You dont have javascript enabled! Please enable it!
১ নম্বর সেক্টর
চাঁদগাজী সংঘর্ষ ২রা মে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলার পতন ঘটলেও মুক্তিবাহিনী তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ফলে ২৪শে মে ১নং সেক্টরের অধীন চাঁদগাজীতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। ক্যাপ্টেন অলি আহমদ এক কোম্পানি। ও এক সেকশন 3 মর্টার সহকারে ২৪শে মে চাঁদগাজী আক্রমণ করে পাকিস্তানি বাহিনীকে বিতাড়িত করে। এরপর ক্যাপ্টেন শামসুল হুদাকে চাঁদগাজী প্রতিরক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং অপর একটি অতিরিক্ত কোম্পানি দ্বারা চাঁদগাজি প্রতিরক্ষা মজবুত করা হয়। ৬ই জুন পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি কোম্পানি চাঁদগাজী আক্রমণ করে কিন্তু দু’ঘণ্টাব্যপি সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী চরম ক্ষতি স্বীকার করে ছাগলনাইয়ার দিকে পালিয়ে যায়। পুনরায় ১৫ই জুন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানকে চাদগাজীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৬ জুন পাকিস্তানি বাহিনী আবার চাঁদগাজী দখল করার জন্য অগ্রসর হলে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তার বাহিনী দ্বারা পাল্টা আক্রমণ করলে পাকিস্তানিরা ৫০ জনের মতাে প্রাণ হারায় এবং পিছু সরতে বাধ্য হয়। ১৭ই জুন পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন সকাল ছ’টায় ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারির। সাপাের্ট সহকারে পুনরায় চাদগাজী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান আক্রমণ করে।
ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা ও ক্যাপ্টেন মতিউর তাদের নিজ নিজ বাহিনীসহ অত্যন্ত সাহসের সাথে পাকিস্তানিদের মােকাবেলা করেন। সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী বেশ ক্ষতি স্বীকার করে হলেও পাকিস্তানি বাহিনীকে ৪৫ জনের মৃতদেহ ফেলে রেখে সরে যেতে বাধ্য করে। চাঁদগাজী অধিকার করার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে উঠে। পুনরায় ১৯শে জুন সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টায় পাকিস্তানি বাহিনী চাদগাজী আক্রমণ করে। এবার তারা হেলিকপ্টার করে ২টি পদাতিক ব্যাটালিয়ন মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের পেছনে নামিয়ে দেয়। স্পিড-বােট যােগে একই সাথে মুহুরী নদী দিয়ে এক কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা অগ্রসর হয়। অপর দিকে পাকিস্তানিরা তাদের রিয়ার হেডকোয়ার্টার থেকে আর্টিলারি এবং মর্টার সাপাের্ট ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী ২০শে জুন ভাের পর্যন্ত টিকে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা চারদিক থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করলে উপায়ান্তর না দেখে মুক্তিবাহিনীকে বাধ্য হয়ে পেছনে সরে আসতে হয়।
এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওদিকে পাকিস্তানি সেনাদের ১৫০ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হবার খবর পাওয়া যায়। এদিকে ১০ই জুন ক্যাপ্টেন মাহফুজ হিয়াকু-রামগড় সড়কে এ্যামবুশ করে ৪জন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে তিনি হিয়াকু-রামগড় সড়কে দুইটি কলামে বিভক্ত হয়ে একটিতে নিজে এবং অপরটিতে নায়েব সুবেদার রহমতউল্লাহকে দিয়ে সড়কের পাশে আখক্ষেতে ওঁত পেতে বসে রইলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল পাকিস্তানি সেনা ভর্তি দুটি মাইক্রোবাস হিয়াকু থেকে রামগড়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সকাল তখন ৮ ঘটিকা। গাড়ি দুটি মুক্তিবাহিনীর ফায়ার রেঞ্জে আসার সাথে সাথে সবগুলাে গান এক সঙ্গে গর্জে ওঠে। বেশ কিছুক্ষণ ধরে সংঘর্ষ অব্যাহত রাখার পর তিনি নিজ বাহিনীকে সরিয়ে নিয়ে তার ঘাটিতে ফিরে যান। পরে স্থানীয় লােকজনের কাছে জানা যায় যে শত্রু পক্ষে ১জন লে. কর্নেল ও ১জন মেজর সহ মােট ৫জন নিহত হয়। পাকিস্তানিরা সামনে অগ্রসর না হয়ে হিয়াকু ফিরে যায়।  ২৩শে জুন ক্যাপ্টেন মাহফুজ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে করলিয়াটিলা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের এ্যামবুশ করেন। ইনফরমার দ্বারা ২৩শে জুন রামগড়ে পাকিস্তানি সেনাদের দু’টি গাড়ি আসবার খবর পেয়ে সেদিন তার পাটুন ভাের বেলা করলিয়টিলাতে পৌছে সড়কের উপর ৩টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী মাইন বসিয়ে রেখে সড়কের পাশে অপেক্ষা করতে থাকেন। সকাল ৬টায় পাকিস্তানি সেনাদের দুটি গাড়ি আসতে দেখা গেল। অফিসার সহ দু’টি গাড়িতে ২০ জনের মতাে সৈন্য ছিল। নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছুতেই বিকট শব্দ করে প্রথম গাড়িটি উল্টে পড়লাে এবং দ্বিতীয় গাড়িটিও ঘটনাস্থলে আসার সাথে সাথে ক্যাপ্টেন মাহফুজ ও তার দল একযােগে গােলা বর্ষণ শুরু করে।
উভয়পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনী নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে ১জন অফিসার সহ বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়েছিল।  অন্যদিকে ১লা জুলাই ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে গভীর রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান দেবীপুর বিওপি আক্রমণ করে ১২ জনকে হত্যা করেন। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সিপাই ফজলুর রহমান শহীদ হন। ৩রা জুলাই পুনরায় ক্যাপ্টেন মাহফুজ পাকিস্তানি সেনাদের এ্যামবুশ করেন। তিনি সংবাদ পেলেন যে পাকিস্তানিরা বাঙালি মেয়েদের নিয়ে হিয়াকু হয়ে রামগড় আসছে। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ২০ জনের একটি দল নিয়ে ৩রা জুলাই চিকনছড়াতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। বেলা ১২টার কিছুক্ষণ পরই একটি মাইক্রোবাসকে আসতে দেখা গেল। সামনে অফিসার, তার পিছনে ৬জন মেয়ে এবং তার পেছনে ৪জন সশস্ত্র গার্ড। গাড়ি ৫০ গজের মধ্যে আসতেই ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হল। লক্ষ্য অব্যর্থ। ড্রাইভার গাড়ির নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে গাড়ি উল্টে যায়। সাথে সাথে ২০ জনের। হাতের সব কয়টি অস্ত্রই আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। ঐ দিন পাকিস্তানি সেনাদের একজনও জীবন নিয়ে ফিরতে পারেনি। ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনী নিয়ে নিরাপদে ফিরে আসেন। পরে জানা যায়, ৪জন মেয়ে বেঁচে গিয়ে পাশের গ্রামে আশ্রয় নিয়েছিল। করুইয়াবাজারে একটি হাই স্কুলে একজন মেজরের কমান্ডে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ভারতে গমনরত বহু শরনার্থী ধরে যথেষ্ট অত্যাচার চালাচ্ছিল। শরণার্থীদের মধ্যে মেয়েদের সংখাই ছিল বেশি।
এই মেয়েদের উপর পাকিস্তানি সেনারা দিনের পর দিন পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১৯শে জুলাই মুক্তিবাহিনীর ৪৫ জনের একটি দল নিয়ে মর্টার, রকেট লাঞ্চার ও এল এম জি নিয়ে একযােগে রাত দেড়টার সময় পাকিস্তানি অবস্থানের উপর আক্রমণ করেন। তুমুল সংঘর্ষের পর ১৫০ জনের মতাে শরণার্থী নিরাপদে সরে পড়লেও বেশ কিছু শরাণার্থী। গােলাগুলিতে নিহত হয়। পাকিস্তানি সেনাদের ৩০জন নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে আসতে সমর্থ হয় । ২৭শে জুলাই মাত্র ১ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর হিয়াকু হেডকোয়ার্টার। আক্রমণ ক্যাপ্টেন মাহফুজের অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ অভিযান। মুক্তিবাহিনীর অবস্থান থেকে হিয়াকুর দূরত্ব ছিল প্রায় ১২ মাইল। কাজেই সেখানে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ করতে পারে এটা পাকিস্তানি সেনাদের ধারণার বাইরে ছিল। মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ঘটনাস্থলে ৪জন সেনাকে নিহত হতে দেখা যায়। আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ির পার্ক বিধ্বস্ত হয়ে যায়। মুক্তি বাহিনীর ঘােট দলটিকে পাকিস্তানি সেনারা ঘিরে ফেলার চেষ্টা করলে ক্যাপ্টেন মাহফুজ দ্রুত তার বাহিনীকে নিয়ে পেছনে সরে আসেন। নিরাপদে ঘাঁটিতে পৌছে সেক্টর কমান্ডারের নিকট তাদের কর্মতৎপরতার রিপাের্ট পাঠান। | ভারতের উপেন্দ্রনগর বি ও পি’র বিপরীতে আমলিকা নামক স্থানে মজবুত বাংকার করে ৬০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজের মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি এবং ভারতীয় ৪নং গার্ডস রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি লে. কর্নেল হিম্মত সিংহের কমান্ডে অগ্রসর হয়। ক্যাপ্টেন মাহফুজ তার বাহিনীকে তিন কলামে ভাগ করে রাত সাড়ে আট ঘটিকায় পাকিস্তানি সেনাদের উপর হামলা চালায়।
ভারতীয় বাহিনী দিল মর্টার ও এম, জি সাপােট। মুক্তিবাহিনীর তিন কলাম তিন দিক থেকে বাংকারগুলির উপর গ্রেনেড চার্জ করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর এই তীব্র আক্রমনে পাকিস্তানি বাহিনী চরম মার খেয়ে শােভাপুরের দিকে পালিয়ে যায়। ২৫ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আমলিকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। মুক্তিযােদ্ধাদের ১জন নিহত হয় ও ২ জন গুরুতররূপে আহত হয়। সেপ্টেম্বর মাসে এই সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা আরাে বৃদ্ধি পায়। সেক্টর কমান্ডার মেজর রফিকের সাহসী নের্তৃত্বে সেক্টর ফোর্সের ক্ষিপ্রতা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ছাগলনাইয়া বি ও পিতে ৪০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা অবস্থান করছিল। ক্যাপ্টেন মাহফুজ ১ কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ১৫ই অক্টোবর রাত সাড়ে আটটায়।
———
* ইতােমধ্যে প্রমােশন পেয়েছেন
ছাগলনাইয়া বি ও পি আক্রমণ করেন। মিত্রবাহিনীর একটি কোম্পানির ফায়ার সাপাের্ট সহকারে তিন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েও ক্যাপ্টেন মাহফুজ পাকিস্তানিদের নড়াতে পারলেন না। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর ৮জন গুরুতর রূপে আহত হয় ও ৩জন শহীদ হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি। তিনদিন পর পাকিস্তানি বাহিনী ছাগলনাইয়া ছেড়ে চলে যায়। প্রথাগত যুদ্ধের জন্য অগ্রবর্তী দল হিসেবে অক্টোবর মাসেই লে, রফিক, শওকত ও লে, ফারুকের নের্তৃত্বে একটি করে কোম্পানি নাজিরহাট, জোরারগঞ্জ ও সীতাকুণ্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
২ নম্বর সেক্টর
এই সেক্টরের টুপস মে মাস থেকেই সবিশেষ তৎপরতা চালাতে থাকে। পাকিস্তানি । সেনারা মে মাসে বিলােনিয়া অধিকার করার চেষ্টা করলে সেক্টর অধিনায়ক খালেদ মােশাররফের নির্দেশে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম তার কোম্পানি নিয়ে শত্রুর অগ্রগতি রােধ। করতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। ওদিকে ছাগলনাইয়াতে তখন মুক্তিবাহিনীর সাথে । পাকিস্তানি সেনাদের সংঘর্ষ চলছিল। ফেণীর দিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনী একই সঙ্গে। ছাগলনাইয়া ও চট্টগ্রাম সড়কের উপর আক্রমণ চালায়, কিন্তু মুক্তিবাহিনীর তীব্র প্রতিরােধের মুখে ২০/২৫টি মৃতদেহ ফেলে রেখে পিছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। এর কয়েকদিন পরই পাকিস্তানি বাহিনী পুনঃ শক্তি সঞ্চয় করে ফেণী-চট্টগ্রাম সড়ক ধরে অগ্রসর হয়ে ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে আকস্মিকভাবেই ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের। বাহিনীর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করে যার ফলে তার বাহিনী বেশ কিছু ক্ষতি স্বীকার করে পেছনে সরে রাজনগর নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। এই পেছনে সরার মধ্যে সম্ভবত কোনও ফাদ অনুমান করে পাকিস্তানি বাহিনী বিলােনিয়া ছেড়ে ফেণীতে মূল ঘাটি প্রস্তুত করে। বিলােনিয়া রক্ষার জন্য ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ফেণী থেকে ২মাইল উপরে বান্দুয়াতে এবং লে, ইমামুজ্জামান তার অপর দিকে প্রতিরক্ষা নেয়। সেক্টরের মূল বাহিনী দিয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কমান্ডে মুন্সিরহাটেও আর একটি মজবুত প্রতিরক্ষা ঘাঁটি তৈরি করা হয়।
মুন্সিরহাট সংঘর্ষ
১৭ই মে পর্যন্ত বান্দুয়া ও মুন্সিরহাট প্রতিরক্ষা ব্যুহ বেশ শক্তিশালী করা হয়। এই প্রতিরক্ষা এমনভাবে সাজানাে হয়েছিল যেন শত্রুকে আসতে হলে অনেক প্রাকৃতিক বাধা বিঘ্ন অতিক্রম করে আসতে হয়। এই প্রতিরক্ষা অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলােনিয়া নদী ছেড়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল যার জন্য প্রতিরক্ষা ব্যুহের সম্মুখ দিক ছাড়া শক্রর আর কোনাে দিক থেকে আসার রাস্তা ছিল না। শক্রকে ধােকা দেবার উদ্দেশে মেজর খালেদ বান্দুয়া রেলস্টেশনের কাছে ছিলােনিয়া নদীর উপর একটি ডিলেয়িং পজিশন তৈরি করে তার সামনের রাস্তা ও রেল সেতু ধ্বংস। করে দেন। শত্রুর অগ্রসর হওয়ার রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম পাশে রাস্তার দিকে মুখ করে। বেশ কিছু উচু জায়গায় মজবুত বাংকার তৈরি করে সেগুলােতে এল, এম, জি প্রস্তুত। রাখা হয়। ৭ই জুন খবর পাওয়া গেল যে পাকিস্তানি বাহিনী বিলােনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০ই জুন পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ করার জন্য। অগ্রসর হতে থাকে। তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত বান্দুয়া সেতুর উপর বাঁশের পুল তৈরি করে যখনই। পার হবার চেষ্টা করছিল ঠিক তখনই ডিলেয়িং পজিশন থেকে মুক্তিবাহিনী গুলি চালায় যার ফলে পুলের উপরের ৪০/৫০ জন পাকিস্তানি সেনা গুলির আঘাতে পানিতে পড়ে যায় ।
কিছুক্ষণ পর পাকিস্তানি বাহিনী গােলন্দাজের সহায়তায় আবার আক্রমণ চালায়। এবারও ডিলেয়িং পজিশনের মুক্তিরা বহু পাকিস্তানি সেনাকে হতাহত করে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করে। কিন্তু পরবর্তীতে আক্রমণ ব্যাপক হবার পর ডিলেয়িং পজিশন ছেড়ে মুক্তিবাহিনী প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে সমবেত হয়। এতে ছিলােনিয়া নদী পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী বিনা বাধায় অগ্রসর হয়ে নদী পার হবার প্রস্তুতি নেয়। তারা মুক্তিবাহিনীর মূল ঘাঁটির উপর বৃষ্টির মতাে আটিলারির গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। এই গােলা নিক্ষেপের ফাকে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সেনা মুক্তিবাহিনীর ২০০/৩০০ গজের মধ্যে চলে আসে, কিছু সংখ্য তখনাে নদী পার হচ্ছিল। এমনি অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান গর্জে ওঠে যার ফলে প্রচুর সংখ্যক শক্রসেনা হতাহত হয়। কিন্তু তবু সব বাধা বিপত্তি ডিংগিয়ে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর পাতা মাইন ফিল্ডে এসে পড়ে এবং মাইনের বিস্ফোরণে শত্রু সেনা ছিন্ন ভিন্ন হতে থাকে তদুপরি । মুক্তিবাহিনীর মেশিনগানগুলাে বৃষ্টির মতাে গুলি বর্ষণ করে যাচ্ছিল। এতদসত্ত্বেও যারা মুক্তিবাহিনীর বাংকারের কাছে পেীছে যায় তারা মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রেনেডের আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এমনি এক চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী আর অগ্রসর না। হয়ে পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। পলায়নরত শত্রুদের উপর ব্যাপক হারে মর্টার ও মেশিনগানের আঘাতে মুক্তিবাহিনী শত্রুসেনাদের অধিকাংশকেই হত্যা করতে সমর্থ হয়। অবশিষ্টরা আর্টিলারি গােলার কভারে তাদের নিরাপদ ঘাঁটি আনন্দপুর পৌছুতে সক্ষম হয়। সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি সেনাদের প্রায় ৩০০ মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর এক ব্যাটালিয়নের অধিক সৈন্য অংশ নিয়েছিল বলে জানা যায়।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!