You dont have javascript enabled! Please enable it! পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ও জামাতের ভূমিকা - সংগ্রামের নোটবুক

পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ও জামাতের ভূমিকা

১৯৫৪ সালের ৯ মে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ সময়ে আবদুর রব নিশতার, খাজা নাজিমুদ্দিন, ফজলুর রহমান প্রমুখ ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিকরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে একটা অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করান। তাঁরা এর কঠোর সমালােচনা আরম্ভ করেন। অবশ্য উক্ত চুক্তি যে পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র ও আত্মমর্যাদার পরিপন্থী ছিলাে, সেজন্য তাঁরা এর বিরােধিতা করেছিলেন কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ এসব রাজনীতিকের পূর্বাপর ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যেকোন লােকের পক্ষে এরূপ ধারণা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে, তাঁরা মার্কিন-বিরােধী ছিলেন না। তাঁরা ক্ষমতায় থাকাকালেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন প্রভাব পুরােপুরি বিদ্যমান ছিলাে। বস্তুত তাঁরা ক্ষমতাসীনদের বিরােধিতার জন্যই সামরিক চুক্তির কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। এ সময় জামাতে ইসলামী ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিকদের সাথে সুর মিলিয়ে সামরিক চুক্তির বিরােধিতা করে। সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর ১০ জুন জামাতে ইসলামীর ‘মজলিসে শূরা’ এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাস করে। তাতে বলা হয়, “৯ মে, ১৯৫৪ তারিখে করাচীতে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে যে সামরিক সাহায্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সে সম্পর্কে ‘মজলিসে শুরা যদি তার সত্যিকার মত প্রকাশ না করে তবে তাতে কেবল তার প্রতি দেশের কর্তব্য পালনে অবহেলার অভিযােগই আসবে না, সত্য কথা লুকানাের অপরাধে খােদার নিকটও জবাবদিহি করতে হবে। এই দায়িত্বানুভূতির প্রেক্ষিতে ‘মজলিসে শুরা’ উক্ত চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছে এবং বিশ্বস্ততার সাথে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, এই চুক্তি শুধু পাকিস্তানের আজাদির পক্ষেই ক্ষতিকর নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য ও তাহজিব-তমদ্দনের প্রতিও তাতে কুপ্রভাব পড়ার সম্ভাবনা লুক্কায়িত রয়েছে।” . উপরােক্ত ঘােষণায় জামাতে ইসলামী স্পষ্ট ভাষায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির। বিরােধিতা করেছে। সে সময় তাদের ছাড়া আরাে কোন কোন রাজনৈতিক দল এ চুক্তির বিরােধিতা করেছিলাে। তবে তারা সবাই বিষয়টি একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে বিরােধিতা করেনি। জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরােধীদের বিচার-বিবেচনার ধারায় একটা বিরাট পার্থক্য ছিলাে। অন্যরা তাদের রাজনৈতিক দলের নীতি-আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে বিরােধিতা করেছে। তাদের দলের এ নীতি অবস্থার প্রেক্ষিতে যেকোন সময় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা ছিলাে। তাতে কারাে কিছু বলার ছিলাে । অপরদিকে জামাতে ইসলামী (তাদের মতে) নিছক ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির বিচার-বিবেচনা করে এর বিরােধিতা করেছিলাে। স্বভাবতই আমরা আশা করেছিলাম, জামাতে ইসলামীর সামরিক চুক্তি-বিরােধী নীতি যেকোন অবস্থায় অপরিবর্তনীয় থাকবে। কারণ মওলানা মওদুদী একাধিকবার ঘােষণা করেছেন কোরআন ও সুন্নাহই হচ্ছে জামাতে ইসলামীর আদর্শ। আর যেকোন অবস্থায় কোরআন ও সুন্নাহর নীতি-আদর্শ অপরিবর্তনীয়।

কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরই দেখা গেলাে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী (?) জামাতে ইসলামীর সামরিক চুক্তি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত পাল্টে গেছে। তারা এখন সামরিক চুক্তির বিরােধিতা করতে নারাজ। এই সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার এক বছর পর ১৯৫৫ সালের ২২ নভেম্বর করাচীর। জাহাঙ্গীর পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মওলানা মওদুদী পাক-মার্কিন । সামরিক চুক্তির সমর্থনদান প্রসঙ্গে বলেন, “…একথা এখন আলােচনার বিষয় নয় যে, এরূপ হওয়া উচিত ছিলাে কিনা। এখন দেখতে হবে, এই চুক্তির ফলে আমাদের ও মধ্যপ্রাচ্যের উপর এর কী ফলােদয় হয়। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলাে কি মুসলমানদের আশাআকাংক্ষা পিষ্ট করা ও মুসলিম দেশগুলাের প্রতিনিধিত্বহীন সরকারগুলাের সাথে ষড়যন্ত্রই করে যেতে থাকে, না মুসলিম সাধারণের জাতীয় ও ধর্মীয় আশা-আকাংক্ষা নিষ্পিষ্ট করা হতে বিরত থেকে তাদের আন্তরিক সহায়তা লাভের চেষ্টা করে।” * মওলানা মওদুদী উপরােক্ত ভাষণে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রতি সমর্থন। জানিয়েছেন। অথচ ১৯৫৪ সালে চুক্তিটি সম্পদিত হওয়ার পর জামাতে ইসলামী কঠোর ভাষায় এর সমালােচনা করেছিলাে। ইসলামের ছদ্মাবরণে সুবিধাবাদিতামূলক রাজনীতি আর কাকে বলে ! জামাতে ইসলামী জনসাধারণ্যে প্রচার করে বেড়ায় তাদের পার্টির সবকিছুই নাকি কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। প্রতিটি বিষয়কে নাকি তারা ইসলামিক  দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে থাকে। যদি তাই হয়, এক বছর পূর্বে তাদের নিকট যে বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিলাে, এক বছর পর মওলানা কি করে হুবহু সে বিষয়টির প্রতি সমর্থন জানালেন ? অনেকের মতে, এ সময় থেকেই জামাতে ইসলামীর প্রতি মার্কিনদের নেক দৃষ্টি পড়া। আরম্ভ হয়। তারা জামাতকে বিরাট অংকের অর্থ সাহায্য দিতে থাকে। ১৯৫৫ সালের জুন। মাসে লাহােরের একটি দৈনিক সংবাদপত্রে এই মর্মে একটি প্রবন্ধও বেরিয়েছিলাে। এর পূর্বে লাহােরের দাঙ্গা তদন্ত কমিশনের সামনে জনৈক খাজা নাজির আহমদও জেরার জবাব ‘দান প্রসঙ্গে জামাত সম্পর্কে একই ধরনের অভিযােগ করেছিলেন। তিনি আদালতে বলেছিলেন, “জামাতে ইসলামী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে, আমার নিকট তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু আমি বিস্তারিত বলবাে না, এতে বিশেষ ‘ অসুবিধার সৃষ্টি হবে।”২

আবার কারাে কারাে মতে অন্য আর একটি বিদেশী শক্তির মাধ্যমে জামাতে ইসলামী  মার্কিনদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতাে। সে সময় পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়, ‘মওলানা মওদুদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেতনধারী এজেন্ট। তাঁর দলের আন্দোলন মার্কিন স্বার্থরক্ষার আন্দোলন। মার্কিনদের ইঙ্গিতে মওলানা মওদুদী মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি নিজের মন ও বিবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অর্থের বিনিময়ে মার্কিন এজেন্ট হিসেবে তিনি মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন।” সে ছিলাে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড। বর্তমানে বাংলাদেশ জামাত পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এ সম্পর্কে ‘জামাতের অর্থের উৎস’ শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে। 

Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল