বাংলাদেশে লবণ দুর্ভিক্ষের আগে পর্দার অন্তরালে আরও একটা ঘটনা সংঘটিত হয়। মহল বিশেষের মতে এই ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং পুনর্গঠিত সামরিক বাহিনীর মধ্যে কিছুটা অবিশ্বাসের সৃষ্টি হয়। আলােচ্য মহলের ধারণায় এক্ষেত্রে খন্দকার মােশতাক আহম্মদ এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের ভূমিকা কিছুটা অর্থবহ ও রহস্যজনক বৈকি! এ সময় দুর্বল পুলিশ, বিডিআর এবং জোড়াতালি দেয়া প্রশাসনের ব্যর্থতার দরুন দেশে কালােবাজারী ও চোরাকারবারী চরম আকার ধারণ করে। সংবাদপত্র এবং বুদ্ধিজীবী মহলের একাংশ এজন্য প্রশাসনকে দায়ী না করে সমস্ত দোষ সযত্নে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উপর চাপিয়ে দেয়। এমন কি বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলাে পর্যন্ত একই অভিযােগ উত্থাপন করে জনপ্রিয়তা অর্জনের চেষ্টা করে। অথচ ক্ষমতাসীন সরকার এবং প্রশাসন এজন্য দায়ী—এই কথাটা পরিস্কারভাবে বলার কেউ সাহস দেখাল না। অন্যদিকে পাকিস্তানি আমলের অফিসার দিয়ে তৈরি। পুলিশ বাহিনীর নৈতিক বল দারুণভাবে হ্রাস পাওয়ায় অনেকগুলাে থানায় সশস্ত্র পুলিশদের রক্ষার জন্য রক্ষী বাহিনীর পাহারা বসলাে।
সে এক অদ্ভুত ব্যাপার! থানার মধ্যে পুলিশবাহিনীর সশস্ত্র অবস্থায় থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প বসলাে। তবুও ব্যুরােক্রেসির কথা হচ্ছে, এই দুর্বল পুলিশ বাহিনী দিয়েই কাজ চালাতে হবে। এরকম এক অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই পরিস্থিতির কোনাে উন্নতি হলাে না। তখন এই প্রতিক্রিয়াশীল প্রশাসনের সুপারিশে বঙ্গবন্ধুর ‘যৌথ সামরিক অপারেশনের নির্দেশ দিলেন। কালােবাজারী ও চোরাচালান বন্ধের জন্য সীমান্ত এলাকায় সেনাবাহিনী মােতায়েন হলাে। বাংলাদেশের নবগঠিত সামরিক বাহিনী দেশ শাসনের ‘এন্ট্রি’ পেলাে। খন্দকার মােশতাকের ইশারায় তথ্য মন্ত্রণালয়ের স্টেট মন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর প্রচার মাধ্যমগুলােকে নতুন নির্দেশ দিলেন। সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপ ফলাও করে প্রচার শুরু হলাে। এমনকি বেতারে সামরিক বাহিনীর মনােরঞ্জনের উদ্দেশ্যে নিয়মিতভাবে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা হলাে।
এদিকে আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী উপদল তখন খুবই তৎপর। সামরিক বাহিনীর হাতে ব্যাপক ধর-পাড় শুরু হলে জনৈক প্রভাবশালী নেতা (খন্দকার মােশতাক) কুমিল্লার একদল এমপিকে নিয়ে গণভবনে হাজির হলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, অবিলম্বে সামরিক বাহিনীর যৌথ অপারেশন বন্ধ না হলে মফস্বল এলাকায় আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। মিলিটারি অফিসাররা কুমিল্লায় বাড়াবাড়ি করছে। ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে মেজর জেনারেল জিয়া হেলিকপ্টারে কুমিল্লায় যেয়ে তদন্ত করে এলেন।
শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক চাপে ‘যৌথ সামরিক অপারেশন প্রত্যাহারের নির্দেশ জারি হলাে। সৈন্যরা আবার ফিরে চললাে ব্যারাকে। অনেকের মতে এই অপারেশনের অজুহাতে সামান্য দিনের জন্য হলেও এরা দেশের প্রশাসন পরিচালনায় যে আস্বাদ পেলাে তা পরবর্তীকালে অর্থবহ প্রমাণিত হয়েছে। সবার অলক্ষ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহল এবং ব্যুরােক্রেসির পাশাপাশি এটাই হচ্ছে তৃতীয় শক্তির অভ্যুদয়ের সূচনাকাল। এরা সবাই এদেশেরই সন্তান এবং এদের একাংশ হচ্ছেন স্বাধীনতা সংগ্রামী মুক্তিযোেদ্ধা। এদিকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টির লক্ষ্যে কট্টর মুসলিম লীগ সমর্থক কলামিস্ট খন্দকার আবদুল হামিদ দৈনিক ইত্তেফাক-এর কলামে ইনিয়ে-বিনিয়ে একথাটাই লিখলেন যে, দায়িত্ব সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই ‘যৌথ সামরিক অপারেশন প্রত্যাহার হচ্ছে মুজিব সরকারের ভ্রমাত্মক পদক্ষেপ।
#সংগ্রামের_নোটবুক #ক্ষমতার_স্বাদ #বঙ্গবন্ধু_হত্যাকাণ্ড
সূত্র – “মুজিবের রক্ত লাল” – এম আর আখতার মুকুল