রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত বনাম দুর্যোগের ঘনঘটা
বাংলার বুকে স্বাধীনতার আনন্দোৎসব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। দেশের রাষ্ট্রভাষা’র প্রশ্নে অচিরেই বাংলার উপর নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা পুলিশী অত্যাচার ও উৎপীড়ন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই দেশের মনিঅর্ডার ফর্ম, মুদ্রা ও ডাকটিকেটের উপর দেখা গেল শুধুমাত্র ইংরেজি ও উর্দুর ব্যবহার, বাংলার ব্যবহার পুরােপুরি অনুপস্থিত। বাংলার ব্যবহার এগুলাে থেকে বাদ দেওয়ার ফলে পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ, বিশেষ করে ছাত্রসমাজ ও বুদ্ধিজীবী মহলে উত্তেজনা ও বিরূপ মনােভাবের সৃষ্টি হয়। এর অবধারিত ফলাফল-১৯৪৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র ও অধ্যাপকের উদ্যোগে গঠিত হয় তমদুন মজলিস” নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। দেশের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে এই সংগঠন প্রথম থেকেই অত্যন্ত সক্রিয় ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করে। ১৫ই সেপ্টেম্বর এই সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু”? এই নামে একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করা হয়। মজলিসের প্রধান কর্মকর্তা জনাব আবুল কাশেম পুস্তিকাটিতে রাষ্ট্রভাষার উপর প্রস্তাব করেন যে ; ১. পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ভাষা হবে দুটি-বাংলা ও উর্দু। ২. পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের ভাষা হবে বাংলা এবং বাংলাই হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন, তবে উর্দু ও ইংরেজি হবে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষা ৩. পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের ভাষা হবে উর্দু এবং শিক্ষার বাহনও হবে উর্দু, তবে বাংলা ও ইংরেজি হবে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাষা। পুস্তিকাটিতে দৈনিক ইত্তেহাদ সম্পাদক জনাব আবুল মনসুর বলেন, “-উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করিলে পূর্ব-পাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ রাতারাতি অশিক্ষিত ও সরকারি চাকুরির অযােগ্য হইয়া যাইবেন।” প্রখ্যাত অধ্যাপক ড. কাজী মােতাহার হােসেন বলেন, –যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের উপর রাষ্ট্রভাষা রূপে চাপাবার চেষ্টা হয় তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে।
কারণ ধুমায়িত অসন্তোষ বেশিদিন চাপা থাকতে পারে না। শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশংকা আছে।” সরকারের বিরােধী তৎপরতা ও বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে যদিও পুস্তিকাটি ব্যপকভাবে প্রদেশের সর্বত্র বিলি করা সম্ভব হয়নি, তবুও এর বক্তব্য বাঙালি জনসাধারণের মনে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” এর অনুকূলে ব্যাপকভাবে আলােড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। তবে পূর্বপাকিস্তানে কর্মরত অধিকসংখ্যক উর্দুভাষী সরকারি কর্মচারি। ও পশ্চিম-পাকিস্তানি আমলাদের বাঙালি-বিরােধী মনােভাব ও কার্যকলাপের ফলেই মূলত পূর্ব-পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনের জন্ম ও দ্রুত প্রসার লাভ ঘটে। ‘তমদুন মজলিস’র উদ্যোগে সে বছর অক্টোবরেই গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ইতােমধ্যে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক স্ত্রীদের সমম্বয়ে করাচির এক শিক্ষা সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বসম্মতিক্রমে এক প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে পূর্ব-বাংলায় প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এই উত্তেজনা সৃষ্টির ফলে সরকারি মহলে দারুণ উদ্বেগের সঞ্চার হয়। পরবর্তীকালে শিক্ষাদপ্তর এক প্রেসবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভ্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে এই উত্তেজনা উপশম করার প্রয়াস পায়। কিন্তু সরকারি সে চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। উপরন্তু ৬ ডিসেম্বর এই
————————-
* উদ্ধৃতি : বদরুদ্দীন উমর ‘পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি: ‘ প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৩১
আরবি অক্ষরে বাংলা শিক্ষাদানের ষড়যন্ত্র
বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার মধ্যেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলা-ভাষা-বিরােধী চক্রান্ত সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাকে ধ্বংস করার অন্যতম উপায় হিসেবে তারা বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর প্রবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ১৯৪৭ সনে স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরই । এই ব্যাপারে পশ্চিমা প্রভুদের সাহায্য সহযােগিতা করার জন্য বাংলায় বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের দোসরদের অভাব হয়নি। এই শব্দ পরিবর্তন প্রচেষ্টার দার্শনিক এবং মূল প্রবক্তা ছিলেন পূর্ববাংলার প্রতিনিধি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান। তার দর্শনমতে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সংহতি এবং জনগণের মধ্যে অর্থপূর্ণ ঐক্য রক্ষা ও সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে পাকিস্তানের সকল ভাষার অক্ষর এক হওয়া উচিত। পাকিস্তানে সিন্ধী, পুশতু, পাঞ্জাবি ভাষার অক্ষর অনেকটা আরবির মত; তাই সেক্ষেত্রে তার কোনাে অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বাংলার সাথে আরবি অক্ষরের কোনাে মিলই নেই; আর তাই বাংলাকে নিয়েই মন্ত্রী মহােদয়ের ছিল যত বিড়ম্বনা। এমতাবস্থায় তার মতে বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষরের প্রচলন ব্যতিত বাংলাভাষীদের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যথার্থ সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আত্মিক ঐক্য সম্ভব নয়। সেদিক দিয়ে নাকি এই পরিবর্তন অবশ্যই প্রয়ােজনীয়! | বাংলা ভাষায় আরবি অক্ষর প্রবর্তনের পক্ষে ফজলুর রহমানের উৎসাহ-উদ্যোগ সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য হলেও অন্যান্য বাঙালি মন্ত্রী এবং আমলাদের কৃতিত্বও এক্ষেত্রে ছিল প্রনিধানযােগ্য। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক শিক্ষা দপ্তরের সেক্রেটারি ফজলে আহমদ করিম ফজলী ছিলেন বাংলাতে আরবি অক্ষর প্রবর্তন প্রচেষ্টার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। চট্টগ্রামের জনৈক মাওলানা জুলফিকার আলীকে দিয়ে করিম ফজলী এবং ফজলুর রহমান উভয়ে ‘হুরফুল কোরআন সমিতি’ নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠা করে তার মাধ্যমে আরবি অক্ষর বাংলাতে প্রবর্তনের আন্দোলন গঠনের চেষ্টা করেন। এ সম্পর্কে পূর্ব-বাংলা শিক্ষা বিভাগের প্রাক্তন পরিচালক জনাব আবদুল হাকিমের ভাষায় ;
জনৈক বাঙালি উজির সাহেবের নিজের উর্দুজ্ঞান সম্পর্কে ঢাকাতে কিছু কিছু হাস্যোদ্দীপক কিংবদন্তী শ্রুত হয়। ইনি কেন্দ্রের সর্বশক্তিমান উর্দুমহলে বাহবা পেতে চেয়ে বাংলা ভাষাকে “হুরফুল কোরআন” দ্বারা সুশােভিত করবার জন্য তার উদগ্র আকাকে কার্যকরী করতে চেয়েছিলেন। এজন্য বই পুস্তক প্রকাশনার জন্য বার্ষিক ৩৫ হাজার টাকার একটা কেন্দ্রীয় মঞ্জুরিও তিনি পূর্বোক্ত প্রাদেশিক শিক্ষা সেক্রেটারি হাতে দেবার ব্যবস্থা করেন।” আরবি অক্ষর বাংলাতে প্রবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে ধ্বংস করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ঘৃণ্য তৎপরতার গভীরতা অনুধাবন করা যায় ১৯৫২ সালের ২৭শে জানুয়ারি
——–
* (‘উদ্ধতি : বদরুদ্দীন উমর “পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি” ১ম খণ্ড পৃঃ ২৫৯। * কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ফজলুর রহমান। ‘ ফজলে আহমেদ করিম ফলি
তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন ময়দানের ভাষণ থেকে। আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে নাজিমুদ্দিন তার বক্তৃতায় বলেন, “ইতােমধ্যেই সরকারি তত্ত্বাবধানে ২১ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্রে সাফল্যের সাথে আরবি অক্ষরে বাংলা ভাষা শিক্ষাদান করা হয়েছে। তাছাড়া এ ধরনের অসংখ্য শিক্ষাকেন্দ্র জনসাধারণ কর্তৃক ভােলা হয়েছে। এ ধরনের নিরেট মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক বাংলার মানুষের কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে তাদের উন্নয়নের দ্বার রুদ্ধ করার ঘৃণ্য প্রচেষ্টা ইতিহাসে সত্যিই নিন্দনীয় হয়ে লিপিবদ্ধ থাকবে। | ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলায় আপামর জনসাধারণ বাংলা ভাষার অপসংস্করণ প্রচেষ্টাকে রুখে দাঁড়িয়েছে। পল্টনে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের এই ধরনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সমস্ত পূর্ববাংলায় প্রতিবাদ সভা ও মিছিল করে ছাত্ররা জোর আওয়াজ তােলেন, রাষ্ট্রভাষা | বাংলা চাই’ আরবি অক্ষরে বাংলা আমরা সহ্য করবাে না’ নাজিমুদ্দিন গদি ছাড়াে’ ইত্যাদি । এই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ার জের হিসেবেই এই প্রথমারের মতাে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন সংগঠনের প্রায় ৩০ জন প্রতিনিধি নিয়ে পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহসভাপতি কাজী গােলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয় ।
আন্দোলনের নতুন ধারা
এরপর আন্দোলন এক নতুন ধারায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়। ৩রা মার্চ ১৯৪৯, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভূক কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবি দাওয়ার প্রেক্ষিতে ধর্মঘট শুরু করে। এই ধর্মঘটের সমর্থনে ছাত্ররাও ক্লাশ বর্জন করে। ৫ই মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় ছাত্ররা স্থির করে যে নিম্ন বেতনভূক কর্মচারীদের দাবি কর্তৃপক্ষ স্বীকার না করা পর্যন্ত তারা সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবে । কিন্তু ছাত্রদের যথােচিত সাহায্য ও সমর্থন লাভ করা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চক্রান্তে তাদের সেই ধর্মঘট ব্যর্থতায় পর্যবেসিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ৭ (সাত) দিনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং কর্মচারীদের ধর্মঘটে অংশ গ্রহণের অজুহাতে ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর প্রতিবাদে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন ও পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৭ই এপ্রিল সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে ছাত্র ধর্মঘট ঘােষণা করে। সেদিন হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সভা করে এবং তারপর মিছিল করে উপাচার্যের বাসভবনে উপস্থিত হয়। কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তারা উপাচার্যের সাথে দেখা করতে পারেনি। পরদিন ১৮ই এপ্রিল শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ধর্মঘট পালন করে এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে তাদের এক বিরাট মিছিল শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদক্ষিণ করে বিকেলে উপাচার্যের বাড়িতে প্রবেশ করে। সেদিনই বিকেল সাড়ে পাঁচটায় উপাচার্যের বাসভবনে বিশ্ববিদ্যালয় এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের এক বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে ছাত্রদের সাথে কর্তৃপক্ষের আলােচনা ব্যর্থ হয় যার প্রেক্ষিতে ৩০ জন ছাত্র উপাচার্যের বাড়ির প্রাঙ্গণে অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্ম পরিষদ ২০শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘট ঘােষণা করে। ২০ শে এপ্রিল ঢাকার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট শুরু হয়। পুলিশের বাধা সত্ত্বেও বেলা দেড়টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এক বিরাট ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় পুলিশী-জুলুমের নিন্দা করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বহিষ্কারাদেশ সরকারি দমন নীতিরই যে বীভৎসরূপ, তা বক্তৃতার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এবং তার প্রতিকারার্থে ছাত্ররা মিছিল সহকারে সেক্রেটারিয়েটের দিকে অগ্রসর হয়। ঢাকা হলের কাছে পুলিশ মিছিলের উপর বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে এবং কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মিছিলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। কিন্তু পুলিশী অত্যাচার সত্ত্বেও ছাত্র-ছাত্রীরা আবার একত্রিত হয়ে বেলা ৩টার দিকে মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করে আর্মানিটোলা মাঠে সমবেত হয় এবং সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্ররা পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পুলিশী জুলুমের প্রতিবাদে পরদিন আবার ধর্মঘট ঘােষণা করে। সেদিন বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতাকে ও পুলিশ গ্রেফতার করে। ২১ শে এপ্রিল আর্মানিটোলা মাঠে ধর্মঘট ঘােষণার প্রেক্ষিতে বিকেলের দিকে ছাত্ররা মিছিল করে করােনেশন পার্কে উপস্থিত হয় এবং সেখানে একটি জনসভা করে।
২২শে এপ্রিল ঢাকা হলে ছাত্রদের এক সভায় ৬ (ছয়) জনকে নিয়ে একটি কর্মপরিষদ গঠিত হয়। ছাত্র-কর্ম-পরিষদ ২৫শে এপ্রিল সাধারণ ধর্মঘটের ঘােষণা দেয়। পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৪৯ এর ২৫শে এপ্রিল একটি গুরুত্বপূর্ণ পথচিহ্ন। কিছু সংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্রের বিরােধিতা ও বিশ্বাসঘাতকতা এবং সরকারের দমনমূলক ব্যাপক ব্যবস্থা সত্ত্বেও এই দিনই ছাত্রদের সাথে বৃহত্তর জনসাধারণের সত্যিকার রাজনৈতিক সংযােগ স্থাপিত হয় এবং ছাত্র-জনতা সম্মিলিতভাবে স্বৈরাচারী সরকারের নির্যাতন ও প্রতিক্রিয়াশীল নীতির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ভিত্তি স্থাপন করে। এই দিন ঢাকা শহরে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। নীলক্ষেত ও পলাশী ব্যারাকের সরকারি কর্মচারীরা অফিসে না গিয়ে বেলা ১টা পর্যন্ত ঢাকার সব দোকান পাট, এমন কি রিক্সা পর্যন্ত বন্ধ করতে তৎপর হয় এবং সেদিনের সেই ঐতিহাসিক ধর্মঘটে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একত্রিত হয়। লেখক বদরউদ্দিন উমরের ভাষায়, “নির্যাতিত ছাত্রদের থেকে শহরের উৎপীড়িত জনসাধারণ ও শ্রমিক কর্মচারীদেরকে বিচ্ছিন্ন করার চক্রান্তকে সম্পূর্ণভাবে বানচাল করে ২৫শে এপ্রিল বস্তুতপক্ষে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে রচনা করেছিল এক নতুন দিগন্ত।” ঐদিন ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হাজার হাজার ধর্মঘটি ছাত্রছাত্রীরা দলে। দলে আর্মানিটোলা ময়দানে সমবেত হয় এবং বেলা ১টায় প্রখ্যাত ছাত্রনেতা তাজউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাশেষে ময়দান থেকে ছাত্র ও জনসাধারণের এক বিরাট মিছিল বিভিন্ন ধ্বনিতে ঢাকার আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে। সেক্রেটারিয়েটের দিকে অগ্রসর হয়, কিন্তু নাজিরা বাজার রেলক্রসিং- এর নিকট সশস্ত্র পুলিশের বাধাপ্রাপ্ত হয়। মিছিলের জনসাধারণ ব্যারিকেড ভাঙতে হবে,” “১৪৪ ধারা মানবাে না” ইত্যাদি ধ্বনিতে ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশ কর্ডন ভেদ করবার চেষ্টা করলে পুলিশ লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস দ্বারা তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পুলিশ নির্দয়ভাবে লাঠি চালিয়ে বহুলােককে আহত করে এবং সেদিনের ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট ছাত্রদের মধ্যে। শেখ মুজিবুর রহমান সহ ২৪ জনকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে। এই নির্যাতনের পরও ছাত্র-জনতার মধ্যে হতাশার সৃষ্টি হয়নি। তারা বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে ভিক্টোরিয়া পার্কে (বাহাদুর শাহ পার্ক) সমবেত হয়। ভিক্টোরিয়া পার্কের সেই সভায় জনসাধারণ দলে দলে যােগদান করে বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্রদের প্রতি তাদের
—————————-
* ম্যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এখন সরকারি কর্মকর্তা/ কর্মচারীদের বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত
সারি সারি মুপিলাশের তৈরি ব্যাৱকই পলাশী ব্যারাক নামে পরিচিত। এই ব্যারাকের বাসিন্দাদের সুখ-দুল নিয়ে শহীদ মুনির চৌধুবাদের বিখ্যাত নাটক ‘পলাশী ব্যারাক।’
ঐক্য ও সংহতির কথা ঘােষণা করে। এই সভায় পরদিন প্রতিবাদ ধর্মঘট ও একই স্থানে সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
আন্দোলনের এই পর্যায়ের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রআন্দোলনের ব্যাপকতা পূনর্বার ধীরে ধীরে কমে আসে। ২৬শে এপ্রিলের ধর্মঘট ও সাধারণ সভার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়। এরপর ছাত্র কর্ম পরিষদ পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য মাঝে মাঝে বৈঠকে বসে এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মঘটের আহবান জানায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও আন্দোলনের পূর্বাবস্থা আর ফিরে আসেনি। ১৯৪৯ সালের মার্চ-এপ্রিল আন্দোলনে যে সমস্ত ছাত্রনেতারা গ্রেফতার হন, তারা ক্রমে ক্রমে মুক্তিলাভ করেন। এদের মধ্যে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের। পক্ষে হাইকোর্টে হেবিয়াস-কর্পাস এর আবেদন করা হয়। এই কেইস পরিচালনাকালে। জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী হাইকোর্টকে বলেন যে দবিরুল ইসলামের আটকাদেশ অযৌক্তিক। দবিরুল ইসলাম মন্ত্রিসভার বিরােধী হতে পারে, কিন্তু মন্ত্রিসভার বিরােধিতার অর্থ রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। সুতরাং সেই অভিযােগে কোনাে ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনে আটক করা যায় না। এরপর দবিরুল ইসলামকে ১৯৫০ সনের ১০ই জানুয়ারি বিনা শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। তার কিছুদিন পূর্বেই নভেম্বরে গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতা রাজশাহীর আতাউর রহমান এবং খুলনার মােহাম্মদ একরামকেও মুক্তি দেওয়া হয়। | তারপর দেখতে দেখতে কেটে গেল আমার ছাত্রজীবনের আরাে দুটি বৎসর, যখন আমাদের স্কুলে ছাত্র আন্দোলন, মিছিল বা ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়নি। ম্যাট্রিক (বর্তমানে এস, এস, সি) পরীক্ষা দিলাম ১৯৫১ সালের ২১ শে মার্চ আমারই গ্রামের চান্দ্রা ইমাম আলী হাই স্কুল থেকে। পরীক্ষার ফলাফল আশাতীত রকম ভালাে দেখে মরহুম নূরুল ইসলাম চৌধুরীর (যিনি ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত ২৭ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে ছিলেন অন্যতম) বক্তিগত প্রচেষ্টায় বাবা আমাকে। ভর্তি করে দিলেন ঢাকা কলেজে। ঢাকার রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের গতি প্রবাহের সাথে ঘটে আমার প্রত্যক্ষ সংযােগ কিন্তু পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে ১৯৪৮/৪৯ এর ভাষা। আন্দোলনের পরবর্তী দুই বৎসর পর্যন্ত এ বিষয়ে উল্লেখযােগ্য কোনাে অগ্রগতি সাধিত হয়নি, যদিও আটচল্লিশােত্তর সময়ে প্রতি বৎসরই ১১ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা-দিবস পালনােপলক্ষ্যে সভা-সমিতির মাধ্যমে সরকারের ভাষা বিরােধিতার সমালােচনা ও নিন্দা করা হয়েছে।
——————————–
* ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধকালিন সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী।
১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে নিমর্ম ভাবে শহীদ।
বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠন ও তার কার্যাবলী
১৯৫১ সাল। প্রতিবারের মতাে এবারও ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস উদ্যাপন করা হয়। তবে এ’ বৎসরে ঐ দিবসটি উদযাপনােপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভায় আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদ গঠিত হয়। ২৫শে মার্চ এই কর্মপরিষদের বৈঠকে এক খসড়া স্মারকলিপি প্রণয়ন করা হয়। অবাঙালিদের বুঝবার সুবিধার্থে ঐ স্মারকলিপিটি ইংরেজিতে ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের কাছে এবং দেশের উভয় অংশের বিভিন্ন সংবাদপত্রের কাছে পাঠানাে হয়। দীর্ঘ ঐ স্মারক লিপিটির উল্লেখযােগ্য কিছু অংশ পাঠকমণ্ডলির প্রণিধানার্থে উদ্ধৃত করার প্রয়ােজন অনুভব করছি : “-যদি পাকিস্তানের একটি মাত্র রাষ্ট্রভাষা হতে হয়, তাহলে সেটা হবে, বাংলা, যদি তা একাধিক হতে হয়, তাহলে বাংলাকে হতে হবে তার মধ্যে অন্যতম। -জনগণের যে সকল প্রতিনিধি দেশের সব কিছু পরিচালনা করছেন, আমরা তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, কেন্দ্রে এবং প্রদেশে বাংলার দাবি যতক্ষণ পর্যন্ত না। পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের, তথা সারা পূর্বপাকিস্তানের ছাত্ররা শান্ত হবে না।”
লিয়াকত আলীর ইন্তেকাল
রাষ্ট্রভাষাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই সমস্ত তৎপরতা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সংবিধান সভায় রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কোনাে প্রশ্ন বা প্রস্তাব কেউ উত্থাপন করেনি দীর্ঘকাল। বিশেষ করে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের ভাষার প্রশ্নে নিদারুণ ঔদাসিন্য ও নিষ্ক্রিয়তা ছিল বাংলার স্বার্থবিরােধী অমার্জনীয় অপরাধ। রাষ্ট্রভাষার উত্তেজনা ও গােলযােগকে সময়ের আবর্তে প্রশমিত হওয়া বা চাপা দেবার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলীর নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার ভাষার বিষয়ে দীর্ঘকাল এক চক্রান্তমূলক নীরবতা বজায় রাখেন। তাঁর পূর্ব পাকিস্তান সফরকালীন সময়ে ভাষার ব্যাপারে কোনাে প্রকার উচ্চবাচ্য না করে মৌনতা অবলম্বনের দৃষ্টান্ত থেকেই তা বােঝ যায়। এমনি সময়ে এল পাকিস্তান শাসকমণ্ডলীর উপর এক নিদারুণ আঘাত। এক আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান, রাওয়ালপিণ্ডির এক জনসভায় ২রা অক্টোবর, ১৯৫১ সাল। খাজা নাজিমুদ্দিন হলেন পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রভাষার উপর বজায়কৃত এই নীরবতা শেষ পর্যন্ত ভঙ্গ হয় ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসে পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতার মাধ্যমে।
খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টন বক্তৃতা ও তার প্রতিক্রিয়া
২৭শে জানুয়ারি ১৯৫২ সাল। পূর্ব-বাংলার প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত পল্টন ময়দানের এক বিরাট জনসভায় ভাষণ দান করেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন। এই ভাষণদানকালে বাংলাভাষার দাবিকে তিনি প্রাদেশিকতা হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং কায়েদে আজমের ১৯৪৮ সালের ঢাকার রেসকোর্সের জনসভায় প্রদত্ত ভাষণের কিছু অংশ উদ্ধৃত করে বলেন যে, কায়েদে আজম উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘােষণা করেছিলেন এবং সেই অনুযায়ী উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। আরবি অক্ষরে বাংলা শিক্ষাদানের ক্ষেত্রেও খাজা নাজিমুদ্দিন সরকারি উদ্যোগের উল্লেখ করে বলেন যে, ইতােমধ্যেই সরকারি তত্ত্বাবধানের ২১ টি পরীক্ষামূলক কেন্দ্রে সাফল্যের সাথে আরবি অক্ষরে বাংলা শিক্ষাদান করা হয়েছে এবং এ ধরনের বহু শিক্ষা কেন্দ্র জনসাধারণ কর্তৃক খােলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতায় সারা পূর্ব-বাংলা দারুণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৯ শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি প্রতিবাদ সভার মাধ্যমে এই বিক্ষোভের সূচনা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রতিবাদমূলক পােস্টারিংও করা হয়। পূর্বপাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদও ঐদিন নাজিমুদ্দিনের বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। ৩০শে জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের প্রতীক ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভাশেষে মিছিল বের করা হয়। মিছিলে ছাত্ররা আওয়াজ তােলে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, আরবি অক্ষর আমরা সহ্য করবাে না, নাজিমুদ্দিন গদি ছাড়ো। মিছিল তৎকালীন পূর্ব-বাংলার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউস-এর সামনে দিয়ে এসে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ হয়। মিছিলের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকা শহরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ধর্মঘটের আহবান জানানাে হয়। যুবলীগের এক বৈঠকে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুধাবন করে তােয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ যুবলীগ নেতারা আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করতে শুরু করে। আওয়ামী মুসলিম লীগের ছাত্রফ্রন্ট পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ৩১শে জানুয়ারি বার লাইব্রেরিতে একটি সর্বদলীয় সভার আহবান করে। ঢাকার প্রায় সব রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের প্রতিনিধিদের এই সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের বক্তৃতার পর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য জন্য ঐ সভায় বিভিন্ন সংগঠনের ৪০ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গােলাম মাহবুব। সভায় গৃহীত প্রস্তাবগুলি ছিল –
——————-
* বদরুউদ্দীন উমর ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ তৃতীয় খণ্ড, পৃঃ ১৩৬
১. বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের এই সভা ১৯৪৮ সালে পূর্ব-পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণের সহিত স্বাক্ষরকৃত নিজের চুক্তি লঙ্ঘন করিয়া প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় যে বক্তৃতা প্রদান করিয়াছেন, তাহার বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও নিন্দা ব্যক্ত করিতেছে। সেই হিসেবে এই সভা খাজা নাজিমুদ্দিনকে তাহার অগণতান্ত্রিক ও অবাঞ্ছিত ঘােষণা প্রত্যাহার কবিবার জন্য দাবি জানাইতেছে। বাংলা ভাষাকে হত্যার আর একটি চক্রান্ত হিসাবে বাংলায় আরবি অক্ষর প্রচলনের জন্য এই সভা সরকারের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপন করিতেছে। ৩. ঢাকা শহরে ৪ঠা ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট করিবার যে সিদ্ধান্ত ঢাকার ছাত্ররা
গ্রহণ করিয়াছে, এই সভা তাহার প্রতি সমর্থন জানাইতেছে। ৪. এই সভা প্রস্তাব করিতেছে যে, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনসাধারণের ভাষা বাংলা হইবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। আর পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের জনসাধারণ যদি উর্দুকে তাহাদের সাধারণ ভাষা বলিয়া স্বীকার করেন তাহা হইলে উর্দুও অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হইবে। এই সভা অবিলম্বে নিরাপত্তা আইনে বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য আটক বন্দিদের মুক্তি এবং জননিরাপত্তা আইন প্রত্যাহারের দাবি জানাইতেছে।
…………………..
৪ঠা ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট ও মিছিল ৪ঠা ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটকে সাফল্যমণ্ডিত করার লক্ষ্যে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে সংগ্রাম কমিটির কর্মীরা সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করে। সেদিন বেলা ১১টায় সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী সমবেত হওয়ার পর সভার কাজ আরম্ভ হয়। কাউকেও কিছু বলবার সুযােগ না দিয়ে হঠাৎ এম, আর আখতার মুকুল সভাস্থলে রাখা একটা টেবিলের উপর লাফিয়ে উঠে সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন এবং তৎক্ষণাৎ কমরুদ্দিন আহমেদ প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। সভার পর হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিছিল করে রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই আরবি হরফে বাংলা চলবে না ইত্যাদি ধ্বনি সহকারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে পড়ে। দেড় থেকে দুই মাইল দীর্ঘ সে মিছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবন ও পূর্ববাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন হয়ে শহরের বিভিন্ন এলাকা প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসে। উল্লেখ্য যে ঢাকা শহরে এত বড় শােভাযাত্রা আর কখনাে হয়নি।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের সভায় এবং ঐ দিনই সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির একটি সভায় ২১ শে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব-পাকিস্তান ব্যাপি এক সাধারণ ধর্মঘট আহবান করা হয় । সর্বদলীয় কমিটির সভায় মওলানা ভাসানীসহ সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অনেক সদস্য ভাষার দাবি সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সংকল্প ঘােষণা করেন। ঐদিন ৪ঠা ফেব্রুয়ারি শুধু ঢাকাতেই নয়, পূর্ব-বাংলার সর্বত্রই ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও ময়মনসিংহের স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা। মিছিল বের করে এবং সভায় বক্তৃতার মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেবার দাবি। জানায়। ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারী ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটকে বানচাল করার উদ্দেশে পূর্ব-পাকিস্তান সরকার পূর্বভাগেই বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি নামমাত্র অজুহাতে একমাত্র বিরােধী সংবাদপত্র বাংলাদেশ অবজার্ভার-এর উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে তার প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। সে সময়ের একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে ১৮ই ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বদলি । ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রাক্কালে হায়দার নামে একজন প্রবীন অফিসার ছিলেন ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু পূর্বপাকিস্তান সরকারের প্রধান সচিব আজিজ আহমদ তাকে বদলি করে তার স্থানে কোরেশী নামে একজন তরুণ অফিসারকে ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়ােগ করেন। যতদূর জানা যায় স্বভাবের দিক দিয়ে কোরেশী ছিলেন অত্যন্ত বদরাগী । ২০শে ফেব্রুয়ারি বুধবার ঢাকার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কোরেশী সমগ্র ঢাকা শহরে পরবর্তী। ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারী করে এক নির্দেশ প্রদান করেন। এই নির্দেশে বলা বলা হয় : “যেহেতু এটা দেখা যাচ্ছে যে জনগণের একটি অংশ ঢাকা শহরে জনসভা, শােভাযাত্রা বিক্ষোভ মিছিল সংগঠিত করার চেষ্টা করছে এবং যেহেতু আমি এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি যে সেই ধরনের শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল জনসাধারণের জীবনে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করতে পারে তাই আমি এস, এইচ, কোরেশী সি, এস, পি, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, ঢাকা, সি, আর, পি, সি’র ১৪৪ ধারা অনুযায়ী কোতােয়ালী, সূত্রাপুর, লালবাগ, রমনা ও তেজগাঁও পুলিশ স্ট্রেশন নিয়ে গঠিত ঢাকা শহরের সমগ্র এলাকায় আমার লিখিত পূর্ব অনুমতি ব্যতিত ২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২ থেকে ৩০ দিনের জন্য। সেই ধরনের সকল জনসভা, শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘােষণা করছি।” ১৪৪ ধারা সম্পর্কিত উপরােক্ত প্রেস নােটটি ২১ শে ফেব্রুয়ারির সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও ২০ শে ফেব্রুয়ারি বিকেলেই পরদিন থেকে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারীর নির্দেশ সরকার কর্তৃক মাইক যােগে প্রচারিত হয়।
——————————–
* বদরুউদ্দীন উমর পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, তৃতীয় খণ্ড পৃ. ২২৪ ২৫৫
…………………………………
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির বৈঠক
ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারীকে কেন্দ্র করে ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে সন্ধ্যায় নবাবপুর রােডে অবস্থিত আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন আবুল হাশিম। (এখানে বলে রাখা প্রয়ােজন যে পরবর্তীকালের বিখ্যাত জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী পূর্বনির্ধারিত সফরসূচি অনুযায়ী ১৯ শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করায় এই সভায় উপস্থিত থাকতে পারেননি। জনাব আতাউর রহমান খান মামলা সংক্রান্ত ব্যাপারে ময়মনসিংহে থাকায় তিনিও উপস্থিত ছিলেন না। শেখ মুজিবুর রহমান তখনাে জেল থেকে ছাড়া পাননি।) সেদিনের ঐ গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে আবুল হাশিম (অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক), খয়রাত হােসেন এম, এল, এ, বেগম আনােয়ারা খাতুন এম, এল, এ শামসুল হক। (আওয়ামী মুসলিম লীগ), মােহাম্মদ তােয়াহা (যুবলীগ), অলি আহাদ (যুবলীগ) কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নওয়াজ খান (সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্রলীগ), মীর্জা গােলাম হাফিজ (সিভিল লিবার্টি কমিটি), মুজিবুল হক (সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ হল ছাত্র-সংসদ), শামসুল আলম (সহ-সভাপতি, ফজলুল হক হল ছাত্রসংসদ), আব্দুল মতিন (আহবায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ), সৈয়দ আব্দুর রহিম (সভাপতি, রিশা ইউনিয়ন,) শামসুল হক চৌধুরী (ভারপ্রাপ্ত সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ), আবদুল গফুর (সম্পাদক, সাপ্তাহিক সৈনিক), আবুল কাসেম (তমদুন মজলিস), শওকত আলী (পূর্ববঙ্গ কর্মী শিবির), গােলাম মওলা (সহ-সভাপতি, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ), ইব্রাহিম তাহা ও ইশতিয়াক আহমদ (ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ), নূরুল আলম (পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ) এবং আখতার উদ্দিন আহমদ (নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ)।
২০শে ফেব্রুয়ারির এই বৈঠকের আলােচনা একটি বিষয়ের উপরই কেন্দ্রীভূত ছিল। এবং সে বিষয়টি ছিল ১৪৪ ধারা জারীর প্রেক্ষিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ। এই করণীয় নির্ধারণে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করা হবে কি হবে না, এই প্রশ্নটিই মূল প্রশ্ন হিসেবে সবার সামনে উপস্থিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির অধিকাংশ সদস্য সবদিক বিবেচনা করে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার অভিমত প্রকাশ করেন। কিন্তু অলি আহাদ ও আব্দুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে জোরালাে বক্তব্য রাখেন। এ বিষয়ে অনেক তর্ক বিতর্কের পরও কোনাে প্রকার সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত এই বৈঠক অব্যাহত থাকে। অবশেষে শামসুল হক কমিটির বিবেচনার জন্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করা এবং পরদিন ২১ শে ফেব্রুয়ারি কর্মসূচি বাতিলের জন্য একটি প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবের বিপক্ষে অলি আহাদ ও আব্দুল মতিনের প্রবল আপত্তির মুখে প্রস্তাবটি বর্তমানের ডেপুটি কমিশনার কে লাে ম্যাজিস্ট্রেট বলা হত।
———————
* বদরুদ্দীন উমর-এর পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৫৩, ২৫৪ ও ২৫৫
ভােটে দেওয়া হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ৪ ভােট এবং পক্ষে ১১ ভােট প্রদান করা হয়। এখানে উল্লেখযােগ্য যে বৈঠকের প্রথমদিকে উপস্থিতির সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও রাত। গভীর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেকেই বৈঠক ত্যাগ করে যাওয়ার ফলে তােটাভুটির সময় উপস্থিত সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১৫ জন। তাই ভােট গ্রহণের পরও অলি আহাদ ঐ প্রস্তাবের বিরােধিতা করে সভা ত্যাগ করেন। বৈঠকের তৃতীয় প্রস্তাবানুযায়ী ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসভায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া ও ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব শামসুল হকের উপর অর্পণ করা হয়।
১৪৪ ধারা জারির প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া
১৪৪ ধারা জারীর ঘােষণা প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলােতে দারুণ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেলে ছাত্ররা সভা করে সরকারের এই ঘােষণার তীব্র সমালােচনা করতে থাকে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। কিন্তু সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম কমিটির সিদ্ধান্তের খবর ছাত্রাবাসগুলােতে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদের মধ্যে নতুন করে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। তারা কমিটির সিদ্ধান্তকে অগ্রাহ্য করে পরদিন অর্থাৎ ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার জন্য প্রত্যেকটি হলে ও হােস্টেলে প্রচারকার্য চালাতে থাকে। তাদের এই তৎপরতা ২০/২১শে’র রাতে সারারাতই অব্যাহত থাকে। মধ্যরাত্রিতে বিভিন্ন ছাত্রাবাসের নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্র গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান (শেলী), মােহাম্মদ সুলতান, জিলুর রহমান, আব্দুল মােমিন, এম, আর আখতার মুকুল, কমরুদ্দিন আহমদ, এস, এ, বারী, এ,টি, আনােয়ারুল হক খান প্রমুখ এক বৈঠকে মিলিত হন। পরিস্থিতির পুখানুপুখ পর্যালােচনা করে তারা সিদ্ধান্ত নেন যে পরদিন ২১শে ফেব্রুয়ারি সকালের ছাত্রসভায় গাজীউল হককেই সভাপতি করবার চেষ্টা করবেন এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে রায় দেবেন। ‘ এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এবং মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজেও গৃহীত হয়েছিল ।
২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রসমাবেশ ও ছাত্রসভা ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল, ৮ই ফাল্গুন ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ, রােজ বৃহস্পতিবার, পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ দিন; বলা যেতে পারে প্রদেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি চূড়ান্ত (Decisive) মাইল ফলক। সেদিন খুব ভাের থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। গাজীউল হক, মুহম্মদ সুলতান, এস, এ, বারী এ,টি, প্রমুখ ছাত্রনেতারা পুলিশ মােতায়েনের পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে দু’জন দুজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হওয়ার নির্দেশ পাঠাতে থাকেন। পূর্ব। নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৮টা থেকেই বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করতে শুরু করে। আমি তখন ঢাকা কলেজে প্রথম বর্ষ বিজ্ঞানের ছাত্র। সকাল ৭ ঘটিকায় কলেজে গিয়ে দেখতে পেলাম কলেজের গেইট বন্ধ, পুলিশ পাহারা দিচ্ছে এবং সারা কলেজ প্রাঙ্গণই পুলিশের দখলে। কলেজ প্রাঙ্গণে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে আমরা দু’জন দু’জন করে পায়ে হেঁটে ৮টার পূর্বেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌছে যাই। আনুমানিক সকাল ৯টার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের আমতলায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর সবাবেশ ঘটে। ছাত্রনের্তৃবৃন্দ বিক্ষিপ্তভাবে আলাপ আলােচনা চালিয়ে যেতে থাকেন। ওদিকে সকাল ৭টা থেকেই ঢাকার সিটি ডি, এস, পি, সিদ্দিক দেওয়ানের পরিচালনায় পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাস্তার উপর নিজেদের অবস্থান গ্রহণ করে। ঢাকার এস, পি ছিলেন মাহমুদ ইদ্রিস। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বেলা ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের সামনে পুলিশের অবস্থান আরাে জোরদার করেন। অনুরূপভাবে মেডিকেল কলেজ গেইট এবং সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সামনেও পুলিশের অবস্থান জোরদার করা হয়। পুলিশ ছিল লাঠি, কাঁদুনে গ্যাস ও বিভিন্ন অস্ত্রে সজ্জিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় বহু সংখ্যক ছাত্র জমায়েত হয়ে উত্তেজিতভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ও বিপক্ষে আলাপ আলােচনা চালাচ্ছিল। তন্মধ্যে গরিষ্ঠসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার পক্ষপাতি ছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রসভা শুরু হওয়ার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন, কয়েকজন অধ্যক্ষকে সাথে করে সেখানে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য উপদেশ দেন এবং এ ব্যাপারে তাদের প্রভাবও খাটাতে চেষ্টা করেন। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল আনুমানিক সহস্রাধিক। ছাত্ররা উপাচার্যকে তাদের সভায় সভাপতিত্ব করবার অনুরােধ জানায়। এর জবাবে উপাচার্য বলেন যে, ছাত্রেরা যদি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করে তাহলে তিনি তাদের সভায় সভাপতিত্ব করতে রাজী আছেন।
কিন্তু ছাত্ররা সেরকম কোনাে প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় তিনি সভায় সভাপতিত্ব করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেন। এর কিছুক্ষণ পরই সভার কাজ শুরু হয়। পুর্বরাতে ফজলুল হক হলে নেতৃবৃন্দের সভার সিদ্ধান্তানুযায়ী এম, আর আখতার মুকুল সভাপতি হিসেবে গাজীউল হকের নাম প্রস্তাব করেন এবং কমরুদ্দিন আহমদ প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। সভা শুরু হওয়ার পর একে একে কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নওয়াজ, শামসুল হক ও মােহাম্মদ তােয়াহা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য যুক্তি সহকারে বক্তব্য প্রদান করেন। অন্যদিকে আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীদের গরিষ্ঠ সংখ্যকই ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে সমর্থন দিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক সভার কাজ চলার পর সভাপতি গাজীউল হক ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার পক্ষে মত প্রকাশ করে বলেন যে এভাবেই তারা নূরুল আমিন সরকারের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে চান। সে সময় ছাত্রছাত্রীরা এমন উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে তারা ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে। সভায় সিদ্ধান্ত হয় : ১. আমরা সুশৃঙ্খলভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবাে ২, শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ১০ জন ছাত্র ছাত্রীর এক একটা দল একটার পর একটা বের হবে। ৩. ছাত্রীদের দল বের হবে সর্বাগ্রে ৪. যদি সরকার এদের গ্রেফতার করে তাহলে আমরাও দেখে নেব সরকারের কারাগারে কত জায়গা আছে। এখানে উল্লেখযােগ্য যে সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে যারা এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে ছিলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর তারা সবাই সাধারণ ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সিদ্ধান্তটি মেনে নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছাত্রীদের প্রথম ও দ্বিতীয় দল বের হতেই তাদের পুলিশের গাড়িতে তােলা হয়। এটা দেখে ছাত্রদের দল হুড়মুড় করে রাস্তায় বের হয়ে পড়লে পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত হয়ে পড়ে। আর তাই শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস-বােমা বিস্ফোরণ। উত্তরের বাতাসের অনুকূলে কাঁদুনে গ্যাসের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ। শুরু হয় বালতি ভরে পানি নিয়ে দৌড়াদৌড়ি, রুমাল ভেজাবার জন্য ছােটাছুটি, চোখে পানির ধারা দেওয়া ইত্যাদি। মুহূর্তের জন্য অনেকেই ভুলে গিয়েছিলাম রাস্তায় গিয়ে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করবার কথা। এক এক জনের চোখ ফুলে লাল হয়ে অবস্থা আশংকাজনক। তারপরেও ভেজা রুমাল মুখে চোখে দিয়ে গেইট থেকে বের হবার চেষ্টা চালানাে হয়, কিন্তু পুলিশের বেপরােয়া লাঠিচার্জের ফলে বের হওয়া আর সম্ভব হয়নি। এদিকে এক দুঃখজনক ঘটনা ঘটে যায়। গাজীউল হক আমতলায় দাড়িয়ে ছাত্রদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। এমনি সময় কাঁদুনে গ্যাসের একটি শেল তার শরীরে পড়ে বিস্ফোরণ ঘটে -যার জন্য তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন এবং তাঁকে শুশ্রুষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। এদিকে হট্টগােলের মাঝে পুলিশ ভ্যান থেকে ছাত্রীরা নেমে পড়ে এবং গেইটের ভেতরে এসে একে অপরের পরিচর্যায় লেগে যায়। পুলিশ কিছুক্ষণের মধ্যেই গেইটের জটলাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। উপায়ান্তর না দেখে ছাত্রছাত্রীরা সবাই মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝের ভগ্ন দেয়াল পার হয়ে মেডিকেল কলেজের গেইট দিয়ে বের হবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেখানেও পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাসের সম্মুখীন হয়ে পড়লে উত্তেজিত ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে শুরু করে পুলিশের সাথে ইট-পাটকেল যুদ্ধ। পুলিশও সমানে কাঁদুনে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে যাচ্ছিল যার জন্য সমস্ত এলাকা ধোয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইট-পাটকেল যুদ্ধের কোনাে এক মুহুর্তে পুলিশকেও ছাত্রদের দিকে ইট ছুঁড়তে দেখা যায়। এমন ঘটনা অবশ্য সম্পূর্ণ নতুন যা শুধু সেদিনই লক্ষ্য করা গেছে। এই ইট পাটকেল যুদ্ধের সময় ছাত্রদের মধ্যে কি ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল তা একটা ঘটনার উল্লেখ করলেই বােঝা যাবে। “হাসান হাফিজুর রহমান ও আজহারকে পাঠানাে হয়েছিল ইট-পাটকেল ছোড়া বন্ধ করবার চেষ্টা করতে। হাসান হাফিজুর রহমান ও আজহার গেলেন। কিন্তু পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছিল যে ইট ছুঁড়তে বারণ না করে তারা নিজেরাই ইটের বড় বড় টুকরা নিয়ে পুলিশের প্রতি খুঁড়তে থাকেন।” ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পর কর্মসূচি অনুযায়ী ছাত্রদের প্রাদেশিক পরিষদ ভবন ঘেরাও করার কথা ছিল। সেজন্য যেসব ছাত্র-ছাত্রী পুলিশের লাঠিচার্জ আর কাঁদুনে গ্যাসকে উপেক্ষা করেও রাস্তায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে একত্রিত হয়েছিল এক সময় তারাই দলে দলে পরিষদ ভবন অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিল। কিন্তু মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের গেটের সামনেই পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজের মধ্যকার ভগ্ন দেয়াল পার হয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রীর মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণে প্রবেশহেতু সেখানকার জমায়েতও বেশ বৃদ্ধি পায়। এর ফলে বেলা ১টার মধ্যে ছাত্রদের মূল সমাবেশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরে মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের প্রাঙ্গণেই অবস্থান করছিল। পুলিশের বিরুদ্ধে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করতে করতে এক সময় ছাত্ররা গেইট দিয়ে বের হবার উপক্রম করেছিল। এমনি সময়ে পুলিশ আবার ব্যাপকভাবে কাঁদুনে গ্যাস শেল নিক্ষেপ করে লাঠিচার্জ করতে করতে মেডিকেল কলেজ এলাকায় ঢুকে পড়ে। পুলিশ বেপরােয়াভাবে লাঠিচার্জ করার ফলে সেই মুহূর্তে বহু ছাত্র আহত হয়। কিন্তু চতুর্দিক থেকে ছাত্ররা পুলিশের প্রতি ব্যাপকভাবে ইট নিক্ষেপ করার ফলে তারা গেইটের বাইরে রাস্তায় ফিরে যেতে বাধ্য হয়। এদিকে পরিষদ অধিবেশন শুরু হওয়ার সময় যতই এগিয়ে আসছিল ছাত্রদের উত্তেজনা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হবারও চেষ্টা চালাচ্ছিল। কিন্তু পুলিশের কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ, লাঠিচার্জ ও প্রস্তর নিক্ষেপের ফলে ছাত্রদের কিছুতেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সে সময় অধিবেশনে যােগদানের জন্য পরিষদ ভবনে গমনকারী কিছু কিছু সদস্যকে ছাত্ররা মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের মধ্যে ডেকে এনে সরেজমিনে পুলিশের অত্যাচারের পরিধি দেখিয়ে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য তাদের প্রতিশ্রুতি আদায় করছিল। | ওদিকে ছাত্রদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষের খবর চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে অনেক লােকজন বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে উপস্থিত হয় এবং ছাত্রদের সাথে যােগাযােগ সৃষ্টি করে যার ফলে সংঘর্ষ ধীরে ধীরে সকল পর্যায়ের লােকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনতিবিলম্বে তা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে।
———————–
* পূর্ব-বাংলা ভাষা আন্দোলন ও তৎকালনি রাজনীতি ৩য় খণ্ড, পৃঃ ২৭৬
ছাত্র-জনতার উপর গুলিবর্ষণ
আমার যদুর মনে পড়ে সেদিন বেলা আনুমানিক ৩টার দিকে পুলিশের বিরুদ্ধে তুমুল ইট পাটকেল লড়াই করেও যখন গেইট থেকে বের হবার বিশেষ কোনও অগ্রগতি হচ্ছিল না, তখন নেতৃস্থানীয় বেশ কিছু ছাত্র ও আমরা অনেকেই মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের বারান্দায় ও চত্বরে ছােট ছােট দলে দাঁড়িয়ে পরবর্তী কর্মসূচি ইত্যাদি নিয়ে আলােচনায় রত ছিলাম। ঠিক এমন সময়ে একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবেই মনে হলাে অনতিদূরে অবস্থানরত মিলিটারি ক্যাম্পের দিক থেকে মেডিকেল কলেজের হােস্টেলে প্রাঙ্গণে ছাত্র সমাবেশের উপর শুরু হলাে রাইফেল ফায়ার । চক্ষের পলকে দেখতে পেলাম আমার অবস্থান থেকে ২গজ দূরত্বের ব্যবধানে একজন ছাত্র মাটিতে পড়ে গেল। তার মাথার খুলি বুলেটের আঘাতে উল্টে গেছে এমনভাবে যেন ছােট পানের কৌটার ঢাকনাটা কেউ উল্টিয়ে রেখেছে। মাথার মগজটা তার খুলে মাটিতে পড়ে গেছে এবং রক্তের বন্যায় মাথার চতুর্দিক ভেসে গেছে। ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতভম্ব। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে অবিলম্বে আমরা ৩/৪ জন তার মৃতদেহটা চেংদোলা করে উঠিয়ে মেডিকেল কলেজের অভ্যন্তরে দৌড়ে নিয়ে গেলাম। অন্য একজন তার মগজটা মাটি থেকে দু’হাতে (কোষ করে) উঠিয়ে নিয়ে এল। আমি অবশ্য এই (মৃত) ছাত্রটিকে চিনতাম না। পরে জানতে পেরেছি তার নাম রফিক। আমি ভেবেছিলাম বুঝি রফিকই। আন্দোলনের প্রথম বলি । কিন্তু আমরা মেডিকেল কলেজের করিডােরে মৃতদেহ নিয়ে পৌছুবার পর ওখানে দেখতে পেলাম আরাে একজনকে গুরুতর আহতাবস্থায় ইমারজেন্সিতে নেওয়া হয়েছে, তাঁর নাম বরকত। ইতােমধ্যে আরাে বেশ কিছু ছাত্র হতাহত হয়ে গেছে কাজেই বুঝবার উপায় ছিল না আন্দোলনের ঠিক প্রথম বলি সত্যিকারভাবে কে ? রফিকের মাথার মর্মান্তিক দৃশ্য সেদিন আমার মনকে দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। আমার মতো অনেকেই তখন কান্নাকে রােধ করতে পারেনি। আকস্মিক গুলিগােলা ও হতাহতের দরুণ ছাত্রদের মধ্যে হঠাৎ যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয় তজ্জন্য সাময়িকভাবে গৃহীত সকল কর্মসূচি বাতিল হয়ে যায়। ছাত্র-ছাত্রীরা হতাহতদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
গুলিবর্ষনের উপর সরকারি ভাষ্য
২১শে ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের উপর গুলিবর্ষণােত্তর সরকারি প্রেসনােট এবং এলিসকমিশন রিপাের্ট-এর ভাষ্য মােটামুটি এক ও অভিন্নই প্রতিয়মান হয়, যেহেতু এলিসকমিশন রিপাের্ট তৈরি হয়েছিল পুলিশ সাক্ষ্যর ভিত্তিতে। কাজেই গুলিবর্ষণের যৌক্তিকতা, ব্যাপকতা এবং হতাহতের সংখ্যার উপর এই প্রেসনােট এবং এলিসকমিশন রিপাের্টের বিশ্বাসযােগ্যতা মােটেই ছিল না। এই উভয় বক্তব্যে পুলিশ এবং সরকারি কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতির বর্ণনা এমনভাবে উপস্থাপনা করেছেন যাতে মনে হবে। শুলিবর্ষণ না করলে ছাত্র-জনতা পুলিশ ও ই, পি, আর বাহিনীকে পরাভূত (Overpower) করে ব্যাপকভাবে হত্যা করতে এবং পরিষদভবন অবরােধ করে মন্ত্রীদেরকেও আক্রমণ করতাে। কিন্তু সত্যিকারভাবে বলতে গেলে বাস্তব অবস্থা মােটেই তার কাছাকাছিও ছিল না। এটা সত্য যে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ইট-পাটকেল | ছোঁড়া, কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠিচার্জ একটানা ভাবেই চলছিল এবং মাঝে মাঝে ছাত্রজনতা পরিষদভবনে যাবার জন্য চাপও সৃষ্টি করছিল। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে সে সময় ছাত্ররা এত অধিক সংখ্যক ও এতখানি শক্তিশালী ছিল যে তারা পুলিশ ও ই, পি, আর বাহিনীকে পরাস্ত করে পরিষদভবন আক্রমণ করতে পারতাে।
এটা ঠিক, যে পুলিশ কত রাউন্ড গুলি ছুঁড়েছে এবং গুলি চালনা ও কাঁদুনে গ্যাসের ফলে কতজন নিহত হয়েছে এবং কতজন আহত হয়েছে তার উপর সরকারি ভাষ্যের | কোনও বিশ্বাসযােগ্যতা ছিল না। তবে ২২ শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদে প্রকাশিত তালিকানুসারে নিহতের সংখ্যা ছিল ৪ জন এবং আহতের সংখ্যা ১৭ জন। নিহতদের পরিচয় ছিল নিম্নরূপ :
১, আবুর বরকত – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ২. সালাহ উদ্দিন – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ৩, আবদুল জব্বার – বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ৪. রফিক উদ্দিন – বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র। এখানে উল্লেখযােগ্য যে সবর্দলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্ম পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী ২১শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশের সর্বত্রই সাফল্যজনকভাবে ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ।
গুলিবর্ষণের প্রতিক্রিয়া
২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি চালনার ফলে ছাত্র নিহত হওয়ার সংবাদে সারা প্রদেশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের দ্রুত পট পরিবর্তন হতে থাকে। প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বিরােধীদলীয় সদস্যগণ গুলির প্রতিবাদে অধিবেশন স্থগিত রাখার আহবান জানান। কিন্তু অধিবেশন স্থগিত না রাখায় বিরােধীদলীয় সদস্যগণ অধিবেশন বর্জন করেন এবং মেডিকেল কলেজে নিহত ও আহত ছাত্রদের দেখতে যান।
পুলিশ কর্তৃক ছাত্রদের উপর গুলি চালনার পরপরই নাজিমুদ্দিন রােডে অবস্থিত ঢাকা বেতারের শিল্পী ও কর্মচারীরা নিকটবর্তী রেস্টুরেন্টে সমবেত হয়ে গুলির প্রতিবাদে ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যার ফলে রেডিও পাকিস্তান ঢাকা কেন্দ্রের ঐ দিনের তৃতীয় অধিবেশনের সমস্ত প্রােগ্রাম বাতিল হয়ে যায়। ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত ৯টায় অলি আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবুল হাশিম, কমরুদ্দিন, শহীদউল্লাহ কায়সার প্রমুখ নের্তৃবৃন্দের সমন্বয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে গুলি চালনার ফলে যারা শহীদ হয়েছে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। শহীদ ছাত্রদের পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করা। হয় এবং শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের উদ্দেশ্যে ৪০ দিন পর্যন্ত কালােব্য ধারণের জন্য সকলকে অনুরােধ করা হয়। সভায় ২২ শে ফেব্রুয়ারি ভাের ৭টায় মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে গায়েবী জানাজা এবং তারপর জনসভা ও মিছিলের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি ও বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি সেই মুহূর্তে অকার্যকর হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সগ্রাম কমিটির সদস্য গােলাম মওলাকে আহ্বায়ক করে একটি নতুন সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। ২২শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ’ এর সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহেব ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের উপর পুলিশী জুলুম ও গুলি চালনার প্রতিবাদে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন। তার এই সমবেদনামূলক বীরােচিত কাজের জন্য শামসুদ্দিন সাহেব দেশের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। ২১শে ফেব্রুয়ারি গুলি বর্ষণের উপর মিথ্যা, উদ্দেশ্যপ্রণােদিত ও বিকৃত সংবাদ পরিবেশনের জন্য সরকার সমর্থক ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ এর বিরুদ্ধে জনগণ ভয়ঙ্কর বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং ২২শে ফেব্রুয়ারি সকালে মর্নিং নিউজ-এর প্রেস জনগণ ভস্মিভূত করে দেয়। ২২শে ফেব্রুয়ারি হাজার হাজার ছাত্র, শ্রমিক, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী এবং সর্বস্তরের জনগণ নিহতদের গায়েবী জানাজায় অংশ গ্রহণ করেন এবং তারপর বিরাট মিছিল করে ঢাকার উল্লেখযােগ্য স্থানগুলি প্রদক্ষিণ করেন। জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে পূর্ণ ধর্মঘট পালন করে এবং মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ঢাকায় সড়ক ও রেল ধর্মঘট, বাস-ট্রাক ও রিকশা ধর্মঘট করে এসব সংস্থার শ্রমিক ও কর্মচারীগণ এবং সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারীগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিছিলে অংশগ্রহণ করে ছাত্রদের সাথে ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারে একাত্মতা ঘােষণা করে। ঐ দিনও পুলিশ মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করে যার ফলে নবাবপুর রােডে এক বন্ধ দোকানের খােলা বারান্দায় দাঁড়ানাে এক কিশাের ছেলে প্রাণ হারায়। বংশাল রােডে সংবাদ অফিসের সামনে পুলিশের গুলিতে এক ব্যক্তি নিহত হয়। শহরে মিলিটারি নিয়ােগ করা হয় এবং তাদের গুলি বর্ষণের ফলেও অনেকেই হতাহত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র ও জনসাধারণের উপর পুলিশের গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ২২ শে ফেব্রুয়ারি যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সভায় পুলিশী নির্যাতনের নিন্দা করা হয় তন্মধ্যে
ঢাকা হাইকোর্ট বার এসােসিয়েশন ও ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভা উল্লেখযােগ্য। ২২ শে ফেব্রুয়ারি জুম্মার নামাজের পর মসজিদে মসজিদে শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় হাজার হাজার মুসল্লী অংশ্রগহণ করেন। ২২শে ও ২৩শে ফেব্রুয়ারি গ্রামের লােকেরাও মিছিল করে ঢাকায় এসে ছাত্রদের সাথে মিলিত হয়। ২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় গুলিবর্ষণ এবং হত্যার প্রতিবাদে ২২শে ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলার সর্বত্রই ব্যাপকভাবে বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতের মধ্যেই ছাত্ররা অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রথম শহীদের স্থান, মেডিকেল কলেজ হােস্টেলের ১২ নম্বর শেডের পাশে অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তােলেন এবং শহীদ সফিউর রহমানের পিতাকে এনে ২৪শে ফেব্রুয়ারি স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে এদেশেরই সন্তানদের দ্বারা গঠিত পুলিশ বাহিনী ২৬শে ফেব্রুয়ারি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়।
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সাল। পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপনা পরিষদের বৈঠকে এই প্রথম বারের মতাে এক প্রস্তাবে বলা হয়, “পূর্ববঙ্গ পরিষদ পাকিস্তান গণপরিষদের নিকট বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করিতেছে” এবং প্রস্তাবটি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে গৃহীত হয়। অবশেষে বহু বিলম্বে এবং বহু অবাঞ্ছিত ঘটনার পর প্রদেশের মন্ত্রীসভা ও ব্যবস্থাপনা পরিষদ সদস্যদের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হল। ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম বাধার অবসান ঘটে।
একুশােত্তর ভাষা আন্দোলনের ঘটনা প্রবাহ বায়ান্নর একুশের অব্যবহিত পরের ঘটনাগুলাে পর্যালােচনা করলে একথা পরিস্কারভাবেই বােঝা যায় যে একুশের বিয়ােগান্ত নাটকীয় অধ্যায় থেকে বাঙালি সেন্টিমেন্টকে দূরে সরিয়ে পরােক্ষভাবে ভাষা আন্দোলনের সমাপ্তি ঘটাবার উদ্দেশেই প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন ২৩শে ফেব্রুয়ারি প্রদেশের ব্যবস্থাপনা পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা করার সুপারিশ প্রস্তাব পাশ করিয়ে নেন। ঠিক তার পরদিনই তিনি ঘােষণা করেন যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে দমন করার ইচ্ছে সরকারের নেই, তবে সরকার শুধু ভাষা আন্দোলনের ছত্রছায়ায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের শায়েস্তা করার জন্যই সবরকম কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। আর এই অজুহাতেই সরকার শুরু করলেন ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরােয়ানা ও গ্রেফতার। ছাত্রনেতা, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ-তথা সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দকে চিহ্নিত করলেন সেই তথাকথিত ষড়যন্ত্রের এজেন্টরূপে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতৃস্থানীয় ছাত্র ও ভাষা আন্দোলনের কর্মীদের করলেন গ্রেফতার। কাজী গােলাম মাহবুব, খালেক নেওয়াজ খান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তােয়াহা, আব্দুল মতিন, নূরুল আলম, আজিজ আহমদ ও আব্দুল আওয়ালের বিরুদ্ধে বের করলেন গ্রেফতারী পরােয়ানা। গ্রেফতার করলেন হাশিম উদ্দিন আহমদ, মােয়াজ্জেম হােসেন, আব্দুল বারী, কাজী শামসুল হুদা, মুখলেসুর রহমান, শামসুল হক, খালেক নেওয়াজ, ফয়েজ আহমদ প্রমুখ বহু সংখ্যক ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও সরকারি কর্মচারীদের। শুধু তাই নয়; গ্রেফতার করলেন আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হােসেন, মনােরঞ্জন ধর ও গােবিন্দলাল ব্যানার্জির মতাে চার জন এম, এল, এ-কে যারা ২১শে ফেব্রুয়ারির ছাত্রহত্যাকে কেন্দ্র করে পূর্ব-পাকিস্তান পরিষদ থেকে ইস্তফা প্রদান করেন। গ্রেফতার করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনির চৌধুরী ও ড, বি, সি, চক্রবর্তীকে এবং জগন্নাথ কলেজের অধ্যাপক অজিত কুমার গুহকে। এভাবে দেশের সর্বত্র সরকার পুলিশী ত্রাসের সৃষ্টি করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করে দমিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তারা বুঝতে পারেননি যে, এ আন্দোলন শুধু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ২১শে ফেব্রুয়ারির গুলিগােলা ও ছাত্রহত্যাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন জনসাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে তা জনগণের আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছে। তাই দেখা যায় হাজার হাজার কর্মী ও নেতৃস্থানীয় সকলকে কারান্তরালে রেখেও আন্দোলনকে স্তব্ধ করা। যায়নি বরং যথাযােগ্য সম্মানের সাথেই সারাদেশে পালিত হয়েছে ১৯৫৩ ও ১৯৫৪ সালের শহীদ-দিবস (২১শে ফেব্রুয়ারি)।
মার্চ ১৯৫৪ সাল, পূর্ব-বাংলায় রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট দলের বিপরীতে মুসলিম লীগ দেশের বৃহত্তম শক্তিশালী রাজনৈতিক দল হিসেবে পূর্ববাংলা থেকে পুরােপুরি ভাবে উচ্ছেদ হয়ে যায়। সরকার গঠন করেন হক-ভাসানী-সহরাওয়ার্দী নের্তৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্ট দল। কিন্তু পূর্ব-বাংলায় মুসলিম লীগের এই রাজনৈতিক ভরাডুবি পশ্চিমা শাসক গােষ্ঠী হজম করতে পারেনি। পক্ষান্তরে, পূর্ব-পাকিস্তানে সম্পূর্ণভাবে বাঙালিদের দ্বারা গঠিত সরকারকেও তারা সহ্য করার মতাে সহনশীলতা প্রদর্শন করেনি। পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল গােলাম মােহাম্মদ ভারত শাসন আইনের ৯২ (ক) ধারার বিধান মতে গঠনের ২ মাসের মধ্যেই পূর্ব-বাংলার নির্বাচিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বাতিল করে গভর্ণরের শাসন কায়েম করেন ৩০শে মে, ১৯৫৪ সাল। ১লা জুন থেকে আবার নতুন করে অসংখ্য কর্মী ও নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হলেন গাজীউল হক বগুড়া থেকে এবং নিক্ষিপ্ত হলেন রাজশাহী জেলে। অবশ্য কদিন পরই স্থানান্তরিত হলেন ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে।
১৯৫৫ সাল। সরকার ভাষা আন্দোলনের সব তৎপরতা বন্ধ করার চেষ্টা অব্যাহত রাখে এবং ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসের অনুষ্ঠানকে ভেস্তে দেবার ব্যবস্থা পাকাপােক্ত করেন সংগ্রাম পরিষদের কর্মী ও নেতাদের গ্রেফতারের মাধ্যমে। কিন্তু সরকারের সবরকম প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাের হবার পূর্বেই ঢাকার সমস্ত ছাত্রাবাসের শীর্ষে উড্ডীন করা হয় কালাে পতাকা, বরকত-সালামের রক্তের প্রতিশােধের ইঙ্গিত বাহক প্রতীক আর তার সাথে আওয়াজ উঠলাে ; “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” “শহীদ দিবস অমর হােক”। পুলিশ ঘিরে ফেললাে সবগুলাে ছাত্রাবাস; চললাে ব্যাপক ধর-পাকড়। কিন্তু ছাত্রাবাসের ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হলাে সারা শহরে এবং দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। অত্যাচারের স্টিম রােলার চালিয়েও ৯২ (ক) ধারার শাসন সে ধ্বনিকে স্তব্ধ করতে পারেনি। হাজার হাজার ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেল হাজতে নির্বিচারে অত্যাচার করেছে; বন্ড দিয়ে বের হয়ে যাবার জন্য ছাত্র ও অভিভাবকদের উৎসাহিত করেছে, হুমকি দিয়েছে। কিন্তু সরকারের কোনও চেষ্টাই সফলকাম হয়নি। এ ব্যাপারে গাজীউল হকের স্মৃতিচারণ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিতে চাই। তিনি বলেছেন : ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমরা পুরানাে হাজতে। দেশে তখন এক স্বেচ্ছাচারী শাসন চলছে। কয়েক হাজার কর্মী জেলে আটক অথবা আত্মগােপন করে আছে। এমতাবস্থায় ২১শে ফেব্রুয়ারি যথাযথভাবে পালিত হবে কিনা স্বভাবতই মনে প্রশ্ন ছিল। কিন্তু আমাদের এ ধরনের সন্দেহকে অমূলক এবং ভ্রান্ত প্রমাণ করে দিয়ে ২০শে ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে সমস্ত ঢাকা শহর স্লোগানের পর স্লোগানে গর্জে উঠলাে। বাংলা ভাষার দাবিতে, রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবিতে সেদিন ঢাকার বুকে গণকষ্ঠের ঢল নেমেছিল। জেলখানার ভেতরে ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরাবার জন্য সরকার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। অভিভাবক ও আত্মীয়-স্বজনদের নিকট থেকে বন্ড নিয়ে তাদের ছেলে বা মেয়েদেরকে জেল থেকে বের করানাের জন্য সরকার বিশেষভাবে চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ৯২ (ক) ধারার শাসনে চূড়ান্তভাবে ফাটল ধরালো। পাকিস্তান সরকার পুরােপুরি বুঝতে পারলে ভাষা আন্দোলনকে আর ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। রাষ্ট্রভাষার দাবিকে স্বীকার করে নিতে হবে। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে তাদের আপােষ করতে হবে। আমি এই কথা স্পষ্টভাবেই বলতে চাই। যে, ১৯৫৫ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই ৯২ (ক) ধারার অবসান ঘটে। এ আন্দোলনের ফলেই আবার যুক্তফ্রন্টকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান জানানাে হয়। যদিও পাকিস্তান সরকার সে সময় যুক্তফ্রন্টের ঐক্যে ফাটল ধরিয়েছিল, তবু ক্ষমতা ১৯৫৪ সালে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতেই ছেড়ে দিতে হয় এবং কিছু দিন পরই প্রায় সব রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হয়। পাকিস্তান সরকারের মনে এ ধারণা দৃঢ়ভাবে জন্মেছিল যে ভাষার প্রশ্নে পূর্ব-পাকিস্তানের প্রতিটি লােকই আপােষহীন। সুতরাং তাদের সাথে বসতে হলে প্রাথমিক শর্ত হবে ভাষার দাবিকে স্বীকার করে নেওয়া। ফলে ১৯৫৬ সালে যে সংবিধান তৈরি হলাে সে সংবিধানে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হল। সফল হলাে শহীদের রক্ত দেওয়া, সফল হলাে বাংলা ভাষার সংগ্রাম।”
সূত্রঃ এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ – লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী