ক্যাপ্টেন গিয়াসের বগুড়া আক্রমণ
(Video link)
২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন সকাল ১০টায় তার বাহিনী নিয়ে বগুড়ার পথে যাত্রা করে সন্ধ্যার দিকে বগুড়া পৌছে যান। প্রথমেই তিনি বগুড়া পুলিশ লাইনের পুলিশের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। সেখানে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ২০০ এর মতাে পুলিশ ছিল। পুলিশ ইন্সপেক্টর বগুড়ায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে ক্যাপ্টেন গিয়াসকে অবহিত করেন এবং পুলিশ ফোর্স সহকারে তাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। ওনিকে বগুড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি ব্যাটারিতে ৬০ জনের মতাে এবং মুনিশন ডাম্প রক্ষা করার জন্য একজন ক্যাপ্টেনের নের্তৃত্বে ২৫ জনের মতাে সৈন্য অবস্থান করছিল। ইতােপূর্বে ২৬শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা জনতার বিরুদ্ধে গুলি চালালে বগুড়া শহর জনশূন্য হয়ে যায়। রাস্তায় প্রতিবন্ধকতার জন্য রংপুর থেকেও তারা কোনাে প্রকার সাহায্য পাচ্ছিল না। বাধ্য হয়ে বগুড়ায় পাকিস্তানি বাহিনী মাঝে মাঝে গ্রামে হানা দিয়ে জোর করে শাক-সবজি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল আদায় করে বগুড়া শহরে নিয়ে আসতাে। তাই ক্যাপ্টেন গিয়াস সিদ্ধান্ত নিলেন যে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রাম থেকে ফিরবার পথে তাদেরকে এ্যামবুশ করবেন। সিদ্ধান্তানুযায়ী তিনি ২৯/৩০ মার্চ রাতে তার বাহিনী নিয়ে এ্যামবুশ পেতে বসে রইলেন। ঐ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী গ্রাম থেকে ফেরার পথে ই,পি, আর বাহিনীর এ্যামবুশে পড়ে যায়। অকস্মাৎ আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এই আক্রমণে ২৩ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় ও ৩টি গাড়ি ধ্বংস হয়। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা বিচ্ছিন্নভাবে রংপুর। অভিমূখে পালিয়ে যায়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ ই.পি. আর বাহিনীর হস্তগত হয়। এর পর ক্যাপ্টেন গিয়াস নওগাঁয় ফিরে যান।
মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রাভিযান
ক্যাপ্টেন গিয়াসের অনুপস্থিতিতে ১লা এপ্রিল নায়েব সুবেদার আলী আকবরের নের্তৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা বগুড়ার আড়িয়াল বাজারে অবস্থিত ‘এ্যামুনিশন ডাম্প’ আক্রমণ করে। এই সংঘর্ষ প্রায় আড়াই ঘণ্টা স্থায়ী হয়। সংঘর্ষ চলা অবস্থায় পাকিস্তানি জঙ্গী বিমান মুক্তিযােদ্ধাদের উপর কয়েকবার হামলা চালালেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাদের অধিনায়ক একজন ক্যাপ্টেন ও ২৩ জন সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের বন্দি করে। বগুড়া শত্রুমুক্ত হয়। ১১ই এপ্রিল বগুড়ার মুক্তিবাহিনীর একটি দলকে নগরবাড়ি ঘাট রক্ষার্থে এবং পাকিস্তানিদের ঢাকা থেকে আগমনকে ব্যর্থ করতে ঘাটে নিয়ােগ করা হয়। অন্যদিকে নওগাঁ থেকে নায়েব সুবেদার সিরাজউদ্দিন লস্করের নের্তৃত্বে ই.পি. আর বাহিনীর একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন রশিদের সঙ্গে যােগাযােগ করে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ক্যাপ্টেন গিয়াস ও তার বাহিনী নিয়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জের গােদাগাড়িতে অবস্থিত বাঙালি ই,পি, আর বাহিনীর সাথে যােগাযােগ করে ৩১শে মার্চ মিলিতভাবে রাজশাহীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
ইতােপূর্বে ৬নং উইং-এর সুবেদার কাশেমের নির্দেশে ২৮শে মার্চ তারিখেই নায়েক এরশাদ আলী ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ এক প্লাটুন সশস্ত্র ই, পি, আর সৈনিক নিয়ে রাজশাহীর পথে রওয়ানা হন। ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিনের অধিনায়কত্বে চাঁপাই নবাবগঞ্জ থেকে আগত ই.পি. আর, পুলিশ, ছাত্র, আনসার, মুজাহিদ সবাই মিলে প্রায় ১০০০ সৈন্য এবং নওগাঁ থেকে সারদা হয়ে প্রায় ১০০০ সৈন্য ২রা এপ্রিলের মধ্যে রাজশাহী শহর উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়। ক্যাপ্টেন গিয়াস তার পরিকল্পনানুযায়ী ক্যাপ্টেন রশিদের বাহিনীকে শহরের পূর্ব দিকে, কিছু সৈন্য একজন সুবেদারের নের্তৃত্বে উত্তর-পশ্চিমে স্থাপন করে নিজ বাহিনীকে দক্ষিণ দিকে মােতায়েন করলেন। সিদ্ধান্ত হলাে তিন দিক থেকেই আক্রমণ হবে। এমতাবস্থায় রাজশাহীর পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান নাজুক হয়ে পড়ে এবং তারা বারবার ঢাকার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে থাকে। ২রা এপ্রিল থেকে ৫ই এপ্রিল পর্যন্ত দিনে কয়েকবার করে পাকিস্তানি জঙ্গী বিমানগুলাে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন অবস্থানের। উপর ব্যাপক গােলাবর্ষণ করেও তাদের তেমন ক্ষতি করতে পারেনি। ৬ই এপ্রিল সন্ধ্যায় মুক্তিযােদ্ধারা তিন দিক থেকে প্রবল বেগে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে হাজার হাজার জনতার প্রবল চাপে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। চার ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে শহর ছেড়ে সামরিক ছাউনিতে একত্রিত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা রাজশাহী শহর দখল করে চারদিকে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর ৩৫ জন হতাহত হয়। প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র শস্ত্র তাদের হস্তগত হয়। তারা কেবল মাত্র পুলিশ লাইনেই তিন হাজার রাইফেল উদ্ধার করে। মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্যে রাজশাহী শহরের জনতা বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধাদের মনে অদম্য সাহস ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
মুক্তিযােদ্ধাদের বিপর্যয় ও রাজশাহীর পতন
মুক্তিযােদ্ধারা তাদের এই বিজয়কে বেশিদিন ধরে রাখতে পারেনি। যদিও ১০ এপ্রিলের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ছিল পাকিস্তানিদের মূল ঘাটির ৪০০ গজের মধ্যে, তবুও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের ব্যাপক প্রতিরােধ ভেদ করে কোনােরকমেই অগ্রসর হতে পারছিল না। তদুপরি পাকিস্তানিরা তাদের ছাউনির চারপাশে কাঁটা তারের বেড়ার সাথে মাইন পুঁতে ও তাদের হালকা ও ভারী সব স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ছাউনির চার দিকে বসিয়ে ছিল সদা প্রস্তুত। এই পর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা বেসামরিক সব অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষাকে আরাে জোরদার করে ফেলে। ওদিকে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য ঢাকা থেকে প্রায় এক ব্রিগেড সৈন্য স্থলপথে নগরবাড়ি হয়ে রাজশাহী এবং কুষ্টিয়া অভিমুখে অগ্রসর হবার জোর চেষ্টা চালায়। ১৩ই এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাটের মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বল প্রতিরােধ পাকিস্তানিদের আর্টিলারির তােপের মুখে উড়ে যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ই এপ্রিল সকাল ১১টার সময় নগরবাড়ি অবতরণ করে বিদ্যুৎ গতিতে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া অভিমুখে ধাবিত হয়। চুয়াডাঙ্গা থেকে মেজর ওসমান নগরবাড়ি অভিমুখে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রসর হবার সংবাদ পেয়ে টেলিফোনে মেজর নাজমুলকে নগরবাড়ি ঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর অবতরণকে নস্যাৎ করবার জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়ােজনীয় প্রতিরােধ গঠন করবার তাগিত জানান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মেজর নাজমুল প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেবার পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী নগরবাড়ি অবতরণ করে রাজশাহী ও কুষ্টিয়া অভিমুখে ধাবিত হয়।
পাকিস্তানি বাহিনীর এই সাফল্যজনক অবতরণ ও ‘মুভ’- এর ফলে কুষ্টিয়া ও রাজশাহীতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ নাজুক হয়ে পড়ে। উভয় স্থানে যুদ্ধের মােড় পাকিস্তানিদের অনুকূলে চলে যায়। মেজর নাজমুল ১২ই এপ্রিল রাজশাহী থেকে ২ কোম্পানি সৈন্য নগরবাড়ি অভিমুখে প্রেরণ করে। ১৩ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস নিজেও একটি কোম্পানি নিয়ে পাবনার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। কিন্তু ১০ মাইল অতিক্রম করার পরই ক্যাপ্টেন গিয়াসের বাহিনী পাকিস্তানি সেনার মুখােমুখি হয়। পাকিস্তানি সেনারা রাস্তায় দু’ধারের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠন করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা রাজশাহী ও সারদা রােডের মােড়ে প্রতিরক্ষা রচনা করেন। ঐ দিন সন্ধ্যায় পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের গােলার আওতায় এলেই আক্রমণ শুরু হয়। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ সরারাত ধরে অব্যাহত থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের কোম্পানি অধিনায়ক সারদা ক্যাডেট কলেজের অধ্যাপক এ, বি. সিদ্দিকসহ বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা এই সংঘর্ষে শাহাদাৎ বরণ করেন। পাকিস্তানি সেনারা ১৪ই এপ্রিল সকালে রাজশাহী শহরে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের উপর ক্রমাগত গােলা বর্ষণ ও বিমান হামলা অব্যাহত রাখে। এর ফলে রাজশাহীর উপকণ্ঠে সামরিক ছাউনির উপর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা চাপ। উত্তোলন করে নিতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায় ছাউনি থেকেও রাজশাহী শহরের উপর পাকিস্তানি সেনারা তাদের চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে যার ফলে রাজশাহীর মুক্তিযােদ্ধারা সম্মুখ ও পশ্চাত দিক থেকে আক্রমণের সম্মুখীন হয়। ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী গভীর রাতে চারদিক থেকে সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়।
এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা পরস্পর যােগাযােগ হারিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তানি গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধাদের মূল দলটি ১৫ই এপ্রিল চাঁপাই নবাবগঞ্জের দিকে সরে যেতে থাকে। ক্যাপ্টেন গিয়াস ১৫ই এপ্রিল মাত্র ৩০০ জন সৈন্য নিয়ে রাজশাহী থেকে ১৮ মাইল দূরে গােদাগাড়ি নামক স্থানে। প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। ঐ দিনই পাকিস্তানিদের হাতে রাজশাহী শহরের পতন ঘটে। এই সংঘর্ষে ৪০ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। ১৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী গােদাগাড়ি ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর ব্যাপক হামলা চালায়। ২১শে এপ্রিল পাকিস্তানি সেনারা গােদাগাড়ি ও অভয়াতে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রবেশ করে ও শহর দখল করে নেয়। ক্যাপ্টেন গিয়াস ও অন্যান্যরা তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে পদ্মার চরে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ২২শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন গিয়াস ও অন্যান্যরা তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সহকারে ভারতের লালগােলায় আশ্রয় নেয়। ক্যাপ্টেন রশিদও চারঘাট এলাকা থেকে তার বাহিনী নিয়ে পদ্মা পার হয়ে ভারত সীমান্তে আশ্রয় নেন।
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী