You dont have javascript enabled! Please enable it!
রংপুর
নিজ ও শক্র শক্তির পরিসংখ্যান রংপুরে ছিল ই.পি. আর বাহিনীর ১০নং উইং সদর দপ্তর। উইং অধিনায়ক ও দু’জন সহকারী অধিনায়কের একজন ছিল অবাঙালি। দ্বিতীয় সহকারী অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন। উইং-এর অধীনস্থ কোম্পানিগুলির অবস্থান ছিল। নিম্নরূপ : ১. উইং সদর রংপুরে একটি কোম্পানি এবং সাপাের্ট প্লাটুন। সাপাের্ট প্লাটুনের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি নায়েব সুবেদার নূর মােহাম্মদ। ২. চিলমারীতে বাঙালি সুবেদার আবদুল মান্নানের নের্তৃত্বে এক কোম্পানি। ৩. বাঙালি সুবেদার আরব আলীর নের্তৃত্বে মােগলহাটে এক কোম্পানি। ৪, বাঙালি সুবেদার বােরহানউদ্দিনের কোম্পানি ছিল পাটগ্রামে এবং ৫. জয়মনিরহাটে একজন অবাঙালি সুবেদারের নের্তৃত্বে এক কোম্পানি। অন্যদিকে রংপুর ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩তম ব্রিগেড সদর দপ্তর যার অধীন ছিল-সৈয়দপুরে অবস্থিত ৩য় ইষ্ট বেঙ্গল ও ২৬তম এফ, এফ রেজিমেন্ট এবং রংপুরে ছিল ২৩তম ক্যাভালরি (ট্যাঙ্ক বাহিনী) ও তার সহযােগী বাহিনী এবং বেলুচ রেজিমেন্টের ৬ষ্ঠ ব্যাটালিয়ন। ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ মালিক। পুরাে ব্রিগেড ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত। ২৫শে মার্চ ১১টায় একটি হেলিকপ্টার যােগে ঢাকা থেকে জেনারেল জানুয়া, জেনারেল মিঠঠা, জেনারেল নাজির হােসেন শাহ, বেশ কয়েকজন ব্রিগেডিয়ার এবং অন্যান্য উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারগণ রংপুর সেনানিবাসে এলেন। তারা সরাসরি ব্রিগেডিয়ার আবদুল্লাহ মালিকের বাসায় পেীছে এক সভায় বসলেন। সভাশেষে জেনারেলগণ হেলিকপ্টারে করে ঢাকা ফিরে যান । সেদিনের সভায় সম্ভবত : পঁচিশের রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার নীলনকশা নিয়ে ব্যাপক আলােচনা করা হয়।  ব্রিগেডিয়ার মালিক ঐ দিনই বেলা ১টার সময় এক বৈঠকে বসেন। সে বৈঠকে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উপস্থিত হবার সাথে সাথেই ব্রিগেডিয়ার মালিক তাকে শহরের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজ তদারকি করবার অজুহাতে পাঠিয়ে দেন। বৈঠকে বাকী যে
——————–
সাক্ষাৎকার : লে. কর্নেল নওয়াসউদ্দিন, অধিনায়ক ৭ নম্বর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, যশাের।
সমস্ত অফিসারগণ ছিলেন তারা সবাই ছিল অবাঙালি। এই বৈঠক শেষে পাকিস্তানি সেনাদের মধ্যে ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ করা গেল। তাদের সেনানিবাসের চতুর্দিকে পরিখা খনন করে অস্ত্রসহ প্রস্তুত থাকতে দেখা গেল। ঐ দিন বেলা ৩টা থেকে ৫টা পর্যন্ত রংপুর শহরে সান্ধ্য আইন জারী রাখা হয়। সন্ধ্যা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের রংপুর হয়ে বগুড়ার দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায় । কিন্তু ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের কত সৈন্য সেদিন মুভ’ করেছিল তা সঠিক জানা যায়নি।
পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ ও ই.পি. আর প্রতিরােধ
২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর রংপুরের পাকিস্তানি বাহিনী রংপুরস্থ ই.পি. আর ও নিরস্ত্র জনতার উপর বেপরােয়াভাবে গােলাবর্ষণ করতে থাকে। সারারাত গুলিগােলা চলতে থাকে। সে রাতে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু হতাহত হয়। ই.পি, আর উইং-এর সহকারী। অধিনায়ক ক্যাপ্টেন নওয়াজেশউদ্দিন সম্ভবত আগে থেকেই অবস্থার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি সাথে কিছু ই.পি, আর সৈনিক নিয়ে রাত এগারােটার দিকেই শহর ছেড়ে নদীর অপর পাড়ে টগরহাটের এক বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে তিনি উইং-এর অধীনস্থ কোম্পানিগুলির সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। ২৮শে মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বাঙালি কোম্পানি অধিনায়ক ও অন্যান্যদের ডেকে টগরহাটে এক বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকের সিদ্ধান্তানুসারে ৩০শে মার্চ ‘বি’ কোম্পানিকে তিস্তা নদীর পাড়ে, ‘এ’ কোম্পানিকে কুড়িগ্রামের সামনে, ‘ডি’ কোম্পানি। লালমনিরহাট বিমান বন্দরের নিকট এবং “সি’ কোম্পানিকে সাপটানাচর এলাকায়। প্রতিরক্ষা নিতে বলা হয়। কিন্তু সিদ্ধান্তানুযায়ী ‘সি’ কোম্পানি সাপটানাচর পৌছুতে না পারায় ‘ডি’ কোম্পানি থেকে একটি প্লাটুন সেখানে পাঠানাে হয়। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ ই.পি, আর বাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপন করলেন কুড়িগ্রামে। . ১লা এপ্রিল ২৬তম এফ, এফ, রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈন্য ও কাউনিয়া থানার ও, সি, সহকারে মেজর এজাজ মােস্তফা তিস্তা নদীর পাড়ে ‘রেকি’ করতে গিয়ে তিস্তা সেতুর উপর ই.পি.আরদের এ্যামবুশে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। এই সংঘর্ষে কাউনিয়ার ওসিও মারা যায় এবং এফ, এফ, রেজিমেন্টের ১৫জন সৈন্য নিহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে পালিয়ে যায়। পরদিন ২রা এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী তাদের আর্টিলারি শেলিং এর সাহায্যে পুনরায় তিস্তা সেতু আক্রমণ করে কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধে পশ্চাদপসরণ করে। সেদিনই সন্ধ্যার দিকে পুনঃশক্তি সঞ্চয় করে পাকিস্তানি সেনারা তিস্তা সেতুতে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবলভাবে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধোদের দু’জন শহীদ হয়। প্রবল শেলিং-এর দরুণ মুক্তিযােদ্ধারা। বাধ্য হয়ে ৩০০ গজ পেছনে গিয়ে পজিশন নেয়। ৪ঠা এপ্রিল পাকিস্তানি সেনাদের একটি রেজিমেন্ট কিছু প্রতিক্রিয়াশীল বাঙালির সহায়তায় হারাগাছা নামক এলাকায় তিস্তা নদী অতিক্রম করে হত্যা লুণ্ঠন ইত্যাদির
————-
সাক্ষাৎকার : মো, আকবর আলী, ডি-এ-ডি, বিডিআর, পীলখানা
মধামে স সৃষ্টি করতে করতে ক্রমশ বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। যু’জহে” তাকে বাধা দেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ঐ দিন বিকেলেই পাকিস্তানি জাের বিমান বন্দরে প্রতিরক্ষা নির্মাণ করে। বিমান বন্দর পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় এবং ঢাকা থেকে বিমান যােগে সামরিক সম্ভার ও অন্যান্য সকল প্রকার সাহায্য লালহিট আসতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীর অপর একটি দল তিস্তা নদী অতিক্রম করে ঝটিকা বেগে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিযােদ্ধারা সামগ্রিক পরিকল্পনা বাতিল করে কুলারঘাট, রাজারহাট, সাপটিবড়িবাজার ও কালিগঞ্জ থানা এলাকা নতুন কর প্রতিরক্ষা গ্রহণ করে। | ৮ই এপ্রিল ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ কুড়িগ্রামে এক বৈঠক করেন। বৈঠকে রংপুরকে একটি সেক্টর হিসেবে ঘােষণা দিয়ে এটাকে দু’টি সাব-সেক্টরে ভাগ করা হয়। একটি সাব-সেক্টর পাটগ্রাম, অধিনায়ক সুবেদার বােরহান উদ্দিন; অপরটি ভুরুঙ্গামারীতে, অধিনায়ক সুবেদার আরব আলী। সার্বিক দায়িত্বে রইলেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ নিজে। এই সময় ই পি আর বাহিনীর সাথে আনসার, মুজাহিদ ও ছাত্র মিলে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তি সংখ্যা প্রায় দু’হাজারে দাড়ায়।
মুক্তিবাহিনীর বিপর্যয় ও রংপুর পতন
১২ই এপ্রিল গভীর রাতে মুক্তিযােদ্ধাদের চার কোম্পানি সৈন্য একটি সাপাের্ট প্লাটুনের সহায়তায় লালমনিরহাট বিমান বন্দরে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর বড় রকমের আক্রমণ চালায় এ আক্রমণ পরিচালনা করেন সুবেদার আরব আলী। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র প্রতি-আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে তাদের মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসতে বাধ্য হয়। ১৪ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান রাজারহাট ও কুলারঘাটে ব্যাপক আক্রমণ চালায়। টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা পেছনে সরে আসে এবং ১৫ই এপ্রিল কাকিনা, পাটেশ্বরীঘাট, রৌমারী সড়ক ও ফুলবাড়ি থানায় পুনরায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের রণ-সদর কুড়িগ্রাম থেকে। ভুরুঙ্গামারীতে স্থানান্তরিত করতে হয়। ১৬ই এপ্রিল থেকে ২৫শে মে পর্যন্ত এই এলাকায় কয়েকটি ছােট-খাট সংঘর্ষ ঘটে কিন্তু কোনাে পক্ষে উল্লেখযােগ্য কোনাে অগ্রগতি হয়নি। ২৬শে মে অপরাহ্নে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানগুলির উপর ব্যাপক শেলিং শুরু করে। এই শেলিং-এর জবাব দেবার মতাে গােলন্দাজ বাহিনী বা বড় কামান মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল না। পাকিস্তানিদের অব্যাহত চাপে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাটেশ্বরীতে টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। ২৭শে মে পাকিস্তানি বাহিনী ধবলা নদী অতিক্রম করে অগ্রসর হতে থাকলে মুক্তিযােদ্ধারা পাটগ্রামে প্রতিরক্ষা ছেড়ে পেছনে সরে যেতে বাধ্য হয়। ঐ দিন বিকেলেই ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের এক কোম্পানি সৈন্যকে পাকিস্তানি লেদার পাটে রাত এনে এ্যামবুশ করতে সমর্থ হয়। এই এ্যামবুশে বেশকিছু মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ হারায়। এরপর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের রণ-সদর ভুরুঙ্গামারীর চতুর্দিকে।
প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ তার বাহিনী পুনর্গঠিত করে ৩০শে মে নিম্নরূপভাবে তার প্রতিরক্ষা পুনঃস্থাপন করেন : ১. সুবেদার আরব আলীর নের্তৃত্বে ২ কোম্পানি ফুলকুমার নদীর পাড়ে ও ১ পাটুন ফুলবাড়ি থানা এলাকায়। সুবেদার বােরহান উদ্দিনের নের্তৃত্বে ২ কোম্পানি দুধকুমার নদী ও জয়মনিরহাটের বিপরীত দিকে । সুবেদার ফজলুর রহমানের নের্তৃত্বে এক কোম্পানি পাটগ্রাম এলাকায় নায়েব সুবেদার কলিম উদ্দিনের বাহিনীর সাথে যুক্তভাবে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাঙ্ক ও গােলন্দাজের আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা এসব এলাকায়ও টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে তাদের অধিকাংশই ভারতের সাহেবগঞ্জে আশ্রয় নেয়। ৩০শে মে বাংলাদেশের রণাঙ্গন উত্তরাঞ্চলের পতন ঘটে।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!