স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ব্রিটিশ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে ভবিষ্যৎ স্বাধীনতার রূপরেখা নির্ধারণকল্পে ১৯৪০ সালের ২২শে মার্চ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লাহােরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক সাধারণ সভা আহ্বান করেন। সেই সভায় বাংলার প্রতিনিধিত্ব করেন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আবুল হাশিম, নাজিমুদ্দিন প্রমুখ । দুই দিনের বিতর্কের পর ২৩ শে মার্চ “পাকিস্তান প্রস্তাব” নামে খ্যাত যে “লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়, তার তৃতীয় ও শেষ ধারাটি ছিল নিম্নরূপ : “That it is the considered view of this session of the All India Muslim League that no constitutional plan would be work-able in this country or acceptable to the Muslims unless it is designed on the following basic principles viz that geographically continuous units are demarcated into regions which should be so constituted with such territorial readjustments as may be necessary in a majority as in the North Western and Eastern zones of India, should be grouped to constitute Independent states in which the constituent Units shall be autonomous and sovereign. That adequate effective and mandatory safeguards should be specifically provided in the constitution for minorities in these units and in these regions for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests, in consultation with them and in other parts of India where the Musalmans are in minority, adequate effective and mandatory safeguards shall be specifically provided in the constitution for them and other minorities for the protection of their religious, cultural, economic, political, administrative and other rights and interests in consultation with them.
That this session further authorities the working Committee to frame a scheme of Constitution in accordance with these basic principles providing for the assumption finally by the respective regions, of all powers such as defense, external affairs, communications, customs and such other matters as may be necessary” সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগের এই অধিবেশনের বিবেচিত মত যে কোন সাংবিধানিক পরিকল্পনা এই দেশের জন্য কার্যকরী হবে না অথবা মুসলমানদের নিকট গ্রহণযােগ্য হবে না, যদি না তাহা নিম্নোক্ত আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হয়। যথা : ভৌগলিকভাবে অবিচ্ছিন্ন এলাকাগুলিকে প্রয়ােজন মতাে স্থানীয়ভাবে পুর্নবিন্যাসের মাধ্যমে অঞ্চলেরূপে চিহ্নিত করা এবং উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মতাে যেই সমস্ত এলাকায় মুসলমান সংখ্যাধিক্যের বাস সেই সমস্ত এলাকাগুলিকে সংযুক্ত করে স্বাধীনরাষ্ট্রে পরিণত করা যেই রাষ্ট্রে অঞ্চলগুলি থাকবে স্বশাসিত ও সার্বভৌম। এই সমস্ত এলাকা ও অঞ্চলগুলির সংখ্যালঘুদের সাথে আলােচনার মাধ্যমে তাহাদের ধর্মীয়, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করবার জন্য সংবিধানে পর্যাপ্ত কার্যকরী ও নির্দেশমূলক রক্ষা করা বিশেষভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে এবং ভারতের অন্যান্য অধিকার ও স্বার্থরক্ষা করবার জন্য তাদের সাথে আলােচনার মাধ্যমে সংবিধানে পর্যাপ্ত কার্যকরী ও নির্দেশমূলক রক্ষা করে বিশেষ ভাবে সন্নিবেশিত করতে হবে।
নিজ নিজ অঞ্চল কর্তৃক সমস্ত ক্ষমতা যথা : প্রতিরক্ষা বৈদেশিক কার্যক্রম, যােগাযােগ ব্যবস্থা শুল্ক বিভাগ ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের জন্য ঐ সমস্ত মৌলিক আদর্শের উপর ভিত্তি করে সংবিধানের পরিকল্পনা বা খসড়া তৈরি করবার জন্য এই অধিবেশন নির্বাহী পরিষদকে ক্ষমতা প্রদান করছে। উপরােক্ত প্রস্তাবের মূল কথাটিই হলাে যে, ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমাংশের মুসলিম গরিষ্ঠ প্রদেশসমূহ নিয়ে স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে। জিন্নাহ যদিও এ প্রস্তাব অনুমােদন করেছিলেন, তবু কোনাে এক অজ্ঞাত কারণে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে তিনি দিল্লীতে আইন সভার মুসলিম লীগ সদস্যদের এক বৈঠক আহবান করেন এবং সেই বৈঠকে বাংলার প্রতিনিধি আবুল হাশিমের প্রবল। আপত্তি সত্ত্বেও লাহাের প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে নিম্নোক্ত নতুন প্রস্তাব গ্রহণ করেন : 1. That the zones comprising Bengal and Assam in the North-East and Punjab, North-West Frontier Province. Sind and Baluchistan in the North-West of India, namely Pakistan: zones where the Muslims are in dominant majority, be constituted into sovereign independent state and that an unequivocal Undertaking be given to implement the establishment of Pakistan without delay. That two seperate constitution making bodies be set up for the people of Pakistan and Hindustan for the purpose of framing their respective constitution. ভারতের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত বাংলা ও আসাম অঞ্চল এবং উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান অঞ্চল অর্থাৎ পাকিস্তানে যেখানে মুসলমানেরা অধিকতর সংখ্যাগরিষ্ঠ সে সব অঞ্চলের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করা হােক এবং পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠন করিবার জন্য সুনির্দিষ্ট অধিকার প্রদান করা হােক। পাকিস্তানও হিন্দুস্থানের জনগণের জন্য তাহাদের নিজ নিজ সংবিধান রচনা করিবার উদ্দেশে দুইটি পৃথক সংবিধান প্রণয়নকারী কমিটি গঠন করা হােক।] মােট কথা ঐ প্রস্তাবে ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাংশের মুসলিমগরিষ্ঠ বাংলায় লাহাের প্রস্তাবে অঙ্গিকারকৃত স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনকে সরাসরি অস্বীকার করা হলাে।
অতঃপর লর্ড মাউন্টব্যাটন ও জওহরলাল নেহরুর কূটনৈতিক যােগসাজসে ভারতের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে বাংলা (বেঙ্গল) ও পাঞ্জাব প্রদেশদ্বয়কে ভাগ করে এবং আসামকে বাদ দিয়ে শুধু পূর্ব-বঙ্গ, পশ্চিম-পাঞ্জাব, উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে নিয়ে ১৯৪৭ সনের ১৪ই আগস্ট সাম্প্রদায়িক রক্তপাত ও পারস্পরিক ঘূণার মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষকে ভাগ করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা হয়। পূর্ববঙ্গের নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান। কেন্দ্রীয় নের্তৃত্বের প্রভাবে সােহরাওয়ার্দীর পরিবর্তে পূর্বপাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হলেন নাজিমুদ্দিন। ক্ষুন্ন হলাে লাহাের প্রস্তাবাধীন পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন ও সার্বভৌমত্বের অঙ্গিকার। তবু বাংলার মানুষ মেনে নিল নব্য স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রকে, স্বাধীন মুসলিম জাতি হিসেবে ভবিষ্যতের সােনালী স্বপ্নের আশায়। কিন্তু পাকিস্তানের রাজনৈতিক কার্যক্রম ও বিধিনিষেধ বিশ্লেষণ করে আমরা দেখতে পাই যে বাংলার উপর পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর প্রভুত্ব ও ঔপনিবেশিক মনােভাব, যার প্রেক্ষিতে অচিরেই রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধে ওঠে “ভাষা আন্দোলন,” জমিদারিত্ব বিলােপ ও ভূমিসংস্কারকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠে “কৃষি আন্দোলন,” আর নানা প্রকার অন্যায় অত্যাচার এবং প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক বৈষমাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে “শ্রমিক আন্দোলন”। এ’ সমস্ত আন্দোলনকে দমন করতে মুসলিম লীগ সরকার যত হিংস্র ও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, আন্দোলনও তত বেশি ব্যাপকতা ও প্রসারতা লাভ করে, যার ফলে জনগণের কাছে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার গণস্বার্থবিরােধী সরকার বলেই চিহ্নিত হয়ে যায়। এর অবধারিত পরিণতির উদাহরণ ১৯৪৯ এর মার্চে টাঙ্গাইলে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে বিরােধী দলীয় প্রার্থী শামসুল হকের নিকট বিপুল ভােটের ব্যবধানে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রাথী খুররম খান পন্নীর শােচনীয় পরাজয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫১ সালের মধ্যে ৩৪ টি প্রাদেশিক পরিষদের আসন শূন্য হলেও নূরুল আমিন আর উপনির্বাচন দিতে সাহস পাননি।
১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনকে আইনের নানা জটিলতা দিয়ে তিনি ১৯৫৪ পর্যন্ত পিছিয়ে দেন। অবশেষে ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে দেশের বৃহত্তম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে মুসলিম লীগ পূর্ব-পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণভাবে উচ্ছেদ হয়ে যায়। পরবর্তী ৪ বছর পাকিস্তানের রাজনীতিতে ছিল অত্যন্ত দুর্যোগময় অবস্থা। ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মােহাম্মদ আলী পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ১২ই সেপ্টেম্বর ১৯৫৬ সালে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তান মন্ত্রীসভা শপথ গ্রহণ করে। কিন্তু গভর্ণর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জার চক্রান্তে ১৯৫৭ সনের ১১ই সেপ্টেম্বর সােহরাওয়ার্দীকেও পদত্যাগ করতে হয়। ১৮ই অক্টোবর চন্দ্রীগড় হলেন পাকিস্তানের ষষ্ঠ প্রধামন্ত্রী, কিন্তু দু’মাস পর তাকেও পদত্যাগ করতে হয়। প্রধানমন্ত্রী হলেন মালীক ফিরােজ খান নুন। তিনি অবশ্য ১৯৫৮ এর অক্টোবরে জেনারেল আইউব খানের সামরিক শাসন প্রবর্তিত হওয়া পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে টিকেছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তান মন্ত্রীসভাও বহু দুর্যোগের মধ্যে বারংবার রদবদল হতে থাকলে ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা, প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদসমূহ বাতিল করে সকল রাজনৈতিক দল বিলােপ করেন এবং সেবাবাহিনী প্রধান জেনারেল আইউব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়ােগ করে নিজে পর্দার আড়ালে অন্তর্ধান করেন।
অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট
জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তি ব্যতিত রাজনৈতিক স্বাধীনতা মূল্যহীন। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর দুই পাকিস্তানের অর্থনীতি ছিল মূলত কৃষিনির্ভর এবং ঐ সময় থেকেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনভার ছিল পশ্চিম-পাকিস্তানি নের্তৃবৃন্দের কুক্ষিগত। দুঃখজনক হলেও সত্য যে কেন্দ্রীয় শাসকরা প্রথম থেকেই শুধু পশ্চিম-পাকিস্তানের জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিই দৃষ্টি দিয়েছিলেন। পূর্ব-পাকিস্তান তাদের কাছে একটা অলিখিত উপনিবেশ রূপেই পরিগণিত হয়েছে। এটি নিয়ে বিশদভাবে লিখতে গেলে শুধু অর্থনীতির উপরই পূর্ণ কলেবর সম্পন্ন বই লেখা যায়। কিন্তু আমার এ লেখার উদ্দেশ্য তা নয়। তাই এ বিষয়ে সরলানন্দ সেনের “ঢাকার চিঠি” নামক সংকলন থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উপর আলােচনা শেষ করতে চাই । যুগান্তরের ৬ই এপ্রিল ১৯৫১ সংখ্যায় প্রকাশিত ‘চিঠি’ তে পূর্ব ও পশ্চিম-পাকিস্তানের মধ্যে বাজেট বরাদ্দে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর বৈমাত্রেয় মনােভাব প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। চিঠিতে লিখেছে : “এবারের উদ্বৃত্ত পাকিস্তান বাজেটে শিক্ষাখাতে কোনাে প্রদেশের জন্য কত ব্যয় বরাদ্দ করা হইয়াছে তাই দেখা যাক : করাচি ৪০ লক্ষ ১৪ হাজার, মাথা পিছু ৪ টাকা ৩ আনা ৩ পাই; সিন্ধু ১০ লক্ষ, মাথা পিছু ৩ আনা ৩ পাই; সীমান্ত প্রদেশ ১১ লক্ষ, মাথা পিছু ৩ আনা ৩ পাই; পূর্ব বঙ্গ ৭১ হাজার, মাথা পিছু ১ পাই এর তিন ভাগের এক ভাগ মাত্র।”
শিক্ষাখাতে তৎপরবর্তী ১০ বছরের পরিস্থিতির উপর DR. MANKEKAR এর। Pak Colonialism in East Bengal পৃষ্ঠা ২০/২১ এ তার রিপাের্ট উল্লেখযােগ্য: “Even in the sphere of education there has been far from any progress, a marked decline. The general level of illiteracy has remained stagnant at 80 percent, during the period 195161, whereas in West Pakistan the number of Matriculates rose by 143. 7 percent, in East Bengal, the figure rose only by 6.3 percent.
As regards University education, the number of graduates in East Bengal actually fell by 32.3 percent and post-graduate degree holder by 12 percent, whereas in West Pakistan the respective figure rose by 21.3 and 60.6 percent. Between 1961 and 1966, forty eight politechnical Institutes were established in West Pakistan as against only 18 in East Bengal” | (এমনকি শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনাে প্রকার উন্নতির পরিবর্তে লক্ষ্যনীয় অবনতি হয়েছে। অশিক্ষিতের সাধারণ স্তর শতকরা ৮০ ভাগের মধ্যেই স্থির রয়েছে। ১৯৫১ খৃ. হইতে ১৯৬১ খৃ. সময়কালে যেখানে পশ্চিম-পাকিস্তানে ম্যাট্রিক পরীক্ষা (বর্তমান এস, এস, সি) পাশের সংখ্যা বেড়েছে শতকরা ১৪৩.৭ ভাগ সেখানে পূর্ববঙ্গে বেড়েছে মাত্র ৬.৩ ভাগ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষায় পূর্ববঙ্গ স্নাতকের সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে কমেছে শতকরা ৩২.৩% ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রির সংখ্যা কমেছে শতকরা ১২% পক্ষান্তরে পশ্চিম পাকিস্তানে বেড়েছে যথাক্রমে শতকরা ২১.৩% ও ৬৮.৬% ভাগ। ১৯৬১ খৃ. ও ১৯৬৬ , এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন করা হয়েছে ৪৮টি তার বিপরীতে পূর্ববঙ্গে মাত্র ১৮টি।
————————
* শিক্ষাখাতে তৎপরবর্তী ১০ বছরের পরিস্থিতির উপর DR. MANKEKAR- এর Pak
Colonialism In East Bengal পৃষ্ঠা ২০/২১ এ তার রিপাের্ট উল্লেখযােগ্য। সরলানন্দ সেন চাঁদপুরের বাসিন্দা। ১৯৪৭ সালের পরে তিনি কলকাতার যুগান্তর পত্রিকার প্রতিনিধি ছিলেন। তার লেখা পাকিস্তানের সংবাদাদি দৈনিক যুগান্তরে ঢাকার চিঠি’ নামে গ্রন্থাকারে ১৯৭১ সালে কলকাতায় ১ম খণ্ড এবং ১৯৭৬ সালে ঢাকায় ২য় খণ্ড প্রকাশিত হয়।
৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩ তারিখে যুগান্তর প্রকাশিত ‘ঢাকার চিঠি’তে দেখা যায় ; “১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গ ৪২১ কোটি ২১ লক্ষ টাকা মূল্যের বিদেশী মুদ্রা অর্জন করেছে এবং এর থেকে ১৬৭ কোটি ২৭ লক্ষ টাকা ব্যয় করেছে। ২৫৬ কোটি ৯৪ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। উক্ত সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের মােট রপ্তানীর মূল্য ছিল ৩৪২ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা এবং আমদানীর মূল্য ছিল ৪১১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা। তাতে মােট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬৯ কোটি ৩ লক্ষ টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের ঘাটতি পূরণের জন্য পূর্ববঙ্গ ৬৯ কোটি ৩ লক্ষ টাকা প্রদান করেছে। এছাড়া বিভাগ পরবর্তী কালে মােট ২৩০ কোটি টাকা সরকারি ব্যয়ের ১৮৪ কোটি টাকাও পূর্ববঙ্গের পকেট থেকেই দেওয়া হয়েছে। এর থেকে প্রতিপন্ন হয় যে পূর্ববঙ্গের সাধারণ চাষি-মজুর-মধ্যবিত্তের গায়ের রক্ত জলকরা অর্থই পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের এক শ্রেণীর নেতা পূর্ববঙ্গের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন যে পূর্ববঙ্গ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও পাকিস্তানের সমৃদ্ধি এবং রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানই অধিক অগ্রগামী এবং পাকিস্তানের মােট রাজস্বের খাতে পূর্ববঙ্গের দান মাত্র শতকরা ১৮ ভাগ।” এ বিষয়ে DR. MANKEKAR এর Pak Colonialism in East Bengal নামক বইয়ের ১৭ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃতি উল্লেখযােগ্য। তিনি বলেছেন : “During the preiod 1950-70 out of the total revenue expenditure of the Government, only about Rs 1300 crores (that is only one fifth of the total) was spent in East Bengal as against over Rs 5000 crores in West Pakistan; of the total development expenditure during the same period, Rs 3000 crores (that is only one third of the total) was spent in East Bengal as against over Rs 6000 crores in West Pakistan. During the same period, West Pakistan imported goods worth more than Rs 300 crores as against its own foreign exchange earnings of barely Rs 1300 crores. Imports into West Pakistan have been three times the value of the imports into East Bengal Mujibur Rahman insisted (Eve-of-election broadcast on October 28, 1970) that the allocation to West Pakistan of Rs 500 Crores of the foreign exchange earnings of East Bengali and allowing it to utilize over 80 percent of all foreign aids, made it possible for West Rs 1000 crores in excess of its export earnings. According to reports of the Advisory Panels for the 4th year Plan 1970. 75. Volume 1. Planning Commission, Government of Pakistan 1970, East Bengal has transferred approximately $ 2.6 billion to West Pakistan over the period 1948/49 to 1968/69.” /১৯৫০-১৯৭০
খৃ. সময়কালে সর্বমােট রাজস্ব ব্যয়ের মধ্যে মাত্র ১৩০০ কোটি টাকা (মােট ব্যয়ের পাঁচ ভাগের এক অংশ) ব্যয় করা হয়েছে পূর্ববঙ্গে, কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে ৫০০০ কোটির বেশি। ঐ সময়ে মােট উন্নয়নমূলক ব্যয়ের মধ্যে ৩০০০ কোটি টাকা (মােট ব্যয়ের তিন ভাগের এক অংশ) খরচ করা হয়েছে পূর্ববঙ্গে, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ করা হয়েছে ৬০০০ কোটি টাকা। একই সময়ে পশ্চিম-পাকিস্তানের ১৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের স্থলে ৩০০০ কোটি টাকার মাল আমদানী করা হয়েছে। পশ্চিম-পাকিস্তানের আমদানীর পরিমাণ ছিল পূর্ববঙ্গের আমদানী মূল্যের ৩ গুণ বেশি। ১৯৭০ . এর অক্টোবরের ২৮ তারিখ জনাব শেখ মুজিবর রহমান তার নির্বাচনী বেতার ভাষণে বলেছেন যে পূর্ববঙ্গের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন থেকে ৫০০ কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানকে প্রদান এবং বৈদেশিক সাহায্যের শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিমে ব্যয়ের অনুমতি প্রদানের কারণেই পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন অপেক্ষা ১০০০ কোটি বেশি টাকার মাল আমদানী করা সম্ভব হয়েছে। ১৯৭০ খৃ. এর পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক প্রণীত ১৯৭০-৭৫ চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, প্রথশ বণ্ড এর উপদেষ্টা মণ্ডলীর মতে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হয়েছে প্রায় ২.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রায় ১১৪৪০ কোটি টাকা বর্তমান)। উপরােক্ত উদ্ধৃতিগুলি থেকে যথােপযুক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় যে পূর্ব-পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত রাজস্ব ব্যয়ে উন্নতমানের সেচব্যবস্থার প্রবর্তন করে পশ্চিম-পাকিস্তানকে খাদ্যোৎপাদনে স্বনির্ভর করা হয়েছে, কিন্তু পূর্ব-পাকিস্তানকে বর্ষায় বন্যার ও শীতের মৌসুমে ধরার কবল থেকে রক্ষা করবার কোনও বাস্তব পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি দীর্ঘ ২৪ বছরেও। পূর্বপাকিস্তানের পাট চা থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করে পূর্ব-পাকিস্তানকে করেছে তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের বাজারে পরিণত। পূর্বপাকিস্তানের নামমাত্র শিল্পায়নে অবাঙালিদের আধিপত্য সৃষ্টি করে পশ্চিম-পাকিস্তানের মূলধনের ব্যাপক পাচারই শুধু করা হয়নি, পূর্ব-পাকিস্তানের তৈরি কাগজ করাচী থেকে বিতরণ ও সরবরাহ করা হতাে যার ফলে কাগজের মূল্য পশ্চিম অপেক্ষা পূর্ব-পাকিস্তানে ছিল অধিক। পাকিস্তানের কৃষি ও শিল্পের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে DR. MANKEKAR তার Pak Colonialism in East Bengal এর ১৮ ও ১৯ পৃষ্ঠায় বলেন : “The sew industrial enterprises that have sprung up in East Bengal are mostly by non-Bengalee entrepreneurs from West Pakistan and even from west Asia. The few Bangalt businessmen that do manage to furish in East Bengal generally in the secondary lines of trade and industry, have many obstacles to negotiate, including having to run up all the way to Karachi to obtain a permit or to accelerate the movement of their files at the Secretariate.
A study carried out by Dr. Gustav F. Papanek of the centre for International Affairs at Harvard University, reveals that Bangalis fail to figure in the list of the top industrialists of Pakistan: among the 29 largest industrial houses, there are only 2 (two) Bengalis and these too happen to be near the bottom of the list.
Two-third of Pakistan’s industries are located in West Pakistan, while even the head offices of quite a few of the industries based in East Bangal, are in Karachi, which has often meant transfer of profits and funds from East Wing to the West. In the sphere of agriculture, the benefits of the green revolution all went to wheat-producing west Bengal remained untouched by it. Acording to the Far Economic, Review 1971 year book,”. During 1970 while the West Wing found itself in the situation of wheat-surplus, the overpopulated Eastern Province continued to be deficit in rice. (সামান্য যে কয়েকটা শিল্প ইউনিট পূর্ববঙ্গে গড়ে উঠেছে তার বেশির ভাগের মালিকই পশ্চিম পাকিস্তানি অথবা পশ্চিম এশিয়ার অবাঙালি। পূর্ববঙ্গের হাতে গোনা যে কজন বাঙালি ব্যবসায়ী যে দ্বিতীয় সারির শিল্প ও বাণিজ্যে উন্নতি করতে দেখা গেছে তাদেরও পারমিট লাভের জন্য অথবা সচিবালয়ে তাদের ফাইলের গতি বাড়াবার জন্য করাচী পর্যন্ত দৌড়ানাের মতাে বাধাগুলােকেও টপকাতে হয়েছে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক বিষয়ক কেন্দ্রের ডঃ গুসতাভ এফ পাপানেক এর এক সমীক্ষায় জানা যায় যে পাকিস্তানের বড় বড় শিল্পপতিদের তালিকায় বাঙালিদের নাম স্থান পায় না; ২৯টি সর্ব বৃহৎ শিল্পাঙ্গনের মাত্র ২টির মালিক বাঙালি, তাও তালিকার সর্বনিম্নে। পাকিস্তানের শিল্প কারখানাগুলির দুই তৃতীয়াংশই পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত পক্ষান্তরে পূর্ববঙ্গে অবস্থিত শিল্প কারখানার বহুলাংশের হেড অফিস করাচীতে অবস্থিত যার কারণে প্রায় অংশই পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিমে মূলধন ও মুনাফার অর্থ পাচার করতে হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লবের সমস্ত উপকারই গম উৎপাদনকারী পশ্চিম পাকিস্তানের ভাগ্যে জুটেছে, কিন্তু ধান উৎপাদনকারী পূর্ববঙ্গের ভাগ্যে সামান্যতমও জোটেনি। ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ ১৯৭১ বর্ষ বহির এর তথ্যানুযায়ী”- ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম পাকিস্তান যখন গম-উদ্বৃত্তের তালিকায় অতিপ্ৰজ (Over populated) পূর্ববঙ্গ চাউল-ঘাটতির অভিশাপে রয়েছে।” ওদিকে দেশের সরকারি অফিসসমূহে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি কর্মচারী নিয়ােগে দুস্তর বৈষম্যমূলক তথ্যাবলির এক প্রতিবেদন ১৫ই এপ্রিল ১৯৫২ তারিখের দৈনিক যুগান্তরের “ঢাকার চিঠি’ কলামে প্রকাশ পায়। তাতে বলা হয় : “গত ২৮ শে মার্চ পাকিস্তান পার্লামেন্টে পূর্ববঙ্গের জনৈক সদস্য এক অভিযােগ উথাপন করে বলেছেন যে, কেন্দ্রীয় সরকারের দপ্তরগুলােতে পূর্ববঙ্গের ন্যায্য। প্রতিনিধিত্ব নেই। এর উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন যে, পররাষ্ট্র দপ্তর ও কূটনৈতিক অফিসগুলােতে ৭ জন সহকারী সেক্রেটারির মধ্যে একজনও পূর্ববঙ্গের লােক নেই । ৫২ জন সুপারিনটেনডেন্ট এর মধ্যে মাত্র ৩ জন এবং ২১৬ জন সহকারীর মধ্যে ২৫ জন পূর্ববঙ্গের অধিবাসী। পররাষ্ট্র মন্ত্রীর জবাবে আরাে প্রকাশ, তাঁর দপ্তরে মােট কর্মচারীর সংখ্যা এক হাজার পঞ্চাশ জন, তার মধ্যে মাত্র ১১ জন পূর্ববঙ্গীয়। ইতােপূর্বে যােগাযােগমন্ত্রী জানিয়েছেন যে, পূর্ব বঙ্গের মােট ১১৫ জন স্টেশন মাস্টারের মধ্যে বাঙালি রয়েছেন মাত্র ৯ জন।” এই তাে গেল দেশের বেসামরিক নিয়ােগ-চিত্র। সামরিক বাহিনীতেও বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বকে (শতকরা ৫ ভাগ মাত্র) সংকীর্ণতায় সীমাবদ্ধ রেখে বাৎসরিক প্রতিরক্ষা বাজেটের মুখ্যাংশ (শতকরা ৯৫ ভাগ) থেকে পূর্ব-পাকিস্তানকে করেছে বঞ্চিত। পূর্বপাকিস্তানের একমাত্র আধাসামরিক বাহিনী “পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্” এর বিপরীতে। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রায় অর্ধ ডজন আধাসামরিক বাহিনী গঠন করে দুই প্রদেশের বাজেটের মধ্যে রেখেছে বিশাল অসমতা।
তদুপরি পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলস্ এর গঠনতান্ত্রিক কাঠামােতে সাধারণ সৈনিক সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ অবাঙালি সৈনিকের স্থান ধার্য্য রেখে (পশ্চিম-পাকিস্তানের আধাসামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের কোনাে স্থান ছিল না) এবং অবাঙালি অফিসারদের দ্বারা বাহিনীকে পরিচালিত করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী. দ্বিমুখী উদ্দেশ্য সাধন করেছে, প্রথমত : রাইফেলস্ এর বাঙালি সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং দ্বিতীয়ত : পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক বাজেটের একটা বড় অংশ পশ্চিমে পাচার করা। এভাবে পরিকল্পিত উপায়ে এবং কৌশলে আরােপিত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্বতসম বৈষম্য রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিকে করা হয়েছে সুগঠিত; পক্ষান্তরে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি হয়েছে অস্থিসারশূন্য কংকালবৎ। ১৯৪৮-৪৯ সনের সারা দেশব্যাপী ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ বাংলার অর্থনীতির মেরুদণ্ডকে দিয়েছে কুজ করে, পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর অবহেলা ও অসহযােগিতার দরুন যা আর কোনােদিনই সােজা হতে পারেনি। এখানে ১৯৫২ সনের ১৯ শে আগস্ট তারিখে দৈনিক যুগান্তরের “ঢাকার চিঠি” কলামের উদ্ধৃতি থেকে পূর্বপাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ-পরিস্থিতির কিছুটা আন্দাজ করা পাঠকের জনা সহজ হবে বলে আমি মনে করি। সেদিনের চিঠিতে প্রকাশ : “পূর্ববঙ্গের দিকে দিকে অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে। পাটের মণপ্রতি দর ৫টাকা থেকে ৮টাকা কিন্তু চাউলের মণপ্রতি মূল্য ২৮-৩০ টাকায় উঠেছে। ফলে চার পাঁচ মণ পাট বিক্রি করেও একমন চাউলের দাম হচ্ছে না। সুতরাং পল্লী অঞ্চলে দুর্ভিক্ষের করাল মুখব্যাদান আত্মপ্রকাশ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনও এই সত্যকে অস্বীকার করতে পারছেন না, … কৃষকদের ঘরে পাট থেকে যাচ্ছে অবিক্রিত। একেই তাে বর্ষায় বন্যায় দিন মজুরেরা উপায়হীন। সাধারণ চাষারা পাটের দর পাচ্ছে না বলে দিনমজুরদের দুঃখের ভার আরাে বেড়ে যাচ্ছে।” এ’ বিষয়ে DR. MANKEKAR এর Pak Colonialism in East Bengal এর ২২-২৩ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃতি পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যকার খাদ্য দ্রব্যের তুলনা মূলক মূল্য-বৈষম্য পাঠকদের অবগতির জন্য তুলে ধরা বিশেষ প্রয়ােজন মনে করছি : “The disparity in the prices of essential commodities in the two wings is equally glaring. Rice costs Rs 50 per maund in East Bengal, only Rs 25 Per maund in West Pakistan; wheat Rs 30 Per maund in East Bengal, only Rs 15 per maund in West Pakistan and mustard oil Rs 5 per seer in East Bengal, Rs 2.50 per seer in the west wing. Inevitably the disparity in the standard of living between the two would be equally wing.
Such a thorough economic dominance of East Bengal by West Pakistan has been made possible by the powerful grip on the levers of power and decision-making hild almost from the very begining by the ruling military-administrative industrial complex based in West Pakistan, East Bengal’s entire economy was thus geared to the colonial pattern self interest of West Pakistan.” {“পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৈষম্যও অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। পূর্ববঙ্গে চাউলের মণপ্রতি মূল্য ৫০ টাকা কিন্তু পশ্চিমে মণপ্রতি মূল্য মাত্র ২৫ টাকা। গম মণপ্রতি মূল্য পূর্ববঙ্গে ৩০ টাকা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে মাত্র ১৫ টাকা। পূর্ববঙ্গে সরিষার তৈল প্রতি সেরের মূল্য ৫ টাকা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতি সের ২.৫০ টাকা মাত্র। অপরিহার্য কারণেই দুই অঞ্চলের জীবন যাত্রার মানে ছিল বিরাট বৈষম্য। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ববঙ্গে এত প্রবল অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার সম্ভব হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত শিল্প -কমপ্লেক্সের সামরিক মালিক ও প্রশাসকগণ কর্তৃক প্রথম থেকেই ক্ষমতার চাবিকাঠি দৃঢ় মুষ্টিতে ধারণ ও এক তরফাভাবে রাষ্ট্রনীতি প্রণয়নের সুবিধার কারণে এই ভাবেই পূর্ববঙ্গে সার্বিক অর্থনীতিকে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে উপনিবেশিক ছাঁচে গড়ে তােলা হয়েছে।”
উপরােক্ত প্রতিবেদনগুলাে নিরীক্ষা করলে এ কথা কারাে কাছেই দুর্বোধ্য থাকার কথা নয় যে ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা প্রাপ্তির গােড়া থেকেই পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালিদেরকে তাদের ন্যায্য গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পূর্ববাংলাকে তাদের ঔপনিবেশিক পশ্চাদভূমি (Colonial Hinterland) রূপেই ব্যবহার করার প্রয়াস চালায়। দেশের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে স্থাপন করে দেশের বাৎসরিক বাজেটের এক বিরাট অংশ রাজধানী খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করে দেশের দুই অংশের উন্নয়নে সৃষ্টি করে রেখেছিল মহাসাগরীয় ব্যবধান। লন্ডনের ফাইনান্সিয়াল টাইম্স এর চার্লস্ স্মিথ লিখেছেন : “If East Bengal is today among the 8th poorest countries in the world it has to be partially attributed to the very fact that it is a part of Pakistan,” writes Charles Smith in the Financial Times, London who points out. “In 1947, at partition, East Bengal was actually better off than the west wing in a number of important aspects,” “As for the future” wrote Smith, “East Pakistan’s flat weltered countryside looked more promising for development than the relatively arid west.” The financial Times correspondent comments, “What West Pakistan did not have, however, and has never possessed to any significant until today, was political power-and it was the exercise of power by the leadership in the West that started the riot.” পূর্ববঙ্গ আজ বিশ্বের সবচেয়ে গরিব ৮টি দেশের অন্যতম এবং এটা সম্ভব হয়েছে এই জন্য যে তা (পূর্ববঙ্গ) পাকিস্তানের একটি অংশ হওয়ার কারণে। তিনি আরও বলেন, “দেশ বিভাগের সময় অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। অগ্রসরমান ছিল। ভবিষ্যতের উন্নয়নের জন্য মরুময় পশ্চিম অপেক্ষা পূর্ব পাকিস্তানের জলসিক্ত সমতল ভূমি ছিল অনেক বেশি সম্ভাবনাময়।” ফাইনান্সিয়াল টাইমস এর সংবাদদাতা মন্তব্য করেন যে পূর্ব-পাকিস্তানের যাহা কখনাে ছিল না এবং যাহা আজও নেই তাহা হইল, রাজনৈতিক ক্ষমতা। পশ্চিমের। নের্তৃবর্গ কর্তৃক ক্ষমতার অপব্যবহারই পূর্বের ভরাডুবির একমাত্র কারণ । বৈষম্য অপসারণের রাজনৈতিক প্রচেষ্টা এক কথায় পাকিস্তান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে যখন দেউলিয়াপনার প্রায় সম্মুখীন, তখনই তার প্রতিকারের দাবিতে ১৯৬৬ সনে পরবর্তীকালে বাংলার স্বাধীনতার স্থপতি, আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলার মুক্তি-সনদ, ৬-দফা ফমূলা পেশ এবং সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ১১-দফা আন্দোলন দেশের আপামর জনসাধারণকে দিল পথ নির্দেশ। পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আলােড়ন সৃষ্টিকারী বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ফমূলা ও সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১-দফা দাবি পাঠকদের সুবিধার্থে হুবহু তুলে ধরা প্রয়ােজন মনে করছি।
বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা ফমূলা 1. The constitution should provide for a Federation of Pakistan in its true sense on the basis to the Lahore Resolution, and Parliamentary form of Government with supremacy of Legislature directly elected on the basis of universal adult franchise, [ ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী সরকার হবে যৌথ রাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় পদ্ধতির। যৌথ রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য সমূহ থেকে কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি নির্বাচন হবে প্রত্যক্ষ এবং সার্বজনিন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে। প্রতিনিধি নির্বাচন জনসংখ্যার ভিত্তিতে হতে হবে। 2. Federal govt shall deal with only two subjects, viz Defense and Foreign Affairs, and all other residua subjects shall vest in the Federating states. (কেন্দ্রীয় সরকারের দায়িত্বে থাকবে শুধু প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়; আর সব বিষয় থাকবে অঙ্গরাজ্যের আওতাধীন। 3. Two separate but freely convertible currencies in two wings may be introduced, or one currency for the whole country may be maintained. In this case, effective constitutional provisions are to be made to stop flight of capital from East to West Pakistan. Separate banking reserve is to be made and separate fiscal and monetary policy to be adoptd for East and West Pakistan. [অবাধে উভয় অঞ্চলে বিনিময়যােগ্য দুটি পৃথক মুদ্রা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য। চালু করতে হবে। অথবা দেশের জন্য একটি মাত্র মুদ্রা চালু থাকতে পারে এই শর্তে যে এমন একটি কার্যকরী সংসদীয় ব্যবস্থা থাকবে যাতে দেশের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে মূলধন পাচার হতে না পারে। দুই অঞ্চলের জন্য পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে এবং পৃথক অর্থনীতি ও মুদ্রানীতি থাকতে হবে।]4. The power of taxation and revenue collection shall vest in the federating units and that the Federal Center will have to such power. The Fed ration will have a share in the state taxes for meeting required expenditure. The Consolidated Federal fund shall come out of a levy of certain percentage of all state taxes. (কর ধার্য্য ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা থাকবে অঙ্গরাজ্যসমূহের হাতে। প্রতিরক্ষা ও বৈদেশিক বিষয়ের ব্যয় নির্বাহের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে প্রয়ােজনীয় রাজস্বের যােগান। দেওয়া হবে। ধাৰ্যকত সব রকম করের একটা নির্ধারিত অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের। তহবিলে জমা হয়ে যাবে । 5. There shall be two separate accounts for foreign exchange earnings of the two wings. Earnings of East Pakistan shall be under the control of East Pakistan Government and that of West Pakistan under the Control of West Pakistan Government. Foreign exchange requirement of the Federal Government shall be met by the two wings either equally or in a ratio to be fixed. Indigenous products shall move free of duty between two wings. The Constitution shall empower the unit Governments to establish trade and commercial relations with, set up trade missions in and enter into agreements with foreign countries. (অঙ্গরাজ্যসমূহের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পৃথক হিসাব থাকবে এবং তাদের নিজ নিজ অর্জনের উপর নিজ নিজ নিয়ন্ত্রণ থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়ােজন অঙ্গরাজ্যসমূহ সমানভাবে অথবা নির্ধারিত আনুপাতিক হারে যােগান দেবে। আঞ্চলিকভাবে উৎপাদিত দ্রব্য দুই অঞ্চলের আদান-প্রদান করমুক্ত থাকবে। শাসনতন্ত্রে এমন বিধান থাকতে হবে যাতে অঙ্গরাজ্যসমূহ তাদের ইচ্ছানুযায়ী যে কোনাে দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি বা বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কিত চুক্তি সম্পাদন করতে ক্ষমতা পায়। 6. Federating units must be empowered to raise their own militia or para military force freely for enhancing the regional and national defense effectively. [ফলপ্রসূভাবে আঞ্চলিক ও জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সাহায্যের জন্য অঙ্গরাজ্যসমূহকে স্বাধীনভাবে আধা-সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটির ১১-দফা দাবি
১. ক, প্রাদেশিককৃত কলেজগুলােকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
খ. স্কুল ও কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। গ. প্রাদেশিক কলেজগুলােতে নৈশ ক্লাশের ব্যবস্থা করতে হবে। ঘ, ছাত্র বেতনের শতকরা ৫০ ভাগ হ্রাস করতে হবে। ঙ. শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে এবং সমস্ত অফিসের কাজে বাংলা ভাষাকে চালু করতে হবে। চ, ছাত্রাবাসের ব্যয় ভারের শতকরা ৫০ ভাগ সরকারকে বহন করতে হবে। ছ, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি করতে হবে। জ, ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ঝ, একটি চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স প্রত্যাহার করতে হবে। ঞ. পলিটেকনিক ছাত্রদের জন্য সংক্ষিপ্ত কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে। ট, হ্রাসকৃত ভাড়ায় রেল ও বাস ভ্রমণের সুযােগ দিতে হবে। ঠ. চাকুরির সুযােগ সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হবে।
ড. বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল করে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। ২. সার্বজনিন প্রাপ্তবয়স্ক ভােটাধিকারের ভিত্তিতে পারিদিক গণতন্ত্রের প্রবর্তন করতে হবে। ৩. ক. যৌথ রাষ্ট্রীয় পদ্ধতির সরকার চালু করতে হবে এবং তাতে ব্যবস্থাপক সভার | সার্বভৌমত্ব থাকবে। খ. কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র প্রতিরক্ষা, বিদেশনীতি ও মুদ্রায় সীমাবদ্ধ থাকবে। ৩. প্রতি অঙ্গরাজ্যের জন্য আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনসহ বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও সিন্ধুকে নিয়ে একটি উপ-যৌথরাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ব্যাংক, বীমা কোম্পানি ও বৃহৎ শিল্পগুলি জাতীয়করণ করতে হবে। কৃষকদের উপর ধার্যকৃত যাবতীয় কর ও রাজস্বের হার কমাতে হবে। ৭. শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য বেতন ও বােনাসের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। ৯. যাবতীয় জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং অন্যান্য নিবারক আইন তুলে নিতে হবে। ১০. সিয়াটো (SEATO) সেন্টো (CENTO) চুক্তির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করতে হবে এবং পাকিস্তান-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করতে হবে। ১১, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামীসহ বিনাবিচারে আটক সকল রাজবন্দির বিনা। শর্তে মুক্তি দিতে হবে।
—————————-
উদ্ধৃতি “Bangladesh Documents page 24-30 এবং রণাত্রি অনুদিত এস্থানী ম্যাসকারেনহাস, দ্য রেইপ অব বাংলাদেশ পৃষ্ঠা-১৫৫/১৫৬,
‘ এই ৬-দফার ও ১১-দফার আন্দোলনে বাঙালি খুঁজে পেলাে নিজেদের অবলুপ্ত প্রায় মৌলিক জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র যার যাদুস্পর্শে সৃষ্টি হলাে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে আপামর বাঙালির তীব্র ঘৃণা-বােধ ও ইস্পাত কঠিন ঐক্য। তারপর থেকেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে ওঠে কাল বৈশাখীর ঝড়, দুর্যোগের ঘনঘটা; ক্রমান্বয়ে হয় দ্রুত পট পরিবর্তন।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের পতন ও ইয়াহিয়ার মঞ্চারােহন ১৯৬৯ সাল। সারাদেশ গর্জে ওঠে আইয়ুবের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। মতাদর্শ, নীতিগত দলীয় কোন্দল ও স্বার্থ সবকিছু জাতীয়তাবাদী চেতনার বন্যায় ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায়। শেখ মুজিবকে তথাকথিত আগরতলা মামলার সাথে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযােগে কারাগারে নিক্ষেপ করে তার ৬-দফা ফমূলার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ঘৃণ্য পাঁয়তারার বিরুদ্ধে বাঙালি একতাবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ালাে। ছাত্র-শ্রমিকজনতা ঢাকার রাজপথে ঢেলে দিলাে বুকের তাজা রক্ত। ভেঙে পড়লাে আইয়ুবের। লৌহকঠিন সামরিক শাসন। মিথ্যা আগরতলা মামলা তুলে নিতে বাধ্য হলাে পশ্চিমা শাসকচক্র বেরিয়ে এলেন কারাগার থেকে পশ্চিমা ষড়যন্ত্রের শিকার, বাংলার ইতিহাসের মহানায়ক শেখ মুজিবুর রহমান, একটা আলাে, একটা বিস্ময় এবং বাঙালির আশাভরসার একমাত্র নির্ভরশীল ব্যক্তিত্ব। প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের মাঝে স্বঘােষিত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান তার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে উনসত্তরের ২৫শে মার্চের রাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে চিরবিদায় গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের রাজসিংহাসন থেকে। সে রাতেই জেনারেল ইয়াহিয়া জারী করলেন পাকিস্তানে দ্বিতীয় সামরিক শাসন। তারপর সপ্তাহ অতিক্রান্ত হবার পূর্বেই ৩১শে মার্চ জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণের মাধ্যমে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন ইসলামিক প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে। যে গণআন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে দেশের শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য হলেন, সারা দেশে সামরিক শাসন জারী থাকা সত্ত্বেও সে গণআন্দোলনের দুর্বার। স্রোত অব্যাহত রইলাে। সভা, মিছিল, হরতাল, লাঠিচার্জ, গুলিবর্ষণ ইত্যাদি নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হল। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক দলগুলাের উপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবার সুযােগ দানসহ দেশের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করতে বাধ্য হলেন। অবশ্য তৎপূর্বে ইয়াহিয়া সাহেব সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের শতকরা ৪০ ভাগের বেশি আসন দখলের সম্ভাবনা নেই, এই মর্মে। বিভিন্ন মহল থেকে রিপাের্ট সগ্রহ করে ভবিষ্যৎ নির্বাচন ফলাফল সম্বন্ধে দৃঢ় আশ্বাসের ভিত্তিতেই নির্বাচন ঘােষণা করেছিলেন!
——————-
* উদ্ধৃতি -এ্যান্থনী মাসকারেনহাস দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ, রণাত্রি অনুদিত-পৃঃ ১৬৩ পরিশিষ্ট-৩
সত্তরের সাধারণ নির্বাচন
১৯৭০ সাল । ৫ই অক্টোবর পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করা হল। কিন্তু সারা পূর্ব-পাকিস্তানে বন্যার কারণে নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে নতুন তারিখ ধার্য হলাে ১৯৭০ সালের ৭ ও ১৭ই ডিসেম্বর এবং বন্যা প্লাবিত এলাকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০টি আসনের নির্বাচনী তারিখ ধার্য হলাে ১৭ই জানুয়ারি ১৯৭১ সন। এদিকে ১২ই নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকার লক্ষ লক্ষ লােক প্রাণ হারায়। ১৫০ মাইল গতিসম্পন্ন হ্যারিকেন নামের এই প্রবল সামুদ্রিক ঝড়ের দাপটে ২০/৩০ ফুট উঁচু জলােচ্ছাসের তীব্র বেগে ১০ থেকে ১২ লক্ষ লােকের প্রাণহানী ও ৩০ লক্ষ লােকের এক বিভীষিকাময় অমানবিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার আর্ত মুহূর্তে পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর নিদারুণ অবহেলা ও উদাসীনতা তাদের বিরুদ্ধে বাঙালির ঘৃণা-বােধ ও ঐক্যকে দিয়েছে। সম্পূর্ণতা। তাই দেখা যায় দুই পক্ষকালের ব্যবধানে অনুষ্ঠিত দেশের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি বাঙালির একতরফা রায় প্রদান পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে তাদের ঐ ঘৃণা-বােধ ও একতারই হয়েছে বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। বাঙালি সৃষ্টি করলাে গণতান্ত্রিক পদ্ধতির এক নজিরবিহীন ইতিহাস। জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩ টি (মহিলা। আসনসহ) আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি আসনে জয়লাভ করে নিরুঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠা অর্জন করে দেশের মন্ত্রী পরিষদ গঠনের জন্য পেলাে একচ্ছত্র অধিকার। প্রাদেশিক পরিষদেও ৩১০ টি আসনের ২৯৮ টিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলাে।
এই অপ্রত্যাশিত ফলাফল কেঁপে উঠলাে পাকিস্তানের রাজ সিংহাসন, চমকে উঠলাে পাকিস্তানি শাসকচক্র, শুরু করলাে শাসনভার হস্তান্তর বানচালের ঘৃণ্য পাঁয়তারা। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক আধিপত্যকে চিরতরে স্তব্ধ করার অভিপ্রায়ে সামরিক প্রস্তুতিকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ধোঁকাবাজি ও দেনদরবারের ভাওতাবাজি দিয়ে আড়াল করে রাখবার প্রয়াস পেল। নির্বাচনােত্তর পরিস্থিতি সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে কেন্দ্র ও পূর্ব-পাকিস্তান পরিষদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকচক্রের নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতির সব পর্যবেক্ষণ রিপাের্টের বিপরীত ফলাফল ছিল তাদের দম্ভের মূলে কুঠারাঘাত স্বরূপ। বাঙালিরা পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে, তথা নির্বাচনী রায়ের বদৌলতে ঐ শাসকচক্রের ভাষায় প্রজার জাত রাজা হবে, ঐ গণতান্ত্রিক রায় তারা হজম করতে পারেনি। তবু সব আগুন বুকে চেপে রেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে ১২ই ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেন :
“জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পরিকল্পনা সামরিক সরকারের রয়েছে নির্বাচন হচ্ছে তার প্রথম পর্যায় মাত্র। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এই জন্যই নব-নির্বাচিত প্রার্থীদের আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, জনগণ তাদের ভােট দিয়ে তাদের উপর বিরাট আস্থা স্থাপন করেছে। দেয়া-নেয়া ও সহনশীলতার ভিত্তিতে এখনই তারা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে যান, জাতি এখন। তাদের কাছে তাই চাচ্ছে। জাতি তাদের উপর যে আস্থা স্থাপন করেছে তারা তা রক্ষা। করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। তাদের এই প্রচেষ্টা সফল হােক এটাই কামনা করি।” ভাষণটি একজন নিরপেক্ষ ও নিষ্ঠাবান প্রেসিডেন্টের উপযুক্ত বিবৃতি বলেই প্রতিয়মান। কিন্তু অন্যদিকে দেশের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় পরিষদে ৮৮ আসনে বিজয়ী বিরােধী দল পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পাটি’ প্রধান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহােরের এক জনসভায় বলেন যে, তাঁর দলের সহযােগিতা ছাড়া কোনও কেন্দ্রীয় সরকারই কাজ চালাতে পারবে না। তিনি আরাে ঘােষণা দিলেন যে, জাতীয় পরিষদে বিরােধী দলে বসে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আরাে পাঁচ বছর অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, তিনি যদি ক্ষমতায় না যান তাহলে পাকিস্তানি জনগণের মঙ্গলের জন্যে কাজ করার কেউ থাকবে না এবং ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের জন্যে কাজ করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি সব গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও রায়কে ভ্রুকুটি করে তিনি। বলেন যে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুই হলাে পাকিস্তানের ক্ষমতার উৎস এবং কেন্দ্রস্থল; আর এই দুই প্রদেশেই তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। অতএব তাকে ক্ষমতায় যেতেই হবে।
জুলফিকার আলী ভুট্টোর উপরােক্ত ঘােষণা বিশ্লেষণ করলে একথা অনুধাবন করতে কারাে কষ্ট হবে না যে, তার এই ঘােষণা ছিল নির্বাচনী ফলাফলকে বানচাল করবার ইঙ্গিতবাহক। কারণ সংখ্যালঘু দলের নেতা হয়ে তাকেও ক্ষমতায় যেতে হবে, এরকম উদ্ভট ঘােষণার কোনাে গণতান্ত্রিক যুক্তি আছে কী না আমাদের জানা নেই। তাঁর পরবর্তী কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করলে এটা স্পষ্টই ধরা পড়ে যে, ভুট্টোর সেই অগণতান্ত্রিক ও অসহিষ্ণু উচ্চাভিলাষকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার অসৎ উদ্দেশ্য সাধনে পুরাে মাত্রায় কাজে লাগিয়ে তাঁকে কলের পুতুলের মতােই ব্যবহার করেছেন। সে যাই হােক, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১১ই জানুয়ারি ঢাকায় এলেন এবং ১২ই। জানুয়ারি কোনও সহকারী ছাড়াই শেখ মুজিবের সাথে আলােচনা করলেন। ১৩ই জানুয়ারি উভয় নেতা রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। সর্ব জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, খােন্দকার মােশতাক আহমেদ, মনসুর আলী ও এ, এইচ, এম, কামরুজ্জমান সে বৈঠকে তার সাথে ছিলেন। ১৪ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বললেন যে, দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে আলােচনা প্রসঙ্গে যা বলেছেন তা পুরােপুরি সঠিক। এছাড়া বৈঠকের ফলাফল সম্বন্ধে আর কিছু জানা যায়নি।
————-
* দৈনিক পাকিস্তান, ১৩ই ডিসেম্বর ১৯৭০ ** মুক্তি সংগ্রাম, ১ম পর্ব, পৃষ্ঠা ১৬৩
২৭শে জানুয়ারি ভুট্টো ঢাকায় এলেন এবং ২৮শে জানুয়ারি তার হােটেল কক্ষেই শেখ মুজিবের সাথে ৭০ মিনিট কলি আলাপ আলােচনা করলেন। ৩০শে জানুয়ারী দুই নেতার ৫ ঘন্টা ব্যাপী নৌ-বিহারের পর ভুট্টো বললেন, “আমরা দু’নেতাই আলােচনায় সন্তুষ্ট। তবে আলােচনার দ্বার খােলা রইলাে। অমীমাংসিত বিষয়গুলাে আলােচনার জন্য আবার বৈঠক বসবে।” | ৩০শে জানুয়ারি দুই কাশ্মিরী মুক্তিযােদ্ধা ভারতীয় বিমান ‘গঙ্গা’ ছিনতাই করে লাহাের বিমান বন্দরে অবতরণ করলাে এবং ২রা ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সামরিক চক্রের চোখের সামনে তা ধ্বংস করে দিলাে। পরিকল্পিত এ ভারতীয় বিমান ছিনতাইাকে কেন্দ্র করে অভিজ্ঞ মহল জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। লােক মুখে নানা গুজব ছুটতে লাগলাে।
অবশেষে ১৩ই ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘােষণা করলেন যে ৩রা মার্চ বুধবার সকাল ৯ ঘটিকায় ঢাকাস্থ প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। ১৫ই ফেব্রুয়ারি জনাব ভুট্টো পেশােয়ারে এক বিবৃতিতে বলেন যে, ৬-দফার প্রশ্নে কোনও আপােষ-মীমাংসার সম্ভাবনা না থাকায় তাঁর দল জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করবে না। তবে ৬-দফার কোন রদবদল বা আপােষের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলে তারা যে কোন দিন ঢাকায় আসবেন। ভুট্টোর এ ঘােষণায় বহু রাজনৈতিক নেতৃবর্গ অসন্তোষ প্রকাশ করেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি বেলুচ-নেতা নবাব। আকবর খান বুগতি এই মর্মে এক ঘােষণা দিলেন যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বাচাল করার জন্য জনাব ভুট্টো যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা পাকিস্তানের দু’অংশকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যেই নেয়া হয়েছে। পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা ও শেখ মুজিবের অসহযােগ আন্দোলন। ২৭শে ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের ৩৩ জন নব-নির্বাচিত সদস্য ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করবেন বলে ঘােষণা দেন। কিন্তু ভুট্টো পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার জন্য জোর দাবি জানালেন। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের তারিখ ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু কিছু সদস্য ঢাকায় আসাও শুরু করলেন। সারা দেশ, এমনকি বলা চলে সারা বিশ্বই অধীর আগ্রহে ৩রা মার্চের অপেক্ষা করছিল। এমন পরিস্থিতিতে ১লা মার্চ ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ঘােষণায় সবাই স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘোষণায় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখা হল। এই ঘােষণার পরপরই ঢাকা সহ পূর্ব পাকিস্তানের সব শহরেই উত্তাল জনতা ক্রোধে ফেটে পড়লাে। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শহরের সব দোকানপাট বন্ধ হয়ে গেল। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কলকারখানার শ্রমিক এবং আদালতের আইনজীবীগণ ও সর্বস্তরের জনসাধারণ রাস্তায় নেমে আসেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভুথানের মতাে।
গােটা শহর স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। সর্বস্তরের লােকজন মিছিল সহকারে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের মুখ থেকে নির্দেশ লাভের উদ্দেশে হােটেল পূর্বাণীর সামনে উপস্থিত হয়। ঐ দিন বেলা সাড়ে তিনটায় পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বৈঠক শুরু হওয়ার পূর্বেই হােটেল পূর্বাণী এলাকায় মানুষের ভিড়ে তিল ধারণের ঠাই থাকে না। সংক্ষিপ্ত বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২রা মার্চ ঢাকায় হরতাল এবং ৩রা মার্চ বুধবার সারা বাংলায় সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান এবং পরবর্তী কর্মসূচি ঘােষণাকল্পে ৭ই মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের ঘােষণা প্রদান করেন। | জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত ঘােষণার মধ্য দিয়েই। প্রকৃতপক্ষে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আসল চেহারা সকলের কাছে ধরা পড়ে। প্রেসিডেন্টের ইত্যকার কর্মকাণ্ড যে সব সাজানাে ব্যাপার ছিল, বাংলার মানুষের কাছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠলাে। নির্বাচনােত্তর কালে পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠানে গড়িমসি, মূলনীতির দাম্ভিক ঘােষণা, সংবিধান সংক্রান্ত হুমকি, মুজিব-ভুট্টো বিরােধ সৃষ্টি ইত্যাদি কাজের এক জঘন্য নায়ক রূপেই বাংলার মানুষ তাকে চিহ্নিত করতে সমর্থ হল । | ২রা মার্চ নির্দেশ মােতাবেক ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। সেদিন ঢাকা বেতারে সরকার পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত সান্ধ্য-আইন বলবৎ থাকবে বলে ঘােষণা দেয়া হয়। কিন্তু ঢাকা নগরী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে; সান্ধ্য আইনের তােয়াক্কা না করেই শহরে মিছিল বের করে। পথে পথে জনতার ঢল, তারা জোর আওয়াজ তােলে “বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর”, পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনতার উপর গুলি চালালাে। বুলেটবিদ্ধ অবস্থায় আহত ও নিহত লােকে হাসপাতাল ভরে গেল। শেখ মুজিব গুলি বর্ষণের তীব্র নিন্দা করে বিবৃতি দিলেন। বিবৃতিতে তিনি ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে সুশৃঙ্খলভাবে সর্বাত্মক হরতাল পালনের নির্দেশ দেন এবং ঘােষণা করেন যে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি পরবর্তী কর্মসূচির নির্দেশ প্রদান করবেন।
এদিকে পূর্বাঞ্চলের গভর্ণর ভাইস এ্যাডমিরাল এস, এম, আহসানকে সরিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব আলী খানকে প্রদেশের বেসামরিক শাসন। ব্যবস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। | ৩রা মার্চ-সারা বাংলাদেশে পূর্ণ দিবস হরতাল পালিত হয়। সেদিনের গণআন্দোলনের ভয়াবহতা উপলব্ধি করে ভুট্টো সাহেব সদলবলে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এই সাক্ষাতের পর এক সংক্ষিপ্ত বেতার ভাষণে ১০ই মার্চ রাজনৈতিক নের্তৃবৃন্দের এক সম্মেলন আহ্বান করেন, কিন্তু শেখ মুজিব এহেন সম্মেলনের নিষ্প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে তা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। বিকেলে পল্টন ময়দানে এক ভাষণে তিনি বলেন “বাংলার গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে না নিলে বাংলার মানুষ। সরকারকে সহযােগিতা করবে না, কর-খাজনা দেবে না। পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত অফিস-আদালতে যাবে না।” প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণের জবাবে তিনি বলেন, “যে মুহূর্তে বীর শহীদদের রক্তের দাগ রাজপথের বুক মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, সেই মুহূর্তে এ সম্মেলন বন্দুকের নলের মুখে নিষ্ঠুর তামাসা ।” দৈনিক ইত্তেফাকে ৪ঠা মার্চের এক রিপাের্টে জানা যায়, সেনাবাহিনীর গুলিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হয়। ৩রা মার্চ চট্টগ্রামের ফিরােজশাহ কলােনি, অয়্যারলেস কলােনি, আমবাগান, পাহাড়তলী, জুট ফ্যাক্টরি এবং সন্নিহিত অন্যান্য এলাকায় সকাল হইতে অপরাহ্ন পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড, হামলা, প্রতিহামলা, প্রাইভেট বন্দুকের গুলিবর্ষণ, সংঘর্ষ এবং আইন-শৃংখলারক্ষাবাহিনীর গুলি বর্ষণ ইত্যাদি ঘটনায় অন্যূণ অর্ধশতাধিক লােক প্রাণ হারাইয়াছে এবং কয়েক শত আহত হইয়াছে” । চট্টগ্রামের উপরােক্ত অবাঙালি এলাকা থেকে সিভিল পােষাক পরিহিত ২০তম বেলুচ রেজিমেন্টের। সৈন্যদের অবস্থান ও গুলিবর্ষণের সংবাদ শহরে দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়ে এবং সমগ্র শহরে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি করে। এ সংবাদে স্থানীয় ই, পি, আর সৈনিকদের উত্তেজিত হতে দেখা যায়।
৩রা মার্চ সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস তাঁর বিখ্যাত বই The Rape of Bangladesh এর ৯৩ পৃষ্ঠায় বলেছেন : There was serious trouble in Chittagong that night when the authorities tried to unload the M.V. Swat which arrived with troops and a cargo of ammunition. Dock workers spread the news. Soon thousands of people were locked in battle with West Pakistani soldiers and sailors. The trouble gained a new dimension when a unit of the East Pakistan Rifles refused to fire on Bengali demonstrators. Seven men were court-martialled and it is learnt, subsequently shot. This action gave a sharper edge to Bangali resentment” [“সেই রাতে চট্টগ্রামে ভীষণ গােলমাল হয় যখন কর্তৃপক্ষ সৈন্য ও গােলাবারুদসহ পশ্চিম থেকে আগত জাহাজ এম, ভি, সােয়াত খালাস করবার চেষ্টা করেছিল। ডক কর্মীর-খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে দেয়ার পর হাজার হাজার লােক পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য ও নাবিকদের সাথে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস্ এর একটি ইউনিট বাঙালি বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করতে অস্বীকার করলে পরিস্থিতি নতুন মােড় নেয়। ৭ জনকে কোর্ট মার্শাল করে পরবর্তিতে গুলি করে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়। বিফলে বাঙালি বিদ্বেষ আরও তীক্ষ্মতর রূপ ধারণ করে । বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আহুত ৩রা মার্চের হরতালের সাফল্যের উপর সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাস বলেছেন
—————
* ইত্তেফাক ২রা ও ৩রা মার্চ ১৯৭১ *
The Rape of Bangladesh. Page 93থেকে শুকিয়ে যায়নি, যখন বহু শহীদের নশ্বর দেহ দাফনের প্রতীক্ষায় পড়ে আছে, যখন শত শত বুলেটবিদ্ধ মানুষ হাসপাতালে “On 3rd March Mujibur Rahman called a province wide strike and launched a non-violent and non-cooperation movement. Everywhere the people responded to Sheikh Mujibur’s appeal and the movement became more orderly and effective. Restoration of order in Dacca was assisted by the withdrawal of troops after it was found they could not enforce the curfew. The troops also began to feel the pinch of hunger as supplies, including food stuffs were denied on the orders of the Awami League” [মুজিবুর রহমান ৩রা মার্চ সারা প্রদেশে হরতালের ডাক দেন এবং অসহযােগ। আন্দোলনের ঘােষণা প্রদান করেন। সর্বত্রই জনগণ শেখ মুজিবের ডাকে সাড়া দেয় এবং আন্দোলন আরও সুশৃংখল ও ফলদায়ক হয়ে ওঠে। সান্ধ্য-আইন বলবত করা অসম্ভব হয়ে পড়িলে সৈন্য প্রত্যাহার করার পর ঢাকায় শৃঙ্খলা ফিরে আসে। আওয়ামী লীগের আদেশে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করার প্রেক্ষিতে সৈন্যরাও ক্ষুধার কষ্ট হাড়ে হাড়ে টের পেতে থাকেন। ৪ঠা মার্চ-পদচ্যুত গভর্ণর ভাইস এ্যাডমিরেল এস, এম, আহসান বিমানযােগে করাচীর উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করলেন। একই দিনে অবসর প্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। ঐদিন থেকেই ঢাকা রেডিও এবং টেলিভিশনের বাঙালি কর্মচারীদের উদ্যোগে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ কেবল ঢাকা বেতার কেন্দ্র এবং পাকিস্তান টেলিভিশন’ কেবল ‘ঢাকা টেলিভিশন’ নামে নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ করে। ৫ই মার্চ-টঙ্গী শিল্প এলাকায় উত্তাল জনতার উপর সশস্ত্রবাহিনী গুলি চালিয়ে ৪জনকে হত্যা করলাে, আহত হলাে ২৫ জন। এই হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা শহরের আপামর জনতা শহীদ মিনারে সমবেত হল। ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমেদ সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আগামী ৭ই মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার থেকে রিলে করার আহবান জানালেন। ঐ দিন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান শেখ মুজিবের সাথে তার ধানমণ্ডির বাসভবনে সাক্ষাৎ করেন। ৬ই মার্চ-প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার যােগে ২৫ শে মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা ঘােষণা করেন। সেই সাথে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে নিযুক্তির কথা ঘােষণা করা হয়। ঐ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে ৩৫০ জন কয়েদী পলায়ন করলে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ৭জন নিহত ও ৩০ জন আহত হল। ধরা পড়লাে মাত্র ১৬ জন । ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আনুমানিক দশ লক্ষাধিক লােকের বিশাল জনসমুদ্রে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ত্যাজোদ্দীপ্ত ভাষণে বলেন : বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ
৭ই মার্চ ১৯৭১ ভাইয়েরা আমার, আজ অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বােঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি, কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রংপুর ও যশােরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, তারা বাঁচতে চায়, তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা ভােট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়ী করেছিলেন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে-আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবাে এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষ আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক মাসন জারী করে আইউব খান দশ বছর আমাদের গােলাম করে রাখলাে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা দেয়া হলাে এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হল। ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনের মুখে। আইউবের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের হাতে। ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন, শাসনতন্ত্র দেবেন-আমরা মেনে নিলাম। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলােচনা হলাে-আমরা তাঁকে ১৫ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরােধ করলাম। কিন্তু মেজরিটি পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজিরিটি পার্টির নেতা নই-সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা । ভুট্টো সাহেব বললেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে। তিনি মার্চের তিন তারিখ অধিবেশন ডাকলেন। আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব, এমনিক তিনি যদি একজনও হন। জনাব ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন, তাঁর সঙ্গে আলােচনা হল । ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন, আলােচনার দরজা বন্ধ নয়, আরাে আলােচনা হবে। মওলানা নূরানী, মাওলানা মুফতি মাহমুদ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারি নেতারা এলেন, তাদের সঙ্গে আলােচনা হলাে উদ্দেশ্য ছিল আলাপ আলােচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবাে। তবে তাঁদের আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, ৬-দফা পরিবর্তনের কোনাে অধিকার আমার নেই, এটা জনগণের সম্পদ। কিন্তু ভুট্টো সাহেব হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ডবল জিম্মী হতে পারবেন না, পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেয়া হবে, হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু পেশােয়ার থেকে করাচী। পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেয়া হবে না।
তা সত্ত্বেও ২৫জন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য এলেন। কিন্তু পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেয়া হলাে বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলাে আমাকে। বলা হলাে আমার অনমনীয় মনােভাবের জন্যই কিছু করা হয়নি। এরপর বাংলার মানুষ প্রতিবাদ-মুখর হয়ে উঠল। আমি শান্তিপূর্ণ সগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এল। কিন্তু কি পেলাম আমরা বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হল। আমাদের হাতে অস্ত্র নেই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষকে হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলি। আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে -আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। ‘ | ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি ১০ই মার্চ তারিখে গােলটেবিল বৈঠকে যােগদান করতে চেয়েছি-তাঁর সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাঁকে বলেছি-আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় আসুন, দেখুন, আমার গরীব জনসাধারণকে কিভাবে হত্যা করা হয়েছে; আমার মায়ের কোল কিভাবে খালি করা হয়েছে, আমি আগেই বলে দিয়েছি, কোনাে গােলটেবিল বৈঠক হবে না, কিসের গােলটেবিল বৈঠক? কার গােলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা-বােনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসবাে আমি গােলটেবিল বৈঠকে? তেশরা তারিখে পল্টনে আমি অসহযােগের আহ্বান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, বাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমার দলের সঙ্গে আলােচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার মানুষের উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ করলেন ভুট্টো, কিন্তু গুলি করা হলাে আমার বাংলার মানুষকে, আমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের; আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের। | ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্তু আমার দাবি, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে-তারপর বিবেচনা করে দেখবাে পরিষদে বসবাে কি বসবাে না। এ দাবি মানার আগে পরিষদে বসার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনাে শুকায়নি, শহীদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ তারিখে পরিষদে যােগ দিতে যাব না।
ভাইয়েরা আমার, আমার উপর বিশ্বাস আছে।’ (লাখাে জনতা হাত উঠিয়ে হাঁ বলে। আমি প্রধান মন্ত্রীত্ব চাই না, মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লােভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। | আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শােধ করবাে। মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শােধ করতে প্রস্তুত। | আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট-কাচারি, হাই কোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনও কর্মচারী অফিসে যাবেন না । এ’আমার নির্দেশ। | গরীবের যাতে কষ্ট না হয় তার রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। ট্রেন চলবে, তবে সেনাবাহিনী আনা নেওয়া করা যাবে না। করলে যদি কোনাে দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকবে না। | সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট সহ সরকারি, আধা-সরকারি, এবং স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলাে বন্ধ। শুধু পূর্ব বাংলার আদান-প্রদানের জন্য ব্যাংকগুলাে ভােলা থাকবে। তবে এখন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবে না। বাঙালিরা বুঝে শুনে চলবেন। টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে, তবে সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন। এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন। দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন। বেতন যদি না দেওয়া হয়, যদি একটি গুলি চলে তাহলে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল-যার যা আছে তা-ই দিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিতে হবে। আমরা তাদের ভাতে মারবাে, পানিতে মারবাে। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, যদি আমার সহকর্মীরা না থাকেন, আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। তােমরা আমার ভাই, তােমরা ব্যারাকে থাক, কেউ কিছু বলবে না। গুলি চালালে আর ভালাে হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবাতে পারবে না। শহীদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবাে। আপনারা যে যা পারেন দিয়ে যাবেন। সাতদিনের হরতালে যে সব শ্রমিক অংশ গ্রহণ করেছেন, কারফিউ’র জন্য কাজ করতে পারেননি।
শিল্পমালিকেরা তাদের পুরাে বেতন দিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে। দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না পাওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপর ছেড়ে দেন-আন্দোলন কিভাবে করতে হয় তা আমি জানি। কিন্তু হুঁশিয়ার, একটা কথা মনে রাখবেন, আমাদের মধ্যে শক্র ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্মকলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোনাে বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবে না। শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই-ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা। আছে, তা না হলে নেই । বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যাবে। আমার অনুরােধ প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নের্তৃত্বে। সগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রস্তুত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন, আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। শৃঙ্খলা বজায় রাখুন। কারণ, শৃখলা ছাড়া কোনাে জাতি সগ্রামে জয়লাভ করতে পারে না। জয় বাংলা। ঐ দিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেবেন, এমন আশা অনেকেই করেছিলেন। অনেকের মতাে মেজর ওসমানও মনে করেন যে, ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। উপস্থিত রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রকে সাথে নিয়ে অগ্রসর হলে কয়েক শ বা কয়েক হাজার প্রাণের বিনিময়ে হলেও ঢাকা সেনানিবাস দখল করা অসম্ভব ছিল না। কিন্তু সেদিন নেতা আমাদের, তথা সব বাঙালিদেরই হতাশ করেছেন। এমনকি বিখ্যাত সাংবাদিক এ্যান্থনী ম্যাসকারেনহাসও ৭ই মার্চের উপর মন্তব্য করে বলেছেন, “জনগণের একজন বিপ্লবী নেতা হিসেবে আওয়ামী লীগ-প্রধান যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তার প্রতি তার আস্থা থাকলে তিনি টিক্কা খানের আত্মসমর্পণের দাবি করে তাকে হাতের মুঠোর পাওয়ার জন্য দৃঢ় মনােভাবাপন্ন লাখ লাখ বাঙালিকে চার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনানিবাসে পাঠাতেন।
বাঙালিরা তা করার জন্য প্রস্তুত ছিল এবং সেনাবাহিনীকে পর্যন্ত করার জন্য সানন্দে কয়েক শ লােক জীবন বিসর্জন দিত। তখন ন্যূনতম রক্তপাতে বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ লাভ করত। পরবর্তীকালে কিছুতেই লাখ লাখ লােক নিহত হতাে না এবং সেনা বাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে অগনিত লােক দেশ ত্যাগ করতাে না।” এতদসত্বেও তার ৭ই মার্চের ঘােষণা-“এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”-কে বাঙালি জাতির ভবিষ্যত করণীয়’র ব্যাপারে। সবুজ সংকেত বলেই ধরে নেয়া যেতে পারে। ২৬শে মার্চ চুয়াডাঙ্গায় বিদ্রোহ ঘােষণার প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধুর ঐ ঘােষণার প্রতিই মেজর ওসমানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি ও পরিপূর্ণ আস্থা ছিল।
—————-
* দৈনিক পূর্বদেশ, ৮ই মার্চ ১৯৭১
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী