You dont have javascript enabled! Please enable it!
কুমিল্লা/ ফেণী
ই.পি. আর ১নং উইং-এর গঠন ও ভূমিকা ১নং উইং ইপিআর-এর অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি মেজর করব আলী। অবাঙালি হয়েও তিনি উইং-এর নির্দোষ বাঙালিদের বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর শিকার হতে দেননি। তার সাধ্যমতাে তিনি বাঙালিদের অন্যত্র যেতে সহায়তা করেছিলেন।
এই উইং-এ চারটি কোম্পানি ও একটি সাপাের্ট প্লাটুন ছিল। কোম্পানিগুলাের অবস্থান ছিল :
১. এক কোম্পানি উইং সদরে।
২. এক কোম্পানি আখাউড়াতে, অধিনায়ক অবাঙালি সুবেদার শের মােহাম্মদ
৩. এক কোম্পানি নয়নপুরে, অধিনায়ক একজন বাঙালি সুবেদার।
৪. এক কোম্পানি পরশুরামে, অধিনায়ক একজন বাঙালি সুবেদার | ১নং উইং- এর সহকারী অধিনায়ক ছিল অবাঙালি ক্যাপ্টেন ফারুকী। সুবেদার মেজরও ছিল একজন অবাঙালি । কোম্পানি অধিনায়কদের অধিকাংশ ছিল বাঙালি এবং প্লাটুন অধিনায়করা প্রায় সবাই ছিলেন বাঙালি।  ২৫শে মার্চে ঢাকায় ই.পি. আর পিলখানা সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ সদরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার খবর ২৬শে মার্চ দাবানলের মতাে সমস্ত কোম্পানি এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে ই.পি. আর বাহিনী উত্তেজিত হয়ে পড়ে। কিন্তু উইং অধিনায়ক মেজর করব আলীর পিতৃসুলভ ব্যবহার ও সান্ত্বনামূলক আশ্বাসবাণীতে সদরের শতাধিক বাঙালি ই.পি.আর কে নিরস্ত্র রাখতে সমর্থ হন। কিন্তু সীমান্তের বাঙালি ই.পি. আর, সৈনিকগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরােধে এগিয়ে আসে। ২৬শে মার্চ বেলা ১টায় সিঙ্গারবিল বি,ও, পিতে থাকা অবস্থায় নায়েব সুবেদার। গােলাম আম্বিয়া একজন বাঙালি সিগন্যাল সিপাইয়ের কাছ থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর পিলখানা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে কর্নেলবাজারে অবস্থানরত প্লাটুন অধিনায়ক নায়েব সুবেদার মােহাম্মদ হােসেনের সাথে পরামর্শের পর উভয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরার সিদ্ধান্ত নেন। তাদের কোম্পানি সদর ছিল আখাউড়া। অবাঙালি কোম্পানি। অধিনায়ক সুবেদার শের মােহাম্মদ পূর্বেই অবাঙালি ই.পি, আর সৈন্যদের একত্রিত করে সদর অফিসের চারদিকে বাংকার তৈরি করে অস্ত্রশস্ত্র সহ প্রস্তুত থাকতে শুরু করেছিলেন। দুই প্লাটুন অধিনায়ক প্রথমেই কোম্পানি সদর আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন।
নিজ নিজ প্লাটুনের অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে তারা ২৮শে মার্চ। আখাউড়া সিনেমা হলের নিকট একত্রিত হন। কোম্পানি সদরের সব বাঙালি সৈনিকদের অধিকাংশই পালিয়ে এসে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যােগ দেয়। স্থানীয় ছাত্র, শ্রমিক, আনসার, মুজাহিদ এবং পুলিশও এদের সাথে যােগদান করে। ২৯শে মার্চ বিকেল ৫-৩০ টায় বাঙালি ই.পি. আর বাহিনী নায়েব সুবেদার। গােলাম আম্বিয়ার নেতৃত্বে আখাউড়া কোম্পানি সদর আক্রমণ করে। গভীর রাত পর্যন্ত উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় অব্যাহত থাকে। যুদ্ধের পরিস্থিতি বেগতিক দেখে অবাঙালিরা কোম্পানি সদর ছেড়ে পালাবার পথে কিছু ভারত সীমান্তে বি,এস, এফ-এর নিকট আত্মসমপর্ণ করে এবং কিছু গ্রামবাসীদের হাতে করুণভাবে মৃত্যুবরণ করে। এখানে নিরস্ত্র বাঙালি জনতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরােধযুদ্ধে অংশগ্রহণের এক উল্লেখযােগ্য ঘটনার বর্ণনা দেওয়া ঐতিহাসিক কারণেই প্রয়ােজন মনে করছি : আখাউড়া সদর থেকে রাতের অন্ধকারে অবাঙালি সৈন্যদের একটি ছােট্ট দল কুমিল্লা অভিমুখে পালাবার সময় আখাউড়া থেকে প্রায় ৪ মাইল দূরে জনতা তাদের ঘিরে ফেলে। উপায়ান্তর না দেখে তারা একটি মসজিদে প্রবেশ করে জানালা দিয়ে অনবরত গুলি চালিয়ে বেশ কিছু লােককে হত্যা করে। এই অবাঙালি সৈন্যদের বাইরে বের করতে অসমর্থ হয়ে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মসজিদের দরজা পথে কঠিন পাহারা রেখে জনতা মসজিদের ছাদ ছিদ্র করতে থাকে। পরে ঐ ছিদ্র পথে কয়েক বস্তা শুকনাে। মরিচ ভিতরে ঢুকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে দেয়। শুকনা মরিচের জ্বালানী গন্ধে অবাঙালি সৈন্যরা কাশতে কাশতে অস্ত্র ফেলে বাইরে এসে তাদের প্রাণ ভিক্ষা করে। কিন্তু তার অজোশ তখন তুঙ্গে।
স্বাভাবিক ভাবেই উত্তাল জনতার হাতে তাদের করুণ মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনা বর্তমান যুগের রাসায়নিক অস্ত্র যুদ্ধেরই একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দৃষ্টান্ত। এই যুদ্ধে বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ বাঙালি ই.পি, আরদের হস্তগত হয়। ওদিকে ১নং উইং- এর সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন ফারুকী এক প্লাটুনের কিছু । বেশি ই.পি, আর সৈন্য নিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ফেণী শহরে সি, ও অফিসে অবস্থান করছিলেন। ২৫শে মার্চের পর ক্যাপ্টেন ফারুকী অবাঙালিদের সহায়তায় স্থানীয় জনসাধারণের উপর অত্যাচার শুরু করেন। এ সম্পর্কে দৈনিক বাংলার এক নিবন্ধে ফ্লাইট লেফটেনেন্ট আবদুর রউফ বলেন : “ফেণী শহরে অবস্থিত দলটি জনসাধারণের উপর অত্যাচার আরম্ভ করে। এতে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং ২৭শে মার্চ তারা সৈন্য দলটিকে ঘিরে ফেলে। হানাদার বাহিনী গুলি চালিয়ে চারজনকে হত্যা করে এবং ১০ জন আহত হয়।” ২৬/২৭ শে মার্চ ১নং উইং সদর থেকে বাঙালি নায়েব সুবেদার আফতাব উদ্দিন এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শালধর বাজার বি, ও, পিতে নায়েব সুবেদার বাদশা মিয়া ও তার প্লাটুনের সাথে একত্রিত হয়ে ফেণীর দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। ফেণী পৌছে তারা স্থানীয় ছাত্র, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকদের সাহায্যে এক বিরাট বাহিনী গড়ে তােলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এই দল ফ্লাইট লেফটেনেন্ট আবদুর
————-
সাক্ষাৎকার : সুবেদার গােলাম আম্বিয়া, কোম্পানী অধিনায়ক, পীলখানা, ঢাকা।
রউফের নের্তৃত্বে সি, ও অফিসে অবস্থানরত ফারুকীর বাহিনীকে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে ক্যাপ্টেন ফারুকী সহ অধিকাংশ অবাঙালি ই,পি, আর সৈনিক নিহত হয়। ১৬ জন বাঙালি ই.পি, আর সৈনিককে সি, ও অফিস থেকে উদ্ধার করা হয়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র বাঙালিদের হস্তগত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন গােলাম মাওলা, ক্যাপ্টেন মজিবুর রহমান, লেফটেনেন্ট শেখ আহমদ চৌধুরী এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন ইনাম আহমেদ এই বাহিনীর সাথে যােগদান করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের বিপর্যয় : কুমিল্লা ও ফেণীর পতন মুক্তিযােদ্ধাদের এই দলটি ফেণী, বিলােনিয়া ও নােয়াখালীর বিভিন্নস্থানে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। এপ্রিলের প্রথমে বিলােনিয়ায় অবাঙালিদের সাথে এক সংঘর্ষের পর বন্দি বাঙালি সুবেদার মকবুল হােসেনেক উদ্ধার করা হয়। এপ্রিল মাসের ৮/৯ তারিখেই ফ্লাইট লেফটেনেন্ট আবদুর রউফ মেজর জিয়াউর রহমানের নির্দেশে এক কোম্পানি সৈন্য নিয়ে মেজর শামসুদ্দিনের সাহায্যার্থে শুভপুর সেতুতে পৌছেন এবং একই নির্দেশে আরেকটি কোম্পানি ফেণী থেকে লাকসামে যুদ্ধরত ক্যাপ্টেন মাহবুবের সাহায্যার্থে পাঠানাে হয়। এই দুইটি ই,পি, আর ও অন্যান্যের মিলিত কোম্পানিকে, ফেণী থেকে প্রত্যাহারের ফলে ফেণীতে মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি দুর্বল হয়ে যায়। এর ফলশ্রুতিতে ২২শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর প্রবল আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা টিকতে না পেরে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেণী থেকে পশ্চাদপসরণ করে ভারতের বিভিন্ন সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ফেণী শহরের পতন ঘটে। অন্যদিকে ২রা এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশে নায়েব সুবেদার গােলাম আম্বিয়া তার কোম্পানি নিয়ে উজানিশর এবং গঙ্গাসাগরে প্রতিরক্ষা নেন। অবিলম্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাথে সুবেদার আম্বিয়া টেলি যােগাযােগ স্থাপন করেন। খালেদ মােশাররফের পক্ষ থেকে ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) সুবেদার গােলাম আম্বিয়াকে সবরকম সাহায্যেরও আশ্বাস দেন। মুক্তিযােদ্ধাদের এই অবস্থানে ভারী অস্ত্র বলতে একটি মাত্র ভারী মেশিনগান ও কিছু হালকা মেশিনগান ছাড়া আর কিছুই ছিল । ২রা এপ্রিল থেকেই পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমান মুক্তিযােদ্ধাদের এই অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৪ই এপ্রিল বিকেল সাড়ে চারটায় পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক এক বিগ্রেড সৈন্য কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে অগ্রসর হয়ে উজানিশর সেতুর প্রায় দেড়মাইল দক্ষিণে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে ২টি কোম্পানি দুদিক থেকে অগ্রসর হয়ে প্রায় সন্ধ্যার সময় পার্শ্ববর্তী টিলার উপর একত্রিত হয়। ঠিক সে মুহর্তেই ই.পি, আর বাহিনীর মেশিনগান ও এল, এম, জি গুলাে গর্জে ওঠে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায় এখানে প্রায় ৭০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
———–
দৈনিক বাংলা ২৮শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭২।
অবশিষ্টরা পালিয়ে মূলবাহিনীর সাথে মিলিত হয়ে তাদের আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে ই.পি, আর বাহিনীর উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। ১৫ই এপ্রিল পর্যন্ত এই গােলন্দাজ আক্রমণ অব্যাহত থাকে। সেদিনই পাকিস্তানি বাহিনীর অপর একটি দল গঙ্গাসাগর হয়ে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। সুবেদার গােলাম আম্বিয়ার বাহিনী প্রস্তুতই ছিল। অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনী ই পি আর সৈন্যদের ফায়ারিং রেঞ্জের আওতায় আসার সাথে সাথেই মুক্তিযােদ্ধাদের গানগুলাে গর্জে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধাদের এই অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই পাকিস্তানি সেনাদের ভারী অস্ত্রের দাপটে তারা বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে, টেলি যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং গােলা বৃষ্টির মধ্যেই সুবেদার গােলাম আম্বিয়া তার বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসরণ করে ১৬ই এপ্রিল দুপুরে আখাউড়া পৌছুতে সমর্থ হয়। সেখানে তিনি ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিনের সাক্ষাৎ পান। উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে উজানিশর থেকে পশ্চাদপসরণকালে গঙ্গাসাগরের প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত বাহিনীকে খবর দেওয়া সম্ভব হয়নি যার ফলে ১৭ই এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বাত্মক ও সর্বমুখী আক্রমণের মুখে নায়েব সুবেদার আসাদ্দর আলী ও নায়েব সুবেদার মােহাম্মদ হােসেনের বাহিনীর সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা ভেঙে পড়ে। সংখ্যার আধিক্য হেতু পাকিস্তানি সেনারা বাংকারে ঢুকে মুক্তিযােদ্ধাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। কিছু বন্দি হয় এবং বাকীরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচাতে সমর্থ হয়। | ওদিকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি ক্যাপ্টেন মাহবুবের নের্তৃত্বে এপ্রিলের ১৫/১৬ তারিখে জাঙ্গালিয়া নামক স্থানে পাকিস্তানিদের এ্যামবুশ করে বহুসংখ্যক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে। এই ঘটনার উপর আলোকপাত করতে গিয়ে বিগ্রেডিয়ার খালেদ মােশাররফ এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, “কুমিল্লা থেকে এপ্রিল মাসের ১৫/১৬ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরাট এক কনভয় প্রায় ৩০টি গাড়িতে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে লাকসামের দিকে যাচ্ছিল। ক্যাপ্টেন মাহবুবের নের্তৃত্বে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘বি’ কোম্পানির বীর সিপাইরা শত্রুসেনার এই দলটিকে দুপুর ১২টায় জাঙ্গালিয়ার নিকটে এ্যামবুশ করে। এই এ্যামবুশে শত্রু সেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। সংঘর্ষ প্রায় ৫ ঘন্টা স্থায়ী হয়। পাকিস্তানি সেনারা গাড়ি থেকে নেমে এমবুশ পার্টিকে আক্রমণ করার চেষ্টা করে কিন্তু আমাদের সৈন্যদের সাহসিকতা ও কৌশলের কাছে পর্যদস্ত হয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এই সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লে, দিদার যথেষ্ট কৌশল ও রণনিপুণতার পরিচয় দিয়েছিল। ক্যাপ্টেন মাহবুব তার সৈন্যদের নিয়ে রাস্তার পূর্বপার্শ্বে এ্যামবুশ করার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসেছিলেন। যখন। শত্রুদের কনভয় তার এমবুশের মাঝে পড়ে যায় তখনই তিনি তাদের উপর গুলি ছুঁড়তে থাকেন। এতে একটা গাড়ি রাস্তা থেকে এ্যাকসিডেন্ট করে পড়ে যায়। বাকী গাড়িগুলাে থেকে পাকিস্তানি সেনারা লাফালাফি করে নিচে নামার চেষ্টা করে। এতেও তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। যেসব পাকিস্তানি সেনা ভালােভাবে গাড়ি থেকে নামতে
————–
সাক্ষাৎকার : সুবেদার গােলাম আম্বিয়া, কোম্পানী অধিনায়ক, পীলখানা, ঢাকা ।
পেরেছিল তারা রাস্তার ওপারে (পশ্চিম দিকে) গিয়ে একত্রিত হয় এবং ক্যাপ্টেন মাহবুবের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয় । লে, দিদারুল আলম রাস্তার পশ্চিম পার্শ্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য নিয়ে তৈরি ছিল। সে তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানিদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। শত্রু সেনারা দু’দিক থেকে আক্রান্ত হয়ে এবং নিজেদের এত হতাহত দেখে মনােবল একেবারেই হারিয়ে ফেলে এবং তারা ৩/৪ টি গাড়ি ধ্বংসাবস্থায় রেখে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধের ফলে ক্যাপ্টেন মাহবুব ও লে. দিদারুল আলমের সম্মিলিত দলটি ২টি ভারী মেশিন গান, ৬টি হালকা মেশিন গান, ৩০টি রাইফেল আহত ও নিহত শত্রু সেনাদের কাছ থেকে দখল করে। যে বিধ্বস্ত গাড়িগুলাে শত্রুরা ফেলে গিয়েছিল, তা থেকে কয়েক হাজার এ্যামুনিশন উদ্ধার করা হয়। ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন আখাউড়া থেকে ই.পি, আর বাহিনী ও তার ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ১টি কোম্পানি নিয়ে ১৯শে এপ্রিল আখাউড়া বর্ডার আউট পােস্টে পৌছে যান। সেখান থেকে তার নির্দেশক্রমে নায়েব সুবেদার গােলাম আম্বিয়া তার বাহিনী। নিয়ে ইটনাশয়ের নামক গ্রামে ২১শে এপ্রিল প্রতিরক্ষা গঠন করেন।
আবার তার নির্দেশেই ই.পি. আর বাহিনীর এই দলটি ২৭শে এপ্রিল আখাউড়া বর্ডার আউটপােস্টে ফিরে যায় এবং সেখান থেকে ২৮শে এপ্রিল তাদেরকে আজমপুর নামক এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আজমপুর থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি ছােট-খাট গেরিলা আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনাদের সামান্য ক্ষতি করতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনীও তাদের তৎপরতা এবং আক্রমণের গতি বৃদ্ধি করতে থাকে। বাধ্য হয়ে মেজর খালেদ ই.পি, আর এর এই দলটিকে ভারতের নরসিঙ্গর নামক স্থানে চলে যেতে আদেশ করেন। এরপর এই সমগ্র এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ই.পি. আর বাহিনীর অন্যান্য দল সুবেদার হাসান আলী, সুবেদার শাহাবউদ্দিন ও সুবেদার আতাউর রহমানের নের্তৃত্বে বিবিরবাজার, তেলিয়াপাড়া ও অন্যান্য স্থানের প্রতিরােধ যুদ্ধে প্রশংসনীয় অবদান রাখেন, কিন্তু হাতিয়ার ও গােলাবারুদের স্বল্পতা, যােগাযােগ ব্যবস্থার অভাব, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনশক্তির অভাব ইত্যাদি কারণে অবশেষে তাদেরকে ভারত সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নিতে হয়। বিবিরবাজার এলাকায় ই.পি, আর বাহিনীর যুদ্ধ বর্ণনা করতে গিয়ে মেজর খালেদ তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “বিবিরবাজার যুদ্ধে ই.পি, আর-এর জোয়ানরা যথেষ্ট সাহসের পরিচয় দিয়েছে। বিশেষ করে মনে পড়ে একজন নায়েকের কথা; সে শত্রুদের গুলি করতে করতে এত উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল যে, তাদের (শত্রুদের) নিহতের বিপুল সংখ্যা দেখে এক পর্যায়ে “জয়বাংলা” হুংকার দিয়ে দাড়িয়ে পড়ে এবং সেই সময়ে হঠাৎ দুর্ভাগ্যবশত মাথায় গুলি লেগে সে মত্যুবরন করে।পতন ঘটলাে কুমিল্লার ।
————–
সাক্ষাৎকার; বিগ্রেডিয়ার খালেদ মােশাররফ।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!