চলচ্চিত্রে একাত্তর : বলিউড যখন ঐতিহাসিক
আলি আব্বাস জাফর পরিচালিত ও আদিত্য চোপড়া যােজিত বলিউডের ‘গুন্ডে’ ছবি নিয়ে বাংলাদেশে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা কিছুটা কৌতুকপ্রদ মনে হতে পারে বলিউডকে যারা ইতিহাসের উৎস হিসেবে বিবেচনা করেন, তাদের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রশ্ন তােলা একদম অযৌক্তিক নয়। বলিউডি ফিল্ম মানেই গাজায় দম দিয়ে বানানাে গল্প বাস্তব অথবা সত্যের সাথে যে ফিলের সংযােগ যত কম, সে ফিল্ম তত বেশি জনপ্রিয় লােকজন সেসব দেখতে ভিড় জমায় ইতিহাস বইতে কি লেখা আছে বা বাস্তবে কী ঘটে, তা জানতে নয়, বরং দুদণ্ড সব ভুলে স্বপ্নের জগতে ঠাই নেওয়া যাবে সে জন্য। ঠিক সে কারণে আলি আব্বাস জাফর পরিচালিত ও আদিত্য চোপড়া প্রযােজিত বলিউডের ‘গুন্ডে’ ছবি নিয়ে বাংলাদেশে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে, তা কিছুটা কৌতুকপ্রদ মনে হতে পারে। ছবিটির প্রথম কয়েক মিনিট বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মনগড়া কিছু কল্প-কাহিনী সাজানাে হয়েছে, যার প্রতিবাদে সােস্যাল মিডিয়াতে এক মহা তুলকালাম ঘটে যায়। ফেসবুকটা মুখ্যত ছেলে-ছােকরাদের দখলে, ফলে তারা যা খুশি বলবে, লিখবে, তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু একদম সরকারি পর্যায়ে তা নিয়ে প্রতিক্রিয়া উঠবে, তা ঠিক ভাবিনি। তর্কবিতর্কের উত্তাপ এতটা ছড়িয়ে পড়ে যে এই আমেরিকার অতি-সিরিয়াস পত্রিকা ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল পর্যন্ত এ নিয়ে নাক গলাতে বাধ্য হয়। ‘গুন্ডে’ নিয়ে এই তর্কাতর্কি নিয়ে কেউ কেউ বাঁকা হাসি হাসলেও ব্যাপারটা উপেক্ষার সাথে দেখাও খুব বুদ্ধিমানের কাজ নয়। একথা ঠিক যে ছেলেছােকরারাই এই নিয়ে প্রথমে প্রশ্ন তােলে, কিন্তু সেটি পরিহাসের বিষয় নয়। এ থেকে বরং বােঝা যায় মুক্তিযুদ্ধ ব্যাপারটাকে এই প্রজন্মের সদস্যরা কতটা গুরুত্বের সাথে নেয়।
এই যুদ্ধের ইতিহাস, তার স্মৃতি, আগলে রাখার কাজ, যা আমরা বুড়ােরা খুব একটা যােগ্যতার সাথে করেছি বলা যাবে না, নব প্রজন্মের সদস্যরা তাকে নিজেদের অস্তিত্বের সংগ্রাম বলে মনে করে। অনেকে যখন সে। ইতিহাস মনে রাখার বদলে হয় তা ভুলতে বা তা বিকৃত করতে ব্যস্ত, তখন এরা সে ইতিহাসকে, সে ইতিহাসের গৌরবময় প্রকাশকে, বুক দিয়ে আগলে রাখতে চায়। চলচিচত্র মাধ্যমটাকে এরা ভালােভাবে জানে, এর শক্তির সাথে এদের পরিচয় আছে। নিজের জন্মের ইতিহাসের এই বিকৃত চলচ্চিত্রায়ন দেখে তারা প্রতারিত বােধ করেছে। প্রতিবাদের তীব্রতাও সে কারণে এমন প্রবল। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, তার ন্যারেটিভ, শুধুমাত্র একটি, একথা আমি বলি না। ইতিহাস মানেই কোন কাল, সময় অথবা ঘটনার ব্যক্তিগত ও সম্মিলিত স্মৃতি। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান, সেই ইতিহাসের এই তিন প্রধান কুশিলব যার যার নিজস্ব চশমায় সে ন্যারেটিভ নির্মাণ করবে, তাতেও অবাকের কিছু নেই। এই ইতিহাসের একটি বহির্গত চরিত্র রয়েছে, তার কুশিলব আবার ভিন্ন নাকের ওপর ভিন্ন চশমা গুজে তারা যখন এই ইতিহাস লিখতে বসেন, তার বহিরঙ্গটি যায় বদলে যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনা- তার বয়স এখন অর্ধ শতক পূর্ণ হয় নি। ফলে ইতিহাসের নৈর্ব্যক্তিকতা অর্জনের জন্য সময়ের যে দূরত্ব প্রয়ােজন, তা অনুপস্থিত ফলে, জাতিগত ও ব্যক্তিগত, দৃষ্টিকোণ থেকে নির্মিত এই ভিন্ন ভিন্ন ন্যারেটিভের মধ্যে যদি বৈপরীত্য, অথবা প্রতিদ্বন্দ্বিতা, রয়ে যায়, তাতেও অবাক হবার কিছু নেই। বস্তুতপক্ষে, এ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস আমরা পেয়েছি, তার অধিকাংশই একটি প্রতিযােগিতামূলক বিবরণী অনুসরণ করে চলে। নিজের ভীরুতা ঢাকতে কেউ কেউ আবার আত্ম-গৌরবের সাতকাহন ফেঁদে বসেন, সময়মত প্রতিবাদের অভাবে সে সাতকাহনও বস্তুনিষ্ঠতার দাবিদার হয়ে উঠতে পারে। অধিকাংশ ভারতীয় লেখকের বিবরণে একাত্তর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের অভাবনীয় ও ঐতিহাসিক বিজয় ভিন্ন অন্য কিছু নয়। অতি-সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রীনাথ রাঘভনের গ্রন্থ ১৯৭১, এ গ্লোবাল হিস্টরি অব দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ গুণগতভাবে ভিন্ন হলেও বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের কোনাে পরিচয় সেখানেও নেই।
অন্যদিকে পাকিস্তানি লেখকের হাতে ১৯৭১ এর ইতিহাস বাঙালি মুসলমানের বিশ্বাসঘাতকতা ও হাতেগােনা কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা কমান্ডারের মূর্খতা ও অযােগ্যতা ছাড়া আর কিছু নয়। যেমন, একাত্তরের ওপর ফজল মুকিম খানের লেখা গ্রন্থের নাম ‘পাকিস্তান’স ক্রাইসিস ইন লিডারশিপ।’ নিয়াজি, সে যুদ্ধের পরাজিত সমরনায়কের গ্রন্থের নাম ‘দি বিট্রেয়াল অব ইস্ট পাকিস্তান।
মার্কিন অথবা ইউরােপীয় লেখক, যারা এই প্রতিদ্বন্দ্বী ন্যারেটিভে কোনাে আনুভূতিক পুঁজি বিনিয়ােগ করেননি বলে ভাবা স্বাভাবিক, তারা একাত্তরকে বরাবরই ভারত ও পাকিস্তানের লড়াই, এই দুই দেশের মধ্যে সংঘটিত তৃতীয় যুদ্ধ, হিসেবেই বর্ণনা করেছেন। যে গ্রন্থটিকে একাত্তরের সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য ও বস্তুনিষ্ট বিবরণ বলে কেউ কেউ রায় দিয়েছেন, মার্কিন গবেষক রিচার্ড সিসন ও লিও রােজ এর লেখা ‘ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এন্ড দি ক্রিয়েশন অব বাংলাদেশ, সেখানেও বাংলাদেশ যুদ্ধকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ হিসেবেই বর্ণনা করা হয়েছে। যারা দৃশ্যত নিরপেক্ষ, যেমন ইংরেজ লেখক রবার্ট জ্যাকসন, তাঁদের কাছে একাত্তর বড়জোর বাঙালির বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন, তার বেশি নয়। স্মর্তব্য, জ্যাকসনের গ্রন্থটির নাম ‘সাউথ এশিয়ান ক্রাইসিস। হেনরি কিসিঞ্জারের মতাে আত্মপ্রেমি মেকি-ইতিহাসবিদের হাতে যখন সে ইতিহাস লিখিত হয়, একাত্তরের প্রকাশ ঘটে পরাশক্তি ত্রয়ের, অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন, এর মধ্যে প্রক্সি যুদ্ধ’ হিসেবে।
তার সুবিশাল ‘হােয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থে একাত্তরের ইতিহাস পুনঃনির্মাণ করতে ৮০ পাতার যে অধ্যায়টি তিনি লিখেছেন, বাঙালির মুক্তি আন্দোলনের কোনাে পরিচয়ই তাতে নেই। কিসিঞ্জার সে পরিচ্ছদের শিরােনাম দিয়েছেন ‘দি টিলট : দি ইন্ডিয়া, পাকিস্তান ক্রাইসিস অব ১৯৭১ অতি সম্প্রতি মার্কিন সাংবাদিক ও গবেষক গ্যারি বাস ‘রাড টেলিগ্রাম এই নামে একাত্তরের যে বিকল্প ইতিহাস রচনা করেছেন, তাতেও অনুসন্ধিৎসু আলােটি পড়েছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ওপর নয়, একাত্তরে যে গণহত্যা হয়, তা রােধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, ব্যর্থতার ওপর কিন্তু বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের যে ইতিহাস, তার প্রধান চরিত্র যেমন তার, তার কথকও সে নিজে, অন্য কেউ নয় বাঙালির অভিজ্ঞতা ও সম্মিলিত স্মৃতির ভিত্তিতে নির্মিত এই ইতিহাস। তার একমাত্র কুশিলব সে, অর্থাৎ বাঙালি, একথা আমি বলি না। কিন্তু জাতিরাষ্ট্রের জন্য বাঙালির সংগ্রামের এই ইতিহাস লিখতে হলে আসল নজর থাকতে হবে বাঙালির অভিজ্ঞতার ওপর সে অভিজ্ঞতার আনুপূর্বিক বিবরণ ও বিশ্লেষণ ছাড়া এই ইতিহাস কখনােই পূর্ণাঙ্গ হবে না। আমরা স্মরণ করতে পারি যে, ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজের হাতে আমাদের ইতিহাস লিখিত হয়েছিল। ইংরেজ দাবি করেছে, সভ্যতার দায়-দায়িত্ব নিয়ে সে উপমহাদেশে এসেছে, ফলে তার লিখিত ইতিহাসে নির্বিকার শশাষণের। বদলে শ্বেত প্রভুর সভ্যতার জয়ডংকা শােনা গেছে।
ম্যাকলের মতাে লেখকের হাতে যখন সে ইতিহাস লিখিত হয়, তাতে ইংরেজের নগ্ন শোষণের পক্ষে এক কৃত্তিম নৈতিকতার সাফাইও শােনা গেছে। আবার পাকিস্তানি আমলে যে নব্য উপনিবেশের সূচনা হয়, তাতে বিজাতীয় প্রভুদের হাতে রচিত ইতিহাসে বাঙালির স্থান হয় দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে, সেখানে বাঙালি চিত্রিত হয় ভীরু ও প্রভু তােষণ-প্রিয় জাতি হিসেবে এই সব সমীকরণই বদলে যায় একাত্তরে এই পরবর্তিত সমীকরণ, যার পেছনে রয়েছে বাঙালির দীর্ঘদিনের লড়াই, তার উদ্ভব আকস্মিক নয়। বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব হয়েছিল অনেক আগেই একাত্তরের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে অর্জিত হয় বাঙালির জাতিরাষ্ট্র সত্তার এই অর্জন তার নিজের, অন্তর্গত বােধন ছাড়া যে অর্জন অসম্ভব ছিল। বিদেশি লেখক বা চলচ্চিত্রকার, তা সে ভারতীয়, পাকিস্তানি বা আমেরিকান যেই হােক, বাঙালির আত্ম-আবিষ্কার ও আত্ম, নিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য দীর্ঘ সংগ্রামের ঘটনাবলি বিষয়ে অবহিত হলেও তার অনুভূতিক অভিজ্ঞতার অংশীদার তারা কখনােই হবে না। ঠিক এই কারণেই বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালিকেই লিখতে হবে অন্য যারা সে ইতিহাস লিখবে, উৎস হিসেবে তাদের বাঙালির লেখা সে আঁকর গ্রন্থের দিকেই হাত বাড়াতে হবে। এই ইতিহাস রচনায় বাঙালির অধিকার কেবল স্বতঃসিদ্ধ ও মৌলিকই নয়, বাংলাদেশের লেখক-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিকদের ওপর ন্যস্ত এক দায়িত্বও বটে।
সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস, সময় প্রকাশনী,২০১৬