৮ নম্বর সেক্টর
মে মাসের প্রথমার্ধেই ৮ নম্বর সেক্টরের পুনর্গঠন ও কোম্পানিগুলির (পরে সাব-সেক্টর নামে পরিচিত) অবস্থান গ্রহণের কাজ শেষ করে মুক্তিবাহিনী পূর্ণোদ্যমে তাদের তৎপরতা পুনরায় শুরু করে। বয়রা সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা ১০ই মে তার এলাকায় এ্যামবুশ করে বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। সেদিন তিনি তার বাহিনী নিয়ে চৌগাছা-মাসলিয়া সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে এ্যামবুশ পেতে পাকিস্তানি সেনাদের অপেক্ষায় ওঁৎ পেতে রইলেন। তার ধারণা বৃথা যায়নি। পাকিস্তানি সেনাদের একটি টহলদার দল ঐ পথে নির্দ্ধিধায় অগ্রসর হচ্ছিল। রেঞ্জে আসার সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন হুদা গুলি চালালেন। বেশ কিছুক্ষণ উভয় পক্ষে গুলি বিনিময়ের পর পাকিস্তানি সেনারা ৮ জনের লাশ ফেলে রেখে পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিবাহিনীর ২জন শহীদ হয়। বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা কাশীপুর বি,ও,পি এলাকায় ১৫ই মে পাকিস্তানি টহলদার আরেকটি দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৬ জনকে হত্যা করে। এই সংঘর্ষে তিনি ১টি এল, এম, জি, ৮টি রাইফেল এবং বিশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। মে মাসের শেষ দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের সহযােগী অবাঙালি দালালরা বয়রা সাব-সেক্টর অধীনে কাশীপুর গ্রামে ঢুকে অগ্নিসংযােগ ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে গ্রামবাসীদের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালাবার খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা ১৭ই মে দুই প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা দ্বারা কাশীপুর গ্রাম ঘিরে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করার আহবান জানান। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ না করে গুলি চালাতে শুরু করে যার ফলে উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। সংঘর্ষে ১১জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ৪জন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। নিহতদের মধ্যে ঝিকরগাছা থানার একজন বাঙালি পুলিশ অফিসারও ছিল।
অবশিষ্টরা পিছনে সরে যেতে সমর্থ হয়। ক্যাপ্টেন হুদা পাকিস্তানি সেনাদের একটি জিপ ও বেশ কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করেন। এই বিজয়ের ফলে ২৭ মে তারিখের মধ্যে ১৫০ বর্গ মাইল এলাকা ক্যাপ্টেন। নাজমুল হুদার নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। কাশীপুর প্রতিরক্ষা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ এফ, এফ রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি সৈন্য ২৭শে মে কাশীপুর বি, ও, পি আক্রমণের উদ্দেশে অগ্রসর হয়। সেক্টর কমান্ডার মেজর ওসমানের নির্দেশে ক্যাপ্টেন নাজমুল সুবেদার মনিরুজ্জামানের নের্তৃত্বে এক প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা ডিলেয়িং পাটি হিসেবে পাকিস্তানি সেনাদের বাধা দেবার জন্য পাঠিয়ে দেন। সুবেদার মনিরুজ্জামানের প্লাটুন প্রতিরক্ষা রচনা করে পজিশন নেবার কিছুক্ষণের মধ্যেই অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাদের সাথে সংঘর্ষ শুরু হয়। সংঘর্ষের তীব্রতা আন্দাজ করতে পেরে ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা নিজে কিছু সংখ্যক সৈন্য ও ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহীর কমান্ডে কিছু সৈন্য দিয়ে বিওপির ডান দিক থেকে শত্রুদের উপর তীব্র প্রতিআক্রমণ করেন। অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করেও পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের এই প্রতি-আক্রমণ ঠেকাকে ব্যর্থ হয়। ফলে তাদের হতাহতের সংখ্যা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। একমাত্র সংঘর্ষের এলাকা থেকেই ৬০ জন পাকিস্তানি সেনার। লাশ উদ্ধার করা হয় এবং ৩জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। মুক্তিবাহিনীর বীরযােদ্ধা ও একজন সাহসী অধিনায়ক সুবেদার মনিরুজ্জামান এই সংঘর্ষে শহীদ হন এবং বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর ৪টি গাড়ি মুক্তিবাহিনীর হাতে ধ্বংস হয়।
১টি রকেট লাঞ্চার ও ৩০টি চায়নিজ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এই সংঘর্ষে অংশগ্রহণকারী হাবিলদার আবদুল কুদ্স খাঁ সাপ্তাহিক দেশ বার্তায় এই সংঘর্ষের উপর লিখেছেন : মনিরুজ্জামান সাহেবের নিউকি ও সুষ্ঠু পরিচালনায় মুক্তিবাহিনীর প্রবল আক্রমণে। শত্রুর আক্রমণ শুধু প্রতিহতই হয় নাই, পক্ষান্তরে শত্রুকে প্রায় ৪ মাইল পর্যন্ত ‘এ্যাডভান্স টু কনট্যাক্ট’ পদ্ধতি অবলম্বনে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল এক পর্যায়ে। ক্যাপ্টেন হুদা সাহেব শক্রর পিছু ধাওয়া করে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে একত্রিত হন। এদিকে শত্রুর সাথে হাতাতাতি যুদ্ধের সুযােগ উপস্থিত হওয়ায় সুবেদার মনিরুজ্জামান সাহেব বীর বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েন শত্রুর উপর ঠিক পুকুরের পাড়ে জঙ্গলের ভিতর, বটগাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা শত্রু চায়নিজ রাইফেল দিয়ে মাত্র চার গজ দূর থেকে সুবেদার সাহেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। আর আমার অবস্থান ছিল অনুমান ৬ গজ দূরে! আহ! একটি আওয়াজই তার কণ্ঠ হতে উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম। সাথে সাথে জঙ্গলের ভিতর ধরাশায়ী হলেন তিনি। সাথে সাথে ধরাও পড়েছিল সেই হত্যাকারী। সেদিন শুক্র ও অনেক জানমালের ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছিল। আমাদের পক্ষে সুবেদার সাহেব (শহীদ) ছাড়া ৪৬ বছর বয়স্ক হাবিলদার, বর্তমানে নায়েব সুবেদার আরব আলী (বীর বিক্রম) শত্রুর এক তরুণ লেফটেনেন্টের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধে সামান্য আহত হয়েছিলেন। উক্ত লেফটেনেন্ট আরব আলীর হাতেই নিহত হয়।”
———————-
* সাপ্তাহিক দেশ বার্তা : সিলেট ২৫শে জুলাই ১৯৭৩ শ্রাবণ ১৩৮৫ ১ম বর্ষ ৪৬ তম সংখ্যা।