You dont have javascript enabled! Please enable it!

কেন্দ্রীয় সরকারে বা পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত সিভিল সার্ভিস অফিসারগণ এবং তাদের ভূমিকা

মুজিবনগর বা প্রবাসী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হওয়ার পর এবার স্থানীয় অর্থাৎ পূর্বপাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষ ও খােদ কেন্দ্রীয় সরকারের টনক নড়ল। আগে বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাস থেকে দু-একজন করে বাঙালি কর্মকর্তার প্রকাশ্য ঘােষণা মারফত পাকিস্তান সরকারপক্ষ ত্যাগের কারণে কিছুটা বিচলিত তারা হয়েছিল বটে। কিন্তু তারা সবচেয়ে বেশি চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়েছিল এপ্রিল-মে নাগাদ মাঠপ্রশাসনের বেশ কিছু বাঙালি সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তার মুজিবনগর সরকারে যােগদানের খবরে এবং পরেও সেই ধারা অব্যাহত থাকলে। কেননা এতে করে একদিকে যেমন সেসব কর্মকর্তার পদ শূন্য হয়, অন্যদিকে তেমনি শূন্য পদে উপযুক্ত ও বশংবদ বাঙালি কর্মকর্তা নিয়ােগ-পদায়নে সঙ্কট দেখা দেয়। যদিও তখনও প্রচুর সংখ্যক বাঙালি কর্মকর্তা ঢাকা সচিবালয়ে এবং মাঠপ্রশাসনে কর্মরত ছিলেন; তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় ছাড়া অধিকাংশকেই তারা নানা কারণে আস্থায় নিতে পারছিল না। পূর্বপাকিস্তান বংশােদ্ভূত কর্মকর্তারা দৃশ্যত তাদের নিয়মিত দাপ্তরিক কার্যাদি সম্পন্ন করে গেলেও কেন্দ্রীয় (এখানে পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হেডকোয়ার্টার্স) ও স্থানীয় (জেলা-মহকুমার) সামরিক কর্তৃপক্ষের প্রতিনিয়ত চাপিয়ে দেওয়া আদেশ-নির্দেশ পালনে এদের অনেকের মধ্যেই শৈথিল্য ছিল, আবার অনেকের বিরুদ্ধে অভিযােগ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের গােপনে সাহায্য-সহযােগিতা করার। ফলে এদেরকে তারা আস্থায় নেয়নি।

প্রসঙ্গত পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ডের মূল নীতি-আদর্শ বাস্তবায়নকারী ও নির্বিচার বাঙালি নিধনের নীলনক্সা প্রণয়নকারীদের অন্যতম মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খানের বক্তব্য প্রণিধানযােগ্য। পরবর্তীকালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ

How Pakistan Got Divided-এ ফরমান আলি লিখেছেন: পূর্বপাকিস্তান বিশৃঙ্খল অবস্থায় ছিল। অসামরিক প্রশাসক, পুলিশ ও রেডিও/টিভির জন্য রিইনফোর্সমেন্ট হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে লােকজন আনা হয়েছিল। এখানকার পরিবেশে তাদের সকলেই নতুন ছিল। তদুপরি তাদেরকে এখানে নিয়ে আসার মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানী সরকারি কর্মচারিদের ওপর পরিষ্কার অনাস্থার  প্রকাশ ঘটেছিল, এদিকে সে সময় এ ছাড়া কোনাে বিকল্প ছিল না। সে ছিল এক ভয়ানক ও নৈরাজ্যজনক পরিস্থিতি।”১

এঅবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােতে পরিবর্তন আনতে কেন্দ্রীয় সরকার জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিল, যার মধ্যে মুখ্য ছিল পূর্বপাকিস্তান বংশোদ্ভুত অর্থাৎ বাঙালি কর্মকর্তাদের বৈদেশিক মিশনে পারতপক্ষে নিয়ােগ-পদায়ন বন্ধ এবং একই সঙ্গে তাদের বিদেশ ভ্রমণেও অঘােষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল।

এপ্রসঙ্গে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের সংস্থাপন বিভাগে এবং পরে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে উপসচিব পদে কর্মরত১৯৫৭ সাল-ব্যাচের বাঙালি সিএসপি (বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন সংস্থাপন সচিব) মােঃ শামসুল হক চিশতী (Md. Shamsul Haque Chisty/Chishty)-র মন্তব্য উদ্ধারযােগ্য।

জনাব চিশতী লিখেছেন: “পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বাঙালি কর্মকর্তাদের ক্রমান্বয়ে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের খবর প্রশাসনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। ফরেন সার্ভিসের বাঙালি কর্মকর্তাদের বিদেশে পােস্টিং বন্ধ রাখা হলাে। মন্ত্রণালয়ের মধ্যম ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ সরকারি কাজে বিদেশে যেতেন। তাদের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ করে দেয়া হলাে। এ সম্পর্কে লিখিত নির্দেশ বেরােলেও এটা সরকারের অঘােষিত নীতিতে পরিণত হলাে।”

তবে বলা দরকার যে, সেই অবস্থায়ও বাঙালি কর্মকর্তাদের বিদেশ গমন একেবারে বন্ধ ছিল না। আগেই জানিয়েছি, তখনও বেশ কিছু বাঙালি সিএসপি উচ্চশিক্ষার জন্য একক ও ক্ষেত্ৰত সপরিবারে আমেরিকায় বা ইংল্যান্ডে গিয়েছেন এবং গােটা মুক্তিযুদ্ধপর্ব সেখানে অতিবাহিত করেছেন।

পূর্বপাকিস্তান সচিবালয়ে এবং মাঠপ্রশাসনে বিশেষত বিভাগীয় এবং ঢাকা-।চট্টগ্রামের মতাে বড়াে জেলাগুলােতে নিজেদের আস্থাভাজন ও নির্ভরযোগ্য কর্মকর্তার পদায়ন নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকার মূলত দু’ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল। প্রথমত পূর্বপাকিস্তানােত কর্মকর্তাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তানে তথা কেন্দ্রীয় সরকারে বদলি, এবং দ্বিতীয়ত একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কর্মকর্তা এনে সমপদে পদায়ন। তদনুযায়ী আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে সরকার তড়িঘড়ি করে কিছু বদলিও করেছিল। উল্লেখ্য, এসময়কার সরকারি গেজেটভুক্ত (মূলত ঢাকা গেজেট) প্রজ্ঞাপন বা আদেশগুলাে দেখলে এর প্রমাণ পাওয়া যাবে। যেমন,পূর্বপাকিস্তান সরকারের একসময়কার দাপুটে Chief Secretary বা মুখ্যসচিব (টিক্কা খান এবং তার পরে নিয়াজিরাও ফরমানের কর্তৃত্ব শুরু হলে তিনি অবশ্য ঠুঁটো জগন্নাথে পরিণত হয়েছিলেন) ১৯৪৯ সাল-ব্যাচের সিএসপি এস.এম. শফিউল আজমের কথা বলা যায়। তাকে ইসলামাবাদে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সচিব পদে বদলি করা হয়েছিল; কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে পরে তিনি সে পদে যােগদান করেছিলেন।

এক্ষেত্রে সরকারের একটা লক্ষ্য ছিল- এঅঞ্চলে (পূর্ব পাকিস্তানে) আগে যারা  কাজ করে গিয়েছে তেমন কর্মকর্তাদের ‘প্রেষণে’ আনা (পাঠানাে), আর নিদেনপক্ষে তা না হলে পূর্বপাকিস্তান সম্পর্কে ‘আনকোরা কিন্তু অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠদের পদায়ন। তা সত্ত্বেও একটা বড়ো সমস্যা কর্তৃপক্ষকে কিছুটা হলেও ভুগিয়েছিল আর তা হলাে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে কর্মকর্তা-আনয়নে। মুক্তিযুদ্ধ ততদিনে বেশ জটিল ও তীব্র আকার ধারণ করেছিল। দিন যত যাচ্ছিল ততই নতুন নতুন ভূখণ্ড তাদের হাতছাড়া হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে যাচ্ছিল। পুলিশ থানা, সেনা চৌকি, আর্মি টহলযান, সিভিল প্রশাসক, তাদের স্থানীয় বিহারি- বাঙালি তল্পিবাহক এবং সর্বোপরি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যান্য সরকারি স্থাপনায় ‘মুক্তি’দের (তাদের ভাষায়) অতর্কিত ও চোরাগােপ্তা আক্রমণ বেড়েছিল। ইতােমধ্যে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তান বংশােদ্ভূত সিএসপি ও বাঙালি কর্মকর্তা নিহত ও আহত হয়েছিল। সঙ্গত কারণে এসব হামলা ও মৃত্যুর খবরে পশ্চিম পাকিস্তানি সিএসপি কর্মকর্তারা এদেশে আসতে অনেকটাই গররাজি ছিল।

যাই হােক, কেন্দ্রীয় সরকারের এজাতীয় বদলির আদেশ অনেকে বাতিল করতে সক্ষম হলেও সবাই হয়নি। একপর্যায়ে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সিএসপি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্বপাকিস্তানে বদলি হয়ে এসেছিল এবং তাদের শূন্যস্থান পূরণে পূর্বপাকিস্তান থেকেও বাঙালি কর্মকর্তারা সেখানে গিয়েছিলেন। সেই অবস্থায় না গিয়েও অবশ্য উপায় ছিল না। সরকারি চাকুরির চিরাচরিত নিয়মে কর্তৃপক্ষের বৈধ ও লিখিত আদেশ অমান্যের অভিযােগে শাস্তি হিশেবে বরখাস্ত করার পাশাপাশি জেলে প্রেরণ, এমনকি হত্যার শিকার হওয়ারও ঝুঁকি ছিল। এসম্বন্ধে মফিজুল্লাহ কবীর তার পূর্বোক্ত Experiences of An Exile At Home : Life In Occupied বাংলাদেশ গ্রন্থে যথার্থই লিখেছেন: “Among other measures to tighten the control of West Pakistan over the Bengalis was the wholesale transfer of the Bengalis to West Pakistan and appointment of West Pakistani officials in their places… In such a Situation a Bengali officer would have been shot deed (dead) if he refused to join posts in West Pakistan. Officers from West Pakistan could have easily avoided such transfer.”

তবে ‘ভাগ্যবান’ দু’চারজন বাঙালি সিএসপি তাদের বদলির আদেশ বাতিল বা কৌশলে বিলম্বিত করিয়ে পরে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার্থ, তা আগেই বলেছি। এখন দেখা যাক, সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তাদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধকালে কারা কেন্দ্রীয় সরকারে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি হয়েছিলেন এবং কারা আগে থেকেই সেখানে কর্মরত ছিলেন। তবে আগেই বলে রাখি যে, এসম্বন্ধে বিস্তৃত বলার মতাে তথ্য তেমন লভ্য নয়। ফলে বিভিন্ন সূত্রে কিঞ্চিৎ ধারণা দিয়েই অধ্যায়টি শেষ করব।

যেমন, কাজী ফজলুর রহমান দিনলিপি একাত্তর-এ লিখেছেন: “১৪/ মে শুক্রবার ১৯৭১, ঢাকা/..এখানকার উচ্চপদস্থ বাঙ্গালী অফিসারদের অনেককেই বদলী করা হচ্ছে পশ্চিমে। কে যাচ্ছে অবশ্য এখনও তা সঠিক জানি না। তবে প্রায় সব সেক্রেটারীই যাবে।../ আজ বিকালে গিয়েছিলাম আনিসুজ্জামানের বাসায় । শিগগিরই চলে যাচ্ছে পশ্চিমে। সেখানে সি.এস.পি সিদ্দিকুর রহমান আর কমিশনার আলাদ্দিনের সঙ্গেও দেখা হল।/ শুনলাম আপাততঃ যারা পশ্চিমে যাচ্ছে তারা হল, আনিসুজ্জামান, মজিবুল হক, রাব্বানী, মােহাম্মদ আলী, আজাহার আলী। তবে এই শুরু। সকলকেই প্রায় যেতে হবে।”৬

তবে এখানে উল্লিখিত সবাই অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানে যাননি। যেমন, কাজী আজহার আলি মুক্তিযুদ্ধে আরেক ফ্রন্ট গ্রন্থে লিখেছেন: “অসময়ের বন্ধু। ৯ মে, ১৯৭১/ ৭ তারিখে অফিসে ডাক দেখছিলাম।.. ডাকের মধ্যে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের সরকারের সংস্থাপন বিভাগ থেকে একটা চিঠি পেলাম। এই চিঠিতে আমাকে ঢাকা থেকে লাহােরে বদলির আদেশ দেয়া হয়েছে।../ পাকিস্তান সরকার বাঙালি অফিসারদের বিশ্বাস করে না। এজন্য ৮ জন সিনিয়র অফিসার জরুরি ভিত্তিতে ইসলামাবাদ, লাহাের ও করাচি থেকে ঢাকায় পাঠিয়েছে। তাদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে সচিব পদে নিয়ােগদান করেছে। ইতিমধ্যে স্বরাষ্ট্র সচিব মুজিবুল হক এবং রিলিফ সচিব আনিসুজ্জামানকেও ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করেছে। আনিস করাচিতে এবং মুজিবুল হক ইসলামাবাদে পােস্টিং পেয়েছেন।.. এই কারণে আমাদের তিনজনকে পশ্চিম পাকিস্তানে ও পৃথক জায়গায় পােস্টিং দিয়েছে। আনিসুজ্জামান এবং মুজিবুল হক ঢাকা থেকে চলে গেছেন। আমি দুই ডিপার্টমেন্টের একটির (শ্রম ও সমাজকল্যাণ) দায়িত্ব হস্তান্তর করেছি। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব এখনও ছাড়িনি ।../ জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম বলেন যে সরকার আদেশ দিয়েছে আমাকে লাহাের যাবার জন্য।”৭

উল্লেখ্য, বদলির আদেশপ্রাপ্তির পর সরকারি কাজে কয়েকদিনের জন্য ইসলামাবাদ ঘুরে এলেও শেষমেশ আর আজহার আলিকে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে হয়নি। হার্ভার্ডে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পাকিস্তান সরকারের আদেশ পেয়ে সেপ্টেম্বর নাগাদ তিনি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তাঁর ভাষায়: “১৯৭০ সালে নভেম্বরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড, জন টমাস ঢাকায় ৭ জন সিনিয়র অফিসারের ইটারভিউ নিয়ে আমাকে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার কোর্সে পড়ার জন্য মনােনীত করেন। ১৯৭১ জানুয়ারিতে হার্ভার্ডে আমার ভর্তি সম্পন্ন হয়েছে এবং পাকিস্তান  সরকার ও ঢাকার প্রাদেশিক সরকার আমাকে উচ্চশিক্ষার জন্য এক বছরের ছুটি মঞ্জুর করেছে।../ ১৯৭১ সালে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করছিলাম।”৮

এসময় অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে থেকে পাকিস্তান সরকারের কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে (বিভিন্ন পদে) যেসব বাঙালি সিভিল অফিসার চাকুরিরত ছিলেন, তাদের সম্বন্ধেও এখানে অল্প-বিস্তর ধারণা দিতে চেষ্টা করব। নিচে উভয়টিই এক্ষেত্রে আলােচিত হলাে।

এপ্রসঙ্গে প্রাপ্ত মতে মােঃ শামসুল হক চিশতীর বক্তব্য উদ্ধারযােগ্য। তিনি প্রকৃতই লিখেছেন: “পাকবাহিনীর আক্রমণ এবং মুক্তিকামী জনগণের প্রতিরোধের ফলে প্রদেশের অর্থনীতির সাথে অবকাঠামাে ব্যবস্থারও যথেষ্ট ক্ষতি হয়। অবকাঠামাে ও অর্থনীতির পুনর্বাসনের জন্য পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্য চায়। কেন্দ্রীয় সরকার চারজন কর্মকর্তাকে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে সুপারিশ পেশ করার জন্য প্রেরণ করল। এঁরা বােধ হয় দু সপ্তাহ অবস্থান করে বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ- আলােচনা করে পুনর্বাসনের এক সুপারিশ পেশ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে মহকুমা হাকিম থেকে শুরু করে ডেপুটি কমিশনার পর্যন্ত বেশ কিছু কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে মুজিব নগর সরকারে যােগদান করায় প্রদেশে যােগ্য কর্মকর্তার ঘাটতি পড়ে। এ অভাব আংশিক পূরণের লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অনুরােধে পাকিস্তান সরকার মধ্যম পর্যায়ের চারজন সি.এস.পি. কর্মকর্তাকে পূর্বাঞ্চলে বদলি করেন। এঁরা হলেন- সৈয়দ আলমদার রাজা, হাসান জহির, মনসুর কাজিম ও আসলাম ইকবাল। মনসুর কাজিম সাহেব যশােরে আমার ডেপুটি কমিশনার ছিলেন। আসলাম ইকবাল বাদে বাকি সবাই চাকরি জীবনের শুরু থেকে ডেপুটি কমিশনার হওয়া পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে কাটিয়েছেন। প্রাদেশিক সরকার এই প্রদেশে আগে চাকরি করেছে এমন কর্মকর্তাদের চেয়েছিলেন।”৯

 মাহমুদ এস, হায়দার লিখেছেন: “As guerilla activity began to be noticeable even in the capital city, e.g., the bomb explosions at Hotel Intercontinental and power-houses, the E.P. Police being both inadequate and unwilling to resist these “miscreants” (the Bengalee offcials of both the executive and police being also considered undependable), the Govt. of Pakistan took the following steps :/ (i)

  Bengalee high officials were gradually replaced by West Pakistani, beginning with the I.G.P. (sent on leave), the Home Secretery (posted to Centre), the Divisional Commissioners. the Deputy Inspections-  General, the A.I.G.s and the D.C. and S.P. of Dacca.”১০

আগেই উল্লেখ করেছি, পূর্বপাকিস্তান থেকে এসময় যেসব কর্মকর্তাকে কেন্দ্রে তথা পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করা হয় তাদের মধ্যে অন্যতম এস. এম. শফিউল আজম, এস.পিকে., এস. কিউ. এ., যিনি ১৫/০৫/১৯৬৯ সাল থেকে প্রাদেশিক সরকারের বেসামরিক প্রশাসনের শীর্ষপদাধিকারী বা মুখ্যসচিব (Chief Secretary) হিশেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। এছাড়া অন্য যারা বললি হয়েছিলেন তাদের নাম পাওয়া যায় তখনকার সরকারি গেজেটের বিভিন্ন তারিখের সংখ্যায় । মােঃ শামসুল হক চিশতীর গ্রন্থেও এদের নাম লভ্য। যেমন তিনি উল্লেখ করেছেন (প্রাসঙ্গিক অংশ উৎকলিত); “ভূতপূর্ব সচিব জনাব মুজিবুল হক১১ (সি,এস.পি.) কে ইসলামাবাদে বদলি করা হয়েছে।../ কিছুদিন পরে মুখ্যসচিব জনাব শফিউল আজমকে ইসলামাবাদে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব পদে বদলি করা হল।”১২ অন্যত্র লিখেছেন: “পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অনুরােধে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এ,টি,এম, শামসুল হককে১৩ (সি.এস.পি.) ইসলামাবাদে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে ।/.. ঢাকায় থাকাকালীন একদিন এ.টি.এম. শামসুল হক দেখা করতে এল। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে ঢাকার ডেপুটি কমিশনারের দায়িত্বভার বুঝিয়ে দিয়ে ইসলামাবাদে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের উপ- সচিব পদে যোগ দেবে।../ শামসুল হক পশ্চিম পাকিস্তানে প্রশিক্ষণ বিভাগে উপসচিবের দায়িত্বে ছিলেন।”১৪

অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলা যেতে পারে যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বা অন্যভাবে বললে ১৯৭১ সালের যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে পাকিস্তানে (প্রয়াত) জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেতৃত্বে যখন সরকার গঠিত হয় তখন জেনারেল ইয়াহিয়ার পরাজিত সৈন্যবাহিনীর সমর নেতাদের অনেককে বরখাস্ত বা অকালীন অবসর দেওয়া হয়েছিল। এসময় স্বাভাবিকভাবে সেখানে কর্মরত পূর্বপাকিস্তান বংশােদ্ভূত বাঙালি সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তাদের অধিকাংশকে (কেউ কেউ অবশ্য সেখানকার প্রশাসনে স্বেচ্ছায় থাকতে চাওয়ায়। কেননা তাদের কারাে কারাে স্ত্রী ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি, তারা বাদে) হয় চাকুরিচ্যুত, না হয় কর্মবিরত বা বিভিন্ন অজুহাতে বিশেষ সেলে নজরবন্দি রাখা হয়েছিল। অনেকে নিজেদের মাতৃভূমি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে চাওয়ায় সরকার তাদেরকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে নজরবন্দি রেখেছিল। যাই হােক, এসময় ভুট্টো সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সম্বন্ধে শামসুল হক চিশতী যা লিখেছেন, তাতে বেশ কয়েকজন বাঙালি কর্মকর্তার নাম থাকায় তার বক্তব্যটি উদ্ধার করা হলাে: “(ভুট্টো) ক্ষমতায় এসেই  পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টের অমিলের বেশ কয়েকজন উচ্চপস্থ আর্মি অফিসারকে অপসারণ করলেন। অল্পদিনের মধ্যে তিনজন বাঙালি পূর্ব পাকিস্তানী সচিবকে তাদের পদ থেকে সরিয়ে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ও.এস.ডি, (OSD) করা হলো। এরা হলে জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে(র) সচিব জনাব শফিউল আজম (সি. এস. পি.), পূর্ত ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব এ.কে,এম, আহসান১৫

(সি. এস. পি.) এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব সউদ। যে তিনজন পূর্ব পাকিস্তানি সচিবকে  নিজ পদে বহাল রাখা হলাে, তারা হলেন যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব আলি হাসান (সি.এস.পি.), স্বরাষ্ট্র সচিব জনাব এ. এস. এম. আহমদ (পি.এস.পি.) এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব ইকবাল  হুসাইন। এ.এস.এম. আহমদ জন্মসূত্রে বাঙালি এবং পূর্ব পাকিস্তানী, অপর দুজন বিহারি এবং পাকিস্তানের জন্মের পর পূর্ব পাকিস্তানের বাসিন্দা হিসেবে  নতুন রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পান। সম্ভবত তারা পাকিস্তান সরকারকে বােঝতে পেরেছিলেন যে তারা পাকিস্তানে থেকে যেতে চান।”১৭

এবারে একটু অন্য প্রসঙ্গ।

অবশ্য এটাকে পুরােপুরি এ অধ্যায়বহির্ভূত আলােচনা বলা ঠিক হবে না। বস্তুত  মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বেশ আগে থেকেই যেসব বাঙালি সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তা পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারে১৮ চাকরি করছিলেন, তাদের তখনকার মনােভাব জানতে এসংক্রান্ত দু-চারটি বিবরণ এখন দেখা যেতে পারে।

একথা সত্য যে, সুবিপুল রক্তক্ষরা মুক্তিযুদ্ধের সেই ভয়াবহ দিনগুলােতে স্বদেশে পরবাসী হয়ে নিরস্ত্র বাঙালি জনসাধারণ তখন যে, যেভাবে পারছিলেন হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মােকাবিলার অসম যুদ্ধে নেমে পড়েছিলেন। বিশেষ করে ১৭ই এপ্রিল মেহেরপুরের আম্রকুঞ্জে আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার মাধ্যমে দেশমাতৃকার সার্বিক মুক্তির লড়াই শুরু হলে পাকিস্তান সরকারের প্রতিনিধি হিশেবে যারা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রে পাকিস্তান দূতাবাসে বা মিশনে কাজ করছিলেন, একপর্যায়ে তারাও স্বদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং ভবিষ্যতে নিয়মিত বেতন-ভাতা না-পাওয়ার ঘাের আশঙ্কা সত্ত্বেও বা পুরােপুরি তা বন্ধ হবে জেনেও এক-এক করে তারা পাকিস্তান সরকারপক্ষ ত্যাগ করতে শুরু করেছিলেন। এ তালিকায় প্রথম যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম কে, এম, শেহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক১৯ এবং তাঁদের দেখাদেখি বা অনুপ্রেরণায় বিশ্বব্যাপী অন্য দূতাবাসকর্মীরা।

ফলত তাঁদের সেই দুঃসাহসী ও ঝুঁকিবহুল কীর্তি অব্যবহিত পরবর্তীকালে অন্যদের মধ্যে বিশেষত পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের মনে আনন্দ, সাহস ও অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল বলে জানা যায়। যেমন, শামসুল হক চিশতী জানাচ্ছেন: “অবরুদ্ধ বাঙালিদের বিমর্ষ জীবনে প্রথম একটুখানি আলোর সন্ধান দিলেন দিল্লীস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন দেশপ্রেমিক অসীম সাহসী জুনিয়র কর্মকর্তা। একজন পাকিস্তান পররাষ্ট্র সার্ভিসের শিহাবউদ্দিন, অপরজন প্রেস সচিব আমজাদুল হক। এরা দুজন পাকিস্তান সরকারের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার জানালেন। ভারতের রেডিওতে তাঁদের বিবৃতি শুনে আমাদের মনে যে কি ধরনের অনুভূতি সৃষ্টি  হয়েছিল, তা আজ বােঝাতে পারব না। তখন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সরকারিভাবে গঠিত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান কবে স্বাধীন হবে, তাও অনিশ্চিত।  এ অবস্থায় শিহাবউদ্দিন এবং আমজাদুল হক যে এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা ভাবতে অবাক হয়ে যাই।” ২০

তিনি আরও লিখেছেন: “পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ একের পর এক বাঙালিদের মনে আশার বাণী বয়ে আনতে থাকল। এসবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলো মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণ (১৭ এপ্রিল, ১৯৭১), কলকাতাস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলীর নেতৃত্বে সমস্ত বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের একযােগে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ এবং ওয়াশিংটন দূতাবাসের এনায়েত করিম, এস. এ. এম. এস. কিবরিয়া, এ. এম. এ. মুহিত, আতাউর রহমান চৌধুরীসহ প্রায় আধা ডজন মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তার বাংলাদেশ সরকারে যােগদান। এরপর প্রায়ই বিভিন্ন দূতাবাস থেকে ধীরে ধীরে বাঙালি কর্মকর্তাদের পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগের খবর আসতে লাগল। এসব খবর রেডিও পাকিস্তান এবং পাকিস্তানের পত্রিকায় প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমরা অল ইন্ডিয়া রেডিও এবং বি. বি. সি’র মাধ্যমে এসব খবর পেতাম।”২১

বিভিন্ন দূতাবাস থেকে এভাবে বাঙালি অফিসারদের পাকিস্তান সরকারের পক্ষ ত্যাগ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দৃপ্ত ঘােষণার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশে কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল। বিশেষ করে এতে আন্তর্জাতিক মহলে তাদের ভাবমূর্তির সংকট দেখা দেয়। তবে এর চেয়েও বড় কথা, যেটা জনাব চিশতী উল্লেখ করেন- ‘অবরুদ্ধ বাঙালিদের বিমর্ষ জীবনে প্রথম একটুখানি আলাের সন্ধান দিলেন দিল্লীস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের দুজন দেশপ্রেমিক অসীম সাহসী জুনিয়র কর্মকর্তা।.. এ অবস্থায় শিহাবউদ্দিন এবং আমজাদুল হক যে এক দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা ভাবতে অবাক হয়ে যাই।’- বলাবাহুল্য ‘জুনিয়র কর্মকর্তাদের এহেন দুঃসাহসিক কর্মে তিনি এবং তাঁর মতাে পশ্চিম পাকিস্তানে কর্মরত অন্য বাঙালি কর্মকর্তারা একটুখানি আলাের সন্ধান’ পেলেও এবং অবাক হলেও, এবং সেখানকার সামরিক বাহিনীতে কর্মরত দু-একজন দুঃসাহসী বাঙালি সেনা কর্মকর্তা কর্তৃক  পাকিস্তান সরকারপক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়ার ঘটনা ঘটলেও, এক্ষেত্রে আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষণীয়, আমাদের জানা মতে, শুধু একজন ছাড়া অন্য কোনও বাঙালি সিভিল সার্ভিস অফিসার সেদিন এ কর্মটি করেননি-  ঐতিহাসিক  সত্য এটাই। কেন করেননি- এর উত্তর তারাই ভালাে দিতে পারবেন। বরং দু-এক ক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটেছে।

এটা ঠিক যে, পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের কঠোর নজরদারির ফলে সেখানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তাদের পক্ষে জঙ্গি সরকারের কর্ম থেকে পদত্যাগ বা স্বেচ্ছায় অব্যাহতিলাভ করার মােটেও সুযােগ ছিল না। বিশেষ করে পরিবার- পরিজন নিয়ে যারা সেখানে থাকতেন, তাদের পক্ষে তাে নয়ই। পরন্তু সীমান্ত পেরােনােও তাদের পক্ষে খুব সহজসাধ্য ছিল না। যেটা আমরা জানতে পারি মুক্তিযুদ্ধ -উত্তরকালে ভুট্টো সরকার যখন তাদেরকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি দিয়ে বা বরখাস্ত করে সীমান্তবর্তী এলাকার জেলাগুলােতে কড়া প্রহরায় আটক বা নজরবন্দি রেখেছিল। তা সত্ত্বেও, সেই অবস্থায়ও অনেক কর্মকর্তা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে বহু পথকষ্ট ও শ্রম স্বীকার করে একক ও সপরিবারে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন প্রথমে আফগানিস্তানে ও পরে ভারতে, এবং সেখান থেকে দেশে ফিরেছিলেন।

 তবে এই ‘অজুহাত’ সম্ভবত খাটে না তাদের ক্ষেত্রে যারা সেদিন মুক্তিযুদ্ধচলাকালে দেশে ছুটিতে এসেছিলেন, দেশের অবস্থা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন এবং অতঃপর বহাল তবিয়তে ফিরে গিয়ে নির্বিকারভাবে সেখানকার কর্মে যােগ দিয়েছিলেন।

এক্ষেত্রে স্বয়ং জনাব চিশতীর কথাই বলা যেতে পারে। যেমন, তিনি জানাচ্ছেন: “ইতিমধ্যে আবার সরকারি খরচে নিজ বাসস্থান অর্থাৎ রাজশাহীতে ছুটি কাটানাের সময় এসে গেল। ছুটিও পাওনা আছে। সচিব ওয়াকার আহমদ সাহেব ছুটি মঞ্জুর করলেন।.. ছুটি থেকে ফেরার পর আমার বদলির আদেশ জারি করা হবে।.. তখনকার অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেও ঢাকা ও ইসলামাবাদের মধ্যে দু একজন অফিসার বদলি হচ্ছিল। পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অনুরােধে ঢাকার ডেপুটি কমিশনার এ.টি.এম. শামসুল হককে (সি.এস.পি.) ইসলামাবাদে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে ।.. শামসুল হক ইসলামাবাদে আসবে আমি ছুটি থেকে ফেরার পর ।.. জুলাইয়ের মাঝামাঝি ছুটিতে যাবার অনুমতি মিলল। ভারতের ওপর দিয়ে ঢাকায় উড়ে যাবার পথ ভারত সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। বিমানপথে করাচি, কলম্বাে, ভারত মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে ঢাকায় যেতে হবে। করাচি পর্যন্ত ট্রেনে যাওয়া সাব্যস্ত করলাম। পথে দুদিন মােহেনজোদাড়ােতে কাটিয়ে যাব। উদ্দেশ্য, সালমা ও ছেলেমেয়েদেরকে আমার প্রথম চাকরির স্থানের সঙ্গে পরিচয় করানাে। সালমাও ইতিহাসের ছাত্রী।

মােহেনজোদাড়াে যেতে সেও খুব আগ্রহী ছিল। নিজের উৎসাহও কম ছিল না। আসার সময় নতুন মিউজিয়াম, বিশ্রামাগার, বিমানবন্দর এবং সেই সাথে বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করার প্রস্তুতি চলছিল। এসব পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়ন দেখতে খুব আগ্রহী ছিলাম। আমাদের দুদিনের সফর অন্যান্যদের জন্য শিক্ষণীয় ছিল।.. আগস্টের মাঝামাঝি ইসলামাবাদ ফিরে গেলাম। ফিরে আসার সময় এবার ঢাকায় সবার মন খুব ভারাক্রান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিল। এর প্রধান কারণ হলাে দেশের বর্তমান অবস্থা। কে কোথায় কিভাবে থাকব, সে চিন্তা সবার মনে। ইসলামাবাদ ফেরার দু সপ্তাহ পরে আমি Economic Affairs Division এর উপ- সচিব পদে যােগ দিলাম।”২২

 তার লেখনী থেকে লক্ষণীয়- ছুটি নিয়ে বাড়ি আসাকালে সপরিবারে বিভিন্ন পর্যটন দ্রষ্টব্য দেখেছেন (উপভােগ করেছেন নিশ্চয়ই?) এবং ছুটি থেকে  ফেরাকালে ঢাকায় সবার মন খুব ভারাক্রান্ত ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও লক্ষ করেছেন।

যাই হােক এখানে আমাদের বলবার এটুকুই যে, স্বদেশে ফিরে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেওয়ার সুযােগ সম্ভবত থাকলেও তিনি তা করেননি, বরং পশ্চিম পাকিস্তানে  ফিরে গিয়ে চাকুরিতে যােগদান করেছেন। অথচ তিনি স্বদেশের তখনকার অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছিলেন, এমনকি বিখ্যাত মুক্তিযােদ্ধা রুমী (স্বনামধন্যা জাহানারা ইমামের সন্তান এবং পরে শহীদ)-র সঙ্গেও দেখা হয়েছিল তার। তবু কেন তিনি, তার ভাষায়- “দেশপ্রেমিক অসীম সাহসী জুনিয়র কর্মকর্তা শেহাবুদ্দিন- আমজাদদের মতাে ঝুঁকি নিতে পারেননি বা মুক্তিযুদ্ধে যােগ দিতে অনুপ্রাণিত হলেন না, তা সম্বন্ধে প্রশ্ন থেকেই যায়।

 রুমী’র সঙ্গে সাক্ষাপ্রসঙ্গে শামসুল হক চিশতী বলেন: “দিন দশেক পরে সপরিবারে রাজশাহী গেলাম ।.. রাস্তার দুপাশে কোনাে কোনাে স্থানে আগুনে পােড়া ভিটেবাড়ি চোখে পড়ে। নগরবাড়ি-পাবনার মাঝে পােড়া ভিটার সংখ্যা অনেক বেশি। লােকমুখে শুনলাম, এগুলাের বেশির ভাগ হিন্দুদের বাড়ি ছিল। পাক আর্মির ধ্বংসযজ্ঞের শিকার।../ রাজশাহীতে দিন দশেক ছিলাম। শুনলাম এখানেও পাকসেনা রাজশাহী শহর পুনর্দখলের সময় কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গুণী শিক্ষককে মেরে ফেলেছে। পাকসেনাদের অত্যাচারের কাহিনী মাঝে মাঝে কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যেত। নিজ দেশের জনগণের ওপর বিশেষ করে মেয়েদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাবার কাহিনী শুনে আমরা হতবাক হয়ে পড়েছি। এরা কি সত্যিই মুসলমান? লক্ষ করলাম, শহরে লােক চলাচল আগের চাইতে কম। সন্ধ্যার পরে আরাে কমে যায়। রাজশাহী থাকাকালীন এখানেও প্রতি রাতে পদ্মার চর থেকে গােলাগুলির শব্দ আসত। চরাঞ্চলে ভারত সীমানার কাছে মাঝে মাঝে সেনাবাহিনীর ঘাঁটি ছিল। রাতের বেলা মক্তিবাহিনীর লােকজন এসব ঘাঁটি লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ত। পাকসেনা পাল্টা জবাব দিত। এই গােলাগুলির

শব্দ মানষকে খুশি করত। তারা এই কথা ভেবে উৎসাহিত হতাে যে আমাদের মুক্তিসেনারা সক্রিয় রয়েছে ।.. দশ দিন পর ঢাকায় ফিরলাম।../ ছুটি ফুরিয়ে আসার কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যায় ধানমণ্ডির বাসায় রুমী এসে হাজির। মনে হয় অনেকদিন চুল কাটেনি। খানিকটা দাড়িও গজিয়েছে। মুক্তিযােদ্ধার চেহারা। রুমী যে  মুক্তিযুদ্ধে গেছে, এ কথা বুবু সবার কাছ থেকে গােপন রাখে।”২৩

ছুটিতে এসে এবং সুযােগ পেয়েও যেমন অনেক বাঙালি সিভিল সার্ভিস অফিসার মক্তিযুদ্ধে যােগ দেননি বা অন্ততপক্ষে পাকিস্তান সরকারপক্ষ ত্যাগ করেননি তেমনি আশ্চর্য হলেও সত্য যে, দু-একজন সিভিল সার্ভিস অফিসার মুক্তিযুদ্ধে  যােগ দিয়েও পরে আবার ফিরে গেছেন নিজ পেশায় পুরােনাে কর্মস্থলে । যেমন, ব্যারিস্টার আমীর লিখেছেন: “সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে শত শত লােক প্রতিদিন আসছে। এদের মধ্যে সরকারী কর্মচারী, ডাক্তার, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, উকিল, ছাত্র-যুবক, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী বিভিন্ন স্তরের লােক রয়েছে। সকলেই চলে আসে বাংলাদেশ মিশনে।”.. “এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে (বাংলাদেশ) থেকে কিছু বেসামরিক অফিসার এসে গেছেন। পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের, রাজশাহীর জেলা প্রশাসক হান্নানসহ আরাে অনেকে। এদের কাজ দেয়া হলাে। রাজশাহীর জেলা প্রশাসক কয়েকদিন কাজ করে ফিরে চলে যান।”২৪

পরিশেষে একটা কথা উল্লেখ্য যে, বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের ন্যায় আকাশপথে প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালানাের ঘটনার মতাে ( দুর্ভাগ্যক্রমে সংশ্লিষ্ট প্লেন ক্রাশড হওয়ায় তিনি শহীদ হন) না হলেও, জানা যায়, পাকিস্তানে কর্মরত ১৯৫৮ সাল-ব্যাচের বাঙালি সিএসপি ড. মােঃ আবদুস সাত্তার (১৯/০৬/১৯৬৯ থেকে তিনি ইসলামাবাদস্থ পরিকল্পনা বিভাগের ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক সেকশনে ‘চীফ’ পদে দায়িত্বরত ছিলেন) পাকিস্তান থেকে পালাতে চেষ্টা করেছিলেন এবং অসফল হয়ে তথা ধরা পড়ে চাকুরিচ্যুত ও কারারুদ্ধ হয়েছিলেন (দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তিনি মুক্তি পান)। শামসুল হক চিশতীর সূত্রে জানা যায়, তিনি লিখেছেন: “ছুটিতে থাকাকালীন খবরের কাগজে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মােঃ আব্দুস সাত্তারের (১৯৫৮ সালের সি.এস.পি) গ্রেপ্তারের খবর দেখে চমকে উঠলাম। পত্রিকায় প্রকাশিত সরকারি ভাষ্যে বলা হয়েছে যে, সে গােপনে উপজাতীয় এলাকা দিয়ে দেশ ত্যাগ করার সময় ধরা পড়েছে। কিছুদিন আগে সে তার গাড়ি বিক্রি করে স্ত্রী এলেনকে তার ছেলেদের সহ বৃটেনে পাঠিয়ে দিয়েছে। বােঝা গেল অনেকদিন ধরে পুলিশ তার ওপর নজর রাখছিল। মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ সাহেবের ডাকে অসহযােগ আন্দোলন শুরুর সময় সাত্তার ঢাকায় ছিল। শেখ সাহেবের পক্ষ থেকে যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার নির্দেশ

জারীতে যে অর্থনীতিবিদদের গােষ্ঠি (গােষ্ঠী) তাকে পরামর্শ দিত, তাদের মধ্যে সাত্তার একজন ছিল। আমাদের বিশ্বাস, তখন থেকে তার ওপর নজরদারী করা হচ্ছিল।”২৫

এপর্যায়ে আর দু-একটি কথা বলে এ আলােচনা শেষ করব।

এক. একটা জিনিস অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, পর্যাপ্ত ও উপযুক্ত তথ্য- প্রমাণের অভাবে ২৬শে মার্চ ১৯৭১ থেকে নিয়ে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত-  অর্থাৎ গােটা মুক্তিযুদ্ধপর্বে যেসব২৬  বাঙালি সিএসপি-ইপিসিএস কর্মকর্তা ( পরিশিষ্ট ‘ঙ’ দ্রষ্টব্য; তালিকাটি সম্পূর্ণ নয় এবং এর অন্তর্ভুক্তিতে কিছু কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুল থাকাও বিচিত্র নয়) পশ্চিম পাকিস্তানে ইসলামাবাদস্থ কেন্দ্রীয় সরকার ও কোনাে কোনাে প্রাদেশিক সরকারের বিভিন্ন পদে কর্মরত ছিলেন (মুক্তিযুদ্ধের বেশ আগে থেকে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা বদলি হয়েছিলেন দুটোর হিসেবে), তাদের সেখানকার প্রকৃত কর্ম ও ভূমিকা সম্বন্ধে সবিশেষ উল্লেখযােগ্য কিছু জানা যায় না। তবে পরিশিষ্ট ‘ঙ’-এ প্রদর্শিত তাদের সেখানকার দাপ্তরিক পদ-পদবি দৃষ্টে এসম্পর্কে কিছুটা আঁচ করা সম্ভব। তবে অবশ্যই তারা সেখানে সন্দিগ্ধ প্রবাসীর ক্রান্তিকাল কাটিয়েছেন, এটা অস্বীকার করা যাবে না।

দুই. পরিশিষ্ট ‘ঙ’ ছাড়া দু-চারজন সিএসপি-ইপিসিএস অফিসার (যেমন, সিএসপি মােঃ শামসুল হক চিশতী, ইপিসিএস এ. এ. এম. ইউসুফ) এবং পাকিস্তান ফেরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের কারাে কারাে লেখায় এদের এসম্বন্ধে। ছিটেফোঁটা বর্ণনা বা তথ্য লভ্য। সব মিলিয়ে বলতে গেলে, সে বিবরণ সুখকর ও দেশপ্রেমমূলক নয়।

পৃষ্ঠাঃ ১৭৭

তথ্য নির্দেশ

১. How Pakistan Got Divided. বাংলাদেশের জন্ম’ নামে শাহ আহমদ রেজা কর্তৃক অনূদিত, দেখুন ঐ, পৃষ্ঠা ৯৫।

২. পাকিস্তানে তিনি মার্চ ১৯৬৮ থেকে জানুয়ারি ১৯৭৩ পর্যন্ত ছিলেন। তার নিজের ভাষায়: “ইসলামাবাদে ছিলাম ১৯৬৮ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৩ সালের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত। এ অবস্থানকে তিনভাগে ভাগ করা যায় : প্রথম ভাগ ১৯৬৮’র মার্চ থেকে  ১৯৭২ এর মার্চের কোনাে এক তারিখ পর্যন্ত চাকরিরত, এর পর দ্বিতীয় ভাগ ১০ই জুলাই পর্যন্ত ও.এস.ডি. (0.S.D.Officer on Special Duty) অর্থাৎ  ঘরে বসে কোনাে কাজ না করে বেতন পাওয়া। তৃতীয় ভাগে বাংলাদেশ সরকারের অধীনে চাকরির ইচ্ছা প্রকাশ করায় চাকরিচ্যুতি এবং বেকার জীবন। অবশ্য এ সময়ে ভরণ-পােষণের জন্য পাকিস্তান সরকার সামান্য ভাতা প্রদান করত। চাকরিকালীন তিন মন্ত্রণালয়ে চাকরির সুযােগ হয়। প্রথম এক বছর দশ মাসে (মাস) যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ে, পরবর্তী এক বছর নয় মাস সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে এবং  শেষ পর্বে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে।” (পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, মােঃ শামসুল হক চিশতী, পৃষ্ঠা ৩৩৪-৫)।

৩. পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৭২।

৪. দেখুন, The Dacca Gazette, Extraordinary, Monday, April 19, 1971; No. GAl-337/71-1642–20″ August 1971; No. GAI-339/71- 1686–24th August 1971, এঁর সম্বন্ধে রাও ফরমান আলি লিখেছেন: “আমি চিফ সেক্রেটারি শফিউল আযমকে চিনতাম। তিনি বাংগালীপন্থী হলেও দেশপ্রেমিক পাকিস্তানী ছিলেন। তাকে যখন সরিয়ে দেয়া হয় তখন আমার খারাপ লেগেছিল।” (বাংলাদেশের জন্ম, পৃষ্ঠা ৯৫)।

৫. Experiences Of An Exile At Home : Life In Occupied Bangladesh, p. 62. 2770 Service and General Administration Department, General Administration Branch-47 No. GAI-5/71-1861-29th September, 1971 তারিখের আদেশ থেকে দেখা যায়, সৈয়দ মহিবুল্লাহ শাহ (Syed Mohibullah Shah), সিএসপি-কে সিন্ধু প্রাদেশিক সরকার থেকে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক; No. GAl-5/71-1862–29th September, 1971 তারিখের আদেশমূলে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে আকবর আহমদ (Akbar Ahmad), সিএসপি-কে সেক্টর ইন্সপেকশন টিম অভ দ্য গভর্নর্স ইন্সপেকশন টিমের সদস্য (Member) ইত্যাদি বদলি করা হয়েছিল। (দেখুন, The Dacca Gazette, Thursday, October 14, 1971, p. 1039).

৬. দিনলিপি একাত্তর, পৃষ্ঠা ৯১-২।

৭. মুক্তিযুদ্ধের আরেক ফ্রন্ট, পৃষ্ঠা ২৬-৩১।

৮. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৬-৩৮।

পৃষ্ঠাঃ ১৭৮

৯. পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৭৩। জনাব চিশতীসূত্রে আরও জানা যায়, “পাকবাহিনীর পরাজয়ের পর এদের সবাইকে যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে এঁদেরকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে দেয়া হয়।” (ঐ, পৃষ্ঠা ৩৭৩)।

১০. Resurrection of Bangladesh, Mahmud S. Haider, p. 67.

১১. এম, মুজিবুল হক, টি,কিউ,এ, ১৯৫৪ সাল-ব্যাচের সিএসপি, তিনি ২৯/০১/১৯৭০ থেকে পূর্বপাকিস্তান সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। (দেখুন, Gradation List of the Civil Service of Pakistan corrected up to the 1st January, 1971, p. 10).

১২. পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৭৬-৭।

১৩. এ. টি. মােঃ শামসুল হক১৯৬০ সাল-ব্যাচের সিএসপি; ২৮/০১/১৯৭০ থেকে ঢাকার জেলাপ্রশাসক পদে কর্মরত ছিলেন। (দেখুন, Gradation List of the Civil Service of Pakistan corrected up to the 1″ January, 1971. P. 19), তার বদলিসংক্রান্ত আদেশের জন্য দেখুন, No. 1272-Edn4th May 1971 (DC, Dacca); No. GAI-202/71-809–31 May 1971; No. 3590(5)-Edn-22nd July 1971 (DC, Dacca); No. GAI-5/71-1593- 9th August 1971; No. GAI/202/71-161913 August 1971).

১৪. পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৭৩-৯।

১৫. এ, কে, এম, আহসান, টি.কিউ.এ.- ১৯৪৯ সাল-ব্যাচের সিএসপি; তিনি ০৯/০১/১৯৭০ থেকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি ও পূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। (Gradation List of the Civil Service of Pakistan corrected up to the 15 January, 1971, p. 5).

১৬. আলি হাসান, এস,কিউ,এ. টি.পিকে,- ১৯৪৮ সালে ‘অপশন’-মূলে পাকিস্তানে আত্মীকৃত হন; তিনি ০৯/০১/১৯৭০ থেকে পাকিস্তান সরকারের যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের সচিব হিশেবে কর্মরত ছিলেন। (Gradation List of the Civil Service of Pakistan corrected up to the 1″ January, 1971, p. 4).

১৭. পদ্মার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৮৪।

১৮. পশ্চিম পাকিস্তানে তখন প্রদেশ বলতে ছিল- ‘পাঞ্জাব’, ‘সিন্ধু’, ‘বেলুচিস্তান’ ও “উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ’। বলাবাহুল্য পঞ্চম প্রদেশ হচ্ছে ‘পূর্বপাকিস্তান’। প্রথম ৪টি মিলে পশ্চিম উইং’ এবং পূর্বপাকিস্তান এককভাবে পূর্ব উইং’।

১৯. দিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসের তৎকালীন দ্বিতীয় সচিব কে. এম. শেহাবুদ্দিন (K. M. Shehabuddin) ও সহকারী প্রেস অ্যাটাশে আমজাদুল হক (Amjadul Huq)- এঁরা অবশ্য মুজিবনগর সরকার গঠনের আগেই ৬ই এপ্রিল ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সরকারের আনুগত্য ত্যাগ করেছিলেন।

২০. পঙ্গার ভাঙনে জীবনের জয়গান, পৃষ্ঠা ৩৭১।

২১, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭১।

২২. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩৭৩-৯।

পৃষ্ঠাঃ ১৭৯

২৩. তদেব, পৃষ্ঠা ৩৭৬-৮।

২৪. মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, পৃষ্ঠা ৫৯।

২৫. তদেব, পৃষ্ঠা ৩৮০-৮১।

২৬. সেখানে এদের প্রকৃত সংখ্যা কত ছিল, তা জানা দুষ্কর। ১৯/০৮/১৯৭০ থেকে ১০/o৭/১৯৭২ পর্যন্ত ইসলামাবাদে War Risks Insurance-র তদন্তকারী কর্মকর্তা (Inquiry Officer) পদে দায়িত্বরত এ. এ. এম. (আবু আইয়ব মােহাম্মদ) ইউসুফ (১৯৫৪ সালে ম্যাজিস্ট্রেট হিশেবে চাকুরিতে যােগদান)-এর একটি মন্তব্য এখানে প্রণিধানযােগ্য।

জনাব ইউসুফ লিখেছেন: “১৯৬৮ | ইসলামাবাদে প্রেষণে আসা EPCS-এর সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ৭৫ এ উন্নীত হল। আমরা কয়েকজন চিন্তা করলাম এখানে একটা এসােসিয়েশন গঠন করা দরকার। প্রথম সেক্রেটারির সম্মানটি আমার জুটল। সদস্যদের মধ্যে অধিকতর মেলামেশা ও পারিবারিক ভাবে পরিচিতি প্রসার করতে আমরা কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম। আমার মনে আছে ঐ ৭৫ সদস্যের টেলিফোন নম্বর আমার মুখস্ত (মুখস্থ) থাকত।../ একই সময়ে (১৯৬৮) বাঙালিরা কারাচীর (করাচীর) মত ইসলামাবাদে একটি পূর্ব পাকিস্তান এসােসিয়েশন গঠন করার উদ্যোগ নিলেন। একটি এডহক কমিটি গঠন হলঃ সভাপতি কেন্দ্রীয় যােগাযােগ সচিব এম.এ. রশিদ (১৯৪৬ সালে আত্মীকৃত), সেক্রেটারি আবদুর রব চৌধুরী (১৯৫৭ সাল-ব্যাচের সিএসপি) ও জয়েন্ট সেক্রেটারী এ.এ.এম ইউসুফ। ১৯৬৯ সনে সাধারণ সভা ডেকে নতুন ও নিয়মিত কমিটি গঠন করা হলঃ সভাপতি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ এ. এম, মালিক, সেক্রেটারি এ.জেড. এম ওবায়দুল্লাহ খান (১৯৫৭ সাল-ব্যাচের সিএসপি), জয়েন্ট সেক্রেটারি এ.এ.এম. ইউসুফ। যথারীতি ১৯৭০ সনে সাধারণ সভায় নতুন কমিটি গঠিত হল। সভাপতি কেন্দ্রীয় সচিব এ.কে.এম, আহসান, সেক্রেটারি ডাঃ আবদুস ছােবহান চৌধুরী, জয়েন্ট সেক্রেটারি এ,এ,এম ইউসুফ। বস্তুতঃ আহসান কমিটিই এক নাগাড়ে ১৯৭২ পর্যন্ত বাঙালিদের সমস্যা সমাধানে পাকিস্তান সরকার ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির সাথে দেন- দরবার করেছিল।”(দেখুন তার, এক সিভিলিয়ানের আত্মকথন, পৃষ্ঠা ১৮৮-৯)। এখানে বর্ণিত ইপিসিএস সংখ্যা (৭৫) পরিশিষ্ট ‘ঙ’-এর ইপিসিএস সংখ্যা (৭৭)-র সঙ্গে মােটামুটি মিলে যায়। তবে নামের কিছু হেরফের হতে পারে। অন্যদিকে সিএসপির সংখ্যা সেই তুলনায় সেখানে কম ছিল।

Ref: মুক্তিযুদ্ধে সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসারদের ভূমিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!