You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ১লা জুন, শুক্রবার, ১৭ই জৈষ্ঠ্য, ১৩৮১

আন্তর্জাতিক শিশু সংহতি

আজ আন্তর্জাতিক শিশু সংহতি দিবস। প্রতি বছর ১লা জুন এই দিবসটি উদযাপিত হয়। বিশ্বের ভবিষ্যত নাগরিক শিশুদের সুখী, সুন্দর ও শান্তিপূর্ণ জীবনের প্রতিশ্রুতি ও আন্তর্জাতিক শিশু সংহতির শপথ নিয়ে আসে দিনটি। সারা বিশ্বের শিশুদের সার্বিক কল্যাণ ও সমৃদ্ধি সাধনের উদ্দ্যেশে বিশ্ববিবেককে জাগ্রত করার ডাক আসে এই দিনে। পৃথিবীর সকল শিশুর জন্য নিরাপত্তাময় ও সম্ভাবনাময় একটি জগৎ গড়ে তোলার মহতী বাসনায় ভাস্বর বলেই ১লা জুনের এই উদযাপন বিশ্ববিবেককের কাছে বিশেষ তাৎপর্যময়।
প্রতিবছরের মতো এবছরও সারা বিশ্বের শিশুদের সাথে একাত্মতা ঘোষনা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে এই দিনটি যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে পালিত হচ্ছে এ উপলক্ষে ঢাকার বিভিন্ন সামাজিক ও শিশু প্রতিষ্ঠানঃ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে আলোচনা সভা চিত্র প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক শিশু দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের দুটি শিশু সংগঠন এর পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার ৩০শে মে এক যুক্ত বিবৃতি প্রদান করা হয়। এই বিবৃতিতে বাংলাদেশের আড়াই কোটি শিশুকে অশিক্ষা-কুশিক্ষা কুসংস্কার ও অপুষ্টিজনিত রোগ থেকে মুক্ত করার কাজে এগিয়ে আসার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানানো হয় এবং গ্রামের শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ দানের আহ্বান জানানো হয়। এতে আরও বলা হয় বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দেশীয় পর্যায়ে সকল শিশুর জন্য একটা সুন্দর স্বাস্থ্যোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করার প্রয়াস পাওয়া।
আন্তর্জাতিক শিশু সংহতি দিবসের প্রসঙ্গে কবিতার একটি পঙক্তি স্মরণে আসছে কবি বলেছেন-‘জন্মের পর মানব জাতির থাকে না কো কোন গ্লানি।’ যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিক মনীষী মানুষকে বলেছেন অমৃতের সন্তান। তারই সন্তান শিশু আর এই শিশু হলো ভবিষ্যতের শিশুর পিতা। অতএব বিশ্বমানবতা বিশ্বকল্যাণ বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা প্রসঙ্গে শিশু সংহতির প্রশ্নই অগ্রণী। কারণ ভবিষ্যতের পৃথিবীটা তো ওদেরই।
অমৃতের সন্তানরূপে যে মানব শিশু পৃথিবীতে আসে সে তো নিষ্পাপ এই পৃথিবীর স্বার্থহীন আলী কোলাহল সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে কোথায় শক্তির মধ্যে মানুষ বেপরোয়া ধ্বংসলীলায় কোথায় সাম্রাজ্যবাদী চক্র শাসনের নামে শোষণ অত্যাচার চালাচ্ছে কোথায় বিজ্ঞানের আশীর্বাদে মানুষ চাঁদে ভ্রমণ করছে তা দিয়ে অবোধ শিশুদের কোন কাজ নেই তারা চায় একটু নিরাপত্তা তারা চায় বাঁচবার ন্যূনতম অধিকার খাদ্য বস্ত্র আশ্রয়ের শিক্ষা।
জন্মসূত্রে যে মানবিক বোধ নিয়ে শিশু এ পৃথিবীতে আসে তার কোন জাতিগত বা ধর্মগত ভেদাভেদ নেই। তাই আমরা যখন দেখি কাল আফ্রিকার শিশুরা এখনো পায় না বাঁচার অধিকার তখন বিশ্ববিবেক ব্যথিত না হয়ে পারে না। মোজাম্বিকে অ্যাঙ্গোলায় গিনি-বিসাউ কেপভার্দের উপনিবেশিক শাসন এবং সেখানকার জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামে কাল শিশুরা আজ বিপন্ন। মানবতাকে তখন কালো সন্তানের পদতলে কাঁদতে দেখি এ থেকে পরিত্রাণ ডাক দিতেই আসে আন্তর্জাতিক শিশু দিবস।
শুধু কি তাই? বিশ্বের যেখানে আজ যুদ্ধের দামামা বাজছে সেখানেই শিশুদের জীবন বিপর্যয় এর মাঝে কাল কাটাচ্ছে যখন দেখি দুধের শিশু মাথায় হেলমেট দিয়ে সতর্ক-সাবধান দৃষ্টি ফেলে ভিয়েতনামের মাটির গুহা থেকে উঁকি মেরে আকাশটা দেখে যখন দেখি বোমায় আহত শিশুকে বুকে নিয়ে কম্বোডিয়ার দুর্ভাগিনী মাতা আর্তনাদ করে ক্রন্দন করে, যখন দেখি ম্যালটের নিরাপরাধ শিক্ষার্থীরা অসহায়ভাবে মর্মান্তিক মৃত্যুবরন করে তখন জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে বিশ্বের সনাতন বিবেক আর্তনাদ করে ওঠে বিশ্বমানবতার দুয়ারে বিশ্ববিবেক ধর্ণা দেয়। সকল শিশুর নিরাপত্তা ও সুস্থ ও সুখী দীর্ঘ জীবনের শুভকামনা সচেতন মানুষ সোচ্চার হবে।
এছাড়াও এ বিশ্বে আছে লক্ষ কোটি বিকলাঙ্গ শিশু। আজকের আন্তর্জাতিক শিশু দিবসে তাদের ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। ওরাও এই পৃথিবীর সন্তান। আলো-হাওয়ায় সুস্থ শিশুদের মতই সমান অধিকার আছে। ওদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ বিশেষ ধরনের শিক্ষা ও কারিগরি বিদ্যার ব্যাপক সুযোগ দিতে হবে।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর দিকে চাইলে দেখা যায় কি অপূর্ব যত্নে তাদের লালন করা হচ্ছে। সেই নজীর সামনে রেখেই আজ বিশ্ব শিশু সংহতি দিবসের আদর্শকে উচ্চ তুলে ধরা হোক। বাংলাদেশ সহ সকল উন্নয়নকামী দেশের নিষ্পাপ শিশুরা যেন খাদ্য-বস্ত্র-আশ্রয় ও শিক্ষার পূর্ণ আশ্বায় পায়। ভবিষ্যতের পৃথিবী কে যেন তারা আরও সুন্দর পরিবেশে ভোগ করতে পারে।

ভাগের মা গঙ্গা পায় না

গত বৃহস্পতিবার সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে ৩৪টি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট এবং একটি লন্ডনগামী আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায়। ফলে বাংলাদেশ বিমানকে আন্তরিক আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক পথে প্রায় ১৯ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হয় এবং ৭৮৩ জন যাত্রী দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ছয়টায় চট্টগ্রামগামী প্রথম ফ্লাইট উড্ডয়নের কিছুক্ষণ আগে এই বিমানের ফ্লাইট পার্সার এবং গ্রাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এর মধ্যে বিতর্ক ও বচসা হয়।
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকজন ঘটনায় হস্তক্ষেপ করেন এবং উভয় দল থেকে কিছু সংখ্যক লোককে সাময়িকভাবে আটক করেন। এদিকে সকালের ঘটনা ও পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারা দিন ব্যাপী বিমান বন্দরে বেশ উত্তেজনা বিরাজ করে। ফলে বিমান চলাচল বিমানবন্দরের অন্যান্য কাজ বিঘ্নিত হয়।
৩৪টি আভ্যন্তরীণ ফ্লাইট ও একটি লন্ডনগামী আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বাতিল হয়ে যাবার নেপথ্য কারণ যদি ‘সামান্য ঘটনা’ হয় তাহলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক বৈকি। কিন্তু এক্ষেত্রে বলতে হয় যে ‘সামান্য ঘটনা’র পেছনে আরও অনেক ঘটনায় যে রয়েছে এটা আর আজকের দিনে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না কেননা বাংলাদেশ বিমানের আভ্যন্তরীণ কেচ্ছা কাহিনী প্রায় দিনই বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। এ থেকে যে জিনিসটি সহজেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো প্রশাসনিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিমানের অবস্থা শূন্যের কোঠায়। সেখানে চরম নৈরাজ্য বিরাজ করছে ওপরতলার সঙ্গে নিচুতলার সংঘর্ষ থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন পর্যায়ে সংঘর্ষ, গরমিল হইচই লেগেই আছে। সম্প্রতি বিমান ভাড়া বৃদ্ধি এবং পরবর্তী সময়ে ভাড়া হ্রাস করার মত তুঘলকীকান্ড-কারখানা থেকেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। কথায় বলে ঠেলাঠুলির ঘর খোদায় রক্ষা কর। ঠিক এই বক্তব্যটি আরো সুন্দর ও পরিমার্জিত ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়- ভাগের মা নাকি গঙ্গা পায় না। বাংলাদেশ বিমানের অভ্যন্তরে ভাগের মা গঙ্গায় যাতে না পায় সেরকম কাজ-কারবারই চলছে। যদি তাই না হবে তাহলে কিভাবে সংবাদ বের হয় যে, জাতীয় বিমান পরিবহণ সংস্থা বাংলাদেশ গত তিন বছরেও বিমানের ইঞ্জিন ও খুচরা যন্ত্রাংশ ‘ওভার হোলিং’-এর জন্য কোন এজেন্সির সাথে চুক্তি করেনি।
বিমানের এই নিয়ম-শৃঙ্খলা বিহীন কার্যকলাপের ফলে বহু দিন ধরে পোকার গুলোর ইঞ্জিন বা খুচরা যন্ত্রাংশ নিয়মিত ‘ওভার হল’ করা সম্ভব হয়নি- যার পরিণতি হিসেবে ফকার বহরের ৮টির মধ্যে পাঁচটি বিমানই বিকল হয়ে রয়েছে। এছাড়া ‘ওভার হোলিং’-এর জন্য ছুটোছুটি করতে গিয়ে একটি ফকার ইঞ্জিনই হারিয়ে গেছে। ইঞ্জিনটির দাম ১৫ লাখ টাকা।
এটা সত্য কথা যে, একবারে শূন্যের কোঠায় থেকেই বাংলাদেশ বিমানকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছে। প্রতি পদে নানান প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু নিষ্ঠা ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সাধনা থাকলে অনেক কিছুই করা সম্ভব। তাছাড়া বিমান পরিবহন সংস্থা সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিয়ম ও শৃঙ্খলা। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলা ছাড়া স্বদেশে ও বিদেশে সুনাম অর্জন করা সম্ভব নয়। বিমানের পরিবহনের প্রধান সম্পদ হলো সুনাম (গুড উইল)। একবার যদি সুনাম এর পেছনে কালো ছাপ পড়ে তাহলে সহজে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। গত বৃহস্পতিবার এর ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের নামের পেছনে যে কালো দাগ পড়লো তা কর্তৃপক্ষ মুছবেন কি করে? এ কথা ভুলে গেলে চলবে কেন যে ঢাকা বিমানবন্দর এখন প্রথম শ্রেণীর আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তালিকায় স্থান পেয়েছে। এই বিমানবন্দরের বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের বিমান প্রতিদিনই চলাচল করছে সুতরাং বিমানবন্দরে যদি সামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে অসামান্য কাণ্ডকারখানা সূত্রপাত হয় তাহলে মান মর্যাদা থাকে কোথায়?
পরিশেষে আমরা এ কথাই বলবো যে, বাংলাদেশ বিমানের প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যেসব দুর্বলতাও ঘাপলা রয়েছে সেদিকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের দৃষ্টি দেয়া উচিত। অন্যথায় একদিন হয়তো শোনা যাবে যে, বাংলাদেশ বিমান নামক জাতীয় পরিবহন সংস্থাটির অকাল মৃত্যু হয়েছে। কাজেই জাতীয় স্বার্থের কথা বিবেচনা করে সামান্য বা অসামান্য ঘটনাগুলোকে কবর দিয়ে এবং ভাগের মা গঙ্গা না আবার মানসিকতা ও প্রবণতাকে পরিহার করে বাংলাদেশ বিমানকে এগিয়ে আসা উচিত বলেই আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!