মওদুদীর বৃটিশ প্রীতি
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলেও ১৯৩৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের অধিবাসীদের সম্মিলিত ভূমিকাই প্রবল ছিলাে। মওলানা মুহম্মদ আলী, শওকত আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ,এমনকি স্বয়ং মিঃ জিন্নাহও কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। এই সম্মিলিত আন্দোলনের সময় মওলানা মওদুদী উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। সত্য, কিন্তু তাঁর ভূমিকা ছিলাে অদ্ভুত ধরনের। তিনি মূল স্বাধীনতা আন্দোলনেরই ঘাের বিরােধী ছিলেন। এ সময়ও তিনি ইসলামের তথাকথিত ছদ্মাবরণেই বিরােধিতা করতেন। তিনি সম্মিলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা প্রসঙ্গে বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য জাতির মত আমাদের স্বাধীনতার অর্থও কি এই যে,বিজাতির শাসনমুক্ত হওয়া ? স্বজাতির শাসন কিংবা স্বদেশীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি আমাদের লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন ? ••• আমাদের সামনে তাে শুধু একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, আর তা হলাে আল্লাহর বান্দার আল্লাহকে ছাড়া আর কারাে অধীন না হওয়া। মানুষের সার্বভৌমত্বের অবসান হওয়া এবং আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে মওলানা মওদুদী যে স্বাধীনতার দাবীর বিরােধিতা করেছেন, একথা কারাে চোখ এড়াবার কথা নয়। এখানে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়, তিনি আল্লাহর হুকুমতের ছদ্মাবরণে উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকার সাফাই গেয়েছেন। ধীরে ধীরে তাঁর স্বাধীনতাসগ্রামবিরােধিতা আরাে স্পষ্টরূপ ধারণ করে। তিনি আরাে বলেন, “যে আজাদী জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য তার সমর্থনে সংগ্রাম করার কোনাে অর্থ নেই। আমি তাে একে ইংরেজের গােলামির চাইতেও ঘৃণ্য মনে করি। আমাদের নিকট (এই আজাদী সংগ্রামের) পতাকাবাহীরা মুসলমানদের জন্য সে পর্যায়ভুক্ত যে পর্যায়ের ছিলাে ক্লাইভ, ওয়েলেসলী। তাদের সমর্থক মুসলমানরা কোন অবস্থায়ই মীর জাফর মীর সাদেক থেকে ভিন্নতর নয়। যদিও অবস্থা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শক্রতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ধরনে এর মধ্যে কোনাে ফারাক নেই।”২উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে মওলানা সে যুগের আজাদী সংগ্রামকে বৃটিশের গােলামির চাইতেও ঘৃণ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। আজাদীর পতাকাবাহীদের তিনি ক্লাইভ, ওয়েলেসলী, মীর জাফর, মীর সাদেক প্রমুখের সমগােত্রীয় বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তিনি যে বিদেশী শক্তির দালালী করলেন এটা মীর জাফরী হলাে না। এইরূপে মওলানা মওদুদী বিশেষ ভঙ্গিতে উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরােধিতা করতে থাকেন। তাঁর এ প্রচারধারায় আর যাই হােক,অন্তত তিনটি মহল খুবই সন্তুষ্ট হতেন। এরা হলেন৷ ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার, বৃটিশ খয়েরখাহ ভারতীয় পদস্থ মুসলিম সরকারি কর্মচারী ও নওয়াব, জমিদার, স্যার—যারা ভারতে বৃটিশ প্রভুত্ব চিরস্থায়ী না হােক আরাে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন।
মওলানা মওদুদী স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, “আজাদীর পুরাে সংগ্রাম যদি কেবলমাত্র এজন্যই হয় যে,রাজতন্ত্রের খােদা সরিয়ে গণতন্ত্রের খােদা সরকারী প্রতিমা ঘরে বসান হবে তবে তাতে মুসলমানদের নিকট বিশেষ কোন পার্থক্য বােধ হবে। লাত’ গেলাে মানাত’ আসলাে। এক মিথ্যে খােদা আর এক মিথ্যে খােদার স্থান দখল করলাে। বাতিলের পূজা যেমন ছিলাে তেমনই রইলাে। কোন্ মুসলমান এটাকে আজাদী বলবে?”৩ সমগ্র বৃটিশ ভারত যখন আজাদী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে, তাদের জনাগত ও ন্যায়ত অধিকার আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাে তখন মওলানা মওদুদী আজাদীর বিরুদ্ধে তাঁর উল্লিখিত ‘বিশেষ ইসলামী দর্শন’ প্রকাশ করে বসলেন। তাঁর মতে জনগণ নির্বাচিত স্বাধীন সার্বভৌম সরকার আর বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের মধ্যে নাকি কোনাে পার্থক্য নেই। তিনি রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-পরাধীনতা, শশাষক-শােষিত ও ন্যায়অন্যায়কে একই কাঠগড়ায় নিয়ে দাঁড় করালেন। কী চমৎকার ইসলামী ব্যাখ্যা! সত্যিই কি ইসলাম তাই বলে ?
মওলানা অন্যত্র বলেছেন, .. ইসলামের এই মতবাদ অনুযায়ী ভাল সরকারের নিরিখ জাতীয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসম্পন্ন হওয়া নয় এবং খারাপ সরকারের নিরিখও বিদেশী কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারহীন হওয়া নয়। আসল প্রশ্ন হলাে, সরকারের ব্যবস্থাপনা ইনসাফ ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক কিনা••• 1 * বাহ্যত মওলানার উপরােক্ত মন্তব্য খুব একটা দোষণীয় নয়। কিন্তু যে সময় ও পরিবেশে এবং যে উদ্দেশ্যে তিনি উক্ত মন্তব্য করেছিলেন সেদিক থেকে এটা অত্যন্ত আপত্তিকর। সে সময় একটা বিদেশী শক্তি এদেশ শাসন ও শােষণ করতাে। পরাধীনতার শৃংখলমুক্ত হওয়ার জন্য সমগ্র উপমহাদেশে প্রবল আন্দোলন চলছিলাে। দু‘চারজন স্বার্থান্ধ ছাড়া হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মুক্তিপাগল নাগরিক এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। এ সংগ্রামের মূলনীতি ছিলাে, প্রতিটি জাতিরই নিজেদের দেশ পরিচালনার অধিকার রয়েছে। সুতরাং এদেশবাসীকেও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে। এরূপ পরিস্থিতিতে মওলানা বললেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে কোনাে সরকারের ভাল কিংবা মন্দ হওয়া জাতীয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসম্পন্ন হওয়া নয়। তাঁর এ উক্তি যে বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার সহায়ক ছিলাে। তা আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বৃটিশ প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বলেছেন, “ইসলামের দৃষ্টিতে ইংরেজ এবং ভারতবাসী উভয়েই মানুষ। সে উভয়কেই নিজের আহবানে সম্বােধন করছে। ইংরেজের সাথে ইসলামের এই জন্য দ্বন্দু নয় যে, সে এক দেশের বাসিন্দা হয়ে অন্য দেশ কেন শাসন করছে,বরং এই জন্য যে, সে খােদার সার্বভৌমত্ব এবং আইনকানুন কেন স্বীকার করছে না।” . এখানেও তিনি ইসলামের ছদ্মাবরণে ঘােলাপানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছেন। এদেশবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপেক্ষা করে বৃটিশপ্রীতির পরাকাষ্ঠা দেখাতে প্রয়াস পেয়েছেন। মওলানা মওদুদী আরাে বলেছেন, “যদি আপনার ইংরেজের সাথে শত্রুতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছ’হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে,আপনার দেশের বাসিন্দা নয়, তবে আপনার এ শক্রতা ইসলামী শত্রুতা নয়- অজ্ঞতাপ্রসূত শতা।” চিন্তা করুন, মওলানা মওদুদী সে আমলে ইংরেজ প্রীতিতে কিরূপ অন্ধ হয়ে । পড়েছিলেন। সেসময় তিনি এভাবেই নিরলসভাবেইংরেজের সমর্থনে লেখনী চালিয়েছেন। এ ধরনের অসংখ্য উদ্ধৃতি তাঁর সে আমলের রচনাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে পাওয়া যাবে। এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করা হলাে।
হায়দরাবাদের নিজামের সমর্থনে মওলানা মওদুদীর ইসলামকে ব্যবহার করার কিছুটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ নিজাম ছিলেন মুসলমান। হয়তাে মওলানা সাম্প্রদায়িক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিলাে তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এক্ষেত্রে একদিকে বৃটিশ স্বার্থ, অপরদিকে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন। ভারত স্বাধীন হলে মুসলমানরাও স্বাধীন হবে, একথাটা তখন একজন সাধারণ মানুষের নিকটও দুর্বোধ্য ছিলাে না। এমতাবস্থায় কেন মওলানা বৃটিশপ্রীতির এরূপ পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি ইসলামকেও পুরােপুরি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটা সত্যি ভাববার বিষয়। সম্ভবত মওলানা মওদুদী তাঁর প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শনকারী একশ্রেণীর পদস্থ মুসলিম সরকারী কর্মচারীর গুণভাজন হওয়ার জন্যই সে আমলে বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার সহায়ক এসব ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতেন। এছাড়া এর পেছনে আর কোন যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। কারণ উপমহাদেশের স্বাধীনতা যখন অত্যাসন্ন, তখনাে এক শ্রেণীর মুসলিম সরকারী অফিসার তাদের বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য বলে বেড়াতেন, মুসলমানদের স্বার্থেই এদেশে বৃটিশের আরাে কিছুদিন থাকা দরকার। কেননা বর্তমানে প্রশাসনযন্ত্রে মুসলমানরা তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করে চলছে। বৃটিশরা আরাে কিছুদিন এদেশে থাকলে মুসলমানরা নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যাবে। তাতে করে হিন্দুদের সাথে কুলিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। জানা গেছে, মওলানা মওদুদীর সে আমলে এসব অফিসারের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিলাে। | বস্তুত সাম্প্রদায়িকতা যাদের রাজনীতির ভিত্তি, তাদের পক্ষে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা সম্ভব নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী থাকে সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে সার্বজনীনতা থাকে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় গোঁড়া, সংকীর্ণ ও সাম্রাজ্যবাদনির্ভর।
কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, কি সাংস্কৃতিক—সবক্ষেত্রেই তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা থাকতে পছন্দ করে। তারা যে বিশেষ আদর্শে বিশ্বাসী বলে প্রচার করে, তার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শােষণের তেমন একটা বিরােধ বা বৈরিতা তারা খুঁজে পায় না। যেহেতু তাদের বিশ্বদৃষ্টি আচ্ছন্ন, সংকীর্ণ, গােষ্ঠী স্বার্থসিদ্ধিই তাদের উদ্দেশ্য, সেজন্য শেষ বিশ্লেষণে তারা সাম্রাজ্যবাদের দোসর হিসেবেই পরিগণিত। তথাকথিত আদর্শের মােড়কে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর স্বার্থকে তারা বিদেশী প্রভুর . কাছে বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। আর তাই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা মওদুদী ইসলামের মুখােশ পরে ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করতে দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেও মওলানা মওদুদী ও তার বাঙালি অনুসারী গােলাম আমরা একই অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি আজো বাংলাদেশে জামাতীদের সে ভূমিকার পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হওয়ার নয়।
১৯৩৭ সালের দিকে মওলানা মওদুদী হায়দরাবাদ থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে চলে আসেন। এখানে পাঠানকোটে মওলবী নিয়াজ আলী নামক জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এসডিও একটি ক্ষুদে মুসলিম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর নাম দেয়া হয়েছিলাে “দারুল ইসলাম”। পাঞ্জাবে আসার পর এই দারুল ইসলামেই মওলানা অবস্থান করেন। মওলানা কেন। হায়দরাবাদ ছেড়েছিলেন এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। সেখানকার শাসকগােষ্ঠীর সাথে তাঁর মতানৈক্য দেখা দিয়েছিলাে কিনা এরূপ কোনাে তথ্যও জানা যায়। অবশ্য পাঞ্জাবে আসার পর তাঁর মতাদর্শে মৌলিক কোন পরিবর্তন দেখা দেয়নি। হায়দরাবাদে তিনি ওপরওয়ালাদের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজতন্ত্র সমর্থন করেছেন। ইসলামের বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা রাজতন্ত্রের বৈধতা প্রমাণ করেছেন। বলেছেন, জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য মুসলমান হিসেবে আমি এ নীতিতে বিশ্বাসী নই।‘ পাঞ্জাবে তাঁর ‘ইসলাম প্রচারধারা’ (?) পূর্বের মতই ছিলাে। তবে লক্ষ্য ছিলাে ভিন্ন। এখানে তিনি বৃটিশ স্বার্থরক্ষায় ইসলামকে ব্যবহার করতেন। এ সম্পর্কে পূর্বে আলােচনা করা হয়েছে।‘ জানা যায়, তৎকালীন ভারত সরকারের মুসলিম পদস্থ সরকারী কর্মচারীরা মওলানাকে পাঠানকোটে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ আমন্ত্রণ রক্ষার্থেই নাকি তিনি এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এখান থেকেই ১৯৩৮ সালে পুনরায় তরজমানুল কোরআন’ বের করা শুরু করেন। মওলানা মওদুদীর এ সময়কার রচনাবলীর প্রতি তাকালে দেখা যায়, তিনি বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার্থে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় পার্টিরই বিরােধিতা করেছেন। মুসলিম লীগ সম্পর্কে পরে আলােচনা করা হবে। কংগ্রেসের উপর আক্রমণকালে তিনি মুসলিম জাতীয়তা ও মুসলমানদের স্বার্থগত দিকের আশ্রয় নিতেন।
কংগ্রেসের বিরােধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তাদের প্রথম আক্রমণ হল ইসলামী জাতীয়তার উপর। তারা মুসলমানদের বলে মূলত তােমরা কোনাে জাতিই নও। এটা শুধু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবঞ্চনা এবং গুটিকতক সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টের প্রচারণা বই কিছু নয়।”১ “…অনুরূপ এই আন্দোলন আমাদের জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর সাথে শরিক হওয়ার অর্থ আমাদের নিজেদের জাতীয়তা ও তাহজিব-তমদ্ন নিশ্চিহ্ন করায় অংশ গ্রহণ করা।” পণ্ডিত নেহরুর প্রতি আক্রমণ করে মওলানা বলেছেন, “পণ্ডিতজী একথা ভাল করেই জানেন, জ্ঞানী মুসলমান_যাদের ইসলাম সম্পর্কে জানাশােনা আছে, যাদের মধ্যে নিজস্ব জাতীয় অনুভূতি পুরােপুরি রয়েছে এবং যারা নিজেদের তাহজিবকে সবচাইতে মূল্যবান মনে করে তারা ইসলামী জাতীয়তা পরিত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের মিশিয়ে ফেলা কেয়ামত পর্যন্ত গ্রহণ করতে সম্মত হবে না। তাদের পক্ষে এরূপ করাসম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।” ‘মার্কসের শ্লোগান ছিলাে বিশ্বের সকল শ্রমিক এক হয়ে যাও। তাঁর শিক্ষা ছিলাে কম্যুনিজম মনােভাবাপন্ন লােক যেখানেই থাকুক না কেন, তারা সবাই একই দলভুক্ত। কম্যুনিস্ট হিসেবে পণ্ডিত নেহরুও এ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু তবু তিনি ইসলামী জাতীয়তার সমালােচনা করেন। অথচ ইসলামী জাতীয়তাও উপরােক্ত নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।”8 মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত উদ্ধৃতি দেখে অনেকের মনে এরূপ ধারণার উদয় হতে পারে। যে,তিনি বােধ হয় পাকিস্তান আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব উক্তি করেছেন। আসলে কিন্তু তা নয়। তাঁর এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মূল লক্ষ্য উপমহাদেশের মুসলিম স্বার্থরক্ষা ছিলাে । তিনি বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এসব যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। প্রতি কংগ্রেসের বিরােধিতা প্রসঙ্গে তিনি অন্যত্র বলেছেন, “মুসলমানদের পক্ষে দেশের এরূপ স্বাধীনতা সংগ্রাম করা হারাম যার পরিণামে ইউরােপীয় অমুসলিমদের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয় অমুসলিমদের নিকট হস্তান্তরিত হবে।
এভাবে তিনি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থে কংগ্রেসের বিরােধিতা করেছেন। অথচ এক সময়ে এই মওদুদী সাহেবই কংগ্রেসের একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। শুধু সমর্থকই নন,তিনি মুসলমানদের কংগ্রেসে যােগদানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। নিজে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। গান্ধীজির জীবনী লিখেছেন। মওদুদী সাহেব বলেছেন, “১৯১৯ সালে খেলাফত ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে আমি এ দুটো আন্দোলনের পক্ষে কাজ করি। সে সময় আমি গান্ধীজির জীবনচরিত লিখি। বইটি ছাপা হচ্ছিলাে। আমার এক বন্ধু পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দেয়। ছাপা অবস্থায় বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ••••জব্বলপুরের মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যােগদানে উৎসাহদানকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।”৬ আল-জমিয়ত‘ সংবাদপত্র ছিলাে জমিয়তে ওলামা হিন্দের মুখপত্র। উপমহাদেশের আলেমদের এই প্রতিষ্ঠান সে সময় কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন জানায়। মওদুদী সাহেব এই পত্রিকায় কাজ করার সময় কংগ্রেসের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানাতে থাকেন। তিনি সে সময় কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন দান প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এখন দেশের জন্য দুটো পথ রয়েছে। প্রথমটি হলাে, নিজেদের আবেগ-অনুভূতির বশবর্তী হয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা এবং যেদিক ইচ্ছে পা বাড়ানাে। দ্বিতীয়টি হলাে, কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে চলা। এক মুহূর্তের জন্যও অন্তরে এর বিরােধিতার মনােভাব পােষণ না করা। প্রথম। পথ অনুসরণের পরিণতি আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। দ্বিতীয় পথ যদিও আমাদের। আবেগ-অনুভূতি বিরােধী, তবু এটাই হচ্ছে ঐক্য ও সংহতির পথ। আর ঐক্য ও সংহতি সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে উত্তম। একতা সকল অবস্থায় বিভেদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের। দাবীদার। আর সংহতি সবদিক থেকেই বিচ্ছিন্নতা থেকে অগ্রগণ্য।”৭
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, পূর্বে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে মওদুদী সাহেব পবিত্র ইসলাম, মুসলিম জাতীয়তা, মুসলিম তাহজিব-তমদুন ও মুসলিম স্বাতন্ত্রের নামে কংগ্রেস ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কিরূপ নগ্ন সমালােচনা করেছেন। অথচ তার আগে তিনি যখন জমিয়তে ওলামা হিন্দের মুখপত্র ‘আল-জমিয়তে চাকরি করতেন তখন তিনি কংগ্রেসের প্রতি কিরূপ জোরালাে সমর্থন জানিয়েছেন। যে সংগঠনে যােগদান করা ইসলামের দৃষ্টিতে তখন হারাম ছিলাে না, যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্বের জন্য তখন ক্ষতিকর ছিলাে না, পরবর্তীকালে একই ব্যক্তির বিচারে কেন হারাম হলাে, ক্ষতিকর হলাে, তা সত্যি। ভাববার বিষয়। আসলে মওদুদী সাহেব উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের বিরােধিতা করেননি। বৃটিশ প্রভু ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্যই তিনি কংগ্রেসের বিরােধিতা করেন। কারণ সে আমলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ছাড়া ছােটখাট যেসব জাতীয়তাবাদী সংগঠন ছিলাে, তারা হয় কংগ্রেস নতুবা মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলাে। এছাড়া ছিলাে ‘অল ইণ্ডিয়া কমুনিষ্ট পার্টি‘। কিন্তু মওদুদী সাহেব এসবের কোনটারই সমর্থক ছিলেন না। এমনকি, তখন তাঁর নিজেরও কোন রাজনৈতিক দল ছিলাে না।
Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল