You dont have javascript enabled! Please enable it!

জার্মানির পথে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল | ১৯৭২

১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে পূর্ব জার্মান সরকার (বর্তমানে এ নামে কোনাে দেশ নেই । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি ভেঙে দুটি দেশ হয়। একটি পূর্ব জার্মানি, অপরটি পশ্চিম জার্মানি। ১৯৯০ সালে আবার তারা একীভূত হয়। বর্তমান নাম জার্মানি) মুক্তিযুদ্ধে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের উন্নত চিকিৎসা সুবিধা প্রদানের জন্য সহায়তার হাত বাড়ায়। বাংলাদেশ সরকার ২৪ জনকে ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি পূর্ব জার্মানিতে পাঠায়। ওই দলে আমিও ছিলাম। পূর্ব জার্মান সরকার চাটার্ড বিমান পাঠিয়ে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের বার্লিনে নিয়ে যায়। এই দলে মেজর হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন শরীফুল হক ডালিম (বীর উত্তম) ও শমসের মবিন চৌধুরীও ছিলেন। হারুন আমার সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু তখনাে তিনি মেজর র্যাংক পাননি। তাঁর আগেই আমি মেজর র্যাংক পাই। আমাদের কারােরই কোনাে পাসপোের্ট ছিল না। মুক্তিযােদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা তৌফিক (তৌফিক-ই-ইলাহি চৌধুরী) সিলযুক্ত মিনিস্টারিয়াল প্যাডে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের নাম, ঠিকানা, পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিক বলে প্রত্যয়ন করে দেন।

আমি দলনেতা ছিলাম। কিন্তু সবাইকে আমি চিনতাম না। বিমানে ওঠার পর পূর্ব জার্মান দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারি আমাকে জানালেন, ২৪ জন যাওয়ার কথা। কিন্তু তােমরা এখানে ২৫ জনের ওপরে। হাসপাতালে ২৪ জনের জন্য সিট বরাদ্দ করা হয়েছে। আমি শমসের মবিন চৌধুরীকে (তাকে আমরা সেরু’ বলে ডাকতাম) বললাম, তুমি গুনে দেখাে তাে। শমসের গুনে এসে আমাকে জানাল, বিমানে আমরা মােট ২৬ জন আছি। এটা শুনে আমি বিব্রত হলাম। আমার কাছে তালিকা আছে ২৪ জনের। পূর্ব জার্মানদের কাছেও আছে ২৪ জনের। ভাবলাম, ২৬ জন হয় কী করে!

খোঁজাখুঁজির পর অতিরিক্ত দুজনকে খুঁজে পাওয়া গেল । একজনের নাম গােলাম মােস্তফা। সে যখন বিমানে ওঠে তখন তাঁকে আমি লক্ষ করেছিলাম। সে খুব কষ্ট করে বিমানে উঠেছে। তার কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা ছিল। তাঁর ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিজে সুপারিশ করেছেন। তাঁকে নিয়ে ২৫ জন হওয়ার কথা। কিন্তু ২৬ জন হবে কেন? পরে জানতে পারলাম, অতিরিক্ত লােকটিকে মােস্তফাই নিয়ে এসেছে। তাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে এসেছেন। কিন্তু আপনার সঙ্গে যে ছেলেটি সে কীভাবে এখানে এল? তার তাে কোনাে অনুমতিপত্র নেই।’ মােস্তফা বলল, ‘আমাকে সাহায্য করার জন্য তাকে সঙ্গে নিয়েছি। সে আমার ভাগনে। আমি বললাম, এটা তাে ঠিক না। সরকারের কাছ থেকে একটা অনুমােদন নেওয়া উচিত ছিল। শেষ পর্যন্ত মােস্তফার ভাগনেও আমাদের সঙ্গে গেল ।

পূর্ব জার্মানি পৌছার কয়েক দিন পর একদিন একজন জার্মান চিকিৎসক আমাকে জানালেন, একজন রােগীকে তােমার মিলিটারি ট্রিটমেন্ট করতে হবে। আমি বললাম, কেন, কী হয়েছে? ডাক্তার বললেন, কোমরে আঘাতপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধার (গােলাম মােস্তফা) আঘাতটা ততটা গুরুতর নয়, যতটা তিনি বলছেন। তিনি অতি নাটকীয়তার ভান করেছেন। চিকিৎসক এ কথা বলার পর আমি মােস্তফার কাছে গিয়ে বললাম, আপনাকে অবশ্যই আগামীকাল থেকে নিজে নিজে হাঁটতে হবে। নার্স আপনার হাত কাঁধে নিয়ে হাঁটাতে পারবে না। তারপর দেখা গেল তিনি একাকী হাঁটতে শুরু করেছেন। মােটামুটি ভালােভাবেই হাঁটতে পারেন। কয়েক দিন পর মােস্তফা আমাকে অনুরােধ করলেন, তার ওই ভাগনেকে বার্লিনের কোনাে আর্ট কলেজে আমি ভর্তি করার ব্যবস্থা করে দিতে পারি কি না। আরও নানা ধরনের তদবিরও করেছিলেন। আমি তার কোনাে সুপারিশই আমলে নিইনি এবং জার্মানদেরও বলিনি। পরে তাঁকে তাঁর ভাগনেসহ বাংলাদেশে ফেরত পাঠানাে হয়। বলা যায়, জোর করেই ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যখন তাঁকে ফেরত পাঠানাের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়, তখন তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন । পুলিশ তাকে খুঁজে বের করে। এ ঘটনা ছিল আমাদের জন্য পীড়াদায়ক। পূর্ব জার্মানিতে দুই মাসের চিকিৎসায় আমরা বেশির ভাগ যখন পুরােপুরি সুস্থ ও কর্মক্ষম হই, তখন আমাদের ফেরত পাঠানাে হয়।

Reference: ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন – আমীন আহম্মেদ চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!