You dont have javascript enabled! Please enable it!

জিন্নার মৃত্যুর পরে খাজা নাজিমুদ্দিন গভর্ণর জেনারেল পদে প্রতিষ্ঠিত হলেও জিন্নার উত্তরাধিকারী বলে পরিচিত প্রধান মন্ত্রী লিয়াকৎ আলির প্রবল প্রতাপের মুখােমুখি নিজস্ব প্রভাবপ্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নি। প্রশাসন এবং সামরিক বিভাগের গুরুত্ব পূর্ণ পদগুলিতে পাঞ্জাবীদের আধিপত্য প্রদেশের নেতাদের উচ্চাকাঙক্ষা বাড়িয়ে দিল। শুধু উত্তরপশ্চিম ভারতের মুসলিম প্রধান অঞ্চলগুলি নিয়ে পাকিস্তান গঠিত হলে পাঞ্জাবীরা হত তার অবিসংবাদী কর্ণধার এবং সুবিধাভােগী। (১৬) কিন্তু বুদ্ধি, রাজনৈতিক চেতনা এবং হিন্দুদের সহয়তা গুণে এখন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হবার যােগ্যতা রাখে পূর্ববঙ্গীয়রা। তাই বাঙলার হিন্দুমুসলিম ঐক্য বিনষ্ট করতে তারা উর্দুকে চাপিয়ে দিতে উদ্যত বাঙলা ভাষার উপরে। পাঞ্জাবীদের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার এই দুরভিসন্ধি সংযত করার ক্ষমতা জিন্না এবং লিয়াকৎ আলির অবশ্যই ছিল। কিন্তু তাঁরা সে ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন নি। বরং পাঞ্জাবীরা ওঁদের সমর্থনই পেয়ে গেছে। (১৭) রাশব্রুক উইলিয়ামস জিন্নাকে যেভাবে পাকিস্তানের দুই অঙ্গের প্রতি সমভাবাপন্ন হিসাবে চিহ্নিত করেছেন তা অতিরঞ্জিত। ১৯৪৮ এর মার্চে ঢাকা পরিদর্শন কালে জিন্না যে বিক্ষোভের সম্মুখীন হন তার ফলেই চারজন পূর্ববঙ্গীয় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় স্থান পান। এরা হলেন তফাজ্জল আলি, ডঃ , এম, মালিক, মুহম্মদ আলি এবং খাজা নাসরুল্লা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত জিন্নাকে ছাত্ররা তিনটি ধ্বনি শুনিয়ে তাঁদের মনােভাব ব্যক্ত করেন। পাকিস্তানের ঐক্য, জিন্নার নেতৃত্ব এবং বাঙলাভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দান সম্পর্কে এই শ্লোগানগুলির কথা সেদিন জিন্নার পার্শে উপবিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ বাপ্রােভােস্ট অধ্যাপক পি, সি, চক্রবর্তী, বর্তমান লেখককে জানিয়ে ছিলেন। সমাবর্তন ভাষণে জিন্না কিন্তু ভারতীয় সংবাদপত্রাদি যেন এই পূর্ববঙ্গীয় ভাষা উত্তেজনার কারণ এমন কথা বললেন। জিন্না এই আন্দোলনের সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বস্ততাকে জড়িয়ে যেইঙ্গিত সেদিন তাঁর ভাষণে দিয়েছিলেন, অচিরাৎ তারই প্রতিফলন ঘটলাে পূর্ববঙ্গে নিযুক্ত পাঞ্জাবী আমলাদের বঙ্গভাষা সমর্থকদের উপরে পুলিশ এবং গুণ্ডা লেলিয়ে (p ৫) দেবার মধ্যে সমর্থকরা সভাসমিতিতে প্রচার করছিলেন বাঙ্গলাভাষার ন্যায্য অধিকারের কথা কারণ সময় পাঞ্জাবী আমলারা বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা জোর করে চাপিয়ে দেবার প্রথম পদক্ষেপটি গ্রহণ করে (১৮) . ১৯৫০ এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে সংখ্যালঘুরা বিপুল সংখ্যায় পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে যাবার পরেও ১৯৫১ আদমসুমারি অনুসারে বঙ্গভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল পাকিস্তানের জন সংখ্যার ৫৪. শতাংশ উর্দুভাষাভাষীর সংখ্যা ছিল নগণ্য মাত্র . শতাংশ পাকিস্তানবাসীর ভাষা উর্দুকেই পূর্ববঙ্গীয়দের উপরে চাপানাের চেষ্টা বাঙলা ভাষাকে বিশুদ্ধ ইসলামিক বলা যায় না হিন্দুরাও বাঙলা ভাষার জন্য আন্দোলনে নিরতএই দুটি অজুহাত অবশ্যই তুলে ধরা যেত বাঙলাভাষা সর্মথকদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে হিন্দুরা এই আন্দোলনে থাকার জন্য তাদের উপরে পাকিস্তানবিরােধিতার অভিযােগও করা কিন্তু কুৎসা সহ্য করেও পাকিস্তানের হিন্দু রাজনীতিকরা বাঙলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন ১৯৪৮ এর ২৫ শে ফেব্রুয়ারী ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য হিসাবে পরিষদেই দাবি করলেন, “উর্দুর সঙ্গে বাঙলাতেও আইনসভার কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করতে হবে প্রধান মন্ত্রী ক্রুদ্ধ জবাবে জানালেন, পাকিস্তানের মতাে মুসলিম রাষ্ট্রে উর্দুই হবে একমাত্র জাতীয়ভাষা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ভারতের চর ভেবে নিন্দা করা দূরের কথা, বাঙালী মুসলিমরা তাঁর উর্দুর আগ্রাসী ভূমিকার বিরােধিতায় মদত দিলেন গণপরিষদের বাঙালীমুসলিম সদস্যরা যে জিন্নালিয়াকতের প্রবল প্রভাব কাটিয়ে সর্বদা বাঙালীর হয়ে কিছু বলতে পারেন না একথা তখন তাঁদের বিশেষভাবে মনে এল (১৯) যেসময় জিন্না ছিলেন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, লিয়াকৎ এবং নাজিমুদ্দিন যথাক্রমে পাকিস্তানী প্রধান মন্ত্রী এবং পূর্ববঙ্গীয় মুখ্যমন্ত্রী তখনকার দিনের ছাত্রদের উদ্যোগে বাঙলাভাষার পক্ষে যেআন্দোলন চলতাে তাকে কী অবজ্ঞার চোখে শাসকচক্র দেখতাে তার একটি দৃষ্টান্ত আয়ুবসুহৃদ মােহাম্মদ আহমদের কথায় পরিষ্কার হয়ে যায় (২০) আহমদ বলেন, ‘পাকিস্তানের শত্রুদের উস্কানিতে পূর্ববঙ্গীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্ররা বাঙলা ভাষার জন্য রাজনীতির নামে ছেলেখেলা শুরু করেছে শ্লোগান, মিছিল নয়

তাে মন্ত্রীকে জোর করে বাঙলা ভাষার পক্ষে ভাষণ দান করানােএই সব চিত্তবিনােদনের নূতন বিকৃত পন্থাতেই তাদের শিক্ষায়তনে সময়ের বেশির ভাগ কেটে যায়। তবে অবস্থা আয়ত্তের বাহিরে চলে গেলে স্থানীয় দুর্গের মজুত সেনাবাহিনীর সাহায্য নিতেই হবে প্রশাসনকে। সময় পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়তে শুরু করলাে। জিন্নালিয়াকতের কঠোর নিয়ন্ত্রণে আনুগত্য দেখিয়ে মুসলিম লীগ, পাঞ্জাবী আমলাতন্ত্রের চক্রান্ত এবং দৌরাত্ম সবই মুখ বুজে সহ্য করেছিল

পূর্ববঙ্গের স্বার্থে সে সবের প্রতিবাদ পর্যন্ত করে নি। ১৯৫৪র প্রাদেশিক নির্বাচনে এর মূল্য দিতে গিয়ে নাকাল এই মুসলিম লীগ দল। ( গ্রন্থে সে আলােচনা পরবর্তী পর্যায়ে করা হবে। কোনাে কোনাে বিদেশী বিশেষজ্ঞ’- পাকিস্তানী শাসকচক্রের কথার প্রতিধ্বনি করে বাঙালা ভাষা ঘটিত প্রশ্নটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে চান নি। ক্যালার্ড এই শ্রেণীর একজন বিশেষজ্ঞ। তাঁর মতে ইসলামিক রাষ্ট্রের রূপ নির্ণয় এবং প্রয়ােগের সমস্যাটাই ছিল গণপরিষদের মূল বিবেচ্য। ভাষা আন্দোলনে তিনি ক্রুদ্ধ আবেগ ভিন্ন কিছু দেখেন নি, যদিও সে আবেগের তীব্রতা তাঁকেও স্বীকার করতে হয়েছিল। ইসলামিক রাষ্ট্রের প্রশ্নটির চেয়ে পূর্ববঙ্গীয়দের চোখে বাঙলাভাষার সরকারী স্বীকৃতির প্রশ্ন কোনক্রমেই কম জরুরী ছিল নাএটুকু ক্যালার্ড বুঝতে পারলেই ভালাে করতেন। (২১)

পাঞ্জাবী আমলারা ভাষা প্রশ্নে পূর্ববঙ্গীয় হিন্দুমুসলমান ঐক্যে সন্ত্রস্ত বােধ করে। ঐক্যে ফাটল ধরাতে ১৯৫০এর ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধায়। ইসলামিক রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে বাঙলা ভাষার সংস্কারের অজুহাতে হিন্দু আবেগে ঘা দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাষা আন্দোলনে ভাঙন ধরাতে উদ্যোগ গ্রহণ করে কেন্দ্রের বশংবদ পূর্ববঙ্গ সরকার। এই উদ্দেশ্যে সরকার নিয়ােজিত কমিটি এক প্রশ্নোত্তরিকায় পাকিস্তানকে সরাসরি ইসলামিক রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করে। মূল লক্ষ্য সনদে বা অবজেকটিভ রেজোলিউশনে কিন্তু এমনটি ছিল না। বেছে বেছে পাঞ্জাবী আমলা এবং কেন্দ্রের বশংবদ মুসলিম লীগের মতে মত দেবে এমন সব লােকের কাছে এই প্রশ্নোত্তরিকা উপস্থিত করা ল। আরবি লিপি, যথেচ্ছ আরবি, ফারসি এবং উর্দু শব্দ, আমদানি ইত্যাদি মাধ্যমে বাঙলা ভাষার প্রকৃতি ধ্বংস করার সঙ্গে সংখ্যালঘু স্বার্থরক্ষার ছুতােয় দুই ধর্মের মানুষের জন্য দুজাতের বাঙলা ভাষার আশ্বাস দিয়ে আসলে হিন্দু এবং মুসলমানের সাংস্কৃতিক সংহতি বিনাশেই ব্রতী কেন্দ্রের বশং বদ প্রাদেশিক সরকার। উর্বর কল্পনার বেগে জমিজায়গার মতাে ভাষারও এলাকাভাগ করতে উদ্যত বাঙলা ভাষা সংস্কার কমিটি। (২২) ‘আজাদসম্পাদক মৌলানা আক্রাম খান বাঙলা ভাষার প্রস্তাবিত সংস্কারের একজন উৎসাহী সমর্থক ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ সরােজেন্দ্র নাথ রায় আজাদ পত্রিকাথেকেই নানা উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন, ‘আনন্দবাজার’-পত্রিকার ভাষা থেকে ভাষা ভিন্ন নয়। ডঃ রায় তখনকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ মুয়াজিম হুসেইনের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখান, প্রকৃতই আরবি ভাষার এই পন্ডিতের রচনায় বাঙলাভাষার মধ্যে আরবি শব্দ জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নি। উভয় ভাষার মর্যাদাই হুসেইন এইভাবে রক্ষা করেছেন। ডঃ রায় আরাে বলেন, উর্দু অথাৎ আরবি লিপিতে বাঙলাভাষা চালু করার অর্থ হবে বাঙলাভাষার উপর পীড়ন তথা লুণ্ঠনের শামিল। (২৩) ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ পূর্ববঙ্গের অগ্রণী শিক্ষাব্রতী। ভাষাবিদ এবং ভাষাতাত্ত্বিকদের মধ্যেও তাঁর স্থান শীর্ষে। তিনি এই সময় ৮০ পৃষ্ঠার এক পুস্তিকা রচনা করেন। আমাদের সমস্যাবাআওয়ার প্রবলেম’ নামের এই পুস্তিকায় ভাষা সংস্কার এবং সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের সমাধানে তিনি যা লিখেছেন তার মধ্যে রাজনীতির উত্তপ্ত পক্ষপাতিত্ব নেই। তিনি বুঝিয়েছেন, বাঙলা ভাষার বিকাশ হিন্দুযুগে বা হিন্দুধর্মপ্রভাবে ঘটে নি। কারণ বৌদ্ধযুগে উদ্ভূত এই বাঙলাভাষাকে পরবর্তী হিন্দুরাজগণ (বৌদ্ধধর্মের প্রতি বিদ্বেষবশতঃ) আদৌ ভালাে চোখে দেখেন নি। এই ভাষার প্রাথমিক বিকাশ এবং উন্নতি ঘটেছে পাঠান রাজত্বে। মুসলিম ধর্মাবলম্বী এই পাঠান রাজগণ এই ভাষার পৃষ্ঠপােষকতা করতেন। অর্থাৎ হিন্দুরাজাদের বিরূপতা সত্ত্বেও পরবর্তী মুসলিম রাজশক্তির সহায়তায় যেভাষার বিকাশ ঘটেছে তাকে নিছক হিন্দুধর্মসংস্কৃতির প্রচার মাধ্যম বলা সম্পূর্ণ ভুল। তদুপরি বাঙলা ভাষা শুধু অধিকাংশ পাকিস্তানীর মাতৃভাষাই নয়, খুবই সমৃদ্ধ একটি ভাষা। বিপরীতক্রমে, উর্দু পাকিস্তানের কোনাে অঞ্চলের অধিবাসীর মাতৃভাষা নয়। তথাপি ইংরেজির উচ্ছেদ হলে উর্দুকে দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা করা যেতে পারে। বাঙলাকে অবশ্যই প্রথম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দিতে হবে। ধর্ম এবং ভাষার প্রশ্ন মিশিয়ে ফেলার কাজটি নিন্দনীয়। লিপি প্রসঙ্গে যে উর্দু হরফে বাঙলাভাষা প্রবর্তনের কথা চলছে, এটি হলে পূর্ববঙ্গের শিক্ষাদীক্ষার মূল উৎসমুখই শুকিয়ে যাবে। পূর্ববঙ্গের বিনাশ হবে এর ফলে। আদালতে এবং শিক্ষায়তনে বাঙলাভাষার স্থলে উর্দুর প্রচলন শুধু বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার পরিপন্থী হবে তা নয়। এই পরিবর্তনের ফলে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন তথা আত্মনিয়ন্ত্রণের মূলনীতিকেই খন্ডন করা হবে। (২৪)

বাঙলালিপিকে ব্রাহ্মী লিপি বলা মারাত্মক ভুল। ভারত, শ্যাম, যবদ্বীপের যাবতীয় লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। ব্রাহ্মী লিপি নাম দিয়ে বাঙলা লিপিকে হিন্দু ব্রাহ্মণদের ব্যাপার হিসাবে প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে এই ইচ্ছাকৃত প্রমাদের আশ্রয় গ্রহণ করেছিল পূর্ববঙ্গবিদ্বেষী শাসকচক্র। উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষার মতাে কৃত্রিম প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ক্যালার্ড বা রাশব্রুক উইলিয়ামসের মতাে যশস্বী লেখকরাও কিছু লেখেন নি। নিরপেক্ষ শিক্ষাসংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতার নিদর্শন তাে অন্যায় য়ে যাওয়া নয়। বরং একালের মনীষার সম্পর্কে এই সহিষ্ণুতা দেখে বিরূপ মন্তব্যের ইচ্ছা জাগে। বাঙালী এবং পশ্চিম পাকিস্তানীদের লিপির মিল যদি মনের মিল ঘটাতে পারে তা হলে লিপির মিল থাকা সত্ত্বেও জার্মানদের সঙ্গে ইংরাজ বা ফরাসির যুদ্ধ বাধে কেন প্রশ্ন তুললেন পূর্ববঙ্গের লেখককুল। পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের মধ্যে বিশিষ্ট অনেকে এমন কথাও বললেন, “আমরা উর্দু শিখতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু উর্দু লিপিতে বাঙলা পড়বাে না।পূর্ববঙ্গের লেখকসম্প্রদায় মনে করলেন, উর্দু লিপিতে বাঙলা প্রচলিত হলে ছয় শত বৎসর ব্যাপী বাঙলা ভাষার যাকিছু সমৃদ্ধি লাভ হয়েছে তার সবই মুছে যাবে। (২৫) ফের নতুন করে সব কিছু শুরু করতে হবে। পূর্ববঙ্গের ভবিষ্যৎ অগ্রগতিবাদি ফিউচার প্রগ্রেস অব ইস্ট বেঙ্গলনামের এক প্রবন্ধে ডঃ শহীদুল্লা অভিযােগ করেন, “উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা সংক্রান্ত রিপাের্ট সরকারী কমিটি পেশ করার পূর্বেই সরকার কর্মে অগ্রসর হয়েছে। প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহার করতে কেন্দ্রীয় সরকার বিপুল অর্থ মঞ্জুর করেছে। এর কী অর্থ ? টাই বা বই সদ্যশিক্ষাপ্রাপ্ত পড়তে পাবে যার ভাষা বাঙলা অথচ লিপি উর্দু ?’ (২৬) প্রাপ্তবয়স্কের শিক্ষায় উর্দু লিপিতে বাঙলাভাষা ব্যবহারের জন্য ১৯৪৯ সালে সরকার ২০ টি স্কুল খুলেছিল। ব্যাপারে ১৯৫০ সালে সরকারী ব্যয়বরাদ্দ দ্বিগুণ করা হয়। উর্দু লিপিতে বাঙলার সমর্থনে এই সময় যে প্রচারপত্র ছড়ানাে হয় তার মূলে যে সরকারী আনুকূল্য ছিল,সেই তথ্য ফাঁস করে দিয়েছিলঅগত্যা নামের এক বাঙলা পত্রিকা। (২৭)

এইরূপ একটি প্রচারপত্রে চট্টগ্রামবাসী কোনাে এক মৌলানা জুলফিকর আলির স্বপ্নাদেশ বর্ণিত হয়েছিল। প্রচারপত্র অনুসারে, পয়গম্বর স্বপ্নে মৌলানাকে আদেশ করেন উর্দু লিপিতে বাঙলা ভাষা চালু করতে। পাকিস্তানের জন্ম যেমন মুসলিমদের উপর হিন্দুদের রাজনৈতিক আধিপত্য খতম করেছে, উর্দু লিপিও তেমন হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য শেষ করবে। কোরান যখন মুসলিমকে পড়তেই হবে, আর বাঙলা হরফের দ্বারা যখন কোরাণের আরবি ভাষা লেখা অসম্ভব অতএব আরবি লিপি অবশ্য জ্ঞাতব্য। সুতরাং আরবি অথাৎ উর্দু লিপি সর্বত্র চলা সঙ্গত। বাঙলাভাষার লিপি হিসাবেও যুক্তিসঙ্গত হবে উর্দুর ব্যবহার। সব প্রচারপত্রে বাঙলা লিপিকে হিন্দুসংস্কৃতির আধিপত্যবাদ তথা পূর্বপশ্চিম পাকিস্তানের অনৈক্যের বীজ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ উর্দু লিপির কারসাজিতে পাঞ্জাবী শাসকচক্র চেয়েছিল পূর্ববঙ্গের সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং পূর্ববঙ্গের হিন্দুমুসলিম সংহতিদুয়েরই সর্বনাশ করতে। বাঙলার সাধারণ সংস্কৃতির নামের পৌত্তলিকতা উর্দুর হাতুড়ির ঘায়ে চূর্ণ করতে হবে। কারণ সাধারণ সংস্কৃতির ধুয়া তুলে তারা পাকিস্তানের মধ্যে শত্রশিবিরের আদর্শ ছড়াতে এবং পাকিস্তানের সংহতি ধ্বংস করতে চায়।‘(২৮) একটি প্রচারপত্রে এই মন্তব্যটুকু ছিল। এই সব প্ররােচনামূলক প্রচারপত্রের পরে বিদগ্ধ লেখক ডঃ শহীদুল্লার বক্তব্য নিশ্চয়ই ক্লান্তিহরণ করবে। তুর্কীতে কামাল আতাতুর্ক আরবি লিপির স্থলে রােম্যান। লিপি চালু করে যে সাফল্য পেয়েছিলেন এবং ইন্দোনেশিয়াতেও যে অনুরূপ পরিবর্তন সাধনে সুফল ফলেছে তার উল্লেখ করে বাঙলা লিপির স্থলে উর্দু অর্থাৎ আরবি লিপি আনার তিনি বিরােধিতা করেন। আহমদ শরিফ লেখেন যে, পারস্যের অনুসরণে ইসলামের শিক্ষা সফলভাবে প্রচার করতে হলে চাই বাঙালীর মাতৃভাষা বাঙলায় সেটি করা। (২৯)

সরকার পক্ষের এই সঙ্কীর্ণ স্বার্থপর এবং ক্রুর পরিকল্পনার ব্যাপারে একটাই আশার কথা যে, পরিকল্পনা কার্যকর হতে পারে নি। পূর্ববঙ্গের মুসলিমদেরই এক কৃতিত্বের কথা। কিন্তু হিন্দুমুসলিম ঐক্য ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়, এই কারণে পাৱাৰী প্রশাসকরা এটি ধ্বংস করার ফন্দি আঁটতে লাগলো। হিন্দুরা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও অংশ গ্রহণ করতাে। 

Reference:

  1. See, for instance, M.R.T., n. 9, pp. 96-97.
  2. CALLARD, n. 12, pp. 5, 184. BINDER, n. 15, pp. 119, 205. SAMAR GUHA, Swadhin Purva Bangla (in Bengali ; Calcutta, 1965), pp. 8-9. JYOTI SENGUPTA, Eclipse of East Pakistan (Renco, Calcutta, 1963), pp. 21, 22, 27.
  3. RUSHBROOK WILLIAMS, n. 12, pp. 38-39. SYMONDS, n. 12, p. 151. SENGUPTA, n. 17, pp. 30-31, 35. GUHA, n. 17, pp. 12-14.
  4. Census of Pakistan, 1951, Vol. 1, p. 71. Constituent Assembly of Pakistan, Debates, Vol. II, 25 February 1948, pp. 15, 17.
  5. AHMAD, n. 12, p. 8. Italics added.
  6. CALLARD, n. 12, pp. 94, 182. Ittefaq (Dacca), 14 August 1949 (Editorial). 22. Janamat, 23 August 1949, pp. 1-2. 23. lbid., 13 September 1949, pp. 5-6.
  7. MUHAMMAD SHAHIDULLAH, Amader Samasya (in Bengali: Renaissance Publications, Dacca, 1949).
  8. SAROJENDRANATH RAY, “Bengali Language in Arabic Script”, Janamat, 6 December 1949, pp. 5-6. Ibid., 13 December 1949, pp. 3-4. Also see ibid., p. 1.
  9. Ibid., 20 September 1949, p. 3. 27. Cited in Janamat, 19 September 1950, p. 9.
  10. For these and other excerpts, Ibid., pp. 9, 11.
  11. Ibid., 20 December 1949, p. 5. AHMAD SHARIF, “Bhashar Kotha”, (i.e., Thoughts on Language), in Hasan Hafizur Rahman (ed.), Ekushe February (i.e., Twenty-first February), Punthipatro Prokashoni, Dacca, 1965, pp. 73-74 ; in Bengali.

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!