You dont have javascript enabled! Please enable it! একাত্তর যেখান থেকে শুরু - সংগ্রামের নোটবুক

একাত্তর যেখান থেকে শুরু

১. এ কান্ট্রি নট সাফিশিয়েন্টলি ইমাজিড সালমান রুশদি তাঁর শেইম উপন্যাসে পাকিস্তানকে বর্ণনা করেছেন ‘আ কান্ট্রি নট সাফিশিয়েন্টলি ইমাজিন্ড’। তাঁর কথায়, দেশটি বানানাে হয়েছিল জোড়াতালি দিয়ে। যে ভূমিখণ্ড নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তান, তার নেতারা জন্মেছিলেন সে দেশের বাইরে। স্বাধীনতার পর দেশটি বরাবর লড়াই করেছে ইতিহাসের দুই ধারার সঙ্গে, যার একদিকে ওপর থেকে আরােপিত ইতিহাস, অন্যদিকে যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইতিহাস।  দেশটির বিভিন্ন অংশের সম্পর্কও বরাবর ছিল বিরােধপূর্ণ। রুশদি লিখেছেন, এ এমন এক দেশ, যার নির্মাণের পেছনের স্বপ্ন ছিল অসম্পূর্ণ। হয়তাে দেশটা এমন, যা নিয়ে যথেষ্ট কল্পনাই ছিল না।  রুশদি ঠিকই ধরেছেন। স্বাধীনতার জন্য চাই মনের মধ্যে একটা স্বপ্ন, যে স্বপ্ন অবলম্বন করে দেশের মানুষ বৈরী শক্তির সঙ্গে লড়াইয়ে নামে। যার যা আছে, তা-ই নিয়ে চলে সে লড়াই। পাকিস্তানের জন্মকে ‘অসম্পূর্ণ স্বপ্নের প্রকাশ’ বলা হলেও একই কথা বলা যাবে না তার পূর্বাংশকে নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পাকিস্তানের পক্ষে ভােট দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু যে স্বপ্ন নিয়ে তাঁরা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, সেখানে পাকিস্তানের কোনাে ঠাঁই ছিল না। বস্তুত, একটি ভিন্ন, স্বতন্ত্র দেশের কথা পাকিস্তানের পূর্বাংশের মানুষ নিজেদের মনে এঁকে নেয় দেশভাগের আগেই।

১৯৪৭ সালের জুন মাসে, অর্থাৎ পাকিস্তান সৃষ্টি দুই মাস আগে গণ-আজাদী লীগ এক ইশতেহার প্রকাশ করে। স্বাধীনতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে এভাবে: রাজনৈতিক স্বাধীনতার মূল্যই নাই, যদি স্বাধীনতা জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি আনয়ন না করে। আমরা স্থির করিয়াছি, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব। অন্যকথায়, পাকিস্তান গঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান হয়তাে একটি নতুন পতাকা পাবে, কিন্তু দেশের মানুষের পরাধীনতা দূর হবে না। রাজনৈতিক স্বাধীনতা যে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সম্প্রসারণ, এই মার্কসীয় তত্ত্বটি গণ-আজাদী লীগের নেতা-কর্মীদের জানা থাক বা না থাক, তাঁরা ঠিকই বুঝেছিলেন, যে মধ্যস্বত্বভােগী অর্থনৈতিক কাঠামাে পাকিস্তানের জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তাতে বাঙালির মুক্তি আসবে না। দেশভাগের এক বছর না পেরােতেই ভাষার প্রশ্নে যে আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে, বাঙালির সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয় নির্ণয়ের সেই লড়াইয়েও অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নটি প্রচ্ছন্ন ছিল। বাংলার বদলে উর্দু চাপানাের চেষ্টা হবে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার গলা টিপে মেরে ফেলা এ কথা প্রথম সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। দেশভাগ হতে না হতেই তিনি লিখলেন,

’বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু বা হিন্দি ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা

রাজনৈতিক পরাধীনতার নামান্তর হইবে।…ইহা প্রাদেশিক

স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বহির্গতও বটে।’

সে কথা আরও খােলামেলাভাবে প্রকাশ করেন ড. এনামুল হক। ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে এক নিবন্ধে তিনি যুক্তি দেখালেন, বাঙালির ওপর উর্দু চাপিয়ে দিলে শুধু যে তার সাংস্কৃতিক মৃত্যু হবে তা-ই নয়, তার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যুও ঘটবে।

“এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা, বাণিজ্য ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইবে উত্তর ভারতীয় ও পশ্চিম পাকিস্তানি উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র, যেমন ভারত ছিল ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র।’

অন্য কথায়, পাকিস্তান নামের দেশটি শুধু নামে নতুন হবে, কিন্তু বাস্তব অর্ধে বাঙালির ওপর ঔপনিবেশিক শাসনের কোনাে পরিবর্তনই হবে না। পরিবর্তন আসবে শুধু ক্ষমতার হাতবদলের মাধ্যমে, যেদিন বাঙালি নিজেই নিজের ভাগ্যবিধাতা হবে। পূর্বাংশের নেতারা স্বাধীনতার এই চেতনাটি খুব সুপরিকল্পিতভাবে প্রােথিত করতে সক্ষম হন দেশভাগের একদম গােড়া থেকে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেরও আগে থেকে। তবে ভাষা আন্দোলন যে তাকে একটি মজবুত গাঁথুনির ওপর বসায়, তাতেও কোনাে সন্দেহ নেই। মানুষের কাছে। স্বাধীনতার প্রশ্ন কিছুটা বিমূর্ত মনে হওয়া ছিল স্বাভাবিক, কিন্তু ভাষার মতাে নিত্যদিনের একটি বিষয় যখন সামনে এসে দাঁড়াল, সিদ্ধান্ত গ্রহণে আর কোনাে বাধা থাকল না। মানতেই হবে ভাষা আন্দোলনের একটি পপুলিস্ট’ চরিত্র ছিল। ভাষার দাবিটির সারার্থ দেশের সাধারণ মানুষের পক্ষে বােঝা সহজ ছিল, কারণ এর সঙ্গে  জড়িত ছিল তাদের রুটি-রুজির প্রশ্ন তাদের সন্তানসন্ততির কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। সে জন্য এই আন্দোলন শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছিল দেশজুড়ে। ঠিক সে কারণে এই আন্দোলনের অগ্রবাহিনী হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন ছাত্ররা। পরবর্তী ইতিহাস আমাদের জানা।

১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী বিজয়  ছিল বাঙালির স্বাধিকার অর্জনের প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। যে কথাটা এত দিন মনের মধ্যে গােপনে বেজে চলেছিল, যুক্তফ্রন্টের অভাবনীয় বিজয়ের ফলে এবার তা সরব হওয়ার সুযােগ পেল। নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক ক্ষমতা  গ্রহণের পরপরই ঘােষণা করেন, তিনি (পূর্ব পাকিস্তানের) স্বাধীনতার পক্ষপাতী। ২২ মে করাচিতে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মােহাম্মদ আলীর সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে ফজলুল হক জানান, মন্ত্রিসভা গঠনের পর যে প্রশ্নটি সর্বাগ্রে আলােচিত হবে, তা হলাে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা। কত দ্রুত স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হবে, সে বিষয়ে তার কোনাে সুনির্দিষ্ট ধারণা নেই। তবে আমার মন্ত্রিসভার জন্য অন্যতম প্রধান কাজই হবে স্বাধীনতার বিষয়টি বিবেচনা করা। হতে পারে স্বাধীনতা ও স্বাধিকার-এ দুটি বিষয় গুলিয়ে ফেলেছিলেন হক। সাহেব, যে কারণে ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসের মাথায় পাকিস্তান সরকার তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিন্তু ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ যে মুসলিম লীগকে ভােট না দিয়ে বিচ্ছিনতাপন্থী একটি জোটের পক্ষে ভােট দেন, তা থেকেই স্পষ্ট, নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির পক্ষেই তাঁরা রায় দিয়েছিলেন। সে ঘটনার মাত্র ১৬ বছর পর অনুষ্ঠিত হয় আরেক ঐতিহাসিক নির্বাচন। তাতে দেশের মানুষ এমন একজন নেতার পক্ষে তাঁদের রায় ঘােষণা করেন, কয়েক মাস আগেও যাঁকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানাে হয়েছিল দেশভাগের ষড়যন্ত্রের অভিযােগে তার পরের ঘটনা তাে আমাদের সবারই জানা। না, অপরিকল্পিত আকস্মিকতার ফলে স্বাধীনতা আসেনি বাংলাদেশের। পাকিস্তান হয়তাে পর্যাপ্ত স্বপ্ন ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের সৃষ্টি ছিল মুক্তিপাগল এক জাতিগােষ্ঠীর স্বপ্ন ও সাধনার ফসল।

২। বাংলাদেশ, জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভব আকবর এস আহমেদ বেশ নামীদামি পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী ওয়াশিংটনের আমেরিকান। ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের এই নামজাদা অধ্যাপক উদারনৈতিক মুসলিম চিন্তাবিদ হিসেবে। পশ্চিমে বেশ নাম কিনেছেন। বিবিসি একসময় তাঁকে ইসলাম ধর্মের ওপর বিশ্বের এক নম্বর ভাষ্যকার বলে রায় দিয়েছিল। এই অধ্যাপকের ধারণা, পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানানােটা ভুল হয়েছে আর ভুলটা করেছে বাঙালিরাই  মুসলমানের আসল পরিচয় তার ধর্মে। সেই ধর্মই যদি বাদ গেল, তাহলে তার আর থাকে কী? বাঙালি মুসলমানেরা তাদের ধর্ম পরিচয় তুলে ধরার বদলে সাংস্কৃতিক পরিচয়টাকে বড় করে দেখল। সেটাই তাদের আসল ভুল জিন্নাহ, পাকিস্তান অ্যান্ড ইসলামিক আইডেন্টিটি (রুটলেজ, লন্ডন, ১৯৯৭), এই নামের গ্রন্থে আকবর সাহেব অভিযোেগ তুলেছেন, বাঙালিরা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে যথেষ্ট সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। জিন্নাহ না থাকলে পাকিস্তান হতাে। , আর পাকিস্তান না হলে বাংলাদেশও হতাে না। এই লজিক তুলে ধরে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা জিন্নাহকে কেবল এক ভাষার প্রশ্ন তুলে তাকে ছােট করে দেখেন। তাদের অর্থাৎ বাঙালি মুসলমানের পক্ষে জিন্নাহ যে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন, বাঙালিরা তাঁর কথা ভুলে গেছে। জিন্নাহ ভারতের মুসলমানদের অভিন্ন জাতি হিসেবে এক হওয়ার সুযোেগ সৃষ্টি করেছেন। অথচ বাঙালিরা তার গুরুত্ব না বুঝে দেশটাকে ভাঙল।

বাঙালি বুদ্ধিজীবীর উচিত হবে, তাদের সংকীর্ণ মনােভাব ত্যাগ করে জিন্নাহর সঠিক মূল্যায়নে সচেষ্ট হওয়া। আকবর সাহেব তার বইয়ে বাঙালিদের জন্য নিজের দরদের কথা নানাভাবে বােঝানাের চেষ্টা করেছেন। তবে বাঙালিরা যে অকৃতজ্ঞ, এ কথা কোনাে রাখঢ়াক। ছাড়াই বলেছেন। ১৯৭০-৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের নড়াইলে তিনি এসডিও হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাঙালি বাঙালি করে শেখ মুজিব যে কাণ্ড শুরু করেছেন, তার ফল অশুভ হতে বাধ্য, এ কথা সে সময়েই তিনি নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখে রাখেন। মুজিবের তোেলা শ্লোগান, বাঙালিদের জন্য বাংলাদেশ, যদি সফল হয় তাহলে অচিরেই পশ্চিম পাকিস্তানে ‘পাঞ্জাবিদের জন্য পাঞ্জাব’ বা ‘পশতুনদের জন্য সীমান্ত প্রদেশ’ এই শ্লোগান উঠবে। আকবর সাহেব পাকিস্তানের বিভক্তির জন্য সামরিক কর্তাদের এবং শেখ। মুজিবকে সমানভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক সামরিক প্রশাসক সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের কথা উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছেন, পাকিস্তান। হলাে মহামূল্যবান চীনামাটির এক পাত্রের মতাে, আর মুজিব সে পাত্রের গায়ে উড়ে এসে বসা এক মাছি। দরকার ছিল মাটির পাত্রটিকে অক্ষত রেখে সপাটে মাছিটিকে মেরে ফেলা। কিন্তু পাকিস্তানি জেনারেলরা হাতুড়ি দিয়ে মাছিটি মারার চেষ্টায় সে পাত্রটিই ভেঙে গুঁড়িয়ে ফেলে, কিন্তু মাছটি নির্বিঘ্নে উড়ে পালায়।’ বইটির উপসংহারে আকবর সাহেব মন্তব্য করেছেন, একাত্তরে পাকিস্তান বিভক্ত হলে কেউ কেউ এই বলে উল্লাস প্রকাশ করেছিল যে জিন্নাহর পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। ‘মােটই না, জিন্নাহর পাকিস্তান তত দিন বেঁচে থাকবে, যত দিন আত্মসম্মান সম্পন্ন ও নিজেদের আত্মপরিচয় এবং অন্যান্য মুসলমানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন এমন মুসলমান বেঁচে থাকবে। জিন্নাহর পাকিস্তানের মৃত্যু হবে না। শুধু আকবর আহমেদ কেন, অনেক পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবীই এখনাে এই সহজ সত্যটুকু মানতে পারেন নি যে শুধু এক ধর্মের দোহাই দিয়ে দুটো ভিন্ন জাতিকে এক জাতি-রাষ্ট্রের পতাকার নিচে এক করে রাখা যায় না। অধিকাংশ বাঙালি, পাঞ্জাবি বা পাঠানের মধ্যে ধর্মের ঐক্য থাকলেও তারা মােটেই অভিন্ন জাতি নয়।

তাদের পক্ষে এক অভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র গঠনও সম্ভব নয়। সিন্ধি বা পাঞ্জাবিদের সঙ্গে বাঙালিদের ভাষা, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এতই আলাদা যে তাদের এক অভিন্ন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তাই অবাস্তব। শুধু ধর্ম দিয়ে যে বিভিন্ন জাতিভুক্ত পাকিস্তানিদের এক রাখা যাবে না, এ কথা খােদ মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বুঝেছিলেন পাকিস্তান হওয়ার আগেভাগেই । ধর্মের দোহাই দিয়ে দেশভাগ হয়েছে, অথচ মুসলমানদের এক বিপুল অংশ রয়ে গেছে ভারতে। তাদের সংখ্যা পাকিস্তানি মুসলমানদের মােট সংখ্যার চেয়েও বেশি। তাদের সবাইকে পাকিস্তানে ঠাই দেওয়া অসম্ভব। সে কথা উপলব্ধি করে জিন্নাহ ১৯৪৭ সালে ১১ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদে যে বিখ্যাত ভাষণ দেন, তাতে স্পষ্ট করে বলে দেন, “পাকিস্তানে ধর্মকে রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়ানাে হবে না। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করা হবে।” তার সে ভাষণের পরপরই একাধিক মুসলিম উলেমা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ধর্মই যদি পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত জাতিসমূহকে ঐক্যবদ্ধ না করে, তাহলে কোন শক্তিতে পাকিস্তান একটি অভিন্ন জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকবে? মজার ব্যাপার হলাে অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার ছাড়া যে জাতি-রাষ্ট্র গঠন সম্ভব নয়, জিন্নাহ নিজেও সে কথা জানতেন। ১৯৪৪ সালে গান্ধীকে লেখা তার একটি চিঠি থেকে এ কথা স্পষ্ট হয় যে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের একটি জাতি বলে বর্ণনাকালে তাদের একটি অভিন্ন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের সম্ভাবনার কথাও ভেবেছিলেন। সে চিঠিতে জিন্নাহ দাবি করেন, “আমরা (অর্থাৎ ভারতের মুসলমানেরা) ১০ কোটি মানুষের একটি জাতি। তার চেয়েও বড় কথা, আমরা এমন এক জাতি, যাদের রয়েছে নিজস্ব সংস্কৃতি ও সভ্যতা, রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সাহিত্য।”

ভারতীয় মুসলমান বলতে যদি বাঙালি, সিন্ধি, পাঞ্জাবি বা পাঠানদের  বােঝায়, তাহলে তাদের সবার ভাষা যে এক নয়, তাদের সাহিত্যও এক নয়, তা বােঝা কঠিন নয়। তা সত্ত্বেও জিন্নাহ যে এক বচনে ভাষা’ শব্দটি ব্যবহার করেন তার কারণ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফিলিপ অলডেনবার্গের ব্যাখ্যায়, জিন্নাহ উর্দুকে সব মুসলমানের সাধারণ ভাষা’ (লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা) বলে ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে ধারণা যে ভুল, তা ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় পল্টন  ময়দানে ভাষণ দানকালেই তিনি বুঝে যান। উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র ভাষা হবে বলে ঘােষণা করলে সে সভার একাংশ না না’ বলে চেঁচিয়ে জিন্নাহকে বিদ্রুপ করে। পরে জিন্নাহ বাঙালিদের প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট বলে অভিযুক্ত করেছিলেন এবং ভাষার প্রশ্ন তুলে ঘোঁট পাকানাের জন্য নাম উল্লেখ না করে সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের মতাে বাঙালি নেতাদের বিরুদ্ধে কটুক্তি করেছিলেন। এসব বাঙালি নেতা দেশভাগের ঠিক আগে আগে পাকিস্তান বা ভারতে অন্তর্ভুক্তির পরিবর্তে এক স্বাধীন যুক্তবাংলার প্রস্তাব তুলেছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক তাদের মধ্যে অলডেনবার্গ ও পাকিস্তানের আয়েশা জালাল অন্যতম- নানা নথিপত্র ঘেঁটে এ কথা প্রমাণ করেছেন যে ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবে মুসলমানদের জন্য একাধিক রাষ্ট্র গঠনের যে প্রস্তাব রাখা হয়, তা কোনাে আকস্মিক ব্যাপার নয়। অথবা তা  স্টেনােগ্রাফারের টাইপের ভুলও নয় (যে দাবি জিন্নাহ পরে করেছিলেন)।

সে প্রস্তাবে সচেতনভাবেই মুসলমানদের জন্য একাধিক রাষ্ট্রের (স্টেটস) দাবি তােলা হয় । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ‘স্টেট’ ও ‘স্টেটস’ এই দুইয়ের ফারাক | কারও নজরে পড়েনি, তার এক কারণ সম্ভবত এই যে মুসলমানদের জন্য একটি নয়, দুটি রাষ্ট্র গঠনের কথাই তকালীন মুসলিম লীগ নেতারা বাস্তবসম্মত বলে ধরে নিয়েছিলেন। এ কথার সপক্ষে অলডেনবার্গ ১৯৩৭ সালে জিন্নাহকে লেখা মােহাম্মদ ইকবালের একটি চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছেন। সে চিঠিতে ইকবাল প্রশ্ন রেখেছিলেন, “উত্তর-পশ্চিম ভারত ও বাংলাকে স্নি। ভিন্ন জাতি হিসেবে কেন বিবেচনা করা হবে না এবং সেই মােতাবেক ভারতের ভেতরের ও বাইরের জাতিসমূহের মতােই সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের ন্যায্য অধিকার তারা কেন ভােগ করবে না?” বিশিষ্ট ভারত-বিশেষজ্ঞ রবার্ট কুপল্যান্ডের উদ্ধৃতি দিয়ে অলডেনবার্গ বলেছেন, “স্বাধীনতা লাভের অল্প সময় আগেও জিন্নাহ ও অন্যান্য। মুসলিম লীগ নেতা একটি নয়, দুটি মুসলিম রাষ্ট্রের কথা ভেবেছিলেন।” বস্টনের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক আয়েশা জালালও সে কথাই মনে করেন। তাঁর বক্তব্য, পাকিস্তানকে একটি ইসলামিক চরিত্র। (ইসলামিক আইডেন্টিটি) দেওয়ার চেষ্টায় সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও একদল বুদ্ধিজীবী সত্য-মিথ্যার যথেচ্ছ ব্যবহার করেছেন। জাতীয়তাবাদের একটি ভৌগােলিক (টেরিটোরিয়াল) ভিত্তি রয়েছে। পাকিস্তানে রচিত সরকারি ইতিহাসে।

যে জাতি-রাষ্ট্রের কথা বলা হয়, তাতে এই ‘ভূখণ্ডগত জাতীয়তাবাদ’-এর (বা। টেরিটোরিয়াল ন্যাশনালিজম) জন্য কোনাে স্থানই ছেড়ে দেওয়া হয় না। দেশভাগের পর অসংখ্য মুসলমান পাকিস্তানের বাইরে (অর্থাৎ ভারতে) রয়ে যায়, তার ফলে এক জনসংখ্যাগত বৈপরীত্য দেখা দেয়। ভারতীয় মুসলমানের দেশ হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে এই জনসংখ্যাগত বৈপরীত্যের যে সমস্যা তা সমাধানে জোড়াতালি দেওয়া ছাড়া আর কোনাে পথই ভােলা থাকল না। ড. জালালের কথায়, “পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে মুসলিম জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তার মধ্যে কোনাে সম্ভাব্য সমতা বিধানের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেল।” এ কথা কেউ অস্বীকার করে না যে জাতিসত্তা নির্মাণে ধর্ম একটি গুরুত্বপূর্ণ। উপাদান, কিন্তু তা একমাত্র উপাদান নয়। একটি ভূখণ্ডের মানুষ যখন নিজেদের একটি সাধারণ ঐতিহ্যবােধের অন্তর্গত মনে করে, তখনই সম্ভব জাতিসত্তার উদ্ভব। আর এই জাতিসত্তাই একসময় প্রকাশিত হয় জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে, যার ভিত্তিমূলে থাকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। আন্তোনিও গ্রামচি জাতি ও জাতি-রাষ্ট্রের একটি তাত্ত্বিক কাঠামাে দিয়েছেন তার ভাষা ও রাষ্ট্র শীর্ষক আলােচনায়। তার ব্যাখ্যা থেকে আমরা শিখেছি, যেকোনাে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের পেছনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সে জাতির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির। এর মাধ্যমে যে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নির্মিত হয়, তার শিকড় প্রথিত গতকালের ইতিহাসে, কিন্তু এই গতকালের কাহিনিই জাতি-রাষ্ট্রের বর্তমান নির্মাণ করে।’ গ্রামচি যাকে ‘ন্যাশনাল প্রেজেন্ট’ বলেছেন, তা আসলে কোনাে ভূখণ্ডভুক্ত জনগােষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ইতিহাস বা তার নিজস্ব ন্যারেটিভ’। জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতির আগে তার ভিত্তিভূমি তৈরি করে অভিন্ন জাতিসত্তার এই নিজস্ব ন্যারেটিভ। এই ন্যারেটিভের ভেতর দিয়েই কোনাে ভূখণ্ডভুক্ত জনগােষ্ঠী এক সূত্রে আবদ্ধ হয়।

বাঙালি, ঐতিহাসিক সালাহউদ্দিন আহমেদ তার বাঙালির সাধনা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থে এ কথা আরও সােজাসাপটাভাবে বলেছেন এভাবে : “জাতীয়তাবােধ জাগরণের পেছনে যে উপাদানটি সর্বাধিক প্রয়ােজন, সেটি হলাে। একটি সম্মিলিত ঐতিহ্যবােধ । এই ঐতিহ্যবােধ বা চেতনা যদি অনুপস্থিত থাকে। তাহলে কেবল এক বংশজাত বা এক ধর্মাবলম্বী হলেই এক অঞ্চল বা এক রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করলে অথবা এমনকি এক ভাষাভাষী হলেই জাতীয়তাবােধের পূর্ণ সূরণ বা উন্মেষ ঘটে না।” আমরা এ কথার স্বীকৃতি পাই পাকিস্তানের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী আইতাজ আহসানের লেখায়। তিনি পাকিস্তানের সাবেক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও সিনেটর, সাম্প্রতিক সময়ে আইনজীবীদের সফল আন্দোলনের একজন প্রধান নেতা। আইতাজ আহসান তার ‘দি ইন্দাস সাগা অ্যান্ড দ্য মেকিং অব পাকিস্তান’ গ্রন্থে পাকিস্তানকে সিন্ধু সভ্যতার সন্তান বলে ব্যাখ্যা করেছেন। কিন্তু শুধু ধর্ম দিয়ে সে সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। ধর্মের বন্ধন যদি সে সভ্যতার আসল জোর হতাে, তাহলে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ভাঙন ঠেকানাে অসম্ভব হতাে না। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান যে ভেঙে যায়, আইতাজ আহসান লিখেছেন, তার কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিভক্তি ধর্মের চেয়েও শক্তিশালী বলে প্রমাণিত হয়। বস্তুত, যখন পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক ব্যবধান তাদের মধ্যে ধর্মের অভিন্নতার চেয়েও অধিক শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তখন এই বিভক্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে। ওঠে। ধর্মের ভিত্তিতে যে দ্বিজাতিতত্ত্বের পত্তন, এই ভাঙনের ফলে তার আর কোনাে যৌক্তিকতাই থাকল না।

স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৫। এত দিন পর পাকিস্তানের সঙ্গে তার। বিভক্তি আমাদের মনে আর প্রশ্ন জাগায় না। বরং আমরা এই ভেবে আশ্চর্য হই, ২৩টি বছর সম্পূর্ণ বিজাতীয় একদল লােকের সঙ্গে এক পতাকার নিচে আমরা কাটালাম কী করে! পাদটীকা : আকবর আহমেদ গভীর আস্থার সঙ্গে বলেছেন, ধর্মভিত্তিক দেশ পাকিস্তান টিকে আছে, টিকে থাকবে। কিন্তু তার সে কথার সঙ্গে সবাই যে একমত, তা মনে হয় না। করাচির দৈনিক ডন পত্রিকার নিয়মিত কলাম লেখক আরদেশি কোয়াসজি মন্তব্য করেছেন, পাকিস্তান ভেঙে পড়ল বলে। এখন যে যেভাবে পারাে, এ দেশ থেকে পালাও। ‘বাক্স-পেটরা এখনই বাঁধাছাদা শুরু করে। এই দেশের আর কোনাে আশা নেই। জিন্নাহই বলেছিলেন, এই দেশের প্রতিটি সরকার তার আগের সরকারের চেয়ে নিকৃষ্টতর হবে। তার সে কথাই ক্রমশ সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। ৩. একুশ থেকে একাত্তর পাকিস্তানের ব্যর্থতার গর্ভ থেকেই জন্ম আরেক স্বপ্নের-বাংলাদেশের স্বাধীনতার । ভারত ভেঙে দুই টুকরাে হওয়ার এক বছর না গড়াতেই ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ এই সিদ্ধান্তে পৌছে যায় : এমন দেশ, যার নেতারা একদম মৌলিক গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখাতে অক্ষম, তাদের সঙ্গে এক হয়ে থাকা অসম্ভব। তারা স্বপ্ন দেখা শুরু করে এক ভিন্ন স্বাধীন ভূমির । না, তাদের সে স্বপ্ন দেখায় কোনাে ভুল ছিল না। প্রমাণ, আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ।

সে স্বপ্নের শুরু বাংলা ভাষার দাবি থেকে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, পাকিস্তানের জনক, ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকায় এসে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবিকে প্রাদেশিকতা-দুষ্ট বলে অভিযােগ করেছিলেন। যারা এমন দাবি তােলে, তারা যথার্থ মুসলমান নয়, এমন ইঙ্গিত তিনি করেছিলেন। ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাছে এক ভাষণে জিন্নাহ এই দুই অভিযােগই তােলেন এভাবে: ‘ভাষা নিয়ে যে সাম্প্রতিক বিতর্ক ছড়ানাে হয়েছে তার লক্ষ্য প্রাদেশিকতার বিষ ছড়ানাে। একসময় যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে বা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, এখন তারাই তােমাদের রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।’ জিন্নাহ ইঙ্গিতে বােঝালেন, যারা বাংলা ভাষার দাবি তুলেছে, তারা হয় হিন্দু, নয় ভারতের দালাল। এরা কেউ প্রকৃত পাকিস্তানি হতে পারে না। পরে জিন্নাহর সেই যুক্তি অনুসরণ করে পাকিস্তানি নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দুদের অর্ধেক পশ্চিম পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাসের দাবিও তুলেছিল। তাদের যুক্তি ছিল, ‘অন্যথায় হিন্দুরা ঘোঁট পাকাবে, পাকিস্তানকে ভাঙার ষড়যন্ত্র করবে।মজার ব্যাপার হলাে, বাংলা ভাষার পক্ষে যারা যুক্তি দেখিয়েছিলেন| জিন্নাহর চিন্তায় যাঁরা ভারতীয় অনুচর’- তাদের একজন ছিলেন জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্।

তার যুক্তি ছিল, পাকিস্তানের ৫৫ শতাংশ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলে। উর্দু ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের সংখ্যা মাত্র ৭ শতাংশ। শুধু দেশের অধিকাংশ মানুষের ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার পর বিবেচনা করা যাবে উর্দুকে বাংলার পাশাপাশি পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া যায় কি না। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর সঙ্গে বাদানুবাদের সময় বাঙালিদের মনে দেশ ভাঙার কোনাে কথা ওঠেনি । জিন্নাহই প্রকারান্তরে তার সে সন্দেহের কথা বলেছিলেন। জিন্নাহর বিবেচনায়, পাকিস্তান মুসলমানদের আবাসভূমি আর উর্দু মুসলমানদের নিজস্ব ভাষা। ফলে, বাংলা ভাষার দাবি তাঁর কাছে ছিল পাকিস্তানের অখণ্ডতার | বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র’। জিন্নাহর কাছে যা ষড়যন্ত্র, বাঙালির কাছে তা ছিল অবিভাজ্য অধিকার। পেছন দিকে তাকিয়ে এখন নির্দ্বিধায় বলা যায়, রাষ্ট্রভাষার দাবি শুধু ভাষার দাবি ছিল না, সে দাবি উত্থাপনের পেছনে আরও গভীর ভাবনা-চিন্তা- এক গভীরতর স্বপ্ন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের মধ্যে কাজ করেছিল। বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা একদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় তাদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা- শুধু স্বকীয়তা নয়, শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরে । অন্যদিকে সে দাবির ভেতর দিয়ে এমন কথাও জানিয়ে দেয় যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে যে ভিন্নতা রয়েছে তা নিয়ে আপস অসম্ভব।

‘আমরা ন্নি মানুষ। শুধু ভাষা ও সংস্কৃতি নয়, আমাদের বিশ্ববীক্ষা ভিন্ন।’ পাকিস্তানি নেতাদের কাছে  বাঙালিদের এই আচরণ ছিল দেশদ্রোহের শামিল। পরে, সামরিক একনায়ক। আইয়ুব খান তার ফ্রেন্ডস-নট মাস্টার্স গ্রন্থে সে অভিযােগ খােলামেলাভাবে তুলবেন। এমনকি এ কথাও বলবেন, বাঙালিরা তাদের হাজার বছরের ইতিহাসে কখনাে স্বাধীনতা ভােগ করেনি, স্বাধীনতা ভােগের যােগ্যও নয় তারা। রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, খুব শিগগির তা স্পষ্টভাবে রাজনৈতিক হয়ে ওঠে। এই রাজনীতির প্রকাশ ঘটে দুইভাবে। এক, পাকিস্তানি রাষ্ট্র পরিচয়ের একমাত্র নিশানা তাদের মুসলমান’-পাকিস্তানে নেতা ও তাত্ত্বিকদের এই ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও উদার রাজনৈতিক আত্মপরিচয় অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালিদের মধ্যে একটি সমন্বিত আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে। ১৯৫৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেই আওয়ামী মুসলিম লীগ তার নামের মুসলিম’ শব্দটি ঘেঁটে ফেলে। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তানের মুখে সেটি ছিল এক স্পষ্ট চপেটাঘাত। একই সময় ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের নতুন মাের্চা ‘যুক্তফ্রন্ট’ গড়ে ওঠে, যার লক্ষ্য একদিকে পূর্ব বাংলা থেকে পাকিস্তানপন্থীদের রাজনৈতিক উচ্ছেদ, অন্যদিকে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের পথে কদম ভােলা। এই দুই লক্ষ্য অর্জনে ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়ায় প্রধান হাতিয়ার। রাজনীতি ও সংস্কৃতি হয়ে পড়ে সমার্থবােধক। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকারের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সাড়ম্বরে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী। উদযাপন কেবল একটি সাংস্কৃতিক ঘটনা ছিল না, ছিল একটি রাজনৈতিক প্রতিবাদ। সে ঘটনার মাত্র ১০ বছরের মাথায় শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ভাষার অধিকার দাবির ভেতর দিয়ে যে আন্দোলনের শুরু, তার সমাপ্তি হয় স্বাধীনতায়।

স্বাধীনতাযুদ্ধে বাঙালির রণকৌশল ছিল সুনির্দিষ্ট, সে লক্ষ্য অর্জনে বাঙালির রাজনৈতিক ও নাগরিক সংহতি ছিল জোরালাে। কিন্তু স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর সে সংহতি ভেঙে পড়ে। বিভক্তি, বৈপরীত্য ও বিশ্বাসঘাতকতার চোরাবালিতে আটকে পড়ে স্বাধীনতার স্বপ্ন। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম ২০ বছর বাঙালি কাটিয়েছে সামনে এগােনাের সঠিক পথটি বাছতে। সে এক পা এগিয়েছে তাে দু পা হড়কে পড়েছে। বিশ্বের অন্য অধিকাংশ নব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের তুলনায় এই অভিজ্ঞতা মােটেই ভিন্ন ছিল না। ১৯৯০-এ সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশ প্রাতিষ্ঠানিক গণতন্ত্রের ভিত নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ বিজয় অর্জন করে। শুরু হয় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার নতুন লড়াই। কিন্তু যে প্রতিশ্রুতি নিয়ে সে লড়াইয়ের শুরু, বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেল রাজনীতির গােলকধাধা থেকে উদ্ধার পাওয়া তত সহজ নয়। একটি দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের গলায় ফাঁস হয়ে বসে। দুর্নীতি ও প্রশাসনের দলীয়করণ সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠে। নতুন যে রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্ম হয়, তার দুই প্রধান খুঁটি হয়ে ওঠে অর্থ ও পেশিবল। এই চোরাবালির ব্যুহ থেকে বাংলাদেশ আর নিষ্কৃতি পাবে না, এমন একটি হতাশা নাগরিক মানসে জেঁকে বসে। এরপর আরও ২০ বছর কেটে যাবে। ২০১৩-তে শুরু হবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের নতুন ও গুণগতভাবে ভিন্ন এক পর্যায়। আমরা জানতাম, যখন চারদিক গভীর অন্ধকার, তখনাে শােনা যায় গান, ‘আঁধারভরা সময়ের গান’। একাত্তরের ঘাতক ও দালালদের যথােপযুক্ত বিচার দাবি করে সারা দেশে যে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, এ হলাে সেই আঁধারভরা সময়ের গান। এই আন্দোলন গুণগতভাবে ভিন্ন। কারণ, এর নেতৃত্বে পেশাদার রাজনীতিকেরা নেই। যে তরুণেরা এই আন্দোলনের শকট চালক, তাদের চোখে পেশাদার রাজনীতিকেরা দেউলিয়া। পেশাদার রাজনীতিকদের একটি দল ঘাতক-দালালদের সঙ্গে প্রকাশ্য আঁতাতে লিপ্ত । অন্য দল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হওয়া সত্ত্বেও নতুন প্রজন্মের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ।

আপাতভাবে ঘাতক-দালালদের বিচার এই আন্দোলনে লক্ষ্য। কিন্তু সে কেবল বাইরের চিত্র। একাত্তর-পরবর্তী বছরগুলাের হতাশা ও মনােভঙ্গের মানচিত্রটি মাথায় না রাখলে এই বিক্ষোভের ভেতর-চেহারা উদ্ধার হবে না । এত দিন যাদের আমরা রাজনীতিবিমুখ ভেবে তিরস্কার করেছি, তারাই ফুঁসে উঠেছে। তাদের স্বপ্ন এক নতুন, এক ভিন্ন বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশে স্থান হবে না কোনাে খুনি রাজাকারের। অথবা দুর্নীতিপরায়ণ রাজনীতিকের। পেশাদার আপসকামী রাজনীতিক পেছনের দরজা দিয়ে নবীনের এই আয়ােজনে শামিল হতে চেয়েছে, পারেনি। নবীন প্রজন্ম যে এক ভিন্ন বাংলাদেশ চায়, এই প্রত্যাখ্যানই তার প্রমাণ। বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাবে এই আন্দোলন? এর উত্তর আমরা পাব সেই চীনা বৃদ্ধ রমণীর মন্তব্যে, যে নির্ভুলভাবে ভবিষ্যৎ গণনায় পারদর্শী ছিল। এক অতি-চালাক যুবক একবার ক্ষুদ্র একটি পাখি দুই হাতে ঢেকে প্রশ্ন করল, বলুন তাে, আমার হাতের পাখিটা জীবিত, না মৃত? বৃদ্ধা জানতেন, জীবিত বললে যুবকটি পাখিটি পিষে মেরে ফেলবে, আর মৃত বললে তাকে ছেড়ে দেবে । এক মুহূর্তে ভেবে বৃদ্ধা বললেন, ‘পুত্র, তােমার প্রশ্নের জবাব তােমার নিজের হাতেই রয়েছে। বাংলাদেশ কোন পথে এগােবে, সে প্রশ্নের উত্তর আজ এই তরুণদেরই হাতে।

সূত্র : একাত্তর যেখান থেকে শুরু – হাসান ফেরদৌস,  সময় প্রকাশনী,২০১৬