অন্ধকারে পথ খুঁজছেন নয়াদিল্লী
প্রধানমন্ত্রীর দর্শন পেলেন সীমান্তের শরণার্থীরা। শ্রীমতী গান্ধীও দেখলেন তাদের। ওরা কাঁদলেন। প্রধানমন্ত্রী অভিভূত হয়ে পড়লেন। সান্তনা দিলেন। ইয়াহিয়া খান মেরে তাড়িয়েছেন তার নাগরিকদের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী টেনে নিয়েছেন তাদের কোলে। দুনিয়া দেখল, পশুশক্তির বিরুদ্ধে অহিংস মানবিকতার চমকপ্রদ সংগ্রাম। জংলী এবং সভ্য সরকারের মধ্যে আসমান-জমিন পার্থক্য। বৃহৎ শক্তিগুলাের কাছ থেকে অবশ্যই আসবে অজস্র সাধুবাদ। নয়াদিল্লী ভাবে গদগদ হয়ে পড়বেন। কিন্তু তারপর? ওপারে পাক-চমুর বর্বরতার বিরাম নেই। বাংলাদেশ বাহিনী করতে পারছেন না তাদের গতিরােধ। অস্ত্র নেই ওদের হাতে। নেই উপযুক্ত সামরিক শিক্ষা। বদলে গেছে যুদ্ধের প্রকৃতি। শুরু হয়েছে গেরিলা পদ্ধতিতে চোরাগােপ্তা মার। চরম সাফল্য বহুদূরে। তিরিশ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন। আরও আসবেন। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না এলে তারা ফিরবেন না বাংলাদেশে। এদের নিয়ে কি করবেন এখন নয়াদিল্লী? সাময়িকভাবে ভারত তাদের দেখাশােনা করবে। এই দেখাশােনার মেয়াদ কতদিন তা জানেন না কেন্দ্রীয় সরকার। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী দেন নি তার কোন ইঙ্গিত। হয়ত তিনি নিজেই অন্ধকারে পথ খুঁজছেন। কথায় এবং কাজে ধরা পড়ছে। গরমিল। প্রথমে কর্তারা বললেন—শরণার্থীরা থাকনের সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলাের মুখ্যমন্ত্রীরা ছুটলেন রাজধানীতে। বুঝালেন সমস্যার ব্যাপকতা এবং জটিলতা। তৈরী হচ্ছে এখন শরণার্থী শিবির বাকুড়া, মেদিনীপুর এবং পুরুলিয়ায়। সীমান্তের শরণার্থী সমস্যা আস্তে আস্তে ঢুকছে দেশের অভ্যন্তরে। মতিস্থির নেই নয়াদিল্লীর। থাকরে এধরনের অস্থিরতা দেখা যেত না প্রশাসনে।
যারা ভারতের নীতি নিয়ামক তাঁদের ধারণ—শরণার্থীরা ফিরে যাবেন বাংলাদেশে। কোন বাংলাদেশে ফিরবেন তারা? ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানে, না মুজিবর রহমানের স্বাধীন বাংলাদেশে? কোন স্পষ্ট উত্তর নেই প্রধানমন্ত্রীর মুখে। কতদিন শরণার্থীরা থাকবেন ভারতে? জানেন না তা কেন্দ্রীয় সরকার। অদূরে ভবিষ্যতে কতর কোঠায় পৌছবে ওদের সংখ্যা? জবাব মিলবে না কারও কাছে। আর জবাব দেবেনই বা কে? সব নির্ভর করছে ইয়াহিয়ার মর্জির উপর। বাঙালীদের রাখলে তিনি রাখতে পারেন, তাড়ালে তাড়াতে পারেন এবং গলা কেটে নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে পারেন। তাঁর মর্জির রকমভেদের দিকে নজর রেখে বিন্যাস, অবিন্যাস এবং পুনর্বিন্যাস হচ্ছে ভারতের নীতি। এরই নাম বাইরের প্রভাবমুক্ত স্বাধীন চিন্তাধারা। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এতগুলাে নাগরিকের দায় বর্তিয়েছে ভারতের উপর। পশ্চিম বাংলা হাবুডুবু খাচ্ছে প্রতিদিন। অর্থের জন্য নাকি তার চিন্তা করতে হবে না। ওটা জোগাবেন কেন্দ্রীয় সরকার। টাকাটা অবশ্যই আসবে জনসাধারণের পকেট থেকে। অথচ জনসাধারণ জানছেন না তাদের দায় কতখানি। যতদিন লড়াই চলবে ততদিন স্বাভাবিক অবস্থা তৈরী হবে না বাংলাদেশে। শরণার্থীরা অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকবেন ভারতে। যতদিন যাবে সমস্যায় তত শাখা প্রশাখা গজাবে। এই সহজ কথাটি নয়াদিল্লী ভালভবেই বুঝেন। বুঝেও তাদের কিছু করার নেই। এখানেই ভারতীয় গণজীবনের শােচনীয় ট্রাজেডী। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলে স্পষ্ট হত ভবিষ্যতের পথ। আপাততঃ তা দিচ্ছেন না কেন্দ্রীয় সরকার। সংশয়ের দোলায় দুলছেন না। তারা। একদিকে স্বাধীন বাংলা সরকারের পিঠ চাপড়াচ্ছেন এবং অপরদিকে ইসলামাবাদে পাঠাচ্ছেন ঝুড়ি ঝুড়ি নােট। সঙ্কট বাড়ছে। নৈরাজ্যের মেঘ জমছে রাজনৈতিক আকাশে।
বিশ্ব চাপে ইয়াহিয়া নতজানু হবেন—এ আশা দুরাশা। যারা এ চাপ সৃষ্টি করতে পারেন তারা নিজস্ব জাতীয় স্বার্থের ধান্দায় ব্যস্ত। ওদের ঘাড়ে পড়ে নি শরণার্থীর বােঝা। ওদের নিরাপত্তা হয় নি বিপন্ন। শুধু মানবতার খাতিরে তারা ইয়াহিয়কে চটাতে রাজী নয়। ক্ষমতার সঙ্গে সংস্রবহীন একদল বিবেকী মানুষের কলরবে ডিকটেটরের মােহভঙ্গ হয় না। ইয়াহিয়ারও হবে না। টাকার অভাব ঘটেছে পাক-সরকারের। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে ইরান, তুরস্ক, সৌদী আরব এবং চীন। আত্মশক্তি ছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের ভরসা কোথায়? সামনের দিনগুলাে আরও সাংঘাতিক। মুক্তিযােদ্ধা কোন অবস্থাতেই অস্ত্র সম্বরণ করবেন না এবং করতে পারেন না। দরকার পড়লে ভারত সীমান্ত থেকে তারা লড়াই চালাবেন। অবস্থাটা হবে ইস্রাইলের বিরুদ্ধে আরব গেরিলাদের আপােষহীন সংগ্রামের মত। শরণার্থী শিবিরগুলাে থেকে চলবে সৈন্য সংগ্রহ। বাধা দিলে দেখা দেবে ভারতের ভিতরে রাজনৈতিক উত্তেজনা। না দিলে ইসলামাবাদ শুরু করবে আকাশ ফাটা চীৎকার। পাক-ভারত বিরােধ নেবে আন্তর্জাতিক রূপ। যে সম্ভাবনা এড়াতে চাচ্ছেন নয়াদিল্লী তাই চেপে বসবে তাঁদের উপর। দুদিন আগেই হােক, আর পরেই হােক ইসলামাবাদ-নয়াদিল্লীর প্রত্যক্ষ ঝগড়া অবশ্যাম্ভাবী। শরণার্থী এবং গেরিলা—এই দুটিই তার উর্বর ক্ষেত্র। বাংলাদেশের শরণার্থীদের পুণঃ প্রবেশ মুখের কথায় হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার যখন ট্যাঙ্ক, কামান এবং বন্দুক নিয়ে মুক্ত অঞ্চল গড়ে তুলতে পারবেন তখনই সম্ভব হয়ে উঠবে শরণার্থীদের পুণঃযাত্রা। পাক-চমুর সমূলে উচ্ছেদের পরই হবে তাদের সত্যিকারের পুণর্বাসন। এ পথের পাথেয় জোগাবার দায়িত্ব যতদিন ভারত কিম্বা অন্য কোন বিদেশী রাষ্ট্র না নেবে ততদিন শরণার্থীর বােঝা ভারী হয়েই থাকবে। বাংলাদেশ সরকারেরও জানা উচিত, তাদের হয়ে অন্যে লড়াইএ নামবে না। যুদ্ধ করতে হবে তাদের নিজের জোরে। অস্ত্র জোগারের পথ বাছতে হবে তাদেরই। ভারতীয় জনতা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে। নয়াদিল্লীর দ্বিধা সঙ্কোচ কাটাবার মুখ্য দায়িত্ব সমব্যথী ভারতীয় নাগরিকদের। এ দায়িত্ব অবশ্যই তারা পালন করবেন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৮ মে ১৯৭১