ঢাকা ই.পি. আর সদর, পিলখানা আক্রমণ
১৯৭১ সালের পঁচিশে মার্চের দিবাগত রাত বাংলার ইতিহাসে এক ভয়াবহ কাল-রাত। একথা কারাে অবিদিত নয় যে সে রাতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান সত্তরের নির্বাচনী ফলাফলের ভিত্তিতে দেশের শাসনভার বাঙালিদের হাতে হস্তান্তর করে বাঙালি জাতির চিরন্তন স্বপ্নকে চিরতরে ধ্বংস করার হীন অভিপ্রায়ে নিরস্ত্র বাঙালির উপর লেলিয়ে দেয় তার সেনাবাহিনী। জেনারেল টিক্কা খানের কাছে পরিকল্পিত গণহত্যার নীলনকশা হস্তান্তর করে তিনি পালিয়ে যান তার দেশে পঁচিশের অপরাহ্নে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে শুরু করলাে সারা বাংলাদেশব্যাপী পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। ই.পি.আর সদর দপ্তর পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও সদর দপ্তর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবাসগুলােকে করলাে প্রধান টার্গেট। ট্যাঙ্ক ও কামানের গােলায় সেগুলােকে করলাে ধূলিসাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকদের নিরস্ত্রাবস্থায় পাশবিকভাবে হত্যা করে দিল। গণকবর ঘুমন্ত ঢাকার শান্ত-বসন্ত পরিবেশকে মুহূর্তে পরিণত করলাে গােলাবারুদের পরীক্ষাক্ষেত্রে। ঢাকার আকাশ লালে লাল, চতুর্দিকে আর্তচিৎকার-মানবসৃষ্ট কেয়ামত এ সম্পর্কে ঢাকার এক দৈনিক পত্রিকার রিপাের্ট উল্লেখযােগ্য : “রাত ১২টা পেরিয়ে হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভেঙে গর্জে উঠলাে মেশিনগান। একটি নয়, দু’টি নয়, অসংখ্য আগুনে লালে লাল হয়ে গেল সারা আকাশ। চারদিক আলােকিত করে ছুটলাে হানাদারদের রং বেরং-এর ম্যাগনেশিয়াম ফ্ল্যাশ। আগুন জ্বলছে। রাজারবাগে, আগুন জ্বলছে পিলখানায়, আগুন জ্বলছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়, জ্বলছে বস্তিতে বস্তিতে হাজার হাজার নারী-পুরুষ-শিশুর মর্মভেদী আর্তচিৎকারে ভরে উঠলাে। ঢাকার আকাশ বাতাস ঘরে ঘরে উঠলাে হাহাকার। রাস্তায় রাস্তায় জমে উঠলাে। লাশের স্তুপ। কিন্তু এর মধ্যেও গড়ে উঠলাে প্রতিরােধ। হানাদারদের প্রতিরােধ করা হলাে রাজারবাগে, পিলখানায়। পিলখানা ই,পি, আর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করলাে ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা যাদের অবস্থান ছিল পিলখানাতেই । আকস্মিক আক্রমণে পজিশন ঠিক করে উঠতে পারলাে না বাঙালি সৈন্যরা। তবুও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে তারা লড়ে গেল শত্রুর বিরুদ্ধে।”
দৈনিক জনপদ, ২৫শে মার্চ, ১৯৭৫ পিলখানায় অবস্থানরত ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যদেরকে পঁচিশের রাত ৯টায় মুভ করতে দেখেও অনেকেই এটাকে সহজভাবে মেনে নিয়েছিল এই জন্য যে সেদিন বিকেলেই পিলখানাতে গুজব রটে যায় যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সব দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছেন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন। পাকিস্তানি সেনারাও শেখ মুজিবের দাবি অনুসারে ব্যারাকে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু দেখা গেল, রাত সাড়ে দশটায় ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পজিশন নিয়ে হুকুমের অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ঠিক ১২টায় একটি গুলির আওয়াজের সাথে সাথেই সমগ্র পিলখানার উপর ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। কোয়ার্টার গার্ডের বাঙালি সৈন্যরা পাল্টা আক্রমণের কোনও সুযােগই পায়নি। তাছাড়া তাদের কাছে মাত্র পাঁচ রাউন্ড করে গুলি ছিল। ই.পি, আর -এর বাঙালি সৈন্যরা বিক্ষিপ্তভাবে প্রতিরােধের চেষ্টা করে, কিন্তু পাকিস্তানি সৈন্যদের পূর্ব পরিকল্পিত আক্রমণের মুখে তাদের সেই ত্বরিৎ ও অপরিকল্পিত প্রতিরােধ ভেঙে যায়। কোয়ার্টার গার্ডসহ সমগ্র পিলখানা পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বেশ কিছু বাঙালি ই.পি. আর সৈনিক ঐ রাতেই শহীদ হয়। কিছু পালাতে সক্ষম হয়। বাকীরা সব পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি হয়ে যায়। গভর্ণর হাউসে সে রাতে ই.পি, আর সৈন্য সংখ্যা ছিল ১১০ জন। রাত ১২টার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ডি.আই. টি ভবনের উপর থেকে গভর্নর হাউসে অবস্থানরত ই.পি, আর বাহিনীর উপর মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। ই.পি, আর বাহিনীর জোয়ানরা সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে। এভাবে তারা সারা রাত কাটিয়ে দেয়। ২৬শে মার্চ ভােরে বেলুচ রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন ট্যাঙ্কসহ গভর্ণর হাউসে প্রবেশ করে সরাসরি ই.পি, আর বাহিনীকে ঘিরে ফেলে।
অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে, ই.পি, আর জোয়ানরা তাদের অস্ত্র জমা দিতে বাধ্য হয়। ২৭ শে মার্চ সান্ধ্য আইন শিথিল করা হলে অধিকাংশ ই,পি, আর জোয়ানরা পালিয়ে গিয়ে পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। ২৫শে মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট হাউসেও ই.পি. আর বাহিনীর ২ কোম্পানি সৈন্য প্রহরারত ছিল। সেদিন সন্ধ্যার সময় ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া বাহিনী প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে জমা হতে থাকে। ই.পি. আর বাহিনীর ঢাকা সেক্টর অধিনায়ক (অবাঙালি) সন্ধ্যার পর প্রেসিডেন্ট হাউসে এসে বাহিনীর সব সদস্যদের উদ্দেশে বললেন যে প্রেসিডেন্ট চলে। গেছেন, তাই হাতিয়ার জমা করে প্রত্যেকের বিশ্রাম করা উচিত এই ঘােষণায় বাঙালি ও অবাঙালি সব ই.পি, আর সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিয়ে বিশ্রাম করতে থাকে। কিন্তু রাত ১১টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সব বাঙালি সৈনিকদের বন্দি করে অবাঙালিদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়। তার পরবর্তী কাহিনী বড়ই করুণ ও মর্মান্তিক। ২৯শে মার্চ রাতেই ১০০ জনের মতাে বাঙালি ই.পি, আর সৈনিককে পাকিস্তানি সেনারা তিন ভাগে ভাগ করে প্রেসিডেন্ট হাউস থেকে নিয়ে কালীবাড়ির নিকট নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করে। ই.পি, আর বাহিনীতে চাকুরিরত অবাঙালি অফিসার ও জোয়ানরাই এই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করে। আশ্চর্যের বিষয় যে এই গুলির মধ্যেও নায়েক মােহাম্মদ আলী ও নায়েক মুজিবুল হক অলৌকিক ভাবে বেঁচে যায় এবং দু’জনই পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। মিরপুর এলাকায়ও কর্তব্যরত ই,পি, আর বাহিনীর দু’টি কোম্পানিকে পাকিস্তানি বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে অধিকাংশকে বন্দি করে। বাকীদের কিছু নিহত হয় ও কিছু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী