You dont have javascript enabled! Please enable it! ওপারের নটবর এপারের খন্দকার - সংগ্রামের নোটবুক
ওপারের নটবর, এপারের খন্দকার
ভারতের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী নটবর সিং-এর চারশ পাতার ঢাউশ স্মৃতিকথা, ওয়ান লাইফ ইজ নট ইনাফ, পড়ার পর আমার এ কে খন্দকারের কথা মনে পড়ল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহ-সর্বাধিনায়ক ও প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান জনাব খন্দকারের স্মৃতিকথা, ১৯৭১, ভেতরে বাইরে, আদ্যোপান্ত আমার পড়া হয়নি, শুধু নির্বাচিত কিছু অংশ পড়েছি। তবে সে বই যে উত্তপ্ত বাদানুবাদের। সূত্রপাত ঘটিয়েছে, আমি তার সাথে পরিচিত নটবরের বইও বিস্তর বিতর্কের সূত্রপাত করেছে, যদিও খন্দকারের মতাে বাপ তুলে গাল তাঁকে শুনতে হয়নি। এই দুই বই নিয়ে যতটুকু জেনেছি, বুঝেছি তাতে আমার কাছে একটা জিনিস স্পষ্ট, নটবর ও খন্দকার উভয়ের এক জায়গায় ভীষণ মিল। তাঁরা দুজনেই অকৃতজ্ঞ নটবর সিং আগাগােড়া নেহেরু পরিবারের নিমক খেয়ে এসেছেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, নিজের পরিবারের একজন ভেবে কাজে-অকাজে সাথে রেখেছেন, তাঁর বিয়েতে সাক্ষী হয়েছেন, পুত্রের জন্মদিনে শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও হাজিরা দিয়েছেন। রাজিব একজন বিদেশি মেয়ে বিয়ে করছে, একথা নিজের পরিবারের কাউকে বলার আগে নটবরকের ডেকে বলেছেন ইন্দিরা। তাঁর মৃত্যুর। পর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে রাজিব গান্ধী যে কয়জন আমলাকে আমলে এনেছেন, নটবর তাঁদের একজন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজনৈতিক মধ্যমঞ্চে এসে পড়ার পর সােনিয়া গান্ধী যে একজন-দুজন ভারতীয়কে নিজের আত্মার আত্মা জ্ঞান করতেন, নটর সিং ছিলেন তাঁদের একজন এই পরিবারের ছত্রছায়ায় আজীবন কাটিয়েছেন তিনি, সে সুবাদে ব্যক্তিগত ও পেশাদার নানা সুবিধাও আদায় করে। নিয়েছেন তিনি। রাজিবের হাত ধরেই তাঁর রাজনীতিতে আসা, মন্ত্রীত্ব লাভ।
দলের ভেতরে অনেকের এবং আমেরিকার কড়া আপত্তি সত্ত্বেও পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন সােনিয়ারই সুপারিশে। যতদিন এইসব সুযােগ। সুবিধা ভােগ করেছেন, তাঁর মুখে একটি কটু কথাও শােনা যায় নি। ওয়ান লাইফ ইজ নট ইনাফ, নটবর সিং, রূপা, নয়াদিল্লি, ২০১৪ ১৯৭১, ভেতরে বাইরে, প্রথম, ঢাকা ২০১৪ . ইন্দিরার জরুরি অবস্থা দেখেছেন, রাজিবের শ্রীলংকা অভিযান দেখেছেন, কংগ্রেসের ভেতর ব্যক্তিতন্ত্রের ও পরিবারতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা দেখেছেন। যতদিন ক্ষমতার সুফল ভােগ করেছেন, কই, নটবর তাে এসবের কোনাে কিছু নিয়ে টু শব্দটি করেননি ইরাকের খাদ্যের বিনিময়ে তেল’ কর্মসূচির অধীনে তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হয়েছেন, জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এমন অভিযােগ উঠলে। প্রধানমন্ত্রী মনমােহন সিং তাঁকে মন্ত্রী থেকে বাদ দেন। সে সিদ্ধান্তে কংগ্রেস দলনেত্রী সােনিয়া গান্ধীর সমর্থন ছিল। ব্যস, হয়ে গেল ফায়সালা এতদিন যে মুখে সােনিয়া ও গান্ধী পরিবারের শতগুণ গেয়েছেন, এখন সে মুখেই শুরু করলেন গান্ধী পরিবারের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার  অন্য সবার চেয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হলেন সােনিয়া, যে ভেবে, না ভেবে নটবরকে নিকটাত্মীয় ভেবে পাশে পাশে ছায়ার মতাে রেখেছিলেন। অকৃতজ্ঞ আমি বলছি সে কারণেই। এ কে খন্দকারের ব্যাপারটা এর চেয়ে খুব কিছু ভিন্ন নয়। তিনি একাত্তরে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু দেশকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছেন কিন্তু সেজন্য প্রস্তুত করেননি, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানের বদলে স্বেচ্ছায় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছেন খন্দকার এমন কথাও বলার চেষ্টা করেছেন, বঙ্গবন্ধু একাত্তরের স্বাধীনতার বদলে পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ধরে রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।
সবচেয়ে যা দুঃখজনক তা হলাে, কোনাে প্রমাণ ছাড়া খন্দকার দাবি করেছেন, ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু ‘জিয়ে পাকিস্তান’ বলে তার ভাষণ শেষ করেন। নটবর সিং দাবি করেছেন, সত্য ও বস্তুনিষ্ঠতার তাগিদে তাঁকে কলম ধরতে হয়েছে। বন্ধুত্বে তিনি বিশ্বাসী, কিন্তু সত্যের খাতিরে বন্ধুত্ব ত্যাগে তাঁর দ্বিধা নেই। এই বলে জ্ঞান দিয়েছেন যে, বন্ধুত্ব কোনাে সামাজিক চুক্তি নয়, বন্ধুত্ব নির্ভর করে বিশ্বাস ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ওপর তাঁর শ্বশুর, পাতিয়ালার মহারাজের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, প্রতিবাদের সময় যে চুপ করে থাকে, সে কাপুরুষ। অনুমান করি, শেষ বয়সে, নেহেরু পরিবারের অনুকূল্য থেকে বঞ্চিত হয়ে, অকস্মাৎ তিনি উপলব্ধি করেছেন, এখনই তাঁর কথা বলার সময়  অন্যথায় ইতিহাসের চোখে তিনি কাপুরুষ হিসেবে চিহ্নিত হবেন। এ কে খন্দকারও একই যুক্তি দেখিয়েছেন। সত্য প্রকাশের খাতিরে অনেক অপ্রিয় কথাও বলতে হয়, সে আপ্তবাক্য মাথায় রেখে এই গ্রন্থটি লিখেছেন, এমন একটি ব্যাখ্যা তিনি দিয়েছেন। গ্রন্থটি প্রকাশের পর নানা বিতর্কের সূত্রপাত হওয়ার পর তিনি নতুন যুক্তি দেখিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নানাজন নানা কথা বলছে। তার সবকিছু বস্তুনিষ্ঠ নয়, সত্য-মিথ্যা নানা কিছু সেখানে ঢুকে পড়েছে। নটবরের বস্তুনিষ্ঠতার যুক্তি যে কারণে খুব গ্রহণযােগ্য মনে হয় না, জনাব খন্দকারের সত্য প্রকাশের এই তাড়নাও আমাদের মনে আস্থা জাগায় না। কোন সন্দেহ নেই, তিনি খুব কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে দেখেছেন এবং দীর্ঘকাল ক্ষমতাসীন মহলের নিকটবর্তী হওয়ার সুবাদে নানা সুবিধা ভােগ করেছেন। বিগত মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ণ মন্ত্রীর মর্যাদায় দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবেও সম্মানিত হয়েছেন।
এই এত বছর, যখন তিনি নিজে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন, চাইলে অনায়াসে নিজের মনের কথা, ইতিহাসের সত্য কাহিনি, তিনি তুলে ধরতে  পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। ২০১৪ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকারে তাঁর স্থান হয়নি। আর ঠিক তখনি তিনি মনের কথা সর্বসমক্ষে বলার সিদ্ধান্ত নিলেন। এটি কি নটবরের মতাে কাণ্ড হয়ে গেল না? নটবর অবশ্য আরেকটি অপরাধ করেছেন। শুধু যে গান্ধী পরিবারের সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের অপব্যবহার করেছেন তাই নয়, সােনিয়া ও প্রিয়াংকার সাথে তাঁর সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত আলাপচারিতা তাঁদের সম্মতি ছাড়া নিজের গ্রন্থে  অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এমনিতে তার বইতে পড়ার, জানার মতাে তেমন কিছু নেই, আত্মকথনেই চারশ পাতা ব্যয় করেছেন। যে কারণে বইটি নিয়ে এত হৈচৈ তা হলাে নটবরের উপস্থিতিতে রাহুল গান্ধী তার মায়ের প্রধানমন্ত্রীত্বে আপত্তি   প্রধানমন্ত্রী হলে পিতা ও মাতামহের মতাে সােনিয়াও রাজনৈতিক হত্যার শিকার হবেন, এই ভয় থেকে রাহুল গাে ধরেছিল, মাকে ঠেকাতে সে সবকিছু করতে প্রস্তুত। নটবর জানিয়েছেন, গ্রন্থ রচনার শেষ পর্যায়ে প্রিয়াংকা ও সােনিয়া নিজে এসে তাঁকে অনুরােধ করেছিলেন এই প্রসঙ্গটুকু বাদ দিতে কারাে সাধ্য নেই আমার এই বই কাটাছেড়া করে, মুখের উপর জানিয়ে ছিলেন নটবর। আমার বিবেচনায়, নটবর গান্ধী পরিবারের নিজস্ব ঘটনা, তাদের ব্যক্তিগত ঘটনা, জনসমক্ষে প্রকাশ করে কেবল সাংবাদিকতার নীতিই ভঙ্গ করেননি, সামান্য শিষ্টাচার দেখাতেও ব্যর্থ হয়েছেন। এর ফলে কী ঐতিহাসিক বস্তুনিষ্ঠতা অর্জিত হলাে আমি জানি না, কিন্তু নটবর সিং-এর সাথে সিঁধেল চোরের মধ্যে কোনাে |তফাৎ থাকল না বলেই আমার মনে হয়েছে।
এই দুই বই নিয়ে ভারতে ও বাংলাদেশে যে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে, তার অবশ্য একটা গুণগত প্রভেদ রয়েছে। নটবরের শ্যালক, আমারিন্দর সিং তাঁকে  মিথ্যাবাদী বলেছেন। সমালােচিত হয়েছেন, কিন্তু এর চেয়ে অধিক নিন্দার। ভাগীদার তাঁকে হতে হয়নি। অন্যদিকে এ একে খন্দকার আমাদের রাজনীতিক ও কলমবাজদের হাতে যেভাবে আক্রান্ত হয়েছে, তা শিষ্টাচার ছাড়িয়ে গেছে। তাঁকে রাজাকার বলা হয়েছে, পাকিস্তানের দালাল বলা হয়েছে, বিদেশি উৎকোচে তিনি এই বই লিখেছেন, এমন কথাও বলা হয়েছে। যারা এইসব অভিযােগ করেন, তারা ভুলে যান মুক্তিযুদ্ধের উপ-সর্বাধিনায়ক সম্বন্ধে এমন কথা বলা হচ্ছে। জেনারেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে তিনিই ঢাকায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেছিলেন। এখন তাঁকে পাকিস্তানের দালাল বললে আমাদের পুরাে মুক্তিযুদ্ধই কালিমাযুক্ত হয়ে পড়ে। কঠোর সমালােচনা ভালাে, কিন্তু তা শিষ্টাচার বহির্ভূত হলে আকাশে ছােড়া থুথুর মতাে তা আমাদের নিজেদের গায়েই এসে লাগে। একমাত্র মাননীয় অর্থমন্ত্রী মুহিতই সবচেয়ে যুক্তিপূর্ণ কথাটি বলেছেন। জনাব খন্দকার একটি বই লিখেছেন, তাঁর মিথ্যাচারের সঠিক জবাব হবে তথ্যপ্রমাণসহ আরেকটি বই লেখা ইতিহাসের বিষয়বস্তু বিগত সময়ের ঘটনাক্রম ও তার ব্যখ্যা কিন্তু তাই বলে ইতিহাস মৃত নয়, নতুন নতুন তথ্য তাকে প্রতিনিয়ত জীবিত রাখে। ভারতে ও বাংলাদেশে যে ঘটনাক্রম নিয়ে বিতর্ক, তার বিষয়বস্তু সাম্প্রতিক সময়ের, আমাদের অনেকেই তার প্রত্যক্ষদর্শী। কেউ কেউ সে ইতিহাস নির্মাণে অংশও নিয়েছেন। নটবর সিং-এর বই থেকে স্পষ্ট ইতিহাসকে তিনি ব্যবহার করেছেন ব্যক্তিগত দেনা-পাওনা মেটাতে  এ কে খন্দকারের ক্ষেত্রেও যদি ঠিক ঘটনাই ঘটে থাকে, বাংলাদেশের ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব হবে তাঁর সাক্ষ্যভাষ্যের সত্য-মিথ্যার প্রামাণিক শব ব্যবচ্ছেদ।

সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস,  সময় প্রকাশনী,২০১৬