাে সৈন্য জড়াে করেছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকে। ১৬ এপ্রিল সন্ধ্যা নাগাদ অগ্রবর্তী পাক সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উপকণ্ঠে এসে পৌছলাে। সে মুহূর্তে অ্যান্ডারসন খালে অবস্থানরত চতুর্থ বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের কোম্পানির সেখানে থাকা আর নিরাপদ রইলাে না। কারণ পাকবাহিনী তাদের পেছন দিয়ে খুব কাছে চলে এসেছিল। আমি তখন অ্যান্ডারসন খালের অবস্থানে আইনউদ্দিনের সঙ্গে। কোম্পানিটিকে সেখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-আখাউড়া রেললাইন ধরে আখাউড়ায় পিছিয়ে এলাম আমরা। আখাউড়া পৌঁছে তিতাস নদীর ওপর রেলওয়ে ব্রিজের দু’পাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে মুখ করে ডিফেন্স তৈরি করলাম। তারিখটা ছিল ১৭ এপ্রিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিছিয়ে আসার সময় আখাউড়ায় অবস্থিত তিতাস নদীর ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছিলাম আমরা। কিন্তু টেকনিক্যাল ক্রটির কারণে ব্রিজটি পুরােপুরি ধ্বংস না হয়ে তার দুটো স্প্যান কাত হয়ে যায়। এতে করে অবশ্য ব্রিজটি যান চলাচলের অযােগ্য হয়ে পড়ে। পাকিস্তানিদেরকে ঐ ব্রিজ পুরােপুরি ভেঙে আবার ঠিক করতে হয়েছিল।
এতে তাদের যথেষ্ট সময় ব্যয় হয়। তখন থেকে আমাদের মূল ঘাঁটি হলাে আখাউড়া স্টেশন ও তার আশপাশের এলাকা এ অবস্থান নিরাপদ রাখা এবং আইনউদ্দিনের অবস্থান জোরদার করার জন্য গঙ্গাসাগরে নদীর পাশে অবস্থান নিতে একটা শক্তিশালী প্রাটুন পাঠালাম। এতে করে কুমিল্লার দিক থেকে পাক সৈন্যরা হঠাৎ করে পেছন থেকে আইনউদ্দিনের ওপর চড়াও হতে পারবে না। আখাউড়া-গঙ্গাসাগর-সিঙ্গারবিলের যুদ্ধ ২২, ২৩ ও ২৪ এপ্রিল আখাউড়া ও গঙ্গাসাগর অঞ্চলে পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের তুমুল যুদ্ধ হলাে। সীমান্ত রেখা লঙ্ঘনের আশঙ্কায় পাকিস্তানিরা এবার আর বিমান ব্যবহার করে নি। পাকবাহিনী দূরপাল্লার কামানের অবিরাম গােলাবর্ষণ আর পদাতিক বাহিনী মারফত হামলা চালালাে। প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পাকবাহিনী আমাদের দুটো অবস্থানই দখলে নিয়ে নিলাে। এ যুদ্ধে আমাদেরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। আমাদের পক্ষে দশবারােজন শহীদ এবং ২০ জনের মতাে আহত হয়। এই লড়াইয়ের পর আইনউদ্দিনের কোম্পানি ও গঙ্গাসাগরে অবস্থানরত প্লাটুনটি প্রত্যাহার করে আমরা ত্রিপুরার আগরতলা শহরের দক্ষিণে মনতলার ‘নাে ম্যান্স ল্যান্ডে ক্যাম্প স্থাপন করলাম। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এটাই আমাদের ফোর্সের প্রথম সীমান্ত অতিক্রমের ঘটনা। আখাউড়া দখল করে পাকবাহিনীর একটা অংশ আখাউড়া-সিঙ্গারবিল-আজমপুর সড়ক ও সমান্তরাল রেললাইন ধরে অগ্রসর হয়। সিঙ্গারবিলে আমাদের চতুর্থ বেঙ্গলের আরেকটি অবস্থান ছিল। সেখানেও পাকবাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। টানা দু’দিন যুদ্ধের পর তৃতীয় দিন সিঙ্গারবিল পাকবাহিনীর দখলে চলে যায় । সিঙ্গারবিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের নিক্ষিপ্ত গােলা প্রায়ই সীমান্তের ওপারে আগরতলা বিমানন্দরে গিয়ে পড়ছিল।
গােলাগুলিতে বিমানবন্দরের বেসামরিক যাত্রীরা হতাহত হতে পারে—এই আশঙ্কায় আগরতলার প্রশাসন সিঙ্গারবিল পজিশন থেকে আমাদের সরে যাওয়ার অনুরােধ করেন। এ কারণে সিঙ্গারবিলে অবস্থিত আমাদের সৈন্যরা পিছিয়ে গিয়ে মনতলা নাে ম্যানুস্ ল্যান্ডে অবস্থান নেয়। সিঙ্গারবিলে অবস্থান নেয় চতুর্থ বেঙ্গলের সেনাদলটিকে আমি ভারতীয় ভূখণ্ডের ওপর দিয়ে সরিয়ে এনে আইনউদ্দিনের কোম্পানির সঙ্গে একত্র করি। বীরশ্রেষ্ঠ মােস্তফা কামাল ল্যান্স নায়েক মােস্তফা কামালের শাহাদাত বরণ আখাউড়া-গঙ্গাসাগরসিঙ্গারবিল যুদ্ধের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা। এই ল্যান্স নায়েক মােস্তফাই পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত হন। মােস্তফা আমার অধীনস্থ একজন সিপাই ছিল। ভালাে মুষ্টিযােদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে অবৈতনিক ল্যান্স নায়েক হিসেবে পদোন্নতি হয় তার। অর্থাৎ ল্যান্স নায়েকের র্যাঙ্ক হলেও সে পেতে সিপাইয়ের বেতন। আখাউড়া-গঙ্গাসাগর যুদ্ধে সে গঙ্গাসাগর ফ্রন্টে একটা এলএমজি পজিশনে ছিলাে। গঙ্গাসাগর যুদ্ধের আগের দিন তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয়। সেদিন জনশূন্য আখাউড়া স্টেশনে তাকে কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মতাে ঘুরতে দেখে আমি রেগে গেলাম। মােস্তফার কাধে একটা এলএমজি। তার অধীনে যে চারজন সিপাই তাদের কাছে শুধু একটা করে রাইফেল, অথচ সে জরুরি এলএমজিটা ফ্রন্ট থেকে সঙ্গে করে নিয়ে এসে ঘুরছে।
ধমক দিয়ে মােস্তফাকে জিগ্যেস করলাম, এখানে কি করছাে তুমি? মােস্তফা উত্তর দিলাে, স্যার, পত দুতিনদিন ধরে আমাদের কারােরই ঠিকমতাে খাওয়া-দাওয়া হয় নি। খাবারের খুবই অভাব। তাই আমি এখানে এসেছি খাবারটার কিছু পাওয়া যায় কি না দেখতে। আমি ওকে বললাম, তুমি এক্ষুনি তােমার জায়গায় যাও, আমি দেখি কি করা যায়। মােস্তফা চলে গেলো। সেদিন রাতে এক বস্তা বিস্কুট যােগাড় করে গঙ্গাসাগরে মােস্তফাদের অবস্থানে পাঠালাম। গঙ্গাসাগরের যুদ্ধে ২৪ এপ্রিল ভাের রাতে অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করে মােস্তফা শহীদ হয়। পাক সৈন্যদের একটি অংশ পেছন দিয়ে গিয়ে সমালেয় সৈন্যদেরকে দুদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমাদের তরফে সৈন্যসংখ্যা ছিল খুবই কম। এক প্লটুনের মতাে। উপায়ান্তর না দেখে ল্যান্স নায়েক মােস্তফা এলএমজি দিয়ে কাভার দিতে দিতে সবাইকে পিছিয়ে যেতে বলে। শুধু মােস্তফার অবিরাম এলএমজির বা ফায়ারেই ২৫/৩০ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। এই ফাকে আমাদের অন্য যােদ্ধারা নিরাপদে বেরিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তারা দূর থেকে মােস্তফাকে কাভার দেয়ার জন্য গুলি ছুঁড়তে থাকে। কিন্তু সে আর ফিরতে পারে নি। নিজের জীবন বিপন্ন করে পাকসেনাদের ওপর এলএমজি চালাতে চালাতে এক সময় সে শহীদ হয়। ল্যান্স নায়েক মােস্তফার অসীম সাহসিকতা আর চরম আত্মত্যাগের জন্য আমাদের বেশ কয়েকজন সৈন্য নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। এ যুদ্ধে মােস্তফা ছাড়াও আমাদের আরাে তিন-চারজন সৈন্য শহীদ হয়। স্বাধীনতার পর অন্যান্যের সঙ্গে আমিও সর্বোচ্চ বীরদের তালিকায় মােস্তফার নাম সুপারিশ করি। সেই সুপারিশ অনুযায়ী ১৯৭২ সালে তৎকালীন সরকার বীর মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন সম্মানসূচক খেতাবে ভূষিত করেন। যাই হােক, ২৫ এপ্রিল নাগাদ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে আমাদের আর কোনাে অবস্থান রইলাে না। সবগুলাে অবস্থান থেকে পশ্চাদপসরণ করে আমরা আগরতলার পার্শ্ববর্তী মনতলায় অবস্থান নিলাম। তেলিয়াপাড়ায় আমাদের যে ট্রপস্ ছিল সেখান থেকে একটা কোম্পানি ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে সীমান্তবর্তী শালদা নদী এলাকায় পাঠানাে হলাে। সিঙ্গারবিলে চতুর্থ বেঙ্গলের যে ট্রপস্ ছিল আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে তাদেরকে পাঠানাে হয় মনতলায়।
মতিনগরে অবস্থান গ্রহণ
২৮ এপ্রিল মেজর খালেদ মােশাররফ আমাকে কসবার দক্ষিণে মতিনগরে অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দিলেন। মতিনগর এলাকাটি উঁচু-নিচু টিলা আর ঘন জঙ্গলে ভর্তি। সেই জঙ্গল পরিষ্কার করে আমরা সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করলাম। কয়েকদিনের মধ্য চতুর্থ বেঙ্গলের সিগন্যাল প্লাটুন, মর্টার প্লাটুন এবং ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারসহ সবগুলাে গাড়ি তেলিয়াপাড়া থেকে মতিনগরে চলে এলাে। সেই থেকে মতিনগরই হয়ে উঠলাে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের মূল ঘাটি এবং প্রাণকেন্দ্র। মতিনগর আসার পরই আমরা একটা ট্রেনিং ক্যাম্প চালু করলাম। মূলত ঢাকা ও তার আশপাশের জেলাগুলাে থেকে দলে দলে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং গ্রামের সাধারণ যুবকরা এসে এই ক্যাম্পে যােগ দিতে লাগলাে। দিনকয়েকের মধ্যেই এদের সংখ্যা কয়েক হাজারে উন্নীত হলাে। এতােগুলাে লােকের থাকা-খাওয়া আর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। করতে গিয়ে হিমশিম খেতে লাগলাম আমরা। | বানেগ্ন পানিতে যেমন পলির সঙ্গে আসে কচুরিপানা, তেমনি মুক্তিপাগল তরুণ-যুবকদের ভিড়ে মিশে এলাে পাকিস্তানিদের কিছু চরও। প্রশিক্ষণার্থীদের কেউ কেউ দুয়েক দিন পর না বলে চলে যেতাে। আমার ধারণা, ওরা আমাদের অবস্থান, প্রস্তুতি, অস্ত্র ও লােকবল সম্পর্কে খবর পৌঁছে দিতাে পাকিস্তানিদের কাছে।
এয়ার ফোর্সের অফিসারদের আগমন
এরি মধ্যে একদিন ধােপদুরস্ত পাজামা-পাঞ্জাবি পরা এক ভদ্রলােককে শনাক্ত করার জন্য বিএসএফ-এর লােকজন আমার কাছে নিয়ে এলাে। ঐ সময় বিএসএফ বা অন্য কেউ কোনাে সন্দেহভাজন লােককে শনাক্ত করার জন্য। আমার বা খালেদ মােশাররফের কাছে নিয়ে আসতাে। সুবেশধারী দ্রলােক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদের (পরবর্তীকালে স্কোয়াড্রন লিডার অব.) বলে। নিজের পরিচয় দিলেন। কাদের জানালেন, তাকে ঢাকাস্থ বিমান বাহিনীর। কয়েকজন সিনিয়র অফিসার পাঠিয়েছেন এখানে আসার পথ এবং ব্যবস্থা। দেখে যাওয়ার জন্য। তিনি এরি মধ্যে এলাকার পথঘাট দেখে নিয়েছেন। কাদের বললেন, আমাকে বিশ্বাস করে ছেড়ে দিলে কয়েকজন বাঙালি অফিসারকে পাবেন আপনি, আর যদি না ছাড়েন তাহলে হয়তাে তারা আর। আসতে উৎসাহী হবেন না। দোটানায় পড়ে গেলাম। এর আগেও এয়ার ফোর্সের পরিচয় দিয়ে একজন এসে দুদিন পর চলে গেছে। এও যদি তাই করে? তবে তার কথাবার্তা থেকে স্পষ্টতই বুঝলাম, ভদ্রলােক প্রকৃতই বিমান বাহিনীর একজন অফিসার। তিনি যদি সত্যিই কয়েকজন অফিসারকে নিয়ে আসেন, তাহলে তাে খুবই ভালাে হয়।
ফ্লা. লে, কাদেরকে ক্যাম্পে রেখে বিকেলে আগরতলায় খালেদ মােশাররফের কাছে পরামর্শ চাইতে গেলাম। সবকিছু শােনার পর কিছুক্ষণ চিন্তা করে মেজর খালেদ বললেন, “আমাদের সম্পর্কে জানতে পাকিস্তানিদের আর কিছু বাকি আছে নাকি? বেঙ্গল রেজিমেন্টগুলাে কি পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বেরিয়ে এসেছে এবং তাদের সৈন্যসংখ্যা কতাে, তাতাে ওরা জানেই। দাও ছেড়ে, কি আর হবে!’ খালেদ মোশাররফের কথায় ফ্লা, লে, কাদেরকে ছেড়ে দিলাম। এরপর কয়েকদিন বেশ টেনশনে ছিলাম। কদিন পরই মতিনগর ক্যাম্পে বেশ কিছু নারী-পুরুষ-শিশু-সম্বলিত এক ‘কাফেলা’ এসে হাজির হয়। এই কাফেলাটা ছিল এয়ার ফোর্সের সেই সব অফিসার এবং তাদের পরিবারবর্গের। আমি ঐ সময় ক্যাম্পে ছিলাম না। পরে ক্যাম্পে এসে তাদের দেখে যুগপৎ বিস্মিত এবং উৎফুল্ল হই। প্রথমে আসা ফ্লা, লে, কাদেরের সঙ্গে সেদিন এয়ার ফোর্সের যেসব অফিসার অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে পালিয়ে আমাদের মতিনগর এসেছিলেন, তারা হলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল, অব.), উইং কমান্ডার বাশার (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল; কর্মরত অবস্থায় বিমান দুর্ঘটনায় নিহত), ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সুলতান মাহমুদ (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল, অব.), ফ্লা, লে, বদরুল আলম (পরে স্কোয়াড্রন লিডার, অব.), ফ্লা. লে. লিয়াকত আলী (পরে স্কোয়াড্রন লিডার, অব.), ফ্লা, লে, সদরুদ্দিন (পরে এয়ার ভাইস মার্শাল, অব.), স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম (পরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন, অব.), ফ্লাইং অফিসার ইকবাল রশীদ (পরে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, অব.), ফ্লাইং অফিসার সালাউদ্দিন (পরে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, অব.) প্রমুখ। এরা আসায় আমাদের শক্তি অনেকটাই বেড়ে গেলাে। আমাদের বাহিনীতে অফিসারদের দলটাও একটু ভারি হলাে, যা তখন খুব প্রয়ােজন ছিল। এর দু’একদিন আগে-পরে ঢাকা থেকে সেনাবাহিনীর আরও চারজন ক্যাপ্টেন—আমিনুল হক (পরে ব্রিগেডিয়ার অব.), জাফর ইমাম (পরে লে. কর্নেল অব.), সালেক (পরে মেজর সালেক, প্রয়াত) ও আকবর (পরে লে. কর্নেল অব.) আমাদের সঙ্গে যােগ দেন।
আবার পরিবারের খোঁজে
মে মাসের ৫/৬ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা কাজী আমাকে জানালো, সে ঢাকায় যাবে। আমি চাইলে সে আমার স্ত্রী-পুত্রদের তার সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারে। ওরা ঢাকা থেকে চলে এলে খুবই ভালাে হয়, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম আমি। কাজীর কাছে রাশিদাকে একটা চিরকুট লিখে দিলাম, যাতে সে নিশ্চিন্তে চলে আসতে পারে। মনে আছে, একটা সিগারেটের প্যাকেট ছিড়ে তার উল্টোদিকের শাদা অংশে তিনটি শব্দ লিখেছিলাম শুধু—“তুমি চলে আসাে’। কাজী ঢাকায় কয়েক দিন ছিল। এর মধ্যে খোঁজ করে জানতে পারে, রাশিদা পুরানা পল্টনে তার বােনের বাসায় আছে। চিঠিটা পাওয়ার পরদিনই ভােরবেলা কাজীর সঙ্গে রওনা হয়ে যান রাশিদা। কাইয়ুম নামে কাজীর এক বন্ধুও তাদের সঙ্গে চললাে। কাইয়ুমের উদ্দেশ্য মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়া। নৌকা, বেবিট্যাক্সি, রিকশা এবং হাঁটাপথে মতিনগর পৌছুতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়। আমি তার ক’দিন আগে কোলকাতায় চলে গেছি। এদিকে কোলকাতায় যাওয়ার আগেই ঘটেছে আরেক অপ্রত্যাশিত ঘটনা। আগরতলা যাওয়ার পথে সােনামুড়া ফেরি ঘাটে ঢাকা থেকে আসা বেশ কিছু তরুণ-যুবকের মধ্যে দেখি আমার ছােট ভাই রুবেল দাড়িয়ে। ওর বয়স তখন তেরাে-চোদ্দ হবে। আমি মতিনগর আছি জানতে পেরে অন্যদের সঙ্গে সেও চলে এসেছে। ঐ পরিস্থিতিতে যেন অবাক হতেও ভুলে গিয়েছিলাম। তাই রুবেলকে দেখে মােটেই আশ্চর্য হই নি। তখনকার মতাে ওকে ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিয়ে আমি আমার কাজে চলে গেলাম। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণীর লােকজন অাসছিল অব্যাহতভাবে। সেই সঙ্গে আমাদের বাহিনীর পুনর্গঠন ও ট্রেনিংয়ের কাজও চলতে থাকে যথাসাধ্য।
সূত্র : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্ণেল শাফায়াত জামিল, প্রকাশনী সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৮