You dont have javascript enabled! Please enable it!

আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া হলাে না

৩ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক শুরু। তার এক দিন পরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি সভা বসে, কী করা যায় তা বিবেচনা করতে। বাংলাদেশের পক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অনুরােধ করেছিলেন, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে তাঁকে বক্তব্যের সুযােগ দেওয়া হােক। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সে প্রস্তাব সমর্থন করলেও চীনের প্রতিবাদের মুখে তা বাতিল হয়ে যায় । পরিষদের এই সিদ্ধান্তে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি সমর সেন পরিহাস করে বলেছিলেন, এ যেন প্রিন্স অব ডেনমার্ক ছাড়া হ্যামলেট নাটকের মঞ্চায়ন। এই ব্যর্থ ভাষণের ইতিহাস বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৭১ সালে। সে সময় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধ। গুণগতভাবে এক নতুন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। প্রতিটি সামরিক সেক্টরেই পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সম্মুখসমর বিস্তৃত হচ্ছে। কোনাে কোনাে জায়গায় পাকিস্তান ও ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে সরাসরি সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে আসা উদ্বাস্তুদের সংখ্যা তখন প্রায় এক কোটি। বিশ্বের অনেক দেশ উদ্বাস্তু-প্রশ্নে সহানুভূতি ও বাংলাদেশ-প্রশ্নে তাদের শর্তসাপেক্ষ সমর্থন জানালেও এই সংকট সমাধানের কোনাে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানের দাবি ছিল সমস্যাটি তার অভ্যন্তরীণ, ফলে বিদেশি কোনাে হস্তক্ষেপ সে সহ্য করবে না। অন্যদিকে, ভারতের যুক্তি ছিল, উদ্বাস্তুদের অব্যাহত আগমনের ফলে সমস্যাটি এখন আর মােটেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এর একটি সুস্পষ্ট আন্তর্জাতিক চরিত্র আছে। আরও বৃহত্তর সংকট এড়াতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব রয়েছে। সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জাতিসংঘের, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় যার ভূমিকা সর্বাগ্রগণ্য।

প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিয়মিত অধিবেশন বসে। জাতিসংঘের সদস্য এমন প্রায় প্রতিটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান নিউইয়র্কে আসেন সাধারণ বিতর্কে অংশ নিতে। ফলে এই সময় | সারা বিশ্বের নজর থাকে জাতিসংঘের কার্যকলাপের ওপর। সে কথা মাথায় রেখে বাংলাদেশের পক্ষে কূটনৈতিক সমর্থন জোরদার করার এক উদ্যোগ গ্রহণ করে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার। সিদ্ধান্ত হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি দলকে পাঠানাে হবে নিউইয়র্কে। লক্ষ্য : জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশের পক্ষে লবি করা। সম্ভব হলে নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যােগাযােগ ও তাদের সমর্থন আদায় । বিচারপতি চৌধুরী ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেনেভায় এসেছিলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করতে। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। গণহত্যার কথা জানামাত্রই তিনি জেনেভা ছেড়ে লন্ডনে চলে আসেন। ২৭ মার্চ লন্ডনে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে এক বৈঠকের সময় গণহত্যার বিস্তারিত বিবরণ জানতে পেরে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এপ্রিলে মুজিবনগর সরকার গঠিত হলে তাকে বাংলাদেশের পক্ষে বিশেষ দূত নিয়ােগ করা হয় । তার ওপর দায়িত্ব বর্তায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন আদায়। আগস্ট ১৯৭১ সালে। তার নেতৃত্বে লন্ডনে স্থাপিত হয় বাংলাদেশ দূতাবাস। সেপ্টেম্বরের গােড়ার দিকে মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে তাকে জানানাে হলাে, ১৬ সদস্যের এক প্রতিনিধিদলের প্রধান হিসেবে তাঁকে নিউইয়র্কে যেতে হবে। তখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের প্রশ্নটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত হয়নি।

এই প্রশ্নে মহাসচিব উ থান্ট একাধিক বিবৃতি দিয়েছেন, ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যােগাযােগ করেছেন, একটি গােপন কূটনৈতিক উদ্যোগও নিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্নটি বিবেচনায় নিরাপত্তা পরিষদ একবারের জন্যও মিলিত হয়নি। সাধারণ পরিষদের একাধিক কমিটিতে তালিকাভুক্ত অন্য বিষয় নিয়ে বিতর্কের সময় পূর্ব পাকিস্তানের, বিশেষত তার উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে, কথা উঠেছে কিন্তু কোনাে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদ বা ইকোসকের বার্ষিক অধিবেশনেও পূর্ব পাকিস্তানের অবনতিশীল মানবিক অবস্থা ও ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালি উদ্বাস্তুদের সমস্যাটি আলােচিত হয়। কিন্তু সমস্যার রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি কার্যত উপেক্ষিত রয়ে যায়। বস্তুত, ভারতপাকিস্তানের বিপরীত অবস্থান ও নিরাপত্তা পরিষদের তিন স্থায়ী সদস্য- চীন, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অবস্থানের কারণে এই প্রশ্নে মতৈক্য অর্জন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

সেপ্টেম্বরে, সাধারণ পরিষদের ২৬তম অধিবেশনের ঠিক আগে আগে, মহাসচিবের বার্ষিক প্রতিবেদনে উ থান্ট বিষয়টি নিয়ে মন্তব্য করলেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না হলে এই সমস্যার যে সমাধান সম্ভব নয়, মহাসচিবের প্রতিবেদনে তার কোনাে ইঙ্গিত ছিল না। তার উদ্বেগ ছিল, এই সংকটের আশু সমাধান না হলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যাবে।  বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের ওপর অর্পিত দায়িত্ব ছিল। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-প্রশ্নে সমর্থন আদায়। ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং তাদের মিত্ররা ছাড়া তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে কোনাে স্পষ্ট রাজনৈতিক সমর্থন মেলেনি। সবচেয়ে বড় বাধা ছিল চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা।

জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র না হওয়ায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলটি জাতিসংঘের সদর দপ্তরে প্রবেশের আনুষ্ঠানিক অনুমতি পায়নি। ভারতের সাহায্য নিয়ে অথবা তাদের প্রতিনিধিদলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তারা সেখানে ঢুকতে পারতেন। কিন্তু আবু সাঈদ চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা সে পথে যাবেন না, কারণ তাহলে পাকিস্তানের হাতে সমালােচনার তৃণ তুলে দেওয়া হবে। জাতিসংঘ ভবনে প্রবেশের ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন ভারতীয় বাঙালি সাংবাদিক জি কে ব্যানার্জি। তিনি তখন জাতিসংঘে বিদেশি সাংবাদিকদের সমিতি ইউ এন করেসপন্ডেন্টস অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি। বিচারপতি চৌধুরী রােজ সকালে এসে অতিথি লবি থেকে ফোন করলে মি. ব্যানার্জি নিজে এসে তাঁকে ভেতরে নিয়ে যেতেন। বিচারপতি চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা প্রতিদিনই কোনাে না কোনাে বিদেশি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে যােগাযােগ করতেন। কখনাে লবিতে, কখনাে কোনাে সভাকক্ষে, কখনাে বা তাদের দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশ সমস্যার কারণ ও তার সমাধানের পথ কী, তা বুঝিয়ে বলতেন। এ ব্যাপারে বিচারপতি চৌধুরী তার নিকটতম সহকারী হিসেবে পেয়েছিলেন জাতীয় সংসদের নবনির্বাচিত সদস্য সৈয়দ আবদুস সুলতান এবং তরুণ কূটনীতিক মাহমুদ আলীকে। প্রতিনিধিদলের অন্য সদস্যদের ওপরও ছিল সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব। সেপ্টেম্বরে সাধারণ পরিষদের যে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্যার কারণ ও তার সমাধান তুলে ধরে।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং দাবি করলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীদের অতিথি গ্যালারিতে বসে সে ভাষণ শুনতে হলাে। সে আসনে বসে তারা বহুবার ভেবেছেন, মূল মঞ্চ থেকে কবে তারা নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরবেন। ক্ষীণ হলেও তেমন একটি সম্ভাবনা সৃষ্টি হলাে ডিসেম্বরের গােড়ার দিকে। ৩ ডিসেম্বর ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধ শুরু হলে তার পরদিন নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হয়। পরিষদের নয় সদস্য আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সােমালিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এক যৌথ চিঠিতে সে বৈঠকের অনুরােধ জানায়। বস্তুত, বাংলাদেশ-প্রশ্নে সেটিই ছিল নিরাপত্তা পরিষদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। পরিষদের বৈঠক বসছে, সে কথা জানার সঙ্গে সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে পরিষদের সভাপতি, সিয়েরা লিওনের আই বি টেইলার কামারার কাছে লেখা এক চিঠিতে পরিষদের সামনে বক্তব্য প্রদানের অনুরােধ জানালেন। বৈঠক শুরু হওয়ার আগেই সে চিঠির কপি নিরাপত্তা পরিষদের সব সদস্যের কাছে বিলি করা হলাে। ৪ ডিসেম্বর, শনিবার বিকেল পাঁচটায় নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠক শুরু হলাে। তাতে যে দেশগুলাে অংশ নেয় তারা হলাে: আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, চীন, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, পােল্যান্ড, সিয়েরা লিওন, সােমালিয়া, সিরিয়া, সােভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। পরিষদের সদস্য না হলেও ভারত ও পাকিস্তান বৈঠকে বক্তব্য দেওয়ার সুযােগ পায়।

নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের শুরুতে সােভিয়েত ইউনিয়নের স্থায়ী প্রতিনিধি ইয়াকফ মালিক প্রস্তাব দিলেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে পরিষদের সামনে বক্তব্যের অনুমতি দেওয়া হােক। বিচারপতি চৌধুরীর চিঠির সঙ্গে পরিস্থিতির বিবরণসংবলিত একটি নথিও বিলি করা হয়। ইয়াকফ মালিক বললেন, এই নথি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি সম্যক বুঝতে তা সাহায্য করবে। তিনি প্রস্তাব দিলেন, নথিটি নিরাপত্তা পরিষদের অন্যান্য নথির মতাে দলিল হিসেবে বিলির ব্যবস্থা করা হােক। বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করে তিনি বললেন, (এই দেশের একজন প্রতিনিধিকে পরিষদের সামনে বক্তব্য দিতে অনুমতি দেওয়া।সভার প্রথম বক্তা ছিল বেলজিয়াম। সােভিয়েত প্রস্তাবের আগে প্রদত্ত বিবৃতিতে সে দেশের প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত ভিসি জানিয়েছিলেন, নথি বিলির ব্যাপারে  তার কোনাে আপত্তি নেই, তবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বক্তব্য দেবে কি দেবে না, সে সিদ্ধান্ত আপাতত মুলতবি থাক। ইতালি, জাপান, সােমালিয়া, সিরিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিঠিটি বিলির ব্যাপারে তেমন আপত্তির কিছু নেই বলে জানাল। পরিষদের সদস্যদের কাছে বেসরকারি নথিপত্র বিলির নিয়ম অনেক আগে থেকেই চালু রয়েছে। কিন্তু বাধা উঠল বাংলাদেশের প্রতিনিধির উপস্থিতি নিয়ে। চীনের রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়া জানালেন, তথাকথিত বাংলাদেশ’, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের। অন্তর্গত ‘বিদ্রোহী অংশের কোনাে প্রতিনিধিকে যদি নিরাপত্তা পরিষদের কার্যক্রমে অংশগ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়, তাহলে সেটি হবে নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক সার্বভৌম পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ। এই কাজ জাতিসংঘ সনদের পরিপন্থী।

আমরা এই তথাকথিত বাংলাদেশের কোনাে প্রতিনিধির অংশগ্রহণ এবং তাদের কোনাে নথি নিরাপত্তা পরিষদে বিলি করার বিপক্ষে’, জানালেন হুয়া। সে কথার জবাবে পাল্টা যুক্তি দেখাতে অনুমতি চাইলেন ইয়াকফ মালিক। নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মবিধির ৩৯ নম্বর ধারা উদ্ধৃত করে তিনি বললেন, “পরিষদে বিবেচ্য কোনাে বিষয়ে সহায়তা করতে সক্ষম, এমন যেকোননা। ব্যক্তি, তা জাতিসংঘ সচিবালয় বা তার বাইরের হতে পারে, বক্তব্য দেওয়ার জন্য। আমন্ত্রিত হতে পারেন। এই নিয়ম দীর্ঘদিন থেকেই চালু আছে। চীনা প্রতিনিধি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলকে যে পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহী অংশ’ বলে চিহ্নিত করেন, সে কথা উল্লেখ করে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত প্রশ্ন তুললেন, এই বিদ্রোহী অংশ বা তাদের বিদ্রোহের সত্যাসত্য কে নিরূপণ করেছে? “এ ব্যাপারে আমাদের আরও ভালাে ধারণা হওয়ার জন্যই প্রয়ােজন। বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধির বক্তব্য শােনা। সাড়ে সাত কোটি মানুষ, যাদের । মধ্যে রয়েছে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী এক কোটি মানুষ, তাদের প্রতিনিধি হয়ে। এসেছেন (বিচারপতি চৌধুরী)। এই মানবগােষ্ঠী, যারা অভাবনীয় দুর্ভোগের। ‘ভেতর দিয়ে দিনাতিপাত করেছে, তাদের নিজস্ব বক্তব্য না শুনেই যদি তাদের। বিদ্রোহী বলা হয়, তাে তা হবে নেহাতই অপরিণত সিদ্ধান্ত। পরিষদের নয় সদস্য এক চিঠিতে পরিস্থিতি জটিল বলে জানিয়েছে, কিন্তু সত্যি সত্যি কী সেই সমস্যা, তার প্রকৃত চেহারা কী, তা জানতে হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য শােনা। অত্যন্ত জরুরি।” ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশে পাকিস্তানি সামরিক হামলার। নিন্দা করলেও তখন পর্যন্ত বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবিটি স্পষ্টভাবে। উত্থাপন করেনি। নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা। হস্তান্তর করলেই সংকটের নিরসন সম্ভব, এ কথা তারা উভয়েই বলেছেন।

কিন্তু একটা স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসেবে বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার রয়েছে, যে অধিকারের স্বীকৃতি রয়েছে জাতিসংঘ সনদে, সে কথা তারা কেউ বলেননি। ৪ ডিসেম্বরের বিতর্কে অংশ নিয়ে ইয়াকফ মালিক প্রথমবারের মতাে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বলে স্বীকৃতি দেন। তিনি বলেন : “আমরা যদি অস্ট্রিচ পাখির মতাে বালিতে মাথা গুঁজে থাকতে চাই, তা হলে এ নিয়ে ভাবার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তব সত্য যদি আমরা জানতে চাই, কেন এই দুই দেশের মধ্যে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দিয়েছে, তাহলে এই সংকটের মূল কারণ জানতে হবে। এই ঘটনা ও তার কারণ নিরূপণ করতে হবে। তা না করে অবশ্য আমরা ভিন্ন পথেও যেতে পারি। আমরা বিদ্রোহ বা বিদ্রোহীদের কথা বলতে পারি। কিন্তু এই যে বিদ্রোহ, জাতিসংঘের নিজস্ব পরিভাষায় তা অন্যভাবেও বর্ণনা করা যায়। আর তা হলাে জাতীয় মুক্তিবাহিনী (ন্যাশনাল লিবারেশন। ফোর্সেস) ও জাতীয় মুক্তি আন্দোলন (ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্ট)। উত্থাপিত প্রসঙ্গগুলাে আমরা এভাবে একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে পারি।”

ইয়াকফ মালিক পরিহাস করে বললেন, “সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি যখন তাঁর বক্তব্য শােনার অনুরােধ করেন, তাদের ‘বিদ্রোহী’ নামে অভিহিত করে কথা বলার সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা দুঃখজনক। সােভিয়েত ইউনিয়নের মতে এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণযােগ্য নয়।” ভারতের প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত সমর সেন সােভিয়েত প্রস্তাব সমর্থন করে বলেন, বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে এই বৈঠকে বক্তব্য দিতে দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। বাঙালিরাই সমস্যার কেন্দ্রে, তারাই দুর্ভোগের শিকার। যদি পরিষদ সমস্যার প্রকৃত চেহারা জানতে চায়, তা হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধির বক্তব্য শােনাই যুক্তিযুক্ত। “আমরা যদি বাংলাদেশের কী বক্তব্য তা না জানি, তাহলে কী নিয়ে আমরা কথা বলব? সমর সেন ব্যঙ্গ করে বললেন, ‘বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে এই প্রশ্ন নিয়ে আলােচনা হবে প্রিন্স অব ডেনমার্ককে বাদ দিয়ে হ্যামলেট নাটকের অভিনয়।”

মূল বিতর্কে অংশ নিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেন বাংলাদেশের প্রশ্নটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও বিপ্লবের বৃহত্তর পটভূমিতে যেভাবে ব্যাখ্যা করেন, তা ছিল যুক্তিনির্ভর ও আবেগবিবর্জিত। বাংলাদেশ-প্রশ্নে জাতিসংঘে ভারতের প্রতিনিধিরা এর আগেও সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরেছেন। কিন্তু যুক্তির চাতুর্যে ও বক্তব্যের গাম্ভীর্যে সমর সেনের এই ভাষণ ছিল স্মরণীয়। পাকিস্তানের বিগত ইতিহাসের বিস্তৃত ব্যাখ্যার পর তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ (পশ্চিম) পাকিস্তানের শােষণ ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। তার কথায় : There is complete domination, complete subjugation, complete military butchery. Against that, the people revolted. বাংলাদেশের প্রতিনিধিকে কেন বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়নি, সে কথা এক লিখিত বক্তব্যে ব্যাখ্যা করেন পরিষদের সভাপতি রাষ্ট্রদূত কামারা। একটি সংযােজনী নথিসহ বাংলাদেশের প্রতিনিধির একটি চিঠি তিনি বৈঠক কক্ষে প্রবেশের আগ মুহূর্তে পেয়েছেন এবং সে চিঠি ও সংযােজনীর অনুলিপি সব সদস্যের মধ্যে বিতরণের নির্দেশও তিনি দিয়েছেন। তিনি প্রস্তাব করেন, সেই নথি বিলি না হওয়া পর্যন্ত এই প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা মুলতবি থাক। বাংলাদেশ প্রতিনিধির অংশগ্রহণ-প্রশ্নে এটি ছিল পরিষদ সভাপতির রুলিং বা নির্দেশ। বেলজিয়াম, সােমালিয়া ও সিরীয় প্রতিনিধি এ ব্যাপারে পরিষদ সভাপতির সিদ্ধান্তে সমর্থন জানান। কিন্তু সােভিয়েত প্রতিনিধি শুধু টেকনিক্যাল কারণে বিষয়টি বিবেচনা বিলম্বিত না করে তা নিয়ে অবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দাবি তােলেন। অন্য কথায়, সােভিয়েত প্রতিনিধি পরিষদ সভাপতির সিদ্ধান্তের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানালেন। এমন পরিস্থিতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব বর্তায় পরিষদের সব সদস্যের ওপর।

বিধি মােতাবেক তার রুলিং’-এর ওপর অনতিবিলম্ব সিদ্ধান্তের জন্য সব প্রতিনিধির মতামত আহ্বান করেন রাষ্ট্রদূত কামারা। কিন্তু কেউ এ নিয়ে নতুন কোনাে বক্তব্য না দিলে তিনি তার গৃহীত সিদ্ধান্ত বলবত রইল বলে ঘােষণা করেন। এরপর অবশ্য সােভিয়েত প্রতিনিধি এ নিয়ে আর কোনাে প্রশ্ন তােলেন নি। বিতর্কের পরবর্তী পর্যায়ে তার রুলিংয়ের ব্যাখ্যা হিসেবে রাষ্ট্রদূত কামারা জানান, বাংলাদেশ প্রতিনিধির যে চিঠি তিনি পেয়েছেন তাতে পরিষদের সামনে বক্তব্য দেওয়ার অনুরােধ জানানাে হয়েছে, কিন্তু তারা যে এ বৈঠকে বক্তব্য দিতে চান, সে কথার উল্লেখ নেই। সােভিয়েত প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে বক্তব্য দেওয়ার পক্ষে যেভাবে জোর দাবি জানান, বিশেষত পরিষদের সভাপতি এ ব্যাপারে তার রুলিং দেওয়ার পরও প্রসঙ্গটি নতুন করে তােলা, বেশ বিস্ময়কর। কোনাে সন্দেহ নেই, সুচিন্তিত কূটনৈতিক উদ্যোগের অংশ হিসেবেই সে চেষ্টা চালানাে হয়। তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রশ্নটি হয় উদ্বাস্তু সমস্যা, নয় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পুরােনাে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিচিত কাঠামাের ভেতরেই আলােচিত হয়েছে। পাকিস্তানের কাঠামাের ভেতরেই এই সংকটের সমাধান সম্ভব, সে ব্যাপারে সবাই দৃশ্যত একমত ছিল। নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠক থেকেই ভারত ও সােভিয়েত অবস্থানের গুণগত পরিবর্তন লক্ষিত হয়। বাংলাদেশের মানুষের লড়াই উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অন্তর্গত, ফলে পূর্ণ স্বাধীনতা। ছাড়া এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়, ভারত ও সােভিয়েত প্রতিনিধি উভয়েই সে কথা বললেন। বিতর্কের পরবর্তী পর্যায়ে চীনা রাষ্ট্রদূত হুয়াং হুয়ার সঙ্গে ইয়াকফ মালিকের মধ্যে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিয়ে তর্ক হয়। সেখানেও সােভিয়েত প্রতিনিধি লেনিনের উদাহরণ তুলে জানান, তার দেশ বরাবর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছে।

এ কথা অনুমান করা কঠিন নয়, নিরাপত্তা পরিষদের ভাষণ দানের অনুরােধটি বিচারপতি চৌধুরী ও তাঁর দল ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সলাপরামর্শ করেই করেছিলেন। বাংলাদেশের এই দুই ঘনিষ্ঠ মিত্রের জন্য তাঁর ভাষণ প্রস্তাব ছিল তাদের কূটনৈতিক রণকৌশলের একটি নবতর পর্যায়। তারা উভয়েই জানতেন, ‘বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষণ দেওয়া সম্ভব হলে তা হবে পাকিস্তানের গালে বেশ জোরেশােরে একটি চড়। তার চেয়েও বড় কথা, এর ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অস্তিত্বের স্বীকৃতি অর্জনের। পথে আরও একটি পদ্ধতিগত অন্তরায় অতিক্রম করা সম্ভব হবে। পাকিস্তান এবং তার নিকট মিত্র চীন সে কথা খুব ভালােভাবেই বুঝতে পেরেছিল। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আগা শাহি তার দেশের পক্ষে বক্তব্য দিতে গিয়ে বাংলাদেশ। প্রতিনিধিদলের পরিষদে অংশগ্রহণের তীব্র বিরােধিতা করে বলেন, বাংলাদেশের নামে যে নথি বিলি করা হয়েছে, তা ভারতের কারসাজি। বাংলাদেশ সরকারের নামে যা গঠিত হয়েছে, তা কলকাতায় ভারতের তত্ত্বাবধানে ও নির্দেশে পরিচালিত। এই সরকারের প্রতিনিধিকে যদি নিরাপত্তা পরিষদে অংশগ্রহণের সুযােগ দেওয়া হয়, তাহলে এক লহমায় জাতিসংঘের এক সদস্যের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগােলিক সংহতি নস্যাৎ করা হবে। শেষ পর্যন্ত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী নিরাপত্তা পরিষদের সামনে তার বক্তব্য দিতে পারেননি। কিন্তু তাঁর বক্তব্য দেওয়ার সূত্র ধরে যে বিতর্ক হলাে, তাতে স্পষ্ট হয়ে গেল বাংলাদেশের প্রশ্নটি শুধু উদ্বাস্তুবিষয়ক একটি সমস্যা নয়। কে আমাদের বন্ধু, কে আমাদের শত্রু-এই বিতর্কে সেই সত্যটিও নতুন করে আলােকিত হলাে। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ছিল জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে সােভিয়েত প্রতিনিধির বাঙালির সংগ্রামকে তৃতীয় বিশ্বের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি। অবশ্য এই বিতর্কের ১০ দিনের ভেতরেই পরিস্থিতি আমূল বদলে যাবে। পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের ভেতর দিয়েই অর্জিত হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস,  সময় প্রকাশনী,২০১৬

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!