You dont have javascript enabled! Please enable it!

ত্রিপক্ষীয় দিল্লী চুক্তি

গত ৯ই এপিল বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সম্পাদিত হলো, তাকে এই উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য এক বিরাট পদক্ষেপ্নবলে অনায়াসেই বলা যেতে পারে। চুক্তি অতীত দিনের সকল তিক্ততা ও বিদ্বেষ অবসানে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে। পাকিস্তানের টালবাহানার জন্য এই চুক্তি সম্পাদনে দেরী হলেও এই ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রতি যথাযথ মর্যাদা দানে পাকিস্তানীরাও সমভাবে এগিয়ে আসবেন— বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ অবশ্যই এটা আশা করবেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রতিশ্রুতি তাঁদের পালন করতে হবে। কারণ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার না করে পাকিস্তানের ক্ষমা প্রার্থনার প্রেক্ষিতে ওদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে উদারতার নজীর স্থাপন করেছেন বিশ্বের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে তা বিরল। পাকিস্তানের এই ক্ষমা-প্রার্থনা একমাত্র একটি কারণেই বাংলাদেশ মঞ্জুর করেছে, তাহলো উপমহাদেশের এই তিনটি দেশের মধ্যে স্বাভাবিক মৈত্রীস্থাপনের স্বার্থে। কারণ বাংলাদেশ এবং ভারত এই উপমহাদেশ থেক উত্তেজনার শেষ চিহ্নটুকু মুছে ফেলার জন্য সব সময়ই তৎপর ছিলো—থাকবেও। অবশ্য বারবার রনডঙ্কা বাজিয়ে পাকিস্তান এই তিনটি দেশের জনগণের জন্য যে চরম দুর্দশা ডেকে এনেছিল— এই চুক্তি সম্পাদনের ফলে তার স্থায়ী পরিসমাপ্তি সকলের কাম্য।
চুক্তির শর্তানুযায়ী পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে তার চার লক্ষ নাগরিককে ফিরিয়ে নিতে স্বীকৃত হয়েছে। পাকিস্তানে আটক ভারতীয়রা, ভারতে আটক পাকিস্তানীরাও স্ব স্ব দেশে ফিরে যাবেন। উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আত্মসমর্পণকারী পাক যুদ্ধ বন্দীদের বাংলাদেশ ও ভারত আগেই ছেড়ে দিয়েছেন। কেবল যুদ্ধাপরাধীরা আটকে ছিলেন। এবার তারাও দেশে ফিরে যাবেন। অন্য দিকে পাকিস্তান বাংলাদেশস্থ তার চার লক্ষ নাগরিকের প্রশ্নে সবসময়ই একটা অনীহা ভাব দেখিয়ে আসছিলো। এখন অবশ্য সেটা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছে। কারণ গত বছরের দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তান বাংলাদেশ থেকে তার নাগরিকদের মাত্র দেড় লাখ জনকে নিয়ে বাকীটা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিলো— বাংলাদেশের দৃঢ়তায় এবার বাকী আড়াই লাখকেও ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে। এটা বাংলাদেশের নীতিরই বিজয়। তাছাড়া বাংলাদেশ পাকিস্তানের ক্ষকমা প্রার্থনার প্রেক্ষিতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর প্রতি উদারতা প্রদর্শন করায় সারা বিশ্বের নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। বঙ্গ বন্ধুও বাংলাদেশের জনগণ যদি এই বর্বর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা না করতেন, তবে তাদের ফিরিয়ে নেবার কোন ক্ষমতাই পাকিস্তানের ছিল না। বাংলাদেশে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচার ও বর্বরতা নাৎসী নির্যাতনকেও হার মানিয়েছিল। সারা বিশ্বের মানুষ তা জানেন।
তবুও বাংলাদেশে এই উপমহাদেশের বৃহত্তর জনস্বার্থের খাতিরেই তাদের ছেড়ে দিয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো অবশ্য এর আগে বহুবারই বলেছিলেন যে, এসব যুদ্ধাপরাধীদের ছেড়ে দেয়া হলে তিনি স্বদেশেই তাদের বিচার করবেন। ভুট্টো সায়েব অবশ্যই একটি নৈতিক দায়িত্বজ্ঞান সম্মত কথা বলেছিলেন। কারণ খুনী বর্বরদের বিশ্বের কোন দেশেই ক্ষমা করা হয় না।পাকিস্তানী জনগণের আত্মমর্যাদা বোধের প্রশ্নেও এক্ষণে এ বিচার অপরিহার্য— এক্ষণে এ বিচার অপরিহার্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের সাথে পাকিস্তানী জনগণের সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার প্রয়োজনে। আর এ বিচার না করলে পাকিস্তানীরা বিশ্ববিবেকের কাছেই অপরাধী থাকবেন— বাংলাদেশের মহত্বতা তাতে মোটেই ক্ষুণ্ণ হবে না—হতে পারেনা।
দিল্লী আলোচনায় ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধকালে দুই দেশের মধ্যে ডাক, তার ও যাতায়াতের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার কথা বলা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রশ্নে পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা গ্রহণেরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই চুক্তি সম্পাদনকালে বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদ্বয় এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিমন্ত্রী তিনটি দেশের প্রধানমন্ত্রীত্রয়ের একটি বৈঠকে মিলিত হবার প্রশ্নে গুরুত্ব আরোপ করেন এবং ঐক্যমতে উপনীত হন। অচিরেই এই বৈঠক সম্ভবতঃ কায়রীয় অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
গত ৫ই এপ্রিল দিল্লীতে এই আলোচনা শুরু হয়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সরদার শরণ সিং এবং পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা দফতরের প্রতিমন্ত্রী জনাব আজিজ আহমদ স্ব স্ব দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিলো উপমহাদেশের এই তিনটি দেশের মধ্যকার সকল বিদ্বেষ,বিরোধ ও তিক্ততার অবসান ঘটানোর জন্য ও উত্তেজনা হ্রাসের ব্যাপারে সঠিক কর্মপন্থা নির্ণয় করা— যাতে করে এই তিনটি দেশের সরকার ও জনগণ পরস্পরের মধ্যে একটি সৌভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। আলোচনার শুরুতেই পাকিস্তান বাংলাদেশ সরকারের বিচারাধীন ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার জন্য এবং তাদেরও অন্যান্য যুদ্ধ বন্দীর মত ছেড়ে দেবার জন্য বাংলা দেশের উপর চাপ দেবার চেষ্টা করতে থাকে। তাঁদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, বাংলা দেশ যদি এই ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার করে তবে পাকিস্তানী জনগণ কোনদিনই সেটাকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নেবেনা এবং তাতে করে আলোচনায় অগ্রগতিও সাধিত হতে পারে না।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তাঁদের এই চাপ ও যুক্তি খণ্ডন করা হয় যথাযথভাবে। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা ডঃ কামাল হোসেন এর জবাবে পাকিস্তানীদের জানান যে, বাংলাদেশে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে এসব যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছে না— করছে একমাত্র মানবিক কারণেই। এটা একটা নৈতিক বিচার— রাজনৈতিক নয়।কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালে পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যরা ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্বে সারাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ ও নারীধর্ষণ বুদ্ধি বুদ্ধিজীবী নিধন সহ যে সব বর্বর কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল বিশ্বের কোন কালের কোন ইতিহাসেই তার কোন নজীর নেই। বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বের শান্তিকামী জনগোষ্ঠীর বাইরে নন— বরং তাদের একটি সক্রিয় অংশ। এহেন সভ্য ও শান্তি জনগণের ওপর পরিচালিত এই বর্বরতা কেবল বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্বরতা নয়—বরং এটা বিশ্ব মানবতার বিরুদ্ধে পরিচালিত বর্বরতার নামান্তর।
এমতাবস্থায় এ বর্বরতা পাকিস্তানী জনগণের বিরুদ্ধেও পরিচালিত হয়েছে। কাজেই এটাকে সহজেই ‘ক্রাইম এগেনিষ্ট দি হিউম্যানিটি’ বলে অভিহিত করা যায়। এহেন বর্বরতার বিচার না করলে বাংলাদেশের জনগণ সরকার ও বাঙ্গালী জাতির পিতা বিশ্ব মানব গোষ্ঠীকে কি জবাব দিবেন? এবং এজন্যই পাকিস্তানী জনগণ এটার যথার্থতা বুঝে নিতে সক্ষম হবেন।
ডঃ কামালের এহেন মানবতাবাদী যুক্তিতে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের সেন্টিমেন্ট বুঝাতে পারেন এবং বিচারের যথার্থতা মেনে নেন। এরপর ওরা পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জনাব ভুট্টোর সাথে যোগাযোগ করেন এবং তাঁরই নির্দেশ ক্রমে পাকিস্তানী বাহিনী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী যে অপরাধ করেছিল তার জন্য লিখিত ভাবে বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের কাছে পাকিস্তানের সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। বাংলাদেশের মানুষ সব সময়ই উদারচিত্ত। একদা যে চরম শত্রু, তাকেও পরে ক্ষমা করতে পারে। সেই ঐতিহ্যবাহী ক্ষমাশীল মন নিয়েই বাংলাদেশের মানুষ, সরকার ও জাতির জনক পাকিস্তানীদের সেই প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার চুক্তি শান্তিকামী মানুষের মনে উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে অনেকটা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। পাকিস্তানের পরম বন্ধু গণচীনের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ইরানের শাহ ও মার্কিন সরকার এ চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশের নেতৃবৃন্দ জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব একে বাংলাদেশের একটি কূটনৈতিক বিজয় বলে অভিহিত করেছেন এবং এই চুক্তি যথাযথ ভাবে সফল বাস্তবায়নের জন্য চুক্তিতে স্বাক্ষরদাতা দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বস্তুতঃ ‘কারো সাথেই শত্রুতা নয়— সবাইর সাথেই মিত্রতা’ জন্মলগ্ন থেকে এটাই হচ্ছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা। বাংলাদেশ তাঁর প্রতিবেশী দেশগুলো তো বটেই বিশ্বের যে কোন দেশের সাথেই পারস্পরিক জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, কারো আভ্যন্তরীন ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ না করা এবং সকলের প্রতি সকলের মানবিক আচরণ ইত্যাদির ভিত্তিতে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী। যে পাকিস্তানীরা দীর্ঘকাল যাবৎ উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণ চালিয়ে বাংলাদেশকে জর্জরিত করেছিল সে পাকিস্তান যখন তার একগুঁয়েমী ও ভ্রান্তনীতি পরিহার করে বাংলাদেশের বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়েছে— নিজের কৃতকর্মের জঅন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে— বাংলাদেশ তখন উদার চিত্ত নিয়ে পাকিস্তানকে গ্রহণ করবে। বাংলাদেশ সব সময়ই তার নীতিতে অবিচল এবং এই চুক্তি ও তার শর্তাবলী তারই প্রমাণ। এখন পাকিস্তানের উচিত তার প্রদত্ত প্রতিশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখানো, না হয় নিজের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে পাকিস্তান নিজেই ঠকবে—বাংলা দেশ বা ভারতের তাতে তেমন কোন ক্ষতি হবে না।

(বাংলার বাণী)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!