পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা
বাঁকা পথ ধরেছে পাকিস্তান। পূর্ব সীমান্তে দলে দলে পাঠাচ্ছে সে গুপ্তচর এবং নাশকদল। এরা আসাম মেঘালয় এবং ত্রিপুরায় খুবই সক্রিয়। হামেশাই বিঘ্ন ঘটাচ্ছে ট্রেন চলাচলের। মাইন দিয়ে উড়াচ্ছে রেল লাইন। এখনও এদের নাশকতামূলক কার্যকলাপ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে নি পশ্চিমবঙ্গে। অদূর ভবিষ্যতে তা পড়লে অবাক হবার কিছু নেই। পাকিস্তানিদের সুবিধা অনেক। ভারতের উদারতার আড়ালে করছে তারা শয়তানীক পাঁয়তারা। পাক-সৈন্য এবং ধর্মান্ধ গুণ্ডাদের অত্যাচারে আশী লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন। ভারতে। তাঁদের সঙ্গেহ ঢুকেছে পাক-গুপ্তচর এবং নাশকদল। এদের চিনে বার করা মুস্কিল। জনসাধারণ এবং শরণার্থীরাই ধরিয়ে দিতে পারেন কুচক্রীদের। ইতিমধ্যেই তাদের সহযােগিতায় হাতে-নাতে ধরা পড়েছে ক’জন। বাংলাদেশ সরকার এবং নয়াদিল্লী সমভাবেই উদ্বিগ্ন। কারন পাক, দুবৃত্তদের কার্যকলাপ ভারতের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনক। মুক্তিবাহিনীর গতিবিধির তথ্যদি সংগ্রহ এবং তা পাক-জঙ্গী শাসকদের কাছে পাচার গুপ্তচরদের কাজের আবশ্যকীয় অঙ্গ। ফলে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন বাংলাদেশ সরকার। প্রমদ শুনছেন আসামের প্রধানমন্ত্রী গান্ধী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রামের সঙ্গে। আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য তিনি চেয়েছেন আরও সি আর পি। জানিয়েছেন সীমান্ত বরাবর রক্ষীবাহিনীকে জোরদার করার দাবী। বাস্তব অবস্থার বিচারে তার অভিমতের যৌক্তিকতা অনস্বীকার্য। শুধুমাত্র পূর্ব সীমান্তই নয়, কাশ্মীর সীমান্তও যথেষ্ট পরিমাণে উত্তপ্ত। যুদ্ধবিরতি সীমারেখার এপারে এবং ওপারে সাত মাইল অঞ্চল সৈন্যমুক্ত থাকার কথা। পাকিস্তান মানছে না গ্রাউণ্ড রুল। সৈন্যমুক্ত অঞ্চলে বানাচ্ছে সে সড়ক। গড়ে তুলছে বাঙ্কার। পাচার করছে হানাদার দল। গুরুতর অভিযােগ উঠছে পাক এলাকায় রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষকদের বিরুদ্ধে। তাদের চোখের সামনেই নাকি ঘটছে এসব নষ্টামী। অনেকেই নিচ্ছেন নাকি উৎকোচ। রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে নাকি প্রতিবাদলিপি পাঠাবার তােড়জোড় করছে ভারত। রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষকদলে বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযােগ নতুন নয়। জর্ডানে যুদ্ধবিরতি সীমারেখা বরাবর অবস্থানের সময় তারা নাকি গােপন মদৎ দিতেন ইস্রাইলকে। আরবভূমিতে ইস্রাইলী ছিটমহলগুলােতে নাকি অস্ত্র পাচার হত তাদের জ্ঞাতসারে। ১৯৪৮ সালে এবং ১৯৬৭ সালে এ ধরনের অভিযােগ এনেছিলেন। দায়িত্বশীল আরবমহল। সাইপ্রাসে আছেন রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী। তাদের কোন কোন দলের বিরুদ্ধে এক সময় সােচ্চার হয়ে উঠেছিল পক্ষপাতিত্বের অভিযােগ। সংখ্যালঘু তুর্কী সিপ্রিয়টদের সম্পর্কে অনেকের নাকি ছিল গােপন দুর্বলতা। কঙ্গোতে লুমুম্বা হত্যার সময় পশ্চিমা স্বাঘচক্র রাষ্ট্রসংঘ বাহিনীকে পরিণত করেছিল বৃহন্নলায়। কাশ্মীরে যুদ্ধরিতি সীমারেখার ওপারে পাক তৎপরতার খবর এবং রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষক দলের বিরুদ্ধে অভিযােগ একেবারে উড়িয়ে না দেওয়াই যুক্তিযুক্ত; বিশেষ করে, কাশ্মীরে পাকগুপ্তচর বৃত্তি এবং হানাদারীর ইতিহাস পুরানাে। মাঝে মাঝে পুলিশ আবিষ্কার করছে পাক-দুশমদের ঘাঁটি। ওপারে ঢাকঢােল পিটিয়ে জঙ্গী শাসকরা তালিম দিচ্ছেন হানাদারদের। দু’একটি দলও ধরা পড়েছে কাশ্মীরে।
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী গেছেন জম্মু এবং কাশ্মীর সফরে। উধমপুরে এক বিরাট জনসভায় তিনি জাতিকে দিয়েছেন হুশিয়ারী এবং নিরাপত্তার আশ্বাস। ভারতের জওয়ানরা সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী সন্দেহ নেই। তাদের লড়াই-এর ক্ষমতা গােটা দুনিয়ায় স্বীকৃত। ১৯৬৫ সালে তার কিছুটা পরিচয় পেয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু গুপ্তচর এবং নাশকদলের সন্ধান তাদের একক দায়িত্ব নয়। এ সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র দপ্তরেরও সজাগ থাকা দরকার। ১৯৬৫ সালে হানাদার অনুসন্ধানের চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন জম্মু এবং কাশ্মীর সরকার। তাদের অজান্তেই পাক-হানাদাররা ঘাঁটি গেড়েছিল শ্রীনগরের কাছাকাছি অঞ্চলে। আকাশপথে পাকচক্রীদের ভারতীয় বিমান ছিনতাই সাম্প্রতিককালের ঘটনা। মাত্র ক’সপ্তাহ আগে পরপর দু’দিন জম্মু এবং কাশ্মীরের উপর দিয়ে চককর দিয়ে গেল পাক-গােয়েন্দা বিমান। এগুলােকে মাটিতে ফেলতে পারল না বিমানধ্বংসী কামান কিম্বা ভারতীয় জঙ্গী বিমান। এসব ঘটনা প্রতিরক্ষার নিখুঁত ব্যবস্থার লক্ষণ নয়। কাশ্মীর নিয়ে লড়াই হয়েছে দু’বার। সবাই এ সীমান্ত সম্পর্কে সজাগ। ত্রুটি সংশােধনে বিলম্ব না হবারই কথা। আক্রমণ করলে কিম্বা হানাদার পাঠালে অবশ্যই চরম জবাব পাবে পাকিস্তান। কিন্তু পূর্ব সীমান্তে শরণার্থীদের নিয়ে সবাই ব্যস্ত। কাশ্মীরের চেয়েও এ সীমান্তের বিপদ এখন বেশী। পাক-গুপ্তচর এবং নাশকদলের উচ্ছেদ অত্যাবশ্যক। এর জন্য সরকারের সঙ্গে জনগণের সহযােগিতা অপরিহার্য। সবার উপরে ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন। এখানে থাকতে পারে না কোন দৌর্বল্য। যারা দেবে পাক-দুশমনের আশ্রয় তারা। দেশদ্রোহী। কঠিন শাস্তি তাদের প্রাপ্য। পূর্ব সীমান্তের নিরাপত্তা ব্যবস্থাং প্রতিরক্ষার অগ্রাধিকার তারিকায় স্থান দেওয়া কর্তব্য।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১