You dont have javascript enabled! Please enable it!
কুষ্টিয়া যুদ্ধ (৩০শে মার্চ-১লা এপ্রিল)
পাকিস্তানি বাহিনীর ২৭তম বেলুচ ব্যাটালিয়নের পদ ছিল সামরিক ভাষায় ‘রেকি এণ্ড সাপাের্ট ব্যাটালিয়ন’ যাদের গােলা শক্তি (fire power) ছিল সাধারণ পদাতিক ব্যাটালিয়নের অনেক গুণ বেশি। এই জাতীয় ব্যাটালিয়ন ছিল সম্পূর্ণরূপে গতিশীল (mobile)। এই ব্যাটালিয়নেরই এক কোম্পানির অধিক সৈন্য (২০০ জন) মেজর শােয়েবের নের্তৃত্বে ২৫শে মার্চ রাত বারােটার পর যশাের সেনানিবাস থেকে এসে কুষ্টিয়া শহর অধিকার করে সান্ধ্য আইন জারীর দ্বারা তাদের আধিপত্য বিস্তার করে। কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ছিল তাদের প্রধান ঘাটি, দুই প্লাটুনের অবস্থান ছিল পুলিশ লাইনে, এক প্লাটুন পজিশন নিয়েছিল ওয়্যারলেস স্টেশনে, এক প্লাটুন ছিল প্রধান ঘাঁটি জিলা স্কুলে এবং এক সেশন ছিল কোতােয়ালী থানায়। শক্তিশালী বেতার মারফত যশােরের সাথে তাদের সংযােগ ছিল এবং আন্তঃপ্লাটুন সংযােগও স্থাপন করেছিল বেতার মারফত। কুষ্টিয়া শহরের টেলিফোন এক্সচেঞ্জকে সম্পূর্ণরূপে বিকল করে রাখা হয়েছিল।  দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অধিনায়ক মেজর ওসমান চৌধুরীর রণ-সদর (OPS Hg) ও চুয়াডাঙ্গার ৪নং ই.পি, আর উইং-এর সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০০’র মতাে বাঙালি। অস্ত্র বলতে ব্রিটিশ আমলের ৩০৩ (থ্রি নট থ্রি) রাইফেল, পুরাতন ধরনের। কিছু মাঝারি ও হালকা মেশিন গান আর কিছু সেকেলে রকেট লাঞ্চার ও ৬টি ৩ মর্টার। এই উইং-এর অবশিষ্ট অফিসার বলতে ছিলেন একমাত্র বাঙালি ক্যাপ্টেন, এ, আর, আযম চৌধুরী। বিদ্রোহ ঘােষণার পর থেকেই শহরে হাজার হাজার জনতা যার যা ছিল তাই নিয়ে যুদ্ধে নামার জন্য প্রস্তুত ছিল ! মেজর ওসমান এই উত্তাল জনতাকে অন্যভাবে কাজে লাগাবেন ঠিক করলেন। তিনি ইতোমধ্যেই কিছু সংখ্যক আনসার,-মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্রকে সামান্য ট্রেনিং দিয়ে মূলবাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। উইং-এর ই.পি, আর বাহিনীর কাছে ফিল্ড টেলিফোন বা ফিল্ড অয়্যারলেস কোনটাই না থাকায় কুষ্টিয়ার রণক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের জন্য টেলিফোন বিভাগের সাহায্যে পােড়াদহের খােলা প্রান্তরে। ফিল্ড এক্সচেঞ্জ বসানাে হল। নিঃসন্দেহে এটা ছিল চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন বিভাগের তকালীন কর্মচারীদের এক অতি প্রশংসনীয় ভূমিকা যা সরকারি স্বীকৃতির দাবিদার।
এই ফিল্ড এক্সচেঞ্জ বসানাের ফলেই কুষ্টিয়া রণাঙ্গন ও চুয়াডাঙ্গা রণ-সদরের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা সহজ হয়েছিল। ডা. কোরেশী, ডা. করিম, ডা. সাইদুর রহমান ও ডা. আসহাবুল হক জোয়ার্দার এর সমম্বয়ে গঠিত মেডিকেল টিমকে রণাঙ্গনে ঔষধ সরবরাহ ও চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়া হল। ডা. আসহাবুল হকের নেতৃত্বে গঠিত স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীকে যুদ্ধক্ষেত্রে খাদ্য। সরবরাহের দায়িত্ব দেওয়া হল। মেজর ওসমান নির্দেশ দিলেন, আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী কুষ্টিয়ার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীকে তৈরি খাদ্য সরবরাহ করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যন্ত উঁচুমানের গােলাবর্ষণ ক্ষমতার (fire power) কার্যকারিতা নষ্ট করার জন্য (neutralise করার জন্য) মেজর ওসমান কুষ্টিয়া আক্রমণে আক্রমণকারী প্রত্যেক ই.পি. আর কোম্পানির পেছনে বাঁশের লাঠি সজ্জিত কমপক্ষে পাঁচ হাজার জনতার সমাবেশ করার দায়িত্বও ডা. আসহাবুল হকের উপর অর্পণ করলেন। আক্রমণকারীদের অনুসরণকারী লাঠি-সজ্জিত। এই জনতার দায়িত্ব দেওয়া হলাে আক্রমণের সময় জয়বাংলা’র গগণ বিদারী ধ্বনি দিয়ে শক্রর মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করা। ডা, আসহাবুল হক স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠনের দায়িত্ব থেকে শুরু করে খাদ্য সবরাহ এমন কি অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্বও গ্রহণ করেন।  ওদিকে যাদবপুরস্থ কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার আবদুল মজিদ মােল্লা ২৭শে মার্চ। সকাল ১০টায় বেতার মারফত মেজর ওসমানকে জানালেন যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। ১ম ব্যাটালিয়ন, যারা সিনিয়র টাইগার নামে পরিচিত, তাদের সব সৈন্য, অস্ত্র ও রসদসহ বাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের নের্তৃত্বে চৌগাছা অবস্থান করছে। তারা ২৪শে মার্চ থেকেই বাৎসরিক ফিল্ড একসারসাইজ উপলক্ষ্যে চৌগাছাতে অবস্থান করছিল।
খবর পেয়ে মেজর ওসমান তখুনি লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের কাছে পত্র লিখলেন :  “দেশ ও দেশের লােকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত, মাবােনের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ই.পি, আর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি, বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি । আর কে কি করছে জানি না, কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে, আপনি আসুন, অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুণ। আমরা সম্মিলিতভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হব”। | এই পত্র মেজর ওসমান সুবেদার মজিদের মাধ্যমে লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের নিকট পৌছানাে সত্ত্বেও পত্রের কোনাে উত্তর পাননি। তাই মেজর ওসমান ২৮শে মার্চ পুনরায় ঐ পত্রের পুনঃকপি লিখে দানেশ নামে এক মুক্তিযােদ্ধাকে তার নিজস্ব মর্টর সাইকেল যােগে লে.কর্নেল রেজাউল জলিলের নিকট প্রেরণ করেন। কর্ণেল জলিল এই পত্র পড়ে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে উড়িয়ে দেন এবং এ বিষয় নিয়ে পুনরায় না আসার জন্য সতর্ক করে দেন।  ২৮শে মার্চ যশাের সেনানিবাসের উর্ধতন সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে নির্দেশ পেয়ে লে. কর্নেল রেজাউল জলিল সিনিয়র টাইগারদের নিয়ে সব অস্ত্রশস্ত্র সহকারে ২৯শে মার্চ সেনানিবাসে পৌছে সব অস্ত্র জমা দিয়ে দেন। ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সরদার আবদুর রহিম দূররাণী অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন। ইন্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্টের সিনিয়র টাইগারদের এর পরের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ ও মর্মান্তিক। 
এদিকে কুষ্টিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার পর মেজর ওসমানের জরুরি নির্দেশ মােতাবেক তার সীমান্তবর্তী কোম্পানি গুলি ২৮শে মার্চ চুয়াডাঙ্গা সদরে রিপাের্ট করে দুপুর ১২টার মধ্যেই। পরিকল্পনা অনুসারে যশাের থেকে কুষ্টিয়ার শক্তি বৃদ্ধি অথবা কুষ্টিয়া থেকে পাকিস্তানি সেনাদের পশ্চাদপসরণের পথ রুদ্ধ করার জন্য মেজর ওসমান এক কোম্পানি সৈন্য দ্বারা যশাের-ঝিনাইদহ সড়ক অবরােধ করেন। আক্রান্তস্থল কুষ্টিয়া থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের চাপ প্রত্যাহারের উদ্দেশে মূলঘাটি চুয়াডাঙ্গার উপর সম্ভাব্য মনােযােগ আকর্ষণী-আক্রমণ (Diversionary attack) রােধকল্পে। মেজর ওসমান সুবেদার জিয়াউল হকের নের্তৃত্বে বিশাখালীতে এক কোম্পানি, ঝিনাইদহের এস, ডি, পি, ও, মাহবুবের নের্তৃত্বে কালীগঞ্জে এক কোম্পানি ও সুবেদার জিদ মােল্লার নের্তৃত্বে কোর্ট চাঁদপুরে দুই প্লাটুন প্রতিরক্ষায় মােতায়েন করেন। ওদিকে কাপ্টেন এ, আর, আযম চৌধুরী ও নায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামানের (শহীদ) নের্ততে দুই কোম্পানি ই.পি, আর চুয়াডাঙ্গা-পােড়াদহ কাঁচা রাস্তা ধরে কুষ্টিয়ার পথে অগ্রসর হতে লাগল। প্রাগপুরের ই.পি, আর কোম্পানিকে সুবেদার মুজাফফরের নের্তৃত্বে। কুষ্টিয়ার অদূরে নির্দিষ্টস্থানে অবস্থান করার নির্দেশ পূর্বেই দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী গন্তব্যস্থানে পৌছার পর সুবেদার মুজাফফরের সঙ্গে সংযােগ ও সমম্বয় করার | জনা প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দেওয়া হয়। কুষ্টিয়া আক্রমণের জন্য যে তিনটি দল পাঠানাে হয় তাদের উপর স্থানীয় নিয়ন্ত্রণক্ষমতা বা কম্যান্ড অর্পণ করা হলাে ক্যাপ্টেন আযম। চৌধুরীর উপর।
সার্বিক কম্যান্ডে রইলেন দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের একচ্ছত্র অধিনায়ক মেজর ওসমান চৌধুরী নিজে। পরিকল্পনা হলাে আক্রমণ করা হবে যুগপভাবে তিন দিক থেকে। নির্দেশ দেওয়া হলাে সুবেদার মুজাফফর তার বাহিনী নিয়ে পুলিশ লাইনের পাকিস্তানি ঘাঁটি আক্রমণ করবে। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে শহরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে অর্থাৎ সার্কিট হাউসের দিক থেকে আক্রমণ করবে জিলা স্কুলের মূল ঘাঁটিনায়েব সুবেদার মনিরুজ্জামান তার বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিক থেকে অয়্যারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ চালাবেন। মেজর ওসমান-এর নির্দেশ ছিল যেমন করেই হােক। আক্রমণের পূর্বে আক্রমণের প্রস্তুতি বা অগ্রসর হওয়ার ব্যাপারে সম্পূর্ণ গােপনীয়তা। রক্ষা করতে হবে যেন শত্রুকে পুরােপুরি অপ্রস্তুত অবস্থায় আঘাত করা যায়। আক্রমণকারী অধিনায়ক ও সহকারী বেসামরিক কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলাে Absolute surprise achieved, half the battle won’. oefte ausforce অপ্রত্যাশা অর্জনে অর্ধেক যুদ্ধ জয় হয়ে যায়। আক্রমণের তারিখ ও সময় নির্ধারণ করা হলাে ৩০শে মার্চ ভাের চার ঘটিকা। পরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার মুজাফফরের কোম্পানি পুলিশ লাইনের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে ভাের চারটায় আক্রমণ শুরু করে। পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক আক্রমণকারী। প্রতিটি বাহিনীর পেছনে পাঁচ হাজার লােকের সমাবেশ ও ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি পাকিস্তানিদের দিশেহারা করে ফেলে। ই.পি.আর-এর মতাে আধা সামরিক বাহিনী। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হয়ে কোনাে প্রকার আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে বা পারবে এমন আংশকা কুষ্টিয়ার পাকিস্তানি বাহিনীর অফিসারগণের ধারণাবহির্ভূত ছিল। তাই মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণকালে পাকিস্তানি সেনাদেরকে ঘুমন্ত ও অপ্রস্তুত অবস্থায়ই পেয়েছিল। কাজেই পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে প্রাথমিকভাবে প্রত্যাশিত প্রতিরােধ বা প্রতিআক্রমণ আসেনি। তাছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের অধিকাংশই ‘তারা আক্রান্ত হয়েছেএটা বুঝবার পূর্বেই তাদের অনেকে ধরাশায়ী হয়েছে।
এদিকে আক্রমণ শুরু করার কিছুক্ষণের মধ্যেই মেহেরপুর থেকে এক কোম্পানি মুজাহিদ সুবেদার মুজাফফরের বাহিনীর সাথে যােগদান করে। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানি সেনারা তাদের প্রতিরােধ সমম্বয় সাধন করার সুযােগ বিশেষ পায়নি। তবু বেলা দেড়টার দিকে দেখা গেল চারজন পাকিস্তানি। সেনা একটা আর-আর প্রস্তুত করছে নায়েব সুবেদার মতিন পাটোয়ারির মেশিনগান। পজিশন ধ্বংস করার জন্য। মতিন পাটোয়ারি সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর আর-আর পজিশনের উপর আঘাত হানার নির্দেশ দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে একটি রকেট লাঞ্চার, তিনটি এল, এম, জি ও একটি ২ মর্টার আর-আর এর উপর একই সাথে আঘাত হানতে থাকে । অতর্কিত এই আঘাতে আর-আরটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং চার। জন পাকিস্তানি সেনাই ঘটনা স্থলে নিহত হয়। ৩০শে মার্চ বিকেল ৫টার মধ্যে কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে চলে আসে। ওদিকে দক্ষিণ দিক থেকে ক্যাপ্টেন, এ, আর, আযম চৌধুরী তার বাহিনী নিয়ে জেলা স্কুলের উপর আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। পূর্ব দিকে নায়েব সুবেদার। মুনিরুজ্জামানও তার বাহিনী নিয়ে মােহিনী মিল ও অয়্যারলেস স্টেশনের উপর আক্রমণ। বহাল রাখেন। তিন দিকের যুগপৎ আক্রমণে এবং বাহিনীকে অনুসরণকারী হাজার হাজার লােকের গগণ বিদারী ‘জয়বাংলা’ স্লোগানে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীর সঠিক সৈন্য সংখ্যা নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশ লাইন এলাকা ও অয়্যারলেস স্টেশন এবং মিল এলাকায় যারা দুপুর পুর্যন্ত জীবিত ছিল তারা ভয়ে তাদের অবস্থান থেকে পালিয়ে জেলা স্কুলে তাদের মূল ঘাঁটিতে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা করছিল। পালাবার পথেও বহু পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
বিকেল ৫টা পর্যন্ত একমাত্র জেলা স্কুলের মূল ঘাটি ছাড়া পাকিস্তানি সেনাদের সবগুলি অবস্থানই মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। চারদিক থেকে জেলা স্কুলকে ঘিরে মুক্তিযােদ্ধারা আঘাতের পর আঘাত হানতে থাকে। বাধ্য হয়ে মেজর শােয়েব অয়্যারলেস মারফত যশাের সেনানিবাসের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। যশাের থেকে অয়্যারলেসে মেজর শােয়বকে বলা হল : :Reinforcement not possible. Try to live on your own.” “wrote অতিরিক্ত সৈন্যদল পাঠানাে সম্ভব নয়, নিজেরাই বাঁচবার চেষ্টা কর। মুক্তিযােদ্ধাদের অয়্যারলেসে সংবাদটি ধরা পড়ে। পরদিন ৩১শে মার্চ ভাের বেলা মুক্তিযােদ্ধারা ব্যাপকভাবে আক্রমণ চালিয়েও পাকিস্তানি অবস্থানের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ভারী অস্ত্রের সাহায্যে ক্রমাগত গােলাবর্ষণের ফলে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হবার জন্য মাথা উচু করতেও পারছিল না। তবু সারাদিন দুই পক্ষেরই প্রবল গােলাগুলি অব্যাহত থাকে। সারাদিনের যুদ্ধ শেষে অফিসারসহ আনুমানিক ৪০/৫০ জন পাকিস্তানি সেনা তখনাে জীবিত ছিল। উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে রাতের অন্ধকারে ২টি জিপ ও ২টি ডজ গাড়িতে আরােহণ করে তারা তীব্র গতিতে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে। ঝিনাইদহে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু ভাগ্য তাদের প্রতিকূলে। মুক্তিবাহিনীর একটি অংশ পূর্ব থেকেই শৈলকূপা সেতুটি ধ্বংস করে শূন্য স্থানটিতে বাঁশের চাটাই দিয়ে। আলকাতরা মাখিয়ে পিচঢালা পথের মতো করে তার দুই পাশে ওঁৎ পেতে বসে থাকে। ও
————–
সাক্ষাৎকার : নায়েব সুবেদার আবদুল মতিন পাটোয়ারি, পিলখানা, ঢাকা।
পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িগুলি ঝিনাইদহের দিকে তীব্রগতিতে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধা ও গ্রামবাসীদের সজাগ দৃষ্টি সেতুর উপর এসে পর পর ২টি জিপই নিচে পড়ে যায়। মুক্তিবাহিনী প্রস্তুতই ছিল। তারা আঘাতের পর আঘাত হানতে লাগল। মেজর শােয়েবসহ কয়েকজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যরা আহতাবস্থায়। আশেপাশের গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে, কিন্তু গ্রামবাসী এড়িয়ে একজন পাকিস্তানি সেনাও বাঁচতে পারেনি। পাকিস্তানি সেনারা মনােবল এমন ভাবে হারিয়ে ফেলেছিল যে তাদের কাছে আধুনিক মারণাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও তারা সামান্য অস্ত্রের অধিকারী গ্রামবাসীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এ সম্পর্কে এখানে একটি ঘটনা উল্লেখযােগ্য। ঘটনাটি ছিল : ঝিনাইদহের একটি গ্রামে একজন পাকিস্তানি সেনা গুলিভর্তি একটি এল, এম, জি, নিয়ে পালাচ্ছিল। সুলতান আলী জোয়ার্দার নামে একটি ১৭/১৮ বছরের ছেলে তার এক নলা শটগান নিয়ে তার পিছু ধাওয়া করে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে পাকিস্তানি সেনাটি তার। এল, এম, জি, থাকা সত্ত্বেও গুলি চালাতে সাহস পায়নি। এক সময় সুলতান আলীর গুলিতে পাকিস্তানি সেনাটির মৃত্যু হয়। সুলতান আলী পাকিস্তানি সেনাটির একটি আঙ্গুল কেটে নেয় এবং এল, এম, জিটি আঙ্গুলসহ চুয়াডাঙ্গা রণ-সদরে জমা দেয়।। ১লা এপ্রিল আহতাবস্থায় পাকিস্তানি অফিসার লেফটেনেন্ট আতাউল্লাহ শাহ ধরা পড়ে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের রণ-সদর চুয়াডাঙ্গা আনা। হলে মেজর ওসমান তার জবানবন্দি নেন। ১লা এপ্রিলই কুষ্টিয়া শত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের ৪জন শহীদ ও বেশ কিছু আহত হয়। প্রচুর গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উল্লেখযােগ্য উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্র হল :
১. ১০৬ মি. মি. রিকয়েললেস রাইফেল জিপারােহী। ৫টি
 ২. ৭.৬২ মি. মি. ভারী মেশিনগান (চায়নিজ) ৮টি ৩. ৭.৬২ মি. মি. হালকা মেশিন গান (চায়নিজ) ১৯টি ৪, ৭.৬২ মি. মি, সাবমেশিন গান (চায়নিজ)। ৩১টি ৭.৬২ মি. মি. স্বয়ংক্রিয় চায়নিজ রাইফেল জিপ গাড়ি ৭. ডজ গাড়ি (১টন) ৮. বড় মটরগাড়ি (৩টন) ৭টি ৯. বড় সিগন্যাল সেট ৪টি এবং সবরকমের প্রচুর পরিমাণ গােলা বারুদ। আশঙ্কা করা হচ্ছে যে কিছু অস্ত্র বিশেষ করে চায়নীজ সাবমেশিন গান খােয়া গেছে। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সাফল্যের সাথে কুষ্টিয়া জয় করে মেজর ওসমান চৌধুরীর নির্দেশে সুবেদার মােজাফফরের এক প্লাটুন সৈন্য কুষ্টিয়া রেখে অবশিষ্টদের নিয়ে ঝিনাইদহে চলে যান। যশাের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি আক্রমণ করা এবং যশাের থেকে তাদের ঢাকায় পশ্চাদপসরণের সম্ভাবনাকে রােধ করার জন্য এই বাহিনীর ৮৯টি কিছু সৈন্য মাগুরা, কিছু ঝিনাইদহের দক্ষিণে বিশাখালী ও কিছু সংখ্যক কোর্ট চাঁদপুরের প্রতিরক্ষায় পাঠানাে হয়
কুষ্টিয়ার মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের উপর ৩১শে মার্চ ময়মনসিংহে পাকিস্তানি বেতার সেট মনিটরিং করে শােনা গেল ১৪তম ডিভিশন সদরের কর্নেল স্টাফ, কর্নেল সাদুল্লাহ যশাের ব্রিগেড মেজরকে বলছেন : “You have been routed by rag-tags. You people have no shame. How could you be routed by unarmed people? You need kick. However, tell your commander if they need any help, we will send air sorties. We are, in any way, sending two air sorties to Kushtia Circuit house. We have been able to tackle Dacca (now it is written as DHAKA) which did not bother us much./ We are really concerned about Kushtia now.” তােমাদিগকে অতি নিম্ন শ্রেণীর সৈনিকরা ছিন্নভিন্ন করেছে। তােমাদের লজ্জা নেই। নিরস্ত্র জনগণ কিভাবে তােমাদের ছিন্নভিন্ন করলাে? তােমাদের পদাঘাত করার প্রয়ােজন। সে যাক, তােমার অধিনায়ককে বলাে সাহায্যের প্রয়ােজন হলে আমরা বিমান হামলা পাঠাব। অবশ্য এমনিতেই আমরা কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে দুইটা বিমান হামলা পাঠাচ্ছি। ঢাকাকে আমরা সামলে নিয়েছি, কোনাে বেগ পেতে হয়নি। আমরা এখন কুষ্টিয়ার জন্য সত্যিই চিন্তিত। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলার উপর ক্র্যাক ডাউনের এক সপ্তাহের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কুষ্টিয়া বিজয় ছিল সামরিক দিক থেকে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি অতি শক্তিশালী ব্যাটালিয়ন যুদ্ধের অনুপযােগী হয়ে পড়ে, যার ফলে ব্যাটালিয়নকে পূণর্বিনাস করার জন্য এর অবশিষ্টাংশকে পশ্চিমে নিয়ে যেতে হয়।
অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মনােবল আকাশচুম্বী রূপ গ্রহণ করে। কিন্তু কুষ্টিয়া বিজয়কে কোনও কোনও লেখক ছােট করে দেখানাের প্রয়াস পান। শুধু তাই নয়। ছােট করে দেখাতে গিয়ে অনেক ভুল তথ্যও পরিবেশন। করেন। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, ভারতীয় সামরিক ঐতিহাসিক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ডি,কে, পালিত তার গ্রন্থ The Lightning Campaign এর এক স্থানে force, Guerillas succeeded in Kushtia in which they occupied a section of the city during the early part of April 71.” (এপ্রিল ৭১ এর প্রথম ভাগে গেরিলারা কার্যকরীভাবে কুষ্টিয়া শহরের একাংশ অধিকার। করেছে।) কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ তথ্য সত্য নয়। বস্তুত : মুক্তিযােদ্ধারা ৩১শে মার্চের মধ্যেই কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত করে। এ সম্পর্কে ভারতীয় দৈনিক পত্রিকার রিপাের্ট মােটামুটি গ্রহণযােগ্য। পত্রিকাতে বলা হয়
————–
 
: * সাক্ষাৎকার : মেজর জেনারেল কে, এম, সফিউদ্বাহু প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনী।
Kushtia is one of the few districts completely liberated from the Pakistan Army. The Kushtia town was taken by the Mukti Bahini after a three pronged assault on the Army on March 29″ গুটিকয়েক জেলার মধ্যে কুষ্টিয়া অন্যতম যেটাকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর কাছ থেকে মুক্ত করা হয়েছে, মার্চের ২৯ তারিখ, (প্রকৃত পক্ষে তারিখটা ছিল মার্চের ৩০ তারিখ) মুক্তি বাহিনী তিন দিক থেকে যুগপৎ আক্রমণ করে কুষ্টিয়া শহরকে অধিকার করেছে।  কুষ্টিয়ার যুদ্ধে হস্তগত যুদ্ধোপকরণ ও যুদ্ধবন্দি এবং ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার উপর পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর বােমাবর্ষণ, স্থল বনাম বিমান যুদ্ধ ইত্যাদির উপর ফরাসি টেলিভিশন কর্পোরেশনের একটি ভ্রাম্যমান দল যে সচিত্র প্রতিবেদন তৈরি করে, তা সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। ফরাসি টেলিভিশন ৫২টি দেশে এই মুভি ফিল্ম বিক্রয় করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃতাবস্থা পৃথিবীর মুক্তিকামী মানুষের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত করে বাংলাদেশের প্রতি বিশ্বের সাহায্য ও সহানুভূতি অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল। এই ফিল্মেই প্রকাশ পেয়েছিল পাকিস্তানিদের দ্বারা বাংলাদেশে গণহত্যার ভয়াবহতা ও নাপাম বােমা ব্যবহারের সচিত্র প্রতিবেদন। বাংলাদেশের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীর ভাষায় : ২৪শে এপ্রিল ৭১-এ বি. বি. সি -তে এই জীবন্ত রিল দেখেই আমরা বাংলাদেশের প্রকৃতাবস্থা জানতে পারি এবং আমাদের পরবর্তী সক্রিয় কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে সমর্থ হই। বলেছিলেন লেখকের সাথে এক অনির্ধারিত সাক্ষাতের সময়।
চুয়াডাঙ্গার টেলিফোন বিভাগ এক দুঃসাধ্য কাজ করেছিল। পূর্বেই বলা হয়েছে যে তারা পােড়াদহের উন্মুক্ত স্থানে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ স্থাপন করে কুষ্টিয়া-যুদ্ধ পরিচালনায় অপূর্ব সহায়তা করেছিল। তৎপূর্বে ২৭শে মার্চ থেকেই চুয়াডাঙ্গার সঙ্গে। ভারতের কলকাতা হয়ে বহির্বিশ্বের সঙ্গে টেলিসংযােগ স্থাপন করে সংবাদপত্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতৃবর্গের কাছে বাংলাদেশের দুঃসংবাদ পৌছানাে সম্ভবপর করে। তােলে। এই টেলিফোন এক্সচেঞ্জটির নামকরণ করা হয় জয়বাংলা এক্সচেঞ্জ। ৩রা এপ্রিল ১৯৭১ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাতে পরবর্তীকালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বাংলাদেশ রেডক্রস সােসাইটির (বর্তমানে রেড ক্রিসেন্ট সােসাইটি) জন্ম হয়। সােসাইটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন এস, পি, এ, ডা, আসহাবুল হক জোয়ার্দার। ড. আসহাব একই সাথে দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গনের একচ্ছত্র অধিনায়ক। মেজর ওসমানের প্রধান রাজনৈতিক উপদেষ্টাও ছিলেন। এপ্রিলের গােড়া থেকেই কিছু কিছু ভারতীয় সাহায্য আসতে থাকে। ভারত সরকারের অনুমতি ছাড়াই ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী কিছু কিছু রাইফেল, এল, এম, জি, স্টেন গান ও গােলাবারুদ দিতে থাকে। বেসামরিক পর্যায়ে ও ভারত সরকারের
————-
The Ilindustan Standard, Calcutta April 4, 1971.
অনুমতি ছাড়াই যুদ্ধ সরঞ্জাম, ঔষধপত্র, পেট্রোল, সিগারেট ইত্যাদি আসতে থাকে। ভারতের শ্রী এম, কে, ভিমানী এবং বিহারের মুখ্যমন্ত্রী এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহেই মেজর ওসমানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরবর্তীকালে মি. ভিমানী মুক্তিবাহিনীকে প্রচুর পরিমাণ ঔষধপত্র সহ সামরিক ও বেসামরিক উপকরণ প্রদান করেন। ৫ই এপ্রিল সকাল ১০টায় জনাব তাজউদ্দিন আহমদ এবং ভারতীয় উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক অফিসারগণ মেজর এস, এ, ওসমান চৌধুরীকে জীবননগর সীমান্তে ডেকে পাঠান। মেজর ওসমান ঐ দিন সীমান্তে পৌছুলে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, ৭৬তম বি, এস, এফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচ, আর, চক্রবর্তী ও অন্যান্য অফিসারগণ তাকে স্বাগত জানান। উভয় পক্ষ যশাের সেনানিবাস আক্রমণে কি কি অস্ত্রের প্রয়ােজন তা এবং যুদ্ধের অন্যান্য দিক নিয়ে আলােচনা করেন। অস্ত্র প্রদানের ব্যাপারে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ ও লে. কর্নেল চক্রবর্তী কর্তৃক প্রদত্ত আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়েই মেজর ওসমানের মনে এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে অচিরেই তিনি ভারত থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র পাচ্ছেন এবং তাহলে তা দিয়ে যশাের সেনানিবাস শত্রুমুক্ত করা তার পক্ষে সহজ হবে। যশাের সেনানিবাস মুক্ত করতে পারলে সমগ্র বাংলাদেশ হানাদারমুক্ত করার পরে তার বাহিনী এক বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারবে। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে ৬ই এপ্রিল মেজর ওসমান দর্শনা -গেদে সীমান্তের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী স্খলিত স্থানে রেল লাইন বসিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোেগাযােগ স্থাপন করেন। ভারী অস্ত্রশস্ত্র বাংলার মাটিতে আনবার জন্য কয়েকটি শূন্য রেলওয়ে বগীও ভারতীয় ভূখণ্ডে স্ট্যান্ড বাই করে রাখেন। কিন্তু তার সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। রাষ্ট্রীয় এবং আন্তর্জাতিক কতকগুলাে বাস্তব অসুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে মেজর ওসমানকে তাৎক্ষণিক সাহায্য লাভে বঞ্চিত হতে হয়েছিল যার ফলে পরবর্তীকালে পাকিস্তানিরা যশাের গ্যারিসনে অস্ত্র-সৈন্য সম্ভারে বলিয়ান করার সুযােগ পেয়েছিল এবং তারই পরিণতিতে যশােরের পতন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের অন্যান্য সংঘর্ষ বিশাখালী সংঘর্ষ (৫ই এপ্রিল) ৫ই এপ্রিল ভাের বেলা পাকিস্তানি বাহিনী যশাের সেনানিবাস থেকে বের হয়ে বিশাখালীতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা পূর্ব থেকেই যে কোনাে অবস্থার জন্য ছিল সদা-সতর্ক। পাল্টা আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়।
পালাবার পথে বহু পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নিহত হয়। কিছু আহত পাকিস্তানি সেনা কোনাে প্রকারে প্রাণ নিয়ে যশাের সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। অপর পক্ষে মুক্তিবাহিনীরও কয়েকজন আহত হয়। ২৬শে মার্চের পর থেকে এই অঞ্চলে এটাই প্রথম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বড় রকম আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিজয়। এই বিজয়ে জনগণের সাহস, বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বী রূপ গ্রহণ করে। কিছু সংখ্যক চায়নিজ এস, এম, জি ও রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। | বিশাখালী সংঘর্ষের পর থেকেই ক্ষিপ্রগতিতে আকাশ ও জলপথে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্যাপকভাবে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র যশাের সেনানিবাসে আনতে শুরু করে। কিন্তু সে সময় আকাশ ও জলপথে পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেবার মতাে প্রয়ােজনীয় অস্ত্র, বিমান বা জলযান কোনােটাই মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল না। শুধু অসহায়ের মতােই মেজর ওসমান দৈনন্দিন পরিস্থিতি ভারতের মনােনীত সমম্বয় অফিসারের (Coordination Officer) কাছে টেলিফোনে জানিয়ে তার প্রয়ােজনীয় ভারী অস্ত্রের জন্য তাগিদ দিতে থাকেন। মেজর ওসমান তখনাে বুঝতে পারেননি যে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি পূরণের (Reinforcement) পূর্বে যশাের সেনানিবাস আক্রমণ করার মতাে অঙ্গীকারকৃত ভারী অস্ত্রশস্ত্র তাৎক্ষণিকভাবে প্রাপ্তির প্রত্যাশা তার পূরণ হবে না। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্য পরিচালনা করার মতাে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক সামরিক অফিসার দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে ছিল না।
ওদিকে তৎকালীন মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী (বর্তমানে জ্বালানী ও খনিজ মন্ত্রনালয়ের সচিব), ঝিনাইদহ মহকুমা পুলিশ অফিসার মাহবুব উদ্দিন এবং ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক সফিক উল্লাহ মেজর ওসমানের নির্দেশে যুদ্ধের ময়দানে অফিসার হিসেবে কাজ করছিলেন। সামরিক অফিসারের বিশেষ প্রয়ােজন উপলব্ধি করে মেজর ওসমান ৭ই এপ্রিল এক সেক্টর-অর্ডার এর মাধ্যমে এই অফিসারদের সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাংকে ফিল্ড কমিশন দিয়ে ব্যাংক পরিয়ে দেন। তার সেক্টর অর্ডারটি ছিল নিম্নরূপ :
“On behalf of the Bangladesh High Command, I hereby award Commission to the following persons directly in the rank of ‘Captain’ to meet operational requirements: a. Mr. Towfique-E-Elahi Chowdhury (SDO Meherpur) b. Mr. Mahbub uddin Ahmed (SDPO Jhenaidah) c. Mr. Md. Shafique Ullah (Professor, Jhenaidah Cadet
College) Sd/ MAJOR M.A. OSMAN CHOWDHURY (আমি বাংলাদেশ হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে যুদ্ধক্ষেত্রের প্রয়ােজনে নিম্ন বর্ণিত। ব্যক্তিদেরকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাংকে কমিশন প্রদান করছি : ক. মি. তওফিক-ই-এলাহী চৌধুরী, এস, ডি, ও মেহেরপুর ব, মি, মাহবুর উদ্দিন আহমেদ, এস, ডি, পিও, ঝিনাইদহ গ. মাে, সফিক উল্লাহ, অধ্যাপক, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ। স্বাক্ষর মেজর এম, এ, ওসমান চৌধুরী
লেবুতলা সংঘর্ষ (৭ই এপ্রিল)
কুষ্টিয়া বিজয়ের পর মেজর ওসমানের টার্গেট ছিল যশােরের সেনানিবাস আক্রমণ। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে তিনি ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী ও তার বাহিনীকে ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিলেন। একথা পূর্বেই বলা হয়েছে। পুরাে বাহিনীকে পুনর্বিন্যাস করতে গিয়ে তিনি সুবেদার জিয়াউল হক ও সুবেদার মজিদ মােল্লার সৈন্যদলকে যশাের সদরের ৮ মাইল উত্তর-পূর্ব কোণে লেবুতলা নামক গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করবার আদেশ দেন। সামরিক দিক থেকে লেবুতলা গ্রাম ছিল বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ঢাকা থেকে স্থল পথে সৈন্য সরবরাহ অথবা যশাের থেকে ঢাকার পথে পশ্চাদপসরণের রাস্তা এই গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে মাগুরার দিকে। প্রতিদিন পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু অংশ এই গ্রামের অসহায় লােকদের হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযােগ ও লুটপাট করে আবার যশাের ফিরে যেতাে। পুনর্বিন্যাসের নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন সফিক উল্লাহর নের্তৃত্বে সুবেদার জিয়াউল হক ও সুবেদার মজিদ মােল্লার বাহিনী ৬/৭ এপ্রিলের রাতে এই গ্রামে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। ৭ই এপ্রিল সকাল ১০টার দিকেই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল যশাের সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে ঠিক ঐ পথেই লেবুতলা হয়ে পূর্ব দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিল। পাকিস্তানি সেনারা লেবুতলাতে ই.পি, আরদের মারণসীমার (Killing range) মধ্যে আসার সাথে সাথেই এক সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের সবক’টি গান গর্জে ওঠে। পাকিস্তানি সেনারা ভাবতেই পারেনি যে মুক্তিযােদ্ধারা যশাের সেনানিবাসের এত কাছাকাছি থাকতে পারে। প্রাথমিক পায়েই পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫/৩০ জন লুটিয়ে পড়ে। প্রায় দুই ঘণ্টাকাল এই সংঘর্ষ স্থায়ী হয় ! পাকিস্তানি বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। লেবুতলা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, পাকিস্তানি সেনাদের লাশের সংখ্যা পঞ্চাশের উর্ধে ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে মাত্র কয়েকজন সামান্য আহত হয়। তাদের এই বিজয়ে গ্রামবাসীরা বহুদিন নিরাপদে থাকে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম ব্যাটালিয়ন, সিনিয়র টাইগার্স, তাদের অধিনায়ক লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের আদেশক্রমে চৌগাছা থেকে যশাের সেনানিবাসে ফিরে গিয়ে তাদের সব অস্ত্র জমা দিয়ে দেয়। ৩০শে মার্চ সকাল ৯ ঘটিকায় পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে সিনির টাইগারদের উপর চতুর্দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে ব্যাটালিয়নের তিন-চতুর্থাংশের মতাে বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করে। কেবল মাত্র লেফটেনেন্ট হাফিজ ও আরাে কিছু সৈন্য অর্ধনগ্ন অবস্থায় শূন্য হাতে পালিয়ে কোনাে প্রকারে আবার চৌগাছাতেই একত্রিত হয়। মেজর ওসমানের নির্দেশে ক্যাপ্টেন মাহবুব লে, হাফিজ ও তাদের কয়েকজনকে তার কাছে নিয়ে আসেন। মেজর ওসমান ই.পি, আরদের হাতিয়ার ও পােষাক দিয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই গ্রুপটিকে (প্রায় ১৪৮ জন) এক কোম্পানিরূপে বিন্যাস করে ক্যাপ্টেন হাফিজের নের্তৃত্বে চৌগাছা এলাকায় মােতায়েন করেন। উল্লেখ্য যে লে. হাফিজকে মেজর ওসমান সেখানেই ক্যাপ্টেন ব্যাংক পরিয়ে দেন।
গােয়ালন্দ সংঘর্ষ (১৩ই এপ্রিল)
চুয়াডাঙ্গা রণ-সদরে ১২ই এপ্রিল খবর আসে যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক বিরাট দল আরিচা থেকে জলপথে গােয়ালন্দের দিকে এগিয়ে আসছে। কালবিলম্ব না করে মেজর ওসমান তখনই নায়েব সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে এক প্লাটুন ই.পি. আর সৈন্য গােয়ল পাঠালেন। এই দলের সাথে ১টি ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী ছােট কামান (রকেট লাঞ্চার), ১টি মেশিনগান ও ২টি হালকা মেশিনগান দিয়ে মেজর ওসমান নির্দেশ দিলেন, কোনাে অবস্থাতেই যেন পাকিস্তানি বাহিনী গােয়ালন্দে অবতরণ করতে সক্ষম
হয়। নায়েব সুবেদার শামসুল হক ঐ দিনই বিকেলের মধ্যে গােয়ালন্দ পৌছে যান। এবং তার সম্ভাব্য সব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। ১৩ই এপ্রিল সত্যিই দেখা গেল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বড় দল বেশ কয়েকটি লঞ্চ ও ফেরি নিয়ে গােয়ালন্দ অভিমুখে আসছে। দ্রুতগতিতে নায়েব সুবেদার শামসুল হক তার বাহিনীকে প্রস্তুত করলেন। মারণ-সীমার মধ্যে আসার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধাদের গানগুলাে সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং তুমুল সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। রকেট লাঞ্চারের গােলার আঘাতে একটি লঞ্চ ধ্বংস হয় ও ডুবে যায়। বহু পাকিস্তানি সেনার পদ্মার গােলা জলে সলিল সমাধি ঘটে। সংঘর্ষ শুধু ১৫ মিনিট কাল স্থায়ী হয়। পাকিস্তানি বাহিনী বহু ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর অপর একটি দল ঐদিনই নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণ করার চেষ্টা। করে। এ বর পাওয়া মাত্র মেজর ওসমান টেলিফোনে রাজশাহীর মেজর নাজমুল হককে অনুরােধ করেছিলেন যে করেই হােক পাকিস্তানি বাহিনীকে নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণ করতে বাধা দিতে।
মেজর ওসমান বুঝতে পেরেছিলেন, পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণ করলে অচিরেই তার বাম পার্শ্ব (left flank) ভেড়ামারা কুষ্টিয়া পাকিস্তানি সেনাদের সহজ-আক্রমণ যােগ্য (Vulnerable) হয়ে পড়বে এবং তাহলে যে উদ্দেশে। যশােরের সম্মুখীন হবার পূর্বে মেজর ওসমান কুষ্টিয়া জয় করে নিয়েছেন, সে উদ্দেশ্যই ব্যহত হবে। কিন্তু মেজর নাজমুল যদিও এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তারা নগরবাড়ি পেীছার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি ঘাটে অবতরণ করতে সমর্থ হয়। নগরবাড়িতে অবস্থানরত এক কোম্পানি মুজাহিদ পাকিস্তানি বাহিনীর শেলিং-এর দাপট সহ্য করতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।  ১৪ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাট পাকিস্তানি বাহিনীর দখল চলে যায়। ঐ দিনই পাকিস্তানি সেনারা তীব্র গতিতে পাবনা ও রাজশাহী অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকে। শুধু কুষ্টিয়াই নয়, পাকিস্তানি বাহিনীর নগরবাড়ি ঘাটে অবতরনের ফলে মেজর নাজমুলের রাজশাহী বিজয়ের স্বপ্নও ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়।
দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বিপর্যয়
ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়ায় স্থানীয় শাসন শৃঙ্খলা রক্ষার্থে মেজর ওসমান শুধু এক প্লাটুন সৈন্য রেখে বাকীদের যশাের সেনানিবাসে অবরােধের জন্য প্রত্যাহার করেছিলেন। ১৪ই এপ্রিল সুবেদার মুজাফফর আহমেদ এক প্লাটুন সৈন্য নিয়েই ভেড়ামারায় পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেন। কিন্তু এই স্বল্প সৈন্য নিয়ে কোনাে প্রকার ভারী অস্ত্রের অভাবে তিনি টিকে থাকতে ব্যর্থ হন। ঐ দিনই ভেড়ামারা পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে চলে যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের যশাের অবরােধ ও আক্রমণের সাফল্যের জন্য ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়ায় মুক্তি বাহিনীর নিঝঞ্জাট দখল ছিল পূর্বশর্ত। কারণ সে সময় দুই ফ্রন্টে যুদ্ধ চালাবার মতাে প্রয়ােজনীয় সৈন্যবল ও অস্ত্রবল দক্ষিণ-পশ্চিম-রণাঙ্গনের ছিল । তাই বিপর্যয় শুরু হয় ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়ার পতনের মধ্যে দিয়ে। যুদ্ধের কৌশলগত সমম্বয় রেখেই পাকিস্তানি বাহিনী যশাের সেনানিবাস থেকেও বের হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই দুই দিকের অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে পিষ্ট (Sandwitched) হয়ে পড়ার আশঙ্কায় মেজর ওসমানকে যশােরের অর্ধবৃত্তাকার ঘেরাও উঠিয়ে নিয়ে তার প্রতিরক্ষা-ফ্রন্ট সংকুচিত করতে হয় যার ফলে ১৫ই এপ্রিল বিকেলের মধ্যেই ঝিনাইদহের পতন ঘটে। একই তারিখ দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণের রণসদর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে মেহেরপুর স্থানান্তরিত করতে হয়। এখানে বলা প্রয়ােজন যে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষিপ্র আক্রমণে অবস্থার এত দ্রুত অবনতি হতে থাকে যে। গােয়ালন্দ ঘাটে অবস্থানরত শামসুল হকের প্লাটুন ও ভেড়ামারায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ রাখাও আর সম্ভব হয়নি। অবশ্য অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে তারা পরবর্তীকালে মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হতে সক্ষম হয়। ১৬ই এপ্রিল রাতে অতি প্রতিকূল অবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্য দিয়ে দক্ষিণপশ্চিম রণাঙ্গনের রণ-সদর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর পাড়ে ইছাখালী বি, ও, ও পি, তে স্থানান্তরিত করা হয়। এই বি, ও, পির দূরত্ব ছিল ভারতীয় বি, ও, পি, থেকে মাত্র ৬০০ গজ।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন ও প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান। ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করে চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী ঘােষণা করা হয়। আকাশবাণী থেকে এ খবর প্রচারের পর পরই পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর জঙ্গীবিমানগুলাে চুয়াডাঙ্গার উপর ব্যাপকভাবে হামলা চালাতে থাকে। | ১৭ই এপ্রিল ১৯৭১, বাঙালি জাতির জীবনে একটি ঐতিহাসিক দিন। সেদিন মেহেরপুরের অন্তর্গত বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ও প্রকাশ্যে শপথ গ্রহণ করেন। তখনই এই স্থানটির নতুন নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। বেলা ১১টা নাগাদ মন্ত্রীবর্গ উপস্থিত হলে ক্যাপ্টেন মাহবুব মুক্তিযােদ্ধাদের ছােট্ট একটি দল নিয়ে অভিবাদন দেন। ইতােমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক মেজর এম, এ, ওসমান চৌধুরীও এসে পড়েন এবং পরবর্তী পর্যায়ে শপথ গ্রহণের পর তিনি ই,পি, আর বাহিনীর তার এক প্লাটুন সৈন্যসহ এক প্লাটুন সৈন্যকে সংগঠিত করে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড-অব-অনার প্রদান করেন। এই গার্ড -অব-অনার প্যারেডে অংশগ্রহণ করেন নায়েব সুবেদার তােফাজ্জল হােসনেসহ ই.পি, আর বাহিনীর ৩৪ জন সদস্য। ১৭ই এপ্রিল বিপুল জনসমাবেশে দেশী ও বিদেশী শতাধিক সাংবাদিকের উপস্থিতিতে প্রকাশ্যে নবজাত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি, উপ-রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদের নাম ঘােষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন) হিসেবে ঘােষণা করা হয় । নবগঠিত মন্ত্রী পরিষদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয় নিম্নরূপ ভাবে : ১, তাজউদ্দিন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী। ২. খােন্দকার মােশতাক আহমদ, আইন, সংসদীয় ও পররাষ্ট্র দপ্তর।
৩. এ,এইচ, এম, কামারুজ্জামান, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পূনর্বাসন দপ্তর। ৪. মনসুর আলী, অর্থ দপ্তর। অবসর প্রাপ্ত কর্নেল এম,এ,জি, ওসমানীকে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি রূপে নিয়ােগ ঘােষণা করা হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে এই অনুষ্ঠানে সারা। বাংলাদেশের নারী জাতির প্রতিনিধিত্ব করেন দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সর্বাধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর স্ত্রী বেগম নাজিয়া ওসমান ও তার দুই শিশুকন্যা চম্পা ও কলি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। এই ঐতিহাসিক ঘােষণাপত্রটি হুবহু তুলে ধরা হল। “যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল : “যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ উক্ত অঞ্চলের জন্য নির্ধারিত ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করেছিলেন। যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহবান করেন; যেহেতু আহুত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করেন। যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সাথে পারস্পরিক আলােচনাকালে ন্যায়-নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকমূলক যুদ্ধ ঘােষণা করেন; যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি আহবান জানান; যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর ও নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করেছে এবং এখনাে বাংলাদেশের বেসামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাচ্ছে; যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা এবং নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের একত্রিত হয়ে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করে তুলেছে; যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের বীরত্ব সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তার কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে।
সেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সেই ম্যান্ডেট মােতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পারস্পরিক আলাপ আলােচনার মাধ্যমে আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে বাংলাদেশের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করার উদ্দেশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ গঠনের কথা ঘােষণা করছি এবং এই ঘােষণা দ্বারা আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্বে যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, সেই পবিত্র ঘােষণাটিকে অনুমোদন করছি ও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন এবং জনাব সৈয়দ নল ইসলাম এই প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কাজ করবেন রাষ্ট্রপ্রধানই কার ওশাসনিক ও আইন প্রণয়ণের ক্ষমতার অধিকারী হবেন, তিনি একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়ােজনবােধে মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের নিয়ােগ করতে পরবেন; তাঁর কর ধার্য ও অর্থ ব্যয় এবং গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও মুলতবী। ঘোষণার ক্ষমতা থাকবে। তিনি বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়ােজনীয় সকল ক্ষমতারও অধিকারী হবেন। বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, কোনাে কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যােগদান করতে না পারেন অথবা তাঁর কর্তব্য ও প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব পালনে যদি তিনি অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধানকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ রাষ্ট্রপ্রধান পালন করবেন। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মােতাবেক আমাদের উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে তা যথাযথভাবে আমরা পালন করবাে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ থেকে কার্যকরী বলে গণ্য হবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘােষণা করছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে ও নিয়মানুগ উপায়ে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করে তাকে এই কাজের জন্য নিযুক্ত করলাম।”
(এম, ইউসুফ আলী) বাংলাদেশ গণ পরিষদের পক্ষ থেকে ওদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্রমাগত স্থল ও বিমান আক্রমণের মুখে মুক্তিবাহিনী ক্রমশ পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। ভেড়ামারা ও কুষ্টিয়া পতনের পর কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ ও দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের সাবেক রণ-সদর চুয়াডাঙ্গা ও পাকিস্তানি বাহিনীর কবলে চলে যায়। অবশেষে ইছাখালী বি,ও,পি, ও তৎসংলগ্ন এলাকা প্রতিরক্ষায় ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে এক কোম্পানির কিছু বেশি ই.পি, আর সৈন্য রেখে অবশিষ্টদের নিয়ে ১৮ই এপ্রিল মেজর ওসমান তার রণ-সদর মেহেরপুর থেকে যশাের। জেলার বেনাপােল নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন। বস্তুত ১৮ই এপ্রিলের পর কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গার পতন ঘটে। বেনাপােলে মূলৰ্ঘাটি স্থাপন করে মেজর ওসমান দ্রুতগতিতে তার বাহিনী পূনর্বিন্যাস করে কাগজপুকুর নামক স্থানে ২ কোম্পানি ই,পি, আর দিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা। করেন। ক্যাপ্টেন হাফিজের ইস্টবেঙ্গল কোম্পানিকে বেনাপােলে রিজার্ভ রাখা হয়।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!