You dont have javascript enabled! Please enable it!
বিমান বাহিনী
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অবদান সবিশেষ উল্লেখযােগ্য। বাংলার গৌরব বাঙালি বৈমানিকগণ ৩রা ডিসেম্বর থেকেই এদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিশেষভাবে অবদান রেখেছেন। ভারতের দেওয়া একটা ডাকোটা, একটা অটার ও একটা এলুভেট হেলিকপ্টার নিয়ে তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ও নের্তৃত্বে জন্ম লাভ করলাে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ২৮শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১-এ নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে তখন এর প্রতিষ্ঠাতা গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার ছাড়া অন্যান্য যেসব বৈমানিকরা ছিলেন তারা হলেন : মরহুম ক্যাপ্টেন খালেক, ক্যাপ্টেন সাত্তার, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন মুকিত, ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন (মরহুম)। এছাড়া পাকিস্তান বিমান বাহিনী থেকে যারা পালিয়ে এসেছিলেন তারা হলেন : স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ, ফ্লাইট লে. শামসুল আলম ও ফ্লাইট লে, বদরুল আলম। আরও ছিল পাকিস্তান বিমান বাহিনী ত্যাগকারী ৬৭ জন এয়ারম্যান। উপরােক্ত জনবল ও বিমান নিয়েই শুরু হলাে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অগ্রাভিযান। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের (যিনি ছিলেন এক কালে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর একজন বিশিষ্ট শিক্ষক ও সুদক্ষ বৈমানিক)। সুযােগ্য নেতৃত্বে ১লা অক্টোবর থেকে শুরু হয় এদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া। নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা ও আসামের জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি এলাকায় শুধু কম্পাসের উপর নির্ভর করে রাতের পর রাত অত্যন্ত নীচু দিয়ে উড্ডয়নের কৌশল আয়ত্ব করার অনুশীলন করেছেন আমাদের বৈমানিকরা। অভ্যাস করেছে সত্যিকার। অভিযানকালে শত্রুর রাডারকে ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত নিচু দিয়ে রাত্রিকালে সঠিকভাবে বিমান চালনার মহড়া।
রাতের বেলায় নিচু দিয়ে বিমান চালিয়ে প্রদীপহীন রানওয়েতে অবতরণের প্রক্রিয়াকে করেছে আয়ত্ব। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের সুযােগ্য তত্ত্বাবধান ও পরিচালনায় এসব দুঃসাধ্য অনুশীলন যে কত নিখুঁতভাবে করা হয়েছে ৩রা ডিসেম্বর। থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে আমাদের বৈমানিকদের অভূতপূর্ব সাফল্যজনক বিমান আক্রমণই তার সুস্পষ্ট প্রমাণ। ভারত ও সারা বিশ্বের মানুষকে আমাদের বৈমানিকরা দেখিয়ে দিয়েছেন যে পরিকল্পনা করে দক্ষতার সাথে আক্রমণ পরিচালনা করলে ছােট ছােট বিমানও অত্যাধুনিক জঙ্গী বিমানের মতােই কার্যকরী হতে পারে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারগণ আমাদের বৈমানিকদের দক্ষতায় সত্যিই অভিভূত হয়েছেন। উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ (পরবর্তীকালে এয়ার ভাইস মার্শাল ও বিমান বাহিনী প্রধান হয়েছিলেন) ও স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত এয়ার কমােডাের) ৩রা ডিসেম্বর মধ্যরাতে নারায়ণগঞ্জের গােদনাইলে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর জ্বালানী তৈলের ডিপােকে এক দুঃসাহসিক। আক্রমণের মাধ্যমে বিস্ফোরিত করে বিশ্বকে হতভম্ব করেছেন। একই সময়ে ফ্লাইট লেফন্টেনেন্ট শামসুল আলম ও ক্যাপ্টেন আকরাম চট্টগ্রামে এক ব্যাপক বিমান আক্রমণ চালিয়ে সবাইকে অবাক করেছেন। এর পর ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা এবং ক্যাপ্টেন আকরাম ও ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন বিভিন্ন রণাঙ্গনে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি ও কনভরে উপর বহুবার সাফল্যজনক আক্রমণ পরিচালনা করে শক্রর প্রভূত ক্ষতিসাধন করেন। ডাকোটা, অটার ও হেলিকপ্টার এই তিন গ্রুপের মধ্যে কে কত বেশি বিপজ্জনক অভিযানের দায়িত্ব পাবে তা নিয়েই পাইলটদের মধ্যে প্রতিযােগিতা বিরাজমান ছিল।
এই সব বিমান আক্রমণ পরিচালনাকালে আমাদের বৈমানিকদের বহু মারাত্মক বিপদেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তারা সাহসের সাথে বিপদ থেকে তাদের মুক্ত করে অভূতপূর্ব দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন। একটি মাত্র উদাহরণ থেকেই তাদের অসীম সাহস ও দক্ষতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিনের হেলিকপ্টার ১০ই ডিসেম্বর সিলেটের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনকালে ভূমি থেকে নিক্ষিপ্ত শক্রর গুলির আঘাতে তার টেইলরােটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে হেলিকপ্টারের ভারসাম্য ব্যহত হওয়া সত্ত্বেও ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন আশ্চর্য রকম পারদর্শিতার সাথে ঘাঁটিতে ফিরে নিরাপদে অবতরণ করেন। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মুক্তিযুদ্ধে অবদান সম্পর্কে দৈনিক ইত্তেফাক লিখেছে : গুটিকয়েক মাত্র বিমান এবং এয়ার ক্রু তখন তাদের হাতে ছিল। এ নিয়ে অবশ্য আলৌকিক কিছু করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এতদসত্ত্বেও ১৯৭১ সনের ৩রা ডিসেম্বর এই বাংলাদেশ বিমান বাহিনীই মুক্তি সংগ্রামে শত্রুসেনার উপর প্রথম বিমান হামলা চালায়। ঐ রাতে উইং কমান্ডার সুলতান মাহমুদ এবং স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম, স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম (তার পূর্বে ৩ জনই প্রমােশন পেয়েছেন) এবং ক্যাপ্টেন আকরাম (পি, আই, এ পাইলট) নারায়ণগঞ্জের গােদনাইল এবং চট্টগ্রামে সাফল্যের সাথে তাদের কার্য সম্পাদন করেন। তারা এসব স্থানে জ্বালানী ডিপােসমূহ ধ্বংস করে দেন। এগুলাে ছিল শত্রুদের জ্বালানী সরবরাহের উৎস স্থান।” স্বাধীন। বাঙালি জাতি যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের অবদানকে শ্রদ্ধা ভরে স্বরণ করবে।
—————-
* দৈনিক ইত্তেফাক, ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭৫, ২৯শে অগ্রহায়ণ ১৩৮২
নৌবাহিনী ও নৌকমান্ডাে গঠন
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে দখলকৃত কয়েকটি ছােট ছােট নৌযান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নৌবাহিনীর লােকজন ও নাবিকদের সমন্বয়ে নভেম্বরের প্রথমার্ধেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী গঠন করা হয়। বিশেষ করে নিম্নের নৌযানগুলাে নিয়ে এই বাহিনীর অগ্রযাত্রা শুরু হয় : ১. বঙ্গ শার্দুল ২, বঙ্গ অসি ৩. বঙ্গ বীর্য  ৪. বঙ্গ তরী ৫. বঙ্গ আশাও ৬, ৭টি স্পিডবােট । ভারতীয় বাহিনীর চার্লি সেক্টরের ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালেক ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন এইচ কে মুখার্জি, বি এস এফ ৭২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল চক্রবর্তী কূটনৈতিক ও এলাকার সংসদ সদস্যদের উপস্থিতিতে ৯ই নভেম্বর হাসনাবাদ ঘাটে এই নৌবহরের উদ্বোধন করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী এ,এইচ, এম, কামরুজ্জামান। তিনিই এই নৌবহরের নামকরণ করেন বঙ্গবন্ধু নৌবহর” এর উপস্থিত সিনিয়র নাবিক এ, জি, এস, খুরশীদকে এই নৌবহরের দায়িত্বে নিয়ােগ করা হয়। তখন থেকেই খুরশীদ লেফটেন্যান্ট খুরশীদ নামে পরিচিত। পরবর্তীকালে ভারতীয় নৌবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত দুটি পুরাতন নৌযানকে ঢেলে সাজিয়ে পদ্মা ও পলাশ নামে বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে হস্তান্তর করা হয়। এ সম্পর্কে মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ১৯৭১ এর বাংলার বাণী’ প্রত্রিকায় লেখা হয় ; নৌবাহিনীর লােকদের নিয়ে একাত্তরের নভেম্বর মাসে নিয়মিত বাহিনীর অধীনে নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ৯ই নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর নিকট থেকে দখল করা ছােট আকারের ৬টি নৌযান নিয়ে প্রথম বঙ্গবন্ধু নৌবহরের উদ্বোধন করা হয়।
এই বাহিনী দখলকৃত অঞ্চলের জল পথে নৌ-তৎপরতা চালাতে থাকে। নৌকমান্ডাে গঠনের পূর্বকথা কোনাে বাহিনী গঠনে প্রথমত ; চাই জনবল, তারপর অস্ত্রবল ও প্রশিক্ষণ। যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে সামান্য যে কজন নৌসেনা ছিল তারা বিভিন্ন সেক্টরের স্থলসেনাদের সাথেই মিলে মিশে যুদ্ধ করতে থাকে। এমনি সময়ে খবর পাওয়া গেল যে ফ্রান্সের তুলন নৌবন্দরে অবস্থানরত পাকিস্তানি সাবমেরিন পি, এন এস ম্যাংগো থেকে ৮জন বাঙালি নাবিক পালিয়ে এসে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে প্রয়ােজনীয় ছাড়পত্রের অপেক্ষায় এ উল্লেখ্য, পাকিস্তান নৌবাহিনী ১৯৬৯ সালে ফ্রান্স থেকে যে তিনটি . অত্যাধুনিক সাবমেরিন ক্রয় করেছিল, পি এন, এস ম্যাগ্রো তার মধ্যে অন্যতম এবং ওটাকে পরিচালনার সুবিধার্থে পাকিস্তান ঐ বৎসরই সাবমেরিনে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন। ১৩জন বাঙালি নাবিক সহকারে মােট ৫৭ জন নাবিক ও নৌকর্মকর্তাকে ফ্রান্সে প্রেরণ করে। ২৬শে মার্চ ৭১ ঐ সাবমেরিনের বেতারকক্ষে বসে বি বি সি’র সংবাদ বুলেটিনে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বর্বরােচিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর জানতে পেরে সমমনা ৯ জন বাঙালি নাবিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণর অদম্য প্রেরণায় পরিকল্পিতভাবে সুযােগের সদ্ব্যবহার করে দলত্যাগ করেন। তারা হলেন : ১. আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী । ২. সৈয়দ মােশারক হােসেন ৩, আহসান উল্লাহ ৪. বদিউল আলম ৫. গাজী রহমতউল্লাহ। ৬. আমিনউল্লাহ শেখ ৭. আবিদুর রহমান ৮, আবদুর রকিব মিয়া ৯. আব্দুল মান্নান। অনেক ত্যাগ তিতিক্ষা অনেক কষ্ট স্বীকার করে অবশেষে তাদের ৮জন স্পেনের মাদ্রিদে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের সহযােগিতায় বােম্বে হয়ে দিল্লী পৌছে যান, কিন্তু শেষােক্ত ব্যক্তি (৯নং) নাবিক আব্দুল মান্নান পথ ভুলে দল বিচ্ছিন্ন হয়ে শেষ পর্যন্ত লন্ডনে পাড়ি জমান এবং সেখানেই থেকে যান ।
দিল্লীতে ভারতের সামরিক বাহিনীর গােয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত বাঙালি সাবমেরিনারদের সাথে আলাপ করে তাদের বােঝাতে সক্ষম হলেন যে প্রয়ােজনীয় রণতরী এবং কর্মকর্তা ও নাবিকের অভাবে যেহেতু মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে নৌযুদ্ধের সূচনা করা সম্ভব নয়, তার বিকল্প হিসেবে নৌ কমান্ডাে অপারেশন চালানােই বেশি যুক্তিগ্রাহ্য। সাবমেরিনারদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও উৎসাহ লক্ষ্য। করে ব্রিগেডিয়ার গুপ্ত এ ব্যাপারে কমান্ডার শর্মাকে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য। আদেশ প্রদান করেন। কমান্ডার শর্মার ব্যবস্থাপনায় ও ভারতীয় নৌবাহিনীর আরেকজন অফিসার এস,কে, দাসের দায়দায়িত্বে দিল্লীর যমুনা নদীতে ২৫শে এপ্রিল থেকে তাদের জন্য কঠের ও শ্রমসাধ্য বিশেষ নৌ প্রশিক্ষণ শুরু হয়। টানা কুড়ি দিন পর ১৫ মে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয়। নেী প্রশিক্ষণ চলাকালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম,এ, জি ওসমানী সাবমেরিনারদের সাথে দেখা করতে এলেন। তার সাথে নেী কমান্ডাে বাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তার উপর বিশদ আলােচনা হয় এবং অচিরেই তিনি প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। ওদিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রধান এডমিরাল নন্দাও একদিন এসে হাজির হলেন এবং নৌকমান্ডাে গঠনের ব্যাপারে তিনি ও মতৈক্য প্রকাশ করেন। শুরু হলাে নৌকমান্ডাে বাহিনী গঠনের প্রস্তুতি।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!