৭ নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব : সত্য ও কল্পনা
৭ নভেম্বরের ঘটনাকে আমি বিপ্লব বলতে নারাজ। বিপ্লবের প্রথম শর্তই হলাে ব্যাপক নাগরিক অংশগ্রহণ। ৭ নভেম্বরের ঘটনায় বিপ্লবের পরিবর্তে বাংলাদেশ দীর্ঘকালের জন্য এক সামরিক আমলাতন্ত্রের শিকার হয় এবং দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায় স্থায়ীভাবে ন্যস্ত হয় সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের হাতে। ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহী বিপ্লব’ এর স্মরণে প্রতি বছরই দেশে ও বিদেশে যত অনুষ্ঠান হয়, তার প্রায় প্রতিটির পেছনে থাকে দেশের প্রধান বিরােধী দল বিএনপি। উদযাপনের ঘটা থেকে মনে হতে পারে সিপাহী বিপ্লব নামক ঘটনাটির পেছনে আসল শক্তি ছিল এই রাজনৈতিক দল, যদিও তখন পর্যন্ত সে কাগজেকলমে আত্মপ্রকাশ করেনি। রাজনৈতিক বক্তব্যের ডামাডােলে একথাও চাপা পড়ে যায় যে ৭ নভেম্বরের ঘটনাক্রমে একমাত্র লাভ যার হয়েছিল তিনি জেনারেল জিয়াউর রহমান, যার হাত দিয়েই পরে বিএনপি প্রতিষ্ঠা। আর এই তথাকথিত সিপাহী বিপ্লবের মন্ত্রদাতা, তার প্রাণপুরুষ কর্নেল তাহের খুন হয়েছিলেন সেই জিয়ার হাতেই। আমার মাথায় ঢােকে না, ঠিক কি কারণে বিএনপি ৭ নভেম্বরকে ঘটা করে উদযাপনে এত সময় ও অর্থ ব্যয় করে। বক্তৃতা করে কি রক্তাক্ত খুনের সে ঘটনা চাপা দেওয়া সম্ভব?
৭ নভেম্বরের ঘটনাকে যারা বিপ্লব বলেন, তারা সম্ভবত বিপ্লব কথাটার অর্থ সম্যক উপলব্ধি করেন না। যদি অভিধান অনুসরণ করে তার অর্থ খুঁজি, তাে ওবেস্টার অনুসারে বিপ্লবের দুই অর্থ- সহিংস উপায়ে এক সরকার উৎখাত করে অন্য সরকার গঠন, ও এমন এক পরিস্থিতির সূচনা যার ফলে দেশের মানুষের জীবন ও কর্মক্ষেত্রে আকস্মিক কিন্তু চূড়ান্ত পরিবর্তন। বস্তুত, উনিশ ও বিশ শতকের যেকয়টি সফল বিপ্লবের কথা আমরা জানি, তাতে এই দুই উপাদনই বর্তমান। অন্যকথায়, বিপ্লবের ফলে এক পুরানাে ধাঁচের সরকারের পতন হয়ে সম্পূর্ণ নতুন এক সরকারের পত্তন, এবং এর ফলে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়, তার প্রভাবে সে দেশের মানুষের সামাজিক, রাজনৈতিক, এমনকি সাংস্কৃতি জীবনে আমূল পরিবর্তন প্রতিষ্ঠা। রাতারাতি হয়ত পরিবর্তন অর্জিত হয় না, কিন্তু যে বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়, সমাজের আগাপাশতলা বদলে ফেলার এক নিরন্তর সংগ্রামের সূচনা হয় তারই হাতে। তর্কে না গিয়ে শুধু উদাহরণ হিসেবে বিবেচনার জন্য আমরা ১৯১৭ সালের রুশ বিপ্লব ও ১৯৪৯ সালের চীনা বিপ্লবের কথা মাথায় রাখতে পারি। বলা বাহুল্য, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের ফলে এই দুই উদ্দেশ্যের কোনােটাই অর্জিত হয়নি। বরং উল্টো, এর ফলে বাংলাদেশ দীর্ঘকালের জন্য এক সামরিক আমলাতন্ত্রের শিকার হয় এবং দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায় স্থায়ীভাবে সমাজের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল অংশের হাতে ন্যস্ত হয়। মার্ক্সবাদীরা, যারা ৭ নভেম্বরের ‘বিপ্লবের পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিলেন, তারা সম্ভবত এই শ্রেণিকে কপ্রাদোর বুর্জোয়া নামে অভিহিত করবেন।
এই পর্তুগিজ শব্দটির অর্থ বনিক শ্রেণি, যারা একজনের কাছ থেকে কম দামে জিনিস কিনে বেশি দামে অন্যের কাছে বেচে তা থেকে মুনাফা বানায়। বাংলায় কেউ কেউ কপ্রাদোরকে মধ্যসত্ত্বভােগী শ্রেণি বলেও অভিহিত করে থাকেন। মােটের ওপর, ৭ নভেম্বরের ঘটনার ফলে ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা নিজেদের অবস্থান সুসংহত করেন, তাদের চরিত্রটি মাথায় রাখলেই কারা এই কপ্রাদোর, তা বােঝা কঠিন হবে না। ৭ নভেম্বরের ঘটনাকে আমি বিপ্লব বলতে নারাজ। বিপ্লবের প্রথম শর্তই হলাে ব্যাপক নাগরিক অংশগ্রহণ। একটি বিপ্লবী দল ও বৈপ্লবিক তত্ত্বের ভিত্তিতে, ব্যাপক নাগরিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সফল যে গণঅভ্যুত্থান, কেবল তাকেই বিপ্লব নামে অভিহিত করা যায়। এই বৈপ্লবিক বৈশিষ্ট্যের কারণে অনেকে রুশ বিপ্লবকে ‘বিপ্লব’ না বলে তাকে পেত্রোগাদ-ভিত্তিক একটি সফল সামরিক অভ্যুত্থান (বা “পুচ’) হিসেবে প্রমাণে আগ্রহী। একথা ঠিক, পেত্রোগাদে সেনা সদস্যদের অভ্যত্থানের মাধ্যমে অস্থায়ী রুশ সরকারের পতন ও জার দ্বিতীয় নিকোলাসের সপরিবারে নৃশংস হত্যার মাধ্যমে বলশেভিক দল ক্ষমতা দখল করে ও রুশ বিপ্লবের সূচনা হয়। কিন্তু বলশেভিক পার্টির হাতে এই বিপ্লবের ভিত্তি অনেক আগে থেকেই রচিত হয়েছিল- শুধু নগরে নয়, সারা দেশে। পেত্রোগাদ পতনের প্রায় একই সময় আগুনের মতাে সে বিপ্লব সারা রাশিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ৭ নভেম্বরে বাংলাদেশে তেমন কিছুই ঘটেনি। বস্তুত, এই বিপ্লবের পেছনে যারা ছিলেন, অর্থাৎ কর্নেল তাহের ও তৎকালীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, দেশব্যাপী গণবিদ্রোহের বদলে শুধুমাত্র ঢাকা ও অন্যান্য প্রধান শহরে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন।
ডাচ সাংবাদিক পিটার কাস্টার্স, যিনি ১৯৭৫-এ ঢাকায় কর্নেল তাহেরের নিকটবর্তী একজন ছিলেন, তাঁর ব্যাখ্যায়, বিপ্লব নয়, তাহের ও তাঁর সতীর্থরা সশস্ত্র বিদ্রোহের রণকৌশল (কাস্টার্সের ভাষায়, ইলারেকশনারি মিলিটারি স্ট্রাটেজি’) অনুসরণের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পরিকল্পনা করেন। গণবিপ্লবের লক্ষ্যে জাসদ একটি ‘গণবাহিনী গঠন করেছিল বটে, কিন্তু সেটি বরাবরই ছিল একটি গুপ্ত সংগঠন, ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে তার ভূমিকা বড়জোর পরােক্ষ। অনেক বেশি প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা, সেনা সদস্যদের নিয়ে গঠিত এই বিপ্লবী পরিষদ’ ছিল তাহের জন্য ক্ষমতা দখলের চাবিকাঠি। কাস্টার্স লিখেছেন, তাহের বিভিন্ন গােপন বৈঠকে, যে বৈঠকে কাস্টার্স উপস্থিত ছিলেন, দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী কোনাে আন্দোলন বা সংঘর্ষের বিপক্ষে মত রাখেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, শুধু সেনা সদস্যদের সমর্থনেই ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যারা ক্ষমতা দখল করেছিল, তাদের উৎখাত ও ক্ষমতা দখল করা সম্ভব। তাহের বক্তব্যের ব্যাখায় কাস্টার্স লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ও রক্তক্ষয়ী কোনাে বিপ্লবের আদৌ প্রয়ােজন ছিল না, কারণ (সিপাহী বিদ্রোহের মাধ্যমে) রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পথ সংক্ষিপ্ত করা সম্ভব ছিল। এই ব্যাখ্যা থেকে স্পষ্ট, ৭ নভেম্বরের যারা পরিকল্পনাকারী তাদের লক্ষ্য।
কোনাে বিপ্লব ছিল না, ছিল ক্ষমতা দখল । সিপাহী বিদ্রোহ ছিল ক্ষমতা দখলের ‘শর্ট কাট’। বস্তুত, ১৫ আগস্ট যে খুনে কর্নেল ও মেজররা ক্ষমতা দখল করেন, তারাও নিজেদের ক্ষমতা দখলকে বিপ্লব নামে অভিহিত করেছিল, গুণগত অর্থে তার সাথে ৭ নভেম্বরের ক্ষমতা দখল পরিকল্পনার কোনাে মৌলিক প্রভেদ ছিল। একথা আমরা জানি, কর্নেল তাহেরকে নিঃস্বার্থ বিপ্লবী হিসেবে দেখার একটি প্রবণতা আমাদের দেশে রয়েছে। কেউ কেউ তাঁর ভূমিকা চে গুয়েভারার। সাথে তুলনা করতেও দ্বিধা করেন না। নাগরিক কল্পনায় এই চিত্রটি এখন এত পােক্ত যে আমরা তাহেরকে নিয়ে কল্পকাহিনী লেখার উদাহরণও দেখেছি। এই ‘রােমান্টিক’ সাহিত্য-চর্চাকে আমি এক কথায় বাতিল করতে চাই না। তাহের বস্তুতই একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা, দেশপ্রেমিক, মাওবাদী চেতনায় উজ্জীবিত একজন শহুরে (‘আরবান’) বিপ্লবী। কিন্তু একথাও ভােলা উচিত নয়, নিজের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে তিনি যে রণকৌশল অনুসরণ করেন তা ছিল। যড়যন্ত্রমূলক ও সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। সাম্প্রতিক সময়ে উন্মােচিত বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে আমরা জানি, খালেদ মােশারফের ব্যর্থ সামরিক অত্যুত্থানের পর তাহের জাসদের নীতিমালার বিরুদ্ধে গিয়ে দেশব্যাপী সামরিক শাসনজারির পক্ষে মত। রাখেন। আমরা এখন এও জানি, তাহের ও তাঁর বন্ধুরা ১৫ আগস্টের সামরিক অ্যুত্থানকারীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। সে অভ্যুত্থানে তিনি অংশ নেন নি, কারণ তাঁর বিবেচনায় এটি ছিল সাম্রাজ্যবাদ-অনুপ্রাণিত । কিন্তু সে অভ্যুত্থানের কোনাে বাহ্যিক প্রতিবাদ তিনি করেননি।
মহিউদ্দিন আহমদ তাঁর গ্রন্থ ‘জাসদের উত্থান পতন: অস্থির সময়ের রাজনীতি’ তে যে তথ্য দিয়েছেন তা যদি সত্য হয়, তাহলে আমরা অনায়াসে বলতে পারি তাহের ও জাসদের অনুসারীরা বঙ্গবন্ধু হত্যায় খুশিই হয়েছিলেন। ১৫ আগস্টের ভােরে, যখন মেজর (অবঃ) ডালিম বঙ্গবন্ধু হত্যার ঘােষণার জন্য ঢাকার রেডিও অফিসে যান, সেখানে তাহের ছিলেন। পিটার কাস্টার্স-ও ১৫ আগস্ট ঢাকা রেডিও অফিসে তাহেরকে খন্দকার মােস্তাকের সাথে বচসায় লিপ্ত হতে দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। ৭ নভেম্বরের যে দুঃখজনক ইতিহাস, তার শুরু অভ্যুত্থান চেষ্টার মধ্যে সীমিত হলেও, এর শেষটি ছিল গভীর বেদনার ও বিশ্বাসঘাতকতার। তাহের ভেবেছিলেন, জেনারেল জিয়ার মাধ্যমে তিনি ক্ষমতা দখল করবেন এবং তাঁর বৈপ্লবিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবেন। ভাগ্যের পরিহাস, সেই জিয়ার হাতেই তিনি নিহত হন। ঘাতক গুলিটি জিয়া নিজ হাতে নিক্ষেপ করেননি বটে, কিন্তু এই খুনের যে ইতিহাস আমরা এখন জানি তা থেকে স্পষ্ট, এই জেনারেলের হাত এখনাে এক-পা হারানাে সেই ক্রাচের কর্নেলের রক্তে রঞ্জিত।
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬