You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.17 | যৌবনের সঙ্কট : বাংলাদেশ- অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায় | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

যৌবনের সঙ্কট : বাংলাদেশ
অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়

যুব বিদ্রোহ, যুব অসন্তোষ বা ছাত্র বিদ্রোহ আজ যেমন সারা বিশ্বের ঘটনা, তেমনি বিশেষ করে বাংলাদেশেরও ঘটনা। আর এ ব্যাপারে ধনতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ভারতের মতাে দো-আশলা কোনাে দেশই ব্যতিক্রম নয়- যারা কর্তা, ক্ষমতায় আসীন তাঁদের প্রসঙ্গে আমলাতন্ত্রের বিপক্ষে, সমগ্র সমাজের অযৌক্তিকতার প্রতিবাদে যৌবনের বিক্ষোভ, বিদ্রোহ নতুন টেনশনের সৃষ্টি করেছে, তাতে কিছুমাত্র সন্দেহ নেই এবং একমাত্র চীনেই বােধহয় কর্তৃত্বের উচ্চতম পর্যায় থেকে এই যুব বিদ্রোহকে উৎসাহিত করা হয়েছে, বম্বৰ্ড দি হেড কোয়ার্টার্স বলে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এই বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য এই যে, সর্বদা অর্থনৈতিক বৈষম্য বা দারিদ্রেই যে কারণ হিসেবে এখানে ক্রিয়াশীল, তা নয়, অন্যান্য আরও বহু চাপ ভাবাদর্শগত সংঘাত বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা, বা যৌবনের নিয়ম ভাঙার প্রবণতা, অ্যানার্কিস্ট ঝোঁক এর পিছনে অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে অথবা মার্কস-কথিত চূড়ান্ত সামাজিক তথা নৈতিক বিষঙ্গীকরণ বা অ্যালিয়েনেশনও বিক্ষোভে বিদ্রোহে নিয়ে যাচ্ছে, অস্তিত্ববাদী ভাবনাও পশ্চিমে এ ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই কার্যকর। কিন্তু অনুন্নত দেশগুলােতে এই যুব বিদ্রোহ মূলত তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপন থেকেই উঠে আসছে— প্রত্যক্ষ চতুর্দিকে পরিকীর্ণ দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক সঙ্কট পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করছে এখানে নিশ্চিতভাবে, এর সঙ্গে আরও নানা প্রসঙ্গ অবশ্যই জড়িত। তবে বাংলাদেশে যুব বিদ্রোহ বা ছাত্র বিক্ষোভ প্রধানত একটি শ্ৰেণীর ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। এখনও পর্যন্ত বিদ্রোহের মূল প্রােথিত হয়ে আছে শহরের অকৃষিজীবী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে। বস্তুত বিশের শতকের গােড়া থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তশ্রেণীর, আরও ঠিকভাবে বলতে গেলে, যাকে আধুনিক সামাজিক ঐতিহাসিকরা ভদ্রলােক’ বলছেন, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, কলােনীর ক্লেদাক্ত বিকাশ এবং সর্বোপরি ব্যর্থতাই এই যুব বিদ্রোহের পটভূমি রচনা করেছে। নেহরুর প্রথম পঞ্চবার্ষিকের স্বর্ণগােধূলির পর হতাশ এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উত্তর-স্বাধীনতার বংশধররা ইতিহাসের নিয়মেই জ্বলে উঠেছে, তার পিতৃ-পিতামহের সমগ্র উত্তরাধিকারকেই অস্বীকার করতে চাইছে- এমনকি বাঙালি মধ্যবিত্তের উনিশের শতকের যে উৎসমূল, রামমােহন, বিদ্যাসাগর তারাও অস্বীকৃত হচ্ছেন বর্তমানের যৌবক্রোধে, বাঙালি মধ্যবিত্তের নিজেদেরই স্বার্থে এতাবৎ তাদের বিকৃত ব্যবহারের প্রতিক্রিয়ায়।
বাঙালি মধ্যবিত্তর জন্ম কোনাে স্বাধীন বুর্জোয়ার মুক্তি প্রচেষ্টায় নয়, এমনকি কলােনীর সীমার মধ্যেও স্বদেশীয় উদ্যোগেও নয়, নিতান্তই ইংরেজির শিক্ষার সুযােগ নিয়ে চাকরির আশায়, নিজস্ব স্ট্যাটাস বাড়ানােয়। তাদের জাতি বর্ণগত শ্ৰেণীগত স্বার্থ যতদিন বৃটিশ সরকার রক্ষা করেছে ততােদিনই বাঙালি ভদ্রলােকেরা সহযােগিতা করেছে। আর এই সহযােগিতায় অন্য জাতি বর্ণ বা শ্রেণীর স্বার্থবিরােধিতায় তারা কুণ্ঠ ছিল না। বস্তুত উনিশের শতকের শেষের দিকে বৃটিশ রাজ ও তার শিক্ষিত প্রজাদের। স্বার্থগত ফাক উপস্থিত হওয়াতেই আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সূত্রপাত। কলকাতা, বােম্বাই, মাদ্রাজের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তিবৃন্দ একই সঙ্গে সাধারণ জাতি বর্ণ ধর্ম এবং শিক্ষা ও রাজনৈতিক মত নির্ভর সংগঠনের সভ্য ছিল- অর্থাৎ শাসকদের ভাষায় অর্থাৎ ইংরেজিতে শিক্ষিত হওয়াই এখানে বড় কথা ছিল। বাংলাদেশে এই শিক্ষার প্রথম সুযােগ নিয়েছিল ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও বৈদ্যরা- বস্তুত একই সঙ্গে উচ্চবর্ণ ও উচ্চশ্রেণীর দ্রলােকরা। এই ভদ্রলোেকরা সাধারণ ধর্ম, ভাষা, সামাজিক প্রতিপত্তির দ্বারা ঐক্যবদ্ধ ছিল-আর শিক্ষা, উচ্চবর্ণ, অনেক ক্ষেত্রেই অর্থসম্পদ তাদের সমাজের জন্য স্তর থেকে তাদের পৃথক করেছিল। তাদের অপ্রাকৃত ভাষা, জমি থেকে মুনাফা জনসাধারণ থেকে কৃষকদের থেকে দূরে নিয়ে গিয়েছিল- স্পষ্টতই বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্ম বৃটিশ সরকারের আমলাতান্ত্রিক উৎসাহে, ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে চাকরির উন্নতির, কেরিয়ার তৈরির আশায় জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতায়, প্রায় নিজ বাসভূমে পরবাসী হওয়াতে। অবশ্য এই ইংরেজি শিক্ষার উৎসাহই এসেছিল ১৭৯৩-এর চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর ভূমি অর্থনীতির বিচিত্র দুর্দশায়, ভাঙনে। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী যেহেতু বৃটিশ সরকারের কলােনীয় নীতির অন্যতম ফল তাই তাদের চাকরিগত হতাশা যখন দেখা দিল, তখনও তীব্র সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী তারা হতে পারল না, কারণ কেবল চাকরি পাওয়ার জন্য যে শ্রেণীর উত্থান, তার এত বড় ভূমিকা পালনও সম্ভব নয়। বস্তুত জন্মক্ষণ থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্তের শিক্ষা, চিন্তা, ভাবনা এই চাকরি, কেরিয়ার নিয়ন্ত্রিত। তাই সে একদিকে শেষ পর্যন্ত বৃটিশ সরকারের যেমন বদ্ধমূল ভৎর্সনাকারী’, তেমনি বিশিষ্ট সেবাইত’ও বটে। (অনিল শীলের দি ইমার্জেন্স অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম গ্রন্থটি দ্রষ্টব্য।)
এই বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলােক শ্রেণী প্রথমাবধিই কোনাে প্রকৃত জাতীয় আন্দোলনের পথে না গিয়ে আইনসভার রাজনীতিতে আস্থা রেখেছিল। তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষাই ছিল, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক শক্তির ভিত্তিই ছিল আমদানি করা আমলাতান্ত্রিক, শিক্ষাবিভাগ, আইনসভা প্রভৃতি লিবারেল প্রতিষ্ঠন সমূহে সাফল্যের সঙ্গে অংশগ্রহণ করায়। এই সাফল্যের মূলকথা ছিল বৃটিশ আমলে প্রাপ্ত নতুন স্ট্যাটাসকে বজায় রাখা, সংস্কার ইত্যাদি এমনভাবে করা যাতে সমাজের অন্য স্তরের ব্যক্তিরা যেন সামনে না আসতে পারে।
তাই ভােটাধিকারের সীমা বাড়ানােতে তাদের ছিল ঘােরতর আপত্তি। বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের সময়ই এই ভদ্রলােকেরা জনসমর্থন সেভাবে জোগাড় করতে পারেনি, কারণ জনগণের সঙ্গে তাদের কোনাে যােগাযােগের মাধ্যম ছিল না। বৃটিশদের কাছ থেকে শেখা আইনসভা ইত্যাদির রাজনীতি প্রথমাবধিই জনসাধারণের কাছে বাধার সৃষ্টি করেছিল। বস্তুত এই সেদিন পর্যন্ত বাঙালি ভদ্রলােকের নেতৃত্বে বামপন্থী দলগুলােও গ্রামাঞ্চলে কিছু করতে পারেনি, তার মূল এই মধ্যবিত্তর বিকাশের মধ্যেই নিহিত। তার ওপর পাশ্চাত্য শিক্ষায় পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় অভ্যস্ত এই ভদ্রলােক শ্রেণীর বহু সাধারণ বক্তব্যও অভদ্রলােকদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল। তারা যে জাতীয়তা, রাষ্ট্র, স্বাধীনতা, ইত্যাদি ধারণার কথা বলত কৃষকদের কাছে তার অর্থই ছিল না। কারণ কৃষকরা শােষক হিসেবে প্রত্যক্ষত জমিদারদেরই অর্থাৎ অনেক ক্ষেত্রে ঐ ভদ্রলােকদেরই দেখত। তদুপরি মুসলমান সমাজের ক্ষেত্র তাদের রাজনীতি, তাদের চিন্তাভাবনা আরও সঙ্কটের সৃষ্টি করেছিল। আসলে যদিও ভদ্রলােক শ্রেণীর সঙ্গে জমির সূত্রে গ্রামের সংযােগ ছিল, তথাপি তাদের শ্রেণীস্বার্থেই তারা কৃষকদের রাজনৈতিক সমর্থন সংগ্রহ করতে পারেনি। ছােটলােকদের থেকে সর্বক্ষণই দূরে থেকেছে। অর্থাৎ বুর্জোয়া নেতৃত্বে যে দেশব্যাপী আন্দোলনের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতায় অঙ্কুরিত হবার সম্ভাবনা থাকে তাও এই ভদ্রলােকদের, মধ্যবিত্তদের ক্ষমতায় ছিল না। বস্তুত তাদের জাতীয় চেতনাও তাই হয়ে দাঁড়ায় ফ্রানোর ভাষায় “An empty shell, a crude and fragile travisty of what it might have been”
বলাই বাহুল্য, এই ভদ্রলােক মধ্যবিত্ত শ্রেণী বিশের শতকের কুড়ির দশক থেকেই তাদের ক্ষমতার সঙ্কট দেখতে শুরু করে উনিশশ ছাব্বিশের পর থেকেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হলাে তাতে হিন্দু ভদ্রলােকদের আশার যুগ শেষ হতে চলল। উনিশশ পাঁচ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ও উনিশশ বারাে খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ যুক্ত হওয়ার সাফল্যে বাঙালি ভদ্রলােক যে ক্ষমতার স্বপ্ন দেখেছিল, তা উনিশশ তিরিশ-এর দশকে ভাঙতে শুরু করে। প্রাদেশিক আইনসভা, নানা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের চলে আসতে হলাে। তদুপরি গান্ধীর রাজনীতি নিদারুণ আঘাত হানল এই ভদ্রলােক এলিটদের ক্ষমতার ভিত ধরে। আসলে নিজ বাসভূমে পরবাসী এই শ্রেণী যুক্তবঙ্গে তাঁদের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন শুরু করেছিল, তা চুরমার হয়ে গেল সাতচল্লিশ-এর দ্বিতীয় বঙ্গভঙ্গে। উনিশশ তেতাল্লিশ-এর বারােই ফেব্রুয়ারি শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায় তার পদত্যাগের কারণ যেভাবে বর্ণনা করলেন তাতেই বােঝা গেল যে, যে আইনসভার রাজনীতিতে হিন্দু ভদ্রলােক তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বেঁধেছিল তার ওপর তারা আস্থা হারিয়েছে। বাংলার ভবিষ্যতের সম্পর্কে প্রধান সিদ্ধান্তগুলােকেও তারা আর প্রভাবিত করতে পারবে না। শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের রাজনীতিই হিন্দু ভদ্রলােকের সঙ্কটকে তীব্রভাবে দেখায় হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণে চেষ্টা চালালেন প্রথমে আইনসভায় ও পরে কর্পোরেশনে, ব্যর্থ হলাে, অন্যবিধ উত্তেজনায় বিক্ষোভে। সাতচল্লিশ-এ স্বাধীনতার সময় বাঙালি ভদ্রলােক হতাশ, বিরক্ত এবং বিক্ষুব্ধ। (বাঙালি ভদ্রলােকের এই রূপান্তরের জন্য যে এচ ব্রমফিল্ড-এর এলিট কনফ্লিকেট ইন এ পুর্যাল সােসাইটি | টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি বেঙ্গল দ্রষ্টব্য। আর শ্যামাপ্রসাদ মুখােপাধ্যায়ের জন্য বি ডি গ্রাহাম-এর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি এন্ড দি কনালিস্ট অলটারনেটিভ প্রবন্ধ।)
বর্তমান বাংলাদেশের যুব বিদ্রোহের পশ্চাতে এই ভদ্রলােক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উৎপত্তি গঠন, দৃষ্টিভঙ্গী, তার আশা ও ব্যর্থতার পটভূমি সর্বদাই স্মরণীয়। এই ধরনের শ্রেণীর মধ্যে সর্বদাই দোটা লিবারেল কনস্টিটিউশনালিস্ট এবং রােমান্টিক রেভােলিউশনারির মধ্যে দ্বন্দ্ব এই ভদ্রলােক শ্রেণীর অবশ্যই আসবে। কারণ যখনই পরিষদীয় রাজনীতির নানা কাটাকুটিতে তারা হতাশ হয়ে ব্যর্থ হয়, তখনই চমকে চমকে ওঠে পরিষদের বাইরে আন্দোলনের ঝোঁক, কখনও সশস্ত্র সন্ত্রাস। বস্তুত আমাদের সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন বা টেররিস্ট মুভমেন্ট ভদ্রলােকের ঐ রােমান্টিক বিপ্লবীর বিদ্যুৎ চমক- তাদের নির্ভীকতা, আত্মত্যাগের আদর্শ অবশ্যই স্মরণীয়, স্মরণীয় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়দের তাদের ডাকাত প্রতিপন্ন করার চেষ্টা- কিন্তু এ সন্ত্রাসও নিতান্তই হতাশ হয়ে, প্রতিক্রিয়ায়, জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভদ্রলােক রাজনীতির সীমার মধ্যেই। বিবেকানন্দ, বঙ্কিমচন্দ্রের রচনার প্রেরণা ভদ্রলােকের সীমা লঙ্ঘনে সহায়তা করতে পারেনি। ভদ্রলােকের বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে কৃষক সাধারণের সঙ্গে সংযােগে নতুন আত্মপ্রতিষ্ঠার কোনো প্রচেষ্টাই এদের মধ্যে ছিল না। ছিল না বলেই গান্ধীর আন্দোলনের সামনে তারা শেষ পর্যন্ত টিকতে পারল।
বস্তুত বাংলাদেশের গান্ধী বিরােধিতা নতুন নয়- সেই উনিশশ বিশ থেকেই। এ বিরােধিতার মূল কেবল বাংলার দ্রলােক নেতৃত্বের সর্বভারতীয় নেতার আশাভঙ্গেই নেই- সুরেন্দ্রনাথ বা চিত্তরঞ্জন দাশ গান্ধীর নেতৃত্বের সামনে, তাঁর সর্বভারতীয় ইমেজের সামনে দাঁড়াতে পারেন নি, এ কথা ঠিকই। এ কথাও ঠিক, গান্ধীর উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে সর্বভারতীয় স্তরে বাঙালি ভদ্রলােকের রাজনৈতিক প্রভাব কমতে থাকে, গান্ধীকে কেন্দ্র করে ধীরে ধীরে উনিশশ সাত খ্রিস্টাব্দে লেবার দলের এমপি কের হার্ডি যে উত্তরপ্রদেশে রাজনৈতিক সচেতনতা সর্বাপেক্ষা কম দেখেছিলেন, সেই উত্তর প্রদেশেই ক্রমশ প্রভাবশালী হয়ে উঠতে থাকে। কিন্তু বাঙালি মধ্যবিত্তের ভদ্রলােকের গান্ধী বিরােধিতার মূল আরও গভীরে। তিলক ইত্যাদির চরমপন্থা এবং মডারেটদের রক্তহীন সংবিধানসম্মত আবেদন নিবেদন এই দুই থেকেই গান্ধীর রাজনীতি ভারতীয় কংগ্রেসকে মুক্তি দিয়েছিল। গান্ধীর নেতৃত্ব পাশ্চাত্যভাবাপন্ন বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি আবার সাধারণ কৃষক—এই সবের এক বিচিত্র সংমিশ্রণ। তাঁর অহিংসা বাঙালি ভদ্রলােকের সন্ত্রাসের সম্পূর্ণ বিপরীত, অন্যদিকে তার প্রাচীন গ্রাম-সমাজেও পুনরুজ্জীবন আস্থা, পােশাকে বাহ্যিকভাবে ভারতীয় কৃষকের আদর্শকে বড় করা এ সবই বাঙালি ভদ্রলােকের সমস্ত ধ্যানধারণা মূল্যবােধের প্রচণ্ড প্রতিবাদ। অবশ্যই নিরুপায় হয়ে বলপূর্বক কৃষকদের নিজেদের দাবির প্রতিষ্ঠাকে তিনি ফ্যাসিজম বলেছিলেন, উনিশশ ছেচল্লিশ সালেও আশঙ্কা করেছিলেন হয়তাে স্বাধীন ভারতবর্ষে জমিদারদের বিলােপ সাধন করা হবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তি, শ্ৰেণী-সংগ্রাম ইত্যাদি সম্পর্কে সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে নিন্দা করতেও তিনি পিছপা হন নি। তবু কৃষকদের সম্পর্কে তার বক্তব্য নিঃসন্দেহে বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকদের স্বার্থ বিরােধী মনে হয়েছিল, তারা প্রাণপণে যে কোনাে কৃষক স্বার্থের অনুকূল আইন-কানুনের বিরােধিতা করছিল। আবার ভারতের ধনিক শ্ৰেণীরও গান্ধীর মতবাদে ঘাবড়াবার কিছু ছিল না, তার বাই ইন্ডিয়ান’-এর সূত্র বৃটিশ প্রতিযােগিতাকেই কমাতে সাহায্য করেছিল : বা গান্ধীর শ্রমিকদের ধর্মঘট বিরােধিতাতেও তারা খুশি ছিল। স্বাধীনতার পর খাদ্য ইত্যাদির মূল্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ব্যবসায়ীরা যে আক্রমণ শুরু করে প্যাটেলের মাধ্যমে এবং নেহরুপ্যাটেল মতবিরােধ শুরু হয়, তাতে গান্ধী প্যাটেলকেই সমর্থন করেন। বস্তুত গান্ধীর নেতৃত্ব, অহিংস আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়ী শ্রেণীরা গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করে। বস্তুত গ্রামে গ্রামে কৃষকদের মধ্যে কংগ্রেসী প্রভাব সেখান থেকেই গড়ে ওঠে। বলাই বাহুল্য, বাঙালি ভদ্রলােক নেতৃত্বের মূল সীমাবদ্ধতাই ছিল এটা তাদের সব আন্দোলন কলকাতা ও শহরেই সীমায়িত, এমনকি এই ভদ্রলােক নেতৃত্বেই যখন বাংলার বামপন্থী, কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে, তখনও এই বাঙালি ভদ্রলােকের গ্রামবিমুখতা থেকেই যায়, কলকাতা ও তার আশেপাশেই তাদের প্রভাব মূলত গড়ে ওঠে। সুতরাং গান্ধীর প্রতি এই গভীর কারণেই বিরােধিতার বীজ বাংলার মাটিতে গড়ে ওঠে। বর্তমানে গান্ধী বিরােধিতা নিয়ে যখন বিরাট হৈ চৈ-এর সময় এই কথা সর্বদাই স্মরণে থাকা উচিত। অবশ্য বর্তমানের গান্ধী বিরােধিতার তফাৎ আছে। কিন্তু এই বিরােধিতা প্রাথমিকভাবে বাঙালি মধ্যবিত্তের ইতিহাস থেকেই এসেছে। (গান্ধী সম্পর্কে মতামত ব্যারিংটন মুরের সােস্যাল অরিজিনস অব ডিকটেটরশিপ এ্যান্ড ডেমােক্রেসি থেকে নেওয়া)।
সাতচল্লিশে বাঙালি হতাশ, তিক্ত, অতীত সাফল্যের স্মৃতিবাহী, পারিপার্শ্বিকের ওপর নিয়ন্ত্রণহীন তাদের সব মূল্যবােধের কার্যকারিতা তখন অবসিতপ্রায়। স্বাভাবিকভাবে সাতচল্লিশ-এর পর যাদের জন্ম বা যারা যুবক হয় তারা মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে এই নপুংশক অবস্থাকেই পেলচাকরি নির্ভর স্ট্যাটাস সন্ধানী বিচ্ছিন্ন দ্রলােক মধ্যবিত্ত তার নতুন পুরুষদের জন্য ভগ্ন শিকড়হীন উদভ্রান্তিকেই রেখে গেল। লক্ষণীয় বিষয়, এই পরবর্তী পুরুষদের, এ সরকার যুবকদের বিদ্রোহ ক্রোধ অন্যতম প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে সেই শিক্ষাব্যবস্থার ওপর, যে শিক্ষা একদা মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকের জন্মলগ্নে উপরে ওঠার অন্যতম প্রধান বা একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল। পঙ্গু ভদ্রলােক উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করার প্রাথমিক ধাপেই তাদের একমাত্র মূলধন শিক্ষা, কলােনীয় উত্তরাধিকারকেই তারা প্রত্যক্ষ আঘাত হানতে চাইল। বস্তুত চাকরি তৃষিত মধ্যবিত্তের এই ক্ষুব্ধ যুবকদের বিদ্রোহের পশ্চাতে একে একে চাকরির সব দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া খানিকটা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ব্যাপারটা কেবল চাকরি না পাওয়ার বলে অনেকে যে ব্যাখ্যা করে তা ঠিক নয়। মনে রাখতে হবে, বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে চাকরি তার আত্মপ্রতিষ্ঠার অঙ্গ। প্রশ্ন উঠতে পারে, উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে ক্রমে কমে মধ্যবিত্ত ভদ্রলােক আরও হতাশায় নিমজ্জিত সন্ত্রস্ত, তখন যুবকরা বিদ্রোহে ফেটে পড়তে চাইল, কেন, তাদের বিদ্রোহের উৎস কোথায়? প্রথমে স্মরণীয়, যৌবনের সাধারণভাবেই সঙ্কট আসে ইগাে-ইন্টিগ্রিটির আত্মকৈবল্যের-ব্যক্তিগত জীনের পর্বে পর্বে এই সঙ্কটই মুভি চায় বৃহত্তর কিছুর সঙ্গে চার্চ, ধর্ম, পার্টি ইত্যাদির সঙ্গে একাত্মবােধে। ইতিহাসের কোনাে না কোনাে শক্তির সঙ্গে ঐক্যচেতনায়। সাতচল্লিশ-এর পর মধ্যবিত্ত যুবকদের তাদের ব্যক্তিগত ও সমাজগত আত্মপ্রতিষ্ঠার, নিজে উত্তীর্ণ হবার পথ সামনে ছিল না। ধর্ম, সমাজ, পারিপার্শ্বিক, নিজ শ্রেণী সবই তার আত্ম-অভিজ্ঞান আবিষ্কারের পরিপন্থী। সে অবক্ষয়ী হতাশ এক শ্রেণীর ধারাকে বহন করছে; অন্যদিকে যে চাকরি মধ্যবিত্তর অভিজ্ঞান আবিষ্কারের বাংলাদেশে একমাত্র পথ নির্ধারিত হয়েছিল, তাও হারালাে স্বাধীনতার পর। অর্থাৎ সমস্ত সঙ্কট এল বাঙালি যুবকদের, যৌবনের এই ইগােইন্টিগ্রিটির সমস্যায়। বস্তুত এ ব্যাপারে বিভিন্ন বামপন্থী দলগুলােও কোনাে সাহায্য করতে পারল না। প্রথমত, তাদের প্রত্যেকের ছাত্রশাখা থাকলেও, এই সমস্যা সম্পর্কে কোনাে সচেতনতা ছিল না। দ্বিতীয়ত, এই দলগুলােও মােটামুটি ভদ্রলােক নেতৃত্ব সমম্বিত, ভদ্রলােক দোটানায় কখনও দারুণ সংবিধান সম্মত, কখনও আচমকা বিপ্লবী ভাবভঙ্গির ধাক্কায় ধাক্কায় চলেছে। ফলে উনিশশ ষাট-এর দশকে সচেতন যুবকদের কাছে এসব পার্টিরও তাৎপর্য হারিয়েছে তদুপরি ফ্রান্স, ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী সাম্যবাদী দলের ভূমিকার কথাও এখানে স্মরণীয়। সুতরাং বঙ্গীয় যুবকদের নিজস্ব পথ বাছা ছাড়া উপায় ছিল না। প্রচলিত দলসমূহের আমলাতান্ত্রিক মনােভাব তাদের এমন কি অ্যানার্কির দিকেও ঠেলে দিয়েছে।
এ ছাড়াও যুবকদের বিদ্রোহের অন্য কারণ রয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে একমাত্র যুবক-স্তরই সমগ্র সমাজ ব্যবস্থার অঙ্গীভূত হয়নি- চাকরি ইত্যাদির মাধ্যমে বস্তুত মধ্যবিত্ত ভদ্রলােক শ্রেণীর অন্যান্য স্তরের কিছু গচ্ছিত স্বার্থ, পিছুটান থেকেই যাচ্ছে। তাদের জীবন ধারণও সমকালীন ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পৃক্ত তাদের এই হতাশ অবস্থায় করার কিছু নেই, পারিপার্শ্বিকের কারুণ্যের শিকার হওয়া ছাড়া, স্ট্যাটাস কুয়ােকেই দেয়ালে পিঠ দিয়ে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা ব্যতীত। কিন্তু যুবক ছাত্রদের এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে কোনাে ঝুঁকি নেই, বাধা নেই তারা নির্দ্বিধায় ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এই খানেই ছাত্রদের বিপ্লবী ভূমিকা বাংলাদেশে যৌববিদ্রোহ নিজ শ্রেণীর বিরুদ্ধেই উচ্ছ্বসিত হয়েছে প্রথমে নিজের বিকৃত উত্তরাধিকারকে টেনে ফেলে দিতে চাইছে হয়তাে অনেক সময় বিচার-বিবেচনা ছাড়াই। তাই বিদ্যাসাগর প্রমুখ সম্পর্কে তাদের যে জিজ্ঞাসা, তার মূল্য অবশ্যই স্বীকার করতে হয়, কিন্তু এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না এই বিদ্যাসাগরেরই শেষ জীবনের তিক্ততা মধ্যবিত্ত সমস্ত মূল্যবােধকে অস্বীকার করে সাঁওতালদের মধ্যে ফিরে যাওয়ায়। যেমন এই যুবকরাই চলে যাচ্ছে গ্রামে গ্রামান্তরে ভদ্রলােকদের চোখে তথাকথিত ছােটলােকদের মধ্যে।
বলাই বাহুল্য বাংলাদেশ যুব বিদ্রোহ এখনও অনেকটা অ্যানার্কির ধারা ঘেসে বস্তুত যুব বিদ্রোহের এই প্রথম স্তরে সর্বব্যাপী আমলাতান্ত্রিক অনাচারের প্রতিক্রিয়ায় এই নৈরাজ্য হয়তাে অনিবার্য। তবে মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকের ‘রােমান্টিক বিপ্লবী মানসিকতা থেকে তারা এখনও মুক্ত নয়- বাইরের উত্তরাধিকারকে যত দ্রুত ভাঙা যায় দলের ভিতরের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করা এত সহজ নয়, দীর্ঘ প্রক্রিয়াসাপেক্ষ। তাই তারা মাঝে মাঝেই বিচ্ছিন্নতায়, ভদ্রলােকদের বিচ্ছিন্নতার সঙ্কটেই আক্রান্ত হয়— মনে হয় তাদের বিদ্রোহে জনসাধারণের স্রোতধারা অপাংক্তেয়, যে স্রোতধারায় তারা মাছের মতাে থাকবে।
তবে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সঙ্গে এই বিদ্রোহের তফাৎ সর্বদাই মনে রাখতে হয়। আমাদের সন্ত্রাসবাদ দ্রলােক সীমাকে স্বীকার করেই বস্তুত বঙ্কিমচন্দ্র বিবেকানন্দের বাঙালি ভদ্রলােকের চিন্তাই ছিল সে আন্দোলনের ভাবাদর্শগত পটভূমিতে। সে সন্ত্রাসে গ্রামে আন্দোলন বিস্তারের কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু সমকালীন যুব বিদ্রোহে ভদ্রলােকের সব ভাবাদর্শগত পটভূমিই অস্বীকার করা হচ্ছে মূলত মাও-সে-তুং-এর রচনাবলীই নানাভাবে এ বিদ্রোহের তত্ত্বগত কাঠামাে তৈরিতে সাহায্য করেছে। অবশ্যই পরিণত ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বােধে, তা সর্বদাই হচ্ছে, এ কথা সকলে হয়তাে স্বীকার করবে না। কিন্তু মাও-সে-তুং-এর রচনাবলী বাঙালি ভদ্রলােকের সমস্ত মূল্যবােধ, চিন্তাধারার বিপরীত মেরুর। বস্তুত তত্ত্বগতভাবেই এই যুবকরা দ্রলােক— সীমা অতিক্রম করতে চায়— আর এ ব্যাপারে সংসদীয় কোনােরকম আপােসই তারা সহ্য করে না। আসলে ভদ্রলােক মধ্যবিত্তের সীমা ভেঙে তারা যেতে চায় জনগণের কাছে এমনকি মধ্যবিত্ত পরিবেশ পিছনে ফেলেই চলে যায় তারা কৃষকদের মাঝখানে। অর্থাৎ ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকের এই নব্যপুরুষরা দেশের সঙ্গে তাদের ঐতিহাসিক বিচ্ছিন্নতা কাটাতে চায়, গান্ধীর জমিদার দরদী কৃষক আন্দোলনের বিপরীত পথে। বস্তুত বাঙালি ভদ্রলােকদের সাম্যবাদী আন্দোলনও এর আগে গ্রাম সম্পর্কে উদাসীন ছিল, কৃষকদের কলকাতা শহরে নিয়ে আসততা আন্দোলনের জন্য কিন্তু এই যুবকরা সে সীমা ভেঙে ফিরতে চায় দেশজ মূলে, শিকড়ে। গান্ধীর অতীন্দ্রিয় কৃষক আন্দোলনের বিপরীতে তারা রাখে মাও-সে-তুং-এর কৃষিবিপ্লবের দৃষ্টান্ত। উনিশশ সাতষটির পর, এই যুবকদের বিদ্রোহের পরই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত বামপন্থী দল গ্রামে যেতে চায়- গান্ধী যেখানে কংগ্রেসের জন্য স্থায়ী আসন পেতেছিলেন। বর্তমানের যুব বিদ্রোহের মূল তাৎপর্য এখানেই বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলােকদের সীমাবদ্ধতার উত্তরাধিকারকে কাটিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বকে দূর করে তার নতুন প্রবাহ আনার বাসনা। সন্ত্রাসবাদীরা এই কাজ করতে পারেনি। বাঙালি মধ্যবিত্তের জন্মলগ্ন থেকে বিচ্ছিন্নতা উপনিবেশের গভীর ক্ষতদুষ্ট তাদের যে অস্তিত্ব তার বিরুদ্ধে যুবকদের এই বিদ্রোহ তাই গভীর ভাবায়। তবে প্রশ্ন থেকে যায় ” ১৯৪৮-৫০-এর ক্ষণমরীচিকাতেই মধ্যবিত্ত সংসদীয় নিরাপদ প্রত্যাবর্তনেই এর শেষ হবে কিনা। সমুদ্রের আন্দোলনে বাংলাদেশ উদ্বেলিত হবে, না বানডাকা সন্ত্রাসেই নিঃশেষ হয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের ওপর কেবল বাঙালি মধ্যবিত্তেরই নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎও নির্ভর করছে।
বলাই বাহুল্য এ আলােচনায় বাংলাদেশের যুব বিদ্রোহকে তার শ্রেণীগত ইতিহাসের পটে দেখার চেষ্টা হয়েছে মাত্র। এই বিদ্রোহের আরও বহু নানাদিক সম্পর্কে অনালােচিতই থেকে গেছে। বিশেষত তাদের প্রােগ্রাম ও বাস্তব কার্যপদ্ধতি, তাদের সম্পর্কে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মনােভাব অন্যান্য ভদ্রলােক নেতৃত্ব সমন্বিত কিন্তু ইদানিং গ্রামাঞ্চলে প্রভাব বিস্তারী বামপন্থী দলের দৃষ্টিভঙ্গি, এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অবশ্যই আলােচনার বিষয়বস্তু। তা থেকেও বড় কথা আমরা যুব বিদ্রোহ বলতে এক শ্রেণীর বিদ্রোহকেই ধরেছি, কিন্তু বিভিন্ন গ্রন্থাদিতে আরও অনেক রকম বিদ্রোহের কথাই বলা হয়। এক অর্থে উনিশের শতকের ইয়ং বেঙ্গলদের ব্যাপারও যুব বিদ্রোহই- ডিরােজিওর নেতৃত্বে তাঁরা দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সবটাই অস্বীকার করতে চেয়েছিলেন, পােশাকে-আশাকে ডিরােজিও extreme of foppery-তে গিয়েছিলেন। এ বিদ্রোহের পরও ইয়ং বেঙ্গলরাও অমিতব্যয়ী পুত্রের মতাে ভারতীয় ঐতিহ্যেই, দ্রলােক মধ্যবিত্তের স্রোতেই ফিরে এসেছে। বস্তুত পােশাকে আশাকে বা your sons and daughters are beyond your command মা-বাবার উদ্দেশে বলে নিজের খুশিমতাে চলার বিদ্রোহ বা যৌন বিদ্রোহ, উওম্যান রেভেলিউশনকে বাংলাদেশের পটভূমিকায় আদৌ তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয় নি যে কারণেই এ আলােচকের বিবেচনায় তারা অপাংক্তেয়। আসলে বাংলাদেশের যুববিদ্রোহ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে তার তীব্র রাজনৈতিক কণ্ঠস্বরে, সমাজ অর্থনীতির পটভূমিকায়। বিদেশের অনেকাংশের এমন কী ভারতবর্ষেরই অন্যান্য অনেক প্রদেশের যুববিদ্রোহ থেকে বাংলাদেশের বিদ্রোহের তফাতই এখানে। তার দায়িত্বও তাই বেশি।

সূত্র: দর্পণ
১৭.০৯.১৯৭১