যে জীবন তাঁর নয়
এই ছবিটা খুব সাদামাটা একটি ছবি মনে হতে পারে। কিন্তু এর মাঝে লুকিয়ে আছে দুই জন মানুষের ভালোবাসার গল্প। প্রথম জন হলেন তিনি যার মুখে হাল্কা দাঁড়ি। জীবন যখন হুমকির মুখে তখন তো দাঁড়ি কামানোর সময় হয়নি। ভেতরে আগুণের খনি আর হৃদয়ের পুরোটা জুড়ে বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশ এতোটা সুন্দর যেখানে ভোরে শিশিরভেজা ঘাসে দাঁড়িয়ে সূর্য দেখা যায়, দুপুরে গরম গরম ভাত খেতে মায়ের ডাক শোনা যায়, ভরা বর্ষায় বিলে শাপলা তোলা যায় ইচ্ছে মত। যেখানে রাতের বেলা দক্ষিণা বাতাসে চোখে ঘুম চলে আসে।
এবার ভাবুন, যে হাতের আঙ্গুল দিয়ে এই ফেইসবুক স্ট্যাটাসটি পড়ছেন সেই হাতখানা আপনার জীবনের জন্য কতোটা গুরুত্বপূর্ণ। খাওয়া, জামা গায়ে দেয়া, লেখাপড়া আর ছোট বড় হাজারো কাজ কত সহজে করতে পারছেন হাত থাকায়। কিন্তু ছবির লোকটা তাঁর হাত হারিয়েছেন। কারণ সে যুদ্ধে গিয়েছিলো। সেখানে যেতে কেউ তাঁকে বাধ্য করেনি। কেউ তাঁকে লোভ দেখায়নি। এমনকি কেউ তাঁকে এক মুঠ খেতে দেবার নিশ্চয়তা দেয়নি। তবু সে যুদ্ধ করেছিলো। যুদ্ধে হাতখানা হারায় সে। পাকিস্তানী আর্মিকে আমেরিকা-চীনের দেয়া অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য সে পেয়েছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার পুরনো এক থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। আর্মিরা যেখানে মাসের পর মাস ট্রেনিং নেয় সেখানে সে খুব কম সময়ের ট্রেনিং নিয়েই যুদ্ধে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিলো। ভয়াবহ গেরিলা যুদ্ধে শত্রুর লাশ ফেলেছিলো একটার পর একটা। সে বিজয়ের আনন্দে তাঁর রক্ত টগবগ করছিলো। শুধু ভাবছিলো এভাবে আর কিছুক্ষণ – আরেকটু এগোলেই মুক্ত হবে দেশ, ফিরে যাবো মায়ের কাছে। জীবন দিতে সে প্রস্তুত ছিলো। কিন্তু কে জানতো মরে যাওয়ার চেয়ে অঙ্গহানি আরও বেশী কষ্টের।
এই ত্যাগের কোন অর্থমূল্য হয়না। আমরা হয়ত পদক বা সার্টিফিকেট দিতে পারতাম। কিন্তু সেসবের আশায় সে যুদ্ধ করেনি। সে শুধু চেয়েছিলো স্বাধীন বাংলা।
দ্বিতীয় মানুষটাকে নিয়ে বিশেষণের শেষ নেই। তবে আলোচ্য বিষয় যখন ছবি সেটাই একটু যত্ন করে দেখা যাক। দীর্ঘদেহী বঙ্গবন্ধু আহত এই মুক্তিযোদ্ধার গালে আলতো করে আদর করে দিচ্ছেন। তাঁর গায়ে একটা চাদর। হাসতে হাসতে কুঁজো হয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। হাত হারিয়েও ছেলেটা হাসছে। মুহূর্তেই সে ভুলে গেছে সব কষ্ট। তাঁর প্রিয় মানুষটা তাঁরই সামনে – তাঁর খোঁজ নিতে চলে এসেছেন। বঙ্গবন্ধুকে বাঙালি যেভাবে ভালবেসেছে তেমনটা পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। সহস্র ধারার বাঙ্গালীকে এতোটা উজ্জীবিত করার ক্ষমতা আর কারো কোনোদিন হয়নি। মানুষকে আপন করে নেয়ার অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন তিনি। পায়ে হেঁটে দেশের আনাচে কানাচে সাধারণ মানুষের খোঁজ তিনি নিয়েছেন।
স্বাধীনতার পর তাঁর প্রতিটি বক্তব্যে তিনি কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমি ভিক্ষুকের নেতা হতে চাইনা – আমি চাই বাঙ্গালী মাথা উঁচু করে বিশ্বের দরবারে ঠাই করে নেবে। উৎসাহ পেলে বাঙ্গালী অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। যা আজও প্রমাণিত। বঙ্গবন্ধু তা জানতেন বহু আগে থেকে। তাঁর ডাকে মানুষ গুণে গুণে জীবন দিয়েছে। বাতাসে তখন লাশ-পচা গন্ধ, নদীতে ভাসমান বেওয়ারিশ লাশ, ৩০ লক্ষের রক্ত ভিজিয়ে রেখেছিলো বাংলার প্রতি বর্গমাইল। সম্ভ্রম হারানো মায়েরা, বোনেরা গুমরে কেঁদেছে। লজ্জায় কেউ আত্মাহুতি দিয়েছে। কেউ হারিয়ে গেছে দিগন্তের মুখে। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি।
আজ হয়তো সব শুকিয়ে গেছে, মাটিতে উঠেছে উঁচু দালান, হাটে বাজারে কোলাহল, ধর্মিয় আগ্রাসন, বিপথগামী তরুণ আর মুক্তিযুদ্ধে হেরে যাওয়াদের দীর্ঘ পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আজ হাটের পণ্য। কিন্তু একটি কথা ভুললে চলবে না – বাঙ্গালী একা একা এক শক্তিহীন প্রাণী – আর যখন তারা একত্র হয় তখন পৃথিবীর যেকোন জাতির চাইতে শক্তিশালী। আর সেই শক্তি ফিরে পেতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিকল্প নেই। বিশ্ব রাজনীতি থেকে শুরু করে অর্থনীতি বা ঘরোয়া দৈন্যতা – সবই পাল্টে যাবে যেদিন আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করব। যে স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছেন, আর যে স্বপ্ন নিয়ে বাঙ্গালী অবলীলায় জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন – তা একই বিন্দুতে সমর্পিত।
তাই আসুন, আমরা এই ছবিটা শুধু তাকিয়ে দেখা নয়, বরং অনুভব করি ছবির মানুষগুলোর ভেতরটা, সেই প্রেরণা আবার ফিরিয়ে আনি আমাদের ঝিমিয়ে পড়া রক্তে। কাজ করি দেশের জন্য। যার যা আছে।
জয় বাংলা; জয় বঙ্গবন্ধু।