৬ নম্বর উইং, চাঁপাই নবাবগঞ্জ
নিজ শক্তির গঠন ও কার্যক্রম রাজশাহী সেক্টরের অধিন ৬নং উইং ই.পি.আর এর অবস্থান ছিল চাপাই নবাবগঞ্জে। উইং অধিনায়ক, সহকারী অধিনায়ক ও সুবেদার মেজর সবাই ছিল অবাঙালি। উইংএর চারটি কোম্পানির অবস্থান ছিল নিম্নরূপ :
১. উইং সদরে একটা সাপাের্ট প্লাটুন ও এক কোম্পানি সৈন্য ছিল। কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি নায়েব সুবেদার আলিমুল্লাহ। ২. একটি কোম্পানি ছিল মনকষাতে, অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি সুবেদার আবুল কাশেম। ৩.তৃতীয় কোম্পানি ছিল জলকরপুলডাঙ্গাতে, অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি সুবেদার ইউসুফ। ৪. চতুর্থ কোম্পানি ছিল গােদাগাড়িতে, অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি নায়েব সুবেদার নূরুজ্জামান। ২৫শে মার্চ বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পিলখানা ও রাজারবাগ পুলিশ সদর সহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ ও নৃশংসতার খবর অবগত হবার পর চাঁপাই নবাবগঞ্জের ৬নং উইং-এর ই. পি আর সৈনিকরাও অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যে কোনাে অবস্থার মােকাবেলার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখেন। কিন্তু নের্তৃত্বের অভাবে তারা কোনাে সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারেনি। ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার পর উইং সুবেদার মেজর (অবাঙালি) দাদু খান হঠাৎ করেই উইং সদরে এসে উপস্থিত সকল বাঙালি ই.পি. আর সৈনিকদের হাতিয়ার জমা দিতে আদেশ করেন। কিন্তু বাঙালিরা অস্ত্র জমা না দিয়ে প্রস্তুত হয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যা ৭টার পর সব অবাঙালি অফিসারগণ তাদের পরিবারবর্গ সহকারে অবাঙালি গার্ডসহ গাড়ি করে রাজশাহী রওয়ানা হবার প্রাক্কালে কোয়ার্টারগার্ডে প্রহরারত বাঙালি ই.পি. আরদের উপর গুলি ছুঁড়লে সব বাঙালি ই.পি, আররা পাল্টা আক্রমণ করে। অফিসাররা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় কিন্তু অন্যান্য অবাঙালি ই.পি. আর সদস্যরা পালাতে ব্যর্থ হয়। উভয় পক্ষে বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর অবাঙালি সৈনিকরা বিস্তর ক্ষতি স্বীকার করে বাঙালিদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। চাপাই নবাবগঞ্জের এই খণ্ডযুদ্ধে হাবিলদার সিদ্দিক, জমজম, সাজ্জাদ প্রমুখ নেতৃত্ব দান করেন। এ সংবাদ সারা শহরে ছড়িয়ে পড়লে শহরের অনান্য স্থানের ই.পি.আর.আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র-জনতা এগিয়ে এসে ই.পি.আর উইং-এ একত্রিত হয়।
বর্ডারের কোম্পানিগুলােকেও অবস্থা বর্ণনা করে খবর পাঠানাে হয়। মনকষার কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার কাশেম ছিলেন সবার সিনিয়র জেসিও। খবর পেয়ে তিনি উইং সদরে এসে নের্তৃত্ব হাতে নেন এবং ই.পি. আর, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্রজনতার সমন্বয়ে এক বিরাট বাহিনী গঠন করে চাঁপাই নবাবগঞ্জ রক্ষার জন্য বিভিন্ন – স্থানে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। চাপাই নবাবগঞ্জে বাঙালি ই.পি. আর বিদ্রোহের খবর পেয়ে রাজশাহীর সামরিক কর্তৃপক্ষ মেজর ভূইয়া নামে এক বাঙালি অফিসারকে ২৮শে মার্চ চাপাই নবাবগঞ্জ পাঠান। এদিকে সুবেদার কাশেমের বাহিনী রাজশাহী যাবার জন্য শুধু আদেশের অপেক্ষায় ছিল। ইতােমধ্যে মেজর ভূঁইয়া চাঁপাই নবাবগঞ্জ পৌছে বাহিনীকে মিথ্যা অজুহাত দিয়ে স্থগিত রাখতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ ঐ রাতেই মেজর ভূইয়ার বিশ্বাসঘাতকতামূলক দূরভিসন্ধির কথা টের পেয়ে ই.পি, আর বাহিনী তাকে বন্দি করে জেলখানায় পাঠায়। তার কাছ থেকে কিছু গােপন কাগজপত্র ও একটি ক্ষুদ্র বেতার যন্ত্র উদ্ধার করা হয়। ওদিকে ৩০শে মার্চ গােদাগাড়িতে অবস্থানরত ই.পি, আর বাহিনীর উপর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমান কয়েকবার হামলা করে। রাতে পাকিস্তানি সেনারাও ঐ অবস্থানের আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু ই.পি, আরকে হতাহত করে। ৭ নম্বর উইং, নওগাঁ নিজ শক্তি ও শুক্র শক্তির পরিসংখ্যান রাজশাহী জেলার নওগাতে ছিল ই.পি. আর -এর ৭নং উইং। বাঙালি মেজর নাজমুল হক অধিনায়ক হিসেবে উইং-এর কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন ১৮ই মার্চ ১৯৭১। অপর দুজন সহকারী অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী ও অবাঙালি ক্যাপ্টেন নাবিদ। উইং-এর অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানি ও একটি সাপাের্ট প্লাটুন। কোম্পানিগুলির অবস্থান ছিল নিম্নরূপ :
১. উইং সদরে ছিল সুবেদার মনােয়ার আলীর অধিনায়কত্বে একটি কোম্পানি, তাছাড়া সাপাের্ট প্লাটুন এবং অন্যান্য আরাে কিছু স্টাফও উইং সদরে অবস্থান করছিল। বগুড়া জেলার পাঁচবিবি থানার অন্তর্গত কুড়িয়া নামক স্থানে এক কোম্পানি, | অধিনায়ক, অবাঙালি সুবেদার ইউসুফ। রাজশাহী জেলার খঞ্জনপুরে এক কোম্পানি, অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি নায়েব সুবেদার নাজিরউদ্দিন। ৪. চারঘাটে ছিল এক কোম্পানি, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার হাসান আলী। ৫. মনকষাতে এক কোম্পানি, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার কালােম । ২৫শে মার্চ ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হকের পরামর্শক্রমে কোয়ার্টার গার্ড ও অন্যান্য স্থানে অবাঙালিদের পরিবর্তে বাঙালিদের নিয়ােগ করেন। তার দু’দিন পূর্বেই অর্থাৎ ২৩শে মার্চ রােহনপুরের বাঙালি ই.পি. আর সৈন্যরা হাবিলদার আক্কাস-এর নের্তৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণাশঙ্কায় ছিল অত্যন্ত সতর্ক। ঘটনাচক্রে ঐ রাতেই পাকিস্তানি বাহিনীর একজন অফিসার ও কিছু সৈন্য রােহনপুর ক্যাম্পের দিকে অগ্রসর হলে বাঙালি ই.পি. আর সৈন্য তাদের উপর গুলি। ছোড়ে। অকস্মাৎ এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং পালিয়ে যায়। এ ঘটনার তদন্তের জন্য কোম্পানি অধিনায়ক অবাঙালি সুবেদার ইউসুফ রােহনপুর এলে বাঙালিরা তাকেও গুলি করে হত্যা করে। বলতে গেলে ৭নং উইং-এর এলাকায় এখান থেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়।
২৬শে মার্চ উইং-এর বাঙালি সৈনিকরা ঢাকায় পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর খবর। পেয়ে উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হকের অনুমতি ছাড়াই উইং সদরের চত্বরে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে যথাযােগ্য রাষ্ট্রীয় অভিবাদন জানায়। সেদিনই বেলা সাড়ে বারােটার দিকে পাশ্ববর্তী অবাঙালি কলােনি থেকে উইং সদরের দিকে গুলি ছোঁড়া হলে বাঙালিরা অস্ত্রাগার খুলে সবাই অস্ত্র নিয়ে যার যার মতাে প্রতিরক্ষা পজিশন নেয়। বিষয়টি মেজর নাজমুল হক ও ক্যাপ্টেন গিয়াসের গােচরীভূত করা হলে তারা স্বাধীন বাংলার অস্তিত্ব স্বীকার করে বিদ্রোহী বাঙালিদের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেন। প্রাথমিকভাবে তারা এক পরিকল্পনা গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নেন যে, ১. অপারেশন সদর অফিস হবে উইং সদর অফিসে। ২. নিজ বেতার সেট খুলে রেখে সমস্ত ই.পি. আর খবরাখবর মনিটরিং করে উইং সদরকে জানাতে হবে। ৩. পুলিশের বেতার কেন্দ্রগুলােকে মনিটরিং করে সেগুলাের মাধ্যমেও
যােগাযােগ করার ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিফোন বিভাগের মাধ্যমে নওগাঁ থেকে অন্তত পঞ্চাশ মাইল দূরবর্তী প্রধান প্রধান স্থানগুলাের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করে পাকিস্তানি বাহিনীর গতিবিধির খবর নিতে হবে। সমস্ত যানবাহন রিকুইজিশন করতে হবে। সর্বস্তরের জনতার মধ্য থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করতে হবে। ৭, ছাত্র ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান করতে হবে। ৮, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ অস্ত্রাগার থেকে সরিয়ে অন্যত্র রাখতে হবে। ৯. অপারেশন সদর অফিসের চতুর্দিকে বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। ১০. চাঁপাই নবাবগঞ্জের ৬নং উইং-এর সাথে যােগাযােগ করার ব্যবস্থা করতে হবে।
উল্লেখ থাকে যে উপরােক্ত সিদ্ধান্তগুলি যথাযথভাবে কার্যকরী করা । হয়েছিল। উইং অধিনায়ক মেজর নাজমুল হক যুদ্ধের নিম্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন : ই,পি, আর-এর এক কোম্পানি সৈন্য বেশ কিছু আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্রস্বেচ্ছাসেবক সহকারে ২৮শে মার্চ বগুড়া আক্রমণের জন্য পাঠানাে হবে। এই বাহিনীর অধিনায়ক হবেন ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দিন চৌধুরী। ই.পি, আর বাহিনীর আরেকটি কোম্পানি নাটোর রােড দিয়ে অগ্রসর হয়ে সারদা ক্যাডেট কলেজের এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রশিদের সাথে মিলিত হবে। এই সম্মিলিত বাহিনীর অধিনায়ক হবেন ক্যাপ্টেন রশিদ। এই বাহিনী রংপুররাজশাহী সড়ক বিচ্ছিন্ন করে রংপুর থেকে অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলবে এবং ঢাকা থেকে অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দিতে হবে।
সাক্ষাৎকার ; ক্যাপ্টেন গিয়সউদ্দিন চৌধুরী, লালগােলা
১৯৭১ পরিকল্পনুসারে ক্যাপ্টেন রশিদ গােপালপুর সংঘর্ষের পর নন্দনগাছি রেল স্টেশন এলাকায় পাবনা-রাজশাহী সড়ক এবং ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেল লাইন পর্যন্ত বিস্তৃর্ণ এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করলেন। গােপালপুর থেকে রাজশাহী অভিমুখে পলায়নপর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্য ৩০ এবং ৩১শে মার্চ ক্যাপ্টেন শিনে প্রতিরক্ষা এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের এমবুশে পড়ে যায়। এই সংঘর্ষে ৩১ জনের মতে’ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। আনুমানিক এক সেকশন পাকিস্তানি সেনা পালিয়ে রাজশাহীতে মূলবাহিনীর সাথে একত্রিত হতে সমর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ২জন শহীদ। হন নিহত ও পরাজিত পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী