You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.02 | ডিসেম্বরে বাংলার রণাঙ্গন - সংগ্রামের নোটবুক

ডিসেম্বরে বাংলার রণাঙ্গন

২রা -১৬ই ডিসেম্বর’ ৭১ ডিসেম্বর মাসে সারা বাংলার রণাঙ্গন বস্তুত মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সম্মিলিত অভিযানেরই চিত্র। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের যুদ্ধকে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত করে। বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের দৃষ্টি আড়াল করবার অভিপ্রায়ে ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তান কোনাে প্রকার যুদ্ধ ঘােষণা ছাড়াই তার জঙ্গী বিমান দ্বারা বিকেল ৫টা ৪৭ মি, ভারতের প্রায় সবগুলি অগ্রবর্তী বিমান ঘাঁটিতে বােমা বর্ষণ করে। পাকিস্তানি বিমান বাহিনী ভারতের অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর, আম্বালী, যােধপুর ও আগ্রায় বােম্বিং করে এবং পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনী ভারতের সােলেমানকি, খেমকারান, পুঞ্চ ও অন্যান্য অগ্রবর্তী এলাকায় গােলাবর্ষণ করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা। গান্ধী তখন কলকাতায়, তাঁর প্রতিরক্ষামন্ত্রী পাটনায় এবং অর্থমন্ত্রী বােম্বেতে ছিলেন। রাত সাড়ে দশটায় এক বিশেষ বিমানে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী দিল্লীতে পৌছে তিন বাহিনী প্রধান-সেনাবাহিনীর জেনারেল এস, এইচ, এফ, জে মানেকশ, নৌ বাহিনীর এ্যাডমিরাল এস, এম, নন্দ এবং বিমান বাহিনীর এয়ার চিফ মার্শাল পি,সি, লাল-এর সাথে এক জরুরি বৈঠকে বসলেন। তাঁদের সাথে সর্বাত্মক পরিস্থিতির উপর আলােচনা করলেন এবং সবশেষে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতি আঘাতের নির্দেশ দিলেন। ৪ঠা ডিসেম্বর সকাল ১টা (৩/৪ ডিসেম্বর দিবাগত রাত ১টা) ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে বলেন, “Today the war in Bangladesh has become a war on India. This has imposed upon me, my government and the People of India, a great responsibility. We have no other option but to put our country on war footing. Our brave officers and Jawans are at their posts, mobilised for the defence of the country.” ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করল। তিন বাহিনী প্রধান তাদের সদর দফতরে নির্দেশ পাঠালেন, :War is on. Hit back, hit back with all your might” শুরু হয়ে যায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তৃতীয় যুদ্ধ।

ভারতের তিন বাহিনী প্রধানকে রাজনৈতিকভাবে তিনটি লক্ষ্য (aim) দেওয়া হয়েছিল : * অরুণ ভট্টাচার্য্য : ডেট লাইন মুজিবনগর : পৃঃ ১৫১

১. বাংলাদেশ যথাশীঘ্র সম্ভব মুক্ত করা (জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার মতে:

ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশকে তিন সপ্তাহে মুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়, কিন্তু ১৩ দিনে মুক্ত করে) | পশ্চিমে ও উত্তরে প্রতিরােধ করা, যদি চীন পাকিস্তানের সাহায্যে অগ্রসর হয়,

এবং ৩. কাশ্মীরে পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য এলাকা দখলের ক্ষতি পূরণে পশ্চিম

পাকিস্তানের যথেষ্ট পরিমাণ এলাকা দখল করা। উপরােক্ত ১ম রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের পরিকল্পনা করতে গিয়ে ভারতীয় পরিকল্পনাকারীদের বাংলাদেশের যুদ্ধে কতকগুলাে বাস্তব-অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত : বাংলাদেশের প্রকৃতি। অসংখ্য নদী-নালার দেশ বাংলাদেশ। কতগুলাে নদী অত্যন্ত বিশাল যা প্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশকে ৪টি বড় বড় অঞ্চলে। বিভক্ত করেছে। অঞ্চলগুলাে হল : ১. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল : পদ্মানদীর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কুষ্টিয়া, যশাের, ‘।

ফরিদপুর, খুলনা, পটুয়াখালী ও বরিশাল জেলা। ২. উত্তর- পশ্চিমাঞ্চল : পদ্মা নদীর উত্তর ও যমুনা নদীর পশ্চিমাঞ্চলে পাবনা,

রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও দিনাজপুর জেলা। উত্তরাঞ্চল : যমুনা নদীর পূর্ব ও মেঘনার উত্তরাঞ্চল শুধু ময়মনসিংহ ও

টাঙ্গাইল জেলা এবং ৪. পূর্বাঞ্চল : ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালী, সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম

জেলা সহকারে মেঘনা নদীর পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা। দ্বিতীয়ত : অধিকাংশ নদী নালা উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত যার ফলে পশ্চিম থেকে পূর্বে বড় সেনাবাহিনী অগ্রসর হওয়া তুলনামূলকভাবে কঠিন। তৃতীয়ত : রাস্তা ঘাটের স্বল্পতা এবং চতুর্থত : দেশের অভ্যন্তরে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক বিমান বা জলযানের দুষ্প্রাপ্যতা। এই বাস্তব অসুবিধাগুলিকে সামনে রেখেই ভারতীয় সমরবিদগণ বাংলাদেশের চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য এক বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল:১. প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য- ক্ষীপ্রতা। ছােট খাটো শহর বা শত্রুঘাটি দখলের জন্য।

সময়ের অপচয় না করে সেগুলােকে এড়িয়ে দু’সপ্তাহের মধ্যে যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকায় স্থাপন। শক্রকে ধােকা দেওয়া। শত্রুকে বােঝানাে যে তার চেয়ে চার গুণ বেশি শক্তি নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করছে এবং সবদিক থেকেই আক্রমণ করতে যাচ্ছে যেন পাকিস্তান তার বাহিনীকে বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে রাখতে বাধ্য হয়। ঢাকা রক্ষার জন্য পিছনে সরে সেই ছড়ানাে সৈন্যদলের কোনাে প্রকারেই সংঘবদ্ধ হওয়ার সুযােগ ব্যর্থ করা।

s, পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে কোথাও কোনাে বড় বা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জড়িয়ে না

পড়া এবং সেজন্য প্রয়াজন বড় বড় সড়ক পথগুলাে এড়িযে শত্রর অনভিপ্রেত কাঁচা সড়কে অগ্রসর হওয়া। বাংলাদেশের দখলদার বাহিনীর মনােবল শুরুতেই ভেঙে দেবার উদ্দেশে কৌশলগত আক্রমণের পদ্ধতি নির্ণয় করে শত্রকে যুদ্ধ না করেই আত্মসমর্পণে বাধ্য করা।

মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর পরিসংখ্যান উপরােক্ত লক্ষ্যগুলাের প্রতি দৃষ্টি রেখে ভারত নিম্নরূপভাবে বাংলাদেশের তিনদিকে তার সেনাবাহিনী মােতায়েন করে। ১. ৪নং কোর । কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সগত সিং তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলেন আগরতলায়। কোরের অধীনে ৮ নম্বর, ২৩ নম্বর এবং ৫৭ নম্বর পার্বত্য ডিভিশন। তাছাড়া দুই স্কোয়াড্রন পি, টি-৭৬ রাশিয়ান সাঁতারু ট্যাঙ্ক, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামান-সজ্জিত একটি মিডিয়াম রেজিমেন্ট এবং সেতু নির্মাণে সক্ষম একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল-সিলেট থেকে দক্ষিণে নােয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। ঢাকা ও কুমিল্লাকেও এই কোরের অপারেশন এলাকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১০১ কমুনিকেশন জোন কমান্ডার মেজর জেনারেল জি, এস, গিল। জামালপুরের যুদ্ধে মেজর জেনারেল গিল আহত হওয়ার পর মেজর জেনারেল জি, নাগরাকে এই এলাকার দায়িত্ব দেওয়া হয়। হেডকোয়ার্টার ছিল গৌহাটি। এর অধীনে দুই ব্রিগেড পদাতিক সৈন্য ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা নিয়ে উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল। ৩৩ নং কোর। কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এম, এল, থাপান। শিলিগুড়িতে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। তার অধীনে ছিল ৬ নম্বর ও ২০ নম্বর পার্বত্য ডিভিশন। এছাড়া ছিল রাশিয়ান পি, টি – ৭৬ সাঁতারু ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ব্রিটিশ ৫.৫ ইঞ্চি কামানে সজ্জিত একটি মিডিয়াম রেজিমেন্ট এবং সেতু নির্মাণে সক্ষম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ১০১ কমুনিকেশন জোন, ৩৩ নম্বর কোরেরই অংশ বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়ার দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। ৪. ২ নম্বর কোর ।

কোর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল টি, এন, রায়না তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন কৃষ্ণনগর। তার অধীন ছিল ৪র্থ ও ৯ম পার্বত্য ডিভিশন। রাশিয়ান টি ৫৫ ট্যাঙ্ক দ্বারা সজ্জিত একটি মিডিয়াম আর্মার্ড রেজিমেন্ট, পি, টি – ৭৬ রুশ সাতারু-ট্যাঙ্কে সজ্জিত একটি হালকা ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট, ১৩০ মি. মি. দূর পাল্লায় রাশিয়ান কামান দ্বারা সজ্জিত একটি মিডিয়াম আর্টিলারি রেজিমেন্ট এবং সেতু নির্মাণে সক্ষম একটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিট। ৪র্থ ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার করা হয় কৃষ্ণনগর ও গেদের মাঝামাঝি এবং ৯ম ডিভিশনের হেডকোয়ার্টার করা হয় ২৪ পরগণা জেলার বয়রার কাছাকাছি এলাকায়। এই কোরকে বাংলাদেশের ৮ নম্বর ও ৯ নম্বর। সেক্টরের কুষ্টিয়া, যশাের, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলা সহকারে বিস্তীর্ণ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এর দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। এছাড়া ছিল মুক্তিবাহিনীর ৩টি রেগুলার ব্রিগেড জেড-ফোর্স, কে-ফোর্স ও এস-ফোর্স, ১০টি মুক্তিবাহিনী সেক্টরের ২০,০০০ মুক্তিযােদ্ধা ও লক্ষাধিক গণবাহিনী গেরিলা। যুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নিয়ে গঠিত হলাে একটি যৌথ কমান্ড। এই কমান্ডের প্রধান কমান্ডার হলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা। ভারতীয় বাহিনী সর্বস্তরে বিমান বাহিনীর একজন করে সমম্বয় অফিসার (Liaison officer) নিযুক্ত করার ফলে নির্দিষ্ট বিমান হামলা ছাড়াও যুদ্ধের ময়দানে খুব কাছাকাছি বিমান সাপাের্ট (Close air support) দেওয়া সম্ভব হয়েছিল। পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান বিমান বাহিনী ধ্বংস হয়ে যাবার পর মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সৈন্যদেরকে Closer air support দেওয়া ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজ (Aircraft carrier) আই, এন, এস ভিক্রান্তকে (INS VIKRANT) তার প্রয়ােজনীয় প্রহরীজাহাজ সহকারে ভারতের ইস্টার্ন ন্যাভাল কমান্ড বেস বিশাখাপট্টম-এ রাখা হয়েছিল। প্রয়ােজনীয় নৌ-যুদ্ধ পরিচালনার জন্য।

বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিসংখ্যান ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ ভারত-পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার প্রাক্কালে বাংলাদেশে। পাকিস্তানের সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক লক্ষ। এই বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টারের অধীনে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ,এ,কে, নিয়াজীর নের্তৃত্বে ৫টি পদাতিক ডিভিশন ও ১টি ইন্ডিপেনডেন্ট ব্রিগেডের ছত্রছায়ায় শুধু এক লক্ষ পাকিস্তানি সেনারাই যুদ্ধ করেনি, তাদের সহযােগী হিসেবে পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশীয় দালালদের দ্বারা তৈরি করেছিল প্রায় ৫০,০০০ সদস্যের রাজাকার, আলবদর ও আল শামস বাহিনী। এছাড়াও ছিল পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে বাংলাদেশে। বসবাসকারী তিন লক্ষাধিক অবাঙালি বিহারি মুসলমান।

মুক্তি ও মিত্রবাহিনীকে মােকাবেলা করার জন্য জেনারেল নিয়াজী তার বাহিনীকে তার মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী যেভাবে নিয়ােগ করেছিলেন তার বিস্তৃত বিবরণ নিয়ে পরিবেশন করা গেল : বাহিনী

অবস্থান। অধিনায়ক ১, হেডকোয়ার্টার ইস্টার্ন কমান্ড ঢাকা | লে. জেনারেল এ, এ, কে, নিয়াজী

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ। পদাতিক ডিভিশন

ঢাকা। জামসেদ খান। ২. হেডকোয়ার্টার

৯৩নং ইনডিপেনডেন্ট ব্রিগেড ঢাকা। ব্রিগেডিয়ার কাদির খান | ৩. হেডকোয়ার্টার | ৩৯নং পদাতিক ডিভিশন চাঁদপুর মেজর জেনারেল রহিম খান ক, হেডকোয়ার্টার | ৫৩নং পদাতিক ব্রিগেড

ব্রিগেডিয়ার মাে, আসলাম নিয়াজী ব, হেডকোয়ার্টার

কুমিল্লা ব্রিগেডিয়ার শেখ মনসুর হােসেন | ১১৭নং পদাতিক ব্রিগেড গ. হেডকোয়ার্টার

চট্টগ্রাম ব্রিগেডিয়ার মিয়া তাসকিনউদ্দিন | ৯১নং পদাতিক ব্রিগেড ঘ, হেডকোয়ার্টার

চট্টগ্রাম। ব্রিগেডিয়ার আতাউল্লাহ খান মালীক ৯৭নং পদাতিক ব্রিগেড ৪. হেডকোয়ার্টার

আগঞ্জ। মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ খান ১৪নং, পদাতিক ডিভিশন ক, হেডকোয়ার্টার

সিলেট | ব্রিগেডিয়ার আসগর হােসেন ২০২নং পদাতিক ব্রিগেড ব, হেডকোয়ার্টার

মৌলবীবাজার ব্রিগেডিয়ার ইফতেখার ৩১৩নং পদাতিক ব্রিগেড গ, হেডকোয়ার্টার।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া ব্রিগেডিয়ার সাদউল্লাহ ২৭নং পদাতিক ডিভিশন ৫. হেডকোয়ার্টার

নাটোর | মেজর জেনারেল নজর হােসেন শাহ ১৬নং পদাতিক ডিভিশন বগুড়া। ক. হেডকোয়ার্টার।

সৈয়দপুর বিগ্রেডিয়ার ইকবাল মাে, সফি ২৩নং পদাতিক ব্রিগেড ব, হেডকোয়ার্টার

ক্ষেতলাল ব্রিগেডিয়ার তাজমল হােসেন মালীক ২০৫নং পদাতিক ব্রিগেড রংপুর হেডকোয়ার্টার।

নাটোর। ব্রিগেডিয়ার মীর আবদুল নাঈম ৩৪নং পদাতিক ব্রিগেড ৬. হেডকোয়ার্টার

যশাের। মেজর জেনারেল এম এইচ, আনসারী ৯নং পদাতিক ডিভিশন

ঝিনাইদহ

ব্রিগেডিয়ার সরদার আ, রহিম দূররাণী

যশাের।

ব্রিগেডিয়ার মালীক হায়াত খান

যশাের

ক. হেডকোয়ার্টার

৫৭নং পদাতিক ব্রিগেড। খ, হেডকোয়ার্টার

১০৭নং পদাতিক ব্রিগেড গ. ৩নং ইনডিপেনডেন্ট।

আর্মার্ড স্কোয়াড্রন। ৭. হেডকোয়ার্টার, ইস্ট

পাকিস্তান ক্যাভালরি ৮. ৬ সেকশন

(২০টা) সেবরজেট জঙ্গীবিমান

ঢাকা

মেজর জেনারেল মােহাম্মদ জামশেদ খান

ঢাকা

মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর অগ্রাভিযান পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ ঘােষণার অব্যবহিত পূর্বেই ভারতীয় নৌবাহিনীর গৌরব, তাদের একমাত্র বিমানবাহিনী যুদ্ধজাহাজ আই, এন, এস ভিক্রান্ত বিশাখাপট্টম ন্যাভাল বেসের অদূরে পরিলক্ষিত পাকিস্তান নৌবাহিনীর গৌরব অত্যাধুনিক সাবমেরিন পি, এন, এস। গাজী কে ডেপথ চার্জের আঘাতে টুকরাে টুকরাে করে সমুদ্র গর্ভে চিরবিলীন করার মাধ্যমে শুরু হয় পূর্ব-বাংলায় পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ। তারপর ৪ঠা ডিসেম্বর ভাের ৩ ঘটিকায় ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকা ও কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটিতে বােমা বর্ষণের মাধ্যমে উদ্বোধন করে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় বহরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যদস্ত করে ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলার আকাশে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে।

চট্টগ্রাম পুনরুদ্ধার ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ সন । ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধ সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘােষণা করে। বাংলাদেশের তিনদিকে তার সৈন্য সমাবেশ করে সত্য, কিন্তু এর পূর্ব থেকেই মুক্তিবাহিনী কখনাে এককভাবে, কখনাে মিত্রবাহিনীর সাপাের্টে আবার কখনাে ভারতীয় বি,এস, এফ কোম্পানি বা ব্যাটালিয়নের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানি সেনাদের পর্যদস্ত করে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। ২নং সেক্টরের কে-ফোর্সের ৪র্থ ও ১০ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন ১লা ডিসেম্বরেই ফেনি শহরকে শত্রুমুক্ত করে রেজুমিয়া সেতুতে উপস্থিত হয়। ওদিকে ১০নং সেক্টরের ক্যাপ্টেন মাহফুজও তার বাহিনীসহ অগ্রসর হয়ে কেফোর্সের ব্যাটালিয়নদ্বয়ের সাথে রেজুমিয়া সেতু এলাকাতে একত্রিত হয়। এই বাহিনীর একটি কলাম ডানদিকে মুহুরী নদীর তীর ঘেঁষে এবং অপর কলাম ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে ৯ই ডিসেম্বর জোরারগঞ্জ উপস্থিত হয়। এখানে মিত্র বাহিনীর ৩২ তম মাহার রেজিমেন্ট লে. কর্নেল হরগােবিন্দ সিংয়ের নের্তৃত্বে মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগদান করে। অন্যদিক থেকে অগ্রসরমান লে, রফিক ও লে, ফারুকের বাহিনীও জোরারগঞ্জে একত্রিত হয়। মুক্তিও মিত্রবাহিনীর এই সম্মিলিত দলের দুর্বার আক্রমণে পাকিস্তানি

বাহিনী শুধু আটিলারি সাপাের্টের সাহায্য পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। জোরারগঞ্জ সংঘর্ষে মুক্তি বাহিনীর ১২ জন যােদ্ধা শহীদ হয়। | ভারতীয় ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপ তার ৮৩তম মাউন্টেন ব্রিগেড সহকারে চাঁদগাজী এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সাথে যােগ দেয়। এই ব্রিগেডের সহায়তায় ১০ম বেঙ্গল ৭ই ডিসেম্বর নােয়াখালী সদর মুক্ত করে। এদের হাতে ৯ই ডিসেম্বর নােয়াখালী পুরােপুরিভাবে মুক্ত হয়। সম্মিলিত বাহিনী সেদিনই চট্টগ্রামের পথে অগ্রসর হয়ে ১৩ ডিসেম্বর কুমীরার সন্নিকটে পৌঁছে যায়। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও মিত্রবাহিনীর লে, কর্নেল হরগােবিন্দের বাহিনী চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রসর হয়ে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দিরে | পৌছুবার সাথে সাথেই পাকিস্তানি বাহিনী আর্টিলারির সাহায্যে ব্যাপক আক্রমণ চালায়।

তাদের এই ব্যাপক আক্রমণে দু’টি অমূল্য প্রাণ মুক্তিবাহিনীর সুবেদার হাফিজ ও | মিত্রবাহিনীর ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আলী শহীদ হন। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের তীব্রতা | সত্ত্বেও সম্মিলিত বাহিনী ১২ই ডিসেম্বর সীতাকুণ্ড পুরােপুরি মুক্ত করে চট্টগ্রাম অভিমুখে | অরস হতে থাকে এবং ১৪ই ডিসেম্বর কুমীরা পৌছে যায়।

| এদিকে মেজর আইনউদ্দিনের নের্তৃত্বে ৯ম ইস্ট বেঙ্গলও চট্টগ্রাম অভিমুখে অগ্রসর | হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামও তার বাহিনী নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর কুমীরার সন্নিকটে

পৌছে যায় । এমনি অবস্থায় কুমীরা আক্রমণের পূর্বেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম মিত্র বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আনন্দস্বরূপের নির্দেশে ১০ম বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি লে, দিদারুল আলমের কমান্ডে মিত্র বাহিনীকে সাথে রেখে অবশিষ্ট সৈন্য সহকারে হাটহাজারী পাকিস্তানি অবস্থান আক্রমণের জন্য চলে যান। ১৪ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর এই দলটি হাটহাজারী পৌছে যায় । এ দিকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নের্তৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলও হাটহাজারীর নিকট অবস্থান গ্রহণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ছিল হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে। মেজর আইনউদ্দিনের ৯ম বেঙ্গলও ইতােমধ্যে হাটহাজারী পৌঁছে যায়। এই সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী ১৫ই ডিসেম্বর হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানিদের উপর ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর হাদী ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের এক কোম্পানি সৈন্যসহ মুক্তিবাহিনীর। নিকট আত্মসমর্পণ করে। এরপর এই বাহিনী আরাে অগ্রসর হয়ে নয়াপড়া পাকিস্তানি অবস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করে।

অপরদিকে লে. দিদারুল আলমের ‘সি’ কোম্পানি ও ক্যাপ্টেন মাহফুজের বাহিনী। মিত্রবাহিনীর লে. কর্নেল হরগােবিন্দ সিংয়ের বাহিনীর সাথে সম্মিলিতভাবে ১৫ই ডিসেম্বর কুমিরা আক্রমণ করে। এই প্রচণ্ড আক্রমণে পাকিস্তানি সেনা কুমিরা ছেড়ে ফৌজদারহাট চলে যায়। মুক্তি ও মিত্রবাহিনী অগ্রসর হয়ে ফৌজদারহাটেও আক্রমণ। চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী ফৌজদারহাট ছেড়ে পশ্চাদপসরণ করে চট্টগ্রাম চলে যেতে বাধ্য হয়। ১৬ই ডিসেম্বরই চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে । চট্টগ্রাম হানাদার মুক্ত হয়।

সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিক তার বাহিনীর সকলের সঙ্গে দেখা করে সাকিট হাউসে অবস্থান গ্রহণ করেন। চট্টগ্রাম ক্লাবের বিপরীতে রেলওয়ের একটি দালানে ভারতের ৮৩তম মাউন্টেন ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী