বাংলাদেশ প্রশ্নে জনৈক ভারতীয় কূটনীতিকের চিন্তাধারা
(বিশেষ সংবাদদাতা)
নয়াদিল্লীর সরকারি লবজ ধার করে বলি ওয়ানা অর্থাৎ ওয়েস্ট এশিয়া নর্থ আফ্রিকার কোনাে এক জায়গা থেকে লিখছি।
অল্প কয়েকজন ভারতীয় যারা আছেন এখানে প্রায় সবাই মর্মাহত। আরবরা ভারতবর্ষ থেকে এতাে সাহায্য পেয়েও ভারতবর্ষের দরকারের সময় শুধু হাত গুটিয়ে বসে আছে তাই নয়, মুখের কথা দিয়ে সমর্থন জানাতে পর্যন্ত রাজি নয়। ইসলামাবাদের ইসলামত্বই ওদের কাছে সবচেয়ে বড় কথা। পাকিস্তান এক সময় মার্কিনী আদেশে আরব জাতীয়তাবাদী অভ্যুত্থানের বিরােধিতা করেছে সে কথা আরবরা যেন ভুলেই গেছে। পূর্ববাংলায় লাখ লাখ লােক খুন করেছে এবং করছে ইয়াহিয়াতন্ত্রের তাতে কিছু যায় আসে না কারণ ওটা নাকি পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। তাছাড়া মেজরিটি মাইনরিটির কথা আরবরা বুঝতে শুনতে চায় না, ওরা শুধু চায়, যে রকম করেই হােক ইসলামিক পাকিস্তান যে রকম ছিল পূর্ব-পশ্চিম মিলিয়ে সে রকম যেন থাকে।
আমাদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছেই তাে। আমরা আরবদের হয়ে কথা বলে যাচ্ছি ইজরায়েলের বিরুদ্ধে এবং না বললে এখনাে ওরা গােসসা করে। যদিও বাংলাদেশের আর পাকিস্তানের কথা তুললেই ওরা কানে আঙুল দেয়। শুনেছি গত জুলাই মাসে যখন ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ কায়রাে গিয়েছিলেন তিনি যতই বলেন, তার সফরের উদ্দেশ্য বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করা, ততই ওখানকার কাগজগুলাে লেখে ভারত থেকে মন্ত্রী এসেছেন মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলতে।
কিন্তু এতাে হলাে আরব্যকাহিনী। ওরা ওদের স্বার্থ ভেবে চলে। কৃতজ্ঞতা অকৃজ্ঞতা ওসব নিয়ে ভাবলে সবসময় সুবিধে হয় না। মানি না মানি, যুক্তিটা বুঝি। বুঝতে পারি না কী কী করে কোন ভারতীয় তর্ক করতে পারেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াইকে সাহায্য করলে ভারতবর্ষের লােকসানই বেশি। পাকাপাকিভাবে বিদেশ থেকে দেশের কথা ভুলে যেতে চেষ্টা করছে এ রকম কেউ যদি হতাে তাহলে ব্যাপারটা গায়ে মাখতাম না। বা জেনারেল কারিয়াপ্পার মতাে শিক্ষা-দীক্ষার বয়স যদি হতাে তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু এ যে ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিসের মধ্যপদস্থ এক লােক, হয়তাে কয়েক বছর বাদে কোথাও ভারতের অ্যাম্বাসেডর হয়ে আমাদের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তবে একটা কথা পরিষ্কার করে রাখি তর্ক এই ভদ্রলােক ঘরােয়া বৈঠকেই করেন এবং যতদূর জানি ভারতীয়দেরই সঙ্গে অন্তত এখনাে পর্যন্ত।
গত এপ্রিল-মে মাস। পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি তাণ্ডবের সংবাদে ভারতীয়রা সবাই বিচলিত এখানে। অনেকেই আশা করছেন নয়াদিল্লী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবেন এবং শিগগিরই পূর্ববঙ্গ থেকে পাকিস্তানের নাম চিরকালের জন্য মুছে যাবে। এমন সময় খবর এল জয়প্রকাশ নারায়ণ কায়রাে হয়ে ইয়ােরােপ-আমেরিকার দিকে গেছেন এবং বলে গেছেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করার সুবর্ণ সুযােগ ভারত সরকার নষ্ট করেছে। আমাদের ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মচারীটি তখন বােঝাতে চেষ্টা করলেন অনেককে : ইন্দিরা সরকার পার্লামেন্টে প্রস্তাব পাস করিয়েছেন বাংলাদেশকে পুরাে সিমপ্যাথি আর সাপোের্ট জানিয়ে, তার বেশি আর কী চাই? চাওয়া উচিত নয় কারণ বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকতে পারবে না, ভারতের এক গলগ্রহ হয়ে দাঁড়াবে এবং সাহায্য দিতে দিতে ভারত নিজেই ফতুর হয়ে যাবে। ব্যাপারটা নাকি হয়ে উঠবে আমাদের পক্ষে এক ওপেন-এন্ডেড কমিটমেন্ট। কোনাে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার রেকগনাইজ করার কথা তাে ওঠেই না ওপেনহাইম টাইম অনেক বিদ্বান বিদ্বান সাহেব স্বর্গে হোঁচট খাবেন।
মাস দু’য়েক পরে বিশেষ গােপনীয় তথ্যাদি (আরাে বেশি গােপনীয় সূত্রে) পেয়ে তিনি আরাে জোরদার তর্ক জুড়লেন। আমরা যারা মুক্তিবাহিনীকে পর্যাপ্ত সামরিক সাহায্য দেয়ার কথা বলি তারা কিছু বুঝে তাে নাই, জানিও না। ভারত সরকার তাে গােলাগুলি দিচ্ছিলই যথেষ্ট, এখন ইন্টেলিজেন্স রিপাের্ট এসেছে দিল্লীতে সে সবের একটা বড় অংশ চলে যাচ্ছে মা-ওইস্টদের হাতে। আরাে সাহায্য পাঠালে বাংলাদেশ চীনাপন্থী নকশালীদের খপ্পরে পড়বে অবধারিত! তার ওপরে বিপদ সে সব বােমা বন্দুক সীমান্ত পার হয়ে শিগগিরই পশ্চিমবাংলায় ঢুকবে এবং তারপর বাঙালিদের তাে জানেনই এপার বাংলা একপার হয়ে এক লণ্ডভণ্ড কাণ্ড বাঁধবে, ভারতের অখণ্ডতা বাঁচিয়ে রাখাই হয়ে পড়বে এক বিরাট সমস্যা।
(ভদ্রলােক উত্তরাবর্তের কোনাে একটি প্রদেশের। যখনই আমার সঙ্গে আলােচনা হয় তখনই মনে করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমরা বাঙালি সত্তা একটু উদ্বেল হয়ে উঠবেই এবং তার ভারতীয় চিন্তাধারা আমার পক্ষে অনুধাবন করা একটু শক্ত হতে পারে তিনি বুঝতে পারেন)।
আরাে দুই তিন পরে এই ভারতীয় ডিপ্লোম্যাটের যেন কী হলাে, হঠাৎ কবুল করলেন প্রেজুডিস থােক বা অন্য কোনাে কারণেই হােক তিনি আগে বিশ্বাস করতে পারেননি বাঙালিরা লড়াই করতে চায় বা পারে। এখন তিনি বুঝেছেন তারা পারে এবং পারবে। সুতরাং ভারত সরকার ঠিক করে ফেলেছেন (আবার গােপন সূত্রে খবর এসেছে) যােলআনা মদদ দেয়া হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে। ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স এয়ার কভার দেবে মুক্তি বাহিনীকে এবং নেভি ব্লকেড করবে বঙ্গোপসাগর, যেন পাকিস্তানি সৈন্যসামন্ত রসদ ইত্যাদি সমুদ্রপথে না আসতে পারে। সবটাই গপপাে এবং অসত্য ইঙ্গিত করতেই ভদ্রলোেক দু’বােতল হুইস্কি বাজি রেখে ফেললেন পর্যন্ত।
বর্তমান পর্বে বাজি তিনি হেরেছেন এবং স্বীকার করেছেন কারণ মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে অক্টোবরের শেষে (বােতল দুটির খোঁজ নিইনি কারণ ঐ বাজিটা আমার সঙ্গে ছিল না) এবং এখন তিনি আবার তাজা টপ সিক্রেট ইন্টেলিজেন্স রিপাের্ট পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ আর বাংলাদেশ রিপ্রেজেন্ট করছে দাবি করতে পারে না কারণ ওখানে ভয়ানক খেয়ােখেয়ি আরম্ভ হয়ে গেছে। সুতরাং ভারতের সক্রিয় সাহায্য পেতে পারে এমন কোনাে দল আর বাংলাদেশে নেই।
এসব কথা শুনতে শুনতে ভাবি এই ভদ্রলােক তাে আমাদের নিজেদের মধ্যেই তার বাকস্বাধীনতা চর্চা করছেন। সেদিন থেকে আপত্তি করতে পারি না। কিন্তু এই যদি তার চিন্তাধারা হয় তাহলে কার্যকালে তিনি বাংলাদেশের জন্য এবং দেশের জন্য কি কিছু করবেন? পশ্চিম এশিয়ার কোনাে এক জায়গায় আমারই দেশের লােক একজন প্রলাপ বকছেন মনে করেও তাে সবটা উড়িয়ে দিতে পারি না। এই ভদ্রলােক যে ভারতের এক কূটনৈতিক প্রতিনিধি। কঠিন পরীক্ষা পাস করে সার্ভিসে ঢুকেছেন এবং যােগ্য বলেই তাে প্রমােশন পেয়ে ওপরে উঠছেন এবং তার সর্বোপরওয়ালা বৈদেশিক মন্ত্রী শরণ সিং ও সিমলাতে বলেই ফেলেছেন যে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তানি কাঠামাের মধ্যেই থাকতে চায় ভারত সরকারের আপত্তি নেই।
সূত্র: দর্পণ
১৯.১১.১৯৭১