বাংলা ভাষার সাংবিধানিক স্বীকৃতি
১৯৫৫ সালের ৬ই জুন আবু হােসেন সরকার বাংলায় যুক্তফ্রন্টের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। সেই সরকারের অধীনে শত সমস্যার মাঝেও এই প্রথম মুক্ত মনে, যেন মুক্ত মাটিতে ছাপ্পান্নোর ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালিত হয়। গৃহে গৃহে উডড্ডীন কালাে পতাকা, শহীদদের সংগ্রাম ও আদর্শের উত্তরাধিকারী ছাত্রছাত্রী ও তরুণ-তরুণীদের বাতে সন্নিবিষ্ট কালাে ব্যজ, নীরবে নগ্ন পদে শােক প্রকাশ, শিক্ষায়তন ও ছাত্রাবাসগুলাের সামনে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, সাশ্রুনেত্রে দলে দলে নাগরিকদের শহীদের মাজার জেয়ারত ও শহীদমিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ এবং পূর্ণ হরতালের মধ্যে দিয়ে শােক বিহবল মহানগরী ঢাকা সেবারের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করে। সপ্তাহের ব্যবধানে ২৯শে ফেব্রুয়ারি বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। ঐ দিন পাকিস্তান গণপরিষদে পাকিস্তান ইসলামিক রিপাবলিকের প্রথম সংবধািন গৃহীত হয়। ঐ সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ২১৪নং অনুচ্ছেদটি ছিল নিম্নরূপ: 214. 1. The state language of Pakistan shall be Urdu & Bengali : Provided that for the period of twenty years from the Constitution Day. English shall continue to be used for all official purposes for which it was used in Pakistan immediately before the Constitution Day. And Parliament may be Act, provide for the use of English after the expiration of the said period of twenty years, for such purposes as may be specified in that Act. 2. On the expiration of ten years from the Constitution Day, the President shall appoint a Commission to make recommendations for the replacement of English. 3. Nothing in this Article shall prevent a Provincial Government from replacing English by either of the state Languages for use in that period of twenty years. বাংলা অনুবাদ ২১৪- ১. উর্দু ও বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।
তবে সংবিধান-দিবসের অব্যবহিত পূর্ব পর্যন্ত পাকিস্তানের যে সকল সরকারি উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ইংরেজি ভাষা ব্যবহৃত হয়েছে, সেই সকল উদ্দেশ্য উক্ত ভাষা সংবিধান দিবস থেকে আরম্ভ করে কুড়ি বছর মেয়াদের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকবে, এবং উক্ত কুড়ি বছর মেয়াদ অতিবাহিত হবার পর। সংসদ আইন দ্বারা যেরূপ উদ্দেশ্য নিরূপণ করবেন, সেইরূপ উদ্দেশ্য। পরিপালনের জন্য ইংরেজি ভাষা ব্যবহারের বিধান করা যাবে। সংবিধান দিবস থেকে আরম্ভ করে দশ বছর মেয়াদ অতিবাহিত হলে ইংরেজি ভাষা পরিবর্তন কল্পে সুপারিশ করার জন্য রাষ্ট্রপতি একটি কমিশন নিয়োেগ করবেন। ৩. এই অনুচ্ছেদে এমন কিছুই নাই, যা উক্ত কুড়ি বছর মেয়াদ অতিবাহিত হবার আগে কোনাে প্রাদেশিক সরকারকে সেই প্রদেশে যে কোনাে একটি রাষ্ট্রভাষার দ্বারা ইংরেজি ভাষাকে পরিবর্তিত করা থেকে বিরত রাখতে পারবে। ভাষা সংক্রান্ত এই অনুচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে যে, সংবিধানের এই বিধানে সরকারি কাজে বাংলা বা উর্দুর ব্যবহার কেবল কুড়ি বছর নয়, আরাে বহুকাল স্থগিত রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। এমতাবস্থায় ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান The Constitution of the Republic of Pakistan (গণপ্রজাতন্ত্রী পাকিস্তানের সংবিধান) নামক সংবিধান প্রবর্তন করেন যাতে রাষ্ট্রভাষার। পরিবর্তে ব্যবহৃত জাতীয় ভাষা সংক্রান্ত ২১৫ অনুচ্ছেদটি ছিল নিম্নরূপ : 215 – 1. The National languages of Pakistan are Bengali and Urdu but this article shall not be construed as preventing the use of any other language and in particular the English language may be used its replacement are made. (2) In the year one thousand nine hundred and seventy two, the President shall constitute a Commission to examine and report on the question of replacement of the English language for official purposes.”
বাংলা অনুবাদ : ২১৫-১, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা বাংলা ও উর্দু; কিন্তু এই অনুচ্ছেদকে অন্য কোনাে ভাষা ব্যবহারের প্রতিবন্ধকরূপে কাজে লাগানাে যাবে না, বিশেষত : ইংরেজি ভাষা পরিবর্তনের ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত এ ভাষা সরকারি ও অন্যান্য উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ব্যবহৃত হতে পারবে। ২. সরকারি উদ্দেশ্য পরিপালনের জন্য ইংরেজি ভাষা পরিবর্তনের প্রশ্নটি পরীক্ষা ও তার উপর প্রতিবেদন পেশকল্পে এক হাজার নয়শত বাহাত্তর সালে রাষ্ট্রপতি একটি কমিশন গঠন করবেন। বহু বেদনা বহু যাতনা, বহু ক্লেদাক্ত ও কন্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে অবশেষে বাংলা পেলাে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা তথা জাতীয় ভাষার মর্যাদা। আমরা আবার দেখতে পেলাম-মুদ্রা, মনিঅর্ডার ফর্ম ও ডাক টিকেটের উপর ইংরেজি ও উর্দুর সাথে বাংলার ব্যবহার। জয় হলাে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের, জয় হলাে বাংলার মানুষের। সার্থক হলাে শত শত শহীদের আত্মদান।
————
* উদ্ধৃতি : বশীর আল হেলাল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী