You dont have javascript enabled! Please enable it!
যশাের-খুলনা
নিজ শক্তি ও শত্রু শক্তির পরিসংখ্যান ই.পি, আর বাহিনীর ৩নং সেক্টর সদরের অবস্থান ছিল যশাের শহরে। সেক্টর অধিনায়ক ছিলেন পাঞ্জাবি লে, কর্নেল আসলাম খান এবং উপ-অধিনায়কও ছিলেন একজন অবাঙালি মেজর সরদার আবদুল কাদের। সেক্টর সদরে ছিল একটি সিগন্যাল কোম্পানি ও একটি সাপাের্ট প্লাটুন। সিগন্যাল কোম্পানির অধিনায়ক ছিলেন একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন আওলাদ হােসেন এবং সাপাের্ট প্লাটুন অধিনায়ক ছিলেন একজন বাঙালি জেসিও নায়েব সুবেদার আবদুল মালেক। সেক্টর সদরের এ্যাডজুটেন্ট ও এ্যাডমিন অফিসার ছিলেন একজন বাঙালি ক্যাপ্টেন হাসমতউল্লাহ। সব মিলে সেক্টর সদরে অবস্থান করছিল প্রায় ২০০ এর মতাে ই.পি. আর সৈনিক। তন্মধ্যে ৫০ জনের মতাে অবাঙালি এবং বাকীরা সব বাঙালি। বাঙালিদের মধ্যে প্রায় ২০/২৫ জনের মতাে ছিল ছুটি ভােগরত। সেক্টর সদরের সাপাের্ট প্লটুনে ছিল ৩টি ৬-পাউডার কামান ও ৩টি ত” মর্টার এবং সবধরনের প্রচুর গোলাবারুদ। খুলনাতে অবস্থান করছিল যশাের সেক্টরের ৫নং উইং, যার অধিনায়ক ছিলেন। একজন অবাঙালি মেজর। এই উইং-এর সহকারী অধিনায়ক ও অন্যান্য উচ্চপদের সবাই ছিল অবাঙালি। উইং-এর অধীন ছিল ৫টি কোম্পানি যাদের অবস্থান ছিল নিম্নরূপ: ১. সাতক্ষীরার কলারােয়াতে বাঙালি সুবেদার আবদুল জলিল সিকদারের নেতৃত্বে
‘এ’ কোম্পানি, উইং সদর খুলনাতে ‘বি’ কোম্পানি, বাঙালি সুবেদার হাসানউদ্দিনের নের্তৃত্বে ‘সি’ কোম্পানি সাতক্ষীরার ভােমরা এলাকায়, নায়েব সুবেদার জব্বার আলীর নের্তৃত্বে ‘ডি’ কোম্পানি সাতক্ষীরার কুমঝুমপুরে, ৫. বাঙালি সুবেদার তারেকউল্লাহর নের্তৃত্বে ‘ই’ কোম্পানি কালীগঞ্জে, ৬. সাপাের্ট প্লাটুন ছিল উইং সদরে। অপরদিকে যশাের সেনানিবাসে অবস্থান করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১০৭তম ব্রিগেডের অধীন ২২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়ন, ২৭তম বেলুচ ব্যাটালিয়ন (রেকি ও সাপাের্ট) এবং ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন।
২৬শে মার্চ ১৯৭১-এ এই ব্যাটালিয়নগুলাের অবস্থান ও পরিস্থিতি ছিল নিম্নরুপ: ১. ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন বাঙালি লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের নের্তৃত্বে িচৌগাছা এলাকা (সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত এলাকা)। ২. ২২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ব্যাটালিয়নের ২ কোম্পানি ব্যাটালিয়নের উপ অধিনায়কের নের্তৃত্বে খুলনা শহরে (৩০০জন)। মূল ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাসে।। ২৭তম বেলুচ ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি ও অতিরিক্ত এক প্লাটুন (২০০ জন) মেজর শশায়েবের নের্তৃত্বে কুষ্টিয়া শহরে। মূল ব্যাটালিয়নের অবস্থান ছিল যশাের সেনানিবাসে। এই বাহিনীর হাতিয়ার ছিল ১০৬ মি. মি. জিপারােহী আর-আর, ও মর্টার, ২’ মর্টার, ৩.৫ রকেটলাঞ্চার, হেভি, মিডিয়াম ও হালকা মেশিনগান, সাব মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় চায়নিজ রাইফেল। এছাড়া যশাের সেনানিবাসে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গােলন্দাজ বাহিনীর একটি ফিল্ড রেজিমেন্ট ও অন্যান্য কোর ও সার্ভিস প্রতিষ্ঠানসমূহ যাতে কিছু কিছু বাঙালি সৈন্যেরও অবস্থান ছিল। পরিসংখ্যানে দেখা যায় ২৬শে মার্চ তারিখে যশাের সেনানিবাসে সব মিলে মােট সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২৩০০ জন। তন্মধ্যে পদাতিক ও গােলন্দাজ বাহিনীর যুদ্ধোপযােগী সৈন্য সংখ্যা প্রায় ১৫০০ যাদের সবাই ছিল অবাঙালি বাকী ৮০০ সৈন্যের প্রায় ২০০ জনের মতাে ছিল বাঙালি, বাকী ৬০০ অবাঙালি সৈন্য সাপ্লাই, মেডিকেল, অর্ডিন্যান্স ইত্যাদি সার্ভিসের ছিল। পদাতিক বাহিনী ব্যতিত অন্যান্যদের হাতিয়ার ছিল মিডিয়াম ও হালকা মেশিনগান, সাব-মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় চায়নিজ রাইফেল। সেনানিবাসে সর্বপ্রকারের প্রচুর গােলাবারুদ মজুদ ছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর কার্যক্রম ও বাঙালিদের ভূমিকা ২৫শে মার্চ রাত ১২টার দিকে যশাের সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল যশাের শহরে প্রবেশ করে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে এবং সমগ্র শহরে টহল দিতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণাশঙ্কায় যশাের সেক্টরের বাঙালি ই.পি, আর বাহিনীও তাদের অস্ত্রাগার ভেঙে অস্ত্র সংগ্রহ করে এবং প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে টহল দিতে থাকে। পাকিস্তানি সেনারা শেষরাতে ই.পি, আর সেক্টর সদরের প্রতিরক্ষা লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়লে ই.পি, আর বাহিনীও তার পাল্টা জবাব দেয়। সে রাতে এছাড়া আর কোনাে অঘটন ঘটেনি।
২৬শে মার্চ সকালে সিগন্যাল কোম্পানি অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আওলাদ হােসেন সেক্টর সদরে প্রবেশ করে সব বাঙালি ই.পি, আর দের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তার কিছুক্ষণ পর সেক্টর অধিনায়ক লে. কর্নেল আসলাম এসে দুপুর ১২টার পর তাদেরকে অস্ত্রাগারে অস্ত্র জমা করাতে সমর্থ হয়। বিকেল ৪টার পর চুয়াডাঙ্গা ৪নং উইং-এর ই.পি. আর-রা সম্পূর্ণ বিদ্রোহ করেছে এ খবর দিয়ে সেক্টর সদরে অবস্থিত বাঙালি ক্যাপ্টেনদ্বয়কেও সেক্টর সদরের বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ করতে। উৎসাহিত করার জন্য দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর এম, এ, ওসমান চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে বেতার মারফত ক্যাপ্টেন আওলাদ ও ক্যাপ্টেন হাসমতউল্লাহর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্যাপ্টেনদ্বয় মেজর ওসমানের সঙ্গে কথা বলতে সম্মত হলেন না। বারবার চেষ্টা করেও মেজর ওসমান দু’জন ক্যাপ্টেনের একজনকেও বেতার সেটের নিকট আনতে পারলেন না। তবে তার কথায় বাঙালি সৈনিকরা চুয়াডাঙ্গার বিদ্রোহের খবর পেয়ে যায় । ৩০শে মার্চ সকাল ৯টার সময় যশাের সেনানিবাসে পাকিস্তানি বাহিনী ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর অতর্কিতে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন হাফিজ তার। সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “৩০শে মার্চ সকালে ব্রিগেডিয়ার দূররানি আমাদের ব্যাটালিয়ন অফিসে যান এবং কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জলিলকে বলেন যে আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলাে এবং আমাদের অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে হবে। তারপর ব্রিগেডিয়ার আমাদের ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে চাবিগুলাে হস্তগত করেন।” একই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী যশােরের পুলিশ লাইন এবং ই.পি, আর সেক্টর সদর দূরপাল্লার কামান ও অন্যান্য আধুনিক মারণাস্ত্র দিয়ে বেপরােয়াভাবে আক্রমণ। করে। সঙ্গে সঙ্গে সেক্টরের বাঙালি ই.পি, আর সৈন্যরা হাবিলদার তৈয়বুর রহমানের নির্দেশে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ই.পি, আর বাহিনী যশাের শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর উপর। গুলি ছুড়তে থাকে। ঐ দিন সামরিক কর্তৃপক্ষের নির্দেশে পুলিশ বেসামরিক অস্ত্র জমা নিচ্ছিল।
কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের সাথে সাথে যশােরের এস,পি, জনসাধারণের হাতে ঐসব অস্ত্র তুলে দেবার নির্দেশ দেন। কর্তব্যরত গােয়েন্দা বিভাগের ওসি আবদুল হামিদ তার সহযােগীদের সহায়তায় সব অস্ত্র জনতার হাতে তুলে দেন। বাঙালি ক্যাপ্টেন আওলাদ হােসেন ও ক্যাপ্টেন হাসমতউল্লাহ (সাবেক ডি, আই, জি, পুলিশ চট্টগ্রাম রেঞ্জ) ইতােমধ্যে পরিবার পরিজনসহ সেক্টর থেকে অন্যত্র চলে গেলে নায়েব সুবেদার আবদুল মালেক সেক্টরের বাঙালি ই.পি. আর দের নেতৃত্ব হাতে নেন। তিনি ই.পি, আর সৈনিকদের সংগঠিত করে বিভিন্ন স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ স্থাপন করার নির্দেশ দেন। ওদিকে খুলনায় ৫নং উইং সদরে অবস্থিত ই,পি, আর এর ‘বি’ কোম্পানি ও সাপাের্ট প্লাটুনের বাঙালি সৈনিকরা ২৫শে মার্চের রাতেই বন্দি হয়ে যায়। পরবর্তী। সময়ে বন্দি অবস্থা থেকে পালিয়ে অনেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। অবশ্য।
———–
* সাক্ষাৎকার : ক্যাপ্টেন হাফিজ (বীরবিক্রম)।
৫নং উইং এর অন্যান্য কোম্পানিগুলি প্রথম থেকেই স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশ নিতে সমর্থ হয়েছিল। সুবেদার আবদুল জলিল শিকদারের নের্তৃত্বে ‘এ’ কোম্পানি, নায়েব সুবেদার জব্বার আলীর নের্তৃত্বে ‘সি’ কোম্পানির সাথে সংযুক্ত একটি প্লাটুন, সাতক্ষীরার ঝুমঝুমপুরে অবস্থানরত ‘ডি’ কোম্পানি যার এক প্লাটুন ছিল যশাের জেল খানা প্রহরায় এবং একটি প্লাটুন ছিল কোম্পানি সদর ঝুমঝুমপুরে, তােবারকউল্লাহর নের্তৃত্বে ‘ই’ কোম্পানি কালীগঞ্জ থেকে অগ্রসর হয়ে মেজর ওসমানের নির্দেশে তিনটি কোম্পানি যশােরের ঝিকরগাছায় একত্রিত হয়। পরে বাঙালি ই.পি, আর বাহিনী নায়েব সুবেদার ইলিয়াস পাটোয়ারির নের্তৃত্বে এক কোম্পানি যশােরের কারবালার কাছে, নায়েব সুবেদার সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে এক কোম্পানি যশােরের উপশহরে গরিব শাহ মাজারের কাছে এক প্লাটুন ও যশাের খুলনা সড়কে এক কোম্পানি সুবেদার হাসানউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে প্রতিরক্ষা গ্রহণ করে। সার্বিক প্রতিরক্ষার নের্তৃত্বে রইলেন সুবেদার আবদুল জলিল শিকদার। অন্যদিকে যশাের সেক্টর সদরের বাঙালি ই,পি, আর দুইভাগে বিভক্ত হয়ে। প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। হাবিলদার তােফাজ্জল আলীর নের্তৃত্বে ৩২ জনের ক্যাডার। দল সন্ন্যাসদীঘিতে এবং নায়েব সুবেদার আবদুল মালেকের নের্তৃত্বে ৬০ জন সেক্টর সদর প্রতিরক্ষায় রইলেন চাচড়ার মােড়ে নায়েক মতিউর রহমানের কর্তৃত্বে একটি ৬ পাউন্ডার কামান ও হাবিলদার তৈয়বুর রহমানের কর্তৃত্বে অপর ১টি ৬-পাউডার কামান চাচড়ার ট্রাফিক আইল্যান্ডে বসানাে হল।  ৩০শে মার্চ সন্ধ্যার পর পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি জিপ, ১টি জড ও ১টি ৩টন গাড়ি করে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে খুলনা থেকে যশাের আসছিল। যথাসময়ে পাকিস্তানি বাহিনীর আগমনের সংবাদ পেয়ে ই.পি, আর বাহিনী প্রস্তুত হয়ে রইল। গাড়িগুলাে রেঞ্জে আসার সাথে সাথে একই সময়ে তিন দিক থেকে আক্রমণ করা হয়।
৬-পাউডার কামানের গােলার আঘাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি গাড়ি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গাড়ি থেকে নেমে তারা পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় । তারা পূর্ব দিকে পালাবার চেষ্টা করে কিন্তু সেদিকেও ই.পি, আর বাহিনীর অবস্থান থাকায় তাদের হাতে চরম মার খায়। জানা যায়, এই সংঘর্ষে ৫০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপর দিকে ২জন ই.পি, আর সৈন্য শহীদ হয়। রাত ১২টার পর পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যান্যরা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় সেনানিবাসে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। | ৩১শে মার্চ যশাের শহর সম্পূর্ণ মুক্ত হয় । যশােরে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে যুদ্ধ বাঁধলে যশােরের ই,পি, আর চুয়াডাঙ্গার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করে। চুয়াডাঙ্গার উইংঅধিনায়ক; দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের প্রধান সেনাপতি মেজর ওসমান যশােরের সাহায্যে ২টি কোম্পানিকে পাঠিয়ে দেন। কোম্পানি দুটি যশােরের বারােবাজারে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তাই ঐ কোম্পানিদ্বয় আর যশাের পৌছুতে
———-
* সাক্ষাৎকাৰ ; মাে, আবদুল হামিদ, সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ, কোতয়ালী থানা, যশাের ।
পারেনি। এদিকে ২রা এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধারা যখন প্রায় সেনানিবাসে প্রবেশ করবে তখনই দেখা গেল যশাের সেনানিবাসে শ্বেতপতাকা উড়ছে। এতে মুক্তিযােদ্ধারা জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। তখন এও দেখা গেল যে পি, আই, এ, এবং পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর পরিবহন বিমানগুলি কিছুক্ষণ পরপর যশাের বিমান বন্দরে ওঠা-নামা। করছে। এতে সবার মনে একটা ভুল ধারণা জন্মায় যে সম্ভবত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেনানিবাস ছেড়ে চলে যাচ্ছে। কিন্তু আসলে সেনানিবাসে সাদা পতাকা উড়িয়ে তারা ঐ সময় ঢাকা থেকে ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসছিল।
পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতি আক্রমণ ও যশােরের পতন
১লা এপ্রিল ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম নামে একজন ছুটি ভােগরত অফিসার যশাের রণাঙ্গনে এসে ৫নং উইং-এর তিনটি কোম্পানির অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। তারপর সুবেদার শিকদার ও হাবিলদার আউয়াল ভারত গিয়ে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে ১৭তম বি, এস, এফ, ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মেঘ সিং থেকে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করেন। ওদিকে ৩রা এপ্রিল থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী যশােরের মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপকভাবে কামানের গােলা নিক্ষেপ করতে থাকে। এ সময় লক্ষ্য করা যায় যে পাকিস্তানি সেনারা শহরের দক্ষিণে অবস্থিত অবাঙালি বসতির প্রায় প্রত্যেক বাড়িতে প্রতিরক্ষামূলক পজিশন নিয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে সেনানিবাসের নিকটস্থ অবস্থানে টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠায় মুক্তিযােদ্ধারা। পশ্চাদসরণ করতে থাকে। অবাঙালিদের সামনে রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছিল। তারা পুলেরহাট ও যশােরের মধ্যে সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ফলে সুবেদার হাসানউদ্দিন যে কোম্পানি নিয়ে সেনানিবাসের উপর ও মর্টারের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তা ব্যহত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা পাশ্চাদপসরণ করতে করতে ক্রমশ একে অপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে এবং দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি দল সুবেদার হাসানউদ্দিনের নের্তৃত্বে নড়াইলের দিকে এবং অপরটি ঝিকরগাছার দিকে পিছু হটতে থাকে।
৬ই এপ্রিলের মধ্যে যশাের শহর পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। সুবেদার হাসানউদ্দিনের নের্তৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের দলটি নড়াইলে অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানের দলের সঙ্গে মিলিত হয়। নড়াইলের মহকুমা প্রশাসক কামালউদ্দিন সিদ্দিকীর সহায়তায় লে, মতিউর রহমান স্থানীয় আনসার, পুলিশ, ছাত্র, মুজাহিদ নিয়ে প্রতিরক্ষা সংগঠিত করবার চেষ্টা করছিলেন। যৌথবাহিনী নড়াইল থেকে। অগ্রসর হয়ে যশোের উদ্ধার করবার জন্যে ঝুমঝুমপুর নামক স্থানে প্রতিরক্ষা রচনা করে। কিন্তু এপ্রিলের ৯ তারিখ পাকিস্তানি বিমানের ব্যাপক হামলায় মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং বহু মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হয়। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে মাগুরা চলে যায়। ১৩ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে নড়াইল শহরের পতন ঘটে। মেজর ওসমানের নির্দেশক্রমে সুবেদার হাসানউদ্দিনের দলটি মাগুরার সীমাখালী। নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর চারদিক থেকে ব্যাপক আক্রমণে মাওয়াতে তাদের টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। পশ্চাদপসরণ করে ইনি, সার বাহিনীর এই দলটি কামারখালী নদীর পাড়ে প্রতিরক্ষা পজিশন গ্রহণ করে। শবে ক খ’লীর পতন ঘটলে ই.পি, আর বাহিনীর এই দলটি বহু প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে রাজাপুর সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।  যশােরের ই,পি, আর বাহিনীর অপর দলটি ঝিকরগাছাতে একত্রিত হয়। ই.পি, আর বাহিনীর অনুরােধে ভারতের ১৭নং বি,এস, এফ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক লে. কর্নেল মেঘ সিং তার ব্যাটালিয়নের দু’টি কোম্পানিকে অফিসারসহ পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে ঝিকরগাছার লাওজান গেটের নিকট প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করতে আদেশ দিলেন।
পুলেরহাট নামক স্থানে ই.পি. আর বাহিনীও প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ১১ই এপ্রিল সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী বাড়িঘর জ্বালিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালাতে চালাতে ঝিকরগাছা অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে বলে খবর পাওয়া গেল। পাকিস্তানি বাহিনীকে। প্রতিরােধ করার জন্য সঙ্গে সঙ্গে ই.পি. আর বাহিনীর দুই প্লাটুন সৈন্য বেনাপােল সড়ক ধরে অগ্রসর হয়। কিছুদূর এগুতেই তারা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল আক্রমণে ই.পি. আর বাহিনী পিছু হটতে থাকে। এই যুদ্ধে ভারতীয় বি, এস, এফ-এর দু’টি কোম্পানিও যােগ দেয়। ই.পি, আর ও বি, এস, এফ বাহিনী ঝিকরগাছা নদীর অপর পাড়ে পজিশন নেয় উভয় পক্ষে তুমুল গােলাগুলি চলতে থাকে। ১২ই এপ্রিল ভােরে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের গােলন্দাজ সাপাের্ট সহকারে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড যুদ্ধে দু’জন ই.পি. আর ও একজন বি, এস, এফ সৈন্য নিহত হয় এবং বি, এস, এফ-এর একজন নায়েক ও একজন অয়্যারলেস অপারেটর সেটসহ পাকিস্তানি। বাহিনীর হাতে বন্দি হয়। এরপর বি,এস, এফ বাহিনী ভারতে চলে যায় এবং ই.পি, আর বাহিনী বেনাপােলের কাগজপুকুর নামক স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে।
বেনাপােল যুদ্ধ (২৪শে এপ্রিল)
পূর্বেই বলা হয়েছে যে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর দপ্তর ১৮ই এপ্রিল ইছাখালী থেকে বেনাপােলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেদিনই রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর ওসমান বেনাপােল-যশাের সড়ক ও দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন এবং বেনাপােলের পূর্বদিকে কাগজপুকুর নামক স্থানে ই. পি.আর -এর দু’টি কোম্পানি দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যহ রচনা করেন। এ সময় ক্যাপ্টেন হাফিজের নের্তৃত্বে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক কোম্পানি সৈন্যকে (১৫০ জন) বেনাপােল কাস্টম কলােনির দক্ষিণ ভাগে রিজার্ভ বাহিনী। হিসেবে রাখা হয়েছি । ইতােমধ্যে ঢাকা সেনানিবাস থেকে পালিয়ে এসে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান নামে দু’জন অফিসার মেজর ওসমানের সাথে যােগদান করেন।
——————-
সাক্ষাৎকার সুবেদার হাসানউদ্দিন আহমদ, সদর উইং বি ভি আর পিলখানা, ঢাকা ।
সাক্ষকার : লে. (,) ; মতিউর রহমান, লােহাগড়া, সাের। **
সাথ কার নায়েক সুবেদার নুরুল হুদা, ৯ নম্বর উই; বি ডি আর ঠাকুগাও, দিনাজপুর।
২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে তিনটায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা বহ কাগজপুকুর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ও প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা কাগজপুকুরের প্রতিরক্ষা গুটিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। পশ্চাতে এসে তারা বেনাপােলের পূর্ব সীমানায় রাস্তার দু’পাশে দুই কোম্পানি অবস্থান নেয়। এখানে উল্লেখ্য যে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনও ফিল্ড টেলিফোন বা ফিল্ড অয়্যারলেস না। থাকার কারণে তাদের প্রতিরক্ষা পজিশনগুলি কখনােই যােগাযােগ সমন্বয় করতে পারেনি, রণ-সদরের সাথেও তাদের যােগাযােগ রক্ষা করা সম্ভব হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনী বেনাপােলের পূর্ব সীমানায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহকে সুরক্ষিত করার সুযােগ ও সময় দেয়নি। মাত্র ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ২৪শে এপ্রিল ভাের চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাদের অবস্থানে টিকে থাকতে পারেনি। মেজর ওসমানের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যার্থে 3 মর্টার সহ একটি সাপাের্ট প্লাটুন পাঠানাে হয়। কিন্তু মর্টারের আঘাতেও পাকিস্তানিদের অগ্রাভিযান বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। মসস এখানে উল্লেখযােগ্য যে পাকিস্তানি সেনাদের কিছু অংশ ই.পি, আর বাহিনীর পােষাক পরে অগ্রসর হচ্ছিল। নায়েব সুবেদার মুজিবুর রহমান নিজেই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মেশিনগান দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে বুলেট বিদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। তার মেশিনগানের সুইপিং ফায়ারে (Sweeping fire) পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে অগ্রসর হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধরত ই.পি. আর সৈনিকরা ই.পি, আর পােষাক-পরা পাকিস্তানি সেনাদেরকে নিজেদের বন্ধু বলে ভুল করলাে। নায়েব সুবেদার মুজিবুরও ভুল করলেন। যখন চিনতে পারলেন তখন আর কোনও উপায় ছিল না। নায়েব সুবেদার মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হলেন।
নায়েব সুবেদার মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সাপ্তাহিক মাতৃভূমিতে লেখা হয়েছে :  “মেজর সাহেবের নির্দেশ না শুনেই একখানা সামরিক জিপ ভর্তি এ্যামুনিশন নিয়ে রওনা হয়ে যান নায়েব সুবেদার মুজিবুর। প্রবল গােলাগুলি ও রকেট বৃষ্টির মধ্য দিয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে প্রতিটি প্রতিরক্ষা পরিখায় এ্যামুনিশন পৌছে দিলেন তিনি। একটি মেশিন গান পরিখায় পৌছে দেখেন অসংখ্য শত্রুসেনা সম্মুখভাগ থেকে উক্ত পরিখার দিকে ধাবিত। মেশিন গানের আশেপাশে প্রবল গােলাবৃষ্টি হচ্ছে। একজন গান। ম্যান গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গানের পাশেই শহীদ হয়ে পড়ে আছেন। বাকি দু’জন শত্রুর চাপের মুখে টিকতে না পেরে গানের লকটা খুলে নিয়ে গানটা অকেজো অবস্থায় রেখে পিছু হটে গেছে । মুজিবুর তৎক্ষণাৎ সঙ্গী সৈনিকটিকে পার্শ্ববর্তী পরিখা থেকে লক আনার আদেশ দিয়ে নিজে পজিশন নেন এবং শত্রুর গতিবিধি লক্ষ করতে থাকেন। সঙ্গীটির ফিরে আসতে বিলম্ব দেখে তিনি নিজেই জীবন বিপন্ন করে লক নিয়ে এসে ফিট করেন, তারপর শত্রুর দিকে গুলি চালাতে শুরু করেন। এমন সময় তার।
—————
* সাক্ষাৎকার : হাবিলদার বেলায়েত হােসেন, ১২নং উইং বি, ডি, আর আখালিয়া, সিলেট
সাহায্যকারী সৈনিকটি শক্রর বুলেটে শাহাদাৎ বরণ করেন। মুজিবুর হামাগুড়ি দিয়ে তার লাশটি একটু দূরে সরিয়ে রাখেন এবং পুনরায় একাই শত্রু নিধনে মেতে ওঠেনযদিও এ গানটি চালাতে তিন জন লােকের দরকার হয় ।… শত্রু যখন অত্যন্ত নিকটে এসে পড়েছে তখন মুজিবুরের গানের বেল্টগুলাে শূন্য হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে কোমর থেকে পিস্তল খুলে নেন। পিস্তলের গুলিও শেষ হয়ে যায়। শক্ত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে; মুজিবুর রহমান তখন পাঞ্জাবিদের উদ্দেশে কঠোর। হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেন। আল্লাহ আকবর’- ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি সহকারে খালি হাতেই বীর বিক্রমে শক্রর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে শত্রুর এক ঝাক গুলি এসে বিদ্ধ করে তাঁকে। ঝাঝরা হয়ে যায় তার বুকের পাঁজর।”  সুবেদার খায়রুল বাশার তার সাক্ষাৎকার বলেছেন, “শত্রুর প্রবল আক্রমণে আমাদের টিকে থাকা বেশ মুশকিল হয়ে পড়লাে। চারদিকে বৃষ্টির মতাে গােলা পড়তে লাগলাে। হাবিলদার মুজিবরকে বার বার পিছু সরে আসতে বললে সে বলল, হাবিলদার মুজিবুর পিছুতে জানে না। তারপরই হাবিলদার মুজিবুরকে আর দেখতে পেলাম না।” পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কাগজপুকুরের পতন ঘটে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সদর-দপ্তর বেনাপােলের পতন ঘটেনি। বেনাপােল সদর দপ্তরে স্বাধীন বাংলার পতাকা সমুন্নত রাখতে তারা সক্ষম হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে এ পতাকার পত্ পত্ বন্ধ করা পরবর্তী ৮ মাসেও সম্ভবপর হয়নি।
ইতােমধ্যে ই.পি, আর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সংখ্যক সৈনিক মেজর ওসমানের বাহিনীতে যােগদান করে। তিনি বাহিনীকে পুনর্বিন্যাস করে সাতটি কোম্পানিতে বিভক্ত করে সাতজন অধিনায়কের নের্তৃত্বে সীমান্তবর্তী সাতটি এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করেন এবং সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ শুরু করেন।
—————-
* এর কয়েকদিন আগেই হাবিলদার মুজিবুরকে প্রমােশন দিয়ে নায়েব সুবেদার করা হয়
হাবিলদার শ্রাবদুল কুদ্দস , সাপ্তাহিক মাতৃভূমি, ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭২।
অন্যান্য জেলার প্রতিরােধ
বরিশাল জেলা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে উঠেছিল বরিশাল, পাবনা, কুমিল্লা, নােয়াখালী প্রভৃতি জেলাতেও। বরিশালের জনপ্রতিনিধি এম, পি, এ, নূরুল ইসলাম মনজুরের নির্দেশে ২৬শে মার্চ ভােরে পুলিশের অস্ত্রাগার ভেঙে জনতার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। তারপর বরিশালের পুলিশ বাহিনীও সশস্ত্র প্রতিরােধে জনতার কাতারে সামিল হয়। বারিশাল জেলার উজিরপুর থানার পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আর্মার্ড কোরের অফিসার মেজর এম, এ, জলিল ছিলেন তখন ছুটি ভােগরত। নূরুল ইসলাম মনজুর মেজর জলিলকে বরিশাল সদরে এনে তাকে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব নিতে বললেন। মেজর জলিল দায়িত্ব গ্রহণ করে ই.পি, আর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে একটি বিরাট বাহিনী গড়ে তুলে তাদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থাও করে ফেলেন। সাথে যােগ দিলেন লেফটেনেন্ট হুদা, লে, মেহেদী এবং লে, নাসের। প্রাথমিক অবস্থায় মেজর জলিল বরিশাল রক্ষার ব্যবস্থা করলেন। বরিশালে প্রবেশের তিনটি পথের তিনটিতেই তিনি প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তােলেন। ১লা এপ্রিলের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের হামলার জন্য প্রস্তুত হয়ে গেল। অস্ত্র সাহায্যের উদ্দেশে ঐ তারিখেই মনজুর ভারতে পাড়ি জমালেন। ৬ই এপ্রিল জলিল খুলনা বেতার কেন্দ্র পুনর্দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। নায়েব সুবেদার সিদ্দিকুর রহমানের নের্তৃত্বে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দলকে প্রস্তুত করলেন। ৪ঠা এপ্রিল মেজর জলিল পিরােজপুর হয়ে বাগেরহাট রওয়ানা হলেন। এদিকে লে, জিয়া পিরােজপুরে ছাত্র, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ই.পি, আর নিয়ে একটা বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এই বাহিনীও মেজর জলিলে অধীনে কাজ করতে শুরু করে। প্রয়ােজনীয় খবরাখবরের জন্য আক্রমণের তারিখ ৬ই এপ্রিলের পরিবর্তে ৭ই এপ্রিল করা হল। ৭ই এপ্রিল রাতে নায়েব সুবেদার সিদ্দিকের নের্তৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল রূপসা নদী পার হয়ে খুলনা বেতারকেন্দ্র আক্রমণ করল।
বেশ কিছুক্ষণের সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও বেতারকেন্দ্র তাদের হাতছাড়া হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের একজন শহীদ হয়। আক্রমণ ব্যর্থ হলে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে। ১৭ই এপ্রিল বরিশালে একজন পাকিস্তানি গােয়েন্দা ধরা পড়লাে। মেজর জলিল তাকে চরম শাস্তি দিলেন। ঐদিনই হাজার হাজার জনতার উপস্থিতিতে বরিশাল স্টেডিয়ামে প্রকাশ্যে গুলি করে সেই গােয়েন্দাকে হত্যা করা হয়। সেদিন পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর দুটি জঙ্গী বিমান বরিশালের উপর নির্বিবাদে গােলাবর্ষণ করে। এপ্রিলের ২২ তারিখেই এম, পি, এ, জনাব নূরুল ইসলাম সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ভারত থেকে বেশ কিছু অস্ত্র নিয়ে এলেন। আরও অস্ত্রের জন্য তার পরামর্শক্রমে মেজর জলিল লে. হদাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে রওয়ানা হলেন। খুলনা, পটুয়াখালী ও বরিশাল প্রতিরক্ষার ভার নিলেন লে, জিয়া, লে. নাসের ও লে, মেহেদী। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা শেষ পর্যন্ত বরিশালে টিকে থাকতে পারেনি। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক আক্রমণে বরিশাল জেলার পতন ঘটে। ঐ সময়ের মধ্যে মেজর জলিল ভারত থেকে ফিরে আসতে পারেননি। মে মাসের শেষার্ধে মুজিবনগরে মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের (ইতােমধ্যে এই রণাঙ্গনের সরকারি নাম দেওয়া হয় ৮নং সেক্টর) প্রধান সেনাপতি (পরে সেক্টর অধিনায়ক মেজর ওসমানকে তার দপ্তরে ডেকে মেজর জলিলের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। পরিচয়ের পর প্রধান সেনাপতি ৮নং সেক্টরের বিশালত্বের দরুণ এই সেক্টরকে ভেঙ্গে ৯নং সেক্টর গঠন করে মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন দেবার প্রস্তাব করলে মেজর ওসমান সানন্দে রাজী হয়ে যান। গঠন করা হলাে ৯নং সেক্টর, অধিনায়ক হলেন মেজর জলিল। সে সময় ৮নং সেক্টরের অধীন পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে দখলকৃত বহু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলা বারুদ মজুদ ছিল। প্রধান সেনাপতির নির্দেশে মেজর ওসমান ৯নং সেক্টরকে সশস্ত্র করার মতাে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ প্রদান করেন।
মেজর জলিল ৫ই মে এসব অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে দু’টি লঞ্চে বরিশালের পথে রওয়ানা করেন। কপােতাক্ষ নদীর তীরে গাবুরা নামক স্থানে (এটা একটা ছােট দ্বীপ ছিল) লঞ্চ দুটি আসতেই পাকিস্তানি গানবােট লঞ্চের উপর আক্রমণ করে। গােলার আঘাতে দুটি লঞ্চেই আগুন ধরে যায় এবং সব অস্ত্র ও গােলাবারুদ সহকারে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মেজর জলিলের সাথে ৪০ জন বাঙালি সৈন্য ছিল, তন্মধ্যে ২৬জনই পাকিস্তানি দালালদের হাতে বন্দি হয়ে যায়। বন্দিদের মধ্যে লে. দাও ছিলেন। মেজর জলিল সাঁতার কেটে পালিয়ে কোনও প্রকারে বেঁচে যান এবং মুজিবনগর ফিরে এসে প্রধান সেনাপতির নিকট ঘটনা বর্ণনা করেন। প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী এরপর মেজর জলিলের সাথে আর কোনও সহায়তা করেননি। এই দুঃসংবাদ অবগত হয়ে ৮নং সেক্টর অধিনায়ক মেজর ওসমান মেজর জলিলকে ডেকে এনে আরাে কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ সহকারে বরিশালে পাঠিয়ে দেন। পুনরায় অস্ত্র সম্ভারে সজ্জিত হওয়ার ফলে মেজর জলিল তার সেক্টরাধীন এলাকায় যুদ্ধের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখেন এবং বেশ কিছু সফল অপারেশন সম্পন্ন করেন।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!