পাকিস্তান আন্দোলন ও মওদুদী
১৯৩৬ সালে বৃটিশকে সরকার পরিচালনার বেশ কিছু ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। সেবার দেশের সব কয়টি প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস অধিকাংশ প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যে কয়টি প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়, সেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী,বিরােধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে। মুসলমানরা মুহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে সংহত হতে আরম্ভ করে। মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কিন্তু মওলানা মওদুদী কংগ্রেসের ঘাের বিরােধী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগে যােগদান করলেন না। মওলানা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক পার্টির বিরােধিতা করে যেতে লাগলেন। তিনি উভয় পার্টিকেই ইসলামবিরােধী,ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ইত্যাকার বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁর এসব বলার পেছনে একই নীতি কার্যকর ছিল। আর তা হলাে বিদেশী প্রভু ও তাদের এদেশীয় সমর্থকদের সন্তুষ্ট করা। নতুবা তখন অন্তত মুসলিম লীগের বিরােধিতার আর কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে! কারণ তিনি যদি সত্যি আন্তরিকভাবে উপমহাদেশীয় মুসলমানদের স্বাতন্ত্রে অনুপ্রাণিত হতেন, নিশ্চয় মুসলিম লীগে যােগদান করতেন। এমনকি তখনাে পর্যন্ত তিনি নিজেও কোন রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। এ সময় তিনি পরিষ্কার ঘােষণা করেন, “এই জাতি প্রথম থেকেই একটি জমিয়ত বা সংঘ। এ সংঘের ভিতর কোন পৃথক সংঘ পৃথক নামে গঠন করা, মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে। পরােক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ নিদর্শন কিংবা বিশেষ কোনাে নাম বা নীতি দ্বারা প্রভেদ সৃষ্টি করা এবং মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে দল-উপদলগত কোন্দল সৃষ্টি করা মূলত মুসলমানদের সুদৃঢ় করা নয়, এতে তাদের আরাে দুর্বল করে দেয়া।‘ – মওলানার উপরােক্ত মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সত্যি আমাদের হাসি পায়।
হাসি পায় এজন্য যে, পাকিস্তান আন্দোলনকারীদের বিরােধিতা করতে গিয়ে কি করে তিনি দিবালােকের মত স্পষ্ট ইতিহাসকে বিকৃত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। সে আমল তাে দূরের কথা, আজকের একজন স্কুলছাত্রও জানে, মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে উপমহাদেশীয় মুসলমানরা সুসংহত ছিলাে না। তারা ছিলাে শতধাবিচ্ছিন্ন। ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী চাকরি-বাকরি, শিক্ষা-দীক্ষা সব ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাে। বস্তুত মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে। সুসংহত হওয়ার পর থেকেই তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হচ্ছিলাে। অথচ মওলানা মওদুদী কিনা বললেন,উপমহাদেশীয় মুসলমানরা এমনিই সংঘবদ্ধ। নতুন নাম দিয়ে, মানে মুসলিম লীগ’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করার অর্থ মুসলমানদের দুর্বল করে। দেয়া। স্বয়ং মওলানার পরবর্তীকালের একটি উদ্ধৃতির প্রতি তাকালেই তাঁর পূর্বোল্লিখিত উদ্ধৃতিটির অবাস্তবতা প্রমাণ হয়। * মওলানা বলেছেন, “সারকথা, এই নামগড়া মুসলিম সমাজে অনুসন্ধান করলে রংবেরং-এর মুসলমান আপনার নজরে পড়বে। এতাে ধরনের মুসলমান দেখতে পাবেন। যা আপনি গুনে শেষ করতে পারবেন না। এটা একটা চিড়িয়াখানা— যাতে চিল, শকুন, তিতির, ভারই এবং আরাে অনেক প্রকার প্রাণী রয়েছে। এরা সবাই পাখী, কেননা এরা চিড়িয়াখানায় রয়েছে।” মওলানা তাঁর এই উদ্ধৃতিতে পরিষ্কার স্বীকার করেছেন, মুসলমানরা সে আমলে সংঘবদ্ধ ছিলাে না। মূলত তিনি যখন প্রথম বিবৃতিটি দেন তখন বেশ ভাল করেই জানতেন , মুসলমানদের মধ্যে একতা নেই। একমাত্র মুসলিম লীগের মাধ্যমেই তারা একটা সুসংহত জাতিতে পরিণত হতে চলেছে। তবু মুসলিম লীগের বিরােধিতার নেশায়ই তিনি সত্যের অপলাপ করেছিলেন। * ১৯৩৯ সালের দিকে মওলানা মওদুদী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালােচনা। করে লিখেছেন, “মুসলমান নিরেট অজ্ঞ হবে যদি এখনাে তারা পরিস্থিতির নাজুকতা যথাযথ উপলব্ধি করতে না পারে। তারা এখনাে এই ধোঁকায় পড়ে রয়েছে যে, বাহাড়ম্বর সভাসমিতি এবং ফাঁপা শশাভাযাত্রা তাদের জাতীয় ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে। তারা এমন। লােকদের নেতৃত্বে আস্থা জ্ঞাপন করছে যাদের সামনে মন্ত্রিত্ব এবং ঐশ্বর্য ছাড়া আর কোন জিনিস নেই। যারা জাতির জন্য এতটুকু ক্ষতি স্বীকার করতে পারবে না, যারা কেবলমাত্র মন্ত্রিসভায় নিজেদের দখল টিকিয়ে রাখার জন্য মুসলমানদের নাম উচ্চস্বরে নিচ্ছে তাদের ভীরুতা সম্পর্কে শক্রদের পুরােপুরি বিশ্বাস রয়েছে।….
সম্ভবত মওদুদী সাহেব এ সময় ধারণা করেছিলেন, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দ্বারা কিছুই হবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের হাতে জাতির তরী ডুববে বই ভাসবে না। এমনকি ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাব পাস হওয়ার ঘটনাও তাঁর মনে কোনরূপ রেখাপাত করেনি। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ যখন মুসলিম জাতীয়তা, মুসলিম তাহজীব-তমদ্দন, মুসলিম রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে আরম্ভ করলেন- মওলানা তখন এসব অনৈসলামিক বলে প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। তিনি কিনা যা বলেন সেটাই খাটি ও নিভের্জাল ইসলাম। অত্যন্ত জোরেশােরে তার খাটি ইসলামের দিকে তিনি মুসলমানদের আহবান করতে লাগলেন। খাঁটি আর ভেজাল ইসলামের প্রচারণায় তিনি এক চরম পর্যায়ে গিয়ে পোঁছেন। এই পরিস্থিতিটা মওলানার লেখা থেকে কিছুটা অনুমান করা যাবে।‘ তিনি তাঁর রাজনৈতিক পুস্তক ‘সিয়াসী কাশমকাশ’ তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, …আমার নিকট এই পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিক থেকে দেশীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাইতে কম নয়। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ লােকদের নেতৃত্বে ভারতের মুসলমানরা যদি একটি বিধর্মী জাতির মত নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে (যেমন তুর্কী ও ইরানীরা রেখেছে), তবে তাদের এরূপ জীবিত থাকা এবং কোনাে অমুসলিম জাতীয়তায় মিশে যাওয়াতে কী পার্থক্য আছে? হীরা যদি তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসে তবে হতভাগা পাথর হয়ে পড়ে থাকুক কিবা বিক্ষিপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যাক, জহুরীর তাতে কী আকর্ষণ থাকতে পারে ?” . সে আমলে এরূপ কঠোর ভাষায় তিনি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করেছেন। আর একস্থানেলিখেছেন, “….এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য আপনাদের ইসলামের নাম ব্যবহার করার অধিকার নেই। কেননা, ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শক্র। সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদই হােক কিংবা নামগড়া মুসলিম জাতীয়তাবাদই হােক।”
একথা বলাই বাহুল্য, সে সময়ে মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সগ্রামীদের বিরােধিতা করার অর্থ ছিলাে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করা। কারণ ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই ছিলাে মুসলিম লীগের ঈপ্সিত লক্ষ্য। বস্তুত সে আমলে যারা তাদের বিরােধিতা করেছেন তারাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মওলানা মওদুদীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তান দাবীর বিরােধিতায় তিনি তাঁর লেখনীর ব্যবহারে এতটুকু কসুর করেননি। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে ইসলামকে তিনি একটা প্রবল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিম লীগ ও তাঁর নেতৃবৃন্দকে তিনি ইসলামের শত্রু আখ্যায়িত কবেছেন। পাকিস্তানকে ‘খোঁড়া পাকিস্তান’, ‘না-পাকিস্তান‘ ইত্যাকার আরাে কত কি বলা হয়েছে! মুসলিম লীগ সম্পর্কে মওলানা বলেছেন, “কেবলমাত্র মুসলমান শব্দ দ্বারা প্রতারিত হয়ে যারা অজ্ঞতার পুজারীদের সংস্থাকে একটি সংস্থা মনে করে এবং একথা ভাবে যে, এ ধরনের কোনাে প্রতিষ্ঠান ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণকর হবে, তাদের স্থলবুদ্ধি শােকজ্ঞাপনযােগ্য।”8
….যে মসজিদের বুনিয়াদ ন্যায়নিষ্ঠার উপর নয়, কোরআন সেখানে দাঁড়ানাের অনুমতি দেয় না। এখানে তাে ন্যায়নিষ্ঠাকে মস্তিষ্কের বিকৃতি মনে করা হয়।”৫ এ ব্যাপারেও আমার কোনাে কিছু বলার নেই যে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলিম লীগের ‘মুসলমান নাম ধারণ নীতি এই জাতি যারা হিন্দুস্থানে বাস করে তাদের জন্য কল্যাণকর হবে, না ক্ষতিকর হবে। আমার নিকট যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে— এসময় যে জাতিকে মুসলমান নামে ডাকার দরুন পৃথিবীতে ইসলামের প্রতিনিধি মনে করা হয়,তার সবচাইতে বড় প্রতিষ্ঠান ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে কিরূপে পেশ করেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুসলিম লীগের প্রস্তাবের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমার অন্তর কাঁদতে আরম্ভ করে।”৬ গ মওলানা মওদুদী যে আমলে মুসলিম লীগ সম্পর্কে এসব উক্তি করেছিলেন তখন উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানই মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলাে। যেসব মুসলিম নেতা কংগ্রেস সমর্থক ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলার নেই; কারণ তাঁরা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। অবশ্য একথা সত্য যে, তাঁরা। উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী ছিলেন। এজন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। জেল খেটেছেন। কিন্তু তাঁরা মওলানা মওদুদীর মত ইসলামের ছদ্মাবরণে বিদেশী শক্তির স্বার্থরক্ষার ভূমিকা পালন করেননি— নানা ছলছুতার আশ্রয়ে মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেননি। সবচাইতে দুঃখের বিষয় হলাে, কোরআন নাকি তাঁকে এ সংস্থায়, যােগদান করতে অনুমতি দেয়নি। আর যাই বলুন, কোরআনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের । ক্ষেত্রে মওলানা মওদুদী উপমহাদেশে শীর্ষস্থানের অধিকারী ছিলেন, একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে মওলানা বলেছেন, “এই সংস্থায় যাদের প্রথম সারিতে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী জামাতে তাদের সঠিক স্থান সবচেয়ে পেছনের সারিতে। এমনকি কেউ কেউ তাে সেখানেও অনুগ্রহেই স্থান পেতে পারে। এ ধরনের লােকদের নেতা বানান রেলগাড়ির সবচেয়ে পেছনের বগিকে ইঞ্জিনের স্থানে লাগিয়ে দেয়ার সমতুল্য। যে উচু স্থানে আপনারা যাওয়ার ইচ্ছে করছেন, এ নামসর্বস্ব ইঞ্জিন আপনাদের গাড়িকে এক ইঞ্চিও নিয়ে যেতে পারবে না। অবশ্য গাড়ি তার আপন গতিতে নিচের দিকে চলে আসবে। আপনারা কিছুকাল পর্যন্ত এভুল ধারণায় পড়ে থাকবেন যে, মাশাআল্লাহ! আমাদের ‘ইঞ্জিন’ গাড়িকে খুব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তব যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পারবেন ততই মঙ্গল। কেননা প্রতিটি মুহূর্ত চলে যাচ্ছে। সে আপনাদের উপরের পরিবর্তে নিচের দিক। নিয়ে যাচ্ছে….।”৭
উপরােক্ত উদ্ধৃতিটি মওলানা মওদুদী মিঃ জিন্না ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর বিচারে এসব নেতা ইসলামী জামাতে স্থান পাওয়ারও যােগ্য নন। নেতৃত্বের আসন পাওয়া তাে অনেক দূরের কথা। এসব নেতার দ্বারা নাকি মুসলিম জাতি তাদের পতনকেই ডেকে আনবে। আশ্চর্যের বিষয়, দশ কোটি মুসলমানের মধ্যে মওলানা মওদুদী। ছাড়া সে আমলে আর কেউই এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা কেউই মওলানার এসব সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করেনি। তাতে তারা ধ্বংস হয়েছে, না কামিয়াব হয়েছে— এ প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসই মওলানাকে দিয়েছে। – মওলানা মওদুদী কেবলমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষিতদেরই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ইত্যাকার বলে গালিগালাজ করেননি। সে আমলে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সর্বজনমান্য পাকিস্তান দাবির সমর্থক আলেমরাও তাঁর এসব অশালীন সমালােচনা থেকে অব্যাহতি পাননি। তিনি একস্থানে বলেছেন, “পাশ্চাত্য ধরনের নেতাদের সম্পর্কে তাে তেমন আশ্চর্যবােধ হওয়ার নয়; কারণ বেচারাদের কোরআনের আলাে-বাতাসও লাগেনি, কিন্তু আশ্চর্য লাগে এবং হাজার বার লাগে সেসব আলেমের ব্যাপারে যাদের দিবারাতের কাজই হলাে আল্লাহ বলেছেন’ ও ‘রাসুল বলেছেন‘ (কোরআন-হাদিস) পড়ান। বুঝে আসে না তাদের কী হয়ে গেছে।” উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে মনে হয় মওলানা মওদুদী একথাই বলতে চেয়েছিলেন যে, পাশ্চাত্য ধরনের নেতৃবৃন্দ যাদের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান নেই, তারা না হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করলাে, তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেসব আলেম সব সময় কোরআন-হাদিস অধ্যাপনার কাজে নিয়ােজিত, তাঁদের এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। তাঁরা তাে জানেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কোরআন-হাদিস বিরােধী। জেনেশুনে কেন এসব আলেম, কোরআন-হাদিস বিরােধী একটা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন! তাঁদের এই অনৈসলামিক ভূমিকার কথা ভাবলে সত্যি তাঁর আশ্চর্যবোেধ হয়।
মওলানা কেবলমাত্র মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান দাবীর সমর্থক নেতৃবৃন্দ ও আলেমওলামার সমালােচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সাধারণ মুসলমানদেরও তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। তাদের মুসলমানিত্বের উপরও কটাক্ষপাত করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “একটি জাতির প্রতিটি ব্যক্তিকে শুধুমাত্র এজন্য যে তারা বংশগত মুসলমান, সত্যিকার অর্থে মুসলমান গণ্য করা এবং এরূপ আশা পােষণ করা, তাদের সমবেত প্রচেষ্টায় যে কাজই হবে তা ইসলামী নীতি মােতাবেক হবে—প্রথম এবং মৌলিক ভুল। এই বিরাট দল, যাদের মুসলিম জাতি বা সম্প্রদায় বলা হয়, তাদের অবস্থা এরূপ যে, প্রতি হাজারে নয় শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে জানে না। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিক ধ্যান-ধারণাও ইসলাম মােতাবেক পরিবর্তিত হয়নি।…..” এসব উদ্ধৃতি থেকে আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারেন, মওদুদী সাহেব পাকিস্তান দাবীর সমর্থকদের সম্পর্কে পবিত্র ইসলামের নামে কিরূপ জঘন্য মন্তব্য করেছেন। যে সুতাের টানে মওদুদী সাহেব কংগ্রেসের বিরােধিতা করেন, পাকিস্তান দাবির বিরােধিতার পেছনেও একই সুতাের টান কার্যকর ছিলাে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালে মওদুদী সাহেব তাঁর ইসলামী মুখােশ পরা এসব ব্যাখ্যা-বিবৃতি বেমালুম ভুলে যান। তিনি পরিষ্কার ঘােষণা করেন, আমি পাকিস্তানের বিরােধিতা করিনি, মুসলিম লীগের বিরােধিতা করেছি। বর্তমান বাংলাদেশেও মওদুদীর অনুসারীরা একই পথ ধরেছে। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে।
Source:
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল