You dont have javascript enabled! Please enable it!

আনুগত্য প্রশ্নে জামাত

বাংলাদেশে জামাতিরা পবিত্র ইসলামের নামে যেসব কাণ্ড-কারখানা করছে এগুলাে নতুন কিছু নয়। এসব তাদের গুরু মওদুদী সাহেবেরই শিক্ষা। বর্তমানে জামাতিরা যেমন এদেশে রাজনীতি করার সুযােগ পেয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধ মেনে নিতে পারেনি, তেমনি মওদুদী সাহেবও সে আমলে পাকিস্তানে আশ্রয় লাভ ও রাজনীতি করার সুযােগ পেয়েও পাকিস্তানের আদর্শকে গ্রহণ করতে পারেননি। সে সময় সুযােগ পেলেই তিনি তাঁর তথাকথিত ‘ইসলামিক খড়গ’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। তিনি ইসলামী শাসনব্যবস্থার ধুয়া তুলে সরকারী কর্মচারীদের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও যুবকদের পাক সেনাবাহিনীতে যােগদান করতে বারণ করেন। ১৯৪৮ সালের দিকে এক সময় পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব সরকার তার কর্মচারীদের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। সে সময় কোন কোন সরকারী কর্মচারীর জামাতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক ছিলাে। তারা এ ব্যাপারে জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা মওদুদীর পরামর্শ চান। তিনি অভিমত দান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “যেহেতু শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এই শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়, যা আইনত প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য যতদিন না বর্তমান শাসনব্যবস্থা পুরােপুরি ইসলামিক হবে, ততদিন এই শপথ গ্রহণ বৈধ নয়। উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি সে সময় নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পক্ষে কীরূপ ক্ষতিকর ছিলাে তা আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। উর্দু দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াকত’ পত্রিকার ১৯৪৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী পশ্চিম পাঞ্জাব সেক্রেটারিয়েটের জনৈক এসিস্ট্যান্টকে এজন্য বরখাস্ত করে দেয়া হয় যে, তিনি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি  জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “যখন শাসনব্যবস্থা শরিয়ত মােতাবেক হবে কেবলমাত্র তখনই আমার পক্ষে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকা সম্ভব হতে পারে।”২ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল উৎস সেনাবিভাগে যােগদান সম্পর্কেও জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। জামাতে ইসলামীর সদস্যদের সেনাবিভাগে যােগদান সম্পর্কে ‘মজলিসে শুরার’ (কার্যকরী পরিষদ) ১৯৪৮ সালের ১০  এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কয়েক মাস পর জামাতের সাধারণ সম্পাদক উক্ত সিদ্ধান্তের আলােকে একটি চিঠির উত্তরদান প্রসঙ্গে লেখেন, “বর্তমান সরকার অনৈসলামিক। এই জন্য আমরা মুসলমানদেরকে তার ফৌজ কিংবা রিজার্ভ বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিতে পারি না।’ ৩

 শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীতে যােগদান সম্পর্কে অনুরূপ বিভ্রান্তিমূলক আলােচনা করে জামাতে ইসলামী একটি পুস্তিকাও বের করে। বইটি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। কী উদ্দেশ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এরূপ ফতােয়া দেয়া হয়েছিলােতা বলা মুশকিল। কিন্তু তাতে পরিস্থিতিটা মওলানা ও তাঁর জামাতের সম্পূর্ণ উল্টো রূপ পরিগ্রহ করে। ইসলামের ছদ্মাবরণে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বুনিয়াদে এ ধরনের কুঠারাঘাত হানা দেখে দেশব্যাপী অসন্তোষের দাবানল জ্বলে ওঠে। দেশের সংবাদপত্রগুলাে জামাত ও মওলানার। বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে আরম্ভ করে। . চারা পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াকতে’ এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়, “…যতদিন এদেশে ইংরেজ ছিলাে মওলানা মওদুদীর সহগামী, সাহায্যকারী ও অনুসারী সরকারী অফিসার ও কর্মীরা পরম আনুগত্যের সাথে বৃটিশ সরকারের খেদমত করেছে। মওলানা মওদুদী তাদের বারণ করেননি। লােক-দেখানাে প্রচারণা ভিন্ন জিনিস, কিন্তু গবর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার কোনাে উচ্চপদস্থ অফিসার যে মওদুদী সাহেবের সাহায্যকারী ও মুরব্বী ছিলেন এবং তাদের নিকট থেকে যে তিনি অর্থ সাহায্য পেতেন একথা কারােরই অস্বীকার করার উপায় নেই। আশ্চর্যের বিষয়, যতদিন ইংরেজ রাজত্ব ছিলাে, যুদ্ধের জন্য সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হওয়া হারাম এরূপ কোনাে ফতােয়া মওদুদী সাহেব দেননি। আমার অনুসারী ও শিষ্যদের ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা উচিত’ এরূপ কোনাে বিবৃতিও মওলানা প্রচার করেননি।••••”৪

প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীতে ভর্তি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে ‘নওয়ায়ে ওয়াকত’ পত্রিকায় আরাে বলা হয় “. আফসােস, শত আফসােস! হিন্দুস্তানে মওলানা হােসাইন আহমদ মাদানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা হেফজুর রহমান ও মওলানা আহমদ  সাঈদ মুসলমানদের মনেপ্রাণে হিন্দুস্তান সরকারের সাথে সহযােগিতা করার পরামর্শ। দিচ্ছেন, কিন্তু পাকিস্তানে ইসলামী সরকার ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার দাবিদার শ্রেণী। মুসলমানদের এই পরামর্শ দিচ্ছেন যে, বর্তমান সরকার অনৈসলামিক এবং বর্তমান শাসনব্যবস্থা কাফেরী’ শাসনব্যবস্থা। সুতরাং ইসলামানুগ করা ছাড়া এর সাথে সহযােগিতা করা অসম্ভব। খােদা না করুন, যদি এরূপ অসহযােগিতার দরুন পাকিস্তান ‘খতম হয়ে যায়, তবে কি এখানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে? জামাতে ইসলামী হিন্দুস্তানেও রয়েছে এবং তার আমীরও মওলানা মওদুদীই। কিন্তু তাঁর সকল ফতােয়াই যে । পাকিস্তান সম্পর্কে, এর রহস্য কী ?”  এভাবে সে সময় পাকিস্তানের প্রতিটি সংবাদপত্র এবং প্রত্যেক মহল থেকেই মওলানা মওদুদী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও ১৯৭১ সালে পাক হানাদার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আবাস আলী খানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী একটি বক্তব্য উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে। তিনি ১৯৮৬ সালের ১৪ জানুয়ারি করাচীতে বলেছেন, “বাংলাদেশের জনগণ এখন পাকিস্তানের সাথে তাদের বিচ্ছেদের কারণে অনুতপ্ত। বস্তুত শঠতা, সুবিধাবাদ ও অন্তর্ঘাতমূলক নীতি সবসময় জামাতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে আসছে। আর পবিত্র ধর্মের ছদ্মাবরণে দেশ ও জাতিবিরােধী এসব তৎপরতা মওদুদী সাহেবেরই শিক্ষা। তাঁর অনুসারীরাও বাংলাদেশে এসব অত্যন্ত যােগ্যতার সাথে ধরে রেখেছে 

জামাতের ডিগবাজি

ইসলামী শাসনব্যবস্থার ধুয়া তুলে জামাতে ইসলামী পাকিস্তানের প্রশাসনযন্ত্র ও সেনাবাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা নিয়েছিলাে, তাতেও তাকে চরম ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। সে ভেবেছিলাে, এ পথে জনসাধারণকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা পাকিস্তান সরকারের জন্য শাপেবর হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণ উল্টো মওলানা মওদুদী, তাঁর বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও জামাতে ইসলামীর প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ সময় সরকার মওলানা ও তাঁর জামাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ অক্টোবর মওলানাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন সরকারের এই কার্যক্রমকে জনসাধারণ ন্যায়সঙ্গত বলেই গ্রহণ করে। | এবার জামাতে ইসলামীর কিছুটা চৈতন্যোদয় হলাে। তারা বুঝতে পারলাে, এভাবে। পাকিস্তানের বিরােধিতা করলে জনগণ কিছুতেই তাদের ক্ষমা করবে না। নির্ঘাত তাদের ঘরে বসতে হবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে তারা তাদের পূর্ব ভূমিকা থেকে অনেকটা সরে দাঁড়ালাে। এখন থেকে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের যেকোন ভাল কাজকে জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় সাধিত হয়েছে বলে জনসাধারণ্যে প্রচার করতে আরম্ভ করলাে। তারা ভাবলাে, সরকারের সমালােচনার ছদ্মাবরণে পাকিস্তানের ভাল কাজকে নিজেদের বলে চালিয়ে দিতে পারলে হয়তাে জনপ্রিয়তা লাভ করা যাবে। তাই তারা এ পথই বেছে নিলাে। এ পথে প্রথম যাত্রারম্ভ করলাে তারা ‘আদর্শ প্রস্তাবের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালে মওলানা মওদুদী ছিলেন জেলে। সেবার মার্চ মাসে পাকিস্তান আইন পরিষদ দেশে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে “আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন করেন। আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন লাভের সাথে সাথেই জামাতে ইসলামীর তরফ থেকে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, এখন পাকিস্তান আদর্শগতভাবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। আইন পরিষদ কর্তৃক আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি। 

এই উক্তি সম্বল করে জামাতে ইসলামী পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের দলীয় নীতি পরিবর্তন করার সুযােগ লাভ করে। তারা একথা মেনে নেয় যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে পাকিস্তানে চাকরি করা অবৈধ নয়। ১৯৪৯ সালের ২ অক্টোবর পাঞ্জাব প্রদেশের চীফ সেক্রেটারীর নিকট জেল থেকে পাঠানাে এক পত্রে মওলানা মওদুদী লেখেন, “….১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ আমাদের  ও সরকারের মধ্যকার মতবিরােধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার পর কেবলমাত্র সরকারী চাকুরেদেরই নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুভাকাংক্ষী, নিঃস্বার্থ শুভাকাংক্ষী হওয়া একান্ত কর্তব্য এবং এটা ঈমানের আবেদন বলে। আমরা মনে করি।”১

একথা পূর্বেও বলা হয়েছে যে, সরকারি চাকরি ও সেনাবাহিনীতে যােগদান সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ভুল ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ফতােয়া জনমনে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলাে। মওলানা সরকারকে কাবু করার জন্য যে ফাঁদ তৈরি করেছিলেন উল্টো নিজেই তাতে ফেঁসে গিয়েছিলেন। এই পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলা এবং জামাতে ইসলামীর নাজেহাল অবস্থা দূর করার জন্য মওলানা ও তাঁর অনুসারীরা ‘আদর্শ প্রস্তাবের আশ্রয় নিলেন। তাঁরা জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন, জামাতে ইসলামীর আন্দোলনের ফলেই গণপরিষদ ‘আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন করেছে। তাতে করে তাঁরা আর একবার নিজেদের পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করে জনসম্মুখে আসতে সক্ষম হন। এ সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর সে আমলের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি বলেছেন, “এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, জামায়াতে ইসলামীই তার (আদর্শ প্রস্তাবের) আসল আন্দোলনকারী ছিলাে। যদি এই সুসংহত শক্তি তার পিছনে না থাকতাে….তবে এ দাবী একটি পুরােপুরি সমস্যারূপে দাঁড় করান এবং তা কামিয়াবীর মঞ্জিলে পৌঁছান কোনাে অবস্থায়ই সম্ভবপর ছিলাে না।”২

এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলাে, সত্যি কি জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণপরিষদে ‘আদর্শ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে ? তাছাড়া পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীরা যেসব দাবী-দাওয়া উথাপন করেছিলেন সেগুলাে পুরােপুরি কি ‘আদর্শ প্রস্তাবে সন্নিবেশিত হয়েছিলাে ? নীতি পরিবর্তন তথা জামাতে ইসলামীর দুরবস্থার অবসানকল্পে সে আমলে জামাত নেতারা আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদনের কৃতিত্বের অধিকারী বলে যতাে প্রচারণাই চালিয়ে থাকুক না কেন, কিন্তু এক্ষেত্রে জামাতে  ইসলামীর এতটুকু কৃতিত্ব ছিলাে না। তাছাড়া আদর্শ প্রস্তাবের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, জামাতে ইসলামী নবীদাওয়া,তাতে সন্নিবেশিত করা হয়নি। মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসরা গােড়া থেকেই দাবী জানিয়ে আসছিলেন, আইন প্রণয়নের দায়িত্ব আলেমদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের আইন প্রণয়ন অধিকার দানের ঘাের বিরােধী ছিলেন। এ সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, “এটা•••• কিরূপ অদ্ভুত কথা যে, অন্য সব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা রায়দান করবেন, কিন্তু শরিয়ত বিষয়ে কোনাে ফয়সালাকারী বিশেষজ্ঞ থাকবে না।”৩

জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধ প্রচারণা সত্ত্বেও আদর্শ প্রস্তাবে আইন প্রণয়নের অধিকার জনপ্রতিনিধিদেরই দেয়া হয়েছিলাে। অবশ্য তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কয়েকটি শর্তারােপ করা হয়েছিলাে। এমনকি এসব শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতবিরােধ দেখা দিলে মীমাংসার ভারও জনপ্রতিনিধিদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলাে—আলেমদের ওপর নয়।  আদর্শ প্রস্তাবে যে জামাতে ইসলামীর মতামতের কোনাে মূল্য দেয়া হয়নি, আর একটি ব্যাপার থেকে তা চমৎকার প্রতিভাত হবে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে আইন পরিষদ অধিবেশনে আদর্শ প্রস্তাব নিয়ে আলােচনাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মরহুম লিয়াকত আলী খান ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতা পরিষ্কার শুনিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের আর জামাতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। এ সময়ে পরিষদে জনৈক অমুসলিম সদস্য মওলানা মওদুদীর ‘ইসলামের রাজনৈতিক আদর্শ’ (ইসলাম কা নজরিয়ায়ে সিয়াসী) নামক গ্রন্থ থেকে অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কিত একটি উদ্ধৃতি পড়ে শুনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন যােগাযােগমন্ত্রী মরহুম সরদার আবদুর রব নিশতার এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদীর উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আপনি কি জানেন সে ব্যক্তি এখন কোথায় ? তিনি এখন কারাপ্রাচীরে আবদ্ধ।”

জামাতে ইসলামী আইন পরিষদের অধিকারের উপর যেসব কঠিন শর্ত আরােপের দাবী করেছিলাে আদর্শ প্রস্তাবে সেসবেরও কিছু ছিলাে না। সারকথা, কোন দিক থেকেই আদর্শ প্রস্তাব সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর আত্মপ্রসাদ লাভের সঙ্গত কোন কারণ ছিলাে না। আসল ব্যাপার হলাে, সে আমলে গণপরিষদকে জামাতে ইসলামীর মর্জিমাফিক আইন তৈরির ভিত্তি প্রণয়নে বাধ্য করার শক্তিসামর্থই ছিলাে না। তাই, আদর্শ প্রস্তাব সমর্থন করা ও পাকিস্তানকে নীতিগতভাবে মেনে নেয়াটাই জামাত নেতারা শ্রেয় মনে করেছিলেন। তাতে তাদের দু’টি সুবিধে ছিলাে। প্রথমত, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ও সেনাবিভাগে যােগদানের ব্যাপারে আনাড়ি ফতােয়া দেয়ায় যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলাে, তারা তা দূর করতে সক্ষম হবে। কারণ পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে উপরােক্ত বিষয়ে পূর্বমত পরিবর্তন করার একটা বাহানা পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জামাতে ইসলামী সরকারের সাথে যে সামর্থ্যাতীত সংঘাত বাধিয়েছিলাে তারও অবসান ঘটবে। মূলত ইসলাম বা পাকিস্তানের স্বার্থে নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই জামাতে  ইসলামী আদর্শ প্রস্তাব সমর্থন করেছিলাে। বর্তমানে বাংলাদেশেও জামাত নেতারা সেই একই কৌশল অবলম্বন করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী ধনিক-বণিকদের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে গালিগালাজ করেছে। ইসলাম রক্ষার নামে লাখাে মুসলমানের রক্তে এদের হাত রঞ্জিত করেছে। এখন আবার ইসলামের নামেই বাংলাদেশের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!