You dont have javascript enabled! Please enable it!
কুমিরা এমবুশ
২৬শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর ৫৩তম ব্রিগেড কুমিল্লা থেকে ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নির্দেশে এফ এফ রেজিমেন্টের ২৪নং ব্যাটালিয়ন লে, কর্ণেল শাহপুর খানের অধিনায়কত্বে চট্টগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির উদ্দেশে রওয়ানা হয়ে যায়। পরস্পর জানা যায় ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি এই দলের সাথে ছিলেন। কুমিল্লা থেকে সিগন্যাল বিভাগের মেজর এম এইচ বাহার চট্টগ্রাম এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন রফিককে এ খবর জানিয়েছিলেন। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন রফিক। একজন জে, সি, ও’র নের্তৃত্বে (পরে জানা যায় সে জেসিও ছিলেন না: সুবেদার মুসা) হালিশহর থেকে এক কোম্পানি সৈন্য পাকিস্তানি বাহিনীকে বাধা দেবার জন্য পাঠিয়ে দেন। ওদিকে পাকিস্তানি বাহিনী বিনা বাধায় শুভপুর সেতু অতিক্রম করে তীব্র গতিতে। চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছে জানতে পেরে রামগড় থেকে ই.পি. আর বাহিনীর কিছু সৈন্য কুমিরা নামক স্থানে এসে প্রতিরক্ষা রচনা করে। এদিকে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তান বাহিনীর অগ্রসর হবার খবর পেয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের হােল্ডিং কোম্পানির অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এম, এস, এ, ভূঁইয়া ক্যাপ্টেন রফিকের পরামর্শক্রমে কিছু ই,পি, আর সৈন্য সহকারে কুমিরার দিকে অগ্রসর হন। কুমিরা পেীছেই ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া সমগ্র ই.পি, আর বাহিনীকে সংঘবদ্ধ করে তাদের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন এবং তড়িৎগতিতে তার প্রতিরক্ষাস্থান নিরূপন করে পাকিস্তানি বাহিনীর অপেক্ষায় এমবুশ পজিশন গ্রহণ করেন। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যার সময় পাকিস্তানি এফ, এফ বাহিনী ই.পি, আর বাহিনীর মারণাওতায় পৌছে গেলে পরিকল্পনানুসারে ই.পি. আর বাহিনীর সবগুলাে গান একসঙ্গে গর্জে ওঠে। অতর্কিত ও অনভিপ্রেত এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। কুমিরা সংঘর্ষের উপর ক্যাপ্টেন ভূইয়ার (বর্তমান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস’এর বর্ণনা উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন :  “২৪নং এফ এফকে প্রতিহত করার জন্য কুমিল্লার দিকে অগ্রসর হলাম। বেঙ্গল রেজিমেন্ট আর ই, পি, আর-এর মাত্র ১০২ জন যােদ্ধা সমবায়ে গঠিত দল নিয়ে এই অভিযানে আমরা বের হলাম। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিমা হানাদার সৈন্যদের মােকাবেলা করার জন্যে আমাদের সম্বল মাত্র ১টি এইচ, এম, জি, কয়েকটি এল, এম, জি, আর বাকী সব রাইফেল। এত অল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে পুরাে একটি সুসংগঠিত ব্যাটালিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ঝুঁকি যে কি বিরাট এবং তার পরিণাম যে কি মারাত্মক।
হতে পারে সেদিন তা আদৌ উপলব্ধি করতে পারিনি। সন্ধ।’ তখন ৬টা। আমরা কুমিরা পৌছে গেলাম। শত্রুকে বাধা দেওয়ার জন্যে স্থানটি খুবই উপযুক্ত বিবেচিত। হল। পথের ডানে পাহাড় এবং বাম দিকে আধমাইল দূরে সমুদ্র। শত্রুর ডানে এবং বামে প্রতিবন্ধকতা আছে। শত্রুকে এগুতে হলে পাকা রাস্তা দিয়েই আসতে হবে। তাই সেখানেই পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি যেখানে পজিশন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেই তার পিছনে একটি খাল ছিল। ঐ খাল থেকে পাঁচ ছ’ গজ সামনে অর্থাৎ উত্তরদিকে আমি পজিশন নিই। খালটা একটা পদাতিক বাহিনীর জন্য তেমন একটা বাধা নয়। তবু এ’টা পিছনে রাখলাম। উদ্দেশ্য ছিল, যদি বর্তমান অবস্থান শত্রু আমাদেরকে ছাড়তে বাধ্য করে তখন খালের পাড়ে পজিশন নিতে পারবাে। এটা ছিল আমার বিকল্প পরিকল্পনা। জমিনের স্বরূপ দেখে কয়েক মিনিটের মধ্যে পরিকল্পনা তৈরি। করে নিলাম। আমার তিনজন প্লাটুন কমান্ডারকে ডেকে খুব সংক্ষেপে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম এবং নিজ নিজ স্থানে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পজিশন নেওয়ার নির্দেশ দিলাম। আমার নির্দেশ অনুযায়ী এইচ এম জি’টা ডান পাশে পাহাড়ের ঢালুতে ফিট করা হল।
স্বয়ং ই.পি. আর সুবেদার মুসা ভারী মেশিন-গানটির সঙ্গে রইলেন। কারণ এই ভারী মেশিন-গানটিই আমাদের প্রধান হাতিয়ার এবং সবচেয়ে বড় সম্বল। আমি বামদিকের কয়েকটি এল এম জি পজিশন ঠিক করে দিলাম। আমার নির্দেশ মতাে সবাই মাটিতে পজিশন নিয়ে নিল। পজিশনের অবস্থাটা ছিল অনেকটা ইংরেজি ‘ইউ’-এর মত। অর্থাৎ ডানে বায় এবং পিছনে আমাদের সৈন্য। যেদিক থেকে শুক্র এগিয়ে আসছে কেবল সেই সামনের দিকটা সাড়াশীর হা-য়ের মতাে ভােলা।”  ক্যাপ্টেন ভূঁইয়ার অবস্থান থেকে ৮০ থেকে ১০০ গজ দূরে বড় বড় গাছ কেটে পথে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনী ব্যারিকেডের কাছে এসে গাড়ি থেকে নেমে ব্যারিকেড সরাতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন ভূঁইয়া তাঁর গ্রন্থে এ ব্যাপারে লিখেছেন : “সন্ধ্যা তখন সােয়া সাতটা। শত্রুরা যখন ব্যারিকেড সাফ করতে ব্যস্ত অমনি সময়ে আমাদের ডান দিকে ভারী মেশিন গানটি গর্জে উঠলাে। শুরু হলাে শত্রু নিধন পালা। চারদিক থেকে কেবল গুলির আওয়াজই শােনা যেতে লাগলাে। ভারী মেশিনগানটি থেকে তখন মাঝে মাঝে ট্রেসার রাউণ্ড বের হচ্ছে। আকস্মিক আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক ছােটাছুটি করতে থাকে। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন: প্রায় ২০ জনের মতাে পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং তিনটিরও অধিক গাড়ি ধ্বংস হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রাথমিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে পিছু হটে ই. পি, আর বাহিনীর উপর মেশিনগান, মর্টার এবং আর্টিলারি । থেকে অবিশ্রান্ত গােলা বর্ষণ করতে থাকে।
দু’ঘণ্টার সংঘর্ষে পাকিস্তানি সেনারা ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হঠতে বাধ্য হয়।
————–
মেজর এম এস এ ভুইয়া : মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ. ২২ ও ২৩
মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদের স্বল্পতা দেখা দিলে অগ্রবর্তী স্থান থেকে এ্যামুনিশন সরবরাহের জন্য বারবার তাগিদ আসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ভূইয়া অনেক চেষ্টা করেও গােলাবারুদ সগ্রহ করতে না পেরে চট্টগ্রাম শহরের দিকে এ্যামুনিশন সগ্রহের জন্য রওয়ানা হলেন। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থার জন্য তিনি আর কুমিরা ফিরে আসতে পারেনি। কুমিরা রণাঙ্গন তখন অফিসার শূন্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীও চাপ অব্যাহত রাখলাে। মুক্তিযােদ্ধারা তীব্রভাবে জনশক্তির, স্বল্পতা গােলাবারুদ ও উপযুক্ত অফিসারের অভাব বােধ করতে লাগলাে। তবুও তারা অটুট মনােবল নিয়ে তাদের পজিশন আঁকড়ে থাকবার চেষ্টা করে। ক্যাপ্টেন ভূইয়া যুদ্ধের ফলাফল সম্পর্কে লিখেছেন, ২৬ তারিখের রাতেই শত্রুবাহিনীর কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল শাহপুর ও একজন লেফটেনেন্টসহ ১৫২ জন সাধারণ সৈনিক প্রাণ হারায়। আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের ১৪ জন। বীর সৈনিক শাহাদাৎ বরণ করেন। | এই সংঘর্ষের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ক্যাপ্টেন (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত মেজর) রফিক তার বই,: A Tale of Millions-এর ৮১ পৃষ্ঠায় বলেছেন, “This ambush by the E.P.R. troops at Kumira was the first direct action against the enemy in the history of our liberation war.” [ই, পি, আর বাহিনী কর্তৃক কুমিরায় স্থাপিত এই এমবুশটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম মুখােমুখি যুদ্ধ হিসাবে চিহ্নিত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৪ এফ এফ ব্যাটালিয়ন সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হলেও তারা মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যুহ ভেদ করবার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। অবশেষে ২৭শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য করে। মুক্তিযােদ্ধারা কুমিরা ছেড়ে ভাটিয়ারী এবং তারপর ২৮শে মার্চ নায়েব সুবেদার আবদুর রউফের নের্তৃত্বে ফৌজদার হাট এলাকায় পজিশন নেয়। সেদিনই ই. পি. আর বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সেনাদের এক মুখােমুখি সংঘর্ষ হয় এবং তাতে ই, পি, আর বাহিনীর ৪ জন নিহত ও ২জন আহত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রগতি রােধ করা সম্ভব হয়নি। | এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ২৪ এফ এফ ব্যাটালিয়ন ডপুর সেতু বিনা বাধায়। অতিক্রম করার সময় সেতু রক্ষার জন্য এক প্লাটুন সৈন্য রেখে যায়। ই. পি, আর বাহিনীর সুবেদার আবদুল জব্বার তার বাহিনী নিয়ে কয়েক বার চেষ্টা করেও সেতু পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। ২৮শে মার্চ মেজর শামসুদ্দিন সন্ধ্যার সময় পাকিস্তানিদের উপর হামলা চালিয়ে শুভপুর সেতু নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে সমর্থ হন। এই সংঘর্ষে পাকিস্তানি প্লাটুন নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, মুক্তিযােদ্ধাদের হাবিলদার হাশেম শহীদ হন।
ওদিকে ক্যাপ্টেন রফিক ২৮ তারিখে শহরের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধরত তার বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য কালুরঘাটে অবস্থানরত ৮ম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মেজর জিয়াউর রহমানকে অনুরােধ করে। জানা যায়, মেজর জিয়াকে শহরে ফিরিয়ে আনার জন্য আওয়ামী লীগ নের্তৃবর্গও গােমদণ্ডি রেল স্টেশনের কাছে মেজর জিয়া, মেজর শওকত
—————
মেজর এম এস এ ভূইয়া : মুক্তিযুদ্ধে নয় মাস, দ্বিতীয় সংস্করণ, পৃ. ২৮
প্রমুখের সাথে সাক্ষাৎ করেন। কিন্তু তার সৈন্যদল তখনাে অসংগঠিত, তাদের সংগঠিত করেই তিনি শহরে ফিরে আসবেন এই আশ্বাস দিয়ে মেজর জিয়া তাদের ফিরিয়ে দেন। এরপর ক্রমশ অবস্থা পাকিস্তানি সেনাদের অনুকূলে চলে যাওয়ায় মেজর জিয়া বা তার বাহিনীর কেউ শহরে ফিরে আসতে পারেনি। ২৮শে মার্চ পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রাম শহরের মধ্যস্থলে অবস্থিত সার্কিট হাউসে তাদের সদর দপ্তর স্থাপন করতে সমর্থ হয়। ঐ দিন কুমিরা থেকে অগ্রসরমান ২৪ এফ এফ ব্যাটালিয়নও চট্টগ্রামে পাকিস্তানি সেনা। সদরের সাথে যােগাযােগ করতে সমর্থ হয়। ই.পি, আর বাহিনী হালিশহরের মধ্যেই যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন রফিক কোনাে স্থান থেকে সাহায্য না পেয়ে সাহায্যের আশায় এ সময় ভারতে চলে যান। ফলে ৩১ শে মার্চ যখন সকাল ৭ টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক ব্রিগেড সৈন্য ট্যাঙ্কসহ হালিশহর কাচা সড়ক জংশনের ই. পি, আর ব্যুহ ভেদ করে বেলা ২টা নাগাদ জঙ্গী বিমান, ট্যাঙ্ক ও আর্টিলারি সহকারে ই, পি, আর কেন্দ্রস্থল হালিশহর আক্রমণ করে, তখন ঐ প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধ পরিচালনা করতে তিনি উপস্থিত ছিলেন না। ঐ দিন বেলা ২ ঘটিকায় হালিশহরের পতন ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের বুলেটে ১৫ জন ই, পি, আর সৈন্য প্রাণ হারায় এবং বহু আহত হয়। এখানে উল্লেখযােগ্য যে ২৫শে মার্চ থেকে ৩১ শে মার্চ চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্রজনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ইপিআর বাহিনীর সাহায্যে এগিয়ে আসে। চট্টগ্রাম রিজার্ভ পুলিশ, লালখান বাজার পুলিশ লাইনের পুলিশও সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ নের্তৃবর্গ এম, আর, সিদ্দিকী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, আবদুল হান্নান, ডা. জাফর প্রমুখের অক্লান্ত পরিশ্রম, ত্যাগ ও সক্রিয় সহযােগিতার কথা যারা জানেন তারা তাদের চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবেন।
ই.পি. আর চট্টগ্রাম সেক্টরের অন্যান্য বাহিনীর ভূমিকা
পঁচিশের রাতে ক্যাপ্টেন রফিকের প্রেরিত সংকেত শব্দ (Code Word)- :BRING SOME WOOD FOR ME” অর্থাৎ আমার জন্য কিছু কাঠ আন, অর্থাৎ ‘অবাঙালিদের বন্দি কর এবং সব রণসম্ভার নিয়ে চট্টগ্রাম রণক্ষেত্রে যােগদান কর, কাপ্তাইতে অবস্থারনত ১৭ নং উইং এর উপ-অধিনায়ক ক্যাপটেন হারুন (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল) পেয়েছিলেন। সংকেত পেয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি সেখানে তার অবাঙালি অধিনায়ক মেজর পীর মােহাম্মদ, অন্যান্য অবাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের বন্দি করে ঐ রাতেই চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওয়ানা করেন। ২৭শে মার্চ তিনি। তার ই. পি. আর সৈন্যদের নিয়ে যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৭/৮ মাইল দূরে এসে পৌছেন, তার পরবর্তী ঘটনাগুলাে সম্পর্কে ক্যাপ্টেন হারুন তার সাক্ষাৎকারে বলেন : | “আমি যখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ৭/৮ মাইল দূরে ছিলাম তখন দেখলাম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সৈন্য পটিয়ার দিকে দৌড়াচ্ছে। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করেছে এবং মেজর জিয়াসহ ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করেছে। তারা পটিয়াতে একত্রিত হবে। আমি আরাে কিছুদূর অগ্রসর হলে মেজর জিয়ার সাক্ষাৎ পাই। তিনি বললেন, আমরা ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পটিয়ায় একত্রিত হবাে, তারপর শহরে এসে আবার পাল্টা আক্রমণ চালাবাে। তিনি আমাকে তার সঙ্গে থাকতে বললেন। আমি মেজর জিয়ার সঙ্গে থেকে গেলাম এবং পরবর্তীকালে তার কমান্ডে কাজ করি।”
টেকনাফ থেকে সুবেদার মফিজুল বার তার এক কোম্পানি ই.পি,আর সেনা সহকারে ২৭শে মার্চ পটিয়া এলাকায় পৌছুলে মেজর জিয়ার নির্দেশে তিনি সেখানে থেকে যান এবং তার অধীনে কাজ করতে থাকেন। ১৭নং উইং এর রাঙ্গামাটিস্থ ‘এ’ কোম্পানির অধিনায়ক সুবেদার (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ডি.এ.ডি) আব্দুল গণি বিদ্রোহের খবর পেয়ে সব অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে জেলা প্রশাসকের নিকট হস্তান্তর করে অবশিষ্ট সৈন্য সহকারে ২৬শে মার্চ রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছেন। তিনি নতুনপাড়া সেনানিবাস থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানকে রােধ করার জন্য সেনানিবাসের উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থান নেন। ২৮শে মার্চ দুপুর ১টায় পাকিস্তান। সেনাবাহিনী মর্টার, আর্টিলারি ও বিমানের সাহায্যে সুবেদার গণির অবস্থানের উপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টার তুমুল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু ই,পি, আর প্লাটুন অধিনায়ক নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ ও আরাে ৩ জন শাহাদাৎ বরণ করেন। বহু ই.পি, আর সৈনিক গুরুতর আহত হয়। ৩০শে মার্চ মেজর জিয়ার নির্দেশে সুবেদার গশি তার কোম্পানি নিয়ে কালুরঘাট ওসমানীয়া গ্লাস ফ্যাক্টরি এলাকায় চলে যান।
৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ভূমিকা
পুর্বেই বলা হয়েছে যে পঁচিশে মার্চ ১৯৭১, ৮ম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মাত্র ৩ টি কোম্পানি ষােলশহরে অবস্থান করছিল। ব্রিগেডিয়ার আনসারী ৮ম ইস্টবেঙ্গল। রেজিমেন্টের অধিনায়ক লে. কর্ণেল জানজুয়াকে নির্দেশ দিলেন, All barricades must be cleared at any cost, (যে কোনাে মূল্যেই হােক সব বাধা পরিষ্কার করতে হবে) এই নির্দেশ পেয়ে জানজুয়া ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে ষােলশহর থেকে সেনানিবাস পর্যন্ত সব ব্যারিকেড সরাবার কাজে নিয়ােগ করলেন। হাজার হাজার জনতার বাধা সত্ত্বেও ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা তাদের অধিনায়কের নির্দেশানুসারে ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য হল। সেদিন তারা রাত ৯টার মধ্যে ব্যারিকেড সরানাের কাজ সমাপ্ত করে। এই ব্যাটালিয়নকে ছােট ছােট গ্রুপে বিভক্ত করে রাখার উদ্দেশে এবং বাঙালি অফিসারগণকে সৈনিকদের কাছ থেকে আলাদা করে রাখার, এমন কি সুযােগ মতাে মেরে ফেলার উদ্দেশে জানজুয়া ব্রিগেডিয়ার আনসারীর সাথে পরামর্শ করে ২৫ তারিখ। সন্ধ্যার পর ষােলশহর থেকে ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কোম্পানি সহ মেজর শওকতকে
—————–
সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন বিডি আর লেখক পরিষদ
ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দিলেন। পরে মেজর জিয়াকে বন্দরে রিপাের্ট করার জন্য ষােলশহরে খবর পাঠালেন। ওদিকে রাত ১০টায় কর্নেল জানজুয়া মেজর শওকতকে সঙ্গে করে নৌবাহিনীর একটি ট্রাকে ৫/৬ জন সশস্ত্র অবাঙালি গার্ড নিয়ে ষােলশহরে রওয়ানা হলেন। মেজর শওকত তার নিজ সৈন্যদের সাথে থাকতে চাইলেও তাকে বলতে গেলে জোর করেই নিয়ে যাওয়া হয়। মােলশহরে পৌছে তিনি মেজর জিয়াকে ঐ ট্রাকেই বন্দরে পাঠিয়ে দেন। অপর দিকে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে ‘ডি’ কোম্পানি নিয়ে ট্রানজিট ক্যাম্পে রওয়ানা হতে নির্দেশ দিলেন। ঠিক এমনি সময় টেলিফোনে ক্যাপ্টেন অলি আহমদ স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক-এর ম্যানেজার আবদুল কাদেরের কাছ থেকে ঢাকায় বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্র্যাকডাউনের খবর জানতে পারেন। ক্যাপ্টেন অলির কাছ থেকে মেজর শওকত সব ব্যাপার জানতে পেরে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে ট্রানজিট ক্যাম্পে যেতে নিষেধ করলেন। শহরে কর্তব্যরত লে. মাহফুজ ও লে, শমসের মবিন চৌধুরীকে তাদের বাহিনী নিয়ে ষােলশহর চলে আসার জন্য খবর পাঠালেন এবং মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনবার জন্য ক্যাপ্টেন অলি পশ্চিমা অফিসার ক্যাপ্টেন আহামুদ্দিন ও লে. হুমায়ুনকে বন্দি করলেন। মেজর জিয়া ষােলশহরে ফেরৎ এসে গাড়ি থেকে নেমেই তার সঙ্গের অফিসার ও সৈনিকদের অস্ত্র সমপর্ণে বাধ্য করলেন। তারপরই তিনি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল জানজুয়াকে বন্দি করে নিয়ে এলেন। ইতিমধ্যে ব্যাটালিয়নের অন্যান্য বাঙালি অফিসাররা ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে উপস্থিত হয়।
মেজর জিয়া সব সৈন্যদেরও একত্রিত করে এক ভাষণ প্রদান করেন এবং ব্যাটালিয়নের অধিনায়কত্ব নিজ হাতে গ্রহণ করেন। মেজর জিয়া ৮ম ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়ন নিয়ে পঁচিশের রাতেই রওয়ানা করে ২৬শে মার্চ ভােরে কালুরঘাটে পৌছেন। পূর্বেই বলা হয়েছে যে ২৬ তারিখে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদের নের্তৃত্বে ১৭নং উইং এর, ই,পি, আর বাহিনী কালুরঘাট এসে মেজর জিয়ার সাথে যােগাযােগ করে। তাছাড়া চট্টগ্রামের ই.পি. আর সেক্টরের অধীন সীমান্ত এলাকার যে সকল ই.পি, আর বাহিনী পচিশের রাতে সেক্টর এ্যডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকের। নির্দেশক্রমে চট্টগ্রাম শহরের উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছিল, তারা কালুরঘাট পৌছুলে মেজর জিয়া তাদেরকেও সেখানেই অবস্থান করবার জন্য নির্দেশ দেন। পরবর্তী পর্যায়ে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ই.পি. আর বাহিনীকে মেজর জিয়া তার নিজ কমান্ডে নিয়ে আসেন। এমতাবস্থায় লােকবলের অভাবে ক্যাপ্টেন রফিকের পরিকল্পনানুযায়ী তার সমস্ত বাহিনীকে একত্রিত করে পাকিস্তান বাহিনীকে সমুচিত শাস্তি দিয়ে চট্টগ্রামকে মুক্ত করা। আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২৭শে মার্চ মেজর জিয়া চট্টগ্রাম বেতার, কেন্দ্রের কালুরঘাট ট্রান্সমিটিং সেন্টার থেকে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। কেন্দ্রটিকে প্রথমে বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এবং পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে ঘােষণা দেওয়া হয়। তখন পর্যন্ত কেন্দ্রটি ই.পি. আর বাহিনীর প্রায় ২০০ সৈন্যের তত্ত্বাবধানেই ছিল । তার বেতার ভাষণটি ছিল নিম্নরূপ :
I Major Zia, Provisional. Commander-in-Chief of the Bangladesh Liberation Army, hereby proclaim, on behalf of Sheikh Mujibur Rahman, the independence of Bangladesh. I also declare, we have already framed a sovereign legal Government under Sheikh Mujibur Rahman to function as per law and the constitution. The new democratic Government is committed to a policy of non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and strive for international peace. I appeal to all Government to mobilise public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh. The Government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal Government of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world”* (আমি মেজর জিয়া, বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি, এতদ্বারা শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করছি। আমি আরও ঘােষণ করছি যে আইন ও সংবিধান অনুযায়ী কার্য সম্পাদন করার জন্য আমরা ইতােমধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানের নের্তৃত্বে একটি সার্বভৌম বৈধ সরকার গঠন করেছি। নতুন সরকার জোট-নিরপেক্ষ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আদর্শে বিশ্বাসী। এই সরকার সব জাতির বন্ধুত্ব ও আন্তর্জাতিক শান্তি উন্নয়নে আগ্রহী। বাংলাদেশে বর্বর গণহত্যা রােধে নিজ নিজ দেশে জনমত গঠনের জন্য সব দেশের সরকারের প্রতি আমি আবেদন জানাচ্ছি। শেক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার সার্বভৌম বৈধ সরকার এবং পৃথিবীর সব গণতান্ত্রিক দেশ ও জাতির স্বীকৃতি পাবার অধিকারী। পাকিস্তানি বিমান আক্রমণে বেতার কেন্দ্রটি ৩০শে মার্চ ধ্বংস হয়ে যাবার পর ৩রা এপ্রিল পাৰ্তব্য চট্টগ্রামের একটি গোপন এলাকা থেকে চালু করা হয় আরেকটি বেতার কেন্দ্র। পরবর্তীকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাকিস্তানিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে মুজিবনগর থেকে পুনরায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করা হয়।
২৮শে মার্চ মেজর জিয়ার নির্দেশে মেজর শওকত এক প্লাটুন সৈন্য নিয়ে কক্সবাজার রওয়ানা হলেন স্থানীয়ভাবে কিছু ই পি আর, আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র ও পুলিশ নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তুলবার উদ্দেশে পথে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযানকে প্রতিহত করার জন্য। ৩০শে মার্চ মেজর জিয়া ক্যাপ্টেন অলিকে কালুরঘাটের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এক সেসন সৈন্য সাথে নিয়ে রামগড় চলে যান। ওদিকে ৩১শে মার্চ ই পি আর সেক্টর সদর হালিশহরের পতন ঘটলে বিচ্ছিন্ন ই পি। অর বাহিনী রেলওয়ে বিন্ডিং, কোর্ট বিল্ডিং, প্রভৃতি এলাকায় বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । ৬ই এপ্রিল পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে ই পি আর বাহিনীর রাস্তায় রাস্তায় খণ্ডযুদ্ধ চলে। ৬ই এপ্রিল চট্টগ্রামের কক্সবাজার এলাকায় ক্যাপ্টেন হারুণ ও লে, শমসের মবিন চৌধুরীর বাহিনীর সাথে পাকিস্তানি বাহিনীর এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে পাকিস্তানিরা ব্যাপক হারে নিহত হলেও পাকিস্তানিদের ট্যাঙ্কের অগ্রাভিযানকে রােধ করা সম্ভব হয়নি। পাঁচটি প্রাণের বিনিময়ে হারুণ ও শমসের তাদের বাহিনী নিয়ে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলেন। এরপর বলতে গেলে সারা শহর পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ৭ই এপ্রিল নাজিরহাটের শিয়ালবুক্কাতে চট্টগ্রাম ই পি আর সেক্টর অধিনায়ক লে. কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ, ১১নং উইং অধিনায়ক মেজর ইকবালসহ ১৮ জন পাকিস্তানির একটি সশস্ত্র দলের সাথে বাঙালি ই পি আর বাহিনীর এক সংঘর্ষ হয়। ই পি আর বাহিনীর পক্ষে নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফ এই সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পাকিস্তানিরা তাদের জীবনের বিনিময়ে ই পি আর বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে রামগড়ে এই ১৮ জন গুরুত্বপূর্ণ পদের অধিকারী পাকিস্তানিকে মেজর জিয়ার কাছে সমর্পণ করা হয়। সমর্পণ কালে মেজর রফিক এবং ক্যাপ্টেন এম, এস, এ, ভূইয়া ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। মেজর জিয়া পরবর্তীকালে বন্দিদের ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের নিকট হস্তান্তর করেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রাভিযান ও চট্টগ্রামের পতন
চট্টগ্রাম শহর পতনের পর পাকিস্তানি বাহিনী সমগ্র মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে শহরের বাইরে অভিযান শুরু করে ৮ই এপ্রিল তারা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র এলাকা আক্রমণ করে। সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী পশ্চাতে সরে গিয়ে কালুরঘাট সেতু এলাকায় প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করে। ঐ তারিখেই মেজর শওকত কক্সবাজার থেকে। ফিরে এসে ব্যাটালিয়নের কমান্ড গ্রহণ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১১ই এপ্রিল মর্টার, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, নৌ ও বিমান এবং অন্যান্য আধুনিক মারণাস্ত্রের সাহায্যে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান কালুরঘাটের উপর তীব্র আঘাত হানে। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে বেশ কিছু পাকিস্তানি নিহত হলেও মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে ৮ জন নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী গুরুতর আহতাবস্থায় দু’জন সহযােদ্ধার সহায়তায় পেছনে সরে এলেন, কিন্তু গুরুতর আহতাবস্থায় লে. শমসের মবিন পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হলেন। মুক্তিযােদ্ধারা পেছনে সরে আসতে বাধ্য হল। ১২ই এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধাদের পুরাে বাহিনী রাঙ্গামাটি পৌছে মেজর শওকতের নেতৃত্ব প্রতিরক্ষা গড়ে তােলেন। মহালছড়ি হলাে ব্যাটালিয়ন সদরদপ্তর। ১৪ই এপ্রিল ছুটি ভােগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যােগ দেন। মেজর শওকত সেদিনই বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এক একজন অফিসারের নেতৃত্বে বাহিনী পাঠালেন : ১. রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি এলাকায় এক কোম্পানি, অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের মীরসরাই নামক স্থানে এক কোম্পানি, অধিনায়ক ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ৩. বুড়িঘাট ও রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে এক কোম্পানি, অধিনায়ক ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী রাঙ্গামাটি ও বরকলের মধ্যস্থলে এক কোম্পানি, অধিনায়ক লেফটেনেন্ট মাহফুজ এবং ৫, কুতুবছড়ি এলাকায় এক কোম্পানি, অধিনায়ক সুবেদার মােতালেব।
উপরােক্ত ব্যবস্থা সত্ত্বেও পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৫ই এপ্রিল রাঙ্গামাটি পৌছে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের অপর দল কুমিরা হতে পশ্চাদপসরণ করে সীতাকুণ্ডুতে অবস্থা নেয়। ১৮ই এপ্রিল এই বাহিনীর উপর পাকিস্তানিরা ব্যাপক হামলা চালালে মুক্তিযােদ্ধারা মীরসরাই নামক স্থানে সংগঠিত হবার চেষ্টা করে। জনবল, অস্ত্রবল, আহার, বিশ্রাম ইত্যাদির অভাবে মুক্তিযােদ্ধারা মনােবল হারাতে থাকে। ক্যাপ্টেন রফিক, তার গ্রন্থে বলেছেন : We knew that at Mirsharai we could hold on for sometime and then fall back to some other position, fight again and fall back. This sad process would continue-no one knew for how long. Troops were by then losing confidence in their ability to hold on to any ground indefinitely. The enemy was dictating the outcome of every battle by sheer weight of trained manpower and tremendous firepower.”
(আমরা জানতাম যে মীরসরাইকে আমরা কিছু সময় পর্যন্ত ধরে রাখতে পারবাে। তারপর অন্য স্থানে পশ্চাদপসরণ এবং যুদ্ধ করে আবার পশ্চাদপসরণ। এই দঃখজনক প্রক্রিয়া কেউ জানত না কত সময় পর্যন্ত চলতে থাকবে। কোনও এলাকা নিশ্চিত ভাবে ধরে রাখতে তাদের সামর্থের প্রতি নিজবাহিনীর সৈন্যরা অনাস্থা করতে শুরু করেছে। শত্রুপক্ষ তাদের প্রশিক্ষিত সৈন্যদল ও ভারী অস্ত্রবলের সাহায্যে প্রত্যেকটি সংঘর্ষের ফলাফল নির্ধারণ করছে। মীরসরাই মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি, মর্টার, মেশিনগান নিয়ে ২০শে এপ্রিল ব্যাপকভাবে আক্রমণ। করলে সামান্য অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হলাে না যদিও পাকিস্তানিদের ৮টি গাড়ি ধ্বংস এবং ১৫০ জন সৈন্য প্রাণ হারিয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের। ১জন শহীদ হয় এবং ৫জন আহত হয়। ক্যাপ্টেন অলি ও তার কোম্পানি নিয়ে। পাকিস্তানিদের গতিরােধের চেষ্টা করে, কিন্তু তারা সুসংগঠিত হওয়ার পূর্বেই ২১শে
————–
 
A Tale of Millions. Page 123.
এপ্রিল পূর্বের ন্যায় পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা অপূরণীয় ক্ষতি স্বীকার করে করেরহাটে পশ্চাদপসরণ করে। ১০০ জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযােদ্ধাদের বুলেটের শিকার হয়। ক্যাপ্টেন রফিক ও ক্যাপ্টেন অলি আহমদ তাদের বাহিনী নিয়ে হিংগুলি নামক স্থানে অবস্থান নেন। | ১৯শে এপ্রিল বিকেল ৩টার সময় পাকিস্তানি বাহিনী বুড়িঘাটে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের অবস্থানের উপর মটার আক্রমণ চালায়। বৃষ্টির মতাে শেলের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা নড়াচড়া করবার সুযােগও পাচ্ছিল না। এই অবস্থার সুযােগে পাকিস্তানি সেনারা তীরে নেমে মুক্তিযােদ্ধাদের ঘিরে ফেলে। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান প্রায় ১০০ জন সৈন্যর একটি কোম্পানি নিয়ে মৃত্যুর মুখােমুখি দণ্ডায়মান। এমনি সময়ে ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফ তার এল, এম, জি, নিয়ে সামনে অগ্রসর হয়ে ব্যাপক ফায়ার দ্বারা পাকিস্তানিদের ব্যাতিব্যস্ত রাখতে সমর্থ হয় যার ফঁাকে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান তার বাহিনী নিয়ে সেদিন নিরাপদ স্থানে ফিরেছিলেন, কিন্তু মুন্সী আবদুর রউফ আর ফিরতে পারেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর গােলার আঘাতে তার দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশ সরকার মুন্সী আবদুর রউফকে ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ খেতাবে ভূষিত করেন। | ২৩শে এপ্রিল দেখা গেল যে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মহালছড়ি সদর সৈন্য দপ্তরে ছিলেন মেজর শওকত। তিনি তখনই ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের এবং লেফটেনেন্ট মাহফুজের নেতৃত্বে কিছু সৈন্য পাঠালেন পাকিস্তানি অগ্রাভিযান রােধ করার জন্য। ২৪শে এপ্রিল কুতুবছড়ি নামক স্থানে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। পাকিস্তানিরা বেশ ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে পিছু হটে যায়। কিন্তু লক্ষ্য করা গেল পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল চিংড়ি নদী দিয়ে নানিয়ারচর বাজার হয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ইতােমধ্যে ক্যাপ্টেন কাদের, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও লে, মাহফুজ তাদের বাহিনী নিয়ে পেছনে চলে এসেছিল।
মেজর শওকত ২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের কোম্পানিটি নানিয়ারচর বাজারে একটি বড় পাহাড়ের উপর অবস্থান করালেন এবং সড়ক পথে ক্যাপ্টেন কাদেরের কোম্পানি নিয়ােগ করলেন। লে. মাহফুজের কোম্পানিকে রিজার্ভে রাখলেন। | ২৭শে এপ্রিল দুপুরের দিকে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানের অবস্থানের উপর মিজো উপজাতিরা আক্রমণ করে বসলাে। মিজোদের অব্যাহত আক্রমণকালে খালেকুজ্জামানকে সাহায্যের জন্যে লে. মাহফুজ দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে এসে মিজোদের উপর পাল্টা আক্রমণ করেন। কিন্তু হাজার হাজার মিজোর আক্রমণে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান পশ্চাদপসরণে বাধ্য হলেন। লে, মাহফুজকে সশস্ত্র মিজোরা ঘিরে ফেললে লে, মাহফুজ সাহায্যের জন্য মেজর শওকতের নিকট অনুরােধ পাঠালেন। তার নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন কাদের তার সাহায্যে অগ্রসর হলেন। অবস্থার অবনতিতে মেজর শওকত মহালছড়ি সদর রক্ষার্থে তার  { করের হাট ও রামগড়ের মধ্যবর্তি ছােট্ট বাজার হিয়াকু-রামগড় যুদ্ধের জন্য পরবর্তী কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। যেভাবেই হােক শক্রর গুপ্তচররা নিশ্চিত হলাে যে চট্টগ্রাম সেক্টরের সদর দপ্তর রামগড়ে অবস্থিত। রামগড় আমাদের জন্য একটা সম্মানের-ইস্যু হয়ে পড়ে, কারণ আমাদের পূর্ণ কর্তৃত্বাধীন এটাই ছিল শেষ মহকুমা-সদর। তাই এটাকে রক্ষা করতে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। পূর্বে করের হাটের পতন হলে শত্রু যখন হিয়াকুর কাছাকাছি চলে আসছিল তখন হিয়াকু ও করের হাট-এর মাঝে কোন সৈন্য রেখে দেয়া কৌশলগতভাবে ছিল অনাকাঙ্খিত, কারণ তাহলে তাদের শত্রুর ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা ছিল অনিবার্য। তাই আমাদের সমস্ত সৈন্য পশ্চাদপসরণ করে হিয়াকুতে কেন্দ্রীভূত করা হয়েছিল।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সাহায্যে চতুর্দিক থেকে হিয়াকুর উপর আক্রমণ চালালে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে চিকনছড়াতে চলে আসতে বাধ্য হয় । লে, এজাজ, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন রফিক প্রমুখ তাদের বাহিনী নিয়ে চিকনছড়াতে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তােলে। কিন্তু ৩০শে এপ্রিল পাকিস্তানিরা চিকনছড়া আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধাদের বাগানবাড়িতে সরে যেতে বাধ্য করে। ১লা মে। বাগানবাড়ি আক্রান্ত হলে মুক্তিযােদ্ধারা রামগড়ে সরে আসতে বাধ্য হয়। মেজর জিয়া, মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন। ভূঁইয়া, লে, এজাজ, লে, মাহফুজ তাদের বাহিনীসহ রাম গড়ে প্রতিরকা স্থাপন করেন, কিন্তু পাকিস্তানী একটি ব্রিগেড তিন দিক থেকে রামগড় আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধারা ২রা মে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত থাকে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমাগত যুদ্ধে আহার দ্রিা জনবল ও অস্ত্রবলের অভাবে মনােবল একেবারেই হারিয়ে ফেলেছিল। এসব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা আর টিকতে না পেরে ২রা মে’র রাত্রিতেই ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ফলে সমগ্র চট্টগ্রাম এলাকা পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। পতন ঘটলাে চট্টগ্রাম রণাঙ্গণের।
.

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!