You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে ঈদুল ফিতর

মেজর কামরুল হাসান ভুইয়া

একাত্তরের ২০শে নভেম্বর, শনিবার ছিল ঈদুল ফিতর। পাকিস্তানি পশুশ্রেণীর সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের অত্যাচার ও নির্যাতনে মানুষ প্ৰায় সহায়হীন। গোটা বাংলাদেশ তখন অবরুদ্ধ। ইতর গোত্রীয় এই দালালদের অনেকেই ছিল বর্ণচোরা। গায়ে সাইনবোর্ড না থাকলেও এরা সাইনবোর্ডওয়ালা দালালদের চেয়েও জঘন্য ছিল। অবাক হতে হয় ভেবে, তাদের অনেকেই ছিল স্কুলের শিক্ষক ও সমাজের সম্মানিত ব্যক্তি। এদের ভয়ে রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্ৰ শুনতে হতো নিচু ভুল্যুয়মে; মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা আর স্বাধীনতার কথা বলতে হতো এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিচুস্বরে।

ঈদের জামাতে ইমাম সাহেব সব শ্রেণীর মানুষের আর্জি মোনাজাতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে উপস্থাপন করেন। মোনাজাত হয় সাধারণ মোনাজাতের চেয়ে দীর্ঘ। কিন্তু একাত্তরের ঈদুল ফিতর ছিল একদমই ভিন্ন বৈশিষ্টের। এমন ঈদ অতীতে কখনো হয়নি, ভবিষ্যতেও কোনোদিন হবে না। স্বাধীনতা-বিরোধী কুলাঙ্গারদের ভয়ে ইমাম সাহেব সরবে মনের কথাও আল্লাহ্ তাআলার কাছে বলতে পারেননি। বলতে পারেননি, আল্লাহ তুমি এই জালেমদের হাত থেকে আমাদের মুক্তি দাও। তুমি মুক্তিযোদ্ধা আর মুক্তিকামী জনতাকে বিজয়ী করে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে দাও। তোমার শান্তির ধর্ম ইসলামের নামে যারা হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, লুট আর নারী নির্যাতন করছে তাদেরকে তুমি বিচার করো। সশব্দে না হলেও মনে মনে সবাই এ দোয়াই করেছে। একাত্তরের চিরায়ত সমাজ বৈশিষ্ট্যের কিছু নতুন মাত্রা যোগ হয়। গ্রামে যেসব বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতো সেগুলিকে গেরিলা যুদ্ধের ভাষায় বলা হতো হাইড আউট। এগুলোকে নির্বাচন করা হতো রণকৌশলগত বিবেচনায়। আর বাকি যে দুটি স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতো তার একটি হচ্ছে শত্রুর মুখোমুখি প্রতিরক্ষা অবস্থানে এবং অপরটি ভারতের অভ্যন্তরে সীমান্তের কাছাকাছি ছোট-বড় ক্যাম্প-এ।

একাত্তরের উত্তপ্ত রণাঙ্গনের মধ্যে একটি ছিল সালদা নদী। আখাউড়া জংশন থেকে যে রেলপথটি কুমিল্লা হয়ে চট্টগ্রাম যায় সে পথে পর্যায়ক্রমিকভাবে গঙ্গাসাগর, ইমামবাড়ি, কসবা, মন্দবাগ, সালদা নদী, শশীদল তারপর কুমিল্লা রেলষ্টেশন। রেলপথটি প্রায় সীমান্ত ঘেঁষে যায়। সালদা নদী আদতে একটা বড় খাল। কিন্তু বর্ষায় প্ৰচণ্ড খরস্রোতা।  এ ছোট্ট নদীটির নামে স্থানটির নাম সালদা নদী,  রেলস্টেশনটির নামও সালদা নদী।  সালদা নদীর রেল সেতুর পূর্বদিকে ১৪ বর্গ কিলোমিটারের একটি বাংলাদেশের ভূখণ্ড। পশ্চিম দিক ছাড়া বাকি প্রায় তিন দিকেই ভারত। ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী (পরবর্তীতে বীর উত্তম এবং প্রয়াত) এখানেই সালদা নদীর পূর্ব পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্ৰহণ করার মাধ্যমে ২ নম্বর সেক্টরের সালদা নদী সাব-সেক্টরের গোড়াপত্তন করেন। সালদানদীর পশ্চিম পাড়ে পাকিস্তানের ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। পরে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্ট ৩০ পাঞ্জাবকে বদলি করে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হালদার (পরবতীতে বীর উত্তম) এ এলাকার প্রায় দুই কিলোমিটার পূর্বে ভারতীয় ভূখণ্ডের ভেতর কোনাবন নামের এক স্থানে ৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পুন:সংগঠন করেন। এই ইউনিটের পুরোনো সৈনিকদের ও গণযোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় ৯ম ও ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট যথাক্রমে ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আইনউদ্দিন (পরবর্তীততে বীর প্রতীক) এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম (পরবর্তীততে বীর বিক্রম)-এর নেতৃত্ত্বে। এ তিনটি ইউনিট এবং ১ম ফিল্ড ব্যাটারি আর্টিলারি (মুজিব ব্যাটারি নামে সমধিক পরিচিত) ও বিগ্রেড সিগন্যাল কোম্পানি নিয়ে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের (পরবর্তীতে বীর উত্তম ও প্ৰয়াত) নেতৃত্বে ফোর্স বিগ্ৰেড গঠিত হয়।

লাইলাতুল বরাত। বিকেল বেলায় ক্যাপ্টেন সালেক প্রতিপক্ষ শত্রু প্রতিরক্ষায় অবস্থিত কোম্পানি কমান্ডারকে বেতারযন্ত্রে না পেয়ে সিনিয়র সুবাদারকে বললেন রাত্রে সবাই এবাদত বন্দেগী করুক। যুদ্ধ এবং গোলাগুলি বন্ধ থাক। পাকিস্তানি সুবাদার আরো এক কাঠি সরস হলো। উর্দুতে জবাবে বললো যে, না স্যার যুদ্ধ তো যুদ্ধই। এ ধরনের নিয়ম মেনে যুদ্ধ হয় না। [৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের কাছে এবং ৩৩ বেলুচের কাছে একই বেতারযন্ত্র (জিআরসি-১০)]। পূর্বেকার রেডিওর মতো নব ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ফ্রিকোয়েন্সি এ্যাডজাস্ট করতে হতো। কাপ্টেন সালেক মুজিব ব্যাটারির ছয়টি কামান প্রস্তুত করলেন। গোলার কোনো অভাব ছিল না। সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু করলেন শত্রু অবস্থানের উপর বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণ। ঘণ্টা দেড়েক পরে পাকিস্তানি সুবাদার বেতার যন্ত্রে ক্যাপ্টেন সালেককে অনুনয় করতে লাগলো, স্যার যথেষ্ট হয়েছে। এবার বন্ধ করুন। ক্ষমা চাই। আমরা একটু শবেবরাতে এবাদত-বন্দেগী করব।

বাংলাদেশের ভিতরে যারা হাইড আউটে থাকতো, তারা পাকিস্তানিদের ঈদের দিনে আক্রমণের আশঙ্কায় হয়। হাইড আউট দুই একদিন আগে বদল করে ফেলে অথবা সর্বোচ্চ সতর্কবস্থায় ছিল। ঈদের নামাজ মুক্তিযোদ্ধারা জামাতে পড়েছে তেমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। পরবর্তীতে পাকিস্তানি অফিসার যারা এখানে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদের লেখা বই থেকে জানা যায় যে একাত্তরে তারা তাদের সব অবস্থানেই সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় ছিল ঈদের দিন মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায়।

রমজান আলী, বয়স ১৩/১৪ । দিনাজপুর সীমান্তে হিলি এবং ফুলবাড়ির মাঝামাঝি জলপাইতলি। এখানে পাকিস্তান আর্মির শক্ত অবস্থান। মুক্তিযোদ্ধারা সে অবস্থান রেকি করতে গিয়ে রমজান আলীকে সে ক্যাম্প থেকে বের হতে দেখে তাকে ধরে নিয়ে আসে তাদের কমান্ডার হামিদুল হোসেন তারেক-এর (পরবর্তীততে বীর বিক্রম) কাছে। বলে, স্যার এ রাজাকার। রমজান আলী কেঁদে কেটে যে কাহিনী শোনায় তা করুণ, বুক ভাঙা কষ্টের। রমজান বাবা-মার একমাত্র সন্তান। শান্তাহার রেল স্টেশনের পাশে তার বাবার একটি ছোট্ট চা-বিস্কুটের দোকান। এপ্রিলের প্রথমে পাকিস্তানিরা শান্তাহার এসে তার সামনেই তারা তার বাবাকে দোকানের ভিতর গুলি করে হত্যা করে। রমজান দৌড়ে কাছেই তার বাড়িতে যায়। দেখে তাদের ঘরসহ গোটা বস্তি আগুনে জ্বলছে। বস্তির সব লোক যে যেভাবে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে। বহু খুঁজেও মাকে পায় না রমজান। আশ্রয় নেয় এক গুদাম মালিকের কাছে। তারপর আরো দু’হাত বদল হবার পর এক মালিক তাকে এই পাকিস্তানি ক্যাম্প-এ দিয়ে যায়। এখানে সে থালা-বাসন ধোয়া থেকে অন্য সব কাজ করে। তার প্রচণ্ড ঘৃণা পাকিস্তানের প্ৰতি। রমজান তার বাবা হত্যার এবং মা হারানোর প্রতিশোধ নিতে চায়। কমান্ডার তারেকের স্নেহে রমজান তাদেরই একজন হয়ে যায়। এলাকার পথ-ঘাট তার নখদর্পণে। ১৯ নভেম্বর রাতে যাত্রা করে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় ৬ গার্ডস রেজিমেন্ট-এর সহায়তায়। ২০ নভেম্বর ভোরে জলপাইতালির পাকিস্তানি অবস্থান দখল করে।

গাইড আমাদের রমজান আলী। শত্রু অবস্থান দখলের আনন্দে ও উচ্ছাসে রমজান একাই দৌড় দেয় ক্যাম্প-এর দিকে। হঠাৎ বিকট শব্দ। শত্রুর পোতা মাইন-এ পড়ে রমজানের ছোট্ট শরীরটা খণ্ড বিখণ্ড হয়ে যায়। যুদ্ধ জয়ের আনন্দ কোথায় মিলিয়ে গেল। প্রত্যেকটি মুক্তিযোদ্ধা রমজানের জন্য বুক ভাসিয়ে কাঁদতে থাকে। সেদিন ঈদুল ফিতর-এর সকাল। ৬ গার্ডস পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় লাস্ট পোস্ট বাজিয়ে রমজানকে শেষ বিদায় জানায়।

১৪ নভেম্বর ভুরঙ্গামারী মুক্ত করা হয়। এবারের লক্ষ্য কুড়িগ্রাম দখল। খবর পাওয়া গেল ওদিকে লালমনিরহাট থেকে পাকিস্তানিরা পালিয়ে গেছে। মোট কথা শত্রুর মনোবল এখন পায়ের তলায়, তারা পশ্চাদপসরণ করে রংপুর জড়ো হচ্ছে। পথে জয়মনিরহাট কোনো বাধা ছাড়াই দখল হলো। ১৯ নভেম্বর রাতে যখন রায়গঞ্জে ফুলকুমার নদীর উপর ব্রিজের কাছে পৌছানো হলো তখনি শত্রুর প্রচণ্ড ফায়ার। একদমই অপ্ৰস্তুত অবস্থায় সবাই; মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী। এখানে পাকিস্তানিদের এতো শক্ত প্রতিরোধ হতে পারে কারো কল্পনায়ও আসেনি। সবাই ভেবেছিল পরবর্তী প্রতিরোধ হবে নাগেশ্বরীতে। গুলির প্রথম তোড়েই মারা যান ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেমস এবং দুজন সৈনিক। সেকেন্ড লে. আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ (শহীদ ও বীর উত্তম) মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার চেষ্টা করতে থাকেন প্রচণ্ড গোলাবৃষ্টির মধ্যেও। সহযোদ্ধাদের পিছিয়ে গিয়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্ৰহণ করার নির্দেশ দেন। নিজে একটি এলএমজি দিয়ে শুয়ে কিভারিং ফায়ার দিতে থাকেন শত্রুর উপর। নিজের জীবন বিপন্ন করে সহযোদ্ধাদের নিরাপদ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস। হঠাৎ একটি গুলি তার মাথার তালু ভেদ করে গলার ভিতর দিয়ে তার দেহের অভ্যন্তরে ঢুকে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে একমাত্র শহীদ। লে. সামাদ নেতৃত্ব ও সহমর্মিতার এক অনুপম দৃষ্টান্ত। ভোর রাতের যুদ্ধের ক্ষেত্রে আগের দিন রাতেই যোদ্ধাদের পরদিন সকালের নাস্তা দিয়ে দেয়া হয়। শহীদ লে. সামাদের পকেটে পাওয়া গেল ঈদের দিন সকালের নাস্তা দুটি পুরি এবং একটু হালুয়া।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের শেষ বর্ষ অনার্সের ছাত্র ছিলেন ২/লে, আবু মঈন মোহাম্মদ আশফাকুস সামাদ। অনার্স শেষ করে আমেরিকায় পড়বার স্কলারশিপ পেয়েছিলেন। সব ছেড়ে এপ্রিলের একদম শুরুতেই যোগ দেন যুদ্ধে। যে চারজন মুক্তিযোদ্ধা এপ্রিলের শুরুতে অস্ত্ৰ নিয়ে ঢাকা শহরে প্রবেশ করেন। সামাদ তার একজন। জুন মাসের মাঝামাঝি অফিসার ক্যাডেট হিসেবে ভর্তি হন এবং ৯ অক্টোবর ১৯৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। অতঃপর তার বদলি হয় ৬ নম্বর সেক্টরের সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টরে।

ছাত্র হিসেবে, সন্তান হিসেবে, সতীর্থ হিসেবে, দুর্গতদের সহায়ক হিসেবে, স্বাধিকার অর্জনের বিপ্লবী হিসেবে, বন্ধু হিসেবে সর্বোপরি মানুষ হিসেবে আশফাকুস সামাদ ছিলেন দৃষ্টান্ততুল্য। ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতরের প্রত্যুষে তিনি নিজের প্রাণ উৎসর্গ করে প্রমাণ করলেন যে যোদ্ধা হিসেবে, দেশপ্রেমিক হিসেবে এবং কমান্ডার হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য।

প্রবাসী সরকারের কার্যালয় কলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয়। অফিস চত্বরের ভিতরেই ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়। জামাতে ইমামতি করেন মাওলানা দেলোয়ার হোসেন। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারে কোরান তেলাওয়াত ও তফসীর করতেন। দুঃখজনক হলেও সত্যি এ জামাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ও কর্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী ছাড়া মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্য বা উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন না। সবার জন্য যে রন্ধনশালায় খাবার রান্না হতো। সেখানে কেবলমাত্র অতি সাধারণমানের সোমাই রান্না হয়। যে কোনো কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সারাদিন কিছুই খাননি।

রাতে তিনি অনির্দিষ্ট এবং অত্যন্ত গোপন সফরে কুষ্টিয়া সীমান্তবতী দুটি মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। মুক্তিযোদ্ধারা ঈদের রাতে প্রধানমন্ত্রীকে তাদের মাঝে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। কপোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে প্রধানমন্ত্রীরও। অথচ তার অফিসের অদূরে সিটি রোডে  আৰু শিশু সন্তান (তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ) ১০৫ ডিগ্রি জ্বরে কাতরাচ্ছে। সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে একটিবার বাড়ি গেলেন না, একটি টেলিফোনও করলেন না। তার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন গাড়ি আসছিল তখনও তাকে অনূরোধ করা হয়। তিনি নিশ্চুপ থেকে অনুরোধ অগ্রাহ্য করেন। সকালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার অনেক ফল-ফলাদি ঈদ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী দপ্তরে পাঠায়। প্রধানমন্ত্রী সেগুলো নিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য। একটি ফল নিজেও খাননি বা তার অফিসের কাউকেও দেননি।

বড় ক্যাম্পগুলোতে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সেক্টর সদর দপ্তর ও সাব-সেক্টর সদর দপ্তর-এ প্রশাসনিক জনবল থাকতো বলে তা সম্ভব হয়। সেমাই নামে যে মিষ্টান্ন তার মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের কী আছে জানি না। তবে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেমন ঈদ, শবেবরাত, শবেকদর, মিলাদ, দেয়া মাহফিল সেমাই প্ৰায় অপরিহার্য একটি মিষ্টান্ন। কোনো কারণ ছাড়াই হিন্দুদের মাঝে এটি জনপ্রিয় নয়। ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর (ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা জেলার সোনামুড়া থানার মেলাঘর)-এ ঈদের দিন বড় বড় তিন হাঁড়ি দুধ জ্বাল দেয়া হলো। সেমাইয়ের জন্য খোঁজা হলো গোটা আগরতলা। এক বাক্স সেমাই পাওয়া গেল। সেটিকে তিন ভাগ করে তিন হাঁড়িতে দেয়া হল।

আরো ভিন্নরকম ঈদ ছিল আটটি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এ। জেড, এস এবং কে ফোর্সের অধীনে ছিল এই আটটি ব্যাটালিয়ান।

জেড ফোর্স ব্রিগেড-মেঘালয়ের তেলঢালা থেকে ১.৩ এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সিলেটের উত্তর ও পূর্ব সীমান্তে পৌঁছে অক্টোবরের মাঝামাঝি। ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই জেলার সদর দপ্তর আমবাশার অদূরে ক্যাম্প স্থাপন করে। ভারতীয় নির্দেশে একরকম বাধ্য হয়েই প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও ২৮ অক্টোবর ধলই বিওপিতে পাকিস্তানি অবস্থান আক্রমণ করতে হয়। এ যুদ্ধে সিপাই হামিদুর রহমান বীরশ্ৰেষ্ঠ উপাধি লাভ করেন। আমবাশা এলাকাতেই ঈদের জামাতের আয়োজন করা হয়। কোলাকুলির পর্যায়ে দেখা গেল দুজনেই কাঁদছে এবং একে অপরকে বলছে, আরো বোকা ঈদ মানে তো আনন্দ, কাঁদছিস কেন?

৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অসম সাহসী অধিনায়ক মেজর সাফায়াত জামিলের (পরবর্তীতে বীর বিক্রম) নেতৃত্বে ঈদের সময় গোয়াইনঘাট এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে পাকিস্তানি ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে দিনে-দুপুরে তারা দেখাচ্ছে। ঈদের কথা ভাববার তাদের খেয়ালই নেই।

৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মৌলভীবাজারের বিপরীতে সাগরনাল ফুলতলা এলাকায়। এখান থেকে তারা পাকিস্তানিদের উপর একের পর এক আঘাত হেনে যাচ্ছে। শত্রুরা প্ৰতি আক্রমণেরও চেষ্টা করছে কয়েকবার। তাতে তাদের হতাহতের সংখ্যাই শুধু বৃদ্ধি পেয়েছে। এই আক্রমণ এবং প্রতি-আক্রমণের মধ্যেই ঈদের আমিনুল হক (পরবর্তীতে বীর উত্তম)। অর্ধেক ব্যাটালিয়ান প্রহরায়-বাকিরা নামাজে। দ্বিতীয় জামাতে তার বিপরীত।

এস ফোর্স বিগ্রেড-২য় এবং ১১তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর যারা যুদ্ধে ছিলেন না এবং সেক্টর সদর দপ্তরে ছিলেন তারা জামাতের আয়োজন করেন। ইমামতি করেন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-র ধর্মীয় শিক্ষক মাহবুব। নামাজ শেষে ইমাম সাহেব অত্যন্ত আবেগময় এক মোনাজাত করেন। নামাজীরা কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে মাটিতে গড়াতে থাকে। ইমাম সাহেব মোনাজাতের এক পর্যায়ে আল্লাহ তাআলার কাছে প্রার্থনা করেন ঈদুল আযহার (কোরবানী ঈদ) জামাত যেন স্বাধীন বাংলাদেশের রেসকোর্স ময়দানে পড়তে পারেন। আল্লাহ রাব্বুল আল আমীন এই দোয়া কবুল করেছিলেন। বাস্তবেও এই ইমাম সাহেব ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ঈদুল আযহার নামাজ রেসকোর্স ময়দানে পড়ান।

কে ফোর্স বিগ্রেড-৪র্থ ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সালদানদী এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। আগেই বলেছি সালদানদী ছিল উত্তপ্ত রণাঙ্গন। ক্যাপ্টেন গাফফার হালদার সিদ্ধান্ত নেন ঈদের দিন পাকিস্তানি ছয়টি অবস্থানের উপর রেইড করবার। তারা ঈদের জামাতেরই আয়োজন করেনি। ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল কসবা এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে। ২১ নভেম্বর দিবাগত রাতে তারা চন্দ্রপুরে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষার উপর আক্রমণ করবে। তাদের সহায়তা করবে ভারতীয় আর্টিলারি এবং সাথে থাকবে ভারতীয় ৭৩ মাউন্টেন বিগ্রেডের ১৯ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট-এর একটি কোম্পানি। ২০ নভেম্বর ১৯ পাঞ্জাব কসবা প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে ৯ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বদল করে। ফলে তাদের কোনো ঈদের নামাজ হয়নি।

১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৫ নভেম্বর রাতে মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে অনুপ্রবেশ করে উত্তরে বিলোনিয়া এবং দক্ষিণে ফেনীতে অবস্থিত। যথাক্রমে, পাকিস্তানি ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ১৫ বালুচ রেজিমেন্টকে বিভাজিত করে ফেলে। ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর এই ‘ইনফিলিট্রশন অপারেশন’ পৃথিবীর বহু সামরিক একাডেমিতে পড়ানো হয়। যেহেতু সেমাই দুষ্প্রাপ্য সেহেতু মিষ্টি সাগু পরিবেশন করা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানে। এই সামান্য মিষ্টান্ন প্ৰাপ্তিও ছেলেদের চোখে পানি নিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে তাদের এই প্রথম মিষ্টান্ন পাওয়া।

একাত্তরের ঈদ-এর তুলনা হয় না, হবেও না। অনন্য ও অসাধারণ এই ঈদ থাক শুধুই আমাদের অহংকারের মুক্তিযুদ্ধের সাথে গাঁথা-আনন্দে, বেদনায়, অর্জনে ও ত্যাগে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!