You dont have javascript enabled! Please enable it! চট্টগ্রাম শত্রু ও নিজ বাহিনীর পরিসংখ্যান - সংগ্রামের নোটবুক
চট্টগ্রাম শত্রু ও নিজ বাহিনীর পরিসংখ্যান
ই.পি.আর-এর ৬নং সেক্টর সদরের অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের হালিশহরে। এই সেক্টরের অধীনে তিনটি উইং তথা ১১নং এবং ১৪নং উইং-এর সদর অফিস ছিল হালিশহরে এবং ১৭নং উইং-এর অবস্থান ছিল কাপ্তাই। লে. কর্নেল আবদুল আজিজ নামে একজন অবাঙালি ছিলেন সেক্টরের অধিনায়ক, উপঅধিনায়ক ছিলেন মেজর আবদুল হালিম নামে একজন পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার। সেক্টর সদরে বাঙালি অফিসার ছিলেন মেডিকেল। অফিসার মেজর আমিরুল ইসলাম ও সেক্টর এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম। ১১নং উইং-এর অধিনায়ক ও উপ অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি অফিসার যথাক্রমে মেজর ইকবাল ও ক্যাপ্টেন হায়াত। ১৪নং উইং -এর অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি মেজর শামসুদ্দিন কিন্তু উপঅধিনায়ক ছিলেন একজন পশ্চিম পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন। কাপ্তাইতে ১৭নং উইং এর অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি মেজর পীর মােহাম্মদ কিন্তু বাঙালি ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী ছিলেন উপ-অধিনায়ক। সেক্টর ও তার তিনটি উইং এর মােট সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই হাজারের মতাে কিন্তু তন্মধ্যে প্রায় ৪০০ সৈন্য ছিল অবাঙ্গালি এবং অবশিষ্ট বাঙালি। ২৫শে মার্চ ১৯৭১ তারিখে সেক্টরের ছুটি ভােগরত সৈন্যদের বাদ দিয়ে। বাঙালি ১৫০০ এবং অবাঙালি ৩০০ সৈন্য শারীরিকভাবে উপস্থিত ছিল।  ওদিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে অবস্থান করছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (ই,বি,আর, সি) ২৫০০’র মতাে শিক্ষানবিশসহ বাঙালি সৈনিক। এই সেন্টারের অধিকাংশ অফিসারই ছিল বাঙালি। ই,বি,আর, সি’র কম্যান্ডেন্ট ছিলেন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এম, আর, মজুমদার এবং এ্যাডজুটেন্ট ছিলেন বাঙালি ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরী। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ এদের ২৩শে মার্চ সম্পূর্ণ অযাচিত ও অনির্ধারিতভাবে ঢাকায় নিয়ে যায় এবং এর পরিবর্তে অবাঙালি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে চট্টগ্রামের দায়িত্বে রেখে যায়।
কিন্তু তারপরও সেন্টারের প্রধান প্রশিক্ষক লে. কর্নেল এম, আর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আখন্দ, ক্যাপ্টেন এস, এ, ভূইয়া, ক্যাপ্টেন আজিজ, ক্যাপ্টেন এনামুল হক, ক্যাপ্টেন নূরুল আমিন, ক্যাপ্টেন মহসীন, লেফটেনেন্ট আৰু তালেব ও আরাে বেশ কিছু বাঙালি অফিসার পঁচিশের রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসেই ছিলেন। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই ডিপাে ইত্যাদি সামরিক ইউনিট গুলাের প্রধান এবং কিছু সৈনিক ছিল বাঙালি। দামপাড়ায় অবস্থিত এ্যাম্বারকেশন হেড কোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন মুসলিমউদ্দিন সহ প্রায় ১০ জন বাঙালি মসৈনিক ছিল। ডবল মুবিং এর আর্মি ট্রানজিট ক্যাম্প অধিনায়ক ছিল অবাঙালি কিন্তু অধিকাংশ সৈনিকই ছিল বাঙালি।  ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৮ম ব্যাটালিয়ন ও তার সদর দপ্তরের অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের ষােলশহরে। সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়নটির একাত্তরের মার্চ মাসের প্রথম দিকেই সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাবার কথা ছিল। এই সিদ্ধান্তকে কার্যকরী করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মার্চ মাসের প্রথমেই একটি কোম্পানি দুইজন পাকিস্তানি অফিসার সহ অগ্রিম দল (Advance Party) হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানের খারিয়ান সেনানিবাসে চলে যায়। কাজেই পশ্চিমে চলে যাবার পূর্ব-করণীয় হিসেবে ব্যাটালিয়নের সব গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ জমা করে দেওয়া হয়েছিল। শুধু দৈনন্দিন প্রশিক্ষণ চালু রাখার জন্য ১২টি হালকা মেশিন গান, ৩০০ থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ন্যূনতম গােলাবারুদ ও ১টি জিপসহ ৩/৪ টি গাড়ি দেওয়া হয়েছিল। একাত্তরের ২৫শে মার্চ এই ব্যাটালিয়নের কাছে যুদ্ধসামগ্রী বলতে এর বেশি কিছুই ছিল না । ৮ম ইস্টবেঙ্গলের এক কোম্পানি সৈন্য পশ্চিমে চলে গেলেও ষােলশহরে তিন কোম্পানি পঁচিশের রাতে অবস্থান করছিল। এই ব্যাটালিয়নের অবাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল জানজুয়া ব্যতিত উপঅধিনায়ক মেজর জিয়াউর রহমান, কোয়ার্টার মাস্টার ক্যাপ্টেন অলি আহমদ, এ্যাডজুটেন্ট লেফটেনেন্ট শমসের মুবিন চৌধুরীসহ কোম্পানি অধিনায়ক ও উপঅধিনায়ক ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন সাদেক ও লেফটেনেন্ট মাহফুজ এরা সবাই ছিলেন বাঙালি।
অপরপক্ষে একাত্তরের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সৈনিক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈনিক বলতে সেখানে অবস্থান করছিল বেলুচ রেজিমেন্টের ২০তম ব্যাটালিয়নের ৪০০ সৈন্য, ২৯তম ক্যাভালরির প্রায় ১০০ ট্যাংক ট্রপস্ এবং সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, ইনফ্যানট্রি ওয়ার্কশপ, সাপ্লাই ডিপাে ইত্যাদি ইউনিটের বিক্ষিপ্তভাবে ছড়ানাে ৫০/৬০.জন সৈনিক এবং সেনানিবাসের বাইরে এ্যামবারকেশন হেডকোয়ার্টার ও ট্রানজিট ক্যাম্পের ৩০/৪০ জন সৈনিক যারা ছিল। সম্পূর্ণরূপে অসংঘবদ্ধ। আর ছিল তাদের অয়্যারলেস কলােনি, ফিরােজ শাহ কলােনি, আমবাগান কলােনি, ইস্পাহানি কলােনি, কুলশী কলােনি এবং সরদার নগরের কয়েক সহস্র বিহারি অবাঙালি অধিবাসীর সক্রিয় জংগী সহযােগিতা যাদের মাঝে ছদ্মবেশে অবস্থান করে পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সংখ্যক নিয়মিত সৈনিক যারা ২৫শে মার্চের বহু পূর্বেই চট্টগ্রামে বাঙালি নিধণের কাজ শুরু করেছিল। চট্টগ্রামের তৎকালীন পুলিশ সুপার শামসুল হকও একথার সত্যতা স্বীকার করেন।
চট্টগ্রামে ই,পি, আর প্রতিরােধ
সত্তরের নির্বাচনােত্তর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইয়াহিয়া ভুট্টোর অশুভ তৎপরতায় ক্রমশ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির রূ প গ্রহণ করে যার ফলে সামরিক শাসকগােষ্ঠীর গণতান্ত্রিক রায়ের প্রতি সদিচ্ছার উপর বাঙালিরা সন্দিহান হয়ে পড়ে। ই.পি. আর এর চট্টগ্রাম সেক্টরের এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ছিলেন একজন তীক্ষ্মবুদ্ধিসম্পন্ন রাজনৈতিক দূরদর্শী অফিসার। পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরে তিনি পচিশের বহু পূর্ব থেকেই পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য অসদুদ্দেশ্যকে প্রতিহত করার জন্য তার বিশ্বাসভাজন বাঙালি সৈন্যদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে থাকেন। দীর্ঘ দিনের অন্যায় অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাঙালি ই.পি. আর সৈনিকগণও ক্যাপ্টেন রফিকের সুযােগ্য নের্তৃত্ব পেয়ে ভবিষ্যতের যে কোনাে পরিস্থিতির মােকাবেলার জন্য নিজেদেরকে প্রস্তুত রেখেছিল। তাই দেখা যায় পঁচিশে মার্চ রাতে বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক ও আওয়ামী লীগ কর্মী ডা, জাফর কর্তৃক ঢাকা সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনী পূর্ণ সামরিক সম্ভারে শহরের দিকে মুভ করতে শুরু করেছে এ খবর দেবার পর ক্যাপ্টেন রফিক তার ট্রপস্ সহকারে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে কয়েক মিনিটের বেশি সময় নেননি। পূর্ব থেকেই ক্যাপ্টেন রফিক রেলওয়ে পাহাড়ে তার যুদ্ধ কৌশলিক (Tactical) সদর দপ্তর তৈরি করে রেখেছিলেন। ষােল শহর ও সেনানিবাসে গিয়ে সব বাঙালি সৈনিকদের তাদের সাথে যােগ দিতে বলার জন্য ডা. জাফরকে অনুরােধ করে তিনি তার বাহিনীকে পূর্বনির্ধারিত সংকেত (Code word) দিয়ে সংকেত মতাে কাজ শুরু করবার জন্য প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিতে এগিয়ে গেলেন। তার সংকেত ছিল- BRING SOME WOOD FOR ME অর্থাৎ পাকিস্তানিদের বন্দি কর এবং সব গােলাবারুদ ও অস্ত্র সহকারে চট্টগ্রামের রণাঙ্গনে যােগদান কর। এ প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন রফিক তার গ্রন্থ A Tale of Millions এ লিখেছেন :
I told Dr Zafar, “I along with my troops of E.P.R will fight the Pakistan Army to save our people and to free them. Move to Sholashahar and the Cantonment and tell all Bangali soldiers to join us. Meet me at my tactical Hg on the Railway Hill, Immediately I dialled Halishahar E.P.R Hg where the Bengali JCOs were awaiting my orders. Just now send the second code message to all stations. Control the kote. Do not allow the West Pakistani soldiers to come out of their rooms. Put some troops in defense against Naval Hg. I am coming shortly.”* (আমি ডাক্তার জাফরকে বললাম, “আমার ইপি আর সৈন্যদের নিয়ে আমাদের। জনগণকে রক্ষা ও মুক্ত করার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবাে। আপনারা ষােলশহর ও সেনানিবাসে গিয়ে সব বাঙালি সৈন্যদেরকে আমাদের। সাথে যােগদান করতে বলুন। তারপর রেলওয়ে পাহাড়ের উপর আমার যুদ্ধকৌশলিক সদর দপ্তরে (Tactical Head Quarter) আমার সাথে দেখা করুন। অবিলম্বে আমি ই.পি, আর সদর হালিশহরে আমার আদেশের অপেক্ষারত বাঙালি জে সি ও-দের ফোন করে বললাম, “এক্ষুণি সব স্টেশনে দ্বিতীয় সাঙ্কেতিক বার্তাটি পাঠিয়ে দাও। অস্ত্রাগারকে নিয়ন্ত্রণ কর, পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যারাকের বাইরে বের হতে দিওনা। নৌসদরের বিপরীতে কিছু সৈন্য প্রতিরক্ষায় মােতায়েন কর। আমি অল্পক্ষণের মধ্যেই আসছি” এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে ১৪নং উইং-এর সদর দপ্তর হালিশহরে অবস্থিত উইং অধিনায়ক মেজর শামসুদ্দিনকে বাঙালি সৈনিকদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার উদ্দেশে সেক্টর অধিনায়ক লে.কর্নেল আবদুল আজিজ শেখ ২৪শে মার্চই তাকে সীমান্ত পরিদর্শনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তাই হালিশহরে পরবর্তী বাঙালি সিনিয়র অফিসার ক্যাপ্টেন রফিকের পক্ষে ই.পি, আর বাহিনীর একক অধিনায়কত্ব গ্রহণ করা সহজ হয়েছিল। অয়্যারলেস কলােনিতে ই.পি, আর এর একটি প্লাটুন নিয়ােজিত ছিল, অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি ক্যাপ্টেন হায়াত। তার উপ-অধিনায়ক ছিল একজন পাকিস্তানি সুবেদার।
বিনা রক্তপাতে নিঃশব্দে এবং অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানিদের বন্দি করার উদ্দেশে ক্যাপ্টেন রফিক দু’জন সশস্ত্র রক্ষী ও ড্রাইভারসহ প্রথমেই অয়্যারলেস কলােনির দিকে অগ্রসর হলেন। রফিক জিপ নিয়ে ক্যাপ্টেন হায়াতের কক্ষের সামনে পৌছুলেন। হায়াত দরজা খুলে দিতেই ক্যাপ্টেন রফিক তার স্টেনগান দিয়ে ক্যাপ্টেন। হায়াতকে আঘাত করেন এবং সাথে সাথে তাকে বন্দি করেন। প্রাটুনের আরাে ৩জন পাকিস্তানিকে বন্দি করে বাঙালি সৈনিকদের বিভিন্ন স্থানে নিয়ােগাদেশ প্রদান করে। সাফল্যের সাথে তার কাজ সমাধা করে ক্যাপ্টেন রফিক রাত সাড়ে ন’টার সময় হালিশহরে ছিলেন। সেখানে বাঙালি জেসিও, এন সি, ও, গর্ণ অস্ত্রাগার (কোত) তাদের নিয়ন্ত্রণে এনে ক্যাপ্টেন রফিকের অপেক্ষায়ই ছিল। রফিক এসে একে একে সব অবাঙালিদের বন্দি করলেন। সুবেদার জয়নাল এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘পঁচিশে মার্চ রাত ৮-৩০ মিনিট থেকে ৯টার মধ্যে ক্যাপ্টেন রফিকের হুকুমে বিদ্রোহ করি। তিনি টেলিফোনে আমাকে এ্যাকশন শুরু করার নির্দেশ দেন। আমরা কোতগুলাে (অস্ত্রাগারগুলাে) আমাদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসি। অবাঙালিদের বন্দি করা শুরু করি।
সেক্টরে অবস্থানরত সিগন্যাল হাবিলদার হাবিবুল্লাহ বাহার সমগ্র বাংলাদেশে আমাদের। এ্যাকশনের সংবাদ জানান। সিপাহী আবদুল মােমিন তখন বাগান বাড়ি বি, ও, পি তে কার্যরত ছিল। সে তার সাক্ষাৎকারে বলেছে “পচিশের রাতে ক্যাপ্টেন রফিকের তরফ থেকে মেসেজ পেয়ে আমরা অবাঙালিদের বন্দি করে চট্টগ্রামের দিকে রওয়ানা হই।” মেজর (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) শামসুদ্দিনও ২৬শে মার্চের সকালে রামগড়ে রফিকের মেসেজ প্রাপ্তির সত্যতা স্বীকার করেছেন। সেক্টর সদরে অবস্থানরত সব অবাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে সেক্টরের সব কোম্পানির অবস্থানগুলাে এবং শহরের বিভিন্ন সৈনিক পােষ্টে সংবাদ বা আদেশ পরিবেশনের পর ঐ রাতেই (২৫/২৬ মার্চ) ক্যাপ্টেন রফিক তার যুদ্ধ কৌশলিক সদর দপ্তর (Tactical Hg) রেলওয়ে পাহাড়ে চলে যান এবং সেখানে তার। বাহিনীকে প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করেন। সুবেদার আইজউদ্দিন তার মর্টার বাহিনী এবং সুবেদার জয়নাল মেশিনগানগুলি রেলওয়ে পাহাড়ের যথাস্থানে নিয়ােগ করে শত্রুর অপেক্ষায় রইলেন। Major Rafiq: A Tale of Millions, Page 56 পঁচিশে মার্চের রাতে পাঁচলাইশ থানায় অবস্থানরত নায়েব সুবেদার লনি মিয়া ক্যাপ্টেন রফিকের নির্দেশ পেয়ে সব অবাঙালিদের বন্দি করে তার প্লাটুন নিয়ে পাহাড়তলী রেলওয়ে বিল্ডিং -এ প্রতিরক্ষায় বসেন।
২৬শে মার্চের রাতে তার প্লাটুনের উপর পাকিস্তানি যুদ্ধ জাহাজ থেকে ব্যাপক গােলা বর্ষণ করা হয়। প্রত্যুত্তরে সুবেদার আইজউদ্দিন ৩ মর্টারের সাহায্যে প্রতিরােধ করার চেষ্টা করেন। সারারাত গােলাগুলি বিনিময়ের পর পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের চাপ তীব্র হয়ে উঠলে ক্যাপ্টেন রফিকের নির্দেশক্রমে লনি মিয়া তার বাহিনী প্রত্যাহার করে ২৭শে মার্চ স্টেট ব্যাংক ও কোতয়ালী এলাকার প্রতিরক্ষায় প্লাটুনকে নিয়ােজিত করেন। ওদিকে ২৬শে মার্চ প্রায় মধ্যরাতে পাকিস্তানি কমান্ডাে কোম্পানি হালিশহরে ই.পি, আর অবস্থানের উপর আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে যায়। সেক্টরের বেতার সংবাদ পেয়ে ২৬শে মার্চের ভােরে গুণদুম বি, ও, পি, এলাকা থেকে ল্যান্স নায়েক আব্দুর রাজ্জাক ও অন্যান্যরা তাদের দু’টি সেকশন সৈনিক প্রত্যাহার করে দক্ষিণ-পশ্চিম হালিশহরের কাঁচা রাস্তার নিকট পজিশন নেয়। ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি সেনাদের ৪টি গাড়ির একটি কনভয় হলিশহরের দিকে অগ্রসর হলে রাজ্জাক তার বাহিনী নিয়ে অতর্কিতে এই কনভয়ের উপর আক্রমণ চালিয়ে বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করে এবং ২টি গাড়ি ধ্বংস করে দেয়। উভয় পক্ষের ক্ষণস্থায়ী সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়।
এই সংঘর্ষে ই.পি, আর বাহিনী বেশ কিছু গােলাবারুদ ও অস্ত্র উদ্ধার করে। ল্যান্স নায়েক রাজ্জাক তার বাহিনীর স্থান পরিবর্তন করে নিকটবর্তী ডেইরি ফার্মে পজিশন নেয়। কিন্তু ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক হামলার মুখে দলটি তাদের প্রতিরক্ষা ছেড়ে অন্যত্র সরে যেতে বাধ্য হয়।  হাবিলদার আবদুল মান্নানের এক প্লাটুন ই.পি. আর সৈনিক ২৭শে মার্চ চট্টগ্রাম শহর থেকে হালিশহরে পৌছুলে সুবেদার জয়নালের নির্দেশে হালিশহর কাঁচা রাস্তার মােড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। ২৮শে মার্চ ভােরে পাকিস্তানি বাহিনীর ৫টি গাড়ির এক কনভয় প্রায় এক কোম্পানি ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য নিয়ে হালিশহরের দিকে। অগ্রসর হতে থাকে। কাঁচা রাস্তার মােড়ে অবস্থানরত ই.পি. আর বাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর আগমন টের পেয়ে ওৎ পেতে থাকে এবং মেশিনগানের মারনাওতায় আসার। সঙ্গে সঙ্গে তাদের গানগুলাে গর্জে ওঠে। উভয়পক্ষের সংঘর্ষে প্রায় ৫০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় ও তাদের ৩টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায়। অপর ২টি গাড়িতে অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা কোনােক্রমে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এই সংঘর্ষে ই.পি. আর বাহিনীর ল্যান্স নায়েক সাত্তার ও নায়েক মান্নান মিয়া শহীদ হয় এবং হাবিলদার মান্নান আহত হয়। হাবিলদার মান্নান সুবেদার জয়নালের কাছে যুদ্ধের সাফল্যের খবর জানিয়ে। শক্তিবৃদ্ধির আবেদন করে ব্যর্থ হয়। ওদিকে ২৬শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরেই ক্যাপ্টেন রফিকের রণ-সদরের বিপরীত দিকের পাহাড় ও মসিজদের দিক থেকে তার প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ব্যাপকভাবে গােলাগুলি আসতে থাকে। ই.পি. আর বাহিনীর ব্যাপক প্রতিআক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণে ‘ধ্য হয়। কিন্তু
——————
সাক্ষাৎকার : ১৪৮ সুবেদার জয়নাল আবেদীন
সাক্ষাৎকার ; ৪৯৩ সিপাই আবদুল মােমিন
পাকিস্তানি সেনারা ব্যাপকভাবে গােলা বর্ষণের মাধ্যমে ট্যাঙ্কের সাহায্যে ক্যাপ্টেন রফিকের প্রতিরক্ষা অবস্থান, রেলওয়ে পাহাড় ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করলে ক্যাপ্টেন রফিক তার যুদ্ধকৌশল সদর দপ্তর রেলওয়ে পাহাড় থেকে অপসারণ করে কোতয়ালী পুলিশ এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হন।

সূত্রঃ  এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী