মওদুদী ও জামাতে ইসলামী ভারতের মুসলমানদের জন্য কী করেছিলো?
মওলানা মওদুদী ইসলামের ছদ্মাবরণে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, কংগ্রেস, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লীগ-এর নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে এতােসব বিষােদ্গার করেও যখন দেখলেন কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করছে না, তখন তিনি একটি নতুন পরিকল্পনা নিলেন। সম্ভবত বৃটিশভক্ত পদস্থ মুসলিম সরকারী কর্মচারীরাই তাঁকে পরিকল্পনাটি নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি একাধিকবার বলেছিলেন, “ইসলাম’ বা মুসলিম নাম দিয়ে নতুন কোনাে সংস্থা গঠন করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। কারণ মুসলমানরা। এমনিই সংঘবদ্ধ। পার্টি গঠন করার কয়েক বছর পূর্ব থেকে তিনি প্রচার করতে আরম্ভ করলেন, এদেশে সত্যিকার ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি সালেহ বা ন্যায়নিষ্ঠ দলের প্রয়ােজন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “একথা স্পষ্ট, কোনাে অমুসলিম মিষ্টার জিন্নার ১৪ কিংবা ২৪ দফায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। মুসলিম লীগ, আহরার পার্টি কিংবা জমিয়তে ওলামার প্রস্তাবাবলীতেও এমন কোনাে জিনিস নেই যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। কেউ যদি বিশ্বাস স্থাপন করে তবে একমাত্র ‘কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র উপরই করতে পারে। তবে শর্ত হলাে—একটি জামাত হতে হবে, যে এই কলেমার জন্য বাঁচতে ও মরতে প্রস্তুত। কিন্তু তা কোথায় ?” | মওলানা মওদুদী তাঁর সিয়াসী কাশমকাশ গ্রন্থে “একটি ন্যায়নিষ্ঠ জামাতের প্রয়ােজন” শীর্ষক প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বলেছেন, “এই কাজের (হুকুমতে ইলাহী প্রতিষ্ঠার) জন্য একটি প্রবল সমালােচনামুখর, ধ্বংসাত্মক ও সংগঠিত আন্দোলনের প্রয়ােজন যা একদিকে জ্ঞানগরিমার শক্তি দ্বারা পুরনাে সভ্যতার বুনিয়াদ উড়িয়ে দেবে এবং অনদিকে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যকে নিজের বিশেষ চিন্তাধারার বুনিয়াদের উপর নতুন করে গড়ে তুলবে। এমনভাবে করতে হবে, যাতে চিন্তাজগৎ পুরােপুরি প্রভাবান্বিত হয় এবং মানুষ এই
পদ্ধতিতে চিন্তাভাবনা করতে আরম্ভ করে।•••.”২ মওদুদী সাহেবের উপরােক্ত উদ্ধৃতি দু’টোও পবিত্র ইসলামের নামে স্ববিরােধিতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আগে তিনি বলতেন “ইসলাম’ বা ‘মুসলিম’ নাম দিয়ে নতুন কোন সংগঠন গড়ার প্রয়ােজন নেই। এমনিতেই মুসলমানরা সংঘবদ্ধ। আবার নিজেই বলে বসলেন, ও ফ্যাসি দল কখনাে এতাে শক্তি ও সফলতা অর্জন করতে পারতাে না, যদি তারা নিজেদের নীতির প্রতি অটল বিশ্বাস না রাখতে এবং নিজেদের নেতৃবৃন্দের কঠোর অনুগত না হতাে।” | জামাতে ইসলামী গঠনের পর মওলানা সমবেতদের সামনে ভাষণদান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমরা সত্যিকার এবং আসল ইসলাম নিয়ে যাত্রা করছি। পূর্ণ ইসলামই হলাে আমাদের আন্দোলন।••••প্রথমে রাসুলুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত যে জামাত ছিলাে আমরাও হুবহু সেই জীবনপদ্ধতিই গ্রহণ করেছি। ….”
জামাতে ইসলামীর নীতি ও উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী বলেছিলেন, “আমাদের নিকট খােদ ইসলামই আন্দোলন এবং সমগ্র বিশ্বমানবের জন্যই ইসলামের আহ্বান। সুতরাং কোনাে বিশেষ জাতি বা দেশের সাময়িক সমস্যাবলীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ নয়। বরং তা সমগ্র মানবতা ও বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত। ••••”3 | জামাতে ইসলামীর নীতি বিশ্লেষণী ভাষণ থেকে স্বভাবতই অনেকে ধারণা করেছিলাে যে, মওদুদীর উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরােধী ভূমিকার হয়তাে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু দেখা গেলাে তা নয়, বরং পূর্বের চাইতেও জোরেশােরে তিনি এ কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। | সিয়াসী কাশমকাশ তৃতীয় খণ্ডের একস্থানে তিনি বলেছেন, “মুসলমান হিসেবে এ বিষয়ের প্রতিও আমার কোনরূপ আকর্ষণ নেই যে, হিন্দুস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হােক। আমার নিকট প্রথম প্রশ্ন হলাে, আপনাদের পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদ খােদাই সার্বভৌমত্বের উপর হবে, না পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিধান মােতাবেক জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের উপর হবে। প্রথমটি হলে পাকিস্তানই হবে। দ্বিতীয়টি হলে তা হবে না—পাকিস্তান যেমনটি হবে দেশের অপর অংশ—যেখানে আপনাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অমুসলিমরা দেশ শাসন করবে। বরং খােদার দৃষ্টিতে ওটা (পাকিস্তান) হবে এর (বর্তমান ভারত) চাইতেও নাপাক বা অপবিত্র।•••• যদি জনসাধারণের মতের নিকট নত হতে হয়, তাহলে হিন্দুস্তান ও তার মাটির পুজারীরা জাহান্নামে যাক। এটা এক দেশ থাকুক কিংবা দশ হাজার খণ্ডে বিভক্ত হােক তাতে আমার কি লাভ ? • • • ‘৪ । মওলানা বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলনের বিরােধিতা প্রসঙ্গে অধিকাংশ সময় ধর্মীয় তাত্ত্বিক বিষয় জড়িয়ে ঘােলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করেছেন। এখানেও তিনি তাই করেছেন। পাকিস্তানকে ‘না-পাকিস্তান’ বলেছেন। তার সাথে খােদা আর জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে দিয়েছেন। তাতে করে তিনি সে সময় সাধারণ মানুষকে। বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। _ মওলানা মওদুদী জামাতে ইসলামীর মূলনীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাদের দৃষ্টি কোন বিশেষ জাতি বা দেশের সাময়িক সমস্যাবলীর প্রতি নিবন্ধ নয়। কারণ তাদের আন্দোলন ইসলামেরই আন্দোলন, আর সে সমগ্র বিশ্বমানবকেই আহবান জানায়। কিন্তু মওলানার দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিপাত করলে যেকোন লােকের নিকট এ সত্য মূর্ত হয়ে ওঠে যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ উক্তির বরখেলাপ করেছেন। হায়দরাবাদ জীবনে ইসলাম প্রচারের ধারা ছিলাে রাজতন্ত্র তথা নিজাম গােষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোটে আসার পর তাঁর ইসলাম প্রচার অভিযান ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামবিরােধী ও বৃটিশ স্বার্থরক্ষামূলক। তাঁর এ ভূমিকার অনেক উদ্ধৃতি পেছনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৪৭ সাল নাগাদ তিনি এভাবে পূর্ণোদ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে তাঁর বিশেষ ইসলামী দৃষ্টিতে কলমী জেহাদ চালিয়েছেন। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মওলানা উপমহাদেশের মুসলমানদের যে পথে পা বাড়াতে আল্লাহ ও রাসুলের নামে বারণ করেছিলেন তারা তা শােনেনি; মওলানার নিষিদ্ধ পথে অগ্রসর হয়েছে। আর তাতে করে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, যুগে যুগে বিভিন্ন উপনিবেশে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলােতে জামাতে ইসলামী ধরনের অনেক ‘আমিরিয়ত’কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তারা দেশে অর্থনৈতিক লুটতরাজ, বিভিন্ন দৈনন্দিন সমস্যা, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে কোন কথাই বলতাে । আদর্শ বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক ও প্রচারণা ছিলাে সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল ভূমিকা। কোন প্রতিষ্ঠানের এরূপ ভূমিকা স্বভাবতই ঔপনিবেশিক স্বার্থহানিকর নয়। এজন্য উপনিবেশবাদীরাও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সহানুভূতির চোখে দেখতাে। মওলানা মওদুদীও ইতিহাসের এই অধ্যায়টি থেকে পুরােপুরি অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করেছিলেন। আর তাই তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেছিলেন। এটা মওলানার অদূরদর্শিতাই বলুন আর অতিদূরদর্শিতাই বলুন তা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। তাঁর মত দু’চারজনের বিভিন্ন রূপ নিয়ে সহায়তা সত্ত্বেও ইংরেজকে এদেশ ছাড়তে হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর অমােঘ ধারা স্বীকার করে নিতে হয়েছে, উপমহাদেশবাসী স্বাধীনতা লাভ করেছে। যায় পাকিস্তান আন্দোলনে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামাতে ইসলামীর ভূমিকা কিরূপ ছিল, তা বিগত সংক্ষিপ্ত আলােচনার মাধ্যমে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। আজাদী-উত্তরকালে স্বভাবতই মওলানা তাঁর পাকিস্তান-বিরােধী ভূমিকার জন্য কঠোর সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছেন। এসব সমালােচনার যে উত্তর তিনি দিয়েছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর। তিনি যেসব জবাব দিয়েছেন তার দু’একটা আমরা এখানে উল্লেখ করছি। ” তিনি বলেছেন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ না করার। কারণ এ ছিল না যে, জামায়াত মুসলমানদের জন্যে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়নি। বরং এর তিনটি কারণ ছিল।•••• প্রথম কারণ হলাে, মুসলমানদের এমন একটি জামায়াত থাকা জরুরী ছিল যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে খােদা না-খাস্তা যদি মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়ে যেত তাহলে যেন সেই জামায়াত জাতিকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়।
এ কারণে এই সংরক্ষিত শক্তিকে (Reserve Force) সগ্রাম থেকে পৃথক রাখার প্রয়ােজন ছিল। দ্বিতীয় কারণ হলাে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও অবশ্য কয়েক কোটি মুসলমানকে বৃটিশ ভারতের সেই অংশে থাকতে হতাে যা পাকিস্তান পরিকল্পনার মাধ্যমে হিন্দুদের কর্তৃত্বাধীন চলে যাচ্ছিল। দেশ বিভাগের পর সেসব মুসলমানকে সাহায্য করার জন্য অবশ্যি মুসলিম লীগ কিছুই করতে পারতাে না। এ উদ্দেশ্যে অন্য একটি সুসংগঠিত দলকে প্রথম থেকে প্রস্তুত রাখার প্রয়ােজন ছিল এবং এ দলকে পাকিস্তান সগ্রাম থেকে পৃথক রাখারও প্রয়ােজন ছিল। যাতে করে হিন্দু ভারতে সে কাজ করতে সক্ষম হয়। তৃতীয় কারণ হলাে, পাকিস্তানের জন্যে যে দলটি (মুসলিম লীগ) কাজ করছিল, তার সমস্ত দৃষ্টি একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপরই নিবদ্ধ ছিল। নৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে দল ও জাতিকে শক্তিশালী করার জন্য তার পক্ষে কোনাে প্রচেষ্টা চালান সম্ভব হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল যে, এভাবে একটি দল সংগ্রাম করে যদি দেশ লাভ করে, তাহলে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা তাে দূরের কথা জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে শক্তিশালী ভিত্তিতে দাঁড় করাতেও সক্ষম হবে না। সেখানে ভীষণ নৈতিক ও আদর্শিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে এ প্রচেষ্টা চলাকালে মুসলমানদের মধ্যে একটি সুসংগঠিত দল গঠনের প্রয়ােজন ছিল, যা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ রাষ্ট্রকে নৈতিক ধ্বংস হতে রক্ষার এবং একে ইসলামের পথে পরিচালিত করার জন্যে কাজ করতে পারে। প্রশ্ন এই যে, এই দূরদর্শিতাপূর্ণ পরিকল্পনাকে কার্যকরী করা কি কোনাে গুনাহ ছিল?”৫
মওলানা মওদুদী উপরােক্ত জওয়াবের প্রথম কারণে বলেছেন, জামাতে ইসলামীকে তিনি সংরক্ষিত রেখেছিলেন, মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলে যাতে মুসলমানদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে পারেন। আচ্ছা ধরা যাক মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলাে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলমানদের বৃহত্তম দল দেশকে বিভক্ত করতে পারলাে না, স্বাধীনতা উত্তরকালে কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ক্ষুদে জামাতে ইসলামী কি দেশকে বিভাগ করতে পারতে? মওলানা মওদুদীর মত একজন লােক কি করে এ ধরনের মন্তব্য করলেন তা আমরা ভেবেই পাই না। তাছাড়া যে দল বা নেতার এরূপ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে, মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলে তিনি ও তাঁর দল মুসলিম লীগের স্থলবর্তী হয়ে মুসলমানদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবেন—এজন্য তিনি তাঁর দলকে সংরক্ষিত রেখেছেন। এরূপ সংরক্ষিত দল ও নেতা আর যাই করুন, মুসলিম লীগ ও তার দাবির বিরােধিতা করতে পারেন না। আপনারা পেছনে দেখে এসেছেন, মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল মুসলিম লীগ ও তার নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কিরূপ বিষােদ্গার করেছেন। গালিগালাজের ভদ্রোচিত এমন কোন শব্দ নেই যা তিনি ব্যবহার করেননি। মুসলিম লীগের দাবি পাকিস্তানকে ‘নাপাকিস্তান’, ‘লেংড়া পাকিস্তান’ আরাে কত কি বলা হয়েছে। এরপরও যদি বলা হয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে জামাতে ইসলামীকে সংরক্ষিত শক্তি হিসেবে রাখা হয়েছিলাে, তা হাস্যাস্পদ নয় কি ? IT জওয়াবের দ্বিতীয় কারণে তিনি বলেছেন, হিন্দু ভারতের মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য তিনি জামাতে ইসলামীকে পাকিস্তান সংগ্রাম থেকে পৃথক রেখেছিলেন। যদি তাই হয় তবে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল কি সে দায়িত্ব পালন করেছেন? পাক-ভারতের স্বাধীনতা ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই মওলানা তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে লাহােরে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
এই কী ছিলাে মওলানা ও তাঁর জামাতে ইসলামীর ভারতে মুসলমানদের সাহায্য করার নমুনা ? মওলানা মওদুদীর তৃতীয় কারণটি প্রথম দু’টোর চাইতেও অবাস্তব ও আপত্তিকর। “ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া’ মওলানার একটা চিরাচরিত অভ্যাস। এক্ষেত্রেও তিনি তাই করেছেন। যে সময় উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমান মুসুলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে সংগ্রাম করছিলাে, সে সময় মুসলিম লীগ নাকি জাতিকে নৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেনি। যার জন্য মুসলিম লীগ পাকিস্তানকে দৃঢ়ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে না। এজন্য মুসলিম লীগ অর্জিত পাকিস্তানকে নৈতিক ধ্বংস হতে রক্ষা করার সংকল্প নিয়ে তিনি ও তাঁর দল তৈরি হয়ে বসেছিলেন। মওলানার এ উক্তিকে কিছুক্ষণের জন্য মেনে নিলেও একথা একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন লােকও বলবে যে, তখন রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সগ্রামে মুসলমানদের সুসংহত করাই মুসলিম লীগের প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য ছিলাে। আর মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাই করেছেন। এদিকে সর্বশক্তি নিয়ােগ না করলে হয়তাে কংগ্রেসের সাথে | কুলিয়ে ওঠা যেতাে না। তাতে করে মুসলিম লীগ মারাত্মক ভুল করতাে। দ্বিতীয়ত, তাঁর উল্লিখিত মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ মুসলিম লীগ ও তার দাবি পাকিস্তান তথা ভারত বিভাগ সৎগ্রামই ছিলাে ধর্মভিত্তিক, দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম লীগ এক মুহুর্তের জন্যও এ দিকটির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেনি। | এমতাবস্থায় মওলানা মওদুদীর উপরােল্লিখিত উক্তি মুসলমানদের নৈতিক ও ধর্মীয় অনুভূতিতে কটাক্ষপাত বই কিছু নয়। কারণ সাধারণভাবে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধ বলতে যা বুঝায়, তা এদেশের মুসলমানদের মধ্যে তখনাে ছিলাে, এখনাে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ এই নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধের প্রতি কোনকালেই উপেক্ষা প্রদর্শন করেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরােধী জামাতীদের ভূমিকাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীকে সশস্ত্র সমর্থন জানিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়ার শাসনামলে তাঁর আনুকূল্যে স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মওদুদী সাহেবের পাকিস্তান-উত্তরকালীন ব্যাখ্যা-বিবৃতির অনুসরণে নিজেদের অতীত কলংক। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমানে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অভিনয় শুরু করেছে। সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদরদের নেতৃত্বদানকারী জামাতীরা গাঁয়ে মানে না আপনি মােড়ল সেজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মায়াকান্না করছে। যে দল এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করেছে যেসব বীর মুক্তিযােদ্ধা এদেশকে স্বাধীন করেছে উল্টো তাদেরকেই জামাতীরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের চেষ্টা করছে। যেমনটি করেছিলাে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে। সত্যি জামাতীদের কি চমৎকার অভিনয় !
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল