স্বাধীনতা আন্দোলনের গােড়াপত্তন
১৯৪৭ সনের স্বাধীনতার প্রেক্ষাপটে ১৯৪৬ সাল। আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের ছাত্রদের সাথে বহুদিন শােভাযাত্রা করে গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি আর স্লোগান দিয়েছি- ‘আল্লাহু আকবার” “লড়কে লেংগে পাকিস্তান।” এসব স্লোগানের অর্থ তখন বুঝবার মতাে জ্ঞান আমার যথেষ্ট হয়নি। বড়দের থেকে শুধু এটুকু বুঝে নিয়েছিলাম যে ইংরেজরা আমাদের দেশ শাসন করছে গত ২০০ বছর ধরে যা আমরা চাইনা এবং শােভাযাত্রা করে, স্লোগান দিয়ে আমরা তাদেরকে আমাদের স্বাধীনতা দেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করছি। ইংরেজরা ভারত ছেড়ে গেলেই আমরা স্বাধীন হব। তার সাথে পাকিস্তান’ নামে মুসলমানদের আলাদা আবাস ভূমির জন্য আমরা সংগ্রাম করছি। এলাকার গণ্যমান্যদের অন্যতম জনাব আব্দুল হাকিম চৌধুরী ছিলেন একাধারে আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও ইউনিয়ন বাের্ডের চেয়ারম্যান, অত্যন্ত দোর্দণ্ড প্রতাপের লােক। স্কুলে যেমন সব ছেলেরা তাকে ভয় করতাে তেমনি শিক্ষক, কর্মচারী। এবং ইউনিয়নের সদস্য ও এলাকার সব মান্যবরগণই তাঁকে সমীহ করতে। সবার উপরই তার যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ছাত্রদের দ্বারা এসব শােভাযাত্রা করে স্লোগান দেওয়াকে তিনি কোনােদিন বাধা দিয়েছেন বা এসবের বিরুদ্ধে আপত্তি করেছেন বলে আমার মনে পড়ছে না। এসবের প্রতি তার পরােক্ষ সমর্থন ছিল বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু কেন, তা বুঝবার বা বিশ্লেষণ করবার মতাে জ্ঞানবুদ্ধি আমার তখনাে হয়নি। এমন কি স্বাধীনতার মর্ম বা অর্থ আমার মনে তখনাে যথেষ্ট গভীরতা পায়নি। দিন বয়ে যায়। ১৬ই আগস্ট ১৯৪৬ সাল। খবর ছড়িয়ে পড়লাে যে কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে গেছে। সংখ্যাধিক্যের দাপটে হিন্দুরা মুসলমানদের রক্তে কলকাতা শহরে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়েছে এবং যারা পারছে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। খবর এসে গেল আমাদের গ্রামেও। চেয়ারম্যান সাহেবের দাপটে সেখানে যদিও শান্তির কোনও প্রকার ব্যাঘাত ঘটেনি, তবু দু’দিন পর দেখা গেল বহুদুর দক্ষিণে, ফরিদগঞ্জে ও নোয়াখালীর রামগঞ্জ এলাকাতে অগ্নিকাণ্ড হেতু বহু উর্ধে উথিত কালাে ধোঁয়ার কুণ্ডুলি।
সাথে গুজব শােনা গেল যে ইয়া বড় বড় ঝাকড়া ঝাকড়া চুলওয়ালা দৈত্যের মতাে লােক হিন্দুদের বাড়িঘর পােড়াতে পােড়াতে। উত্তরাভিমুখে ছুটে আসছে আর যাকে সামনে পাচ্ছে রামদা দিয়ে শরীর থেকে তার মাথা ছিন্ন করে ফেলছে। আমরা উৎকণ্ঠার সাথে শুধু দক্ষিণের দিকেই চেয়ে চেয়ে কালক্ষেপন করেছি। এদিকে খবর ছড়াবার সাথে সাথে দেখা গেল, এলাকার হিন্দু অধিবাসীরা সবাই বাড়ি-ঘর ছেড়ে চলে যাচ্ছে। শুনতে পেলাম তারা নাকি সবাই কলকাতা চলে যাবে। স্থানীয় চেয়ারম্যান সাহেবের প্রচেষ্টার ফলে আমাদের এলাকাতে কোনও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি, আর দক্ষিণের ঝাকড়া ঝাকড়া চুলওয়ালা দাঙ্গাকারীরাও আমাদের এলাকাতে প্রবেশ করেনি সত্য, কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের অতি সাবধানতা সত্ত্বেও দেখা গেল কিছু সংখ্যক সুযােগসন্ধানী লােক সুযােগের অপব্যবহার করে পলায়নপর হিন্দুদের মালামাল, টাকাপয়সা, শাড়ি, গয়না ও জমিজমা আত্মসাৎ করে রাতারাতি ধনী হয়ে গেছে। যে সমস্ত হিন্দু শিক্ষকদের কাছে আমি লেখাপড়া করেছি, প্রাণভয়ে তাদের দেশত্যাগের সময় কিছুমাত্র তাদের সাহায্য করতে পারিনি বলে আমার তরুণ মনে দারুণ ব্যথা পেয়েছি। ভারত ত্যাগের প্রাক্কালে ধর্মের ভিত্তিতে ভারতকে ভাগ করে দুই সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িক স্বাধীনতা দেবার ব্যবস্থা করে বৃটিশরাজ এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার যে বীজ বপন করে যায় তার অভিশাপ থেকে বৃহত্তর ভারতবাসী আজও রেহাই পায়নি। ১৪ই আগস্ট, ১৯৪৭ সাল। বহু সংগ্রাম ও প্রতীক্ষার পর সেদিন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান নামে একটি মুসলিম রাষ্ট্র আমরা পেয়েছি যার দ%