গণতন্ত্র ও জামাত
মওদুদী জামাত বর্তমানে বেশ বড় গলায় গণতন্ত্রের কথা বলছে। এক কথায় বলতে হয় তারা গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেজেছে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবানমাত্র অন্তত তাদের এ ভূমিকার নিন্দা করবেন না। কিন্তু জামাতে ইসলামী কবে থেকে গণতন্ত্রের ভক্তে পরিণত হলাে, এটাই হলাে ভাববার বিষয়।১৯৫৫ সালের ২৮ এপ্রিল মওলানা মওদুদীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তিলাভের কিছুদিন পরই মওলানা রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করেন। হঠাৎ দেখা গেলাে, তাঁর বিশেষ ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের কারণ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে নিঃসঙ্গ চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতি কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থরক্ষার তাগিদ যাই হােক না কেন,একথা সত্য যে, এ সময় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের চিন্তাধারা থেকে অনেকটা সরে পড়েন। এতদিন যে গণতন্ত্রকে তিনি তাঁর বিশেষ ইসলামের দৃষ্টিতে অবাস্তব, অবৈধ, অভিশপ্ত ইত্যাকার বলেছেন, এ সময় সে গণতন্ত্রকে তিনি বৈধ, ইসলামের সারমর্ম, সমগ্র জাতির অনুসরণীয় বলে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ দিতে আরম্ভ করেন। এ সময় থেকে তিনি গণতন্ত্রের চরম ভক্তে পরিণত হন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এ সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান। তিনি তাঁর বিশেষ প্রকাশভঙ্গিতে গণতন্ত্রের মাহাত্ম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। সেবার ১৮ জুন পাকিস্তানের সারগােদার এক জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “…তিনটি জিনিস এমন যার জন্য প্রতিটি দলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করা দরকার। প্রথমত আইনের শাসন। এর মৌলিক নীতি হলাে আইনের চোখে সবাই সমান হওয়া, সবার জন্য একই রূপ আইন হওয়া, আইন ও নীতি প্রতিটি বস্তুর উর্ধে হওয়া, শাসক ও শাসিত, আমির ও গরীব সবাইকে আইনের সামনে শির নত করা, আদালতগুলাে প্রশাসন বিভাগের প্রভাবমুক্ত হওয়া এবং ইনসাফ বাবিচারের বেলায় সার্বজনীন নীতিমালা অনুসরণ করা। দ্বিতীয় বিষয় হলাে,মানুষের লেখা ও বক্তৃতা, সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা। এটাও আইনের শাসনের দাবি এবং গণতন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। তৃতীয় বিষয় হলাে গণতন্ত্র। আর এর বুনিয়াদ হলাে দুটো জিনিসের উপর।
একটি হলাে জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠিত হওয়া এবং তাদের ইচ্ছানুসারে শেষ হওয়া। দ্বিতীয় নীতি হচ্ছে নির্বাচনগুলাে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া। এ দু‘টো নীতি যথাযথ কার্যকরী না হলে গণতন্ত্র একেবারে অর্থহীন। গণতন্ত্র যদি না হয় তবে স্বাধীনতা হলাে শুধু শাসকদের,জনসাধারণের স্বাধীনতা নয়।”১ সারগােদার পর আরাে অনেক জায়গায় বক্তৃতা-বিবৃতিতে মওলানা মওদুদী গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এ ব্যাপারে জামাতে ইসলামীর মজলিসে। শুরা একটি প্রস্তাবও অনুমােদন করে। তাতে বলা হয়েছে, নাগরিক স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন এমন দু‘টো বিষয় যার দ্বারা কোনাে দেশে গণতন্ত্র জীবিত থাকতে পারে। এযাবৎ যারা ইসলাম ও গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে চলেছে ইসলামী ভাবাপন্ন কর্মীরা খােদা চাহে ত তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হবে।” * ১৯৫৫ সালে তরজমানুল কোরআনের আগস্ট সংখ্যায় গণতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা। প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী লিখেছেন, “দ্বিতীয় ভিত্তি, যার উপর একমত হওয়া যায়,তা হলাে। ‘গণতন্ত্র‘। কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্ম এবং দেশের অধিবাসীদের ইচ্ছাও তাই। এর সরল অর্থ এই যে, দেশ কোনাে বিশেষ শ্রেণী বা গােষ্ঠীর নয়। বরং এদেশে যারা বসবাস করছে। তাদের সবার। সুতরাং এর ব্যবস্থাপনা তাদের সবার কিংবা ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী চলতে হবে। এবং তাদের নীতিগতভাবে এই অধিকার ও কার্যত এ সুযােগ থাকতে হবে যে, নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী শাসক নির্বাচন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
“দেশকে বিশৃংখলার ক্ষতিকর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করার একটিমাত্র পথ হলাে, দেশের ভাবী বিধিব্যবস্থা রূপদানে যারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে সর্বপ্রথম তাদের খাঁটি মনে গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করা এবং পরে সৎ উদ্দেশ্যের সাথে এরূপ একটা বিধিব্যবস্থা। তৈরি করা যাতে এই নীতি যথাযথ কার্যকর হয়। “একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও অনেক ক্রটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে এবং যখন কোন দেশের অধিবাসীদের ভিতর অনুভূতির দীনতা থাকে তখন সেখানে ত্রুটি-বিচ্যুতি অধিক হারে বেড়ে যায়।….কিন্তু এসব বাস্তব স্বীকার করে নেয়ার পরও এ বৃহৎ সত্য স্বস্থানে বহাল থেকে যায় যে, একটা জাতির সেসব দুর্বলতা দূর করে তাকে সামগ্রিকভাবে পরিণত জাতি হিসেবে গড়ে তােলার একমাত্র পথ গণতন্ত্র। » “এছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা যা একজনের ভেতর এই অনুভূতি জাগিয়ে তােলে যে, দেশ তার। দেশের ভাল-মন্দ তার নিজের ভাল-মন্দ। ভাল-মন্দ দেখা দেয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তার ফয়সালার যথার্থতা কিংবা ক্রটির দখল রয়েছে। আর এ জিনিসটিই ব্যক্তির মধ্যে জাতীয় প্রেরণা সৃষ্টি করে থাকে।” মওলানা মওদুদী উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে গণতন্ত্রের কল্যাণকর দিকগুলাের যে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ইসলামের সাথে এর সাযুজ্যতার যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর এ গণতন্ত্রপ্রিয়তা বেশিদিনের নয়। ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রের চরম বিরােধী ছিলেন। ১৯৩৩ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মওলানা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরােধিতা করে এসেছেন। ইসলাম ও গণতন্ত্র দু‘টো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরােধী বিষয় বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। এমনকি পাকিস্তান যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সেজন্য স্বাধীনতা সংগ্রামকালে একে ‘অভিশপ্ত’, ‘না-পাকিস্তান’ ইত্যাকার বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলােচনা প্রসঙ্গে তাঁর এ সম্পর্কিত কতকগুলাে উদ্ধৃতি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আরাে দু‘একটা উল্লেখ করা যাক।তিনি বলেছেন, “বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ৩)
তাদের (মুসলমানদের উদ্দেশে আমি পরিষ্কার বলছি, বর্তমান যুগের ধর্মহীন (ধর্মনিরপেক্ষ) জাতীয় গণতন্ত্র তােমাদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তােমরা যদি এর সামনে মাথা নত করাে তবে কোরআনের প্রতি পৃষ্টপ্রদর্শন করবে। তার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করলে নিজের রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এর পতাকা উত্তোলনের জন্য দাঁড়ালে নিজের খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা হবে। যে ইসলামের নামে তােমরা নিজেদের মুসলমান বলছে, এর সারমর্ম (রূহ) সেই অপবিত্র পদ্ধতির সারমর্মের সাথে, এর মৌলিক নীতি তার মৌলিক নীতিমালার সাথে এবং এর প্রতিটি অংশ তার প্রতিটি অংশের সাথে সংগ্রামমুখর। ইসলাম এবং এ পদ্ধতি কোথাও। পরস্পরে সমঝােতা করে না।”৪। ” “একটা জাতির সবাইকে শুধু এজন্য যে তারা বংশগতভাবে মুসলমান, সত্যিকার অর্থে মুসলমান মনে করা এবং এরূপ আশা পােষণ করা, তাদের দ্বারা যে কাজই হবে তা ইসলামী নীতিভিত্তিক হবে, প্রথম ও মৌলিক ভূল। এই বিরাট সম্প্রদায় যাদের মুসলমান বলা হচ্ছে, তাদের প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, ন্যায়অন্যায়ের প্রভেদ করতে জানে না। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক ধ্যান-ধারণা ইসলামানুগ পরিবর্তিত হয়নি। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের হাতে লাগাম দেখে কেউ যদি মনে করে, গাড়ি ইসলামের পথেই চলবে, তবে তার সুধারণাকে বাহবা দিতে হয়।” যেসব জামাত কোনাে শক্তিশালী আদর্শ ও সজিব সামগ্রিক (ইজতেমায়ী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সবসময়ই লঘিষ্ঠ হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে। মুসােলিনীর ফ্যাসী পার্টির সদস্য হলাে মাত্র চার লাখ এবং রােমে মার্চ করার সময় ছিলাে মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়ের উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজি পার্টিরও। একটি মজবুত ও সুসংহত দল শুধু বিশ্বাস ও শৃংখলার জোরে ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সদস্যসংখ্যা দেশের অধিবাসীদের মধ্যে প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন।৬ , “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই।”৭ কুর “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।
তা প্রথমে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে আপনারা পরিষ্কার দেখতে পেয়েছেন, মওলানা ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর গণতন্ত্রের কীরূপ একনিষ্ঠ ভক্ত সেজেছেন। তাঁর বিশেষ প্রকাশভঙ্গিতে গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনগণের অধিকার ইত্যাদির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী সরকারের উথান-পতন হবে। নিরপেক্ষ ও সম্পূর্ণ স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এ দু‘টো বাস্তবায়িত না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অপরদিকে মওলানাই বলেছেন, “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য—এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই। বর্তমান যুগের গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পার্লামেন্ট কিংবা পরিষদের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।” একদিকে বলছেন, কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্মই হল গণতন্ত্র। অপরদিকে বলছেন, গণতন্ত্র ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতন্ত্র মুসলমানদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গণতন্ত্রের সামনে মাথানত করা কোরআনের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনের নামান্তর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করা রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা। ইসলামের সারমর্ম গণতন্ত্রের সারমর্মের সাথে সব সময়ই সংগ্রামমুখর। ইসলাম ও গণতন্ত্র পরস্পর কোথাও সমঝােতা করতে পারে না। * মওলানা একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে বলেছেন, জনসাধারণ অজ্ঞ। তাদের মতামতের মূল্য দিলে বিপথগামিতার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরাে বলেছেন, আদর্শবান দলের অনুসারীরা সংখ্যায় কমই হয়ে । থাকে। তাদের সংখ্যা প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন, তারাই শাসনক্ষমতা পরিচালনা করে থাকে। এজন্য তিনি মুসােলিনী ও হিটলারের অনুসারীদের দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মওলানা মওদুদীর কোন্ উক্তিকে সঠিক বলে ধরে নেয়া যাবে। অথচ গণতন্ত্রের সপক্ষ-বিপক্ষ উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ইসলামের দোহাই পেড়েছেন। ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এর চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে! বস্তুত যখন যেমন তখন তেমনই হচ্ছে ধর্মের মুখােশ পরা মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল।
জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল। মওলানা মওদুদী গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে ইসলামের নামে স্ববিরােধী উক্তি করলেও ইসলামে কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার মূল্যমানগুলাে কখনাে উপেক্ষিত হয়নি। বিবেক ও নিজ নিজ জীবন পদ্ধতি অনুসরণের স্বাধীনতা সকল সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মত ইসলামেও মৌল উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলাের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনষ্ট হওয়ার পর গণতন্ত্রের ধারণা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলাে। দীর্ঘকাল পর সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের মাধ্যমে মানব সমাজে আবার গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশ শুরু হয়। গণতন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে মহানবীর (সঃ) উদ্দেশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “(হে মুহম্মদ ! সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়) কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।” মহানবীর আমলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবীর ইচ্ছা ছিলাে মদীনা শহরে থেকেই কাফেরদের প্রতিরােধ করা। কিন্তু যুবক মুসলিম সৈনিকদের প্রস্তাব ছিলাে মদীনার বাইরে গিয়ে মােকাবেলা করা। মহানবী (সঃ) সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি মদীনার বাইরে গিয়ে কাফেরদের মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মহানবীর জীবনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলাে, তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তাঁর কোন প্রতিনিধি মনােনয়ন করে যাননি। যােগাযােগবিহীন সেকালের বিশেষ সামাজিক পরিবেশের উপযােগী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খােলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয়েছে। মদীনার বিশিষ্ট নাগরিকরা চার খলিফাকে নির্বাচন করেন।
মহানবীর খলিফারা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের খেলাফতকালের দু‘একটি ঘটনা থেকে তা সহজে অনুমান করা যায়। মুসলমানদের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর প্রথম ভাষণদান প্রসঙ্গে বলেন, “আমি আপনাদের মতই একজন মানুষ। আপনাদের কারো থেকে আমি শ্রেষ্ঠ নই। সুতরাং আমার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। যতক্ষণ আমি সত্য ও ন্যায় পথে আছি, ততক্ষণ আপনারা আমাকে মানবেন। যদি আমি সত্য পথ থেকে সরে যাই আমাকে সৎপথে টেনে আনবেন।” হযরত আবু বকরের এই উক্তি মহানবীর দুটো হাদীসেরই সারকথা। তিনি বলেছেন, “পাপ কাজে আনুগত্যের দায়িত্ব নেই। শুধুমাত্র সৎকাজের বেলায়ই আনুগত্য।” মহানবীর অপর হাদীসটি হচ্ছে, “অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ।”.. » মহানবীর এই হাদীস দুটো সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত স্পষ্ট। এগুলােতে মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে তিনি মানবজাতিকে ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার এক অনুপম পথনির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে এক্ষেত্রে মওলানা মওদুদীর অভিমত হচ্ছে, অন্যায় কাজেও আমীরের অনুগত থাকতে হবে।” চিন্তা করুন, দলে নিজের একনায়কত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মওদুদী সাহেব ইসলামের নামে কিরূপ অনৈসলামিক কথা বলেছেন। * দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) ইসলামের ইতিহাসে একজন কঠোর স্বভাবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ছিলাে তা বর্তমান আধুনিক সমাজে কল্পনাও করা যায় না। হযরত ওমরের একজন অমুসলিম ক্রীতদাস ছিলাে। অন্যান্য সাহাবারা খলিফার ক্রীতদাসকে মুসলমান হওয়ার জন্য চাপ দেন। সে ধর্মান্তরিত হতে অসম্মতি প্রকাশ করে। তারা এ ব্যাপারে খলিফার নিকট অভিযােগ করেন। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “এরূপ করার তার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।”
একদিন হযরত ওমর অন্যদের চেয়ে লম্বা একটি জামা পরে মসজিদে যান। এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, “হে খলিফা ! বায়তুল মাল থেকে আপনি যে পরিমাণ জামার কাপড় পেয়েছেন আমরাও তাই পেয়েছি। আপনার জামা এতাে লম্বা করলেন কি করে ? বাড়তি কাপড় আপনি কোথায় পেলেন?” খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) একজন সাধারণ নাগরিকের এই প্রশ্নের জবাব দান প্রসঙ্গে বললেন, “আমাকে ইমামতি করতে হয় তাই আমার ছেলে ও আমার নিজের কাপড় একত্র করে এই জামাটি তৈরি করেছি। বর্তমান আধুনিক সমাজে কোন রাষ্ট্রনায়ককে তার পােশাক-আশাক সম্পর্কে একজন সাধারণ নাগরিকের এ ধরনের প্রশ্ন আর তার এরূপ জবাব আশা করা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার এর। চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আরুকি হতে পারে ? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়।” | বস্তৃত খােলাফায়ে রাশেদীনের কথা ও কাজে আমরা আল্লাহ তায়ালার উপরােক্ত বাণীর বাস্তবরূপ দেখতে পাই। হযরত ওমর (রাঃ) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতেন, “পরামর্শ ছাড়া খেলাফত হতে পারে না।” হযরত ওমরের সময় বর্তমান সৌদী আরব, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর এক কথায় গােটা মধ্যপ্রাচ্য খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। এসব এলাকা বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিলাে। এই বিশাল রাষ্ট্র তিনি মদীনা থেকে পরিচালনা করতেন। সেকালে মদীনার মসজিদে নববী ও মসজিদ প্রাঙ্গণ ছিলাে জাতীয় সংসদ। রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় খলিফাকে সাহায্য করার জন্য মজলিশে শূরা বা উপদেষ্টা পরিষদ ছিলাে। মুহাজির ও আনসারদের জ্ঞানী ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন। মজলিশে শূরার অধিবেশন মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হত। যেকোন লােক তাতে যােগদান করতে পারতেন। খেলাফতের প্রতিটি কাজ এই মজলিশের পরামর্শ অনুযায়ী করা হতাে। খেলাফতের প্রাত্যহিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রতিদিন মসজিদে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে। মজলিশে শূরার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সদস্য এই বৈঠকে নিয়মিত যােগদান করতেন। তাদেরকে বর্তমান যুগের মন্ত্রিসভার সাথে তুলনা করা যায়। আলােচ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলে খলিফা আরব ভূমির নেতৃস্থানীয় লােকদের মদীনায় আহবান করতেন। এটা ছিলাে আধুনিক রাজনৈতিক সম্মেলনের মত। প্রয়ােজন হলে খলিফা জনসাধারণের রায়ও গ্রহণ করতেন। প্রাদেশিক আমিরদের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করতেন। আধুনিক ভাষায় এটা গণভােট বলা যেতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, খেলাফত ছিলাে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য।
খােলাফায়ে রাশেদীন ৩০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁদের আমলে গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা পুরােপুরি অনুসরণ করা হতাে। এরপর অবশ্য মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্রের স্থান দখল করে একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্র। মহানবী (সঃ) নিজেই বলে গেছেন, “আমার পর খেলাফত বা প্রজাতন্ত্র থাকবে ৩০ বছর। এরপর রাজতন্ত্র কায়েম। হবে।” মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালনার সুদীর্ঘ ইতিহাসে মহানবীর এই বাণীরই বাস্তব রূপ আমরা দেখতে পাই। পরবর্তী মুসলিম শাসকরা নামেমাত্র খলিফা ছিলেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ তাঁরা মােটেও অনুসরণ করতেন না। কোরআন-হাদীস ও খােলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্রের বাস্তবরূপ এতাে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও মওলানা মওদুদী হায়দরাবাদের নিজাম ও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করার দিনগুলােতে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন~~ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হচ্ছে অভিশপ্ত। আবার পাকিস্তান আমলে একই ব্যক্তি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ইসলামের সারমর্ম। সত্যি মওলানা মওদুদী পবিত্র ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ কারিগর ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশেও জামাতীরা তাদের এই দক্ষগুরুর ধ্যান-ধারণাই অনুসরণ করে চলেছে। ইসলামের মুখােশ পরে, ইসলামের নামে যখন যেমন তখন তেমন কথাবার্তা বলছে।
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল