You dont have javascript enabled! Please enable it!
ময়মনসিংহ / টাঙ্গাইল
নিজ ও শক্র শক্তির পরিসংখ্যান ই.পি. আর-এর ২নং উইং-এর সদর দপ্তরের অবস্থান ছিল ময়মনসিংহ শহরে। উইংএর ভারপ্রাপ্ত অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস। শােনা যায় ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ছিলেন ঘােরতর বাঙালি-বিদ্বেষী। এই উইং-এর অধীন ৪টি কোম্পানির অবস্থান ছিল : ১. সুবেদার এ,বি, এম, আজিজুল হকের নের্তৃত্বে লেঙ্গুরা নামক স্থানে ‘এ’ কোম্পানি ২. সুবেদার জিয়াউল হকের নেতৃত্বে করইতলিতে ‘বি’ কোম্পানি ৩. সুবেদার আবদুল হাকিম-এর নের্তৃত্বে নকসীতে ‘ডি’ কোম্পানি এবং ৪. সুবেদার ফরিদ উদ্দিন আহমদ-এর নের্তৃত্বে ‘সি’ কোম্পানি শহরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার (Internal Security) কাজে নিয়ােজিত ছিল। তবে ৭ই মার্চের পর থেকে তিনি ও তার কোম্পানি যে কোনাে বিশেষ ও জরুরি (emergency) কাজের জন্য স্ট্যান্ড বাই’ ছিল। ময়মনসিংহ-এর খাগদহ এলাকায় ২৫শে মার্চের পূর্ব থেকেই জয়দেবপুরের ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কোম্পানি মেজর নূরুল ইসলামের নের্তৃত্বে অবস্থান। করছিল। ওদিকে ময়মনসিংহ ই.পি. আর উইং সদরে পাকিস্তানি সৈন্য সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে বেশি। তাছাড়া বিশেষ কাজের জন্য অবস্থান করছিল বিমান বাহিনীর এক প্লাটুন পদাতিক সৈন্য (Ground Force), পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি সেকশন এবং আনসার ও মুজাহিদদের প্রশিক্ষণে নিয়ােজিত কিছুসংখ্যক অবাঙালি প্রশিক্ষক (Instructor)। সর্বমােট ১৩৮ জন অবাঙালি সৈন্যকে ৭ই মার্চের পর থেকেই পূর্ণ আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে সর্বক্ষণই প্রস্তুত থাকতে দেখা যায়।
সাক্ষাৎকার :সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ
————–
অবাঙালিদের তৎপরতা ও বাঙালিদের প্রতিক্রিয়া ২৭শে মার্চ সকালেই ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস সুবেদার ফরিদ ও তার বাহিনীকে বিশ্রামের উপদেশ দিয়ে নিরস্ত্র করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি সৈনিকগণ কোনাে প্রকারেই অস্ত্র জমা দিতে রাজি হয়নি। ওদিকে অস্ত্রাগার থেকে বেশ কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ ক্যাপ্টেন কমরের বাসায় নিয়ে যেতে দেখা যায়। ঐ দিনই দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে ই,পি, আর সদর দপ্তর পিলখানা থেকে ১নং জেনারেল স্টাফ অফিসার ময়মনসিংহ উইং অধিনায়কের সাথে বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে কথা বলতে চাইলেন। সে সময় বেতারের কর্তব্যে ছিল বাঙালি নায়েক ফরহাদ হােসেন। বেতারের কথােপকথন ইংরেজি এবং পাঞ্জাবি ভাষায় চলতে থাকলেও সে সব বুঝতে পারলাে। উইং অধিনায়ককে ২৮শে মার্চ সকাল ৮টার পূর্বেই সব বাঙালি ই.পি, আরকে বন্দি অথবা হত্যা করবার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।  নায়েক ফরহাদ এই গােপন অভিসন্ধির খবর অনেককেই জানালো। এদিকে ২৭শে মার্চ বিকেলে উইং সদরে বেশ কিছু অবাঙালি মিলে এক গােপন বৈঠক করার খবর যথাসময়ে বাঙালিদের গােচরীভূত হয়। সর্বস্তরের অবাঙালি সৈনিকদের এহেন তৎপরতায় এবং পিলখানার সাথে উইং অধিনায়কের কথােপকথনের রিপাের্টে চিন্তিত হয়ে সুবেদার ফরিদ ঐ দিনই বিকেলে দ্বিতীয় ইষ্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক মেজর নূরুল ইসলামকে সমস্ত ব্যাপার অবগত করিয়ে অবাঙালির দ্বারা আক্রান্ত হলে প্রতিআক্রমণ করার আদেশ চাইলেন। কিন্তু সামরিক নিয়ম শৃঙ্খলার অবতার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন মেজরের পক্ষে অতটুকু প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই বিদ্রোহাত্মক কোনাে প্রকার আদেশ-উপদেশ দেওয়া সম্ভব ছিল না।
স্বাভাবিকভাবেই তার কাছ থেকে সুবেদার ফরিদ বিদ্রোহাত্মক। কোনাে ইঙ্গিত পায়নি। বরং পরিস্থিতিকে শান্ত করবার অভিপ্রায়ে মেজর নূরুল ইসলাম। ঐদিনই সন্ধ্যার অব্যবহিত পরই ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসকে সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পে ই, পি, আরদের উদ্দেশে এক ভাষণে পরস্পরের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি না করার জন্য উপদেশ দেন। কিন্তু ইতােমধ্যেই দেখা গেল অস্ত্রাগারে, জেসিও মেসে, কিছু অফিসের ভেতর, কিছু ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসের বাসায় শুধু অবাঙালি সৈনিকরা সশস্ত্র প্রহরায় অগ্রসর হচ্ছে। এমনকি ২৫/৩০ জনের একটি অবাঙালি সৈন্যদলকে সদর এলাকা টহল দিতে। শুরু করার ঘটনাও লক্ষ্য করা যায়। অবাঙালিদের আক্রমণ ও বাঙালিদের প্রতিরােধ ২৭শে মার্চ রাত ৯টার পর ঘটনার ক্রমাবনতি ঘটছে বলে পরিষ্কার বােঝা গেল। এতে বাঙালি ই.পি, আর সৈনিকরাও সতর্ক হয়ে যে কোনাে অবস্থার জন্য প্রস্তুত হতে থাকলাে। এই সময় সুবেদার ফরিদ রানার দ্বারা ডাক বাংলােয় অবস্থানরত মেজর নূরুল
—————
সাক্ষাৎকার : নায়েক ফরহাদ হােসেন, রেডিও মেকানিক।
সাক্ষাৎকার : সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ।
ইসলামকে (জেনারেল শিশু নামে পরিচিত, বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করা। কিন্তু মেজর নূরুল ইসলাম কোনাে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করার পূর্বেই ২৭শে মার্চ রাত ১১টা ৩০ মিনিটে পাকিস্তানিরা বাঙালি ই,পি, আর বাহিনীকে আক্রমণ করে। পূর্বেই বলেছি যে বাঙালি সৈনিকরাও ছিল প্রস্তুত। এক রাউন্ড গুলির শব্দের সাথে সাথেই সব বৈদ্যুতিক বাতি বন্ধ হয়ে যায় এবং উভয় পক্ষে তুমুল গােলাবৃষ্টি শুরু হয়। ই,পি, আরদের তিন তলা ভবনটিতে অধিকাংশ বাঙালি সৈনিকরা থাকতাে। বিমান বাহিনীর প্লাটুন ভবনটির উত্তর দিক ঘেঁষে, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সেকশন দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে ভবনটির উপর ক্রমাগত গােলাবর্ষণ করতে থাকে। কিন্তু সিপাই নানু মিয়া ও সিপাই আফতাব হােসেনের দুটি হালকা মেশিনগানের অব্যর্থ গােলাবৃষ্টিতে তাদের সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। সারারাত ধরে বিচ্ছিন্নভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে। ক্রমাগত ১৭ঘন্টা যুদ্ধের পর ২৮শে মার্চ বিকেল ৫টার মধ্যে সমস্ত অবাঙালি বাঙালিদের হাতে চরম পরাজয় বরণ করে। ভারপ্রাপ্ত ই.পি, আর উইং অধিনায়ক অবাঙালি ক্যাপ্টেন কমর আব্বাস ও তার দলবল বাঙালিদের হাতে নিহত হয়। বন্দি হয় সুবেদার মেজর জিন্নাত খ, নায়েব সুবেদার বােস্তান স্বা, হজরত খাঁ, খান বাহাদুর খাঁ প্রমুখ। একজন মুক্তিযােদ্ধা হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। হাজার হাজার জনতা, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র এগিয়ে এল ই.পি. আরদের সাহায্যে। সুবেদার ফরিদউদ্দিন ময়মনসিংহের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। ১৪০২ টি রাইফেল ও ২৮টি এল, এম, জি, সহ বহু গােলাবারুদ তাদের হস্তগত হয়। | ওদিকে ২৭শে মার্চ রাতে ডাকবাংলাতে মেজর নূরুল ইসলামের উপরও পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালায়। মেজর নূরুল ইসলাম ও লেফটেনেন্ট মান্নান পিছন দরজা দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর অপর পাড়ে গিয়ে প্রাণরক্ষা করেন। সারারাত তাদের সাথে তাদের বাহিনীর আর কোনাে যােগাযােগ ঘটেনি।
রাত প্রায় সাড়ে বারােটায় পাকিস্তানিরা টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মেজর নূরুল ইসলাম ও লে, মান্নান ই.পি. আর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রায় আধমাইল দূরে সি এন্ড বি রেস্ট হাউসে ঘুমােচ্ছিলেন। রাত সাড়ে বারােটায় রেস্ট হাউসের উপর তার কামরা লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয় । তিনি টেলিফোনে তার কোম্পানির সাথে কথা বলতে চেষ্টা করেন। ব্যর্থ হয়ে তিনি এবং লে, মান্নান পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে নদীর দিকে চলে যান। সকাল না হওয়া পর্যন্ত তিনি কোম্পানির সাথে কোনাে যােগাযােগ করতে পারেননি। ভােরে যখন যােগাযােগ হয় তখনও ভীষণভাবে দুই দলের মধ্যে গােলাগুলি চলছিল । | ২৮শে মার্চ সুবেদার ফরিদ সীমান্তের সব কোম্পানি অধিনায়কদের সব পরিস্থিতি জানিয়ে বাঙালিদের বন্দি করে উইং সদরে চলে আসবার জন্য বার্তা প্রেরণ করেন। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মেজর সফিউল্লাহ ময়মনসিংহে আসার পর তিনিও অনুরূপ একটা বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তা দুটো পেয়ে কোম্পানি অধিনায়কগণ তাদের বাহিনী নিয়ে ময়মনসিংহ অভিমুখে অগ্রসর হয়ে জামালপুর, মুক্তাগাছা ও নেত্রকোণায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। ঐ দিনই সুবেদার ফরিদ রাবেয়া মেমােরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে তার রণ-সদর (OPS Hg) স্থানান্তর করেন। মেজর সফিউল্লাহর আগমন ও অধিনায়কত্ব গ্রহণ ২৯শে মার্চ সকালে হাজার হাজার লােকের উপস্থিতিতে রাবেয়া মেমােরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়ে ই.পি, আর বাহিনী যথাযােগ্য মর্যাদার সাথে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে রাজকীয় সম্মান প্রদর্শন করেন। তারা দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য। বজ্রকঠোর শপথ গ্রহণ করেন। সেদিন বিকেলে মেজর সফিউল্লাহ দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অধিকাংশ সৈন্য সহকারে ময়মনসিংহে পৌছেন। এখানে এসেই তিনি। উপস্থিত সমস্ত বাহিনীর অধিকায়কত্ব নিজ হাতে নিলেন এবং সামরিক ও বেসামরিক কর্মীদের নিয়ে ময়মনসিংহ রাজবাড়িতে এক বৈঠকে বসলেন। এই বৈঠকে ঢাকা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় ।
ঢাকার পথে মেজর সফিউল্লাহর বাহিনী
ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনানুসারে মেজর সফিউল্লাহ উত্তরবঙ্গ থেকে পাকিস্তানিদের আক্রমণ রােধকল্পে বাহাদুরাবাদ, সিরাজগঞ্জ ও গফরগাঁও নামক স্থানে একটি করে ই.পি, আর, ছাত্র, পুলিশ ও আনসার মুজাহিদদের মিলিত কোম্পানিকে প্রতিরক্ষায় নিযুক্ত করেন। এই সব কোম্পানিগুলাে ৩১শে মার্চের মধ্যেই নিজ নিজ এলাকায় প্রতিরক্ষা গ্রহণ। করে। এদিকে দুই কোম্পানি ই.পি. আরকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে মীরপুর, মােহাম্মদপুর। এবং ঢাকা বিমান বন্দর আক্রমণ করার নির্দেশ দিয়ে ঢাকার পশ্চিমাঞ্চলে প্রেরণ করেন। তিনি নিজে এক কোম্পানি ই.পি. আর ও এক কোম্পানি ইস্ট বেঙ্গল বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিক দিয়ে টাকা আক্রমণ করবেন বলে স্থির করলেন। ঢাকার পশ্চিমাংশে প্রেরিত মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় পাকিস্তানিদের মনে করা স্বাভাবিক যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পশ্চিম দিক থেকেই আসবে। এই সুযােগে মেজর সফিউল্লাহ তার বাহিনী নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে কিশােরগঞ্জ-ভৈরব-নরসিংদী পর্যন্ত ট্রেন এবং নরসিংদী থেকে পায়ে হেঁটে ডাঙা নামক স্থানে শীতলক্ষ্যা পার হয়ে ঢাকার পূর্বাংশে আক্রমণ করবেন। এই পরিকল্পনা ১লা এপ্রিলের মধ্যে বাস্তবায়িত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ৩১শে মার্চ তাই মেজর সফিউল্লাহ তার বাহিনী ট্রেন যােগে পাঠাতে শুরু করেন। এবং ঐ দিনই তার রণ| সদর (OPS Hg) ময়মনসিংহ থেকে কিশােরগঞ্জে স্থানান্তরিত করেন। এ সময় ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর শাফায়াত জামিলের মারফত মেজর সফিউল্লাহ মেজর খালেদ মােশাররফের নিকট থেকে বার্তা পেয়ে তার ঢাকা আক্রমণের পরিকল্পনা পরিবর্তন করে তার অধীনস্থ সব ট্রপস নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া চলে যান। কিন্তু মেজর সফিউল্লাহর নির্দেশে যে সমস্ত সৈনিক ঢাকার অদূরে গিয়ে অপারেশন শুরু করেছিল তাদের সাথে আর তিনি যােগাযােগ রক্ষা করতে পারেননি।
সাক্ষাৎকার : সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমেদ
———-
এদিকে মেজর সফিউল্লাহর পরিকল্পনানুসারে ৩০শে মার্চ ক্যাপ্টেন নাসিমের নের্ততে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি এবং সুবেদার ফরিদের নের্তৃত্বে ই.পি, আরদের একটি কোম্পানি ট্রেন যােগে ভৈরব হয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়ে যায়। এই বাহিনীর সাথে ছুটিভােগরত ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানও ছিলেন। ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান ময়মনসিংহ থেকেই মেজর সফিউল্লাহর সাথে যােগদান করেছিলেন। রাত ১১টায় বিশেষ ট্রেনটি ভৈরব পৌছুলে ক্যাপ্টেন নাসিম তার কোম্পানি নিয়ে ভৈরব স্টেশনে নেমে পড়েন। সুবেদার ফরিদের ই.পি, আর কোম্পানিটি ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নের্তৃত্বে ৩১শে মার্চ সকালে নরসিংদী অবতরণ করে ডেমরা ঘাট হয়ে ঢাকা। পৌছার উদ্দেশে পায়ে হেঁটে রওয়ানা করে। কিন্তু ডেমরা ঘাটে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রতিরক্ষ্য রচনার পরিপ্রেক্ষিতে ক্যাপ্টেন মতিউরের ই.পি, আর বাহিনী শীতলক্ষ্য নদীর পূর্ব তীরে ডাঙ্গা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা পজিশন গ্রহণ করে। ৩১শে মার্চ অপরাহ্নে ক্যাপ্টেন সাইগলের নের্তৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের এক কোম্পানি সৈন্য নরসিংদী আসে। ডাঙ্গায় ক্যাপ্টেন মতিউরের যে ই.পি. আর দলটি অবস্থান করছিল তাদের পেছন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ থেকে রক্ষা করার উদ্দেশে ক্যাপ্টেন সাইগল ঢাকা-নরসিংদী রােডে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। এদিকে ২রা এপ্রিল ঢাকা রেডিওর ঘােষণা অনুসারে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বহু সংখ্যক বাস ট্রাক একত্রিত হয়েছিল। ঐ সব যানবাহন যােগে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল টাঙ্গাইলের দিকে ও অপর একটি দল নরসিংদী অভিমুখে অগ্রসর হয়। ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কে ই.পি, আর বাহিনীর একটি কোম্পানি সুযােগের অপেক্ষায় ওঁত পেতে বসেছিল। পাকিস্তানিরা ই.পি, আরদের এ্যামবুশে পড়ে বেশ কিছু ক্ষয়ক্ষতির স্বীকার হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, আহত ও নিহতদের নিয়ে যাবার জন্য ৬টি বড় গাড়ি ব্যবহার করা হয়েছিল। ই.পি, আর বাহিনী শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র পাল্টা আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে।
অন্যদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ২য় কলাম যেটা নরসিংদীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, সে দলটি ছিল ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন। তারা ৮ই এপ্রিল ঢাকা-নরসিংদী সড়কে ও ডাঙ্গায় অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের পূর্বভাগেই মুক্তিযােদ্ধারা খবর পেয়ে তাদের মেশিনগানগুলি রাস্তার দু’পাশে স্থাপন করে ওঁত পেতে অপেক্ষা। করছিল। মারণ-রেঞ্জে আসার সাথে সাথেই মুক্তিবাহিনীর গানগুলি গর্জে ওঠে। অতর্কিত এই আক্রমণে পাকিস্তানিবাহিনী দিশেহারা হয়ে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রায় ১০০ জন নিহত হয়। ৯ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বিমান ও আর্টিলারির সাহায্যে ব্যাপক আক্রমণ করেও মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান থেকে নড়াতে ব্যর্থ হয় । তাই বিকেল ৫টায় পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করে আরাে ব্যাপকভাবে। মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়। ফলে তারা পশ্চাদপসরণ করে আশুগঞ্জ এসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাহিনীর সাথে মিলিত হয়।
—————
সাক্ষাৎকার : সুবেদার ফরিদউদ্দিন আহমদ।
মুক্তিযােদ্ধাদের এই দল ১৩ই এপ্রিল ভৈবর-রামনগর সেতুর নিকট প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। কিন্তু ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী জঙ্গীবিমান ও আর্টিলারির সমর্থনে চতুর্দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ হেলিকপ্টার যােগে দুই কোম্পানির মতাে কমান্ডাে বাহিনী মেঘনার পূর্ব-পাড়ে নামিয়ে দেয়। তারাও এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। তুমুল সংঘর্ষের পর মুক্তিযােদ্ধারা ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে মেঘনা অতিক্রম করে ভারতসীমান্তে তেলিয়াপাড়া পৌঁছে যায়। অপর দল সুবেদার ফরিদের নের্তৃত্বে উত্তরদিকে চলে যায়। তারা ময়মনসিংহের মধুপুরে অবস্থিত সুবেদার জিয়াউল হকের কোম্পানির সাথে মিলিত হতে সক্ষম হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ই.পি. আর ২নং উইং-এর সীমান্তবর্তী অপর তিন কোম্পানির অধিনায়কগণ জামালপুর, মুক্তাগাছা ও নেত্রকোণায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে অপেক্ষা করছিল। সুবেদার ফরিদের বাহিনী ও মেজর সফিউল্লার বাহিনী ময়মনসিংহ থেকে চলে যাবার পর কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ময়মনসিংহ শহরের পতন ঘটে। সুবেদার জিয়াউল হক মধুপুরগড়, কালিহাতীপুল ও জামুরকী এলাকায়, সুবেদার আবদুল হাকিম জামালপুর মহকুমার ধনবাড়ি থেকে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত এবং সুবেদার আজিজুল হক নেত্রকোণা ও কিশােরগঞ্জ মহকুমায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে টিকে থাকবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
৮ই এপ্রিল বি এস এফ-এর ক্যাপ্টেন ত্যাগীর সহায়তায় পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযান রােধকল্পে কালিহাতী সেতুটি ধ্বংস করতে গেলে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ‘সুবেদার। জিয়াউল হকের দলটির এক খণ্ডযুদ্ধ হয় । প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে। এরপর টাঙ্গাইল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল ধনবাড়ি হয়ে জামালপুরে এবং অপরদল মধুপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পথিমধ্যে জামুরকী নামক স্থানে নায়েব সুবেদার হারিস আহমদের নের্তৃত্বে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর এক বড় রকমের সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়া সত্ত্বেও তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে।  পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযান রােধ করার জন্য ১৪ই এপ্রিল মধুপুর সেতুটি ধ্বংস করা হয়। কিন্তু তাদের অগ্রাভিযান রােধ করা যায়নি। জিয়াউল হক তার বাহিনী নিয়ে মধুপুর থেকে মুক্তাগাছায় চলে আসেন। ১৮ই এপ্রিল থেকে পাকিস্তানি সেনারা ক্রমান্বয়ে মুক্তাগাছা, রসুলপুর, ঘাটাইল, জামালপুর, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ ইত্যাদি এলাকার উপর বেপরােয়া হামলা চালাতে থাকে। সে আক্রমণে টিকে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে অসম্ভব ছিল। চতুর্দিক থেকে মার খেয়ে তারা ভারত সীমান্তের দিকে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে যেতে বাধ্য হয়। অবশেষে মে মাসের প্রথম দিকে সুবেদার আজিজুল হক তার লােকজন ও রসদপত্র নিয়ে ভারতের রংরা-তে, সুবেদার জিয়াউল হক ও তার বাহিনী ঢালুতে এবং সুবেদার আবদুল হাকিম ও তার বাহিনী-পুরাখাসিয়া নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। কার্যত ; তখন থেকেই ময়মনসিংহের পতন ঘটে।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!