You dont have javascript enabled! Please enable it! ৬ নম্বর সেক্টর -বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস - সংগ্রামের নোটবুক
৬ নম্বর সেক্টর
রংপুর, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুরের ই পি আর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে যথাক্রমে সাহেবগঞ্জ ও ভজনপুরে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তােলে। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিনের কমান্ডে রংপুরের ১০ নং উইং ই পি আর সৈনিকরা সাহেবগঞ্জে এবং ৯নং উইং ই পি আর সৈনিকরা ক্যাপ্টেন নজরুলের কমান্ডে ভজনপুরে অবস্থান গ্রহণ করে। মে মাসের। প্রথম দিকেই পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্তের কিছু কিছু অংশ ব্যতিত প্রায় পুরাে এলাকাই তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছিল। এতদসত্ত্বেও ই পি আর ট্রপস্ পাকিস্তানি সেনাদের উপর ছােটখাট আক্রমণ, এ্যামবুশ, রেইড ইত্যাদি অব্যাহত রেখে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত রেখেছিল। জুন মাসে উইং কমান্ডার এম, কে, বাশার সেক্টর কমান্ডার হিসেবে যােগদান করে পুরাে সেক্টরটি পরিদর্শন করে সেক্টর বাহিনীকে সুসংগঠিত করে। গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন। প্রাথমিক পদক্ষেপেই তিনি ভজনপুর সাব-সেক্টরের মাইল তিনেক অগ্রবর্তী স্থান মাগুরমারী ও ময়নাগড়িতে দুটি পােষ্ট স্থাপন করেন। সুবেদার মুরাদ আলীর কমান্ডে এক কোম্পানি পাকিস্তানি ঘাটি ওমরখানার বিপরীতে এবং নায়েব। সুবেদার বদিউজ্জামান ও নায়েব সুবেদার গােফরানের প্লাটুন দুটি মাগুরমারীতে পােস্টিং করেন। তারা পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। জুলাই মাসের প্রথম দিকে স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন এই সেক্টরে যােগদান করলে সেক্টর কমান্ডার তাকে ভজনপুর এলাকার দায়িত্ব প্রদান করেন।
ক্যাপ্টেন নজরুলকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হল। স্কোয়াড্রন লিডার সদরউদ্দিন সাব-সেক্টরটিকে পুনর্গঠিত করার উদ্দেশে সুবেদার হাফিজের কোম্পানিকে কাগমারা-ওমরখানা এলাকায়, নায়েব সুবেদার খালেকের নের্তৃত্বে এক কোম্পানিকে সাহেবজুট-বেরাট এলাকায় এবং সুবেদার মুরাদ আলীর কোম্পানিকে নছরাপাড়া এলাকায় প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করলেন। অল্পদিনের ব্যবধানেই ১৫ই আগস্ট সেক্টর কমান্ডার বাশার পাকিস্তান থেকে আগত ক্যাপ্টেন সুলতান শাহরিয়ার রশীদকে সঙ্গে করে সাব-সেক্টর হেডকোয়ার্টার দেবনগরে এসে সাব-সেক্টরের দায়িত্ব বুঝে নেবার আদেশ প্রদান করেন। ১৮ই আগস্ট ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার সাব-সেক্টরটির দায়িত্ব বুঝে নেন। তিনি এসেই সমস্ত প্রতিরক্ষা এলাকা ঘুরে প্রত্যেকটি সৈনিকের সঙ্গে দেখা করেন। তার সৈনিকেরা নতুন প্রাণের সন্ধান পায়।
পাকিস্তানি বাহিনী ২৮শে জুলাই এই সাব-সেক্টরের অধীনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ডাঙ্গাপাড়া, নুনিয়াপাড়া ও প্রধানপাড়া গ্রাম তিনটি অতর্কিতে আক্রমণ করে। সুবেদার হাফিজ তার কোম্পানিকে সুবিন্যস্ত করে যথাসম্ভব প্রতিরােধ করা সত্ত্বেও মুক্তি বাহিনীর বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয় । কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়ে অবশেষে চাই। নদীর তীরে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। ৭ই সেপ্টেম্বরের ভজনপুরের মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি ঘাটি জগদলহাট আক্রমণ করে দখল করে নিলে পাকিস্তানিদের প্রতিআক্রমণের মুখে জগদলহাট ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। সেপ্টেম্বর মাঝামাঝি পর্যন্ত। মুক্তিবাহিনী চাওই নদীর তীর পর্যন্ত এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়। সাহেবগঞ্জ সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিনও তার বাহিনী নিয়ে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত তৎপর ছিল। ক্যা:নওয়াজেশ ৮ই আগস্ট ফুলবাড়ি, ১৩ই আগস্ট ভুরুঙ্গামারী ও ১৮ই আগস্ট আলীপুর থানা এলাকায় প্রচণ্ড আঘাত হেনে পাকিস্তানি সেনাদের অশেষ ক্ষতি সাধন করে। তার নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর ব্যাপকভাবে আক্রমণাত্মক তৎপরতা চালিয়ে যায়। সুবেদার আরব আলীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ৪ঠা সেপ্টেম্বর ৩ মর্টার সহকারে নাগেশ্বরীতে পাকিস্তানি অবস্থানের উপর ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে ৫ জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত এই সেক্টরের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনী।
পাকিস্তানিদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর আক্রমণ এ্যামবুশ বা সেতু ধ্বংসকরণের কাজ অব্যাহত রাখলেও উল্লেখযােগ্য কোনাে সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। তবে অক্টোবর মাসের প্রথম দিকেই মুক্তিবাহিনী কৌশল সামান্য পরিবর্তন করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বড় রকমের আক্রমণ পরিচালনার জন্য প্রস্তুত হয়। ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট সংঘর্ষ ১৪ই অক্টোবর মেজর নওয়াজেশউদ্দিন তার বাহিনী নিয়ে একই সঙ্গে পাকিস্তানি অবস্থান ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট আক্রমণ করেন। পরিকল্পনা ছিল: সুবেদার ওহাব তার কোম্পানি নিয়ে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি সাপাের্টে পাকিস্তানি ঘাটির সম্মুখভাগ। সরাসরি চার্জ করবে। হাবিলদার সােনা মিয়া এক প্লাটুনের কিছু বেশি সৈন্য নিয়ে সম্মুখভাগে ফাইটিং পেট্রোল পাটি হিসেবে থাকবে। সুবেদার শামসুল হক ৭০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সুবেদার ওহাবের পিছনে রিয়ার পাটি হিসেবে থাকবে। নায়েক। আজাহার আলীর নের্তৃত্বে ২০ জনের একটি মুক্তিযােদ্ধার দল জয়মনিরহাট এবং রায়গঞ্জের মাঝে সি এন্ড বি সড়কে কাট-অফ পাটি হিসেবে থাকবে। মুজাহিদ। অধিনায়ক আবদুল আজিজের নের্তৃত্বে এক প্লটুন রায়গঞ্জ ও নাগেশ্বরির মধ্যস্থলে সি এন্ড বি সড়কের দ্বিতীয় ‘কাট-অফ’ পার্টি হিসেবে প্রতিরক্ষায় থাকবে। ২০০ মুক্তিবাহিনীর একটি বিরাট দল নিয়ে সুবেদার মাযহারুল হক ও সুবেদার আরব আলী জয়মনিরহাট আক্রমণ করবে। উপরােক্ত পরিকল্পনানুসারে মুক্তিবাহিনী ১৩ই অক্টোবর রাত ১২টার মধ্যে নিজ নিজ স্থানে অবস্থান গ্রহণ করে। গ্রিন সিগন্যালের সাথে সাথে রাত ১টার সময় (১৪ই অক্টোবর) মুক্তিবাহিনী ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাটে মিত্রবাহিনীর আর্টিলারি ফায়ার শেষ
————–
* ইতােমধ্যে প্রমােশন পেয়েছেন।
হবার সাথে সাথেই পাকিস্তানি ঘাঁটির উপর ঝাপিয়ে পড়ে। উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয়ে সকাল ৭টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। উভয়স্থানেই পাকিস্তানিরা দারুণভাবে মার খেয়ে পালিয়ে গিয়ে রায়গঞ্জে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেয়। ভুরুঙ্গামারী ও জয়মনিরহাট মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৮জন সৈন্য ও ১জন আর্টিলারির ক্যাপ্টেন মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দি হয়। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার হয়। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে সেক্টরের ৬০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্ত | অপরদিকে ভজনপুর সাব-সেক্টরের মুক্তিবাহিনী চাওই নদীর তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নতুন কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার লে, আবদুল মতিন চৌধুরী ও লে, মাসুদুর রহমান ৯ই অক্টোবর এই সাবমেরে যােগদান করলে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যার ফলে এলাকায়। পাকিস্তানিদের চলাচল সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সাব-সেক্টর বাহিনী সৈয়দপুর পাকা সড়ককে সামনে রেখে পাকিস্তানি ঘাটি ওমরখানা অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। প্রবল আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী পিছনে সরে গিয়ে পঞ্চগড় এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী