সিলেট
নিজ শক্তির (Own force) পরিসংখ্যান ই.পি, আর বাহিনীর ২নং সেক্টরের সদর দপ্তর সিলেট যার অধীন ছিল ৩টি উইং। উইংগুলির অবস্থান ছিল-কুমিল্লার কোর্টবাড়িতে ১নং উইং সদর, সিলেট শহরে ৩নং উইং সদর এবং ১২ নং সদর। ৩নং উইং-এর অধীন ৪টি কোম্পানি ছিল ১. ধর্মময় সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে সিন্ধুরখান পর্যন্ত ‘এ’ কোম্পানি, অধিনায়ক সুবেদার ফজল হােসেন। ২. শমসেরনগর বিমান ঘাঁটির রক্ষণাবেক্ষণে ‘বি’ কোম্পানির দুই প্লাটুন, অধিনায়ক সুবেদার ফজলুল হক চৌধুরী এবং এক পাটুন উইং সদরে প্রশিক্ষণরত। গান্ধাইটিলা সীমান্ত থেকে গােজুকাটা সীমান্ত পর্যন্ত ‘সি’ কোম্পানি, অধিনায়ক সুবেদার মজিবুর রহমান এবং ৪. ধােলাই সীমান্ত থেকে লাঠিটিলা পর্যন্ত ‘ডি’ কোম্পানি, অধিনায়ক সুবেদার আবদুল মান্নান উইং সদরে একটি সাপাের্ট প্লাটুনসহ বেশ কিছু বাঙালি সৈন্যের অবস্থান ছিল। উল্লেখযােগ্য যে উইং অধিনায়ক, সহকারী অধিনায়ক এবং উইং সুবেদার মেজর পদগুলিতে অবাঙালিরা নিয়ােজিত থাকলেও কোম্পানিগুলির অধিনায়করা সবাই ছিল বাঙালি। ১২নং উইং সদর ছিল সিলেটের খাদেমনগরে, অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি মেজর জাভেদ বরকত । এর অধীন ৪টি কোম্পানির অবস্থান সিলেট শহরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা (Internal Security) ও অন্যান্য বিশেষ কাজে নিয়ােজিত এ কোম্পানি, অধিনায়ক সুবেদার শমসের খান। (অবাঙালি)। লালখাল সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে কালছাতক সীমান্ত ফাঁড়ি পর্যন্ত ‘বি’ কোম্পানি, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার মজিবুর রহমান। লক্ষীবাজার সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে লুবাছড়া সীমান্ত ফাঁড়ি পর্যন্ত ‘সি’ কোম্পানি, অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার বি, আর, চৌধুরী এবং সােনালীচেলা সীমান্ত এলাকা থেকে বীরেন্দ্রনগর সীমান্ত পর্যন্ত ‘ডি’ কোম্পানি অধিনায়ক বাঙালি সুবেদার নছিবুর রহমান।এই উইং-এর অধিনায়ক, সহকারী অধিনায়ক এবং সুবেদার মেজর সবাই ছিলেন অবাঙালি।
এতদসত্ত্বেও জানা যায় যে অধিনায়কের পরােক্ষ সাহায্যেই এই উইং সদরের। বাঙালি ই.পি, আর সৈনিকরা পালিয়ে গিয়ে সীমান্ত কোম্পানিগুলাের সাথে যােগ দিতে সক্ষম হয়েছিল। লক্ষণীয় যে ই.পি. আর এর সিলেট সেক্টরটিতে সেক্টর কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিন ব্যতিত আর কোনাে বাঙালি অফিসার ছিল না। ক্যাপ্টেন। আলাউদ্দিনকে পাকিস্তানি বাহিনী পঁচিশের রাতেই বন্দি করে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। শত্রু শক্তির (Enemy Force) পরিসংখ্যান শত্রু সৈন্য বলতে সিলেটে অবস্থান করছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পাঞ্জাব। রেজিমেন্টের ৩১তম ব্যাটালিয়ন। তাদের সঙ্গে অন্যান্য রেজিমেন্ট বা কোরের ও কিছু সংখ্যক সৈন্য পরিলক্ষিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর এই ব্যাটালিয়নকে সিলেটের শমসেরনগর, শালুটিকর ও মৌলভীবাজার এলাকায় প্রতিরক্ষা রচনা করে অবস্থান করতে দেখা যায়।
নিজ শক্তির ভূমিকা
সিলেট সেক্টর সদরের বাঙালি ক্যাপ্টেন আলাউদ্দিনকে ২৫শে মার্চের রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক মর্মান্তিকভাবে হত্যার কাহিনী চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। পৌছে যায় এ খবর এবং ঢাকার হত্যাযজ্ঞের খবর সীমান্তের ই.পি, আর বাহিনীর কাছে। ২৯শে মার্চ ১২ নং উইং-এর ‘সি’ কোম্পানি অধিনায়ক সুবেদার বি, আর, চৌধুরীর নির্দেশে তার। অধীন সব বি ও পি’র অবাঙালি সৈন্যদের বন্দি করে কোম্পানির সব বাঙালি সৈন্যরা লক্ষীবাজার নামক স্থানে একত্রিত হয়। সুবেদার চৌধুরী তার কোম্পানি নিয়ে জুরিতে পৌছুলে সেখানে ৩নং উইং-এর সুবেদার আবদুল মান্নান ও সুবেদার মুজিবুর রহমানের সাক্ষাৎ পান। সে সময় সুবেদার আবদুল মান্নান ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মেজর খালেদ মােশাররফের স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগদান এবং তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটি নির্দেশনামা সুবেদার বি, আর চৌধুরীকে দেখান। এদিকে ৩নং উইং ও ১২নং উইং-এর অন্যান্য কোম্পানি অধিনায়কগণও তাদের অধীন সমস্ত অবাঙালি ই.পি.আর সৈনিকদের বন্দি করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৭শে মার্চ ৩নং উইং-এর সুবেদার ফজলুল হক চৌধুরীর কোম্পানি শমসেরনগর বিমান ঘাটিতে প্রতিরক্ষারত পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রথম আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে সিলেট শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়। ঐ দিনই সুবেদার ফজলুল হকের ই,পি, আর। দলটি মৌলভীবাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। রাতে এই দলটির সাথে মৌলভীবাজারে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর দুই প্লাটুন সৈন্যের সংঘর্ষ হয়। এই সাক্ষাৎকার : বি. আর, চৌধুরী, ডি-এ ডি চট্টগ্রাম সেক্টর সদর, চট্টগ্রাম।
সংঘর্ষে ক্যাপ্টেন গােলাম রসুল সহ ২১ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ই,পি, আর বাহিনী একটি ডজ ও একটি জিপ গাড়ি দখল করে। সিরাজুল ইসলাম নামের এক ই.পি, আর সিপাই পাকিস্তানি সেনার গুলিতে নিহত হয়। ২৮শে মার্চ নায়েব সুবেদার মােশাররফ হােসেন এক প্রাটুন নিয়ে আখলিয়ায় অবস্থিত ৩১তম পাঞ্জাবের একটি প্লাটুনকে আক্রমণ করেন কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র পাল্টা আক্রমণে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হন। অন্যদিকে ২৯শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা ১২নং উইং এর সুনামগঞ্জ কোম্পানিকে আক্রমণ করে। কিন্তু ই.পি, আর বাহিনী সুবেদার নছিবুর রহমানের নেতৃত্বে তীব্রভাবে প্রতিরােধ করেন। বেশ কিছুক্ষণ সংঘর্ষের পর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কয়েকজনের মৃতদেহ ফেলে সিলেট চলে যেতে বাধ্য হয়। ই.পি, আর এর একজন শহীদ হয়। ওদিকে ৩১শে মার্চ সকাল ৮টায় ৩১তম পাঞ্জাব ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য হঠাৎ ১২নং উইং-এর সদর দপ্তর খাদেমনগর আক্রমণ করে বসে। উপস্থিত বাঙালি সৈন্যরা প্রতিরােধ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় এবং সদর থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ কয়েকটি অমূল্য জীবন এই আক্রমণে শেষ হয়ে যায়। এদিকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের মেজর খালেদ মােশাররফের নির্দেশে সুবেদার বি,আর, চৌধুরী শালুটিকর বিমানবন্দর আক্রমণের জন্য রওয়ানা হয়ে যান এবং সুবেদার আবদুল মান্নান সুবেদার মুজিবুর রহমান তাদের স্ব স্ব বাহিনী নিয়ে তেলিয়াপাড়া অভিমুখে রওয়ানা করেন।
অধিনায়কদের পরিচিতি ও যুদ্ধে যােগদান
সিলেট ও কুমিল্লা জেলার যুদ্ধের পরবর্তী ঘটনা বর্ণনার পূর্বে এলাকার অধিনায়ক মেজর বালেদ মােশাররফ ও মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের উপর একটু আলােচনা করা অত্যাবশ্যক মনে করছি । ২২শে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত মেজর খালেদ মােশাররফ ঢাকায় ৫৭ তম ব্রিগেডের ব্রিগেড মেজর হিসেবে নিয়ােজিত ছিলেন। ঢাকার সামরিক কর্তৃপক্ষের এক আদেশে উনি কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের উপঅধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ২৪শে মার্চ । কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষের। দূরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনানুসারে মেজর খালেদকে দায়িত্ব গ্রহণের পরই তার অবাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল খিজির হায়াত বাংলাদেশে তথাকথিত নকশালদের অনুপ্রবেশের অজুহাতে ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানিসহ শমসেরনগর পাঠিয়ে দেন। এদিকে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের একটি কোম্পানি মেজর শাফায়াত জামিলের অধিনায়কত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে অবস্থান করছিল এখানে মেজর শাফায়াতের সাথে মেজর খালেদ নানা বিষয় নিয়ে আলাপ আলােচনার পর আবার শমসেরনগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। ২৫শে মার্চের কালরাতে তিনি শমসেরনগরেই ছিলেন। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর হামলার খবর তিনি ২৬শে মার্চ অবগত হন। বেতার মারফত মেজর শাফায়াতের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে। সাক্ষাৎকার : সুবেদার মেজর ফজলুল হক চৌধুরী, ৪নম্বর উইং চুয়াডাঙ্গা।
ভালােচনা শেষে মেজর খালেদ এক ঘণ্টার মধ্যেই তার সিদ্ধান্ত মেজর শাফায়াতকে জ্ঞানবেন বলে আশ্বাস দেন। মেজর শাফায়াত ব্যাটালিয়নের বাকী অংশসহ স্বয়ং ধনক লেকর্নেল খিজির হায়াতের ব্রাহ্মণবাড়িয়া আগমনের সংবাদ জানালে মেজর খালেদ তাকে খুব সাবধানে থাকবার উপদেশ দিয়ে বললেন যে খুব শিগগিরই তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে রওয়ানা হচ্ছেন। | মেজর খালেদ শমসেরনগর ই.পি, আর এর পরিবর্তে ৩১তম পাঞ্জাবের কিছু সৈনাকে টহল দিতে দেখেন। একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেনের সাথে আলােচনায় তিনি মৌলভীবাজারে রেজিমেন্টের একটি ছাউনির কথা জানতে পারেন। ঢাকায় পাকিস্তানিদের বর্বর হামলা, আকাশবাণীতে বাংলাদেশর গৃহযুদ্ধের খবর, ই.পি. আর এর পরিবর্তে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের উপস্থিতি ইত্যাদি ঘটনা বিশ্লেষণ করে পাকিস্তানিদের দূরভিসন্ধি বা কু-মতলবের উপর তার মনে আর কোনাে সন্দেহের অবকাশ থাকলাে। একঘন্টার মধ্যে তিনি মেজর শাফায়াতকে তার বিদ্রোহের সিদ্ধান্তের কথা জানালেন যে কোনও পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে শাফায়াতকে আদেশ দিয়ে তিনি তার কোম্পানি সহকারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে রাতের অন্ধকারে রওয়ানা করেন। ২৭শে মার্চের ভাের বেলায় শেষ বেতার সংযােগে মেজর শাফায়াত মেজর খালেদকে জানালেন যে বেলা ১০টার সময় ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক এক বৈঠক ডেকেছেন। উত্তরে খালেদ বলেন, আমার জন্য অপেক্ষা না করে প্রয়ােজনে পাকিস্তানিদের বন্দি করবে।’ এ প্রসঙ্গে দৈনিক বাংলার সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মেজর খালেদ মােশাররফ বলেন, ‘আমার জন্য অপেক্ষার প্রয়ােজন নেই। তুমি তােমার কাজ কর, আমি কাছে এসে গেছি।’ এই নির্দেশ অনুযায়ী ঠিক ন’টায় খিজির হায়াত খান এবং অন্যান্য পাঞ্জাবিদের গ্রেফতার করে শাফায়াত বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেন। মেজর শাফায়াত জামিল ২৭শে মার্চ অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে তার অধিনায়ক। লে. কর্নেল খিজির হায়াত খানসহ অন্যান্যদের বন্দি করলেন। পরবর্তীকালে মেজর বালেদ এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘দশটা বাজবার দশ মিনিট আগে কর্নেল। খিজির হায়াত, মেজর নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন আমজাদ কন্ফারেন্সে বসেছিলেন।
এমতাবস্থায় মেজর শাফায়াত জামিল, লে, কবীর ও লে, হারুন হঠাৎ সেই কামরায় প্রবেশ করেন এবং পাঞ্জাবি অফিসারদের তাদের অস্ত্র সমর্পণ করার নির্দেশ দেন। মেজর নেওয়াজ যিনি একজন কমান্ডাে ছিলেন, তিনি কিছুটা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু লে. হারুনের ত্বরিত হস্তক্ষেপে তার সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং সমস্ত পাঞ্জাবী অফিসারদের তারা গ্রেফতার করেন। ইতােমধ্যে বাকী বঙ্গ -শার্দুলরা বাইরে যেসব পাস্তাৰি সৈনিক ছিল, তাদের নিরস্ত্র করে এবং চরম শাস্তি প্রদান করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শত্রুমুক্ত করে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানাে হয়। সেদিন ছিল ২৭শে মার্চ ১৯৭১’। মেজর খালেদ মােশাররফ ২৭শে মার্চ বেলা ২টার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌছে ৪র্থ। ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। তার পরপরই তিনি বেতারে বিভিন্ন স্থানে খবর দৈনিক বাংলা ২৬শে মার্চ ১৯৭২পাঠাতে থাকেন । সীমান্তের ই.পি, আর বাহিনীর সাথেও যােগাযােগ করেন, যার ফলে সিলেট সেক্টরের সমস্ত ই.পি, আর এর কিছু সংখ্যক মেজর খালেদের অধীনে এবং কিছু সংখ্যক মেজর চিত্তরঞ্জন দত্তের অধীনে চলে যায়। * মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের (এফ, এফ, রেজিমেন্ট) একজন সিনিয়র মেজর। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাস থেকে তিনি ৩ মাসের ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে এসে নিজ বাসস্থান হবিগঞ্জে দুটি ভােগ। করছিলেন। ২৬শে মার্চ অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল আবদুর রব এম, সি, এ, মানিক চৌধুরী এম, সি-এ, আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ, ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকদের একত্রিত করে সামান্য যে কয়টি ৩০৩ রাইফেল সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন তাই দিয়ে সিলেট শহরকে শত্রুমুক্ত করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যুদ্ধ পরিচালনার ভার দিলেন মেজর দত্তকে আর নিজেরা নিলেন রসদপত্র অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ ও যােগযােগ রক্ষা। ইত্যাদির দায়িত্ব। মেজর দত্ত উপস্থিত আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্রদের হাতে ৩০৩ রাইফেল তুলে দিয়ে সিলেটের পথে অগ্রসর হলেন। ই.পি, আর বাহিনীর সীমান্ত চৌকিগুলিকে খবর পাঠালেন যার ফলে সিলেট সেক্টরের ই.পি. আর সৈনিকরা ক্রমশ মেজর দত্তের সঙ্গে যােগ দিতে থাকে।
মেজর দত্ত ও তার বাহিনীর অগ্রাভিযান
১লা এপ্রিল মেজর দত্ত রশীদপুর থেকে তার সমর-সদর স্থানান্তরিত করার প্রাক্কালে তার বাহিনীর সাথে নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। আধুনিক মারণাস্ত্র থাকা সত্ত্বেও মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সাথে হাজার হাজার লােকের “জয়বাংলা’ ধ্বনিতে ভীত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করে। ঐ দিনই মেজর দত্ত মৌলভীবাজারে। বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ই.পি. আর বাহিনীর সৈনিক নিয়ে পুরাে বাহিনীকে পুনর্গঠিত করেন। নয়নপুর থেকে পিছনে এসে পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ২ প্লাটুন শেরপুর-শাদীপুর প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে। সিলেট আক্রমণের জন্য এই দুটি স্থানই ছিল সামরিক দিক। দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। তাই এ দুটি স্থানকে দখল করার উদ্দেশ্যে মেজর দত্ত তার বাহিনীকে ৩টি কলামে ভাগ করে ৪ঠা এপ্রিল রাতে নৌকায় নদী পার হয়ে। শেরপুরের দিকে অগ্রসর হয়ে ৫ই এপ্রিল ভাের ৫টায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীও তাদের মেশিনগান ও মর্টারের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ। করে ঘরবাড়ি ও গ্রামবাসীদের প্রভূত ক্ষতিসাধন করে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত স্থায়ী এই সংঘাতে পাকিস্তানি বাহিনীর অধিকাংশ নিহত হয় এবং কিছু কিছু পালাতে গিয়েও গ্রামবাসীদের হাতে নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদেরও ৩জন শহীদ ও বেশ কিছু আহত হয়। সেদনিই শাদীপুর মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
* সাক্ষাৎকার : ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, পি এস সি, বীর উত্তম। দৈনিক বাংলা, ২৬শে মার্চ ১৯৭২
ইতােমধ্যে মেজর চিত্তরঞ্জনের অনুরােধক্রমে মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও সংসদ সদস্য, প্রাক্তন সেনাবাহিনী প্রধান) কর্তৃক প্রেরিত ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সৈন্য ক্যাপ্টেন আজিজের নের্তৃত্বে। এসে উপস্থিত হলে মেজর দত্ত তাদেরকে সুরমা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে বললেন। ক্যাপ্টেন আজিজ তার বাহিনী নিয়ে কদমতলী নামক স্থানে এলে। পাকিস্তানি সেনারা আকস্মিকভাবে তাদের আক্রমণ করে, কিন্তু ইস্ট বেঙ্গল বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা কদমতলী ছেড়ে সিলেট শহরে চলে যায়। ক্যাপ্টেন আজিজ অগ্রসর হয়ে সুরমা নদীর দক্ষিন পাড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। এদিকে মেজর দত্ত তার বাহিনী নিয়ে শাদীপুর হয়ে সিলেটের পথে অগ্রসর হন। বিশ্বনাথ নামক স্থানে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জানতে পেরে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ করে । পাকিস্তানি বাহিনী মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করেও টিকে থাকতে ব্যর্থ হয় এবং রাতের অন্ধকারে সিলেট চলে যায় । এই যুদ্ধে শত্রুরা সমস্ত শক্তি ব্যবহার করেছিল কিন্তু তাদের মনােবল ভেঙে গিয়েছিল। রাতের অন্ধকারে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে ওরা। টিকে থাকতে ব্যর্থ হয়ে বিশ্বনাথ ছেড়ে পালিয়ে একেবারে সিলেট চলে গেল। ৭ই এপ্রিলের মধ্যে সিলেট বিমানবন্দর এবং লাক্কাতুরা চা বাগানের নিকটবর্তী স্থান ব্যতিত সমগ্র জেলা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
মুক্তিযােদ্ধাদের বিপর্যয় ও সিলেটের পতন
৬ই এপ্রিল খাদেমনগরে সুবেদার বি, আর, চৌধুরীর বাহিনী এবং লালকাজী নামকস্থানে সুবেদার নছিবুর রহমানের বাহিনীর উপর পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর জঙ্গী বিমান একই সঙ্গে ব্যাপক হামলা চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধা নিরীহ জনতার ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। ৮ই এপ্রিল মেজর দত্ত ভারত গিয়েছিলেন। সেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই পাকিস্তানি বাহিনী শালুটিকর বিমান বন্দর ও লাক্কাতুরা এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর হামলা চালাতে থাকে। ১০ই এপ্রিল বিকেলে পাকিস্তানি বাহিনী খাদেমনগরে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধাদের উপর যুগপৎ স্থল ও বিমান হামলা চালায়। সে তুলনীয় মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ছিল অপ্রতুল। ফলে রাতের অন্ধকারে পশ্চাদপসরণ করে তারা হরিপুরে প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে অন্য দিকে সুবেদার নছিবুর রহমান এবং সুবেদার মুজিবুর রহমানের বাহিনীও হরিপুরে একত্রিত হয়। ওদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অব্যাহত আক্রমণে ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের ক্যাপ্টেন আজিজের কোম্পানি মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যত্র চলে যায়। এদিকে হরিপুরে সুবেদার বি, আর, চৌধুরী, মুজিবুর রহমান, নূরুল হক, নছিবুর রহমান প্রমুখের বাহিনীকে পুরােপুরি পুনর্গঠিত হবার সুযােগ না দিয়েই পাকিস্তানি বাহিনী জঙ্গী। বিমানের সাপাের্ট সহকারে আর্টিলারি, মটার ও মেশিনগান দ্বারা ৩দিক থেকে অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। সেই তুলনায় মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র ছিল অতি নগণ্য। সুতরাং পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের ধার সহ্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব হলাে না। বাধ্য হয়ে।
বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চাদপসরণ করতে হল। এই আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক ক্ষতি হল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার নূরুল হক ও ই.পি, আর হাবিলদার আতাউর রহমান সহ ২০ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। অল্পদিনের ট্রেনিংপ্রাপ্ত বেশ কয়েকজন বেসামরিক যােদ্ধাও শাহাদাৎ বরণ করেন। এই চরম ক্ষতি স্বীকার করেও মুক্তিযােদ্ধারা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আবারাে তামাবিল নামক স্থানে একত্রিত হতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন মােতালেব, সুবেদার বি, আর, চৌধুরী, মুজিবুর রহমান, নছিবুর রহমান প্রমুখ একত্রিত হয়ে বাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে থাকেন। ক্যাপ্টেন মােতালেব পুরােবাহিনীকে তিন কোম্পানিতে ভাগ করে শ্রীপুর, প্রতাপপুর ও জাফলং এলাকায় প্রতিরক্ষার নির্দেশ দেন। কিন্তু পাকিস্তানিবাহিনী এসব স্থানের সন্ধান পেয়ে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সব ক’টি অবস্থানের উপর সর্বাত্মক আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে টিকে থাকতে ব্যর্থ। হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের সুখ্য পুঞ্জি’ নামক স্থানে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।
ওদিকে তেলিয়াপাড়াতে মেজর খালেদ মােশাররফ ৩০/৩১শে মার্চ ই.পি. আর, আনসার, মােজাহিদ, পুলিশ, অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিভােগরত সৈনিক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্যদের মিলিয়ে এক বিরাট বাহিনীকে কোম্পানি গ্রুপে পুনর্গঠিত করে বিভিন্ন স্থানের প্রতিরক্ষায় পাঠিয়ে দেন : ১. ক্যাপ্টেন নাসিমের নের্তৃত্বে সুবেদার মান্নান এক কোম্পানি নিয়ে আশুগঞ্জ। ২. সুবেদার ফরিদের নের্তৃত্বে এক কোম্পানি শােভাপুর সেতু এলাকা। ৩. সুবেদার মুজিবুর রহমান এক কোম্পানি নিয়ে তেলিয়াপাড়া এবং ৪. মেজর খালেদ মােশাররফ এক কোম্পানি নিয়ে নিজেই বিলােনিয়া। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন নাসিম বর্তমানে (অবসরপ্রাপ্ত লে. জেনারেল ও সাবেক সেনাপ্রধান) এবং সুবেদার মান্নান ঢাকা থেকে পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রসর প্রতিরােধকল্পে আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা নেন। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই পাকিস্তানি বাহিনী। গান-বােট, আর্টিলারি ও মর্টারের সাহায্যে এবং জঙ্গী বিমানের সাপাের্ট সহকারে ব্যাপকভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর এই ব্যাপক আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। তারা শাহবাজপুরে পূণরায় প্রতিরক্ষা গড়ে তােলে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা শাহবাজপুর আক্রমণ করলে সেখানেও টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধারা ১৫ই এপ্রিল মাধবপুর নামক স্থানে প্রতিরক্ষা গ্রহণ করে। এ সময় তেলিয়াপাড়া থেকে ছুটি ভােগরত আর্টিলারির ক্যাপ্টেন মতিন এবং ই,পি, আর সুবেদার মুজিবুর রহমান এক কোম্পানি নিয়ে মাধবপুরের প্রতিরক্ষা মজবুত করতে ছুটে আসেন। ক্যাপ্টেন মতিন নিজে অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী মাধবপুর আক্রমণ করে বসে। ক্যাপ্টেন মতিন ই.পি,আর, বাহিনীকে নিয়ে টিকে থাকবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ২৮শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা মাধবপুর দখল করে নেয়। ক্যাপ্টেন মতিন তার বাহিনীকে প্রত্যাহার সাক্ষাৎকার : সুবেদার মুজিবুর রহমান, ৬ নম্বর উইং যশাের।
করে ইটাখােলা নামক স্থানে প্রতিরক্ষা গঠন করেন। মুক্তিযােদ্ধারা ইটাখােলাতেও টিকতে না পেরে তেলিয়াপাড়া চলে আসে। এখানে ক্যাপ্টেন মতিন নিজ বাহিনী ও অন্যান্য উইং থেকে আগত ই.পি, আর সৈনিক নিয়ে কয়েকটি কোম্পানিতে বিভক্ত করে শক্ত প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী তেলিয়াপাড়াতে বারবার আঘাত হেনেও মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি থেকে সরাতে ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে জুলাই মাসের শেষভাগে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ও সর্বাত্মক আক্রমণে টিকতে অসমর্থ হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা ভারতের সিমনা নামক স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করে। পুরােপুরিভাবে সিলেটের পতন ঘটে।
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী